রিমঝিম আহমেদ

নারীর কবিতা, মানুষের কবিতা

ভাবনা কোথা হতে আসে ! ভাবনারও নিশ্চয় প্রেক্ষাপট আছে , আর সে প্রেক্ষাপট ভিন্ন কবি কি লিখতে পারে ? কবির অন্তর্গত ক্ষরণ, বেদনা, হাহাকার, সুখানুভূতি ব্যতিত ভাবনার উদয় হয় কি! সেসব অনুভূতিসমূহের আন্দোলন ছাড়া তো ভাবনা আসে না।
কবিতা কবির কাছে নৈঃশব্দ্য ধ্যানের এক নাম। সমস্ত যাপন থেকে ইচ্ছে পালানোর নাম। মেঘের ওড়া, বৃষ্টির ঝরেপড়া, পাতার মর্মর, ঘাসের ডগায় ফড়িঙের বসার ভঙিমা এসব চিরাচরিতের মাঝে নতুর রঙ এনে দেয়া এক হকিয়ার। কবিতা কবির একচিলতে উঠোন যেখানে ইচ্ছেমত পাতা ফেলা, নিকোনো, ঝাটপাট দেয়া, রোদ পোহানো, কিংবা জোছনা মেখে শুয়ে থাকা চলে। কবি, কবির ভাবনা, অভিজ্ঞতা, মানবিক সম্পর্ক, জীবন জটিলতা ব্যতিত কবিতার শরীর বিকলাঙ্গ। সুতরাং কবি যা, কবির বাহির ও ভেতরগত আন্দোলন-সংঘাতসহ সামগ্রিক প্রকাশই কবিতার সমূহ অবয়ব।

“নারী নিজেই কবিতা, সে আর কী কবিতা লিখবে?” এমন কথা অহরহ শুনেছ, এখনো শুনি। তবে কি কোথাও কোন সাংবিধানিক নিয়ম কি আছে, নারী কবিতা লিখতে পারবে না বা নারী কবিতা সৃষ্টিতে অপারগ?

সৃজনশীলতার উৎস কি লিঙ্গ নির্ভর, নাকি সহজাত শিল্পসত্তার উদগীরণেই তার প্রকাশ? এ প্রশ্ন বহুদিন ধরে বহুভাবে তাড়িত করেছে আমাকে। আমি নারী বলেই কি! না, আমার নারীসত্তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তবে এই সত্তার উপর আঘাত আসলে যে কারো মর্মে লাগার কথা। হয়তো সে কারণেই অথবা সে আঘাতের পাল্টা আঘাত দেবার কোন সারথি নেই বলেই একবার জোর গলায় বলে উঠি। তাতে পুরুষতন্ত্রের পাথর দেয়ালে আঘাত লেগে প্রতিধ্বনিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনের জমানো পাথর ভাঙে না। আরও জোর আঘাত দাবি করে। প্রশ্ন করেছি সৃষ্টিশীলতা আসলেই লিঙ্গনির্ভর কি না! ভেবেছি, জবাব ঠিকঠাক পাইনি কোথাও, কারো কাছে না। নারীর কবিতা নিয়ে, কবিতা হয়ে ওঠা না-ওঠা নিয়ে দুই বাংলায়ই চিৎকার হতে দেখেছি। এ বাংলায় কি একটু বেশি নাকি ওপার বাংলায় বিচরণ কম বলে আমার ধারণাগোচর হয়নি তা নিয়ে কিঞ্চিৎ নিজের প্রতি সন্দেহ আছে।

দুই বাংলায় নারীরা লিখছে নারী সত্তায় দাঁড়িয়ে মানুষের কবিতা। যা একান্তই মানুষের কথা বলছে। নির্দিষ্ট কোন গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে নয়। ভালো কবিতা সবসময় ভালো কবিতা হয় বলেই জানি। লৈঙ্গিক পরিচয় তাকে খাটো করার স্পর্ধা রাখে না। কিন্তু সমাজ যেহেতু একটা লৈঙ্গিক কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত, সে প্রভাব তো সর্বাঙ্গে থাকেই। শত শত বছরের বিকাশমান ধারা থেকে নারীর উত্থান ধীর গতিতে হলেও এবাংলা-ওবাংলা মিলিয়ে সব জড়তাশৃঙখল কাটিয়ে উঠতে পেরেছে নারী। অস্বীকার করা যায় গায়ে জোর থাকলে।

পৃথিবীতে মানুষ একটা জাত বটে। তাতে আবার দুটো ভাগ- পুরুষ ও নারী। প্রকৃতিগতভাবেই নারী-পুরুষ আলাদা, স্বতন্ত্র সত্তা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দ্বারা মহিমান্বিত। জীবন যতটা দৃশ্যগত, যতটা অনুভবের- পুরুষ যতখানি দ্রষ্টা সেখানে, নারীও তো ততখানি। তবু নারী, শিল্পী ও শিল্পবিবেচনায় কোথাও কি একটু সন্দেহের আওতায় থেকে যায় না? অথবা উপেক্ষা কিংবা করুণায়? ভুল হতে পারে কি আমার! তাই যদি হয়, তবে নিজের বীক্ষণ আর অনুভবকেও সন্দেহে রাখতে হয় যেন।

সমাজে নারী পুরুষ দুটো ভিন্ন সত্তা হেতু সমাজের আরোপিত জগত, নিয়মতন্ত্র, বিধিবিধান সর্বোপরি যাপনপদ্ধতি তাদের অনেকটাই ভিন্ন। নারী-পুরুষের অভিজ্ঞতা, দেখার দৃষ্টি, চিন্তা সবই আলাদা যাপনে তাপনে। আলাদা কি প্রতিটি মানুষে মানুষেও নয়? এই যে, আমরা একই বাবা-মায়ের ঔরসে জন্ম নিয়ে একই পরিবারে বড় হওয়া আরেকটি ভাই বা বোনের চেয়েও কি আলাদা নই, চিন্তায়, রুচিতে, চলনে-বলনে?

এটাও সত্য- একজন পুরুষ কবি এবং একজন নারী কবির কবিতা অর্থাৎ ভাবনা-বিশেষ বহু জায়গায় আলাদা হতে বাধ্য। আমাদের ভারতবর্ষীয় সমাজপ্রেক্ষাপটে তো বটেই, সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী সম্ভবত তা আলাদা। আবার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কমন কিছু ব্যাপার থাকে যা আলাদা হতে পারে না। প্রেম, প্রার্থনা, ঈশ্বর কল্পনা, বিরহ, রাজনৈতিক ভাবনা এসব তো উভয়েই কমন এক ব্যাপার। এসব ভাবনার প্রতি-কথামালা যে যার অবস্থান থেকে লিখছেন মাত্র। আর ভিন্ন ভাবনাগুলি, বিশেষত নারীর ক্ষেত্রে, এমন কিছু আছে, যা কেবলই নারীর একান্তই মনোজগত, নারীজন্মের নিয়ামক, সন্তান ধারণের মতো প্রাকৃতিক ঘটনাবলী, স্তন দান, মাতৃত্ব। যেখানে পুরুষের প্রবেশের সাধ্য নাই কোনকালেই। তাকে দশমাস নিজ গর্ভে লালন, আলো দেখানো পৃথিবীর, এই যে মহাজাতিক একটা বিস্ময়কর ঘটনা, এর থেকে পুরুষ বহু আলোকবর্ষ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো । সে চাইলেও ওই কবিতা লিখতে পারবে না, তা একান্ত নারীর। সত্যি বলতে পুরুষের এমন একান্ত কবিতা কি আছে কিছু?

“গর্ভ-অন্ধকারের মতো ঢেকে আছে এই
স্তব্ধ শব্দহীন পরিসর
বড় নৃশংস মনে হয় কাছে থেকেও
কাছে যেতে না পারার অমোঘ- দূরত্ব
জবার মুখ মনে এল, ‘’দূর কিছু নয়, অন্ধকারও”
_____আসমা বীথি [ থাকা/টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ি]

নারীর বিকাশের ইতিহাস ডিঙিয়ে যারা সমান পাল্লায় রেখে নিজের চিন্তাকে নারীর চিন্তায় প্রবাহিত করতে চায় সে-ও তো পিতৃতন্ত্রের অন্য এক ছোবল যা থেকে নারী কালে কালে মুক্তি পায়নি। সময়ের সাথে সাথে সে নিয়ন্ত্রণের ভঙ্গিটারই কেবল বদল ঘটেছে।

নিজস্ব ফেসবুক দেয়ালে এক পোস্টে কোন এক কবি লিখেছিলেন- “বাংলাদেশে কোন নারী কবি নেই যে পুরুষের পাশে দাঁড়াতে পারে।” নারীর কবিতা আর পুরুষের কবিতার মাঝখানে দুটি প্রতিযোগী ঘোড়া আছে তা অবশ্য জানা ছিল না। কবিতা কি শক্তিপ্রদর্শনের কুরুক্ষেত্র কি না জানি না। সেটা যারা এরূপ চিন্তা করেন তারাই ভালো বলতে পারেন। যেখানে নারী নিজেই শক্তির আধার।

একইভাবে, নারীর কবিতা কেন হয় না? সে প্রশ্ন উত্থাপন করলে অনেকেই অবশ্য যুক্তি খাড়া করেন। নারীর বিকাশের ইতিহাস দীর্ঘদিনের নয়। আগল ভেঙে নারী তার মহিমায় ফিরতে সময় লেগেছে অনেক। এই দোহাই দিয়ে যারা নারীর শিল্পসত্তাকে পাল্লায় তোলেন তাদের যুক্তিতে অবশ্য একটুখানি আত্মতৃপ্তির প্রকাশ বুঝতে পারি। তারা ভাবেন, নারী সুযোগ পায়নি, বা সীমাবদ্ধতা ঠেলে শিল্প সৃষ্টির চেষ্টা করে বৈকি, তবে এখনো তা যথাযথ শিল্পের মানদণ্ডে দাঁড়িয়ে উঠতে পারেনি । পুরুষের মতো সুযোগ পেলে নারীর কবিতার মান বেড়ে যেত। নারীর পক্ষে কথা বলা হল বটে, তাতে অবশ্য এমন যুক্তিতে খুশি হতে পারা যায় না। কেননা এখানেও পিতৃতন্ত্র তার মহিমা লাভের চেষ্টারত। যেন, এই দেখ- আমি তোমার হয়ে কথা বললাম। কেন তুমি পারছ না, কোথায় তোমার সীমাবদ্ধতা আমি বলছি। তুমি সুযোগ পেলে এগিয়ে যাবে। এও একপ্রকার লিঙ্গরাজনীতি। সমাজে বহুল প্রচলিত, আধুনিক আর পদানতকরণের ভদ্রস্থ ভঙ্গি।

তখনও কবির কলম লিঙ্গবাদী নয়। কলমের লিঙ্গ হয় না। তিনি লিখেন-

“একদিন খাদের ফলায় অসর্তক হৃৎপিণ্ড কেটে গেলে তলার অন্ধকারে সঙ্গমে সমবিন্দু হই। হৃদয় নির্মম সাক্ষী, “আঁধার দেখেছি, দেখেছি আরও বড় অন্ধকার ।”
____নুসরাত নুশিন [গোলাপসঙ্গম]

আমরা তো সে ইতিহাস জানি। যুগ যুগ ধরে নারী আর পুরুষের যাপনপদ্ধতি ঠিক করে দিয়েছে সমাজ। নারী কোথায় থাকবে, পুরুষ কোথায় থাকবে সেটাও সমাজের সিদ্ধান্তে চলেছে। নারী ও পুরুষের কাজ নির্ণয় করেছে তাও সমাজ। সে সমাজ যে পুরুষের, পিতৃতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মেয়েরা প্রথম থেকেই নিজের দৃষ্টিকোণ, অনুভবের এতটা অনায়াস উচ্চারণে সমর্থ ছিল? নিজের বুদ্ধিদীপ্ত, মননশীল বিকাশের প্রকাশ করার এতটা দক্ষতা কি ছিল আদৌ? তারা যে ছিল না সেটা আমরা জানি। মূলত পিতৃতন্ত্রের অচলায়নে বন্দি নারীর নিজস্ব পরিসর ছিল প্রেম, সংসার, বিচ্ছেদ, আশা-নিরাশার প্রাত্যহিক যাপন। সে যাপনকে উপজীব্য করে নারী লিখেছে তার আখ্যান। কেননা নারীর সীমিত বিচরণে কবিতার অনুষঙ্গও ছিল সীমিত। পুরুষের মতো সমান মেধা থাকলেও বৈচিত্র্যময় পথে কবিতাকে নিয়ে যাওয়ার উপকরণ তার ছিল না। কিন্তু এটা তো নারীর সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা নয়। বরং অভিজ্ঞতা। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি, সাজসজ্জা, সন্তান, প্রেম, বিরহ, হেঁসেল, মশলার ঘ্রাণ এসবই তো তার নিত্যকার জীবনের অনুষঙ্গ। সে উপকরণ ঘিরেই তার অভিজ্ঞতা আর শিল্পের আবর্তন। শিল্পও সে উপকরণকে উপজীব্য করে সৃষ্টি হয়েছ। মানুষ তার জীবন আর যাপনের বাইরে গিয়ে কোন শিল্পকে প্রাণ দিতে পেরেছে!

“ ঠাকুমার ঝুলি থেকে একদিন আবিষ্কার করেছিলাম
ঠাকুর্দার বাড়ি
শীতকালে রোদ্দুরে বসে ঠাকুমা আমাদের বলতেন শ্বশুরবাড়ির গল্প,
হাঁড়িকুঁড়ি-কুকুর-বেড়াল-ঢেঁকিশাক-গোয়ালঘর নিয়ে
চার দেউড়ির বিশাল মহলে তিনি ছিলেন মুখচোরা বউ।”
––––নাসিমা সুলতানা [ঠাকুর্দার বাড়ি]

নারীও চিরকাল পুরুষ নিয়ন্ত্রিত জীবনে তাদের এঁকে দেওয়া ছকে স্বস্তি পেয়েছে, নিরাপদ বোধ করেছে। এখনো যে পায় না তা নয়। আবহমান কাল ধরে যে জীবনে অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে তা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আশা করা ভুল। তবুও কোথাও সভ্যতাজনিত অভিমানে নারী হয়ে ওঠে একেকজন মূর্তিমান লিলিথ। আদমের বাহুডোর ভেঙে দিতে চায় নিজের স্বকীয় সত্তার জানান দিয়ে অদম্য চিৎকারে। তারা লেখে নবজীবনের আখ্যান আবার নতুন করে পুরনো কালকে ভেঙে দিয়ে। পুরুষমহলে তখন গেল গেল বলে রব ওঠে। ডানা ভেঙে দিতে তৎপর হয় নতুন নতুন কৌশলে।

তখনই হয়তো লেখা হয়-

“এ শহর মাংসাশী, আদিম, সবুজ লোমশে ভরা টালিছাদ
পাদ্রী ও পুরুত ধর্মান্ধ, রক্তলোলুপ, প্রেম তো অচল মিথ”
কিংবা
“এইতো মাংসের রেণু, বেণুবনে কাঁদছি একা, পুড়ে যাচ্ছি জ্বরে
মাংস বিক্রি করে কিনি প্রেম, প্রাণবায়ু মাংসাশী শহরে”
শেলী নাজ [ মাংসাশী, সুচের ওপর হাঁটি]

মানুষের হৃদয় আছে, আত্মা আছে কিংবা প্রেম ও বিরহ আছে বলতে পার অনায়াসে। কিন্তু মানুষ যদি নারী হয় সে পারে না বলতে তার নিজস্ব শরীর ও কামের কথা, স্বমেহনের কথা। খেতে পারবে, ঘুমোতে পারবে শরীরসঙ্গের কথা বলতে গিয়ে জিভ কাটতে হবে, এমনই সময় ছিল নারীর ভূষণই লজ্জা আর পুরুষের বেলাজ হওয়াই নিয়ম। আজ অতিবাহিত সময়ে এসে নারী ভেঙেছে সে ট্যাবু, কী অবলীলায় বলছে সে কথাগুলো নিজের সৃষ্ট কবিতায়। যেখানে পুরুষ নারীকে কবিতার অনুষঙ্গ করে লিখেছে পদ্য, নারী আজ মূর্তিমান কবি কেবল পুরুষের কবিতার অলঙ্কার নয়, অনুষঙ্গ নয় নিজেই লিখছে নিজেকে। যাপনের নানাবিধ অভিজ্ঞতাকে। তখনই নারী লিখেন-

“রেহেলে তোলা আত্মমগ্ন যন্ত্রণা নেই
ঈশ্বরকে মুক্তি দিলাম।
অবশেষে মানুষ হলাম।”
____সেলিনা শেলী [গ্রন্থবিহীন ধর্মমানি/নিভে আসে সূর্য সকাল]

মানুষ তার যাপনকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। একান্ত নিজস্ব জগতের ভেতর থেকে অঙ্কন করে নিজের ভাবনা ও চেতনার দ্যোতনাকে শব্দ-বাক্যে যা কোথাও গিয়ে পাঠকের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে ফেললেই আমরা তাকে বলি নৈর্ব্যক্তিক। তাই কোন কোন কবিতা কবির নিজস্ব মানস ডিঙিয়ে অসংখ্য আমি’র সাথে সংযোগ ঘটায়।

যেমন, কবি শাফিনূর শাফিন তার নিঃসঙ্গম কাব্যে ‘মেয়েরা’ কবিতায় লিখেছেন-

“… তারা এলাচবনে তুমুল নৃত্যের ঘোরে
একের-পর-এক তির গাঁথতে থাকে শরীরে।
রক্তাক্ত হবার মুহূর্তেও মেয়েরা ভাবে,
মিটসেফে তুলে-রাখা খাবার গরম করার কথা।”

কবিতা পড়তে পড়তে চিরচেনা কোন নারীর মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আমাদের গৃহবাসী কোন পরিচিত নারীমুখ,প্রতিবেশীনি যে সকল দাম্পত্যকলহ, অশান্তি আর ক্লেদ লুকিয়ে নিত্যকার সাংসারিক আয়জনে ব্যস্ত। সংসার, সন্তানাদিই যার ধর্ম। নারী ছাড়া এমন করে নারীকে আঁকতে পারে কে!

সৃষ্টিশীল হওয়ার মেধা ও আকাঙ্ক্ষা কোনদিনই কম ছিল না নারীর। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের ঘেরাটোপে বসে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, সে সৃজনশীলতার গণ্ডিও আগে থেকে ঠিক করে রাখা। পূর্বনির্ধারিত মাপজোখ এড়িয়ে গেলেই চরিত্রনাশ।

আবহমান নারীসত্তার লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, বিপন্নতা, শোক, বিস্ময় যথাযথ নারীই উপলব্ধি করতে পেরেছে যা পুরুষ ছুঁতেও পারেনি।

“বিশ্বাস মুদ্রিত খামে আলো ও ছায়ারা আছে
এবং বন্ধুহীন রাত ও দিনের সীমানায়
এখানে সকাল নেই কোনো। “
—সালেহীন শিপ্রা [ঘাস/প্রকাশ্য হওয়ার আগে]

পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে পথ কেটে কেটে নারীকে কীভাবে সমাজের মূলস্রোতধারার বৃহৎ পরিধিতে পা রাখতে হয়েছে সে নারীজন্ম মাত্রেই জানে। ফলত সমাজের নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ, পিতৃতন্ত্রের লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে নিজের অস্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করা নারীর জন্য অতটাও সহজ হয়নি। তাই ক্ষেত্র বিশেষে আরোপ করা দুটো ভিন্ন জীবনপ্রবাহকে এক গণ্ডিতে ভাবা আর এক পাল্লায় মাপা আমাদের পুরুষের দৈন্যই বলা যায়। কেননা আলাদা যাপনে আলাদা অভিজ্ঞতায় মানুষ স্বতন্ত্র। সে অভিজ্ঞতার ভাষা ও চেতনা তাদের একান্তই নিজস্ব। একান্তই ব্যক্তিগত। তা না হলে শিল্প মাত্রই স্বতন্ত্র স্বরের প্রয়াসী হবে কেন?

“এতটা রঙিন নয় কিছু; তবু, কেন আমি সাদাকালো দেখি না”
অথবা,
“ঘুম আসে না; দেখি ঈগলের চোখের স্পষ্ট লালে ঝুলে আছে আমাদের ঘুমের কার্বন কপি।”
______জিনাত জাহান খান [প্রতিস্থাপন/শর্তহীন দেবদারু]

অনেকেই বলে থাকেন- নারীর কবিতা নারীসত্তা পেরিয়ে আসতে পারে না। তারা কেবল ঘরগৃহস্থালী আর কোমল প্রেমের আখ্যান লিখে ক্লিশে হয়ে গেছে।

তা বটে! তবে বলতে হয় নারী-জীবনটাই তো ক্লিশে। তাদের জীবনের সাথে অন্য কোন জীবনের পাল্টাপাল্টি না ঘটলে বহুবিধ অভিজ্ঞতা আসবে কোথা থেকে! আর নারীই বা কী করে কবিতাকে বৈচিত্র্যে ভরিয়ে দেবে! এমন ভাবনাটাকে আমি বলি ক্লিশে। নারী তো কখনো প্রশ্ন তোলেনি- পুরুষও কেন সেই রাজনীতি সমাজনীতি, নারী, প্রেম এসব লিখে লিখে ক্লিশে হয়ে গেছে, কেন তারা নতুন কিছু লিখে না। নারী যদি আলাদা মানুষ হয়, তাহলে নারীকে কেন নিজের সত্তা বিকিয়ে, অভিজ্ঞতা পেরিয়ে পুরুষ হয়ে কবিতা লিখতে হবে, তবেই নারীর কবিতা কবিতা হবে, নচেৎ নয়? নারীর কি তাহলে প্রশ্ন তোলা উচিৎ পুরুষের কবিতা কেন কবিতা হয়, কোন মানদণ্ডে হয়, নারীর কেন নয়?

প্রশ্ন, নারীকে কেন পুরুষের মতো হতে হবে, পুরুষকে কেন নারীর মতো?

এক বিষাদগ্রস্থ জীবন কী করে পারবে তুমুল সুখের কবিতা লিখতে! কে ঠিক করে দেবে নারীকে সে কেমন লিখবে? এ অধিকার কার জন্মে যায় অন্য এক মানুষ হয়ে ? নারীর নিজস্ব সংবেদনশীলতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপলব্ধি করে নারীর বাইরে কার এত যোগ্যতা আছে?

” এ কোন ভ্যাপসা দিনে
ছেঁড়া বিকেল সেলাই কর তুমি?…”
অথবা, “আজকাল শুধু ভয় হয়
উঠোনটা লুকিয়ে ফেলবে কেউ।”
ফারাহ সাঈদ [ পৃথিবীর নিচুছাদ প্রেম]

নারীর সংবেদনই তো পারে এভাবে বলতে–। কিন্তু এটাই সত্য যে, এই শতাব্দীতে এসেও বাংলাদেশে কবিতার সৃজনশীল স্রষ্টা হিসেবে নারীকে শতভাগের সিকিভাগ দিতেও অনেকে নারাজ। অহরহ আবর্জনা লিখেও শুধুমাত্র পুরুষ হবার সুযোগে কেউ কেউ কোথাও কোথাও কবি পরিচয়ে আত্মতুষ্টির হাসি হাসে। তাদের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলে বলে না- তোমার তো কবিতা হয় না!

কবিতা না হওয়ার সে দায়ভার অনেকক্ষেত্রেই নারীর। নারীর যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেবে পুরুষ। পুরুষতন্ত্রের শেখানো বুলিতেই আওড়াতে হবে নারীর কবিতা। তাহলেই কবিতা হবে।

মূলত নারীর কবিতা বুঝবার আগে নারীকে, নারীর জীবনকে বোঝা দরকার। সমাজের যে অচলায়তন নারীকে ঘিরে, রাষ্ট্রযন্ত্রে বণ্ঠনব্যবস্থা, নারীকে ঘিরে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এসবকেও জানা দরকার। নারী জীবনকে অনুভব না করে করে নারীর কবিতাকে বাটখারা বসিয়ে মাপতে আসা বোকামি।

কেননা যে সমাজে এখনো সতীত্ব বিবেচনায় নারীকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়, নারী শরীরকে ভোগ্যবস্তু করে কবিতার অনুষঙ্গ করা হয়, সেখানে সে পিতৃতন্ত্রের দেয়া সার্টিফিকেট কেনইবা দরকার হবে নারীর?

“আমি পাতালের মেয়ে, আমাকে জড়িয়ে জন্মেছে
কোটি কোটি বছরের পুরাতন প্রেম, রাজধানী নগর
বিমনা নিবাস, একসহস্র নগরপতির দুঃসহ প্রণয়
বারবার ছেড়ে যেতে চেয়েছে তারা পৃথিবীর একশটি সমুদ্র।”
__ফেরদৌস নাহার [সভ্যতা একা গান গাবে]

এই শতাব্দীতে এসে, নারীর যেখানে সর্বত্র পদচারণা, মেধায়, মননশীলতায় এবং প্রতিযোগিতায় সেখানেও নারী (!) একটু চোখ কুঁচকানো, বক্রদৃষ্টি, এই হেয়প্রতিপন্নতা নারীর ভাগ্যকে ছাড়তে পারেনি।

এসময়ে দাঁড়িয়ে নারীকবি শব্দটাকে এড়াতে চাওয়া কিংবা এমন শ্রেণিবিভাজনে আপত্তি থাকাই স্বাভাবিক। পুরুষ পুরোপুরি কবি। নারী, নারীকবি। যেন অর্ধেক। একক হতে পারেনি আজও। কবিতা কেন, কোন সৃষ্টিশীল কাজে নারী এখনো পারেনি নিতে আত্মপ্রত্যয়ের সে জায়গাটুকু। এমন এক সময় কি কাঙ্ক্ষিত নয় নারীদের কাছে? নারী জীবনকে খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এমন কোন সংবেদী কবি (পুরুষ) কি ভেবেছে এর ব্যাখ্যা, জীবন বীক্ষায় নারী আলাদা মানুষ, তার অন্তর্গত আলোটুকু তার চিন্তা, এক মহাজাগতিক কাব্যিকবোধ তার কবিতার আধার। নারী মানুষের তীরে দাঁড়াবে, গহন ভাঙনের শব্দ শুনতে শুনতে জবা ফুলের দিকে তাকিয়ে লিখবে মানবিক কবিতা।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment