যশোধরা রায়চৌধুরী

ধুমুহা

প্রচুর আম হয়েছে এবার। এই এপ্রিলের শুরুতেই পথেঘাটে দেখা যাচ্ছে আমগাছগুলো ফলভারে নুয়ে পড়ছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে  গাছে গাছে আম ঝুলে আছে । যেন পান্নার কুচি। স্পষ্ট সবুজ সুন্দর। কেমন লম্বা বোঁটায় ঝুলে থাকা নিটোল আমের ওই আকৃতি। ছবি যেন। 

ছবি নয় শুধু।  বিজ্ঞাপনের ছবি। এই দ্যাখো, এই দ্যাখো বলে চোখ টানছে। নিজেকে  দ্যাখাচ্ছে। আমাকে  দ্যাখো গো, আমার নাম আম। গ্রীষ্ম কালে ফলি, রসে টুসটুস করি। 

সেই সেবার কাজিরাঙা গেসল আন্টি আর স্যার । সুলতাকে নিয়ে গেসল। ওদের সঙ্গে হাতিও চড়ল সুলতা। নইলে বুবুকে ধরবে কে? বুবুকে রেখে যাবেই বা কেন! 

সে কী হুড়োহুড়ি!  চলো অন্ধকার থাকতে উঠে। বড় বড় ঘাসের মধ্যে দিয়ে যায় হাতি। গালে গায়ে সরসর করে লাগে ঘাস। 

কিছুটা জঙ্গল ভেঙে যেতে যেতে উঁচুনীচু কাদার গর্তে পা ফেলছিল হাতি। মোটা পুরু গদি পাতা, সে গদির ওপরে ঢুলছে বুবু, সুলতা তাকে আঁকড়ে ধরে বসে। হঠাৎ একটা ফাঁকা জমির সামনে এসে থেমেছিল হাতির দল। পাশের হাতিতে বুবুর বাবা মা আলতো চিৎকার করেছে। চাপা গলায় । কারণ মাহুত পই পই করে বলে দিয়েছে জোরে গলা তুলে কথা বললে জানোয়ার ভড়কে যাবে। 

হঠাৎ নিবিড় ঘাসবন ছাড়িয়ে আরো দূরে, যেখানে পাতলা হয়ে এসেছে রোদে পোড়া হালকা হলুদ ঘাস, সেখানে দেখেছিল ওদের। কী শোভা!  ছ-সাতটা গন্ডার এরকম সার দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।  স্থির। দেখে মনে হয়েছিল সাজানো পুতুল। ওদের যেন কারা শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে!  সেই রকম। বিজ্ঞাপনের মতন। সুলতা হেসে ফেলেছিল। ওরাও কি তার মতন মাইনে পাওয়া দাসদাসী? মুনিবের কথা শুনে চলে? হাসতে বললে হাসে, চা করে দিতে বললে চা করে? 

সুলতা বুবুকে টেনে নিল নিজের দিকে। চুল পরিষ্কার করে সিঁথে কেটে দিল। ঠিক যেন একটা পায়ে চলা রাস্তা চলে গেছে বনের মধ্যে দিয়ে। দুপাশে কালো চুল, স্পষ্ট সাদা চামড়ার পাশে তেল দিয়ে পাট পাট করে আঁচড়ানো চুল। বুবুর বয়স সাত। সামনের বছর আট হলে বড় ইশকুলে যাবে আন্টি বলে। এখন ও ক্লাস টু তে পড়ছে। সরকারি ইশকুলে। 

ডিপ্টি স্যার আর ম্যাডাম আন্টির খুব দুঃখ আসামে থাকতে হয়, সরকারি স্কুলে পড়াচ্ছে যাতে বদলি হলে সহজে অন্য স্কুলে যেতে পারে। কলকাতা ফিরে যেতেই হবে। তখন বড় ইশকুলের কথা ভাববে ওরা। 

বুবু পড়াশুনো করে আন্টির  কাছে। আংকেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা। তখন সুলতাও থাকে। লেখাপড়া আর খেলাধুলোর পর বুবুর পুরো সময়টা সুলতার। তখন ওরা গল্প করে। সুলতা গল্প বলে, বুবু শোনে। বা গান শোনে ওরা, নতুন সিনেমার নতুন গান। ইংরেজি গান… বুবু শোনায় সুলতাকে। সুলতা ওকে গল্প বলে ভূতের , বলে নিজের জোরহাটে ফেলে আসা বাড়ির, চা বাগানের আর ভালোলাগা ছেলে ইরফানের গল্প। ইরফানকে পুরো নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির মত দেখতে। টিভি চললে নওয়াজকে দেখালে সুলতা বুবুর গা টিপে  জানায় ওকে। বুবুর মুখে একটা আলগা রোমাঞ্চের হাসি ফুটে ওঠে। বুবুর গালে লাল আভা ছড়ায়। সাত থেকে আটে যেতে যেতে বুবুরও কিছু পছন্দ অপছন্দ তৈরি হয়েছে। ক্রাশ তৈরি হয়েছে।বুবু জানে ক্রাশ শব্দ। সুলতা জানেনা। 

আম খায়েগি? পেছনের বাগানে কাল ধুমুহা হয়ে অনেক আম পড়েছে। আগে জোরহাটে ধুমুহা হলেই পরদিন ভোরে আম কুড়োতে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত সুলতাদের। 

আজো সুলতা সেই গন্ধটা পায়। আশ্চর্য এক সবজেটে গন্ধ। মাঠ শুদ্ধু আম কুড়নোর ধুম।  তার হৈচৈ। 

 

 

হাতের পাতা গুটিয়ে গেছে মৃত লোকটির। হারু কিস্কু। 

গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে লোকেরা। বিষবৈদ্য এসেছে। 

মুঠোয় কী যেন নিয়ে, কী যেন রক্ষা করতে করতেই মাঠের মাঝে, ঘাসের মাঝে মরে গেল কিস্কু বুড়ো। টাকা? 

সাপটা যখন ছোবল দিল তখন বুড়ো টাকা গুনছিল। বিষটা  যখন সারা শরীর জুড়ে নীলচে দাপাদাপিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল, তখনো সে টাকাটাকেই বাঁচাতে চেয়েছিল। সুলতাকে বিয়ে দেবে বলে দশ হাজার টাকা মহাজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল। 

এত সজোর মুঠিতে মেয়ের ভবিষ্যৎকে চেপে রেখেছিল সে, যে, মরার পরও কেউ সে টাকা কেড়ে নিতে পারবে না। 

বৈদ্য দেখছিল। নাহ, এ হাত আর খোলা যাচ্ছে না।

হাত খুলতে গেলে মটমট করে আঙুল ভেঙে যাবে।

ক্রন্দনরত বউ আর কন্যা সুলতার দিকে চাইল কিস্কু। 

সমাজ তাদের ঘিরে বলয় রচনা করেছে। এদিকে কিস্কু ও তার পরিবার। ওদিকে সমাজ। যারা চায় গ্রুপডি পাত্রকে সাইকেল দেবে সুলতার বাবা। মানে গত মাসে চেয়েছিল। তারাই, আবার, এখন  চায়, সাপে কাটা অপঘাতে মৃত্যুর জন্য একটা শান্তি বিধান করতে যজ্ঞ করুক বৈদ্য। কী বিশ্রি এক দুর্ঘটনা, যদি আর কেউ মরে শেষে? 

হিন্দুমতে স্বস্ত্যয়ন না। চার্চে গিয়ে গান গেয়ে সবাইকে ভাল মন্দ খাইয়ে ক্রুশ পুজো করা আর কী সব কেমিক্যাল বোতলে ভরে গ্রামময় মন্ত্রপূত জলের মত ছেটানো। 

কার্বলিক অ্যাসিডে কী ভক্তিভাব জাগালেন বাইবেলের অনূদিত ভার্শান পড়ে জন টোপো। 

মট মট আঙুল ভাঙার আওয়াজ শুধু সুলতা ভুলতে পারে না আজো।  রাতে শুয়ে বিছানা ভেজাতো ছোট বেলায় দুঃস্বপ্ন দেখে, বাপু তখন ওকে কোলে কাঁধে নিয়ে ভয় ভাঙাতো। আর এখন ওর নিজেরই বাবার ভূতের ভয়। এমনি গাঁয়ে ওরা বলত  সাদা শার্ট পরা কাকে যেন দেখেছে।  রাত্তিরে, রাস্তায়, আধো অন্ধকারে। চার্চের পাশের কবরীস্তান থেকে উঠে আসছে। শার্ট পরা কিস্কু নাকি ওটা? ঠিক ওরকম সাদা শার্ট। 

বিয়ে হয়নি ওর আর। বদলে মা কাঁদতে কাঁদতে দশ হাজার টাকা দালালকে দিয়েছে। গাড়ি করে তাকে বাবলু ভাইয়া সাত ঘন্টা ধরে জোরহাট থেকে গুয়াহাটি নিয়ে এসেছে। ডিপ্টি সাহেবরা সাতশো দেবে, ওটা এজেন্সি নিয়ে টাকা কেটে ওর মাকে দেয় পাঁচশো। ও খাওয়া পরা পাচ্ছে, বছরে দুবার সালোয়ার কামিজ। বাচ্চা ধরলে সারাদিন হাসি মজাকে কেটে যায়।

শুধু ভয়টা চেপে বসে রাতে। রাতে ওকে সিঁড়ির নীচে শুতে দেয় যে! কোণের কাছে মাদুর টেনে সিঁটিয়ে শুয়ে থাকে ভয়ে সুলতা।

 

 

গন্ডারগুলো রাতে ঘোঁত ঘোঁত করে আসে।  দু’তিনটে ভাইয়া, সরু চোখে দেখছিল দুপুরে। ও যে চোখে গাছে গাছে ফলন্ত আম দেখে, লালচি হয়। তেমন চোখে।

সুলতা সব বোঝে। এরা সব বুবুর ভাইয়া। বুবু বলেছে কাজিন। একটা বা দুটো নিজের চাচাতো-মামাতো ভাই। বাকি তাদের বন্ধু।  কলকাতা থেকে এসেছে।  শিলং যাবে, কাজিরাঙা যাবে।

দু’রাত থাকল ডিপ্টি সাহেবের বাড়ি, গুয়াহাটির মলে গেল খেতে। আইসক্রিম। চিকেন তন্দুরি।  দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিল মাংস। 

সুলতাকে যেতেই হল। নইলে বুবু যাবেই না। আন্টিও বুবুর দেখরেখ, ভালো মন্দ  ভেবেই বলল যেতে। ভাল, নতুন কামিজ পর সুলতা। সাবান দিয়ে হাত পা ধুবি। ওখানে বুবুকে খেয়াল রাখবি। অচেনা লোককে দেখে যেন বুবু না হাসে। ওর হাসির এই দোষ আছে। সবাইকে দেখে হাসে। 

সুলতা এত পরিষ্কার তাও কাছে গেলে আন্টি নাক কুঁচকাবেই। আসলে আন্টি ভাবে আন্টি সুলতার গা থেকে গন্ধ পায়। কুলি লাইন, চা বাগানের গন্ধ। 

গন্ডার পায় না? ছেঁড়া মাদুর, না ধোয়া চাদর, তেলচিটে বালিশে কোন গন্ধ?

গন্ডাররা এল যখন রাতে৷ ওর ঘুম ভাঙাল। সুলতা বুঝল এটা ওর সেই পুরনো দুঃস্বপ্নটা না! যেটাতে ঘরে ঢুকে যেত আস্ত সিংহ। দরজা নেই, বেরুতে পারছে না। এটা আরো জ্যান্ত। ইরফানের কথা ভাবলে যে নরম, অদ্ভুত আনন্দ ভাব হয়৷ বোঝা যায় দিল বলে আছে কিছু  পাঁজরের খাঁচায়, এরা যখন দু’তিন জন মিলে ওকে হিঁচড়ে তুলে ঘুম ভাঙাল, আর নিজেদের ঘরের দিকে আঙুল তুলে কীরকম যেন চোখ করে বলল –  যাবি? নাচব, গাইব, ড্রিংক্স আছে। ব্লু ফিল্ম দেখাব… চকচকে নীল একটা আলো বেরুনো ট্যাব হাতে বড়সড় এক ভাইয়া হাসল কেমন করে, দাঁত সব দেখিয়ে। 

সুলতার দিল বলে কিসসু নেই তখন।  পুরোটা শরীর। জিসম। সুলতার খুব নোংরা লাগল, ভয় হল, ঘেন্না হল।

আরো বেশি রাগ। 

না যাব না। আমি ঘুমাব। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ঘোরাঘুরি, ফিরে চাপাটি তৈরি, অত্ত মাংস রান্না, এত লোকের খাবার সাজানো, বাসন ধোয়া সব করেছি। কোমরে দর্দ।

মোটা গন্ডার এগিয়ে এল, মোটা হাতের পাতা ওর কোমরে রেখে বলল কোথায় ব্যথা?  আয়, মালিশ করে দিচ্ছি।

খিল খিল করে, খ্যাঁক খ্যাঁক করে সবাই হাসল। ধুমুহা তখনই সুলতার মাথায় চড়ল। সাপের মত হিলহিল করল শরীর। এক টানে ওর মোটা আঙুলগুলো উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিতেই সেই শব্দটা হল। 

মট মট মট। আঙুল ভাঙার শব্দ। যে আওয়াজ ওর মাথায় ঢুকে বসে আছে। কোনদিন বেরুবে না।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment