নবব্রত ঘোষাল

নিউটন – ১০

প্রিঙ্কিপিয়ার প্রেক্ষাপট         

১৬৮৪-র আগস্ট মাস। ঘোড়াটানা একখানি গাড়িতে লন্ডন থেকে কেমব্রিজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন বছর আটাশের এক যুবক। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে ইতিমধ্যে কিছু নাম-ডাক হয়েছে এই যুবকের। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। জ্যোতির্বিজ্ঞানী যুবকটির নাম এডমন্ড হ্যালি। ভিতরে-ভিতরে বড় অস্থির হয়ে আছেন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তাঁর কিছু জরুরী কাজ আছে। কিন্তু সে-সব নয়, এমন এক প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে যা শান্তি দিচ্ছে না। এ-প্রশ্নের সমাধান তাঁর কাছে নেই। এমন-কি রয়্যাল সোসাইটির সভায় উপস্থিত প্রায় সকল বিজ্ঞানীই নিজেদের অপারগতার কথা জানিয়েছেন। হ্যালি জানেন, এর উত্তর মিলতে পারে একজনের কাছেই। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজের গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর – আইজাক নিউটন। আগের বছরই এক ধূমকেতুর গতিপথের বিষয়ে আলোচনা হয় তাঁর সাথে। সেই সূত্রে আলাপ। হ্যালির মনে এখন একটিই সংশয় – নিউটন কি তাঁর প্রশ্নের আদৌ কোনও উত্তর দেবেন? এই বিজ্ঞানীর অন্তর্মুখিতার কথা তাঁর অজানা নয়। এ-পর্যন্ত কোনও গাণিতিক আবিষ্কারই প্রকাশ্যে আনেননি। হ্যালির কৌচ এসে থামল ট্রিনিটির ‘গ্রেট গেট’-এর পাশে নিউটনের বাসার ঠিক সামনে।

হ্যালি জানতেন না যে একেবারে সঠিক সময়েই তিনি উপস্থিত হয়েছেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে বলা যায় এ-এক মাহেন্দ্রক্ষণ। 

১৬৭৯-র বসন্তে, নিউটন যখন থিয়লজি ও অ্যালকেমি চর্চায় নিমগ্ন, ওইসময় মা-হান্নার অসুস্থতার খবর পান। তৎক্ষণাৎ উলস্‌থর্প-এর খামার বাড়িতে যান নিউটন। জন কনদ্যুইত-এর বয়ান অনুযায়ী, তিনি নিজের হাতে কয়েক মাস মা-এর সেবা শুশ্রূষা করেন। কিন্তু হান্না স্মিথ মারা গেলেন জুন মাসে। নিউটনের যেন শেষ বন্ধনটুকু ছিন্ন হল। জ্যেষ্ঠ সন্তানের হাতে হান্না সঁপে গেলেন উলস্‌থর্প-এর জমিদারি আর সেইসঙ্গে তিন সৎ-ভাইবোনের দায়িত্ব। আজীবন সেই ভার বহন করেছেন নিউটন। 

অর্পিত সম্পত্তির সুষ্ঠু বন্দোবস্ত করতে লেগে গেল আরো চার মাস। নভেম্বরের শেষদিক। উলস্‌থর্প-এ প্রায় ছ-মাস কাটিয়ে ফিরে এলেন কেমব্রিজে। রবার্ট হুকের লেখা একখানি চিঠি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। ইতিমধ্যে রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি হেনরি ওল্ডেনবার্গ প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন রবার্ট হুক। হুকের সাথে বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনার দরজা দীর্ঘদিন বন্ধ রেখেছেন নিউটন। তার কারণও আছে। সাত বছর আগে নিউটনের আলোক সংক্রান্ত আবিষ্কারের তীব্র সমালোচনা করে প্রাওরিটি দাবি করেছিলেন হুক। সে-বিবাদ পর্ব ভোলেননি নিউটন। মাইক্রোগ্রাফিয়া গ্রন্থের লেখক হুক তখন ইউরোপের প্রথম সারির বিজ্ঞানী। অপরদিকে কেমব্রিজের অখ্যাত এক নবীন গবেষক, যিনি সমালোচনার ভয়ে যেকোন অভিনব ভাবনাই প্রকাশ্যে আনতে বার বার পিছিয়ে যান। তারই মধ্যে কিছু কাজ সদ্য জনসমক্ষে এসেছে, যার কৃতিত্ব দিতে অস্বীকার করেন হুক। তরুণ নিউটন, হুকের আচরণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও আহত হয়েছিলেন ওই সময়।  

নিউটন চিঠিটি খুলে পড়লেন। হুক লিখেছেন, রয়্যাল সোসাইটি ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সাথে নিউটন যেন আগের মতো তাঁর প্রাকৃতিক দর্শন সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করেন। বিনিময়ে সোসাইটিতে যে-সমস্ত নতুন কাজ হচ্ছে তা নিউটনকে জানানো হবে। চিঠিতে একইসঙ্গে, গ্রহদের কক্ষীয় গতি সংক্রান্ত তাঁর সদ্য উপস্থাপিত প্রকল্পের বিষয়ে নিউটনের মতামতও জানতে চেয়েছেন হুক। সম্ভবত এটিই চিঠির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হুকের এই প্রকল্প, বছর পাঁচেক পরই নিউটনের অমরকীর্তি প্রিঙ্কিপিয়ার জন্ম দেবে।  

১৬৭৪-এ প্রকাশিত, ‘Attempt to prove the motion of the Earth by Observation’ শীর্ষক গবেষণা পত্রে তাঁর নতুন প্রকল্পের তিনটি পূর্বানুমানের উল্লেখ করেন হুক। প্রথমটি এরকম – সকল মহাজাগতিক বস্তুরই নিজ কেন্দ্রের অভিমুখে আকর্ষণ ক্ষমতা আছে (‘…..have an attraction or gravitating power towards their own Centers…’), যার দ্বারা কেবলমাত্র নিজের দেহের বিভিন্ন অংশকে নয়, বস্তুটি তার প্রভাবক্ষেত্রে অবস্থিত সকল বস্তুকেই আকর্ষণ করবে। হুকের দ্বিতীয় অনুমানটি হল, যেকোনো বস্তু সরাসরি ও সরলরূপে গতিপ্রাপ্ত হলে এবং কোনো প্রকার ক্ষমতার দ্বারা বিঘ্নিত না হলে, তার গতির অভিমুখে সরলরেখা বরাবর চলতে থাকবে। আর ক্ষমতার দ্বারা প্রভাবিত হলে গতিপথ পাল্টে গিয়ে বৃত্তাকার, উপবৃত্তাকার অথবা অপর কোনো জটিল বক্ররেখা গঠন করবে। এবার হুকের তৃতীয় অনুমান। হুক লিখেছেন, কোনো বস্তু অপর কোনো বস্তুকে যে বলে আকর্ষণ করে তার মান, বস্তু দুটির কেন্দ্রের মধ্যেকার দূরত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত। হুক একই সাথে জুড়েছেন, এ-পর্যন্ত অবশ্য এই সম্পর্কের গাণিতিক রূপ তিনি পরীক্ষার সাহায্যে নির্ধারণ করেননি।  

তাঁর এই প্রকল্পে, সূর্যকে ঘিরে গ্রহ-উপগ্রহের বৃত্তাকার অথবা উপবৃত্তাকার গতিপথের রহস্যও যেন ভেদ করে ফেলেছেন হুক। হুকের মতে, কোনো বস্তু অপর কোনো স্থির বস্তুকে ঘিরে কক্ষপথে আবর্তিত হয় কারণ,   দ্বিতীয়টির কেন্দ্রের অভিমুখে সর্বদা একটি বল ক্রিয়া করে। কেন্দ্রাভিমুখী বলের প্রভাবে, গতিশীল বস্তুটি প্রতি মুহূর্তে তার স্পর্শক রেখা বরাবর যে গতিপথ তা থেকে বিচ্যুত হয় এবং বৃত্তাকার অথবা উপবৃত্তাকার কক্ষপথ রচনা করে। 

এখানে একটু থামতে হয়। গ্রহ উপগ্রহদের কক্ষীয় গতির যে ডায়নামিক্স হুক দিয়েছেন তা ছিল নির্ভুল। নিউটন আগে কখনো এভাবে ভেবে দেখেননি। নিউটনের ধারণা ছিল, গ্রহের উপর সক্রিয় কেন্দ্রাভিমুখী বল,  হাইগেনস্‌-এর সেন্ট্রিফিউগ্যাল বা অপকেন্দ্র বলের ক্রিয়ায় নাকচ হয় ও সম্ভব হয় সুস্থির কক্ষপথে আবর্তন। হুক নিউটনকে শেখালেন নতুন এক তত্ত্ব। হুক যেটা পারেননি তা হল, তাঁর এই ব্যাখ্যার গাণিতিক রূপদান। আর প্রিঙ্কিপিয়াতে সেটাই করবেন নিউটন। যে কেন্দ্রাভিমুখী বলের ক্রিয়ায় বস্তু সরলরৈখিক গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাকে ‘সেন্ট্রিপেট্যাল ফোর্স’ নামে অভিহিত করবেন সেখানে নিউটন। 

শুধুমাত্র ‘গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স’ বা মহাকর্ষ বলের গাণিতিক রূপদানই নয়, এর সার্বজনীনতার দিকটিও নিউটনের প্রিঙ্কিপিয়াতে থাকবে। হুকের প্রকল্পে ‘ইউনিভার্সাল গ্র্যাভিটেশন’-এর ধারণাটি ছিল না। তথাপি বলতেই হয়, ১৬৬৯-এর নভেম্বরের এই চিঠির মাধ্যমে নিউটনকে যেন রত্নভাণ্ডারের পথটি চিনিয়ে দিলেন তাঁর ‘চিরশত্রু’, রবার্ট হুক স্বয়ং।* 

হুকের চিঠির জবাবে নিউটন লিখলেন, বিগত ছ-মাস লিঙ্কনশায়ারের পারিবারিক বিষয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল তাঁকে যে প্রাকৃতিক দর্শন চর্চার এতটুকুও সময় পাননি। তাই এখনই তাঁর পক্ষে এই বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

স্পষ্টত, নিউটন রয়্যাল সোসাইটির সাথে আগের মতো আর যোগাযোগ রাখতে চাইছেন না, বিশেষত হুক সোসাইটির সেক্রেটারি হওয়ার পর। হুককে তিনি এখনও অপছন্দ করেন। আর বিশ্বাসও করেন না।     

নিউটন জানালেন, মহাজাগতিক গতি সংক্রান্ত হুকের প্রকল্পটির কথা শোনেননি তিনি। আর পত্র মারফত যোগাযোগ রাখার সময়ের বড় অভাব তাঁর হাতে। কারণ, অন্য বিষয়ের চর্চা করছেন তিনি (‘busy upon other things’)। ঠিকই, এই সময়টি ছিল নিউটনের থিয়লজি ও অ্যালকেমি গবেষণার কাল। 

এখানেই চিঠির ইতি টানতে পারতেন নিউটন। কিন্তু তা না-করে, পৃথিবী যে স্থির নয়, ঘূর্ণনশীল, তার প্রমাণ সরূপ একটি পরীক্ষার প্রস্তাব দিলেন নিউটন (‘…I shall comunicate to you a fancy of my own about discovering the earth’s diurnal motion…’)। রয়্যাল সোসাইটি বা হুকের প্রতি তিনি যে কোনও বিরাগ পোষণ করেন না তা বোঝাতেই যেন এই সংযোজন। আর এখানেই মারাত্মক এক ভুল করে বসলেন।

 নিউটন বর্ণিত পরীক্ষাটি ছিল এরকম – পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে অনেকটা (বিশ-তিরিশ গজ উচ্চতার টাওয়ারের) ওপর থেকে একটি ভারি বস্তুকে অবাধে ফেললে, সোজাসুজি লম্বভাবে না নেমে বস্তুটি, নিজের ‘গ্র্যাভিটি’ ও পশ্চিম-থেকে-পূর্বে পৃথিবীর ঘূর্ণনের মিলিত ক্রিয়ায়, যৎসামান্য পূর্বদিকে সরে যাবে এবং পৃথিবীকে একটি গোলকাকার বায়বীয় পিন্ড রূপে কল্পনা করলে, অবাধে পতনশীল বস্তুটি একপ্রকার ‘স্পাইরাল’ অর্থাৎ সর্পিল পথে ভূকেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হবে। চিঠিতে পতনশীল বস্তুটির গতিপথের একটি চিত্রও আঁকলেন নিউটন। নিউটনের যুক্তি হল, টাওয়ারের শীর্ষের স্পর্শক-বেগ পাদদেশের স্পর্শক-বেগের চেয়ে সামান্য বেশি হওয়ায় বস্তুটি পূর্বদিকে সরে মাটিতে এসে পড়বে।    

চিঠির শেষে লিখলেন, ‘ভালগার’-দের বক্তব্যের সাথে তাঁর প্রস্তাবিত পরীক্ষার ফলাফলের আদৌ মিল নেই। অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শনে বিশ্বাসী, ‘ভালগার’-দের অভিমত হল, পৃথিবী স্থির। তাঁদের বক্তব্য, পৃথিবী যদি পশ্চিম-পূর্বে ঘুরত,  তাহলে বস্তুটি মাটি ছোঁয়ার আগে ভূতল কিছুটা পূর্বে সরে যেত এবং তার ফলে পতনশীল বস্তুটি অভিলম্বের পশ্চিমে কিছুটা সরে গিয়ে মাটিতে পড়ত। ‘ভালগার’-দের মতের একেবারে বিপরীত ছিল নিউটনের অনুমান।** 

২৮ নভেম্বর ১৬৭৯-তে লেখা নিউটনের এই চিঠি, রয়্যাল সোসাইটির সভায় পাঠ করলেন রবার্ট হুক। উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন খ্রিস্টোফার রেন, জন হসকিন্স, এডমন্ড হ্যালি, জন ফ্ল্যামস্টিড। নিউটন প্রস্তাবিত পরীক্ষাটির পরিকল্পনা সাদরে গৃহীত হল সভায় – “This proposal of Mr. Newton was highly ap-proved of by the Society; and it was desired, that it might be tried as soon as could be with convenience.”। 

এর ঠিক এক সপ্তাহ পর হুক, নিউটনকে আর একটি চিঠি পাঠালেন। নিউটন বর্ণিত পরীক্ষা নয়, হুকের আপত্তির জায়গা হল, অবাধে পতনশীল বস্তুর ওই ‘স্পাইরাল’ গতিপথের কল্পনা। হুক বললেন এই গতিপথ ‘স্পাইরাল’ হবে না, হবে উপগোলীয় আকারের। আর ঘর্ষণজনিত-বাধা বা রোধের উপস্থিতিতে বস্তুটির গতিপথ ‘এলিপ্টিক-স্পাইরাল’ হবে এবং অনেকগুলি আবর্তনের পর কেন্দ্রে এসে স্থির হবে। চিঠিতে হুক নিউটনের আর একটি ভুল চিহ্নিত করলেন। পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে বস্তুটি পূর্বদিকে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিচ্যুত হবে।  

হুকের চিঠি পড়ে নিউটনের মনের অবস্থা কি হয়েছিল তা আন্দাজ করা যায়। ভাল করে না-জেনে, না-বুঝে,  কেউ তাঁর ভুল ধরবে এবং তা সংশোধন করে পাঠাবে, বিশেষত হুকের মতো কেউ যাঁর গণিতের জ্ঞান সীমিত, নিউটনের পক্ষে তা কি মেনে নেওয়া সম্ভব? প্রত্যুত্তরে নিউটন যেটা করলেন তা হল, হুকের দেওয়া তত্ত্বে কোথায় ত্রুটি আছে উল্লেখ করলেন তা এবং অবাধে পতনশীল বস্তুর নতুন এক গতিপথ আঁকলেন। 

চিঠিতে নিউটন জানালেন, হুকের সাথে তিনি একমত যে অবাধে পতনশীল বস্তুটি সামান্য দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সরে যাবে। এখানে নিউটন যেন স্বীকার করে নিচ্ছেন নিজের ভুল। কিন্তু ঠিক তার পরেই লিখলেন, হুকের অনুমান মতো বস্তুটির গতিপথ কখনওই উপগোলীয় আকারের হবে না। ‘গ্র্যাভিটি’ যদি সুষম ধরা হয় তাহলে ‘গ্র্যাভিটি’ ও অপকেন্দ্র বলের মিলিত ক্রিয়ায় বস্তুটি পর্যায়ক্রমে উঠবে ও নামবে।  

নিউটন আবারও ভুল করলেন। ‘গ্র্যাভিটি’-কে সুষম ধরলেন এবং অপকেন্দ্র বলের মান যে কেন্দ্র থেকে দূরত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তাও হিসাবে রাখলেন না। 

হুক তাঁর পরের চিঠিতেই (৬ জানুয়ারি, ১৬৮০) নিউটনকে বিঁধলেন। লিখলেন, নিউটনের ধারণা সঠিক নয়।  হুক বললেন তাঁর অনুমান, বস্তুর ওপর সক্রিয় আকর্ষণ বল, কেন্দ্র থেকে বস্তুর দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হবে। 

এখানে হুক একেবারে নির্ভুল। কিন্তু এই গাণিতিক সম্পর্কটি কেপলারের তৃতীয় সূত্র থেকে এডমন্ড হ্যালি ও ক্রিস্টোফার রেন-এর মতো লন্ডনের কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী নির্ণয় করে ফেলেছিলেন ওই সময়। বিষয়টি হুকের অজানা থাকার কথা নয়।  

নিউটন এ-চিঠির আর কোনও উত্তর দিলেন না। আকর্ষণ বল ও দূরত্বের মধ্যেকার প্রকৃত গাণিতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাঁকে। হুকের দেওয়া গাণিতিক সম্পর্কটি কি সঠিক? এই বলের ক্রিয়ায় গতিশীল বস্তুর সঞ্চারপথের সমীকরণ-ই বা কি? তাঁকে জানতে হবে। নিউটন গ্রহণ করলেন এই চ্যালেঞ্জ।  

এই সব চিঠি-পত্রে নিউটন কী ধরণের ভুল করেছেন এবং তিনি সেগুলির কী প্রকার সংশোধন বাতলেছেন, রয়্যাল সোসাইটির সভায় সেসব সকলের সমক্ষে আনলেন হুক। সতের শতকের দুই কিংবদন্তি পুরুষ, রবার্ট হুক ও আইজাক নিউটন-এর মধ্যে এই হল দ্বিতীয় বিবাদ পর্ব। যার সূত্রপাত হয়েছিল, ১৬৭৯-র ২৪ নভেম্বরে নিউটনকে লেখা, হুকের এক চিঠি দিয়ে। যা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল আদতে সখ্যতার বার্তা। 

এই ঘটনার এক বছর পর শীতের আকাশে দুটি ধূমকেতুর উদয় হল। প্রথমটিকে প্রায় একমাস ধরে দেখা গেল ভোরের দিকে। পনের দিন বাদে (৮ ডিসেম্বর, ১৬৮০) আর একটি ধূমকেতু এল সন্ধ্যাবেলার আকাশে। মাস দুয়েকের বেশি সময়কাল ধরে পর্যবেক্ষণ করা গেল এই ধূমকেতুটিকে। এত বড় টেইল বা লেজ বিশিষ্ট  ধূমকেতু আগে কেউ দেখেনি। ইউরোপে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এই মহাজাগতিক দৃশ্য। এই দ্বিতীয় ধূমকেতুটিকে নিউটন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করলেন। রেফারেন্স নক্ষত্রদের থেকে কত ডিগ্রি কোণে অবস্থান করছে তা মাপলেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ অবধি চেষ্টা করলেন ধূমকেতুটির গতিপথ বোঝার। সময়, অবস্থান ও লেজ-এর দৈর্ঘ্য লিখে রাখলেন নোটবুকে।  

নিউটন ছিলেন ক্ষীণ-দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। দূরের জিনিস দেখার জন্য একটি লেন্সের সাহায্য নিতেন। এই লেন্সের মধ্যে দিয়েই ধূমকেতুটিকে প্রথম কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করলেন। জানুয়ারির শেষদিকে যখন ধূমকেতুটি বিলীয়মান প্রায় তখন তিন ফুটের একটি টেলিস্কোপের সাহায্য নিলেন। এক সপ্তাহ পর মাইক্রোমিটারযুক্ত প্রায় ছ-ফুট লম্বা একখানি নতুন টেলিস্কোপ ব্যবহার করলেন নিউটন ধূমকেতুটিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। 

জ্যোতিষ্কলোকের যে মহিমা গ্রান্থামের বালক নিউটনকে বিস্ময়াবিষ্ট করেছিল একদিন, এখন আবারো তা আচ্ছন্ন করল পরিণত বিজ্ঞানীকে। 

কেমব্রিজে ছাত্রাবস্থায় রাত জেগে ১৬৬৪-র এক ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন নিউটন। পড়েছিলেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী টমাস স্ট্রিট-এর লেখা বই ও জার্মান গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী রোথম্যানের বই। সেই ছিল প্র্যাক্টিক্যাল অ্যাস্ট্রনমি-তে তাঁর হাতে খড়ি। 

১৬৮১-তেও ধূমকেতুর তথ্য বিশ্লেষণ টমাস স্ট্রিট-এর পদ্ধতিতেই করলেন নিউটন। ধূমকেতুর গতিপথ সরলরেখা হবে এমনই কথা বলা আছে স্ট্রিট-এর বইয়ে। ধূমকেতুর সরলরৈখিক গতিপথ ওইসময় প্রায় সর্বগ্রাহ্য এক তত্ত্ব ছিল। 

এরইমধ্যে, অ্যাস্ট্রোনমার-রয়্যাল জন ফ্ল্যামস্টিড, নিউটনের এক পরিচিত ব্যক্তি মারফত নিউটনের কাছে পাঠালেন তিনটি চিঠি। ফ্ল্যামস্টিডের মতে, এই দুটি ধূমকেতু ভিন্ন নয়। সূর্যের কাছাকাছি গিয়ে দিক বদল করেছে একটি ধূমকেতুই, যাদের আলাদা বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ এখানে ফ্ল্যামস্টিড গ্রহ উপগ্রহদের থেকে ভিন্ন কোনো প্রজাতির মহাজাগতিক বস্তু হিসাবে বিবেচনা করছেন ধূমকেতুকে। সূর্যকে ঘিরে গ্রহদের সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে যে নিয়মিত আবর্তন, ধূমকেতুদের ক্ষেত্রে যেন তা হয় না। গ্রহদের চলন যে সূত্র মানে, ধূমকেতুরা নাকি তা মানে না। ফ্ল্যামস্টিড তাঁর চিঠিতে ধূমকেতুদের চলাচলের অদ্ভুত এক তত্ত্বও দিয়েছেন যা দুটি চুম্বকের আকর্ষণ-বিকর্ষণ ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। 

ফ্ল্যামস্টিডের এই তত্ত্ব একেবারেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হল না নিউটনের। তাছাড়া ধূমকেতু দুটি যে একই নয় তাও বুঝলেন নিউটন। ফ্ল্যামস্টিডকে চিঠি লিখে তাঁর মতামত জানালেন নিউটন। 

কেবলমাত্র নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্য নয়, ফ্ল্যামস্টিড ও অন্যান্য জ্যোতির্বিদদের থেকেও সংগ্রহ করলেন ১৬৮০-৮১-র দুই ধূমকেতুর অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যাবলী। এদের বিভিন্ন প্যাটার্ন বা সজ্জাগুলি ভাল করে লক্ষ্য করলেন। কখনো ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রির সরলরৈখিক গতিপথ বলে মনে হল তাদের। আবার কখনো স্ফেরিক্যাল ট্রিগোনোমেট্রির মহাবৃত্ত বা ‘গ্রেট সার্কেল’-এর এক অংশ বলে মনে হল ধূমকেতুর গতিপথকে। এই সময় নিউটনের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি গ্রহদের অনুরূপ ধূমকেতুদের গতিপথও উপবৃত্তাকার হবে। এই সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছবেন ১৬৮৪-তে এডমন্ড হ্যালির সাথে সাক্ষাৎ-এর কিছুদিন পরই।     

এবার আসা যাক হ্যালি ও নিউটনের ইতিহাস প্রসিদ্ধ সেই সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে। 

ওই সময় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছিল, সূর্যকে ঘিরে আবর্তনরত কোনো গ্রহের উপর সক্রিয় আকর্ষণ বল দুজনের কেন্দ্রের মধ্যেকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হয়। দু-দশক আগেই তাঁর ছাত্রাবস্থায় নিউটন,  ঘূর্ণায়মান বস্তুর উপর অভিকেন্দ্র বলের সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু, বর্গের ব্যস্তানুপাতিক নিয়ম (inverse-square-law)-এর অধীনে চলমান বস্তুর কক্ষপথ কেমন হবে, এ ছিল এক মহা-প্রশ্ন। ১৬৮৪-র প্রথমদিকে বিষয়টি নিয়ে এডমন্ড হ্যালি, ক্রিস্টোফার রেন ও রবার্ট হুক, এই তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে আলোচনা হয় লন্ডনে। হ্যালি ও রেন দুজনেই জানান এ-প্রশ্নের সমাধান করতে সফল হননি। হুক ভিন্ন সুরে মত প্রকাশ করলেন। হুক বললেন, তিনি এর গাণিতিক সমাধান করে ফেলেছেন এবং তা দেখাতেও পারেন। এরপর কয়েক মাস কেটে গেল, হুক কিন্তু তাঁর সমাধান দেখাতে পারলেন না। হ্যালির স্থির বিশ্বাস, হুক সত্য কথা বলেননি। 

১৬৮৪-র আগস্টে হ্যালি কেমব্রিজ-এ নিউটনের সাথে দেখা করে, প্রশ্নটি করলেন নিউটনকে। যদি ধরা হয় যে সূর্য ও গ্রহের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বল ওদের মধ্যেকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয় সেক্ষেত্রে গ্রহটির কক্ষপথ কি প্রকার হবে বলে আপনি মনে করেন? সাথে সাথেই নিউটন জবাব দিলেন, উপবৃত্তাকার হবে। হ্যালির চোখ-মুখ আনন্দে ভরে উঠল। হ্যালি বলে উঠলেন, তিনি কী ভাবে জানলেন!  নিউটন বললেন, কেন, আমি অঙ্কটা তো কষেছি। হ্যালি তৎক্ষণাৎ দেখতে চাইলেন সেই অঙ্ক। নিউটন কাগজপত্রের মধ্যে খুঁজে পেলেন না তাঁর সেই অঙ্ক কষা কাগজটি। হ্যালিকে আশ্বস্ত করলেন, নতুন করে অঙ্কটি কষে পাঠিয়ে দেবেন তিনি। 

এই সাক্ষাতের বিবরণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত গণিতবিদ আব্রাহাম দ্য ময়ভ্যর-এর স্মৃতিচারণা থেকে। 

 নভেম্বরেই হ্যালির হাতে এসে পৌঁছল তাঁর প্রশ্নের ন-পাতার উত্তর। এই পান্ডুলিপির শিরোনাম De motu corporum in gyrum অর্থাৎ, কক্ষপথে বস্তুদের চলন। পাতা উল্টে হ্যালি বিস্মিত হলেন। তিনি এতটা আশা করেননি। নিউটন দেখিয়েছেন, বর্গের ব্যস্তানুপাতিক নিয়মের অধীনে চলমান বস্তুর কক্ষপথ কি হবে তা নির্ভর করছে বস্তুটির বেগের ওপর। একটি নির্দিষ্ট বেগের কম বেগ থাকলে কক্ষপথ হবে উপবৃত্তাকার। গতিবিদ্যার কিছু প্রাথমিক স্বীকার্য প্রয়োগ করে গণিতের সাহায্যে কেপলারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্র দুটির সত্যতা প্রমাণও করেছেন নিউটন। ন-পাতার এই ‘De motu’-তে ধরা আছে গ্রহ-উপগ্রহের ‘অরবিটাল ডায়নামিক্স’। হ্যালি আর দেরি করলেন না। ১০ ডিসেম্বর নিউটনের এই আবিষ্কার রয়্যাল সোসাইটির রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করা হল। 

নিউটন হ্যালিকে চিঠি লিখে জানালেন তিনি সামান্য কিছু সংযোজন করতে চান। তাই ‘De motu’ এখনই যেন ছাপা না হয়।

বছর দুয়েকের মধ্যেই এই ‘সামান্য কিছু সংযোজন’ বিপুল আকার ধারণ করবে ও  প্রকাশ পাবে তিন খন্ডের প্রিঙ্কিপিয়া। ইউরোপের বিজ্ঞানীদল বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে প্রত্যক্ষ করবে অতিমানবীয় এক সৃষ্টি।  

(চলবে)

সূত্রনির্দেশ 

  1. R. S. Westfall – Never at rest, Cambridge University Press, New York, 1980.
  2. A. R. Hall – Isaac Newton – Adventurer in Thought, Cambridge University Press, UK, 1996.
  3. A. Koyre – An Unpublished Letter of Robert Hooke to Isaac Newton, The History of Science Society, Volume 43, Issue 4, Pages 312-337, December 1952
  4. J. A. Ruffner – The snare of simplicity: the Newton-Flamsteed correspondence revisited, Archive for History of Exact Sciences, Volume 67, Issue 4, Pages 415-455, July 2013

 

* নিউটনের প্রিঙ্কিপিয়া প্রকাশ পাওয়ার পর, এই চিঠিকে (২৪ নভেম্বর, ১৬৭৯) হাতিয়ার করেই, রবার্ট হুক ১৬৮৬-তে নিউটনের বিরুদ্ধে তাঁর গবেষণা চুরির (plagiarism) অভিযোগ এনেছিলেন। হুকের দাবি অবশ্য সঠিক ছিল না।  

 

** অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শনে বিশ্বাসীদের ধারণা ছিল, পৃথিবী স্থির। আর তাকে ঘিরে বিচরণ করে সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রেরা। অ্যারিস্টটলের জিওসেন্ট্রিক মডেলে বিশ্বাসীদের ‘ভালগার’ অর্থাৎ ইতর শ্রেণীর জ্ঞান করতেন রবার্ট হুক, নিউটন, ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস, এডমন্ড হ্যালি বা ক্রিস্টোফার রেন-এর মতো আধুনিক বিজ্ঞানীরা,  যাঁরা আদতে কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বকে সঠিক বলে মানতেন।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment