নবব্রত ঘোষাল

নিউটন-৪

আপেল পড়ার গল্প

১৬৬৫-র জুন-জুলাই মাস নাগাদ উলস্‌থর্প ম্যানর-এ ফিরে এলেন আইজাক  নিউটন মহামারির প্রকোপ এড়িয়ে নিরাপদে  পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন এই খামার বাড়িতে। কেমব্রিজ থেকে সঙ্গে এনেছেন বাক্সভর্তি বই সেগুলি রাখার জন্য দোতলার একটি ঘরে পাইন কাঠের সেলফ্‌ বানিয়ে নিলেন নিউটন এখন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হল সৎপিতা বারনাবাস স্মিথের থেকে পাওয়া সেই ‘ওয়েস্ট বুক’ক্রমশ যা ভরে উঠতে থাকল নানা রকম সাংকেতিক চিহ্নে, গাণিতিক সংখ্যায় ও জ্যামিতিক চিত্রে।   

তেইশ বছরের এই যুবক আর আগের সেই গ্রাম্য আইজাকের মধ্যে এখন বিস্তর ফারাক। নিউটন নিজেকে এখন ‘আইজাক নিউটন অফ উলস্‌থর্প, জেন্টল্‌ম্যান’ বলে পরিচিত করাতেই বেশি পছন্দ করছেনএখন তিনি খামারের জমিদার এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ‘ব্যাচেলর অফ আর্টস’! 

১৬৬৪ থেকে ১৬৬৬ এই তিনটি বছর হল নিউটনের জীবনের  সেরা ফলপ্রসূ-কাল। তাঁর জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান এই বছরগুলি ল্যাটিন ভাষায় ‘অ্যানি মিরাবিলিস’ বলে চিহ্নিত।  

নিউটনের নিজের কথায়, “নতুন ভাবনা ও আবিষ্কারের দিক থেকে ওই সময় আমি ছিলাম চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং গণিত ও দর্শনে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলাম ওই সময়ই 

নিউটনের ‘ওয়েস্ট বুক’ (MS Add. 4004) ও ‘ট্রিনিটি কলেজ নোটবুক’ (R.4.48c) দেখলে তাঁর এই কথার যাথার্থ্য উপলব্ধ হয়। 

সেল্‌ফ-আইসোলেশন’ পর্বের গোড়ার দিকে, উলস্‌থর্পের এই ‘জেন্টল্‌ম্যান’ নিমগ্ন রইলেন একই সঙ্গে গণিত ও বলবিজ্ঞান (মেকানিক্স) চর্চায় 

কেমব্রিজে থাকাকালীনই নিউটন, সতের শতকের অঙ্ক শাস্ত্রের যা কিছু নতুন, যা কিছু অজ্ঞাত, নিরন্তর সাধনার মধ্যে দিয়ে আত্তীকরণ করেছেন এবং ইউরোপের গণিত চর্চার একেবারে প্রথম সারিতে তুলে এনেছেন নিজেকে   

জন ওয়ালিসের ‘এরিথমেটিকা ইনফাইনিটোরাম’ থেকে অসীম শ্রেণীর ধর্ম, আচরণ জেনেছেন তিনি এবং দক্ষতা এতটাই অর্জন করেছেন যে, কোনও শ্রেণীর দুটি জ্ঞাত পদ (টার্ম)-এর মাঝের নতুন পদটি কি হতে পারে নির্ণয় করতে পারেন তা 

এই পদ্ধতিতে, গাণিতিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘অন্তর্বেশন’ বা ‘ইন্টারপোলেশান’, যে-কোনো বৃত্তাংশের অথবা পরাবৃত্তাংশের অন্তর্গত ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা সম্ভব। নিউটন অনুধাবন করলেন এমন সম্ভাবনার কথা।    

