আমেরিকা এক হিমায়িত চিৎকার বলে চিহ্নিত করার পর একটা কাজ আরও বেড়ে যায় এক অদ্ভুত দায় ও সচেতনতা। যে আমি অন্ধের মত স্পর্শে চিনেছি আমেরিকা পণ্ডিতের মত নয় তার কাছে এই অনুভূতি আর কজন বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া খুবই প্রয়োজন। মার্কিন দেশে এত বাঙালি থাকা সত্ত্বেও এই বিষয়টা আমাদের মত গোদা লোকেদের সামনে কেউ তুলে ধরেছেন বলে মনে পড়ে না। কবিতার ক্ষেত্রে কেউ হয়তো ধরিয়ে দিয়েছেন নতুন ধরনের কবিতার আঙ্গিক এর কথা। কিন্তু কেউ ধরিয়ে দেননি ইউরোপীয় ভাষায় লেখা হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা মহাদেশের কবিতা একেবারে তাদের ঔপনিবেশিক দাগ ঘষে-মেজে তুলে দিয়েছে। হ্যাঁ সেখানেও উচ্চ নিচ ভেদাভেদ যেমনটা বা দেখেছেন তাত্ত্বিক হোমি কে ভাভা। কিন্তু যেটা আমাদের প্রত্যেকের শিক্ষণীয় বিশেষ করে এই ভারতবর্ষে যেখানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষিত মানুষের আপন এবং ভারতীয় সমস্ত ভাষা গোদা সিরিয়ালের প্রাণ হয়ে উঠছে, সেখানে এই উত্তর ঔপনিবেশিক ভাষা নির্মাণ আমাদের লক্ষ্য করা উচিত।
আগেই লিখেছি ১৯৭০ এর এর দশকে গোটা ইবেরো আমেরিকায় কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নব বারোক রীতি। আর সেই রীতি কিভাবে বদলে দিয়েছিল আত্মপরিচয় নির্মাণের নবীনতম আঙ্গিক আমি এই ধারার প্রধান কবিদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তাঁরা কিভাবে এই প্রবাহ কে আত্মপরিচয় নির্মাণের দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে দেখেছেন। আজকের ভাষায় আত্মপরিচয় টু পয়েন্ট ও।
কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক। নেরুদার সেই বিখ্যাত পঙক্তি, “আসলে আমি মানুষ হিসেবে ক্লান্ত/ আসলে আমি দর্জির দোকানে সিনেমা হলে ঢুকি/ মিইয়ে যাওয়া অভেদ্য উৎস ও ছাইয়ের জলে সাঁতার কাটা সারস এর মত।’ এই সেই পৃথিবীতে বসবাস নামক কবিতার বই যা গোটা এস্পানিওল ভাষার কবিতায় এক দিক চিহ্ন বহনকারী গ্রন্থনা। আজও লেখার প্রায় ১০০ বছর পর বইটার মূল্য কিছুই কমেনি। কিন্তু এই বইটি ইউরোপীয় অবক্ষয়ী ব্যক্তির কবিতা বলে চিহ্নিত করা যায়। নেরুদা প্রতীম প্রতিভাধর যে কোন ইউরোপীয় কবি হয়তো এই বইটি লিখতে পারতেন। এখানে আমেরিকা মহাদেশ নেই। এই বই প্রকাশের প্রায় ১৫ বছর পর পাবলো নেরুদা আবিষ্কার করছেন আমেরিকা। লিখছেন সাধারণ গান। লিখছেন “সে এক ইগুয়ানা সকাল/ তার রংধনু কর্কশ পিঠ/ বর্শার মতো জিভ/ সবুজে ডুবে যাচ্ছে।” এই প্রথমবার নেরুদার কবিতায় এল আমেরিকা মহাদেশের প্রাণী ইগুয়ানা। এরপর নেরুদা কখনোই আর ফিরে তাকাননি আমেরিকা মহাদেশ প্রাণ পেয়েছে তাঁর কবিতায়। এবং এখানে লক্ষণীয় নেরুদার কবিতা বাহ্যিককে লক্ষ্য করে। তিনি সেই বিরল প্রজাতির কবি যিনি ওই ইগুয়ানা মতোই পাথরে জিভ দিয়ে শিকার করতে পারেন কবিতা। তিনি নির্মাণ করেন স্প্যানিশ ভাষার আমেরিকা বা ইস্পানো আমেরিকার কাব্যিক মানচিত্র। নেরুদার চেয়ে দশ বছরের ছোট ওক্তাবিও পাস তাঁর বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার আগে লিখেছেন সূর্য প্রস্তর নামক দীর্ঘ কবিতা যা আসলে আসতেকা সভ্যতার সঙ্গে এক যোগাযোগের সেতু। এবং তিনি এই বইটি লিখেছেন ১৯৫৭ সালে নেরুদার সাধারণ গান প্রকাশের সাত বছর পর। এখানে প্রকাশ পেয়েছে পরাবাস্তববাদের প্রয়োগ সম্পূর্ণ মেহিকোর প্রেক্ষিতে যেমনটা বা নেরুদার পৃথিবীর বাসিন্দা বইতে ছিল পরাবাস্তবতা। দীর্ঘ কবিতা এমন এক প্রকরণ যা ওক্তাবিও পাস চর্চা করবেন আজীবন এবং বৈয়াকরণ হনুমান নামক ১৪২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ গদ্য স্তবকে লেখা কবিতায় তাকে বিশ্বনাগরিক করে তুলবেন। এই বই হয়ে উঠবে একুশ শতকের এক প্রধান প্রবাহ মিশ্র মাধ্যম কবিতা বা গদ্যপদ্য রিপোর্টাজ ছবি ডাইরি মিশ্রিত কবিতার প্রথম পূর্বসূরী।
যেমন আগের প্রবন্ধে আমি লিখেছি এই সময়ে খন্ডে প্রবাহিত হচ্ছিল আর এক রকমের কবিতা। বা বলা উচিত ইবেরো-আমেরিকার বাহ্যিক বর্জন করে ভিতরের কথা বলা কবিতা। সকল মানুষের সার ধর্ম আসলে এক এমনসব ভাব এবং বস্তুবাদী দর্শন কে নাকচ করে উপনিবেশ বাসিন্দা মানুষের মূলগত স্বর যে নানাভাবে আলাদা এবং জটিল তার বহিঃপ্রকাশ। উপনিবেশ আমাদের মননে চিরস্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়। বাধ্য করায় অনুকরণে যেমন বলেন হোমি ভাভা। গভীরে ভাবলে খুঁজে পাবো এমনকি রবীন্দ্রনাথের বসন্ত পর্যায় এক ঋতু যা বাংলায় প্রায় নেই বললেই চলে এবং তার থেকে বেরিয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের বর্ষা। তেমনি নেরুদা বা ওক্তাবিও পাস এর ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসা। সেই সময় হোসে লেসামা লিমা নির্মাণ করে নিচ্ছিলেন আমেরিকার অন্তর্মুখী ভাষ্য। আমি আগেই লিখেছি। কোথায় আলাদা হয়ে যাচ্চেহ সেই অন্তর্ভাষ্য, দেখা যাক। মনে রাখা দরকার পূর্বোল্লিখিত নেরুদা। এবার দেখি পাস। “কাচের উইলো গাছ, জলের পপলার/ বাতাস খিলান তৈরি করে দেয় এমন এক পাম্প/ বৃক্ষ সুপ্রথিত কিন্তু নৃত্য তার গায়ে…” আরেকটু এগিয়ে লিখছেন “তোমার জনার স্কার্ট ঢেউ তোলে, গান গেয়ে ওঠে/ তোমার কাচের স্কার্ট, তোমার জলের তৈরি স্কার্ট” । এই যে প্রবেশ করল জনার বা ভুট্টা, প্রবেশ করল মেহিকো, এলো আসতেকা সভ্যতার প্রধান ফসল, যা আমাদের পুরনো দুনিয়ায় ছিল না। কিন্তু এই আগমনও বাহ্যিক। ভৌগলিক। ছন্দটি প্রাচীন, স্পেনদেশীয়, এনদেকাসিলাবো, আমাদের অক্ষর বৃত্তের মত। যেই মুহূর্তে আমরা আসছি হোসে লেসামা লিমার জগতে আমরা প্রবেশ করছি গভীর উত্তর ঔপনিবেশিক জটিল স্থাপত্যের মস্তিষ্কে। যেখানে বাহ্যিক ভৌগলিকতা নয় আসছে চিন্তা ও কল্পনার উপনিবেশজাত নবীনতা। লেসামা তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ আমেরিকার স্বর শুরু করছেন এখন প্রবাদ হয়ে যাওয় সেই লাইন দিয়ে ” যা কিছু কঠিন তাই উদ্দীপক; শুধুমাত্র প্রতিরোধ আমাদের চ্যালেনজ করে, সে জন্ম দেবার মত শক্তিধর, সে আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণাকে উৎপ্লব করে, বাঁচিয়ে রাখে।” আগেই লিখেছি এই কথা। ১৯৪০ সালের ডায়রিতে ২৯ ফেব্রুয়ারি লিখছেন ” আজকের শিল্প হবে সমালোচনাত্মক, সংশ্লেষী, কোনও আবেগের উৎসার নয়।” বোঝাই যাচ্ছে আমরা কবিতা ও কাব্যিক প্রাণ বলতে যা বুঝি এ ঠিক তা নয়। এই বইয়ের বহু পরে ওক্তাবিও পাস স্বীকার করবেন তাঁর বিশ্ববীক্ষায় লেসামার অবদান। মিশ্রমাধ্যম কবিতা বা হাইব্রিড কবিতা যা পাস শুরু করেন তা আসলে উশকে দিয়েছিলেন লেসামা লিমা। লেসামা নিজের কবিতায় রাখলেন সেই শান্ত ধ্বংসের আগুন। ” যেহেতু তোমার ধর্ম জ্বলন্ত ও কঠিন/ যেমন প্রত্যঙ্গ কোনও, নিজেকে আগুন দিয়ে ঘেরে/ স্যাঁতসেঁতে এবং গোল সূর্যোদয় অবধি/ এমনকি চওড়া ঘেরের কোনও আগুনকেও শ্রদ্ধা করা হয়” কবিতাটির নাম দিনের বেলা সোন সঙ্গীত। লেখা ১৯৪০ সালে। একই ছন্দ। কিন্তু বাহ্যিকতা অর্থাৎ কবির কুবা নামক দ্বীপস্বদেশ প্রবেশ করছে তার একেবারে নিজস্ব সোন সঙ্গীতের হাত ধরে এই অন্তর্মুখী কবিতায়। তার কাল্পনিকতায়। জীবনের শেষ কবিতার বই “শূন্যের দালান”-এ লিখছেন “স্ক্রু হাতে চলেছি/ দেয়ালকে প্রশ্ন করতে করতে/ বেরং আওয়াজ,/ চাদরে চাপা দেওয়া রং/ কিন্তু আমার চলা অর্থহীন, সাময়িকভাবে/ অন্ধ, নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত টের পাই না।/ আচমকাই মনে পড়ে/ নখ দিয়ে তোকোনোমা উন্মোচন করি, দেওয়ালে।” আর এখানেই প্রোথিত হয় ভবিষ্যতের কবিতার বীজ। না এখানে কোনও চিৎকার নেই। কারণ আমাদের চলা সাময়িকভাবে অন্ধ। নিজের অস্তিত্বও টের পাই না। যেমনটাবা বলেন ভাভা তাঁর অনুকরণ তত্ত্বে। এই কবিতা থেকেই বিবর্তন শুরু।
জীবন্ত ভাষার কবিতা ও কবিদের সমস্ত কালের বৈশিষ্ট্য আগেকার অন্তঃসলিলা কবিতা থেকে জীয়নকাঠির স্পর্শ নেওয়া। নেরুদার সমগ্র ও ওক্তাবিও পাসের “ভারতীয়” কবিতার আগে পর্যন্ত কবিতাকে ইউরোপ সহজে গ্রহণ করেছে কারণ সে কবিতা ইউরোপেরই অপর। এবং লেসামা লিমা ও নববারোককে সহজে বোঝেনি এবং পাস এর দ্বিতীয়ার্ধকে আমেরিকা মহাদেশের খামখেয়াল বলে ছেড়ে দিয়েছে ( যেমনটা বা ঘটেছে মার্কিন দেশের বহু কবির ক্ষেত্রে) কারণ এই কবিতা ইউরোপের ঔপনিবেশিক অপর নির্মাণের খেলার বাইরে। এই কবিতা নির্মিত হয়েছে তার ধ্রূপদী ক্লান্তি চুষে, বাহ্যভৌগলিকতা ফেলে অন্তঃভাষাভূগোল নির্মাণ করে। এবং এরই ফলে আমেরিকা মহাদেশ ইউরোপীয় ভাষায় কথা বললেও তার আর ইউরোপ বা তার স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই।