টাঁকশালের দায়িত্বে নিউটন
১। ‘দ্য গ্রেট সিলভার রিকয়েনেজ’
১৬৯৬-এর মার্চ মাসের শেষদিক। দুটি ঘোড়া-টানা গাড়ি এসে থামল লন্ডন টাওয়ারের ভিতরে। তার একটি থেকে নেমে এলেন টাঁকশালের নতুন ওয়ার্ডেন – মিস্টার আইজাক নিউটন। অপর গাড়িটি বাক্স-প্যাঁটরা ও বিস্তর বইপত্রে বোঝাই। টাঁকশালের সমস্ত প্রশাসনিক পদাধিকারীদের থাকার বন্দোবস্ত টাওয়ারের মধ্যেই। নতুন ওয়ার্ডেন এতদিন ছিলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্রোড়ে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থলে। গণিতের স্বনামধন্য অধ্যাপক রূপে। এখন তিনি বেছে নিয়েছেন এমন এক প্রশাসনিক পদ, যার প্রধান কাজ জালমুদ্রার-কারবারি সন্দেহে ধৃত ব্যক্তিদের অপরাধ বিচার। টাওয়ারের মধ্যে অপ্রশস্ত পাথুরে রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ কুঠির একটি বরাদ্দ রয়েছে ওয়ার্ডেন-এর জন্য। নতুন ওয়ার্ডেনের একেবারেই পছন্দ হল না অপরিচ্ছন্ন, পাথরে মোড়া, ঘিঞ্জি পরিবেশ।
টাওয়ারের ভিতরেই আর একটি অংশ ব্যবহৃত হয় সামরিক অস্ত্র-সস্ত্র, কামান ও গোলা-বারুদ মজুদ করতে। যুদ্ধের ঘোড়া ও সৈনিকদেরও থাকার বন্দোবস্ত ওখানেই। সবকিছু মিলিয়ে, বসবাসের একেবারেই অনুপযুক্ত পরিবেশ। টাঁকশালের অধিকাংশ অফিসারদের কোয়ার্টার তাই শূন্যই পড়ে থাকে। ভাড়া নিয়ে থাকেন টাওয়ারের বাইরে অন্য কোথাও। মাস চারেকের মধ্যেই, লন্ডন শহরের পশ্চিমপ্রান্তে, ওয়েস্টমিনস্টারের সেন্ট জেমস চার্চের কাছাকাছি একটি বাড়িতে উঠে গেলেন নিউটন। পরবর্তী দশ বছর তাঁর নতুন ঠিকানা হল, ৮৭ নং জের্মিন স্ট্রিট, সেন্ট জেমসেস্।
সতের শতকে, লন্ডন টাওয়ারের মধ্যেই রয়্যাল-প্রিজন ও রয়্যাল-মিন্ট ছিল ঠিক পাশাপাশি। সরকারি জেলখানার গায়েই স্থান পেয়েছিল টাঁকশালের প্রধান কার্যালয়। নিউটন যখন টাঁকশালের ওয়ার্ডেন-এর দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন, সেখানে তখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা। ইংল্যান্ডের ‘গ্রেট সিলভার রিকয়েনেজ’ শুরুর বছর ওই ১৬৯৬। এতকাল চলে আসা দেশের সমস্ত পুরনো রুপোর কয়েন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ণ উদ্যমে চলছে নতুন রুপোর মুদ্রা উৎপাদনের কাজ।
চালু রুপোর কয়েন বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে উইলিয়ামের সরকার। কেন? আসল রুপোর কয়েনের মধ্যে মিশে গেছে শয়ে-শয়ে নকল কয়েন। বিমুদ্রাকরণ ছাড়া গতি নেই।
ওদিকে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের আমলেই, ১৬৬২ নাগাদ, বন্ধ হয়েছে হাতুড়ি পিটিয়ে মুদ্রা নির্মাণের প্রাচীন পদ্ধতি। পরিবর্তে শুরু হয়েছে যন্ত্রের সাহায্যে রুপোর কয়েন তৈরি। তবুও, একই সঙ্গে দু-ধরণের মুদ্রাই চালু আছে প্রায় তিন দশক জুড়ে। সমস্যা হল, হাতে পেটাই কয়েনের কিনারা কোনো প্রকার বেড় দিয়ে নির্দিষ্ট করা নেই, যার সুযোগ নিয়ে অধিকাংশেরই গা থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে রূপো। অসাধু লোকজনের হাত ফিরি হয়ে গ্রোট, পেনি, শিলিং সব ধরণের কয়েনেরই কমেছে প্রকৃত ওজন। অপরদিকে, যন্ত্রে প্রস্তুত কয়েনে রয়েছে সঠিক পরিমাণ ধাতু। ওজনে ভারি নতুন কয়েন সহজে হাত ছাড়া করতে চায় না কেউই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দুশোটির মধ্যে বড়জোর একটি চকচকে নতুন রুপোর মুদ্রার দেখা মেলে। বাজারে আসা-মাত্র গায়েব হয়ে যায় নতুন কয়েন। তার বিশেষ এক কারণও আছে।
১৬৯০-এর দশকের ইংল্যান্ড। সোনার দামের নিরিখে রুপোর দাম, ইউরোপের আর সব দেশের তুলনায় বেশ কিছুটা কম। বিশেষত ফ্রান্স ও হল্যান্ডে, রুপোর মূল্য চড়া। চোরাকারবারিদের তাই পোয়াবারো। তারা ইংল্যান্ডের টাঁকশালের যন্ত্রে তৈরি হওয়া কয়েন সংগ্রহ করে এবং সেসব গলিয়ে, বানিয়ে ফেলছে রুপোর বাট। তারপর সেই রুপোর বাট ইংলিশ চ্যানেল পার করে চোরাপথে চালান করছে ফ্রান্স অথবা হল্যান্ডে। রুপোর বিনিময়ে প্যারিস বা অ্যামস্টারডামের বাজার থেকে সম্ভব হচ্ছে ইংল্যান্ডের যে কোনো বাজারের তুলনায় বেশি পরিমাণ সোনা কেনার। সেই সোনা নিয়ে চোরাকারবারিরা ফিরে আসছে লন্ডনে। আর তা বিক্রি করে মিলে যাচ্ছে আরো আরো বেশি রুপো। সেই সমস্ত রুপো পুনরায় গলিয়ে তৈরি হচ্ছে আরো বেশি সংখ্যক বাট। যা বিদেশ ঘুরে ফিরে আসছে বেশি বেশি পরিমাণ সোনা হয়ে। এ-এক আজব লোভনীয় চক্র। অর্থনীতি শাস্ত্রে, সম্পদ সৃষ্টির এমনতর অবিরাম গতিযন্ত্রের উদাহরণ বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই।
১৬৯০ নাগাদ অবস্থা সংকটময় হয়ে উঠল। পার্লামেন্ট-এর কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে বিশেষ তদন্ত কমিটি গড়তে হল মেরি ও উইলিয়ামের সরকারকে। কমিটির সদস্যেরা লক্ষ্য করলেন, মাত্র ছমাসের মধ্যেই ইংল্যান্ডের বাজার থেকে হাওয়া হয়ে গেছে প্রায় আট টন রুপো। এর সমস্তটাই ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে পৌঁছে গেছে ফ্রান্স অথবা হল্যান্ডের ধাতু ব্যাপারীদের হাতে।
অপরদিকে, সোনার গিনির জোগান নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু, এক গিনি সোনা মানে তো তিরিশ শিলিং! যেখানে ওই কালে এক শিলিং-এ পাওয়া যায় এক গ্যালন বিয়ার। আবার এক শিলিং মানে বারো পেন্স। এক পাউন্ড মাংসের দাম তিন পেন্স। তাই সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে চাই রুপোর মুদ্রা। পেনি অথবা শিলিং। সোনার গিনি নয়। চাই রুপোর খুচরো কয়েন। কিন্তু বিপদ হল, টাঁকশালে রুপোর জোগান প্রায় বন্ধের মুখে। রুপোর মুদ্রা উৎপাদন তাই কমছে দিনে-দিনে।
দেশের অন্দরে যখন অর্থের আকাল, ঠিক তখনই ফ্রান্সের আগ্রাসন ঠেকাতে কিং উইলিয়াম উঠেপড়ে লাগলেন সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপাতে। ১৬৯৫-এর মাঝামাঝি তখন। সাত বছর ধরে চলে আসা ফ্রান্সের সঙ্গে ক্ষমতা দখলের যে লড়াই তা জোরদার করতে উইলিয়াম তার সৈন্য সংখ্যা পঁচিশ হাজার থেকে বাড়িয়ে করলেন প্রায় এক লাখ। জোট বাঁধলেন ইউরোপের আর সব দেশের সঙ্গে। ওই সময় সমগ্র ইউরোপে, ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই ছিলেন সর্বশক্তিমান। তাঁর বিপুলাকায় সৈন্যবাহিনীর সামনে একক কোনো দেশ দাঁড়াতেই পারছে না। তৈরি হয়েছে তাই মহাজোট।
হাউজ অফ কমন-এর সমস্ত মেম্বারদের কাছে কাতর ভাবে অনুরোধ জানালেন উইলিয়াম, “সমুদ্র ও স্থল-পথে যুদ্ধ চালাতে, কমপক্ষে, আগের সেশনের অনুরূপ অর্থ ও রসদ বরাদ্দের অনুমোদন প্রয়োজন।’’
মহাজোটের অংশীদার হয়ে যুদ্ধের যে খরচ, ক্রমশ তা ইংল্যান্ডের রাজস্ব আদায়কে ছাড়িয়ে গেল। আর্থিক দিক থেকে ইংল্যান্ডের অবস্থা হয়ে দাঁড়াল অতীব ভয়াবহ।
সাথে যুক্ত হয়েছে জাল মুদ্রার সমস্যা। নকল রুপোর কয়েনে ভরে গেছে দেশ।
আর্থিক সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজতে ইংল্যান্ডের সরকার, দেশের ওই সময়কার কয়েকজন বিশিষ্ট দার্শনিক ও গণিতবিদ-দের পরামর্শ চাইলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন, জন লক, ক্রিস্টোফার রেন, জন ওয়ালিস। হ্যাঁ, এই তালিকায় আরও একজন অবশ্যই আছেন। তিনি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক, মিস্টার আইজাক নিউটন।
প্রিন্খিপিয়া প্রকাশের পর মিস্টার নিউটন তখন ইংল্যান্ডের উজ্জ্বলতম গণিতজ্ঞ। জাতীয় বিপর্যয়কালে তাঁর ডাক পড়বে না তা-কী হয়!
যদিও, এক্ষেত্রে মুখ্য পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন যিনি করেছিলেন তিনি দার্শনিক জন লক। অনেক আলোচনার পর রিকয়েনেজ বা পুনর্মুদ্রাকরণই একমাত্র কার্যকর প্রতিকার বলে বিবেচিত হয়। নিউটনের অভিমত ছিল, পুনর্মুদ্রাকরণের সময়, সব ধরণের কয়েনে রুপোর পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে, বাজার চলতি রুপোর দামের সঙ্গে সমতা আনা। অর্থাৎ, ডিভ্যালুয়েশনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন নিউটন। “Concerning the Amendment of English Coyns” এই শিরোনামে তাঁর মতামত লিখিতরূপে পেশ করেন নিউটন। তবে তাঁর এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। লকের পরামর্শক্রমে পুরনো মান বজায় রেখেই নেওয়া হয় পুনর্মুদ্রাকরণের কর্মসূচী।
ট্রেজারি অর্থাৎ, রাজকোষাগারের চ্যান্সেলর ও নিউটনের একসময়ের সহপাঠী, চার্লস মন্টেগু-র নেতৃত্বে ‘সিলভার রিকয়েনেজ’-এর কাজ শুরু হল ১৬৯৬-এর জানুয়ারি মাসে। নিউটন তখনও টাঁকশালের ওয়ার্ডেন নিয়ুক্ত হননি। অপরদিকে বিমুদ্রাকরণের ফলে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে চূড়ান্ত অস্থিরতা। মুদ্রার অভাবে কাজ-কারবার স্তব্ধ। রাজকোষাগার আর টাঁকশালের উচ্চপদস্থ আধিকারিক ও কর্মচারীদের ছুটেছে রাতের ঘুম।
এখন থেকে ভোর চারটেয় খুলে যায় টাঁকশালের সদর দরজা। বন্ধ হয় মধ্যরাত পেরিয়ে। কয়েক টন কয়লা জ্বালিয়ে চুল্লীতে রুপো গলানোর কাজ শুরু হয় ভোর থেকেই। সবগুলি রোলিং-মিল চালু হয়ে যায় একে-একে। রোলিং-মিল টানতে কাজে লাগানো হয় কমবেশি পঞ্চাশটি ঘোড়াকে। চুল্লীর ধোঁয়া, মিলের ঘড়-ঘড় শব্দ, আর ঘোড়ার মল-মূত্রের দুর্গন্ধে ভরে থাকে চারপাশ। নোংরা, অপরিসর জায়গায়, দিন ও রাত মিলিয়ে, পালা করে দুই শিফ্টে শ-তিনেক কর্মী কাজ করে। তবুও নতুন মুদ্রার যোগান যথেষ্ট হয় না। টাঁকশাল তার সবটুকু শক্তি নিংড়ে দিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে।
দেশজুড়ে মুদ্রার হাহাকার। সরকারের ভাঁড়ারও তলানিতে। দৈনিক কর আদায় প্রায় শূন্যের ঘরে ঠেকেছে। বাজারে মালপত্র কেনা-বেচার নূন্যতম অর্থ নেই মানুষের হাতে। জনগণের মধ্যে ছড়িয়েছে ভয়ানক আতঙ্ক। শোরগোল উঠছে, বিতাড়িত রাজা জেমসকে ফিরিয়ে আনা হোক ক্ষমতায়। তাঁর আমলেই সুখে ছিলেন ইংল্যান্ডবাসী।
দেশের এরকমই এক টালমাটাল সময়ে নিউটন, উপস্থিত হলেন লন্ডন টাওয়ারের টাঁকশালে।
মন্টেগুর প্রস্তাবে যখন রাজি হলেন, তখন তাঁর ধারণা ছিল, ওয়ার্ডেনই টাঁকশালের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদাধিকারী ব্যক্তি। কদিনের মধ্যেই সে ভুল ভাঙল। রয়্যাল-মিন্ট-এর মাথায় একজন নয়, রয়েছেন তিন-তিনজন অফিসার – মাস্টার, কন্ট্রোলার ও ওয়ার্ডেন।
সরকারি নির্দেশিকা অনুসারে, নতুন মুদ্রা উৎপাদনের দেখভালের প্রধান দায়িত্বে থাকবেন মাস্টার। অপরদিকে, ওয়ার্ডেন-এর কাজ হবে, টাঁকশালের সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর রাখা। এছাড়াও, ওয়ার্ডেনকে পালন করতে হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর এক দায়িত্ব, যার কথা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না নিউটন। এই পদাধিকারী ব্যক্তিই, টাঁকশালের একমাত্র ম্যাজিস্ট্রেট বা হাকিম। লন্ডন শহর ও শহরতলীর মধ্যেকার, জালমুদ্রার কারবারি অথবা আর্থিক দুর্নীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের তদন্তের ভার ন্যস্ত এই ওয়ার্ডেন-এর ওপরই।
জালমুদ্রার-কারবারি সন্দেহে ধৃত ব্যক্তিদের প্রথমে বন্দি রাখা হয় লন্ডন শহরের নিউগেট জেলখানায়। এই নিউগেট জেলখানার নাম শুনলে ভয়ে বুক হিম হয়ে যায় বিচারাধীন সকলেরই। এর মধ্যেকার প্রতিটি কারাগার যেন সাক্ষাৎ নরক। বন্দিদের রাখা হয় পশুর মতো। সহ্য করতে হয় অমানুষিক অত্যাচার। আর বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তার জন্য নির্ধারিত আছে চরম শাস্তি – প্রাণদণ্ড। মুদ্রা জাল করার যন্ত্র বানানো, অথবা জাল মুদ্রা তৈরি – রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে বিবেচিত হয়। দুক্ষেত্রেই অপেক্ষা করে আছে ফাঁসীকাঠ। সাজা-প্রাপ্ত আসামীকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় টাইবার্নে। সতের শতকে দুই রোমান রোডের সংযোগস্থলের এই টাইবার্ন ছিল ইংল্যান্ডের বধ্যভূমি। প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় টাইবার্ন-এ। অথবা পুড়িয়ে মারা হয় সেখানে।
চিঠিতে মন্টেগু লিখেছিলেন, ওয়ার্ডেন-এর বিশেষ তেমন কাজ নেই। যতটা সময় নিউটন উপস্থিত থাকতে পারবেন তার বেশি আর প্রয়োজন পড়বে না।*
তদন্তকারী অফিসারের কাজ সামলাতে হবে, এ-কথা তাঁকে তো জানানো হয়নি! চোর-জোচ্চর, ঠকবাজ, জালমুদ্রার চোরাকারবারি – এসব অপরাধীদের বিচার কী তাঁর কাজ! আর এতে বিপদও যে অনেক। কুৎসা, অপবাদ ছড়াবে তাঁর নামে। বাড়বে শত্রু সংখ্যাও।
মন্টেগু-র আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কি ভুল করলেন?
১৬৯৬-এর ২ মে। টাঁকশালের ওয়ার্ডেন পদে শপথ নিলেন নিউটন। ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে উচ্চারণ করলেন – কখনই কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাছে, মুদ্রা চক্রাকার করার এবং প্রান্ত নির্মাণের নতুন আবিষ্কার, যা-ই হোক-না-কেন, প্রকাশ করবেন-না তা।**
সিলভার-রিকয়েনেজ-এর দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত নিউটন। কিন্তু, ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ? এই দায়িত্ব ভার নিতে একেবারেই ইচ্ছুক নন তিনি। ট্রেজারির উচ্চ-পদাধিকারীদের চিঠি লিখলেন – “আমার পূর্বসূরিদের কারোর ওপর, জাল-কয়েন-কারবারিদের তদন্তের ভার ন্যস্ত হয়েছিল এমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি…আমার সবিনয় প্রার্থনা, এই দায়িত্বটি, মিন্টের ওয়ার্ডেন অফিসের সাথে যেন যুক্ত করা না-হয়। তদন্ত ভার ন্যস্ত সরকারের প্রতিনিধি, আইন-কর্মকর্তাদের ওপর। সলিসিটর জেনারেল-এর দায়িত্ব হওয়া উচিত। টাঁকশালের ওয়ার্ডেন-এর নয়।”
না, নিউটনের প্রার্থনা মঞ্জুর হল না। জুলাই মাসের শেষ দিকে ট্রেজারি জানাল, এই দায়িত্ব ওয়ার্ডেনকেই পালন করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, এই নির্দেশ আসে লর্ড-জাস্টিসেস-এর পক্ষ থেকে। রাজার প্রতিনিধি স্বরূপ পার্লামেন্টের সাতজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত লর্ড-জাস্টিসেস, তখন ইংল্যান্ডে প্রশাসনিক প্রধানের ভূমিকা পালন করছে। ১৬৯৪-এর ডিসেম্বরে মেরির মৃত্যুর পর উইলিয়াম বেশ কিছুদিন দেশ ছাড়া। ফ্রান্স বিরোধী জোট মজবুত করতে ইউরোপের অন্য সব দেশেগুলিতে যাচ্ছেন। রাজার অনুপস্থিতিতে, দেশের শাসন ভার তুলে দেওয়া হয়েছে লর্ড-জাস্টিসেস অর্থাৎ, আইন-কর্মকর্তাদের-এর হাতে।
নিউটনের ওজর আপত্তিতে কর্ণপাত করল না সেই লর্ড-জাস্টিসেস। তদন্তের প্রথম মকদ্দমা বরাদ্দও হয়ে গেল। টাঁকশালের ভিতর থেকে চুরি যাওয়া কয়েকটি ছাঁচ-এর অনুসন্ধান। রুপোর কয়েন তৈরির সময় এই ছাঁচ ব্যবহার করা হয়। নকল কয়েন-এর চোরাকারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সেই সংক্রান্ত সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে শেষমেশ মাঠে নামতেই হল নিউটনকে। তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে সকল তথ্য পৌঁছে দিতে, নিয়মিত হাজিরও হতে হল লর্ড-জাস্টিসেস-এর দরবারে।
হায়! কোথায় গ্রহ-নক্ষত্রদের মহাকর্ষ বিচার, কোথায় জড়বস্তুর গতিপথের হিসাব, আর কোথায়ই-বা গণিত-চর্চা! এ ভিন্ন এক জগৎ। ক্রিমিনালদের ওয়ার্ল্ড। অপরাধ দুনিয়ার চরিত্রেরা তাঁর কাছে অপরিচিত। তাদের মনস্তত্ত্ব সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। বৈজ্ঞানিকের আসন ছেড়ে তাঁকে হতে হবে গোয়েন্দা! চিহ্নিত করতে হবে আসল অপরাধী কারা!
কিন্তু, এই মুহূর্তে টাঁকশালের অগ্রাধিকার রিকয়েনেজ। আশু কর্তব্য নতুন মুদ্রার জোগান বাড়ানো।
একেবারে নিজস্ব ঘরানায় আরম্ভ করলেন নিউটন। বিগত তিন শতাব্দীব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নিদর্শন, হিসাব খাতা ও সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র ঘেঁটে, খুঁটিয়ে পড়লেন টাঁকশালের ইতিবৃত্ত। যা পড়েন তাই-ই লিখে রাখেন নিজের নোটবুকে। কয়েক হাজার পৃষ্ঠার হবে সেই সব লেখাপত্র।
নিউটনের বুঝতে অসুবিধা হল না, তাঁর পূর্বসূরিদের মধ্যে প্রায় সকলেই, ওয়ার্ডেন পদটিকে অলঙ্কৃত করেছেন নাম মাত্র। বিশেষ কোনো কাজ না করেই, বেতন নিয়ে গেছেন বছরে ৪১৫ পাউন্ড করে। ওয়ার্ডেন-এর অধীনে যে তিনজন ক্লার্ক রয়েছেন, কাজ চালাতে তাঁরাই যথেষ্ট। টাঁকশালের সুযোগ সুবিধার দেখভাল করে নিতে পারেন। নিত্যকার যা-যা প্রয়োজন, ঘোড়াদের খাবার কিংবা চুল্লীর কয়লা – এসবের জোগান রাখা নিয়ে ওয়ার্ডেনকে ভাবতে হয় না।
কিন্তু, এই কালটি তো সাধারণ নয়। দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে মুদ্রাসংকট। রাজাসন টলোমলো। নিউটন অনুভব করলেন, এই অসময়ে দেশের প্রয়োজন তাঁকে।
নতুন মুদ্রা উৎপাদন ও সরবরাহের মূল দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনি টমাস নীল। টাঁকশালের মাস্টার। অল্পদিনের মধ্যেই নিউটন বুঝলেন, লোকটি একেবারেই অকেজো। শুধু তাই-ই নয়। অধিকাংশ সময় কাটে জুয়ার আড্ডায়। রাজা-রাজরাদের জুয়ার আখড়া বানাতে ডাক পড়ে ওস্তাদ জুয়াড়ি নীলের। জুয়াড়িদের জুয়াড়ি বলা হয় নীলকে। টাঁকশালের কাজ চালাতে মজুত রেখেছেন ভাড়া করা কয়েকজন সহকারী। মুদ্রা উৎপাদন পিছু যে কমিশন পান তার ভাগ-বাটোয়ারা পায় সহকারীরা।
টাঁকশালের প্রতি নীলের এই অবহেলায় স্বভাবতই রুষ্ট নিউটন। টাঁকশাল পরিচালনার ভার কার্যত তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। রাশ ধরলেন শক্ত হাতে।
সবেমাত্র চারদিন হয়েছে, ওয়ার্ডেন পদে বসেছেন। ট্রেজারিকে লিখিত পরামর্শ দিলেন – প্রতিটি বিল পাশের আগে, কর্মীদের কাজের গুণমান যাচাই করে যেন অবশ্যই দেখা হয়।
একটি বিষয়ে খুবই অসন্তুষ্ট নিউটন। ওয়ার্ডেনের বেতন, মাস্টারের বেতনের চেয়ে কিছু কম। অমর্যাদাকর এই বেতন বৈষম্য। সম-বেতনের জন্য, ট্রেজারিতে চিঠি লিখে অনুরোধ জানালেন। ট্রেজারি বাধ্য হল অনুরোধ মানতে। ওয়ার্ডেনের বেতন, বেড়ে হল বছরে পাঁচশো পাউন্ড।
ঠিক পরের মাসেই, ট্রেজারিতে আর একটি চিঠি লিখলেন। এবারে অনুযোগ। আরও বেশি সংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ করা জরুরী টাঁকশালে, কিন্তু ট্রেজারি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করছে না।
ইতিমধ্যে, ট্রেজারি থেকে নির্দেশ এসেছে, সাপ্তাহিক উৎপাদন দুই থেকে তিন-গুন বৃদ্ধি করার। বছর দুয়েকের মধ্যেই সম্পূর্ণ করতে হবে পুনর্মুদ্রাকরণ। ওই মুহূর্তে যা প্রায় অসম্ভব এক টার্গেট।
টাঁকশালের যেরকম অবস্থা, তাতে সপ্তাহে বড়জোর পনের হাজার পাউন্ড কয়েন উৎপাদন সম্ভব। মনে মনে হিসাব কষলেন নিউটন। এই হারে চললে, পুনর্মুদ্রাকরণ সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে প্রায় ন-বছর! সত্তর লক্ষ পাউন্ড রুপোর কয়েন উৎপাদন করা গেলে তবেই সম্পূর্ণ হবে সিলভার-রিকয়েনেজ। টাঁকশালের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতেই হবে। বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কেনা প্রয়োজন। চাই আরও লোক-লস্কর।
প্রথমেই, ধাতু বিগলনের জন্য নিউটন গড়ে তুললেন দুটি নতুন ফার্নেস। এখন থেকে মোট পাঁচটি ফার্নেসে, প্রতিদিন পাঁচ টন বিশুদ্ধ তরল রুপো প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।
কিন্তু, এই বিপুল পরিমাণ তরল রুপোর স্রোতকে, মুদ্রার রূপ দিতে পরবর্তী ধাপে যথেষ্ট সংখ্যক যন্ত্রপাতি রয়েছে তো? অর্ধ-শতাব্দী প্রাচীন ক্ষয়িষ্ণু সব যন্ত্রপাতি। সংখ্যায়ও অপ্রতুল। আটটি নতুন রোলিং মিল, আর পাঁচটি কয়েন-প্রেস কেনার অর্ডার দিলেন নিউটন।
রুপোর বাট থেকে রুপোর পাত তৈরি করা হয় রোলিং মিলে। রোলিং মিল ঘোরাতে কাজে লাগানো হয় ঘোড়াদের। নিউটন লক্ষ্য করলেন, মুদ্রা নির্মাণের গতি নির্ভর করছে অন্যত্র। একেবারে শেষ ধাপটিতে। যেখানে ভারি ক্যাপ্সটন মিশিনে ছাপ দেওয়ার কাজ হয়। প্রতি মিনিটে কতগুলি মুদ্রায় ছাপ দেওয়া সম্ভব তার আন্দাজ পাওয়ার জন্য, নিজের হাতের নাড়ি টিপে পরীক্ষা করলেন নিউটন। যে কর্মচারীটি ভারি ক্যাপ্সটন প্রেস-এর নীচে হাতের আঙুল বাঁচিয়ে মুদ্রার পিঠ উল্টে দিচ্ছে, এ-হল সেই ব্যক্তির ক্ষিপ্রতার পরীক্ষা। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের চেয়ে সামান্য কম এই ছাপ দেওয়ার হার। মিনিট প্রতি ৫০ থেকে ৫৫ বার মুদ্রায় স্ট্যাম্প দেওয়া সম্ভব। যন্ত্রের গতি ও সময়ের সম্পর্কের পরিমাপ ইতিপূর্বে হয়নি কখনো। গোটা টাঁকশালকে এই ছন্দে বাঁধলেন নিউটন।
স্পষ্টত, সুতীব্র পর্যবেক্ষণ ও নিরলস প্রয়াসে মুদ্রা নির্মাণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ের ওপর অর্জন করলেন চূড়ান্ত দক্ষতা। কেমব্রিজের গবেষণাগারে বছরের পর বছর রাত-দিনের অমানুষিক পরিশ্রম চরিত্রে এনে দিয়েছে যে কঠোরতা, তা আরোপ করলেন রয়্যাল মিন্ট-এ ধাতুকে মুদ্রার রূপ দিতে। এমন কঠোরতা, এমন শৃঙ্খলাপরায়নতা, আগে কখনো দেখেনি এই টাঁকশাল।
দেশের এমন আর্থিক দুর্দশার মধ্যেও কিছু ধনী ব্যবসায়ী যেমন পারছে লুঠ করছে। নিউটন তাঁর এক সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে যাচাই করে দেখলেন, ধাতু গলানো ও পরিশোধনের জন্য যেসব স্বর্ণকারদের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, তারা কমপক্ষে চল্লিশ শতাংশ অতিরিক্ত মুনাফা লুঠছে। সরকারের কাছে এই মর্মে একটি রিপোর্টও জমা দিলেন নিউটন।
যতক্ষণ-না নিজের চোখে দেখছেন, যতক্ষণ-না নিজের হাতে হিসাব কষছেন, ততক্ষণ অবিশ্বাসী তাঁর মন। তাঁর ডেপুটিদেরও সেই মোতাবেক চলার নির্দেশ দিলেন – “… nor any other eyes than your own”। স্বাভাবিক নিয়মেই অল্পদিনের মধ্যেই অনেকের বিরাগভাজন হতে হল নিউটনকে।
কিন্তু তিনি যে ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করেছেন! এই রয়্যাল মিন্ট-এ রাজার প্রতিনিধি তিনি! কঠোর তাঁকে তো হতেই হবে।
টাঁকশালের সকলেরই কি অপ্রিয় হয়ে উঠলেন নিউটন? না, এমনটি ধরে নিলে ভুল হবে। নতুন ওয়ার্ডেন-এর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠল কয়েকজন নিষ্ঠাশীল ক্লার্ক ও অফিসারের। নিউটনেরও অগাধ ভরসা ও বিশ্বাস তাঁদের ওপর। এঁদের একজন টমাস হল। এই আধিকারিকের দক্ষতায় মুগ্ধ হলেন। আরো একজন নিউটনের বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন। জন ফ্রান্সিস ফকিয়র। নিজের ডেপুটি হিসাবে রাখলেন তাঁকে টানা দু-দশকেরও বেশি সময়। পরবর্তীকালে, এঁকেই নিজের ফাইনান্সিয়াল এজেন্ট নিয়োগ করেন নিউটন।
মুদ্রা উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে, শহরতলী এলাকায় আরো পাঁচটি টাঁকশাল বা কান্ট্রি-মিন্ট গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয় নিউটন আসার আগেই। কিন্তু তা বাস্তবায়িত করা যাচ্ছিল না। এই পাঁচটি টাঁকশাল চালু করার অতিরিক্ত দায়িত্ব নিউটনকে নিতে হল। দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মধ্যেই ওই টাঁকশালগুলিতে শুরু হয় মুদ্রা উৎপাদনের কাজ। কান্ট্রি-মিন্টগুলি দেখভালের জন্য পুরনো একজন ক্লার্ক, হপটন হেইন্স-এর বিশেষ সহযোগিতা পেলেন নিউটন। ইংল্যান্ডের পুনর্মুদ্রাকরণ নিয়ে এই হপটন হেইন্স-এর স্মৃতিচারণামূলক একটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে যা থেকে ওই সময়কার ঘটনাপ্রবাহের স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া সম্ভব। শহরতলীর টাঁকশালগুলি পরিচালনার জন্য নিযুক্ত হলেন বেশ কয়েকজন ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকও। রয়্যাল মিন্টের অফিসারদের ডেপুটি হিসাবে কাজ করবেন তাঁরা। বন্ধু এডমন্ড হ্যালিকে ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক হিসাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করলেন নিউটন। হ্যালির কাছে অশেষভাবে ঋণী তিনি। অল্প হলেও কিছু তার শোধ হল।
দেশের বিপর্যয়ের মুখে আক্ষরিক অর্থেই, নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন নিউটন। ১৬৯৬-এর গ্রীষ্মে, মুদ্রা নির্মাণের প্রতিটি ধাপের দক্ষতা বৃদ্ধি ও দিন-রাতের নজরদারিতে উৎপাদন হার বেড়ে দাঁড়াল সপ্তাহে এক লক্ষ পাউন্ড। বছর শেষে হিসাব কষে যা দেখা গেল, তা প্রায় অবিশ্বাস্য! মাত্র কয়েক মাসে নিউটনের তত্ত্বাবধানে যে পরিমাণ রুপোর কয়েন তৈরি হয়েছে তা ছাড়িয়ে গেছে পঁচিশ লক্ষ পাউন্ড। ১৬৯৭-এর শেষদিকে দেখা গেল ট্রেজারিতে জমা পড়া প্রায় সমস্ত রুপোই, রূপান্তরিত হয়েছে ঝকঝকে নতুন কয়েনে। আর, ১৬৯৮-এর মাঝামঝি, সম্পূর্ণ হল ইংল্যান্ডের ‘গ্রেট সিলভার-রিকয়েনেজ’।
যে-কোনো ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল ভাবে গড়ে তোলার, এক সহজাত প্রবণতা ছিল নিউটনের মধ্যে। একজন দক্ষ প্রশাসকের সমস্ত গুণাবলীর পরিস্ফুটন ঘটল রয়্যাল মিন্ট-এর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর।
সাধারণ মানুষের হাতে এখন পর্যাপ্ত নতুন মুদ্রা। রাজা জেমসকে ফিরিয়ে আনার কথা আর শোনা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে, ১৬৯৭-এর সেপ্টেম্বরে, ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই-এর সাথে সন্ধি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে রাজা উইলিয়ামের। এই সন্ধি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে পুনর্মুদ্রাকরণের সাফল্য হয়তো সরাসরিভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়। কিন্তু বছর-দুই আগে যে দুর্যোগ ঘনীভূত হয়েছিল, তা পঙ্গু করে দিতে পারতো সমগ্র দেশকে। সে-ভয় আর নেই। সর্বাধিক কৃতিত্ব কার, তা-আর কারো অজানা নয়।
পুনর্মুদ্রাকরণ কর্মসূচীর এমন অভূতপূর্ব সাফল্যে স্বাভাবিকভাবেই খুশি রাজকোষাগারের চ্যান্সেলর চার্লস মন্টেগু। বন্ধুর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বললেন, নিউটন না থাকলে পুনর্মুদ্রাকরণ কখনোই করতে পারতেন না তিনি।
হপটন হেইন্স-এর লেখা ইংল্যান্ডের রিকয়েনেজ বিষয়ক এক স্মৃতিকথায় নিউটন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে এই বলে – “this gentleman’s care we have seen it brought to that extraordinary nicety … as was never known in any reign before this”।
(চলবে)
সূত্রনির্দেশ
- S. Westfall – Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
- R. Hall – Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
- The Master of the Royal Mint: how much money did Issac Newton save Britain? – Belenkiy Ari, Journal of Royal Statistical Society, 2012, Volume 175, Part 4, pp 1-18.
- Levenson – Newton and the Counterfeiter, Cengage Learning, Inc, 2010.
* “… has not too much business to require more attendance than you may spare.”
**“would never reveal to any person whatsoever the new Invention of Rounding the money and making the edges of them.”