নবব্রত ঘোষাল

নিউটন – ১১

প্রকাশ পেল ‘ফিলসফিয়াই ন্যাচারালিস প্রিঙ্কিপিয়া ম্যাথেমেটিকা’

 

মায়ের মৃত্যুর পর উলস্‌থর্প থেকে কেমব্রিজে ফিরেই নিউটন হাতে পেলেন রবার্ট হুকের একটি চিঠি। ১৬৭৯-র একেবারে শেষদিক। বিগত কয়েক বছর ডুবে ছিলেন থিয়লজি ও অ্যালকেমির গবেষণায়। হুকের চিঠি, বাধ্য করল থিয়লজি ও অ্যালকেমি চর্চায় সাময়িক বিরতি টানতে। গ্রহ-উপগ্রহদের কক্ষীয় গতির অন্তর্নিহিত কারণানুসন্ধান ও সেই সংক্রান্ত গণিত নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে গেলেন নিউটন। 

প্রায় একই সময়ে ঘটল এক বিরল মহাজাগতিক ঘটনা। ১৬৮০-৮১-র সন্ধ্যার আকাশে সুদীর্ঘ পুচ্ছ-বিশিষ্ট এক ধূমকেতুর আবির্ভাব, নতুন করে আকৃষ্ট করল নিউটনকে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায়।  

এর কয়েক বছর পর (১৬৮৪), তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, এডমন্ড হ্যালি, লন্ডন থেকে কেমব্রিজে এলেন এবং সেই প্রশ্নটি করলেন, যা শুধুমাত্র জ্যোতিষ্কলোকের রহস্য উন্মোচনই নয়, সমগ্র বিশ্বতত্ত্ব-নির্মাণে, ভাবনার গভীরে নিমজ্জিত করল নিউটনকে। বিশ্ব-প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের আহ্বান এর আগে একাধিক বার পেয়েছেন তিনি। সম্পূর্ণতা পায়নি কাজ। কিন্তু এবার আর পরিত্রাণ মিলল না। প্রায় তিনটি বছর দিবা-রাত্রির পরিশ্রমে, প্রদেয় যা-কিছু, যেন তা উজাড় করে দিতে হল।  

নিউটনের বিশেষ গুণমুগ্ধ হ্যালি, এমন-এক ‘অতি-মানবীয়’ সৃষ্টিতে নিজের ভূমিকার কথা স্মরণ করে বিস্মিত হতেন বার-বার। নিজেকে গ্রিক পুরাণের চরিত্র, ‘ইউলিসিস’-এর সঙ্গে, আর ট্রয় যুদ্ধের নায়ক, ‘অ্যাকিলিস’-এর সঙ্গে তুলনা করতেন নিউটনকে। ইউলিসিস দৈববাণী শুনেছিলেন,  অ্যাকিলিসকে ছাড়া ট্রয় নগরী রক্ষা করা যাবে না। ইউলিসিস তাই খুঁজে এনেছিলেন বীর অ্যাকিলিসকে। 

হ্যালিও যেন অন্তরালবাসী নিউটনকে প্রকাশ্যে আনলেন। যেন আবিষ্কার করলেন নিউটনকে।  

১৬৮৪-র গোড়ার দিক। হ্যালি, ক্রিস্টোফার রেন ও রবার্ট হুক, এই তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে একটি বিশেষ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হয় লন্ডনে। বর্গের ব্যস্তানুপাতিক নিয়ম (inverse-square-law)-এর অধীনে চলমান বস্তুর কক্ষপথ কেমন হবে? এ-প্রশ্নের উত্তর তখনকার মতো অমীমাংসিত রয়ে যায়। সমস্যাটির সমাধান যে আদৌ সহজ নয় তা অনুধাবন করে, ক্রিস্টোফার রেন ঘোষণা করলেন পুরস্কার। আবিষ্কারের স্বীকৃতি স্বরূপ উপহার দেওয়া হবে চল্লিশ সিলিং মূল্যের একখানি বই। সময় দিলেন দু-মাস। রবার্ট হুকের দাবি, এর সমাধান করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু তা কখনো প্রকাশ্যে আনলেন না। হুকের কথা বিশ্বাস করেননি, রেন বা হ্যালি, দুজনের কেউ-ই। 

হুক যে সত্য কথা বলেননি, তা সহজেই অনুমান করা যায়। হুকের পক্ষে সম্ভব ছিল না এ-প্রশ্নের গাণিতিক সমাধান নির্ণয়। দুটি বস্তুর মধ্যে সক্রিয় আকর্ষণ বল, তাদের মধ্যেকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে পরিবর্তিত হলে, এবং একটি বস্তুর ভর অপরটির তুলনায় নগণ্য হলে, হাল্কা বস্তুটির গতিপথ কী-প্রকার হবে, তা জানতে প্রয়োগ করতে হবে ‘ক্যালকুলাস’। 

কিন্তু গণিতের এই ব্রহ্মাস্ত্রটি তো রয়েছে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লুকাসিয়ান প্রফেসর-এর হাতে। হ্যালি অবশ্য সে-কথা জানতেন না। হ্যালি কেন, নিউটনের ঘনিষ্ঠ দু-একজন ছাড়া, এ-আবিষ্কার ওই সময় কেউ-ই প্রত্যক্ষ করেননি। ১৬৮৪-র নভেম্বরে, হ্যালির হাতে ন-পাতার যে পান্ডুলিপি, ‘De motu’, তুলে দিলেন নিউটন, তাতে ছিল কক্ষপথে আবর্তনরত গ্রহ-উপগ্রহদের গতিবিজ্ঞান। অরবিটাল-ডায়নামিক্স। 

নিউটনের যে ক্যালকুলাস অর্থাৎ, ‘ফ্লাক্সিওনস্‌’ ও ‘ফ্লুয়েন্টস্‌’, যা তিনি ছাত্রাবস্থায়, ১৬৬৫-৬৬-তে উদ্ভাবন করেন, প্রয়োগ করেছিলেন তা। 

আরো সঠিক ভাবে বললে, নিউটন তাঁর ন-পাতার পান্ডুলিপিতে এবং সমগ্র প্রিঙ্কিপিয়াতে, ‘ক্ল্যাসিকাল জিওমেট্রি’ অর্থাৎ, ধ্রুপদী জ্যামিতির রূপে ‘ক্যালকুলাস অফ ইনফাইনিটেসিম্যালস্‌’-এর প্রয়োগ ঘটান। ক্যালকুলাস-এর ‘অ্যালজেব্রিক ফর্ম’ প্রিঙ্কিপিয়ার কোথাও ব্যবহার করেননি। ক্যালকুলাস-এর এই ‘জিওমেট্রিক ফর্ম’, ‘ফ্লাক্সিওনস্‌’ ও ‘ফ্লুয়েন্টস্‌’-এর থেকে কিছুটা আলাদা। 

গ্রিক গণিতবেত্তা ইউক্লিড অনুধাবন করতে পারেননি, তাঁর ধ্রুপদী জ্যামিতি ধারণ করে আছে কী বিপুল সম্ভাবনা! যার পরিস্ফূরণ ঘটে ইউক্লিডের সময়ের থেকে প্রায় দু-হাজার বছর পর, নিউটনের হাত ধরে।   

ন-পাতার সংক্ষিপ্ত ‘De motu’-তে ছিল চারটি ‘থিয়োরেম’ ও অবাধে গতিশীল বস্তু সংক্রান্ত   পাঁচটি সমস্যার সমাধান। ‘De motu’-তে ‘সেন্ট্রিপেট্যাল ফোর্স’ বা ‘অভিকেন্দ্র বল’-এর সাধারণ প্রকৃতির (general nature) বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন নিউটন। কক্ষপথে আবর্তনরত যে কোনো বস্তুর উপর ‘অভিকেন্দ্র বল’ সক্রিয় থাকে সর্বদাই। গ্রহ ও উপগ্রহদের চলনে, এই ‘অভিকেন্দ্র বল’-এর জোগান দেয় গ্র্যাভিটি। 

গ্র্যাভিটি যে ইউনিভার্সের সর্বত্র সক্রিয়, সে-কথা ‘De motu’-তে লিখলেও, সূর্যকে ঘিরে ভ্রাম্যমাণ গ্রহদের নিজেদের মধ্যেকার আকর্ষণের প্রভাব কী হতে পারে তার উল্লেখ ছিল না।  

১৬৮৫-র জানুয়ারিতে ফ্ল্যামস্টিড-কে চিঠি লিখলেন নিউটন। জানতে চাইলেন, বৃহস্পতির উপগ্রহদের আবর্তনকাল ও তাদের কক্ষপথের ব্যাসার্ধের মাপ। সেই সঙ্গে, বৃহস্পতি ও শনি, এই দুই গ্রহের সংযোগ (Jupiter-Saturn Conjunction)-এর সময় এদের বেগের যে সব মান পরিমাপ করা হয়েছে, তা পাঠানোর অনুরোধও করলেন। 

গ্রহ-উপগ্রহের গতি সংক্রান্ত কেপলারের তিন-সূত্রেরই গাণিতিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। প্রয়োজনীয় মেকানিক্স গড়েছেন নিজের হাতে। এখন, বুঝতে চান গ্রহদের পারস্পরিক প্রভাবের সঠিক রূপটি। পারস্পরিক প্রভাবের ফল কী হতে পারে। 

ওই সময় জানা গিয়েছিল, কেপলার প্রকাশিত তালিকা, Rudolphine Tables-এ উল্লেখিত শনি-গ্রহের বেগের মান ত্রুটি-পূর্ণ। জ্যোতির্বিদরা লক্ষ্য করেছিলেন, সংযোগের ঠিক আগে, বৃহস্পতি, শনির যত কাছে আসতে থাকে, শনির বেগ ততই কমতে থাকে। শনিকে যখন অতিক্রম করে যায় বৃহস্পতি, তখন শনির বেগ আবার বাড়ে। নিউটন বুঝলেন, দুই গ্রহের মধ্যেকার আকর্ষণের ফলেই এমন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু, এর সঠিক গাণিতিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে? 

হ্যালিকে জানিয়েছিলেন, ‘De motu’ তখনই যেন ছাপা না হয়। সামান্য কিছু সংযোজন করতে চান তিনি। কিন্তু, প্রতিটি নতুন জিজ্ঞাসায় অন্বেষণের ক্ষেত্র হয়েছে প্রসারিত। ন-পাতার ‘De motu’, ল্যাটিন-এ গ্রথিত পাঁচশো দশ পাতার, তিন-খন্ডের বৃহৎ এক গ্রন্থের আকার নেয় বছর দুয়েকের মধ্যেই। 

একটু আগে যে প্রশ্নটির কথা বলা হল, তার উত্তর পাওয়া কতখানি দুরূহ, ওই সময় তা অনুমান করতে পারেননি নিউটন। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, এ-হল ‘থ্রি-বডি প্রব্লেম’ অর্থাৎ, তিন-বস্তুর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জনিত গাণিতিক সমস্যা। 

সূর্য ও পৃথিবী, কিংবা পৃথিবী ও চাঁদ, এরকম দুই বস্তুর পারস্পরিক গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষের ক্রিয়ায় যে আবর্তন তা হল ‘টু-বডি প্রব্লেম’। তার মেকানিক্স সম্পূর্ণতা পেয়েছে তাঁরই হাতে। 

কিন্তু ‘থ্রি-বডি প্রব্লেম’? 

বস্তুত, এই সমস্যাটির সাধারণ কোনো সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তখন তো তা জানা ছিল না। অনেক চেষ্টাতেও তাই সাফল্য অধরা রয়ে গেল। 

‘থ্রি-বডি প্রব্লেম’-কে তখন ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেন নিউটন। গ্রহ বা উপগ্রহদের কক্ষপথ সম্পূর্ণ উপবৃত্তাকার হয় না। সামান্য স্খলন বা বিচলন ঘটে। কক্ষপথের এই বিচলন (perturbation) জানা গিয়েছিল পর্যবেক্ষণ থেকে। বিশেষত পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের আবর্তনে ধরা পড়েছিল নানা অসঙ্গতি। প্রিঙ্কিপিয়ার দ্বিতীয় খন্ডে, চাঁদের গতির এই অসঙ্গতির ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন নিউটন ‘থ্রি-বডি প্রব্লেম’-এর প্রেক্ষাপটে।    

ওদিকে, রয়্যাল সোসাইটির তৎকালীন সেক্রেটারি, ফ্রান্সিস অ্যাস্টন, পরিমার্জিত পান্ডুলিপি পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠালেন। অ্যাস্টন পূর্বপরিচিত নিউটনের। ট্রিনিটির বন্ধু।  

প্রত্যুত্তরে, ১৬৮৫-র ফেব্রুয়ারি, বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নিউটন লিখলেন, ‘…নানান বিষয়ের অনুসন্ধানেই বিস্তর সময় চলে যাচ্ছে, অধিকাংশই কোনো কাজে আসছে না।’

ওই সময় মহাকর্ষ বলের যে সার্বজনীন প্রকৃতি, তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন নিউটন। ১৬৮৪-র গ্রীষ্ম থেকে ১৬৮৬-র বসন্ত, প্রায় দু-বছরের সময় কালে ফ্ল্যামস্টিডকে অন্তত ন-টি চিঠি লিখেছেন। জানতে চেয়েছেন, ১৬৮০-৮১-র ধূমকেতুর বিভিন্ন সময়ের অবস্থান। আরো একটি  বিষয়ের তথ্য পাঠাতে বলেছেন নিউটন। কয়েকবছর আগে, টেমস্-এর মোহনায় জোয়ার-ভাটা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ফ্ল্যামস্টিড। এই সম্পর্কিত আরো কিছু তথ্য চাইলেন নিউটন।

স্পষ্টত, মহাকর্ষের ধারণা শুধুমাত্র জ্যোতিষ্কদের চাল-চলন নিরীক্ষায় সীমাবদ্ধ রইল না, প্রসারিত হল ভূ-পৃষ্ঠের সকল বস্তুর, এমনকি সাগর-নদীর জলতলের গতি প্রকৃতির অনুসন্ধানেও।    

প্রিঙ্কিপিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডায়নামিক্স বা গতিবিজ্ঞান নিজের হাতে গড়ে নিতে হল নিউটনকে। বলা বাহুল্য, প্রিঙ্কিপিয়ার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় রচনার মতোই দুরূহ এ-কাজ। ‘De motu’-র মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কক্ষীয়-গতিবিজ্ঞান বা ‘অরবিটাল-ডায়নামিক্স’। ‘সিস্টেম-অফ-ডায়নামিক্স’ অর্থাৎ সাধারণ গতিবিজ্ঞান ছিল না সেখানে।  

১৬৮৫-র প্রথম ভাগে নিউটন তাঁর বিখ্যাত তিন গতিসূত্র স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে লিপিবদ্ধ করলেন। যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে তাঁর সনাতন বলবিদ্যা বা ‘নিউটনিয়ান মেকানিক্স’। 

প্রথম গতিসূত্রটির রূপদানই তাঁকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলে।  

প্রায় কুড়ি বছর আগে ছাত্রাবস্থায় দেকার্তের বইয়ে পড়েছিলেন পদার্থের জড়তা বা জাড্য-নীতি  (principle of inertia)। দেকার্তে লিখেছিলেন, প্রতিটি জিনিস-ই যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থাতেই সর্বদা থাকবে এবং যদি কখনো গতি-প্রাপ্ত হয় তাহলে, সর্বদা গতিশীল থাকবে।  

নিউটন তাঁর ‘ওয়েস্ট বুক’-এ ছাত্রাবস্থায়, প্রায় দেকার্তের অনুরূপে, দুটি ‘অ্যাক্সিয়ম’ বা স্বতঃসিদ্ধি লিখেছিলেন। প্রথমটি  কোনও বস্তু একবার গতিপ্রাপ্ত হলে সেটি আর থামবে না, যদি-না বাইরে থেকে কোনও কারণ তাকে বাধা দেয়। দ্বিতীয়টি, গতিশীল বস্তু সর্বদা সরলরেখায় চলবে যদি-না বাইরের কোনও কারণ তার গতিপথের বিচ্যুতি ঘটায়।  

প্রিঙ্কিপিয়ার প্রথম খন্ডে, এই দুই ‘অ্যাক্সিয়ম’কে একত্রিত করে প্রথম গতিসূত্রের রূপ দিলেন। এবার ‘অ্যাক্সিয়ম’ এর পরিবর্তে বসালেন ‘ল্য’ শব্দটি। 

প্রসঙ্গত, প্রিঙ্কিপিয়া রচনার গোড়ার দিকে, তিনটি নয়, গতিসূত্রের সংখ্যা ছিল মোট পাঁচটি। 

দুটি গতিশীল বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটলে, তাদের গতির পরিবর্তন কী প্রকার হয়, তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন ওই ১৬৬৫-তে, ছাত্রাবস্থায়। দেকার্তের দেওয়া বলের যে ধারণা, অর্থাৎ, গতিশীল বস্তুর মধ্যেই নিহিত থাকে ক্রিয়াশীল বল, নিউটন প্রথমে তা গ্রহণ করে তাঁর ‘ওয়েস্ট বুক’-এ লিখে রাখেন। কিন্তু, সংঘর্ষের পরীক্ষার ফলাফল বিচার করে, অনুধাবন করেন যে বলের বস্তু-নিরপেক্ষ এক অস্তিত্ব আছে। ওই সময় ‘ওয়েস্ট বুক’-এ লিখেছিলেন, বস্তুর গতির হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে প্রযুক্ত বলের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর। 

১৬৮৫-র পরিণত বিজ্ঞানী এ-বার, বস্তুর গতির সাথে যুক্ত করলেন নতুন এক ধারণাকে। বস্তুর মধ্যে যত পরিমাণ পদার্থ থাকে তাকে সংজ্ঞায়িত করলেন ‘mass’ অর্থাৎ ‘ভর’ রূপে। আর বস্তুর ভর ও বেগের সমন্বয়ে সৃষ্ট যে গতীয় ধর্ম তার পরিবর্তনের হারের সাথে সমানুপাতিক হয় প্রযুক্ত বল। তৈরি হল দ্বিতীয় গতিসূত্র।  

দুই বস্তুর সংঘর্ষে ওদের গতির যে সমান ও বিপরীতমুখী পরিবর্তন তার সাধারণীকরণ (generalization) -এর মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটল তৃতীয় গতিসূত্রের।  

১৬৮৫-র মধ্যভাগে সম্পূর্ণ হল ‘সিস্টেম-অফ-ডায়নামিক্স’। ভূ-পৃষ্ঠে পতনশীল বস্তু সম্পর্কিত গ্যালিলিও-র সূত্রাবলী ও মহাকাশে গ্রহ-উপগ্রহদের চলনে কেপলারের সূত্রাবলী, ধরা দিল নিউটন নির্মিত গতিবিজ্ঞানের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি রূপে।

১৬৮৫-র পাঁচ-ছ-টা মাস, ওয়েস্টার্ন সায়েন্সের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য এক অধ্যায়, যখন নিউটন গতিবিদ্যার আধুনিক তত্ত্বটি নির্মাণ করলেন।  

দেকার্তের যে ‘ভর্টেক্স-মডেল’ বা ঘূর্ণি-তত্ত্ব, যেখানে ধরা হয়, বিশ্বের সমস্ত স্থান বা স্পেস ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার পদার্থ দিয়ে পূর্ণ, তাকে সরিয়ে স্থান করে নিল গণিত-নির্ভর এক গতিবিজ্ঞান।    

প্রিঙ্কিপিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা মেলে, ‘action at a distance’ অর্থাৎ, বিনা-স্পর্শে, দূর-স্থিত বস্তুদের মিথস্ক্রিয়া। দেকার্তের ‘ভর্টেক্স-মডেল’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনা এই ‘action at a distance’। যা আহ্বান জানায় গণিতকে। 

দেকার্তের প্রিঙ্কিপিয়া ফিলসফিয়াই’ তখন সমগ্র ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞান গ্রন্থ। ফরাসি দার্শনিকের ‘প্রিঙ্কিপিয়া ফিলসফিয়াই’-কে চ্যালেঞ্জ জানাতেই যেন, নিউটন তাঁর প্রকৃতি বিজ্ঞান গ্রন্থটির নাম রাখলেন – ‘ফিলসফিয়াই ন্যাচারালিস প্রিঙ্কিপিয়া ম্যাথেমেটিকা’। গণিতের বিমূর্ত ভাষায় বিরচিত প্রিঙ্কিপিয়া। যাথার্থ প্রমাণে গণিতই শেষ কথা তাঁর কাছে।

যে ‘সিস্টেম-অফ-ডায়নামিক্স’ গড়েছেন, এবার ‘ইউনিভার্সাল গ্র্যাভিটেশন’-এর ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হবেন তিনি। গ্রহদের মতোই ধূমকেতুও যে একই প্রকার আকর্ষণ বলের অধীনে চলমান সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই তাঁর।    

নিউটনের মনোজগতে ‘ইউনিভার্সাল গ্র্যাভিটেশন’-এর স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। মহাকর্ষের কারণ কী হতে পারে? কেন সৃষ্টি হয় মহাকর্ষের? না, নিউটন এর কারণ অনুসন্ধান করলেন না। লিখলেন, মহাকর্ষ বস্তুর প্রকৃতিগত এক ধর্ম – “…arise from the universal nature of matter…”। স্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেন, মহাকর্ষ বলের গাণিতিক উপস্থাপনার কোথাও এর উৎপত্তির কারণ বিধৃত নেই। 

নিউটন লিখলেন, কোনো একটি ভারি বস্তুর ওজন, বস্তুটির মধ্যে যত পরিমাণ পদার্থ আছে তার সমানুপাতিক হয়। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন একটি পরীক্ষার পর। সোনা, রূপো, সীসা, কাচ, বালি, লবণ, জল, কাঠ এরকম বিভিন্ন পদার্থের সমান ওজনের কয়েকটি গোলক নিলেন। এরপর, সমান দৈর্ঘ্যের দোলক বা পেন্ডুলাম করে তাদের দোলনকাল মাপলেন। পরীক্ষায় দেখলেন, প্রতিটির দোলনকালই হুবহু সমান। বুঝতে অসুবিধা হল না, এরকম হতে পারে তখনই, যদি প্রতিটি গোলকের ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের কণাকে তাদের ভরের সমানুপাতে আকর্ষণ করে পৃথিবী। স্পষ্ট হল, অবাধে পতনশীল বস্তুরা কেন সমান দ্রুততায় নামে। গ্যালিলিও-র সেই সুবিখ্যাত পরীক্ষার ফলাফলের অন্তর্নিহিত কারণ অজানা রইল না আর।  

কেপলারের তৃতীয় সূত্র থেকেও যে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। নিউটন অঙ্ক কষে দেখলেন তা। সূর্য তার গ্রহদের অথবা বৃহস্পতি তার উপগ্রহদের যে বলে আকর্ষণ করে তা গ্রহদের বা উপগ্রদের ভরের একেবারে সমানুপাতিক। 

১৬৮৫-র কোনো এক সময়, বৈপ্লবিক এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন নিউটন। মহাবিশ্বের সকল বস্তুই একে অপরকে আকর্ষণ করছে। আর এই আকর্ষণ বল, বস্তুদুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও তাদের মধ্যেকার দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক। নিউটন গড়লেন তাঁর সুবিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্রটি। 

স্পষ্টত, এরকম যুগান্তকারী এক সূত্র ও তার ভিত্তি স্বরূপ একাধিক প্রপোজিশন বা গাণিতিক প্রতিজ্ঞা, উপপাদ্য, মাত্র ন-পাতার ‘De motu’-তে ধরানো সম্ভব ছিল না। প্রথমে, দু-খন্ডের গ্রন্থেই তাঁর সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক দর্শন সীমাবদ্ধ রাখবেন ভেবেছিলেন। তারপর ঠিক করলেন, বাধাযুক্ত মাধ্যমে বস্তুর গতির বর্ণনা, প্রথম খন্ডে না রেখে, রাখবেন দ্বিতীয় খন্ডে। আর তৃতীয় খন্ডে থাকবে ‘De motu’-তে উল্লেখিত গ্রহ, উপগ্রহ ও ধূমকেতুদের গতির বিস্তৃত গাণিতিক ব্যখ্যা –“System of the World”।     

১৬৮৬-র এপ্রিল মাস নাগাদ প্রিঙ্কিপিয়ার প্রথম খন্ডের পাণ্ডুলিপি, রয়্যাল সোসাইটিতে পাঠানোর মনস্থির করলেন নিউটন। 

ওদিকে, হ্যালি তখন রয়্যাল সোসাইটির ‘ক্লার্ক’ নির্বাচিত হয়েছেন সদ্য। সোসাইটির সভায় হ্যালি  জানালেন, নিউটনের লেখা প্রায় সম্পূর্ণ। এবার তাঁর পান্ডুলিপি প্রেসে পাঠানোর প্রস্তুতি নিতে হবে।

ঠিক এক সপ্তাহ পর, প্রথম খন্ডের পাণ্ডুলিপি, মিস্টার ভিন্সেন্ট নামক এক ব্যক্তি মারফত রয়্যাল সোসাইটিতে এসে পৌঁছল। 

সপ্তাহ-তিনেক পর, সোসাইটির সভায় নিউটনের প্রথম খন্ডের পাণ্ডুলিপি প্রকাশের পক্ষে সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যেরা মতদান করলেন। সেই সঙ্গে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন, অতুলনীয় এই  গ্রন্থটি নিবেদন করার জন্য। 

সে-কথা জানিয়ে নিউটনকে চিঠি লিখলেন হ্যালি, “Your Incomparable treatise intituled Philosophiae Naturalis Principia Mathematica, was by Dr Vincent presented to the R. Society …and they were so very sensible of the Great Honour you do them by your Dedication, that they immediately ordered you their most hearty thanks, and that a Council should be summoned to consider about the printing thereof… ”।

এ-কথা হ্যালি লিখলেন ঠিকই কিন্তু, সোসাইটির সেই সময়ের আর্থিক অবস্থা মোটেও সুবিধার নয়। অল্পদিন আগেই, ‘Historia piscicum’ (The History of Fishes)-শীর্ষক একটি বই প্রকাশনার সমস্ত ব্যয় বহন করতে গিয়ে সোসাইটির তহবিলে আর অবশিষ্ট বলতে প্রায় কিছুই নেই। 

জুন মাসে কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, “Mr. Newton’s book be printed, and that Mr. Halley undertake the business of looking after it, and printing it at his own charge… ”। অর্থাৎ, নিউটনের গ্রন্থের প্রকাশক খাতায় কলমে রয়্যাল সোসাইটি। কিন্তু প্রকাশনার ব্যয় ভার কার্যত বহন করলেন মিস্টার হ্যালি।  

প্রকাশনার এই আর্থিক বন্দোবস্তের কথা নিউটনকে না জানালেও, আর একটি অপ্রীতিকর বিষয় হ্যালিকে জানাতেই হল। 

রবার্ট হুকের দাবী, সূর্যকে ঘিরে আবর্তনরত গ্রহের উপর সক্রিয় আকর্ষণ বল যে ওদের মধ্যেকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হয়, সে-তো তাঁরই আবিষ্কার; তাঁর গবেষণা চুরি করেছেন নিউটন। 

রবার্ট হুকের ক্ষোভের কথা জানাতেই হল নিউটনকে। 

ইতিমধ্যে প্রিঙ্কিপিয়ার দ্বিতীয় বই লেখার কাজ সম্পূর্ণ। তৃতীয় বইটি লিখছেন এবং সেখানে বেশ কয়েকটি জায়গায় রবার্ট হুকের নাম রেখেছিলেন ঋণ-স্বীকার স্বরূপ। হ্যালির চিঠি পড়ে ক্রুদ্ধ নিউটন, দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া, প্রায় সবকটি জায়াগা থেকে কেটে দিলেন হুকের নাম। 

হুকের দাবি খন্ডন করে, ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ, ইসমায়েল বুলিয়ালদাস (Ismael Bullialdus)-এর নাম উল্লেখ করলেন নিউটন। বুলিয়ালদাসের আগে, কেপলারের অনুমান ছিল গ্র্যাভিটি দূরত্বের ব্যাস্তানুপাতিকে পরিবর্তিত হয়। বুলিয়ালদাসই সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ করেন, গ্র্যাভিটি দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক হারে পরিবর্তিত হয়। 

হ্যালিকে চিঠি লিখে জানালেন, “The third [Book] I now designe to suppress…”। প্রিঙ্কিপিয়ার তৃতীয় বইটি তিনি আর প্রকাশ করতে চান না।  

একইসঙ্গে লিখলেন, “…দর্শন এমন এক অবান্তর ঝগরুটে মহিলা যার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়া, মামলা লড়ার সামিল। অতীতেও এই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। আর এই এখন, যেই-না কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি তার, সাবধান বাণী শোনাচ্ছে সে আমায়।”

এ-কথা শুনে হ্যালির মনের অবস্থা কী হয়েছিল, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। তৃতীয় খন্ডেই তো  রয়েছে আসল আলোচনা। সমগ্র বিশ্বতত্ত্ব। ‘De motu’-তে ছিল তার আভাসটুকু মাত্র। 

হ্যালি, বলা যায় প্রায় হাত জোড় করে নিউটনকে অনুরোধ জানালেন যাতে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন তিনি। নিউটনকে চিঠিতে লিখলেন, “…not to let your resentments run so high, as to deprive us of your third book…”। 

বহু সাধ্যসাধনায় নিউটনকে শান্ত করলেন হ্যালি।  

নিউটনের রাগ হয়তো প্রশমিত হল, কিন্তু তৃতীয় খন্ডটি প্রকাশ করবেন কিনা, সে ব্যাপারে হ্যালিকে নিশ্চিত করে কিছু জানালেন না।  

নিউটন যা করলেন তা হল, তৃতীয় বইটি ঢেলে সাজালেন। সাধারণ্যের বোধগম্যতার বহু যোজন দূরের, জটিল গাণিতিক ভাষায় উপস্থাপন করলেন তাঁর মহাবিশ্ব-তত্ত্ব। অযোগ্য, গণিতে অক্ষম ও তর্ক-প্রবণ মানুষ জনের হাত থেকে যেন নিস্তার পেতে চান তিনি। স্পষ্টত, রবার্ট হুক-ই তাঁর   মানসিক পীড়ার কারণ। হুকের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে গণিতকেই ঢাল করলেন। 

ইতিমধ্যে প্রথম খন্ড ছাপার কাজ সম্পূর্ণ। বই-বাঁধাই চলছে প্রেসে। দ্বিতীয় খন্ডের পান্ডুলিপি,  ১৬৮৭-র মার্চ মাসের গোড়ার দিকে পৌঁছল সোসাইটির ঠিকানায়। প্রথম খন্ড যে প্রেসে ছাপা হয়েছে, হ্যালি সেখানেই পাঠালেন দ্বিতীয় খন্ডের পান্ডুলিপি।          

১৬৮৭-র এপ্রিল। তৃতীয় খন্ডের পান্ডুলিপি হাতে পেলেন হ্যালি। এই খন্ডে এমন এক আশ্চর্য আবিষ্কার রয়েছে যা কল্পনাও করতে পারেননি। বিস্ময়াবিষ্ট হ্যালি। প্রত্যক্ষ করলেন নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটি। এমন এক সূত্র যা মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রদের সুশাসিত চলনকে গাণিতিক সমীকরণে বাঁধে, তার হদিশ পাওয়া, কোনো মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব!  

তৃতীয় খন্ড ছাপার জন্য অন্য আর একটি প্রেস নির্বাচন করলেন হ্যালি। এতটুকুও সময় নষ্ট করতে চান না আর। 

৫ জুলাই, ১৬৮৭। নিউটনকে খবর পাঠালেন হ্যালি। ‘ফিলসফিয়াই ন্যাচারালিস প্রিঙ্কিপিয়া ম্যাথেমেটিকা’ প্রকাশিত হয়েছে। 

মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে, এমন মহামূল্যবান বিজ্ঞান-গ্রন্থ দ্বিতীয়টি আর হয়নি।

প্রিঙ্কিপিয়ার ভূমিকায় হ্যালি লিখেছেন একখানি কবিতা – “Ode to Newton”। আর সেখানে লিখেছেন একটি বাক্য, ‘Nec fas est propius mortali attingere Divos”

লাতিন ভাষায় লেখা এই কথাগুলির বাংলা তর্জমা এইরকম  

“ঈশ্বরের নিকটতম তিনি। সর্বশক্তিমানের কাছে এরচেয়ে নিকটে আর কোনো মানুষের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়।” 

(চলবে)

সূত্রনির্দেশ 

  1. R. S. Westfall – Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
  2. A. R. Hall – Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
  3. D. T. Whiteside – The Prehistory of the ‘Principia’ from 1664 to 1686, Notes Rec. R. Soc. Lond. 45, 11-61 (1991)

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment