(দেবভাষা’র পক্ষে)
৬বি, যতীন দাস রোড, লেক মার্কেট, কলকাতা ২৯। দেবভাষার সাম্প্রতিক ঠিকানা। এ-বছর পয়লা বৈশাখ থেকে। এর আগে ছিল রিজেন্ট প্লেস, রাণিকুঠি। ওটা দেবজ্যোতির বাড়ির ঠিকানা। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে দেবভাষার যাকে বলে পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস, তা এখনও অব্দি নেই। কোনোদিন যে হবে তা হলফ করে বলা খুব কঠিন। ব্লাড ডোনার অনেকেই। আমরা একজন যে কোনো গ্রুপের ল্যান্ড ডোনার খুঁজছি, জানা থাকলে বলবেন, কৃতজ্ঞ থাকবো।
যতদূর জানি, আমি এবং দেবজ্যোতি ( মুখোপাধ্যায় ), সিরিয়াসলি কিছু করতে হবে ভেবে, আজ অব্দি কোনো কাজই করিনি। কবি হতে হবে ভেবে কবিতা লিখিনি। সম্পাদক হতে হবে ভেবে কাগজের অফিসে চাকরি নিই নি। জম্পেশ এক প্রকাশক হবো ভেবে দেবভাষা করি নি। তবু আমাদের কবিতা কোথাও ছাপা হলে কাছের লোকেরা বলেন শুনেছি, ওরা তো সম্পাদক! খুব ভালো একটা সংখ্যা (যাকে কাগজের আপিসে বলে ‘হিট সংখ্যা’) বের হলে, কাছের লোকেরা বলেন শুনেছি, ওরা তো প্রকাশক! শিল্প বিষয়ে কোনো বই প্রকাশ করলে, সেই কাছের লোকেরাই বলেন শুনেছি, ওরা তো কবিতা লেখে! যে চুল বাঁধে, সে কেবলই চুল বাঁধে বলে আমাদের দুজনের কোনো পার্মানেন্ট পরিচয় নেই। ঠিক যেমন দেবভাষারও আজ অবধি কোনো পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস নেই।
পার্মানেন্ট পরিচয় না থাকায় কুলীন বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে আমরা দুজনেই আজও বহিরাগত। আউটসাইডার। দেবভাষাও বাংলা প্রকাশনার জগতে বহিরাগতই। নইলে তার ঠিকানা কলেজ স্ট্রিট ছেড়ে লেক মার্কেট হয়? সুতরাং সূত্র মেনে বলাই যায়, আমি এবং দেবজ্যোতি বাংলায় লেখালিখি করলেও যেমন বাংলা সাহিত্যের কেউ নই, তেমনই, আমাদের ‘দেবভাষা, বই ও শিল্পের আবাস’ও বাংলা প্রকাশনাক্ষেত্রের কেউ নয়। এহেন প্রকাশনা বিষয়ে অনিমিখ ও সঙ্ঘমিত্রা যখন কিছু লিখতে বললেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমি যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম।
প্রসঙ্গের মূলে পৌঁছই, খামোকা দেবভাষা করতে গেলাম কেন? বাংলা সাহিত্য তো শুনেছি রটউইলার-রাই চালান। আমাদের তেমন পেডিগ্রি কেন হবে? আমরা নিতান্তই নেড়ি (তায় বহিরাগত)। ফলত আমাদের কোনো প্রকাশক নেই। আমাদের জন্য নেই কোনো ক্ষুদিরাম। ফলে আমরাই আমাদের বার খাওয়ালাম আর ‘দেবভাষা’ রচে সেখান থেকে বের করলাম নিজেদের কবিতার বই। বই প্রকাশের সেই মাহেন্দ্রমুহূর্তটি থেকে আজ পর্যন্ত সিলভার ফিশেরাই আমাদের লেখা কবিতার বইয়ের একমাত্র পাঠক।
যদিও আমাদের কোনো পাঠক নেই তবু আমরা নিজেদের লেখা লিখবোই, নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে বই বার করে যাবই। কেননা তুষার চৌধুরির কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- বদরক্ত শরীরে জমতে দেবো না, বই হিসেবে বার করে দেবো। তাহলে আবার নতুন রক্ত, নতুন লেখা …। উৎপলকুমার বসু একবার স্বগৃহে দীর্ঘ আড্ডাবসানে দাবি তুলেছিলেন, নিজেদের বই প্রকাশ না করলে তোমাদের সঙ্গে এর পরের আড্ডাটি আর সম্ভব নয়। আপনার এহেন র্যােগিং-এ আমাদের কই, অপকার হলো না তো! ইতিপূর্বে পানশালার আলো-আঁধারিতে (বোধহয় বঙ্গসাহিত্যের প্রেতেদের ভয়ে ভীত) রাহুল পুরকায়স্থ ঘোষণাই করে দিলেন –কবিরা দেবতার ভাষায় কথা বলেন। কবিতার ভাষা তাই ‘দেবভাষা’।
আমাদেরও পরিকল্পনা ছিল ‘দেবভাষা’ থেকে কবিতারই বই বের হবে। তুষার চৌধুরির জীবিতাবস্থায় শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘সময়মঞ্জীর’ বেরল দেবভাষা থেকে (অত্যন্ত খারাপ প্রোডাকশনসহ)। কিন্তু পড়ামাত্র কর্পুরের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল, ঠিক যেমন, চিরবিদায়ে চলে গেলেন তুষারদাও, ক’দিন পরেই। অতঃপর তুষার চৌধুরি স্মরণ সংখ্যা। অতঃপর ‘অগ্রন্থিত কবিতা তুষার চৌধুরি’।
কবিরা প্রকৃতই প্রতিভাবান। কবিরা নিজেদের বই বের করার দুর্নিবার প্রেরণায় ল্যাম্পপোস্টকেও প্রকাশক করে দিতে পারেন। দেবভাষার কাছেও এরকম বেশ কয়েকটি অফার আসতে, আলো না থাকার অজুহাতে দেবভাষা বিনীত ভঙ্গিমায় সেইসব উপরোধ ফিরিয়ে দিল। কবিরা অনেকেই শুনে বললেন, আলো নেই, তাতে কী! আলোর ব্যবস্থা তো আমরাই করে দেবো। এভাবেই তো বাংলা প্রকাশনা জগৎ তার কৌলিন্য বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু দেবভাষা তো আউটসাইডার। সে দিনে আনে আর দিনে খায়। সাহিত্যের কুলিকামিন। হ্যাভ নট। সে কী করে প্রকাশক হবে? টাকা নিয়ে বই করার প্রচলবহু রীতিটি তার অদরকারি মনে হল। পাশাপাশি, সে এও লক্ষ করছে, ডি. কে-র মডেল অনেক আগেই অচল হয়ে গেছে। ডিটিপির কল্যাণে এখন ফিঙে পাখিটিও বাতাসে আঁচড় কেটে বই প্রকাশের জাদুবিদ্যে রপ্ত করে ফেলেছে। বইয়ের মান নিয়ে, প্রোডাকশন নিয়ে কে ভাবে? কেনই বা ভাববে? আপনি কি ঠাসবুনোট লোহালক্কড়ের ব্যবসাদার? কিংবা হোসিয়ারি কোম্পানির মালিক? মাছের ভেড়ি আছে আপনার? নিদেন নির্জন পাহাড়ের কোলে রতিবিলাসের এইটুকু হোমস্টে? কিংবা অমুক মন্ত্রীর ছোট ছেলের তৃতীয় পক্ষের বউয়ের সেজো পিসির আপনিই তো জুতো সাপ্লায়ার? তাহলে আর চিন্তা কী মশাই? অনন্ত আলকাতরা রঙের টাকা আপনার। চলুন, রোববার করে মা বিশ্বেশ্বরীর মন্দিরে কাঙালি ভোজন করান আর ফি বছর কাঙাল সাহিত্যজীবীদের জন্য খুলে ফেলুন একটি গ্রন্থ প্রকাশনা কেন্দ্র। কালো যেমন সাদা হবে, বুদ্ধিজীবি মহলে সমাদর পাবেন তেমনই।
শুরুতেই বলেছিলাম, দেবজ্যোতি আর আমি, খুব সিরিয়াসলি কিছু করতে হবে ভেবে, আজ অবধি কোনো কাজই করিনি। উপরোক্ত বঙ্গপ্রকাশককুলের মতো সিরিয়াসলি আমরা আমাদের প্রকাশনাকে দেখি না। স্বীকার্য, এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। সুগন্ধি পাউডার বগলে মেখে ফুটবল খেলতে যাওয়ার শখ ও সামর্থ যে কেন আমাদের হল না! আমাদের অজানা রয়ে গেল এরকম কত কিছুই! আর আমাদের দুজনের তো হারাবার কিছু নেই ( হ্যাভ নট ), তাই, আমরা যে কিছুই জানিনা, তা স্বীকার করতেই বা লজ্জা কীসের? শিল্পী কে.জি. সুব্রম্ভণ্যন কে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর বরোদার বাড়িতে। স্বীকার করলাম, ‘মানিদা, আমরা কিচ্ছু জানিনা। আমরা আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি’। প্রকাশিত হল ‘সাক্ষাৎকার কে.জি.সুব্রম্ভণ্যন’।
ছবির পাশাপাশি উৎসাহ আলোকচিত্র বিষয়েও। প্রকাশিত হল ‘সাক্ষাৎকার নিমাই ঘোষ’। এরকম ভাবেই, যা যা অজানা আমাদের, সেসব বিষয় সম্পর্কে কিছুমাত্র আন্দাজ পাবো, এই নেশায় অন্য অন্য বই বের করে চলেছি। কবিতা লিখতে গেলে একমাত্র কবিতাই পড়বো, অন্য বিষয়ে জানার অত কী দরকার – এরকম আশা করি কেউই ভাবেন না, আমরাও ভাবি না। বরং এভাবেই ভাবতে ভালোবাসি, অন্ধকার একটা টানেলের মধ্যে হোঁচট খেতে খেতে, হাতড়াতে হাতড়াতে চলেছি আমরা, এটুকুই আমাদের পথ চলা।
এখন প্রশ্ন হল, কিছু জানার জন্য বই পড়লেই তো হয়, বই করার দরকার কী?
আমি ছোটবেলা থেকেই বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছি। ইংরেজি বই পড়ি যখন, দেখি, অনেক শব্দই বার কয়েক পড়ে ফেলার পরেও, মাথার ভিতরে গেঁথে যাচ্ছে না, কেমন যেন বাইরের স্তরেই রয়ে যাচ্ছে। তখন খাতায় কলমে আমি সেই বাক্য বা বাক্যাংশকে অনুবাদ করে দেখেছি, তা আর বাইরে বেরোতে পারছে না, মাথার মধ্যেই মাছের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। তারপর ক্লান্ত হলে ঘুরপাক থামিয়ে সেই মাছ মাথার ভিতরেই স্থির ভাবে রয়ে যাচ্ছে।
আর, একটা বই করা মানে প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে তার সঙ্গে যাপন, প্রুফ চেকিং থেকে শুরু করে একেবারে বই হয়ে ওঠার পর শুকিয়ে আসা আঠার গন্ধ প্রথম নেওয়া- এই জার্নিটুকু একেবারে নেশার মতো। যার এই নেশা আছে, একমাত্র তারই এই নেশা আছে। এই নেশাড়ুরা ব্যাঙ্ক ব্যালান্সকে পেশিবহুল করার জন্য প্রকাশনার সাথে যায় না; আহা কী দারুণ দারুণ সব বই বার করছ – এমন প্রশংসা পাবে বলেও এই বইবিবাহে যায় না, এ হল সম্পূর্ণতই এক ধরণের খেয়াল, পাগলামো, এর অতিরিক্ত কিছু নয়। দেবভাষাও আমার আর দেবজ্যোতির কাছে ব্যক্তিগত খেয়াল চরিতার্থ করার বা পাগলামো করার জায়গা। এখনও অবধি আমরা নেট সেল, গ্রস প্রফিট, অ্যানুয়াল টার্নওভার গোছের কোট-টাই পরা শব্দসমূহের থেকে দেবভাষাকে দূরে রাখতে পেরেছি। তা বলে, দেবভাষা সম্পর্কে আমরা যে শুচিবায়ুগ্রস্ত, এমনটাও দাবি রাখি না। বই ছাড়া আরও অনেক কিছুর মধ্যে দিয়েও তো আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। বাংলার অনেক প্রকাশকই বরং নাক সিঁটকোতে পারেন এই জেনে, এখানে নিয়মিত গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি চিত্রপ্রদর্শনী হয়, লোকশিল্পের নমুনাও রাখা থাকে উৎসাহী সংগ্রাহকদের জন্য। প্রকাশনার তথাকথিত ওরিজিনালিটি নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, তবে জানাই – আমি মাঝে মাঝে দাড়ি রাখি। একঘেয়ে মনে হলে কেটে ফেলি। দেবজ্যোতির চুল এতো বড়ো হয়ে যায় যে, সর্দি হলে কিছুতেই যেতে চায় না। একঘেয়ে লাগলে ও একেবারে ছোট ছোট করে চুল কেটে ফেলে। আমরা একভাবে, একরকম হয়ে থাকতে কে-ই বা কতদিন পছন্দ করি? আমাদের বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কবিতা যেমন বদলে যায়, আমাদের কাজও তো বদলাবে, নাকি? আর দেবভাষা সে অর্থে আমার ও দেবজ্যোতির শুধু কর্মক্ষেত্র নয়, আমাদের বিভিন্নরকম আইডিয়ার একটা জংশন। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে দেবভাষাও তো বদলে যাবে, তাই না? শুরুতেই বলেছি, আবারও বলছি, আমার, দেবজ্যোতির, এমনকি আমাদের দেবভাষার কোনো পার্মানেন্ট পরিচয়পত্র দাখিল করা এককথায় অসম্ভব।
পুনশ্চ : একটি কথা, ব্যতিক্রম যেমন সর্বত্র, সাহিত্য ক্ষেত্রেও কি তা নেই? অবশ্যই আছে। সেইসব প্রকাশক ও সাহিত্যিকদের আমার প্রণাম। তাঁরাই কম্পাস। সমস্যা এই, ঝুড়ি থেকে এখন ভালো আমটিকে খুঁজে নিতে হয়। আগে যা করতে হত নষ্ট আমের ক্ষেত্রে। তুমি নষ্ট ফলটি চিনে ফেললে তো তাকে ফেলে দিলেই নিশ্চিন্ত। এখন তার উলটপুরাণ। তুমি দেখলে এই ফল কার্বাইডে পাকা নয়, একে ঝুড়ি থেকে আলাদা করে রাখো। শনাক্ত করাটা ইদানীং সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে। অভিভাবক প্রয়োজন। যেমন দুজন অভিভাবক। একজন কৃষ্ণেন্দু চাকী। অপরজন সুশোভন অধিকারী।
১. সময়মঞ্জীর। তুষার চৌধুরী। ২০১১।
২. অগ্রন্থিত কবিতা। তুষার চৌধুরী। জানুয়ারি ২০১২।
৩. অবশেষ কোথায় কখন। সঞ্জয় মুখার্জি। জানুয়ারি ২০১২।
৪. ব্যভিচারী অ্যাকোয়ারিয়াম। সৌরভ দে। জানুয়ারি ২০১২।
৫. সহস্র চাঁদের ধ্বনি। দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। জানুয়ারি ২০১২।
৬. প্রেতলোক। সৌরভ দে। জানুয়ারি ২০১৪।
৭. শেষ দুমাত্রার মতো। দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। জানুয়ারি ২০১৪।
৮. রাই বলো রাই। সৌরভ দে। ক্রিসমাস ২০১৪।
৯. আমাদের বাড়ি। দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। ক্রিসমাস ২০১৪।
১০. সাক্ষাৎকার কে.জি. সুব্রহ্মণ্যন। জানুয়ারি ২০১৫।
১১. তো? সৌরভ দে। ডিসেম্বর ২০১৫।
১২. আঙুরভাব শেয়ালভাব। দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। ডিসেম্বর ২০১৫।
১৩. সাক্ষাৎকার নিমাই ঘোষ। মার্চ ২০১৬।
১৪. শব্দে আমাদের জন্ম।তুষার চৌধুরী। মে ২০১৭।
১৫. Ramkinkar’s Final Decade। আর. শিবকুমার। মে ১০১৭।
১৬. সাক্ষাৎকার সনৎ কর। অগস্ট ২০১৭।
১৭. কে.জি. সুব্রহ্মণ্যনের সরা। অগস্ট ২০১৭।
১৮. আমার শিল্পভাবনা। সুতনু চট্টোপাধ্যায়। অক্টোবর ২০১৭।
১৯. আমার মাস্টারমশাইরা। অনিতা রায়চৌধুরী। নভেম্বর ১০১৮।
২০. বাংলার পটচিত্র। সুশোভন অধিকারী। জানুয়ারি ২০১৮।