প্রথমবার পার্লামেন্টের সদস্য হলেন নিউটন
প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশ পাওয়ার খবর হ্যালির চিঠি পড়ে জানতে পারেন নিউটন। ৫ জুলাই, ১৬৮৭-তে লেখা সেই চিঠি। হ্যালি জানান, নিউটনের তরফ থেকে প্রিঙ্কিপিয়ার কপি, রয়্যাল সোসাইটিকে এবং লন্ডনের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মিস্টার বয়েল, মিস্টার প্যাগেট ও মিস্টার ফ্ল্যামস্টিডকে প্রদান করবেন তিনি।
হ্যালি তাঁর চিঠির সাথে কুড়ি কপি প্রিঙ্কিপিয়া পাঠান, যাতে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পরিচিত জনদের উপহার দিতে পারেন নিউটন।
হ্যালির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সে-কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্তও করেছেন প্রিঙ্কিপিয়ার মুখবন্ধে। নিউটন লিখেছেন, ‘মিস্টার এডমন্ড হ্যালি শুধুমাত্র যে ছাপার ত্রুটি সংশোধনে আমায় সাহায্য করেছেন অথবা প্রকাশনার ভার নিয়েছেন তা নয়, তাঁর বারং-বার উপরোধেই এই সৃষ্টি জনসমক্ষে আসতে পেরেছে।’
প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশের পর ইউরোপের বিজ্ঞানী মহলে একেবারে প্রথম সারিতে চলে এলেন নিউটন। তাঁর জীবনে এই বিশেষ মুহূর্তটি ছিল এক টার্নিং-পয়েন্ট। প্রাকৃতিক দর্শনের বিবর্তনে এই গ্রন্থটির ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রিঙ্কিপিয়া গ্রহণের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না সতের শতকের বিজ্ঞান। এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই মহা গ্রন্থটির প্রকাশের মধ্য দিয়ে, সূচনা হল এক নতুন যুগের।
১৬৮৭-র গোড়ার দিকে, ইউরোপ জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে প্রাকৃতিক দর্শনের এক ‘অতি-মানবীয় সৃষ্টি’ আসতে চলেছে। বলা বাহুল্য, এই প্রচার-কান্ডে হ্যালির ভূমিকাই মুখ্য। প্রকাশ লাভের ঠিক আগে ফিলজফিক্যাল ট্রানজ্যাকশন-এ প্রিঙ্কিপিয়ার পর্যালোচনা বের হয়। পর্যালোচনাটি যিনি লিখেছেন তাঁর নাম কোথাও উল্লেখ না-থাকলেও, স্পষ্ট বোঝা যায় এটির লেখক হ্যালি ভিন্ন অপর কেউ নয়। পর্যালোচনায় লেখা হয় – ‘মানব-মনের যে কী বিপুল ক্ষমতা, এই গ্রন্থটিই হল তার সর্বোত্তম নিদর্শন।’ পর্যালোচনাটি শেষ করা হয়েছে এভাবে – ‘একসাথে এত-সংখ্যক ও এত-মূল্যবান প্রাকৃতিক দর্শনের সত্যাবলী (Philosophical Truths), আবিষ্কৃত ও তর্কাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই গ্রন্থে, যা ইতিপূর্বে কখনো কোনো একক মানবের শ্রম ও ক্ষমতার দ্বারা সম্ভব হয়নি।’
প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশের পর, সমগ্র ব্রিটেনে প্রশংসার ঝড় বয়ে গেল। প্রিঙ্কিপিয়ার পাতা উল্টে, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ফেলোদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন, ‘এই গ্রন্থের যে-কোনো অংশের অর্থোদ্ধারের জন্য অন্তত সাত বছর অধ্যয়ন করতে হবে।’
তরুণ ব্রিটিশ গণিতবিদ, ডেভিড গ্রেগরি, নিউটনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চিঠি লিখলেন, ‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, বিশ্ববাসীর জ্ঞান উন্মেষণের লক্ষ্যে যে মানসিক যন্ত্রণা আপনি বহন করেছেন, তার তুলনা কোথাও নেই।’
প্রখ্যাত দার্শনিক ও রয়্যাল সোসাইটির ফেলো, জন লক, প্রিঙ্কিপিয়ার বিষয়বস্তু আয়ত্তে আনতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু, গাণিতিক দক্ষতা বিশেষ না-থাকায় লকের পক্ষে, প্রিঙ্কিপিয়ার মেকানিক্স বোঝা সম্ভব হল না। তখন তিনি, ডাচ জ্যোতির্পদার্থবিদ, খ্রিস্টিয়ান হাইগেনস-এর কাছে জানতে চাইলেন, ‘প্রিঙ্কিপিয়ায় যে-সব ম্যাথেমেটিক্যাল প্রপোজিশন অর্থাৎ গাণিতিক প্রতিজ্ঞার অবতারণা করেছেন নিউটন, সেগুলি আদৌ কি সঠিক?’
ইতিমধ্যে, তিন খন্ডের প্রিঙ্কিপিয়া হাইগেনসকে পাঠিয়েছেন নিউটন। সতের শতকে মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন প্রিঙ্কিপিয়ার গণিত বুঝতে সক্ষম ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাইগেনস অন্যতম। হাইগেনস, জন লককে জানালেন, নিউটনের ম্যাথেমেটিক্যাল প্রপোজিশনগুলি নির্ভুল।
এরপর জন লক, গাণিতিক অংশ সরিয়ে রেখে, চেষ্টা করলেন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নির্যাসটুকু আহরণের। প্রিঙ্কিপিয়ার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ বোধগম্য না হলেও, লকের বুঝতে অসুবিধা হল না, উজ্জ্বল এক মহারথীর আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বের বিজ্ঞানাঙ্গনে।
প্রিঙ্কিপিয়া যখন প্রকাশ পেল, প্রখ্যাত গণিতবিদ আব্রাহাম দ্য ময়ভ্যর-এর বয়স তখন একুশ। জন্মসূত্রে তিনি ফরাসি। বসবাস করেন লন্ডনে। পেশা গৃহশিক্ষকতা। গণিতের মাস্টারমশাই। প্রিঙ্কিপিয়ার পাতা উল্টে প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল, এর গণিত বুঝতে তাঁর সমস্যা হবে না। কিন্তু ক্রমে তিনি উপলব্ধি করেন, নিউটন যে-গণিতের অবতারণা করেছেন তা রীতিমত দুরূহ। এই অভিনব ধারার সাথে পরিচিত হতে অনেক পথ পেরোতে হবে তাঁকে। নিজের জন্য তিন খন্ডের প্রিঙ্কিপিয়া কিনলেন দ্য ময়ভ্যর ও গণিত-ঠাসা বেশ কিছু পৃষ্ঠা আলাদা করে খুলে নিয়ে সর্বক্ষণের জন্য রেখে দিলেন সাথে করে। দ্য ময়ভ্যর ও ডেভিড গ্রেগরি, ব্রিটেনের এই দুই তরুণ গণিত প্রতিভা, ক্রমে নিউটনের ঘনিষ্ঠ পরিমণ্ডলের সদস্য হয়ে গেলেন। দুই গুণমুগ্ধ শিষ্য।
ওই সময়কার আর একজন প্রখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ হলেন গিয়্যম দ্য লোপিতাল (Guillaume de l’Hopital)। প্রিঙ্কিপিয়ার প্রাকৃতিক দর্শন ও গাণিতিক সূত্রাবলীর বিপুল কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে গভীর বিস্ময়ে বলে ওঠেন , ‘তিনি কি খাওয়া-দাওয়া করেন? পান করেন? ঘুমোন? আর সব মানুষেরই মতন কি তিনি?’
নিউটনের ‘অতিমানবীয়-সৃষ্টি’ সর্বত্র যে সাদরে গৃহীত হল, তা কিন্তু নয়। রবার্ট হুক তো অগ্নিশর্মা। আস্ত প্রিঙ্কিপিয়া-ই যেন তাঁর হাত থেকে লুঠ করে নিলেন নিউটন! হুক নিরন্তর দাবি করতে থাকলেন, এই গ্রন্থের বেশ কিছু তত্ত্বের প্রকৃত স্রষ্টা তিনিই। এমনতর অভিযোগ ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী মহলে আর তেমন আমল পেল না। হুকের দাবি ক্রমশ গুরুত্ব হারালো। এখানে একটি প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়, প্রিঙ্কিপিয়া রচনায়, হুকের অবদান কি সত্যিই অস্বীকার করতে পারেন নিউটন?
১৬৮৮-তে, ইউরোপের ওই সময়কার তিনটি বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকায়, প্রিঙ্কিপিয়ার রিভিউ বের হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য, জার্মান বিজ্ঞান পত্রিকা, Acta Eruditoram-তে প্রকাশিত পর্যালোচনাটি। সুদীর্ঘ আঠারো পৃষ্ঠা জুড়ে বের হয় প্রিঙ্কিপিয়ার সার-সংক্ষেপ। এই পুস্তক পর্যালোচনার ছত্রে-ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে প্রশংসা, আর শ্রদ্ধা। অটো মেনক্যে (Otto Mencke) ছিলেন বিজ্ঞান পত্রিকাটির সম্পাদক। আর সুপ্রসিদ্ধ জার্মান গণিতজ্ঞ, গডফ্রিড উইলহেম লাইবনিৎজ, যাঁর সঙ্গে ক্যালকুলাসের প্রকৃত স্রষ্টা কে, তাই নিয়ে পরবর্তী দু-দশককালে নিউটনের বিবাদ চরমে পৌঁছয়, তিনি ছিলেন Acta Eruditoram-এর প্রধান কনট্রিবিউট্যর। লাইবনিৎজ-এর পেপার নিয়মিত প্রকাশিত হয় এই পত্রিকায়।
নিউটন তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন, নিকোলাস ফাতিও দে দ্যুইলার্ মারফত, প্রিঙ্কিপিয়ার কপি উপহার পাঠিয়েছিলেন লাইবনিৎজ-কে। লাইবনিৎজ তখন জার্মানির হ্যানোভার শহরে থাকেন। কিন্তু ওই সময় হ্যানোভার ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন, যে-কারণে প্রিঙ্কিপিয়ার কপি তাঁর হাতে পৌঁছতে অনেক সময় লাগে। যদিও তার আগেই Acta Eruditoram-এ প্রকাশিত প্রিঙ্কিপিয়ার সংক্ষিপ্তসার লাইবনিৎজ পড়ে ফেলেন।
নিউটনের গ্রন্থের মূল যে ধারণা, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমগ্র সেলেস্টিয়াল মেকানিক্স অর্থাৎ জ্যোতির্গতিবিদ্যা, তা ভ্রান্ত বলে মনে করলেন হাইগেনস ও লাইবনিৎজ, উভয়েই। বিনা-স্পর্শে দূর-স্থিত বস্তুদের মিথস্ক্রিয়া, ‘action at a distance’ – এই ছিল নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের ভিত্তি।
হাইগেনস, নিউটনের এই বিনা-স্পর্শে আকর্ষণ তত্ত্বকে অযৌক্তিক (‘absurd’) বলে অভিহিত করলেন। আর লাইবনিৎজ বিস্ময় প্রকাশ করলেন। গ্র্যাভিটি-কে ‘action at a distance’ রূপে কীসের ভিত্তিতে চিহ্নিত করলেন নিউটন! কেনই-বা গ্র্যাভিটির কারণ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন?
এ-প্রসঙ্গে বলতে হয়, নিউটন নিজেও তাঁর বিনা-স্পর্শে আকর্ষণ তত্ত্ব নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন। ১৬৯৩-এ ইংল্যান্ডের এক ধর্মতত্ত্ববিদ রিচার্ড বেন্ডলি (Richard Bentley)-কে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘…one body may act upon another at a distance through a vacuum without the moderation of anything else… is to me so great an absurdity that I believe no man who has in philosophical matters any competent faculty of thinking can ever fall into it. Gravity must be caused by an agent acting constantly according to certain laws… but whether this agent be material or immaterial is a question I have left to the consideration of my readers…’। অর্থাৎ, নিউটন এখানে স্বীকার করছেন, কোনো প্রকার ‘এজেন্ট’ বা মাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া, তফাতে থাকা দুটি বস্তুর পারস্পরিক ক্রিয়া-বিস্তার সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না, গ্র্যাভিটি যে ‘এজেন্ট’-এর সাহায্যে ক্রিয়া করে, তা কোনো পদার্থ বিশেষ, নাকি অপার্থিব অন্য কিছু। আর তাই, গ্র্যাভিটির উৎস সন্ধানের ভার, ছেড়ে দিতে চান পাঠকের হাতেই।
হাইগেনস ও লাইবনিৎজ, দেকার্তের ভর্টেক্স-মডেল বা ঘূর্ণি-তত্ত্বকেই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করলেন। এই তত্ত্ব বলছে, মহাকাশে শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। সৌরজগতের সমস্ত স্থান পদার্থ দিয়ে পূর্ণ। আর সেই সব পদার্থ, সূর্যকে ঘিরে প্রকান্ড ঘূর্ণিরূপে বেগবান। এই ঘূর্ণির কারণেই আবর্তিত হয় গ্রহরা।
ভর্টেক্স-তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে গ্রহদের গতির গাণিতিক রূপদানে সচেষ্ট হলেন লাইবনিৎজ। নিউটন উপস্থাপিত, ‘অরবিটাল-ডায়নামিক্স’-এর, একেবারে বিপরীতে অবস্থান করে তাঁর এই অভিনব প্রয়াস। প্রশ্ন হল, প্রিঙ্কিপিয়া পাঠই কী রসদ জোগাল লাইবনিৎজকে, এই প্রকার গবেষণায়? না, সে-কথা মানতে চাননি তিনি। এ যেন তাঁর স্বাধীন একেবারে নিজস্ব এক প্রয়াস।
পরবর্তীকালে লাইবনিৎজ জানান, বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দর্শন বিষয়ক সমস্যা যেগুলির সমাধান নিউটন তাঁর গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন, তা অনেক আগেই সমাধান করেছিলেন তিনি নিজের উদ্ভাবিত ক্যালকুলাসের সাহায্যে। ১৬৮৯-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে তিনটি গবেষণা পত্র Acta Eruditoram-এ প্রকাশ করলেন লাইবনিৎজ। ল্যাটিন-এ লেখা এই গবেষণা পত্র তিনটির শিরোনাম ছিল – “De lineis opticis, et alia”, “Schediasma de resistentia medii” এবং “Tentamen de motuum coelestium causis”। প্রথমটি আলোর প্রতিসরণ সংক্রান্ত, দ্বিতীয়টি বাধাযুক্ত মাধ্যমে বস্তুর গতি বিষয়ক। তৃতীয়টিতে, মহাকর্ষের কারণ ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করলেন ভর্টেক্স-তত্ত্ব। সেই সঙ্গে লাইবনিৎজ, তাঁর ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস-এর সাহায্যে বিপরীত বর্গের সূত্রটি প্রমাণ করলেন ও গ্রহ-উপগ্রহের উপবৃত্তাকার কক্ষপথে আবর্তনের গাণিতিক ব্যাখ্যা দিলেন।
লাইবনিৎজ-এর এই তিনটি পেপার পড়ে, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন হাইগেনস। হাইগেনস এক অর্থে লাইবনিৎজ-এর শিক্ষক। হাইগেনস-এর হাত ধরেই পরিচিত হয়েছিলেন ওই সময়কার আধুনিক গণিতের সাথে। তারপর লাইবনিৎজ নিজস্ব ঘরানায় গড়েছিলেন তাঁর ডিফারেন্সিয়াল ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস। লাইবনিৎজের এই ক্যালকুলাস, নাকি নিউটনের ‘ফ্লাক্সিওনস্’ ও ‘ফ্লুয়েন্টস্’ –দিনের আলো প্রথম দেখেছিল কোনটি? ইতিহাস প্রসিদ্ধ সেই বিবাদ পর্বের বীজ বপন হয়েছিল এই সময়ই।
যাইহোক, ইউরোপের বিজ্ঞানী মহল, প্রিঙ্কিপিয়া গ্রহণ করতে কুন্ঠা করেনি। তথাপি, এই গ্রন্থে উপস্থাপিত প্রায় প্রতিটি বিষয় ঘিরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছিল বিতর্ক।
নিউটন যখন তাঁর প্রিঙ্কিপিয়ার তৃতীয় খন্ড প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছেন, ঠিক সেই সময়, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হল, যা নিউটনকে তাঁর গবেষণাগার থেকে, তাঁর নিভৃত অধ্যয়ন কক্ষ থেকে বের করে, একেবারে জনসমক্ষে এনে ফেলল। বলা যায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন ইংলিশ রিভলিউশনে।
ইংল্যান্ডের রাজাসনে, ওই সময় রয়েছেন দ্বিতীয় জেমস্ যিনি রোমান ক্যাথলিক ধর্মের উগ্র সমর্থক। সেনা বাহিনী, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ইউনিভার্সিটির উচ্চ পদে এনে বসাচ্ছেন ক্যাথলিকদের।
১৬৮৭-র ফেব্রুয়ারিতে, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের হাতে এসে পৌঁছল এক রাজাদেশ। নির্দেশ পাঠানো হয়েছে, এম-এ ডিগ্রি প্রদান করতে হবে অ্যালবেন ফ্রান্সিস নামের এক ক্যাথলিক সন্ন্যাসীকে। কোনো প্রকার লিখিত পরীক্ষা বা শপথ গ্রহণ ছাড়াই। স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল, এম-এ ডিগ্রি লাভের পর, ইউনিভার্সিটির কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হবে ওই ক্যাথলিক সন্ন্যাসীকে। নিউটন, উপাচার্যকে পরামর্শ দিলেন, এই আদেশ যেন তিনি না মানেন – “Be courragious therefore & steady to the Laws & you cannot fail”। নিউটনের অভিমত হল, রাজার ব্যক্তিগত আদেশ কখনই স্ট্যাটিউটে লিপিবদ্ধ নিয়ম-কানুনকে নাকচ করে, অগ্রাধিকার পেতে পারে না। এবং রাজাদেশ অমান্য করার জন্য এক্ষেত্রে কেউ শাস্তিও পেতে পারে না। আরো বেশ কয়েকজন ফেলো এই অন্যায় হুকুমজারির বিরোধিতা করলেন। জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে, ‘An Account of the Cambridge Case’, এই শিরোনামে একটি পুস্তিকাও ছাপা হয়। সম্ভবত নিউটন নিজেই এটির রচয়িতা। নিউটনের কাগজ-পত্রের মধ্যে পরবর্তী সময় এই পুস্তিকার একটি খসড়া পাওয়া যায়, যার হস্তাক্ষর নিউটনের ছাত্র হাম্ফ্রের।
উপাচার্য, জন পিচেল (John Peachell) ও ইউনিভার্সিটির সিনেটের সদস্যরা, প্রত্যাখ্যান করলেন সেই রাজাদেশ। রাজদরবার থেকে পুনরায় একই নির্দেশ এসে পৌঁছল ইউনিভার্সিটিতে। ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে এবারেও জানিয়ে দেওয়া হল, প্রেরিত নির্দেশ কার্যকর করা সম্ভবপর নয়। কারণ, লিখিত পরীক্ষা বা শপথ গ্রহণ ছাড়া এম-এ ডিগ্রি প্রদান একপ্রকার আইন বিরোধী কাজ।
এবার রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়ে সমন জারি করলেন দ্বিতীয় জেমস্।
এই ঘটনার বছর কয়েক আগে, ব্রিটেনে, এক যাজকীয় বিচার ব্যবস্থা, Ecclestical Commission, চালু করেন দ্বিতীয় জেমস্। আর এর মাথায় বসান জর্জ জেফ্রিকে। রাজভক্ত জেফ্রি, ইতিপূর্বে, শতাধিক ব্যক্তির প্রাণদণ্ড দিয়ে ‘সুনাম’ কুড়িয়েছেন। তারই পুরস্কার সরূপ, Ecclestical Commission-এর প্রধান বিচারকের পদলাভ।
এখন, এই যাজকীয় কমিশনের কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল, উপাচার্য ও ইউনিভার্সিটির সকল প্রতিনিধিদের। ইউনিভার্সিটির সিনেট মিটিং-এ ঠিক হল, নিউটন ও ব্যাবিংটন-এর নেতৃত্বে আট সদস্যের প্রতিনিধি দল কমিশনের সামনে উপস্থিত হবে।
১৬৮৭, এপ্রিলের শেষ দিক। হ্যালি, প্রিঙ্কিপিয়া ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ দ্রুত সম্পূর্ণ করার জন্য তাড়া দিচ্ছেন প্রিন্টারদের। আর কয়েক মাসের মধ্যেই বের হবে প্রিঙ্কিপিয়া। ঠিক সেই সময়, ইউনিভার্সিটির নিয়ম-কানুন ঘেঁটে, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন নিউটন। লন্ডনে, Ecclestical Commission-এর সামনে উপস্থিত হতে হবে। চলছে তারই তোড়জোড়।
বিচারক জেফ্রি যে ভয়ঙ্কর প্রকৃতির মানুষ, সে-কথা জানতে বাকি নেই কারোর। পরবর্তীকালে, নিউটন তাঁর ভাগ্নি-জামাই জন কনদ্যুয়িতকে জানান, শুনানির আগেই উপাচার্যের প্রতিনিধি দলের অধিকাংশ সদস্যই আপসে মিটমাট করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সাহস জুগিয়েছিলেন, এই অন্যায় আদেশকে প্রতিহত করার জন্য।
এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে চলল বিচার পর্ব। শুনানির শেষে, বিচারক জেফ্রি রায় ঘোষণা করলেন। রাজাদেশ লঙ্ঘন করেছেন পিচেল। সেই অপরাধে, উপাচার্য পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল ও বেতন বন্ধ করা হল পিচেলের।
আইন ও যুক্তির ওপর ভরসা রেখে, নিজের মতো করে লড়েছিলেন নিউটন। কিন্তু, রাজ-আজ্ঞাবাহী কমিশন, তাঁর কথার যৌক্তিকতায় কর্ণপাত করেনি। বিচারের রায়, বিচারের আগেই নির্ধারিত ছিল।
ক্যাথলিক রাজার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে পরাজিত হলেও, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে প্রটেস্ট্যান্ট হিরো হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটল নিউটনের।
অপরদিকে, দ্বিতীয় জেমস্-এর রোমান-ক্যাথলিক-ধর্মপ্রীতি, কয়েক বছরের মধ্যেই, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করল তাঁকে। ১৬৮৮-র একেবারে শেষদিকে, এক রক্তপাতহীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয় জেমস্-এর শাসনের অবসান ঘটল।
১৬৮৯-এ দ্বিতীয় জেমস্-এর কন্যা দ্বিতীয় মেরি ও মেরির স্বামী এবং ডাচ প্রজাতন্ত্রের প্রশাসক তৃতীয় উইলিয়াম, যিনি William of Orange নামেই সমধিক পরিচিত, রাজাসনে বসলেন।
ইতিহাসের পাতায়, ক্ষমতার এই পালাবদল, ‘Glorious Revolution’ বা ‘গৌরবময় বিপ্লব’ হিসাবে চিহ্নিত। এই জয় প্রটেস্ট্যাণ্টদের জয়। তাঁদের বিশ্বাস, দ্বিতীয় জেমস্-এর ক্ষমতার অবসান ছিল পূর্বনির্ধারিত। ঈশ্বরের ভবিষ্যৎবাণী আগেই যেন শুনেছিলেন তাঁরা।
১৬৮৯-এর ‘কনভেনশন পার্লামেন্ট’, ব্রিটেনের শাসনভার, যুগ্মভাবে অর্পণ করল উইলিয়াম ও মেরির হাতে। শাসনভার হস্তান্তরের আগেই গঠন করা হয়েছিল ‘কনভেনশন পার্লামেন্ট’। প্রতিনিধিদের মধ্যে দু-জন নির্বাচিত হয়ে এসেছেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে। ইউনিভার্সিটির সিনেট মেম্বারদের ভোটে, যে দু-জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে এলেন, তাঁদের একজন, আইজাক নিউটন।
নির্বাচিত হওয়ার পরে-পরেই লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন নিউটন। ১৭ জানুয়ারি ১৬৮৯, যোগ দিলেন তৃতীয় উইলিয়াম-এর ডিনার-এ। এক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হল পার্লামেন্ট সেশন। ১৬৮৯-৯০-এর প্রায় পঞ্চান্ন সপ্তাহকাল নিউটন কাটালেন লন্ডনে।
পার্লামেন্ট-এর অদূরেই, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যে অ্যাংলিকান চার্চ আছে, তার কাছেই বাসা নিলেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আনাগোনা এখন লেগেই থাকে তাঁর বাসায়। এই নিউটন, আর আগের নিউটন-এ বিস্তর ফারাক। এখন তিনি আর কেমব্রিজের নিভৃতবাসী গবেষক নন। তিনি এখন প্রিঙ্কিপিয়ার রূপকার। বরেণ্য বিজ্ঞানী। সেই সঙ্গে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার। জীবন যাপনের ধরণে বদল তাই অনিবার্য।
ওই বছরই, অর্থাৎ ১৬৮৯-এ, নিজের একটি তৈলচিত্র আঁকালেন নিউটন। এখন তাঁর হাতে সময়ের অভাব আর নেই।
ওই সময়, লন্ডনের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হলেন, গডফ্রে নেলার (Godfrey Kneller)। এমন পোর্ট্রেট-শিল্পী আর দ্বিতীয়জন নেই। তাঁর হাতে চিত্রিত রাজা দ্বিতীয় চার্লসের প্রতিকৃতি, এনে দিয়েছে অঢেল সুখ্যাতি। রাজ চিত্রকর হয়েছেন তিনি।
এই গডফ্রে নেলারকেই পচ্ছন্দ হল নিউটনের। তাঁর তুলিতেই গড়ে উঠল নিউটনের প্রথম পোর্ট্রেট। নিউটনের বয়স তখন ছেচল্লিশ। এই প্রতিকৃতিটি থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। ইন্টেলেক্টের ছটায় উদ্ভাসিত এক ব্যক্তিত্ব। উজ্জ্বল নীলাভ দু-চোখ। শানিত মুখাবয়ব, ধারালো নাক, কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা রুপোলি চুল। ছবিতে সুস্পষ্ট, সৃষ্টিশীলতার চূড়ায় অবস্থান করছেন নিউটন এই সময়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ইনি-ই প্রিঙ্কিপিয়ার স্রষ্টা।
নিউটনের আরো তিনটি পোর্ট্রেট নেলার আঁকবেন, ১৭০২, ১৭২০ এবং ১৭২২-এ। ততদিনে সূর্য মধ্য গগনে। নিউটনের তৈলচিত্রগুলির মধ্যে, সন্দেহাতীতভাবে সেরাটি হল, ১৬৮৯-এর চিত্রটি।
পার্লামেন্টে নিউটনের ভূমিকা কেমন ছিল? না, এ-বিষয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, আগের অবস্থান কখনোই বদলাননি তিনি। প্রটেস্ট্যান্টদের পক্ষ নিয়ে, দ্বিতীয় জেমস্-এর অপসারণ এবং উইলিয়াম ও মেরিকে দায়িত্বভার প্রদানে, পূর্ণ সমর্থন জানান। ব্রিটেনে রোমান ক্যাথলিক ধর্মাচারণের বিপক্ষে, যে বিল আনা হয়েছিল তার সপক্ষেও যে মতদান করেছিলেন, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
কিন্তু, ‘আরিয়ানিজম’-এ বিশ্বাসী ব্যক্তিরা ধর্মদ্রোহী হিসাবে বিবেচিত হবে, এই মর্মে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, সেখানে নিউটনের অবস্থান কী ছিল? নিউটন নিজেই তো ‘আরিয়ানিজম’-এ ঘোরতর বিশ্বাসী! যদিও সেকথা প্রকাশ করেননি কখনো। তথাপি, আরিয়াসের একেশ্বরবাদ বিরোধীতা, তাঁকে যে প্রবল বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়।
পার্লামেন্টের কোনো বিতর্কে নিউটন অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়নি। পার্লামেন্টের ভিতরে, নিউটনের ভূমিকা ঠিক কেমন ছিল, সেই সংক্রান্ত একটি বহুল প্রচলিত অ্যানিকডোট আছে। নিউটনকে নাকি একবারই কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। কী বলেছিলেন? একটি জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা আসছিল। তিনি সেটি বন্ধ করে দিতে বলেন। ব্যাস এটুকুই।
কিন্তু, ওই সময় কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির উপাচার্যকে লেখা নিউটনের চিঠিগুলি পড়লে বোঝা যায়, এই গল্পটি সম্পূর্ণ সত্য হতে পারে না। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির জন্য বিশেষ অধিকার আদায়ে তিনি যে সচেষ্ট ছিলেন, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে ওই চিঠিগুলির মধ্যে।
‘কনভেনশন পার্লামেন্ট’ বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। তেরো মাস পর ভেঙে দেওয়া হয়। প্রথমবার পার্লামেন্টের সদস্য পদের মেয়াদকাল এখানেই শেষ হয় নিউটনের।
১৭০১-এ পুনরায় পার্লামেন্টের মেম্বার হবেন নিউটন। ওই সময় তিনি রয়্যাল মিন্ট-এর মাস্টার পদে রয়েছেন। সেসব অবশ্য এক দশক পরের কথা।
(চলবে)
সূত্রনির্দেশ
- R. S. Westfall – Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
- A. R. Hall – Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
- E. J. Aiton – Leibniz on Motion in a Resisting Medium, Archive for History of Exact Sciences, Vol. 9, No. 3 (1972)
- E. J. Aiton – The Vortex Theory of Planetary Motions, American Journal of Physics Vol. 41, No. 146 (1973)