কিন্তু, অঙ্কের পণ্ডিতদের কাছে সে সময়, এ ছিল মস্ত বড় এক প্রহেলিকা! সেই কোন খ্রিস্টপূর্বকালে, এক খন্ড অধিবৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় পদ্ধতি (‘squaring a parabola’) আবিষ্কার করেছিলেন আর্কিমিডিস। তারপর প্রায় দু-হাজার বছর অতিক্রান্ত। অধিবৃত্ত ছাড়া অপর কোনও বক্ররেখার অন্তর্গত ক্ষেত্রফল নির্ণয় সম্ভব হয়নি। সতের শতকের গণিতজ্ঞদের কাছেও বৃত্তাংশের অথবা পরাবৃত্তাংশের ক্ষেত্রফল নির্ণয় অধরাই রয়ে গেছে  

এখন নিউটন, ‘ইন্টারপোলেশান’-এর সাহায্য নিয়ে উদ্ভাবন করলেন নতুন এক বিস্তার প্রণালী যা দ্বিপদ-বিস্তার বা ‘বাইনোমিয়াল এক্সপানসান’-এর সামান্যীকরণ। আর তা প্রয়োগ করে বৃত্তাংশ ও সমপরাবৃত্তাংশের অন্তর্গত ক্ষেত্রফলের প্রায় নিখুঁত মান নির্ণয় করলেন                               

উলস্‌থর্প ম্যানর থেকে মাইল ছয়েক দূরে বুথবি প্যাগনেল। সেখানকার রেক্টর মিস্টার ব্যাবিংটন। ব্যাবিংটনের যে লাইব্রেরি রয়েছে, সেখানে পড়াশোনা করতে মাঝে-মধ্যেই যান নিউটন। পরবর্তী কালে নিউটন  জানান, লিঙ্কনশায়ারের বুথবিতে আমি বাহান্ন দশমিক স্থান পর্যন্ত  পরাবৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করেছিলাম।” 

ক্ষেত্রফল গণনার মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হল গণিতের এক অভিনব ক্ষেত্র – ‘ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস’ বা সমাকলন। তেইশ বছরের যুবকটির পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি এ কত বড় এক আবিষ্কার! গণিতের নতুন এই ধারাটির তিনি নাম রাখলেন  ‘মেথড অফ ফ্লোয়িং কোয়ানটিটিস’সংক্ষেপে, ‘ফ্লুয়েন্টস্‌’। 

সমকালীন যত অগ্রজ গণিতবিদ, রণে দেকার্তে, জোহান হুডে, জন ওয়ালিস, ভন স্কুটেন, আর অগ্রসর হতে পারেননি যেখানে, নিউটন পাড়ি জমালেন সেই অনাবিষ্কৃত অপরিজ্ঞাত রহস্যময় গণিতের সাম্রাজ্যেঅজানা ভাবনা-সাগরে ভেসে চলা একাকী এক নাবিক! নিউটন সম্পর্কে, শেষের এই কথাগুলি বললেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ – “a mind forever voyaging through strange seas of thought, alone.”    

১৬৬৫-র শরৎ-এ নিউটনের গণিত চর্চার ধরণ গেল আমূল বদলে। নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে চলমান কোনও বিন্দুর সঞ্চারপথ গড়ে তোলে ভিন্ন ভিন্ন আকারের  বক্ররেখা। নিউটন তা জানতেন। তাঁর ভাষায়, এরা সব ‘মেকানিক্যাল কার্ভ’। এই ‘কাইনেমেটিক অ্যাপ্রোচ’ তিনি শিখেছিলেন প্রফেসর ব্যারোর লেকচার শুনে ‘ওয়েস্ট বুক’-এর সাদা পাতায়, স্পাইরাল, ইলিপ্স, কোয়াড্রাট্রিক্স, সাইক্লয়েড এরকম বেশ কয়েকটি মেকানিক্যাল কার্ভ-এর উপর স্পর্শক টানলেন নিউটন। এই ট্যান্‌জেন্ট বা স্পর্শক অঙ্কন প্রণালী একেবারে তাঁর নিজস্ব। আর এই কাজটি করতে গিয়ে জন্ম নিল ‘ক্যালকুলাস অফ ফ্লাক্সিওন্স্‌’এখন যা ‘ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস’ বা অবকলন হিসাবেই পরিচিত  

ফ্লাক্সিওন ও ফ্লুয়েন্ট নিয়ে তাঁর অভিনব গাণিতিক ভাবনাদের একত্রিত করে, ১৬৬৫-র নভেম্বরে একটি গবেষণা পত্রের খসড়া প্রস্তুত করলেন নিউটন এরপর,  হঠাৎ-ই গণিত চর্চায় যেন আগ্রহ হারালেন তিনি। উৎসাহের বাতিটি সহসা গেল নিভে। গণিতের সঙ্গে এক প্রকার বিচ্ছেদ ঘটল তাঁরছমাস বিরতির পর, ১৬৬৬-র মে মাসে লিখলেন আরও দুটি গবেষণা পত্রতারপর অক্টোবরে, খসড়া তিনটি একত্রিত এবং কিছু প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে নিলেন সংকলিত এই গবেষণা পত্রের শিরোনাম দিলেন “To resolve Problems by Motion these following Propositions are sufficient” 

নিউটন গবেষণা পত্রের খসড়া প্রস্তুত করলেন ঠিকই, কিন্তু তা প্রকাশ করা থেকে  বিরত থাকলেন। ক্যালকুলাসের জন্ম হল, অথচ বাকি পৃথিবী সে খবর জানতেও পারল না! কিন্তু, সত্যিই যদি গবেষণা পত্রটি প্রকাশ পেতো সেই সময়? যদি ইউরোপের পণ্ডিত সমাজ দেখতে পেতেন কুল-গোত্রহীন, অখ্যাত এই যুবকটির গাণিতিক কর্মকাণ্ড, তাহলে? নিউটনের জীবনীকার রিচার্ড ওয়েস্টফল এই প্রসঙ্গে লিখেছেন – “… that would have left the mathematicians of Europe breathless in admiration, envy, and awe.” গণিতজ্ঞরা হয়ে যেতেন, মুগ্ধতায় শ্বাসরুদ্ধ, কিছুটা ঈর্ষান্বিত ও সেই সঙ্গে বিস্ময়াবিষ্ট।    

কিন্তু, নিউটনের জীবদ্দশায় তাঁর ‘ওয়েস্ট বুক’, প্রফেসর ব্যারো সহ হাতে গোণা কয়েকজনেরই মাত্র চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ক্যালকুলাস আবিষ্কৃত হল, অথচ, ট্রিনিটির চার দেওয়ালের বাইরে সে খবর গেল না কেন যে তাঁর নতুন গাণিতিক ভাবনা প্রকাশ্যে আনতে নিউটন কুন্ঠিত ছিলেন, তা সঠিক করে বলা মুশকিল। হয়তো তিনি আরও বিশুদ্ধ রূপে, একেবারে নির্ভুল আকারে তাঁর গণিতের পরিমার্জন চেয়েছিলেন। কিংবা, তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এমনতর অভিনব সব ভাবনা প্রকাশ পেলে তিনি সমালোচিত হতে পারেন। অথবা, এ ছিল তাঁর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য যে তিনি সবকিছুই গোপন রাখতে চাইতেন।         

এই যে ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কথা জানালেন না নিউটন, তার ভবিষ্যৎ ফলাফল তাঁর পক্ষে মোটেও সুখকর হবে না ঠিক এক দশক কাল পর, ইউরোপের অপর এক প্রান্তে, এক জার্মান গণিতবিদ, কলনবিদ্যা অর্থাৎ, ক্যালকুলাস নতুন করে উদ্ভাবন করবেনসেই সংক্রান্ত গবেষণা পত্রও প্রকাশ করবেন তিনি এরপরই    ‘প্রাইওরিটি’ প্রমাণে সচেষ্ট হবেন নিউটনক্যালকুলাস আবিষ্কারকের শিরোপাটি যেখানে তাঁর জন্যই নির্ধারিত ছিল, সেখানে এই আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে পরবর্তী প্রায় তিনটি দশক গড়িয়ে যাবে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই বিবাদইউরোপের গণিত মহল ভাগ হয়ে যাবে দুই পক্ষে। মর্মাহত ও ব্যথিত চিত্তে নিউটন সংকল্প নেবেন গণিত ও বিজ্ঞানচর্চা ছেড়ে দেওয়ার এই বিজ্ঞান সাধকের জীবন জুড়ে বারে বারে তাঁর  এই স্পর্শকাতর মনের পরিচয় পাওয়া যায়! 

১৬৬৬-র শীতের মরশুম পার হলে, প্লেগের দাপট কমার খবর আসে। মার্চ মাস নাগাদ নিউটন একবার কেমব্রিজে যান। হয়তো ভেবেছিলেন,  প্লেগের হাত থেকে কেমব্রিজ মুক্ত হয়েছে। কিন্তু, মহামারীর প্রকোপ কিছুটা কমলেও ইউনিভার্সিটি তখনও বন্ধ। তিন চার মাস সেখানে থেকে আবার ফিরে আসেন উলস্‌থর্পে। তারপর, টানা দশ মাস মা ও ভাই-বোনদের সাথে গ্রামের বাড়িতেই কাটালেন নিউটন।   

ওই সময়, বস্তুর গতি সংক্রান্ত দেকার্তের ধারণাটি বিচার করে, ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তা প্রকাশ করার চেষ্টা করলেন। প্রায় দেকার্তের অনুরূপে, দুটি ‘অ্যাক্সিয়ম’ অর্থাৎ, স্বতঃসিদ্ধি লিখলেন তাঁর ‘ওয়েস্ট বুক’-এ। প্রথমটি কোনও বস্তু একবার গতিপ্রাপ্ত হলে সেটি আর থামবে না যদি-না বাইরে থেকে কোনও কারণ তাকে বাধা দেয়। দ্বিতীয়টিতে লিখলেন, গতিশীল বস্তু সর্বদা সরলরেখায় চলবে যদি-না বাইরের কোনও কারণ তার গতিপথের বিচ্যুতি ঘটায়।  

পরবর্তীকালে, প্রিঙ্কিপিয়াতে এই দুটি অ্যাক্সিয়মকে একত্রিত করে নিউটন তাঁর সুবিখ্যাত ‘গতির সূত্রাবলী’-র প্রথম সূত্রের রূপ দেন তখন ‘অ্যাক্সিয়ম’ এর পরিবর্তে ব্যবহার করলেন ‘ল্য’ বা সূত্র’ শব্দটি 

একটি কথা এখানে বলতেই হয়, খুব আশ্চর্যজনকভাবে প্রিঙ্কিপিয়ার কোথাও দেকার্তের নাম উল্লেখ করেননি নিউটন। যদিও, নিউটন গবেষকরা মনে করেন, প্রথম সূত্রের ধারণাটি তিনি পেয়েছেন দেকার্তের থেকেই। কিন্তু, যে জায়গাটিতে দেকার্তে ও সমসাময়িক অন্যান্য গবেষকদের থেকে নিউটন এগিয়ে রইলেন, বা বলা যায়, বিজ্ঞানচর্চায় যুগান্তকারী দিক নির্দেশ করলেন, সেটি হল, বিজ্ঞান-দর্শনকে ‘এক্সপেরিমেন্টস্‌’ বা নানাবিধ পরীক্ষার মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করে নেওয়া। তাই, নিউটনের গতিসূত্রগুলি বাস্তব পরীক্ষা-সিদ্ধতার সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সতেরো শতকে যখন বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ দার্শনিক বোধের জায়গা থেকে এবং অনেক সময়ই ‘মেটাফিজিক্যাল’ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হত, সেই সময় নিউটন তাঁর বিজ্ঞান ভাবনার স্বপক্ষে ‘ফেনোমেনলজিক্যাল এভিডেন্স’ অর্থাৎ, কঠোর বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ইউরোপের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে এ-এক সাড়া জাগানো ব্যাপার। যদিও, এই সব ঘটনা ঘটবে আরো বেশ কয়েক বছর পর, প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশ পাবে যখন।  

দুটি গতিশীল বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটলে, তাদের গতির ঠিক কীরকম পরিবর্তন হয়, তা পর্যবেক্ষণ করলেন নিউটন। দেকার্তের দেওয়া বলের যে ধারণা, অর্থাৎ, গতিশীল বস্তুর মধ্যেই নিহিত থাকে ক্রিয়াশীল বল, নিউটন প্রথমে সেটি গ্রহণ করে তাঁর নোটবুকে লিখে রাখলেন কিন্তু তারপর, ওই সংঘর্ষের পরীক্ষার ফলাফল বিচার করে, বলের বস্তু নিরপেক্ষ অস্তিত্বের ধারণা অনুধাবন করলেন। লিখলেন, বস্তুর গতির হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে তার উপর ক্রিয়াশীল বলের হ্রাস-বৃদ্ধির উপর। তৈরি হল তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় গতিসূত্রের প্রেক্ষাপট। প্রিঙ্কিপিয়াতে যা পরিণতি পাবে।  

এই প্লেগের সময় উলসথর্পের খামার বাড়িতে অনেক কিছুই ঘটল। যুগান্তকারী সব আবিষ্কারের সূচনা হল এই কয়েক মাসে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, এই প্লেগ অধ্যায়ে তাঁর গবেষণার কথা উল্লেখ করেন নিউটন –১৬৬৫-র প্রথমদিকে, আমি মেথড অফ অ্যাপ্রক্সিমেটিং সিরিজ এবং বাইনমিয়াল (দ্বিপদ বিস্তার)-এর নিয়ম বের করেছিলাম। ওই বছরেরই মে মাসে, গ্রেগরি ও স্লাসিয়াসের স্পর্শক নির্ণয়ের পদ্ধতি এবং নভেম্বরে, প্রত্যক্ষ পদ্ধতির ফ্লাক্সিওন্স (ইন্টিগ্রেশন) আবিষ্কার করলাম। ঠিক পরের বছর জানুয়ারিতে, ‘থিয়োরি অফ কালার’ এবং মে মাসে, ফ্লাক্সিওন্স-এর বিপরীত পদ্ধতি সৃষ্টি করলাম‘  

আরও লিখলেন – ‘ওই বছরই, পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্র বা গ্র্যাভিটি যে চাঁদের কক্ষপথ পর্যন্ত বিস্তৃত, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। যে আকর্ষণ বলের প্রভাবে, কোনো গোলক অপর কোনো গোলককে ঘিরে আবর্তন করতে সক্ষম হয়, তার হিসাব-নিকাস আমার তখন জানা তাই, গ্রহদের পরিভ্রমণ কাল ও দূরত্ব সম্পর্কিত  কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে, গ্রহউপগ্রহদের কক্ষপথে ধরে রেখেছে যে বল তা যে তাদের ঘূর্ণন কেন্দ্র থেকে দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতে সম্পর্ক যুক্ত, আমি তা নির্ণয় করলাম” 

নিউটন নিজেই যখন জানিয়েছেন, তখন ধরে নেওয়াই যায় যে, মহাকর্ষ সম্পর্কিত সবচেয়ে জনপ্রিয় তাঁর যে আবিষ্কারের গল্পটি অর্থাৎ, সেই আপেল পড়ার গল্প, যা ইংরেজি সাহিত্যে প্রায় লোকগাথায় পরিণত হয়েছে, তা এই প্লেগের সময় উলস্‌থর্প ম্যানরেই ঘটেছিল। 

যদিও, এই আপেলের গল্পটি, বিশ্ব বিজ্ঞানের ইতিহাস নিঃসংশয়ে গ্রহণ করেনি। তার যথেষ্ট কারণও আছে। উলসথর্পের ফলের বাগানে আপেল গাছ থেকে আপেল পড়া এবং তাই দেখে মহাকর্ষ সূত্রের আবিষ্কার – এই গল্পের চারটি ভার্সন রয়েছে। মজার ব্যাপার হল, পরবর্তীকালে নিউটন নিজেই চারজন ব্যক্তির কাছে চারটি আলাদা আলাদা গল্প বলেন। 

গল্পের প্রথম ভার্সনটি শোনা যাক। এটি পাওয়া যায় উইলিয়াম স্টাক্লির লেখা থেকে। স্টাক্লি যে সময়ের কথা বলছেন, নিউটনের তখন অনেকটা বয়স হয়েছে। লন্ডনে নিউটনের বাড়িতে স্টাক্লি সেদিন আমন্ত্রিত। স্টাক্লি লিখছেন – ‘সেদিন গরম একটু বেশিই ছিল। ডিনারের অব্যবহিত পরে, তিনি (নিউটন) ও আমি বাগানে একটি আপেল গাছের নীচে গিয়ে বসলাম। চা পান করতে করতে এটা-সেটা কথা হচ্ছিল আমাদের। তিনি (নিউটন) সেইসময় কথাটি  বললেন – বহুদিন আগে, অনুরূপ এক পরিবেশে তাঁর মনের মধ্যে মহাকর্ষের ধারণাটি প্রথম উদয় হয়।তখন তিনি গভীর ভাবনায় তন্ময় ঠিক সেই সময়, একটি আপেল পড়া দেখে তাঁর মধ্যে ওই বোধ জন্ম নেয়‘  

এবার গল্পের দ্বিতীয় ভার্সন। নিউটনের ভাগ্নি-জামাই, জন কনদ্যুইত-এর ভাষ্যটি ছিল এরকম – একদিন নিউটন বসে আছেন বাগানে। সেই সময় তাঁর মনের মধ্যে মহাকর্ষের ধারণাটি সহসা উদ্ভাসিত হয়। নিউটনের মনে হল, যে-মহাকর্ষ বলের ক্রিয়ায় একটি আপেল, গাছ থেকে মাটিতে পড়ে, সেই বলের প্রভাব পৃথিবীর অল্পদূর মাত্র সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। পৃথিবীর মহাকর্ষ টান সম্পর্কে সাধারণত যেমন অনুমান করা হয়, তার চেয়ে অবশ্যই অনেক অনেক বেশি দূর পর্যন্ত তা বিস্তৃত। আপন মনেই বলে উঠলেন, এমনটা তো হতেই পারে, এই যে আকর্ষণ, তা একেবারে চাঁদের কক্ষপথ পর্যন্ত সক্রিয় যদি তাই-ই হয় তাহলে অবশ্যই তা চাঁদের গতিকেও প্রভাবিত করে।  

নিউটনের বন্ধু স্থানীয় এবং ফরাসি গণিতবিদ আব্রাহাম ডি ময়ভার্‌-এর বর্ণনায়, আপেল পড়া অংশটি কিন্তু ছিল নাযদিও তাঁর কাহিনিতে দেখা যায়, নিউটন বাগানে বসে ছিলেন, আর সেই সময় হঠাৎ করেই পৃথিবীর মহাকর্ষ টানের ভাবনাটা নিউটনের মাথায় উদয় হয় 

তবে, আপেল পড়ার গল্পটি জনপ্রিয় করার মূল কারিগর যিনি, তিনি ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক, ভলতেয়ার। Lettres philosophiques* এবং Elements de la philosophie de Newton – এই দুই গ্রন্থে, ভলতেয়ার নিউটনের যে ছবি আঁকলেন, সেখানে বিজ্ঞানী নিউটন একেবারে হিরোচন্দ্র-সূর্য-পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রদের নিয়ে যে অনন্ত বিশ্ব জগৎ এবং তাদের ঘিরে যুগ-যুগ ধরে মানব মনে যে অপার বিস্ময়, নিউটন যেন সেই রহস্য ভেদ করে ফেলেছেন আঠারো শতকের জনমানসে নিউটনের অতিমানবীয় চেহারাটা গেঁথে গেল। বিশেষ করে, আপেল গাছের নীচে বসে নিউটনের গ্র্যাভিটি আবিষ্কারের আখ্যানটি, আমজনতার চোখে তাঁকে লিজেন্ড করে তুলল।

নিউটনের জীবনীকার ডেভিড ব্রুস্টার সর্বপ্রথম, আপেল পড়া ও মহাকর্ষ সূত্রের আবিষ্কারের কাহিনিটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। মজার ব্যাপার হল, নিউটন নিজেই পছন্দ করতেন মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার প্রসঙ্গে এই গল্পটি বলতে। এমন একটি মহা আবিষ্কারের চাবিকাঠিটি, তিনি যে প্রাকৃতিক একটি ঘটনা থেকেই পেয়েছেন, তা বলতে পেরে হয়তো তৃপ্ত হতেন 

যা-ই ঘটুক-না কেন, মহাকর্ষ সূত্রের আবিষ্কার কিন্তু হঠাৎ করে সম্ভব হয়নি। ১৬৬৪ সালে কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতেই, সূর্যকে ঘিরে গ্রহদের পরিভ্রমণ সংক্রান্ত কেপলারের যে সূত্রাবলী, তার প্রতি আকৃষ্ট হন নিউটন পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের এবং সূর্যকে ঘিরে গ্রহদের চলন, ঠিক কীভাবে কেপলারের তিনটি সূত্র মেনে চলে,  তা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। উলস্‌থর্পের অখন্ড অবসরে, এবার নতুন করে এই বিষয়ে মনোনিবেশ করলেন। 

ইতিমধ্যে, বৃত্তাকার পথে গতিশীল কোনও বস্তুর উপর যে অপকেন্দ্র বল কাজ করে, তার গাণিতিক ফর্মুলা বের করে ফেলেছেন নিউটন সর্বপ্রথম, দেকার্তেই বৃত্তীয় গতির সমস্যাটি আলোচনা করেন এবং আবর্তনশীল বস্তু যে কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করে, সে কথা বলেন। একটি পাথরকে দড়ি বেঁধে ঘোরালে, দড়ির ওপর বাইরের দিকে একটি টান অনুভব করা যায়। নিউটন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে দেকার্তের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন। বাইরের দিকে ক্রিয়াশীল এই বলের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করলেও, এর গাণিতিক রূপ নির্ণয় করতে সক্ষম হননি দেকার্তে। গণিতে সুদক্ষ নিউটন, এই বলের রাশিমালাটি নির্ণয় করে ফেললেনএকটি বৃত্তস্থ বহুভুজ কল্পনা করলেন নিউটন, যার বাহুগুলিতে ক্রমান্বয়ে সংঘাতের ফলে একটি কণার গতি বজায় থাকে। এরপর অঙ্ক কষে বের করলেন, বহুভুজটির বাহুর সংখ্যা অসীম হলে, ওই সংঘাতের ফলে কত মানের বল সৃষ্টি হয় বহুভুজের বাহুর সংখ্যা অসীম হলে, তা যে একটি বৃত্তে পরিণত হয়, সে-তো গ্রান্থামের কিংস স্কুলেই শিখে নিয়েছিলেন নিউটন

ইতালীয় ভাষায়, ১৬৩২-এ প্রকাশিত গ্যালিলিওর বিখ্যাত বই, ‘Dialogo dei Massimi Sistemi’, সংক্ষেপে ‘ডায়ালগ’**, তার যে ইংরেজি অনুবাদ, ‘Dialogue on the great world systems’ (১৬৬১-তে টমাস সলস্‌বুরি অনুবাদটি করেন), নিউটন সেটি পড়েনতিনজন ব্যক্তির সংলাপের আকারে ‘ডায়ালগ’ লিখেছেন গ্যালিলিও। পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সূর্য ও গ্রহেরা আবর্তন করছে – টলেমির এই তত্ত্বকে খন্ডন করে, কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন এই বইতে। 

‘ডায়ালগ’-এর এক জায়গায়, তিন ব্যক্তির কথোপকথনের মাঝে, এক ব্যক্তি মন্তব্য করছেন – “পৃথিবীর ঘূর্ণনের দরুন যে কেন্দ্রাতিগ বলের সৃষ্টি হয়, তার জন্য, ভূ-পৃষ্ঠের বস্তুদের ছিটকে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না, তার কারণ হল, বস্তুদের উপর সক্রিয় মহাকর্ষ বল।”  

নিউটনের হাতে এখন একটি নতুন অস্ত্র প্রস্তুত – কেন্দ্রাতিগ বল বা অপকেন্দ্র বলের গাণিতিক ফর্মুলাটি নিউটন এবার এই অস্ত্রটি ব্যবহার করে, ‘মহাকর্ষ বলের জন্যই যে পৃথিবী পৃষ্ঠের বস্তুরা ছিটকে যায় না এবং কেন্দ্রাতিগ বল নাকচ হয়ে যায়’ – গ্যালিলিওর এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করলেন। অঙ্ক কষে দেখলেন, ভূ-পৃষ্ঠে কোনো বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল কেন্দ্রাতিগ বলের তুলনায় মহাকর্ষ বল প্রায় তিনশো গুণ বেশি শক্তিশালী! নিঃসন্দেহে, তরুণ বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কার, প্রকৃতির এক অপ্রত্যক্ষ সত্যের সুস্পষ্ট উপলব্ধি। 

উলসথর্পের খামার বাড়িতে নিভৃতে, এইসব মহা আবিষ্কারের কর্মকাণ্ড যখন ঘটে চলেছে, আইজাক নিউটন তখন মাত্র ২৩-২৪ বছরের এক যুবক। এই সময় মেকানিক্সের যাবতীয় গবেষণার কাজ সেরেছিলেন ‘ওয়েস্ট বুক’-এ। কিন্তু, আবর্তন গতি সংক্রান্ত গণনাটি করেছিলেন একখণ্ড পার্চমেন্ট কাগজের এক পিঠে। কাগজের উল্টোপিঠটি ব্যবহারের জন্য ধার নিয়েছিলেন তাঁর মা, হান্না হান্না হয়তো ভাবতেন, খামারের কত দরকারি হিসাবপত্র রয়েছে, সে-সব না করে, কেন-যে তাঁর এই পাগল ছেলেটি অদ্ভূত সব আঁক কষে কাগজপত্র নষ্ট করে!     

নিউটন আর একটি গণনা করলেন, যা রীতিমত চমকপ্রদ। সূর্যকে ঘিরে গ্রহদের গতি সংক্রান্ত কেপলারের যে তৃতীয় সূত্র, অর্থাৎ, ‘কোনো গ্রহের প্রদক্ষিণ কালের বর্গ, সূর্য থেকে গ্রহটির দূরত্বের ঘনের সমানুপাতিক’, এই সূত্রটি কাজে লাগিয়ে,  গ্রহের উপর ক্রিয়াশীল অপকেন্দ্র বল সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন – ‘সৌরজগতের কোনো গ্রহের উপর যে কেন্দ্রাতিগ বল ক্রিয়া করে, তার মান, সূর্য থেকে গ্রহটির দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয়‘  

রাতের আকাশে, গ্রহদের নিয়মিত চলাচল পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কেপলারের সূত্রাবলী এখন, কেপলারের সূত্র ও নিউটনের মেকানিক্স সংযুক্ত  হয়ে সৃষ্টি করল, একেবারে নতুন এক তত্ত্ব – দূরত্বের সঙ্গে কেন্দ্রাতিগ বলের বর্গের-ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক (inverse-square relation)  

গাছ থেকে আপেল পড়ার ঘটনা এবং কেন্দ্রাতিগ বলের এই বর্গের-ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক, যুবক নিউটনের মনে মহাকর্ষ সম্পর্কে যে ধারণা গেঁথে দেয়, তা অবিকল রয়ে যায় দু-দশক পরও, যখন নিউটন তাঁর বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্রটি আবিষ্কার করবেন।  

(চলবে)

অলঙ্করণঃ সৌহার্দ্য চক্রবর্তী

সূত্রনির্দেশ 

 

  1. R. S. Westfall, Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980
  2. R. Iliffe, Priest of Nature, Oxford University Press, New York, 2017 
  3. A. R. Hall, Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996
  4. Voltaire’s Myth of Newton by Julia L. Epstein, Pacific Coast Philosophy, Vol-14, pp-27-33, 1979
  5. https://cudl.lib.cam.ac.uk/view/MS-ADD-04004 (MS Add. 4004, Cambridge, UK)
  6. http://www.newtonproject.ox.ac.uk/view/texts/normalized/PERS00001 (R.4.48c, Trinity College Library, Cambridge, UK)

* ১৭২৬ থেকে ১৭২৯ এই সময়কালে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ভলতেয়ারের যে সকল অভিজ্ঞতা, তা নিয়ে লেখা কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন হল ‘Lettres philosophiques’। 

** ইতালির সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞান ভাবনা পৌঁছে দিতে, গ্যালিলিও ইতালীয় ভাষায় লিখেছিলেন ‘ডায়ালগ’ বইটি

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment