নবব্রত ঘোষাল

নিউটন – ৬

‘মার্ভেলাস টেলিস্কোপ অফ মিস্টার নিউটন’

১৬৬৭-র বসন্তের মাঝামাঝি কেমব্রিজে ফিরে এলেন উলসথর্পের বছর পঁচিশের সেই যুবক। যুবকটি কি বুঝতে পারছেন যে তিনি একজন বিরল প্রতিভার অধিকারি? প্লেগ মহামারির আগের নিউটনের কাছে নিজের ঐশ্বর্য অনাবিষ্কৃত থাকারই কথা। কিন্তু আঠার মাস গৃহবন্দী দশায় যে-সমস্ত অভিনব ভাবনার, ‘গ্রাউন্ড ব্রেকিং’  আবিষ্কারের ভিত্তি স্থাপনের কাজ সেরে কেমব্রিজে এবার এলেন, তারপর নিশ্চয়ই নিজের বৈজ্ঞানিক সত্ত্বার অস্তিত্ব টের পেয়েছেন তিনি।     

কেমব্রিজে ফিরে এসে প্রথমেই, ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর গাউন ও দু-জোড়া জুতো বানিয়ে নিলেন নিউটন এবং বেশ কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনলেন। ওই সময় তাঁর হিসাবের খাতা (Fitzwilliam Notebook) থেকে দেখা যায়, জমার ঘরে লেখা, আগের হিসাবের অবশিষ্ট ও মা হান্নার থেকে পাওয়া (১০ পাউন্ড) অর্থ মিলিয়ে সর্বমোট ১৪ পাউন্ড ১১ সিলিং ৪ পেন্স। খরচের তালিকায় রয়েছে, কেমব্রিজ আসার খরচ ৬ সিলিং ৬ পেন্স, দুজোড়া জুতোর জন্য ৮ সিলিং এবং যন্ত্রপাতির জন্য খরচ ১ পাউন্ড ১০ সিলিং।  

কোন কোন যন্ত্র কিনলেন? একটি লেদ মেশিন, ড্রিল, গ্রেভার্স (খোদাই করার যন্ত্র), হোন (শান দেবার পাথর), হাতুড়ি, চুম্বক, কম্পাস, আর তিনটি প্রিজম। এদের ঠাঁই হল তাঁর বাসার মধ্যেই। নিজেদের রুমটিকে প্রায় আস্ত একটি ল্যাবরেটরি বানিয়ে তুললেন নিউটন। এই সময় ইউনিভার্সিটিতে অনেকেই অনিয়মিত। নিউটনের সঙ্গে আর একজন যে শিক্ষার্থী থাকেন, সেই জন উইকিন্সও বেশীরভাগ সময় অনুপস্থিত। হয়তো-বা তাঁর রুমমেটের কাণ্ডকারখানা দেখে ইউনিভার্সিটিতে আসার আগ্রহ কিঞ্চিৎ হারিয়েছেন উইকিন্স! নিউটনের কিন্তু দম ফেলার ফুরসুত নেই। ভারী ব্যস্ত। আলোর প্রকৃতি অনুসন্ধানের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি তাঁর। প্রিজম নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষার  প্রয়োজন।                

এদিকে কেমব্রিজে ফিরে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন করে ফেলোশিপ অর্জনের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল। এই ফেলোশিপ না পেলে ট্রিনিটি কলেজে গবেষণা চালানো, অথবা ইউনিভার্সিটি থেকে এম-এ ডিগ্রি অর্জন, কোনওটাই সম্ভব হবে না। ফিরে যেতে হবে লিঙ্কনশায়ারের সেই অখ্যাত গ্রামে। উলসথর্পের ‘লর্ড অব ম্যানর্‌’ হয়েই খুশি থাকতে হবে তাঁকে।     

ফেলোশিপ নির্বাচন আবার শেষ তিন বছর হয়নি এবং ট্রিনিটির মাত্র ন-জন ছাত্রকে ফেলোশিপ দেওয়া হবে। একজন পূর্বতন সাব-সাইজার পক্ষে ফেলো নির্বাচিত হওয়া খুব সহজ কথা নয়। 

নিয়ম অনুযায়ী ট্রিনিটির আটজন সিনিয়র ফেলো ইন্টারভিউ নিয়ে থাকেন। কলেজ চ্যাপেলে টানা চারদিন ধরে চলে সেই বাছাই পর্ব। তারপর ঘণ্টা বাজিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় নির্বাচিত প্রার্থীদের নাম। ফল ঘোষণার দিন, যে ন-জনের নাম ডাকা হল, তার মধ্যে আইজাক নিউটনের নামও রয়েছে। মাইনর ফেলোশিপ পেতে নিউটনের অসুবিধা হল না। আটজন সিনিয়র ফেলোর একজন ছিলেন হাম্ফ্রি ব্যাবিংটন। যাঁর জন্য নিউটনের কেম্ব্রিজে আসা সম্ভব হয়েছে এবং যাঁর ‘সাইজার’ হিসাবে নিউটনের নাম নথিভুক্ত ইউনিভার্সিটির খাতায়, সম্ভবত সেই মিস্টার ব্যাবিংটনের ব্যবস্থাপনাতেই ফেলোশিপ পেলেন নিউটন। সে-সময় মাইনর ফেলোশিপ-এ থাকা-খাওয়া ছাড়াও, পোশাক পরিচ্ছদ ও বছরে দু-পাউন্ড নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা ছিল কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। ট্রিনিটিতে তাঁর জন্য ‘স্পিরিচুয়াল চেম্বার’ নির্ধারিত হল। কিন্তু নিউটন যে ঘরটিতে ছিলেন সেখানেই রুমমেট জন উইকিন্সের সঙ্গে রয়ে গেলেন। আলোর পরীক্ষায় তাঁর একজন সহযোগীর প্রয়োজন। রুমমেট উইকিন্সই তাঁর সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট।

এই সময় একটানা ডুবে রইলেন গবেষণায়। ইউনিভার্সিটি ছেড়ে বড় একটা বের হন  না আর। ১৬৬৭-র এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর এবং তারপর ১৬৬৮-র ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট, এই দু-পর্যায় কাটল আলোর গবেষণায়। মাঝে শুধু ১৬৬৭-র খ্রিস্টমাসের ছুটিতে উলস্‌থর্পে গেলেন একবার। হিসাবের খাতায় দেখা যায়, বোনের জন্য কমলালেবু কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন নিউটন সেবার। মাস দুয়েক গ্রামের বাড়িতে ভাইবোনদের সাথে কাটালেন। বড়দিনের ছুটি কাটিয়ে ফিরে এলেন কেমব্রিজে। 

প্রিজম নিয়ে আলোর ওপর কাজ এখন তাঁর সম্পূর্ণ হয়েছে। সাদা আলো বহু বর্ণের মিশ্রণ অর্থাৎ ‘হেটেরোজিনিয়াস’ চরিত্রের। এ-তাঁর পরীক্ষাসিদ্ধ নির্ভুল উপলব্ধি। বিশ্ব প্রকৃতির এক অলক্ষ্য সত্য ধরা দিয়েছে যুবকটিকে।   

এই সত্য উন্মোচনের পথেই দিনের আলোর মত স্পষ্ট হল, প্রচলিত টেলিস্কোপে বর্ণ ঘটিত ত্রুটি ঠিক কী কারণে হয়। দেকার্তে, হেভেলিয়াস, রেন – এঁদের মত বিজ্ঞানীরা শত চেষ্টা করেও এই সমস্যার মীমাংসা করতে পারেননি। অথচ, ট্রিনিটি কলেজের এক তরুণ গবেষকের স্থির বিশ্বাস তিনি এবার তা সমাধান করে ফেলবেন। যদিও,  দেকার্তের বাতলে দেওয়া রাস্তা ধরে কখনওই হাঁটবেন না তিনি।                         

১৬৭২-এ রয়্যাল-সোসাইটিকে লেখা চিঠিতে নিউটন লিখেছেন, ‘প্রিজম নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ওই সময় (১৬৬৬-৬৭), গোলীয় লেন্স ব্যতীত অন্যান্য জ্যামিতিক আকারের লেন্স, কাচ গ্রাইন্ড করে বানানোর কাজ শুরু করেছিলাম।’  

গোলীয় লেন্সই ছিল সে-সময় টেলিস্কোপের প্রাণভোমরা। কিন্তু অচিরেই গোলীয় লেন্সের দুটি বিশেষ অসুবিধার কথা জানা গেল। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এদের বলে, গোলাপেরণ (spherical aberration), আর বর্ণাপেরণ (chromatic aberration)। গ্রহ-উপগ্রহের প্রতিবিম্ব বা ‘ইমেজ’ গঠনে বিঘ্ন ঘটায় এরা। স্পষ্ট করে দেয় প্রতিবিম্বকে। নিউটন চেষ্টা করছিলেন পরাবৃত্তাকার (‘হাইপারবলিক’) প্রস্থচ্ছেদের লেন্স তৈরি করার। তিনি শুনেছেন, গোলীয় লেন্স-এর বদলে যদি ‘হাইপারবলিক-লেন্স’ ব্যবহার করা সম্ভব হয় তাহলে টেলিস্কোপের সমস্ত ত্রুটি দূর হয়ে তা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। দেকার্তের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লা ডায়পট্রিক’ থেকে পেয়েছেন এই ধারণা। কেবল নিউটন নন, ‘হাইপারবলিক-লেন্স’ কীভাবে তৈরি করা যায় তা নিয়ে সেই সময়কার তাবড়-তাবড় বিজ্ঞানীরা উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। 

এই বিশেষ জ্যামিতিক আকারের লেন্স-এর খোঁজ (‘হাইপারবলিক কোয়েস্ট’) শুরু নিউটনের জন্মেরও আগে। ১৬২৯ নাগাদ। ওই সময় প্যারিস নিবাসী ফেরিয়ার নামের এক যন্ত্র প্রস্তুতকারককে একখানি দীর্ঘ পত্র লেখেন রণে দেকার্তে। সেই পত্র মারফত দেকার্তে, একেবারে নতুন ধরনের এক যন্ত্র তৈরির বরাত দিলেন ফেরিয়ারকে। যন্ত্রটি ঠিক কীভাবে প্রস্তুত করতে হবে এক ডজন চিত্রসহ তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণও বাতলে দিলেন। সেই সঙ্গে আরও দুটো কথা জুড়লেন। যন্ত্র বানানোর কাজটি ফেরিয়ার যেন অত্যন্ত গোপনে সারে। কারণ, যন্ত্রটি যদি নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারে সে, তাহলে তা হবে এক মস্ত-বড় আবিষ্কার। এনে দেবে অঢেল খ্যাতি ও অর্থ – দুটোই। কাজটি তবে রীতিমত দুরূহ। তাই বিশেষ যত্ন ও অনেকটা সময় দেওয়া প্রয়োজন।   

কী সেই আশ্চর্য যন্ত্র যা নিয়ে দেকার্তে এত রোমাঞ্চিত? ঈপ্সিত যন্ত্রটি হবে স্বয়ংক্রিয় এবং এটি কাচ-গ্রাইন্ড করে নিখুঁত ‘হাইপারবলিক-লেন্স’ তৈরি করতে সক্ষম। তাঁর বিশ্বাস এই ‘হাইপারবলিক-লেন্স’ টেলিস্কোপের দক্ষতা আমূল বদলে দেবে।

পত্রটি দেকার্তে শেষ করছেন এই বলে – ‘তোমার হাতে যদি ভালরকম সময় না-থাকে, তাহলে তুমি এই প্রজেক্টে হাত দিও না। আর যদি টানা এক-দুবছর সময় নিয়ে নামতে পারো, তাহলে জেনো, তোমার এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ আমরা অচিরেই দেখতে পাব চাঁদে সত্যিই কোনো প্রাণী বাস করে কিনা।’ 

প্রায় বছর পনের ধরে নিরলস চেষ্টা চালান দেকার্তে, যাতে তাঁর সাধের যন্ত্রটি বানানো সম্ভব হয়। সেজন্য তিনি, ফেরিয়ার ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন দক্ষ কারিগরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁর যন্ত্রের নকশা পাঠিয়ে। কিন্তু যন্ত্রটি বানাতে কেউই সফল হলেন না। শেষে নিজেও অনেক চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হলেন, তখন দেকার্তে, ১৬৩৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লা ডায়পট্রিক’-এ চ্যালেঞ্জ জানালেন – এই বিশেষ যন্ত্রটি যিনি তৈরি করতে পারবেন, তিনি একালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী ও সেরা কারিগর বলে বিবেচিত হবেন (‘the most curious and the most skilled of our generation’)। 

সতের শতকের প্রায় পুরো সময় জুড়ে ‘হাইপারবলিক-লেন্স’-এর খোঁজে বিজ্ঞানীরা মেতে গেলেন। জার্মানির বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস হেভেলিয়াস ছিলেন সেই দলে। ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ জ্যোতির্পদার্থবিদ ক্রিস্টোফার রেন*। তিনি ‘হাইপারবলিক-লেন্স’ বানানোর একটি যন্ত্রের ডিজাইন রয়্যাল সোয়াইটিকে উপহার দেন। কিন্তু এটিও বাস্তবায়িত হয়নি। রেনের প্রস্তাবিত যন্ত্র শেষপর্যন্ত একটি জ্যামিতিক চিত্র রূপেই ফিলজফিক্যাল ট্রানজাকশন-এর পাতায় রয়ে যায়। ডাচ জ্যোতির্পদার্থবিদ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনসও দেকার্তের ঈপ্সিত যন্ত্রটির নাগাল পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। 

হাইপারবলিক-লেন্স বানানোর প্রতিযোগিতা যে চূড়ান্ত ‘হাইপে’ পৌঁছেছিল তার খানিক অবসান হল নিউটনের প্রিজমের পরীক্ষার পর। যদিও তার আগে কাচ-গ্রাইন্ড করে ‘হাইপারবলিক-লেন্স’ বানানোর কাজে নিউটন নিজেও কিছুদিন ব্যপৃত ছিলেন এবং দেকার্তের অনুরূপ একটি যন্ত্রের নকশা এঁকেছিলেন। গ্রান্থামের সেই মডেল প্রস্তুতকারকের কাছে এই চ্যালেঞ্জটি যে যথেষ্ট লোভনীয় ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু নিউটন যখন বুঝলেন, লেন্সের জ্যামিতিক আকার নয়, সাদা আলোর মিশ্র চরিত্র এবং লেন্সের মধ্যে দিয়ে প্রতিসরণের সময় ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের আলোতে বিশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণেই টেলিস্কোপে যে ইমেজ সৃষ্টি হয় তা স্পষ্ট হয় না, তখনই ‘হাইপারবলিক-লেন্স’ তৈরির চেষ্টায় তিনি ইতি টানেন – “I left off my aforesaid Glass-works …”। 

ঠিক এই সময় নিউটনের মনে উঁকি দিল ভিন্ন এক সম্ভাবনার কথা – “…take Reflections in consideration… I understood, that by their mediation Optick instrument might be brought to any degree of perfection imaginable…”। নিউটন বুঝলেন, প্রতিফলন, হ্যাঁ প্রতিফলনের দ্বারাই আলোকীয় যন্ত্রের পরিপূর্ণ উৎকর্ষ সাধন সম্ভব। তাঁর স্থির বিশ্বাস,  প্রচলিত দূরবীনে লেন্স এর বদলে যদি বক্রতল দর্পণ ব্যবহার করা যায় তাহলে বর্ণ ঘটিত ত্রুটি আর থাকবে না! মনে পড়ল, স্কটিশ গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস্‌ গ্রেগরির লেখা ‘অপটিকা-প্রোমোটা’ বা ‘দ্য অ্যাডভান্স অব অপটিক্স’ বইটির কথা। মাত্র কয়েক বছর আগে (১৬৬৩) লন্ডনে প্রকাশ পায় বইটি। মিস্টার ব্যারোর নিজস্ব লাইব্রেরিতে বইটি তিনি পড়েছেন।**  গ্রেগরি তাঁর বইয়ে টেলিস্কোপের নতুন এক মডেল-এর বিবরণ দিয়েছেন। চিত্রসহ বুঝিয়েছেন কীভাবে লেন্স এর বদলে দর্পণ বসিয়ে টেলিস্কোপ তৈরি করা যায়।  

তবে, গ্রেগরি প্রথম নন, প্রতিফলক দূরবীন তৈরির কথা তাঁর আগেই ইউরোপের (বিশেষত ইতালির) বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন***। স্বয়ং গ্যালিলেও ছিলেন সেই দলে। এছাড়া ছিলেন নিকোলো জুক্কি, সিজার মার্শিলি, বোনাভেনতুরা ক্যাভেলিয়েরির মতো অনেকেই। কিন্তু না-গ্রেগরি, না-মার্শিলি, না-ক্যাভেলিয়েরি, সেই কালে কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি প্রতিফলক দূরবীন নির্মাণ। এবার আসরে অবতীর্ণ হলেন এক নবীন গবেষক – এই আখ্যানের নায়ক।  

নিউটন প্রথমেই প্রতিফলক দূরবীনের ভিন্ন এক নক্সা প্রস্তুত করলেন। দুটি মসৃণ ধাতব দর্পণ থাকবে তাঁর টেলিস্কোপে। প্রথমটি অবতল, যাকে বলা হবে প্রাইমারি স্পেকুলাম। আর দ্বিতীয়টি হবে সমতল – সেকেন্ডারি স্পেকুলাম। টিউবের পাশের একটি ছিদ্র পথে পর্যবেক্ষণ করা হবে প্রতিবিম্বকে। কিন্তু এজন্য তাঁকে শিখে নিতে হবে গোলীয় দর্পণ ও লেন্স বানানোর সঠিক পদ্ধতি। দর্পণ নির্মাণের উপযুক্ত ধাতুও প্রস্তুত করা চাই। এখনই একবার লন্ডন শহরে যাওয়া প্রয়োজন তাঁর। সেখানেই দেখা মিলবে সুদক্ষ কারিগরদের।       

ইতিমধ্যে, ১৬৬৮-র জুলাই-এ, কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির মাস্টার অফ আর্টস এবং সেই সঙ্গে প্রথা মাফিক ট্রিনিটির মেজর ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন নিউটন। মেজর ফেলোশিপ বছরে ৬০ পাউন্ড। ঠিক এই সময় তাঁর হিসাবের খাতায় উল্লেখ আছে, এম-এ-র গাউনের জন্য ১৮ গজ কাপড় কিনেছেন। একজোড়া নতুন জুতো ও একটি স্যুট তৈরি করিয়েছেন। সেই সঙ্গে কিনেছেন টুপি আর হুড। নিউটনের অ্যাকাউন্টে এই সময়কার ব্যয়ের ধরণ দেখলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনে প্রবেশ করছেন তিনি। এক পূর্বতন সাবসাইজার থেকে ইউনিভার্সিটির পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিতে উত্তরণ ঘটছে তাঁর। লিঙ্কনশায়ারের সেই লাজুক স্বভাবের ছেলেটি এখন অনেক বদলে গেছে। কেম্ব্রিজের সম্ভ্রান্ত মহলে তিনি এখন দিব্যি মানিয়ে গেছেন। সর্বক্ষণের জন্য একজন ভৃত্যও রেখেছেন নিউটন। কেম্ব্রিজে এই প্রকার ভৃত্যদের বলা হত ‘জিপ’। জিপদের কাজ ছিল প্রভুকে সকালে ঘুম থেকে তোলা, জামাপ্যান্ট ব্রাশ করে দেওয়া, পার্সেল বয়ে দেওয়া, পার্টিতে সঙ্গে যাওয়া। একজন মেজর ফেলো মনে করলে কয়েকজন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রের টিউটরও হতে পারতেন। নিউটন এরকমই তিনজন ছাত্রের টিউটর ছিলেন। কিন্তু একজন ছাত্রের পিতাকে লেখা একখানি চিঠি ছাড়া এই সংক্রান্ত আর কোনও তথ্য নেই। ছাব্বিশ বছরের অন্তর্মুখী যুবকটি টিউটর হিসাবে ঠিক কেমন ছিলেন তা জানা যায় না। তবে, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে ঠিক সেই সময়, এই যুবক অন্য এক কারণে চিন্তামগ্ন। রাতের ঘুম ছুটেছে। যে কাজে হাত দিয়েছেন তা যে কতটা কঠিন, ভালই জানেন তিনি। 

মেজর ফেলো নির্বাচিত হওয়ার ঠিক পরের মাসে (১৬৬৮-র আগস্টে) লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন নিউটন। কেমব্রিজ থেকে লন্ডন প্রায় ষাট মাইলের পথ। ঘোড়ায় টানা কৌচে কম করে একদিন সময় লাগে। রাজধানীতে এই প্রথম তাঁর পদার্পণ। বিশেষ এক উদ্দেশ্য নিয়ে আসা তাঁর। লন্ডন টাওয়ার দেখে সময় নষ্ট করার মানুষ তিনি নন। তাছাড়া বছর দুই আগে লন্ডন শহর প্রায় ভস্মিভূত হয়ে গেছে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে। ইতিহাসের পাতায় ‘দ্য গ্রেট ফায়ার অফ লন্ডন’ হিসাবে চিহ্নিত সেই দুর্ঘটনা। নিউটন যখন এলেন, তখন সেখানে ঘর-বাড়ি, চার্চ, মার্কেট সবকিছু নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী – ক্রিস্টোফার রেন ও রবার্ট হুক খুবই ব্যস্ত সেসময়। স্থপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ তাঁরা।

নিউটনের এই লন্ডন যাত্রা ঠিক কী কারণে, তার কোনো তথ্য প্রমাণ মেলে না। তাঁর এই গোপনীয়তা কি ইচ্ছাকৃত? সম্ভবত তাই-ই। নিউটন-গবেষকদের অনুমান,  একজন দক্ষ গ্রাইন্ডারের সন্ধানেই তাঁর প্রথম লন্ডন যাত্রা। তাঁকে শিখে নিতে হবে একজন অপটিশিয়ান ঠিক কীভাবে লেন্স গ্রাইন্ড করেঠিক কীভাবে মসৃণ  দর্পণ বানায়। সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যেই নিউটন তিন সপ্তাহ কাটালেন লন্ডনে। কিন্তু নতুন কোনও যন্ত্র উদ্ভাবনের পূর্ব মুহূর্তে, একজন আবিষ্কারক যে চূড়ান্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করবেন তা আর আশ্চর্যের কথা কী!

লন্ডন থেকে সরাসরি গেলেন উলস্‌থর্পে মায়ের কাছে। এম-এ ডিগ্রি লাভের পর বাড়ি ফেরার বাড়তি তাগিদ নিশ্চয়ই অনুভব করছিলেন তিনি। আর দামি নতুন পোশাক পরিহিত উজ্জ্বল চেহারার পুত্রকে দেখে হান্নার চোখে মুখে যে গর্ব ও বিস্ময় ঝরে পড়েছিল তা বেশ আন্দাজ করা যায়।  

কেমব্রিজে ফিরে এসে শুরু হল রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ গড়ার কাজ। গ্রান্থামের সেই স্কুল বয়, যার মডেল বানানোর হাত দেখে তাজ্জব হয়ে যেতেন পড়শিরা, এবার জীবনের সেরা মডেলটি গড়তে বসেছেন।     

ছাত্রাবস্থার একটি নোটবুকে (MS Add. 3996) তামা, টিন, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি ইত্যাদি ধাতু গলিয়ে সংকর ধাতু তৈরির পদ্ধতি লিখে রেখেছিলেন। এটির ব্যবহার হিসাবে তাতে লেখেন, ‘মেটাল ফর রিফ্লেকসন’ অর্থাৎ প্রতিফলনের ধাতু। এই সংকর ধাতু, যার পোশাকি নাম ‘স্পেকুলার মেটাল’, তাই দিয়ে বানালেন দু-ইঞ্চি ব্যাসের একখানি মসৃণ অবতল দর্পণ। এই হল প্রাইমারি রিফ্লেক্টর অর্থাৎ মুখ্য দর্পণ – এতেই গড়ে উঠবে গ্রহ-উপগ্রহের প্রতিবিম্ব। আর একটি ছোট্ট সমতল দর্পণ টিউবের মধ্যে কিছুটা আনতভাবে রেখে বাইরে আনার ব্যবস্থা করলেন প্রতিবিম্ব-কে। নব-আবিষ্কৃত দূরবীনের দৈর্ঘ্য দাঁড়াল মাত্র ছ-ইঞ্চি। এবার রাতের আকাশের দিকে তাক করার পালা। তাতেই স্পষ্ট ধরা দিল বৃহস্পতি আর তার বড় চার উপগ্রহ। দেখা গেল শুক্রের দশাও।   

তুলনা করে দেখলেন, এই খুদে দূরবীন, ক্ষমতায় ছ-ফুটের প্রচলিত রিফ্র্যাক্টিং টেলিস্কোপকে হার মানায়। আর সবচেয়ে বড় কথা, এর ইমেজ বর্ণ-ঘটিত ত্রুটি মুক্ত। যেমনটি ভেবেছিলেন ঠিক তাই। এই যন্ত্রই হবে তাঁর হাতিয়ার। ‘থিয়রি অফ কালার্স’-এর সত্যতায় দেবে শিলমোহর। বিশ্বের বিজ্ঞান দরবারে হাজির করবেন তাঁর আলোক তত্ত্বের প্রামাণ্য হিসাবে।

নিউটন তখন বৃদ্ধ। তখনও এই টেলিস্কোপের কথা মনে পড়লে ভারী গর্ব হয় তাঁর।  জন কনদ্যুইত-এর সঙ্গে এই বিষয়ে সেই সময় যে কথোপকথন হয়েছিল তা কনদ্যুইত, নিউটনের স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন – ‘আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাঁকে, কোথা থেকে বানিয়েছিলেন এই টেলিস্কোপ? তিনি জানান, এ-তাঁর স্বহস্তে গড়া। শুধুমাত্র টেলিস্কোপ নয়, এর জন্য প্রয়োজনীয় ‘টুলস্‌’ বা যন্ত্রপাতিও নিজেই তৈরি করেছিলেন।’ এরপর কনদ্যুইত লিখছেন, ‘তারপর অল্প হেসে (নিউটন) বলেছিলেন, এসব তৈরির জন্য যদি অপর কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভর করতে হত তাহলে, সেই সমস্ত যন্ত্র দিয়ে কখনই কিছু করতে পারতাম না।’ 

প্রতিফলক দূরবীন নির্মাণের কাজটি যে রীতিমত দুরূহ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিউটন-জীবনীকার A. Rupert Hall এ-প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘To attain success with even a tiny mirror requires no mean skill and patience; it is a tremendous testimony to Newton’s persistence and artisanal skill that he did succeed.’

নিউটন তাঁর গাণিতিক আবিষ্কার প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ইউরোপের পণ্ডিতদের চেনেন তিনি। মারাত্মক সমালোচনার মুখে পড়বেন। সেই ভয়ে গণিত সমাজের থেকে দূরে রেখেছিলেন নিজেকে। কিন্তু, তাঁর নিজের হাতে তৈরি যন্ত্রটিকে লোক চক্ষুর আড়ালে রাখলেন না। টেলিস্কোপের নতুন সংস্করণটি ট্রিনিটিতে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের দেখালেন। ট্রিনিটি কলেজের দুই প্রফেসর, টমাস গেল ও আইজাক ব্যারো রয়েছেন সেই দলে।       

১৬৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে জনৈক ব্যক্তিকে একটি চিঠি লেখেন নিউটন। সেই চিঠিতেই প্রথম তাঁর টেলিস্কোপের বর্ণনা পাওয়া যায় – ‘মিস্টার এন্ট-কে কথা দিয়েছিলাম যে আপনাকে আমার সাফল্যের বিবরণ জানাবো… যে যন্ত্রটি আমি বানিয়েছি তার দৈর্ঘ্য মাত্র ছ-ইঞ্চি। বিবর্ধন ক্ষমতা ৪০ গুণ, যা স্পষ্টতার বিচারে যে কোনো ৬ ফুট টিউবের থেকে বেশি – আমার তেমনই বিশ্বাস। এই যন্ত্রে স্পষ্ট দেখলাম বৃহস্পতির গোলাকার চেহারা ও তার উপগ্রহদের। আর দেখলাম একফালি শুক্রকে…।’               

লন্ডনের রয়্যাল-সোসাইটিতে পৌঁছে গেল নিউটনের আশ্চর্য টেলিস্কোপের কথা। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এক আলোক যন্ত্র ক্ষমতায় ছ-ফুটের সাধারণ টেলিস্কোপকে হার মানায়! রয়্যাল-সোসাইটি দেখতে চাইলেন যন্ত্রটি। ততদিনে কয়েকটা বছর পার হয়ে গেছে।  নিউটন তখন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজের গণিত প্রফেসর। প্রফেসর ব্যারোর স্থলাভিষিক্ত। ব্যারো, রাজার চ্যাপেলিন নিযুক্ত হয়েছেন লন্ডনে। 

বছর তিনেক ব্যবহার করায় যন্ত্রটি আর আগের চেহারায় নেই। প্রধান দর্পণ অর্থাৎ প্রাইমারি স্পেকুলাম হারিয়েছে ঔজ্জ্বল্য। আগের মতো ইমেজ স্পষ্ট হয় না এখন। নতুন করে আর একটি রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ গড়তে বসলেন নিউটন। রয়্যাল-সোসাইটিতে পাঠাবেন সেটি। এবার যেন আরও সুন্দর দেখতে হল। অতি যত্নে পালিশ করা মসৃণ ধাতব দর্পণে আরও ঝকঝকে দেখাচ্ছে প্রতিবিম্ব।  

১৬৭১-এর ডিসেম্বরে নিউটন-নির্মিত সেই দ্বিতীয় টেলিস্কোপ লন্ডনে নিয়ে গেলেন মিস্টার ব্যারো। টেলিস্কোপটি পৌঁছতেই সাড়া পড়ে গেল সেখানে। রয়্যাল-সোসাইটিতে তখন বড়দিনের ছুটি। ১১ জানুয়ারি ১৬৭২, ‘হোয়াইট-হল’-এ সেটি প্রদর্শিত হল। রাজা দ্বিতীয় চার্লস স্বয়ং উপস্থিত। রয়েছেন রয়্যাল-সোসাইটির প্রেসিডেন্ট লর্ড ব্রাউঙ্কার, স্যর রবার্ট মোরে, স্যর পল নিল, বিশিষ্ট দুই-বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার রেন ও রবার্ট হুক (Notes and Records of the Royal Society, 33, no. 2, Mar. 1979)। নিউটনের দূরবীন দিয়ে তিনশো ফুট দূরের একটি হাওয়া-মোরগের মাথার মুকুট পর্যবেক্ষণ করা হল। ছোট্ট এক যন্ত্র অথচ, এমন স্পষ্ট আর বড় প্রতিবিম্ব! সকলেই বিস্মিত। প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত তাঁরা। কেবল একজনের মনে সংশয়। তিনি রবার্ট হুক। তখনই কিছু বললেন না হুক। তাঁর মনের ভাব কেউ জানতে পারল না। উপস্থিত বিশিষ্টজনদের পক্ষ থেকে সোসাইটির সেক্রেটারি, হেনরি ওল্ডেনবার্গ-কে অনুরোধ জানানো হল এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব যেন তরুণ গবেষক আইজাক নিউটনই পান এবং তার জন্য যা যা করণীয় তা যেন তিনি করেন। একইসঙ্গে, রয়্যাল-সোসাইটির সদস্য পদে নির্বাচনের জন্য নিউটনের নাম প্রস্তাব করা হল। 

১৬৭২-এর জানুয়ারি মাসের গোড়াতেই হেনরি ওল্ডেনবার্গ-এর একখানি চিঠি পেলেন নিউটন। ওল্ডেনবার্গ লিখেছেন – ‘…আপনার উদারতার প্রশংসা করি। কারণ, আপনি আপনার উদ্ভাবিত কনট্র্যাকটিং-টেলিস্কোপ এখানকার বিজ্ঞান-দার্শনিকদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। আলোক-বিজ্ঞানের খ্যাতনামা বিশারদরা এটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে উচ্চকন্ঠে প্রশংসা করেছেন এবং তাঁদের অভিমত হল, এই আবিষ্কারটিকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন যাতে আবিষ্কারের স্বীকৃতি বিদেশিদের দখলে চলে না যায়।’ 

এ-চিঠির প্রত্যুত্তরে নিউটন লিখলেন –

মহাশয়, 

আপনার পত্র পড়ে যারপরনাই আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার অতি সামান্য এক উদ্ভাবনকে আপনারা এমন যত্ন সহকারে সংরক্ষণের প্রয়াস নিয়েছেন। এবং যেহেতু,  রয়্যাল-সোসাইটি এটিকে মূল্যবান জ্ঞান করে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নিয়েছে, আমাকে  স্বীকার করতেই হয় এর প্রাপ্য মর্যাদা আমি দিইনি। এতগুলি বছর এই উদ্ভাবন যেভাবে অপ্রকাশিত ছিল হয়তো সেভাবেই থেকে যেত আমার কাছে। … সোসাইটির সদস্য নির্বাচনে আমার নাম প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে যে সম্মান জানানো হয়েছে, তাতে আমি অভিভূত … কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আমি সচেষ্ট থাকবো আমার অতি সাধারণ ও একক প্রয়াসের দ্বারা আপনাদের দার্শনিক ভাবনার অগ্রগতিতে সাহায্য করার (I shall endeavour to testify my gratitude by communicating what my poore & solitary endeavours can effect towards the promoting your Philosophicall designes)

বিনীত 

আইজাক নিউটন (কেমব্রিজ, ৬ জানুয়ারি, ১৬৭১/২)। 

ক্রিসমাসের ছুটির ঠিক পরই, ১৮ জানুয়ারি, সোসাইটির মিটিং কল করলেন সেক্রেটারি ওল্ডেনবার্গ। সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে যিনি গুরুত্বপূর্ণ তিনি সোসাইটির কিউরেটর,  রবার্ট হুক। তিনি না-থাকলে মিটিং শুরুই হয় না। হুকের উপস্থিতিতে মিটিং-এ নিউটনের টেলিস্কোপ পুনরায় পরীক্ষা করা হল। যন্ত্রটির অভিনবত্ব নিয়ে হুক তাঁর সংশয় ব্যক্ত করলেন। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, হুকের মতো বহুমুখী প্রতিভা বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিরল। প্রায় সমসাময়িক কালে ইংল্যান্ডে জন্ম নিয়েছিলেন দুই প্রকৃতি দার্শনিক – রবার্ট হুক ও আইজাক নিউটন। দু-জনেই তুখোর এক্সপেরিমেন্টালিস্ট। নতুন যন্ত্র বানানোয় সহজাত তাঁদের দক্ষতা। কিন্তু হায়! ভাগ্যবিধাতা এঁদের যেন দুই প্রতিপক্ষ করেই পাঠিয়েছেন। সোসাইটির রেজিস্টারে লেখা হল – ‘The Curator [Hooke] said that he did endeavour to make such a Telescope himself, and to find out a Metall not obnoxious to turnishing’। হুক নাকি অনুরূপ একখানি দূরবীন বানিয়েই ফেলেছিলেন, শুধুমাত্র দর্পণ নির্মাণের উপযুক্ত ধাতুর অভাবে কাজটি আর শেষ করা হয়নি তাঁর। সোসাইটির তরফ থেকে হুককে অনুরোধ জানানো হল কিছুটা বড় আকারের একটি প্রতিফলক দূরবীন নির্মাণ করার জন্য। সোসাইটির মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, এই আবিষ্কারের খেতাব যাতে আইজাক নিউটনই পান সেজন্য সচেষ্ট হতে হবে। এই মিটিং-এই ‘ফেলো অব রয়্যাল-সোসাইটি’ নির্বাচিত হলেন নিউটন। 

ওল্ডেনবার্গ এতটুকুও সময় নষ্ট না করে, টেলিস্কোপের বিশদ বিবরণ লিখে পাঠালেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের। ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস তাঁদের একজন। হাইগেনস তখন প্যারিসে থাকেন। ‘ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’-এর একবারে প্রথম-সারির বিজ্ঞানী। যন্ত্রটির বিবরণ পড়ে হাইগেনস মুগ্ধ। নিউটনের এই উদ্ভাবনকে তিনি এই বলে উল্লেখ করলেন – ‘marvellous telescope of Mr. Newton…’। এই দূরবীনই প্রথম ট্রিনিটির বাইরের দুনিয়ার সাথে পরিচয় ঘটাল  নবীন বিজ্ঞানীর।           

এত কিছুর পরও পরিতাপের বিষয় একটি রয়ে গেল। সকলেরই যে বৈশিষ্ট্য নজর কাড়ল তা হল, যন্ত্রটির ছোট-খাটো চেহারা। অথচ, এর প্রধান যে বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ,  বর্ণ-বিরহিত প্রতিবিম্ব গঠনের ক্ষমতা, তা কেউ-ই প্রায় খেয়াল করল না। অবশ্য খেয়াল করার কথাও নয়। সেই মুহূর্তে এই গ্রহের একজন ব্যক্তিই কেবলমাত্র জানেন, প্রকৃতির শাশ্বত এক সত্যের কথা – সাদা আলো মৌলিক নয়। আদতে বহু বর্ণের এক মিশ্রণ। কিন্তু তিনি ভয় পাচ্ছেন তাঁর এই উপলব্ধির কথা প্রকাশ্যে আনতে।

তাঁর টেলিস্কোপের এমনতর আবাহন নিউটন কল্পনাও করতে পারেননি। এই সাফল্যে ভরসা পেয়ে, ১৮ জানুয়ারি, ওল্ডেনবার্গকে লিখলেন, ‘সোসাইটির বিবেচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি ফিলজফিক্যাল-ডিসকভারির বর্ণনা সোসাইটিতে পাঠাবার মনস্থির করেছি যা ওই টেলিস্কোপ নির্মাণে প্রণোদিত করেছিল আমাকে। এবং আমি নিশ্চিত, ওই যন্ত্র নির্মাণ অপেক্ষা এ-আবিষ্কারের মূল্য অনেক-অনেক বড়। আমার অভিমত, প্রকৃতির ক্রিয়া-কলাপের নিগূঢ় এক রহস্য উন্মোচনে এ-এক অত্যাশ্চর্য বা বলা যায়, এ-যাবৎ কালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসন্ধান (in my Judgment the oddest if not the most considerable detection which hath hitherto beene made in the operations of Nature)।’  

এর অল্পদিন পর, ১৬৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি, নিউটন তাঁর সেই বিখ্যাত পত্র, যা বয়ে নিয়ে চলেছে তাঁর ‘থিয়রি অফ কালার্স’, পাঠালেন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির  ঠিকানায়।

এদিকে, হুক ও তাঁর সহকারী অপটিশিয়ান, খ্রিস্টোফার কক্‌, এক বছরেরও বেশি সময় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন বড় আকারের কোনও প্রতিফলক দূরবীন নির্মাণে। কেমব্রিজের এক অখ্যাত নবীন বিজ্ঞানীর কাছে এ-যেন তাঁর এক প্রকার পরাজয়। হুক মেনে নিতে পারছেন না। তার ওপর নিউটনের চিঠির ভাষায় কেমন এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বর। প্রমাণ দেওয়ার ধার ধারে না। নতুন আলোক তত্ত্বের ছত্রে-ছত্রে সুতীব্র বিশ্বাসের কাঠিন্য ঝড়ে পড়ছে। হুকের মনে যেন জ্বালা ধরায়!          

(চলবে)

অলঙ্করণঃ সৌহার্দ্য চক্রবর্তী

 

সূত্রনির্দেশ 

  1. R. S. Westfall, Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
  2. R. Iliffe, Priest of Nature, Oxford University Press, New York, 2017.
  3. A. R. Hall, Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
  4. P. E. Ariotti – ‘Bonaventura Cavalieri, Marin Mersenne, and the Reflecting. Telescope’, Isis – History of science society, Volume 66, Number 3 (1975).
  5. P. Fara – Newton shows the light: a commentary on Newton (1672) ‘A letter … containing his new theory about light and colours…’, Phil. Trans. R. Soc. A 373: 20140213.
  6. http://www.newtonproject.ox.ac.uk/view/texts/normalized/NATP00003
  7. http://www.newtonproject.ox.ac.uk/view/texts/normalized/NATP00020
  8. 8. http://www.newtonproject.ox.ac.uk/view/texts/normalized/PERS00001 (R.4.48c, Trinity College Library, Cambridge, UK)

*ক্রিস্টোফার রেন-এর আর একটি বিশেষ পরিচয় আছে – সে-সময় তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের সেরা স্থপতি। কেবলমাত্র লন্ডন শহরেই পঞ্চাশটিরও বেশি গির্জার নকশা তাঁরই হাতে গড়া। বয়সে বছর দশেকের বড় এই মানুষটির প্রতিভা ও বিজ্ঞানচর্চার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন স্বয়ং নিউটন।

**ট্রিনিটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল জেমস্‌ ডুপোর্ট-এর লাইব্রেরিতেও ওই সময় ‘অপটিকা প্রোমোটা’ ছিল। সেখান থেকে নিয়েও বইটি পড়ে থাকতে পারেন নিউটন। 

***কাচ কেটে তাকে ঘষে-মেজে নিলে সে যেমন বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়, যাকে আমরা লেন্স বলি, ঠিক তেমনই চকচকে কোনও মসৃণ তলকে বাঁকিয়ে সঠিক জ্যামিতিক আকার দিলে সেটি তখন বিশেষ গুণ সম্পন্ন আলোক যন্ত্র হয়ে ওঠে। এরকম বক্রাকার অবতল দর্পণ অবিকল লেন্স-এর মতোই গ্রহ-নক্ষত্রদের বিবর্ধিত উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব গড়ে তুলতে সক্ষম। বক্রতল দর্পণের এই বিশেষ ক্ষমতার কথা জানতেন একাদশ শতকের মানুষেরাও। সেকালের ইরাকি বিজ্ঞানী আল হাজেন-এর বিখ্যাত আলোক-বিজ্ঞান গ্রন্থ, ‘কিতাব আল-মানাজির’-এ এর উল্লেখ পাওয়া যায়।     

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment