আজকাল নিপাট ভ্রূযুক্ত মানুষদের ভন্ড বলে মনে হয় চঞ্চলার। কথা বলতে গিয়ে মানুষের ভ্রূ দেখতে থাকে সে। আসল কথা কানে বা মাথায় ঢোকে না। মানুষের ভ্রূ দেখে মানুষকে যাচাই করতে থাকে চঞ্চলা। আর দেখে কীভাবে সত্যি সত্যি নিপাট ভ্রূযুক্ত মানুষেরা ভন্ডামি করে চঞ্চলার সাথে। ভন্ডামির শিকার হতে হতে চঞ্চলা গাছে জল দেয়, সমস্ত বিধ্বংসী খবর উপেক্ষা করে শব্দছক সমাধান করে খবরের কাগজের পাতায়। চঞ্চলার স্বামী গলা তুলে বলে “এক কাপ চা হবে না কি,”
চঞ্চলারা নিঃসন্তান। ঘরে আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই তাই। কোথাও কোনো উৎপাতের চিহ্নমাত্র নেই। দেওয়ালে রংপেন্সিলের অত্যাচার নেই। পোষাকের বাড়বাড়ন্ত নেই আলনায়। থালা বাসন দোহারা। নিস্তরঙ্গ জীবন। শুধু ঘরের চারদিকে ধুলোর আস্তর পড়ে থাকে। সন্তানহীন দম্পতির সংসার ধুলিময়। যতই সাফ করুক না কেন, ধুলোধুলো হয়ে যায়। ধুলো ধুলো হয়ে থাকে। চঞ্চলা ভবিষ্যতের দিকে তাকালে ধুলো দেখতে পায়। অতীতের দিকে ফিরলেও চোখে মুখে ধুলোবালি এসে একাকার হয়। চঞ্চলা চোখ বুজে ফেলে। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মধ্যে চঞ্চলা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। চঞ্চলার স্বামী ছেলে ভোলানোর ছলে ঘুমের ঘোরে অস্ফুটে বলে, “না- না!”
চঞ্চলাদের ঘরগুলো ধূসর রঙের। যদিও দেওয়ালে সাদা রঙ করা। তবু চঞ্চলাদের বাড়ি গেলে গোটা বাড়িকেই ধূসর বলে মনে হয়। চঞ্চলাদের মাথার চুলও এখন ধূসর হওয়ায় মানানসই হয়েছে বেশ। অতিথিদের ধূসর চায়ের কাপে হলদেটে চা খেতে দেয় চঞ্চলা। চঞ্চলাদের ঘরগুলো যেন ৯০ দশকে আটকে আছে। চঞ্চলারাও। চঞ্চলাদের বাড়ি গেলেই টের পাওয়া যায় এখানে সচরাচর কেউ আসেনা। এলেও কাজ নিয়ে আসে। অকারণে, শুধুমাত্র দেখা করার জন্য কেউ চঞ্চলাদের বাড়ি যায় না। পেপারবিক্রেতা, কেবল টিভিওয়ালা, দুধওলা, লন্ড্রিওলা বাদে তেমন কেউ যায় না চঞ্চলাদের বাড়িতে। আর যখন যায়, প্রতিবার চঞ্চলার স্বামী বলে ওঠে, “আসুন! আসুন!”
শিয়ালদা স্টেশান থেকে ট্রেনে বা বাসে চঞ্চলাদের বাড়ি যাওয়া যায়। চঞ্চলার বিয়ের সময় বিয়ের কার্ডে দিকনির্দেশ করা ছিল। যে কেউ সেই অনুযায়ী চঞ্চলাদের বাড়ি এসে পড়তেই পারে। কিন্তু কেউ আসেনা। চঞ্চলা চুপচাপ ঘরে বসে শব্দছক সমাধান করে। চঞ্চলার পাশাপাশি আর চঞ্চলার স্বামীর উপরনীচে আঠালো অন্ধকার লেপে থাকে। চঞ্চলা সেই অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে দিনের অনেকটা সময়। অন্ধকার দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে চঞ্চলার চোখে চালশে পড়ে একাকার অবস্থা। চঞ্চলার স্বামীও সেই কবে থেকেই মোটা কাঁচের চশমা পরে। আর সকাল বিকেল থেকে থেকে বলে, “আমার চশমাটা দেখেছ,”
চশমা, ঘড়ি, ইলেক্ট্রিক বিল, ওষুধের পাতা, খুচরো পয়সা খালি হারিয়ে হারিয়ে যায় চঞ্চলাদের ঘর থেকে। চঞ্চলা মাঝে মাঝে ভাবে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি চঞ্চলাও গায়েব হয়ে যায়? চঞ্চলার স্বামী এঘর ওঘর খুঁজবে। পুরনো ড্রয়ারে, আলমারির ভিতর, প্লাস্টিকে ভরে রাখা একতাড়া কাগজের ফাঁকে, ওষুধের প্রেস্ক্রিপশন রাখার ফাইলে, কাঁচের বাসনের তাকে, জামাকাপড়ের আলনায়, বাতিল কাপড় ভরা স্যুটকেসে, সব জায়গায় চঞ্চলার স্বামী চঞ্চলাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজবে আর বলবে, “শুনছ,”
একদিন একটা বিড়াল, চঞ্চলাকে খুঁজে পেল। সাদাটে, রোগা পাতলা, দেখে মায়া হয় না এমন একটা বিড়াল, চঞ্চলাদের বাড়ি যাওয়া আসা শুরু করল। চঞ্চলা ওকে এঁটো খাওয়ায়। মাছ চুরি করতে গেলে ধাওয়া দেয়। পায়খানা বমি করে দিলে লাঠিপেটা করে। বিড়ালটা এক দু বেলা আসেনা। ভয় পায়। তারপর ভুলেও যায় যে মার খেয়েছিল। রাতের দিকে মাছের কাঁটা খেতে চলে আসে আবার। পরের দিন, বা তারপরের দিন বা তারও পরের দিন চুপিচুপি রান্নাঘরে চলে আসে বিড়ালটা। পায়ের আওয়াজ হয় না বিড়ালদের। চঞ্চলা টের পায় না যে বিড়ালটা লাফ দিয়ে গ্যাসওভেনের উপর উঠে এসেছে। আর জিরোতে দেওয়া দুধের বাটির ঢাকনা সরিয়ে কবোষ্ণ দুধের মধ্যে জিভ নামিয়ে দিয়েছে। চঞ্চলার স্বামী এই দৃশ্য দেখা মাত্র চিৎকার করে ওঠে, “অ্যাই! হ্যাট! হ্যাট!”
বিড়ালটা আবার বেশ কয়েক বেলা খেতে আসে না। চঞ্চলা অতখানি দুধ নর্দমায় ফেলে দেয়। সাদা দুধ নর্দমার জল লেগে পাতলা হয়ে বয়ে যায়। কুয়াশার মত দেখতে লাগে। চঞ্চলার রাগ হয় খুব। চঞ্চলার প্রচন্ড কান্না পায়। মনে মনে ভাবে বিড়ালটা এলে এবার আচ্ছা করে পিটবে। কিন্তু বিড়ালটা আসে না। পরেরদিনও আসে না। তারপরের দিনও না। চঞ্চলার মন কেমন করে। কিছু হয়ে গেল না তো, গাড়িতে চাপা পড়ল কি না, অন্য বিড়ালে এসে মেরে দিয়ে গেল কি না, অথবা মানুষের আঘাতে বিড়ালটার প্রাণ গেল কি না ভেবে ভেবে সারা হয় চঞ্চলা। দুপুরবেলা খেতে বসে গ্রাস করতে ভুলে যায়, ভাতমাখা হাত মুখ অবধি উঠে আসে না। চঞ্চলার স্বামী বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিনদিন পরে বিড়ালটা যখন আবার আসা শুরু করে, ধীরে ধীরে চঞ্চলা টের পায় বিড়ালটার পেট হয়েছে। চঞ্চলার হিংসে হয়। ইচ্ছে করে মাছের কাঁটা কম রাখে। ইচ্ছে করে মাছের কাঁটা গিলে খায়। গলায় কাঁটা বেজে খ খ করে খানিকক্ষণ। জলের বোতল হাতড়ায়। একদলা ভাত নুন দিয়ে মেখে কক্ করে গিলে ফেলে। তারপর ঢোক গিলে দেখে কাঁটা গেল কি না।
কাঁটা যায় না। গলার ভিতর খচখচ করে। সারাজীবন খচখচ করে। সকাল বিকেল খচখচ করে। মনের ভিতর খচখচ করে। চঞ্চলার স্বামী খাবার টেবিলে একা একা বলে ওঠে, “দোষটা কার ছিল বলো তো,”
বিড়ালের বাচ্চা হয়, খান তিনেক। একটাকে এলাকার হুলোয় নেয়। একটা কাকের খপ্পরে পড়ে। একটাকে আগলে রাখে মা বিড়াল। মুখে করে এবাড়ি ওবাড়ি নিয়ে নিয়ে শেষে চঞ্চলাদের বাড়ি এসে পড়ে। চঞ্চলার চোখ মুখ চিড়বিড় করে। চঞ্চলা শাবক মুখে মা’কে বিদায় করতে চায়। বিড়ালটা নাছোড়। দরজা নিয়ে তাড়ায় তো জানালা দিয়ে আসে। জানালা দিয়ে তাড়ায় তো চোখ মুখ নাক কান নয় দ্বার দিয়ে ঢুকে আসতে চায়। ঘুমের ঘোরে ভিজে যায় চঞ্চলা। রান্নাঘরে ভিজে যায় চঞ্চলা। শসা, পেঁয়াজ, আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে চঞ্চলা ভিজে একসা হয়, হাত থেকে সশব্দে খসে পড়ে যায় আনাজ ভরা বাটি। চঞ্চলার স্বামী টিভির ভলিউম কমিয়ে ডাকে, “করছ কী!”
রাতের বেলা চঞ্চলার হাত গিয়ে পড়ে চঞ্চলার স্বামীর খোলা পিঠে। নাইট ল্যাম্পের আলোয় সেখানে আঁচিল দিয়ে তারামন্ডল তৈরি হয়ে থাকে। স্বামীর পিঠে চঞ্চলা মনে মনে আঁচিলের ক্যাসিওপিয়া, আঁচিলের কালপুরুষ আঁকে। তারপর তাদের ছুঁয়ে দেয়। ঘেঁটে দেয়। পিঠে তারাদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে চঞ্চলার স্বামী অঘোরে সুষুপ্ত। চঞ্চলা বুকের বাঁধন আলগা করে স্বামীকে ডাক দেয়। চঞ্চলার স্বামী ঘুমের মধ্যে বলে ওঠে, “কী হল,”
চঞ্চলার কী হয়েছে চঞ্চলা জানেনা। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে বিড়ালটাকে সেধেসেধে দুধ খাওয়ায় সে। তারপর বাচ্চাসমেত বিড়াল বস্তায় ভরে বেরিয়ে পড়ে। স্টেশানে এসে অনেক দূরের টিকিট কেটে লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ে বস্তাসমেত। আমরা দেখি লাল হলুদ শাড়ি পরে চঞ্চলা দূরে অনেকদূরে চলে যাচ্ছে। সীটের নিচে রাখা বস্তায় বিড়ালরা ছটফট করছে ভয়ে, ক্যাও ম্যাও করছে। বিড়ালের ডাক শুনে যাত্রীরা ঘুরে ফিরে চঞ্চলার দিকে তাকাচ্ছে। অবাক চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে গাছ পালা পুকুর বিল সরু রাস্তা ঝুপড়ি বস্তি দেখতে দেখতে চঞ্চলা নিজেকে পার করে যাচ্ছে। অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।
সন্ধ্যেবেলা চঞ্চলা ফিরে এল, খালিহাতে। দেখল চঞ্চলার স্বামী খাটের উপর বসে তাসের পরে তাস সাজিয়ে পেশেন্স খেলছে। নিপাট ভ্রূযুক্ত চঞ্চলাকে দেখে চঞ্চলার নিপাট ভ্রূযুক্ত স্বামী বলে উঠল, “এসেছো? এসেছো?”
চঞ্চলার স্বামী বলে উঠল, “ডিড ইউ কাম?”
চঞ্চলার স্বামী জানতে চাইল, “হ্যাভ ইউ কাম?”
চঞ্চলার স্বামী জিজ্ঞাসিল, “হ্যাভ ইউ কাম ইয়েট?”
কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। জানি না কেন…
বড় হয়ে গেলে বোধহয় সবারই এরকম এমনি এমনি কান্না পায়…
ভালো থাকবেন।
পড়লাম, অনবদ্য গদ্যের চলনে ডুবে গেলাম… এমনও গল্প হয়! শুভেচ্ছা রইল