জুয়েল মাজহার

টোমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা

টোমাস ট্রান্সট্রোমার: কবিতায় যার শেকড় পোঁতা

Transtromer’s roots are deep into the land of poetry—Adonis

‘‘সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন একজন মনোবিদ, যিনি তাঁর কাজের অবসরে কালেভদ্রে-লেখা কবিতার ছত্রে তুলে আনেন প্রতিদিনের জীবনরহস্য; গাড়ি চেপে কাজে যান, সূর্য ওঠা দ্যাখেন অথবা রাত নামার প্রহর গোনেন।’’

২০১১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমার সম্বন্ধে এই কথা ক’টি লিখেছিল সংবাদ সংস্থা এপি

গাড়ি চালিয়ে কাজে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা নিয়ে, ভোরবেলা সূর্য ওঠা আর গোধূলি নিয়ে বিস্তর কবিতা আছে এই কবির। জীবনের এইসব অতিসাধারণ মুহুর্ত আর নীরব পালাবদলের প্রতিটি সময়খণ্ডকে বাঙময় করেন তিনি নিরাভরণ শব্দে, শান্ত ধূসর অনচ্ছ রঙে, অচঞ্চল তুলির পরশে; আর সেসব মুহুর্ত আয়নার ভেতরে প্রতিফলিত হয়ে বারবার ফিরে ফিরে আসে, মুখ বাড়িয়ে দ্যায় নানা অলিন্দে, জানালায়।অজস্র চিত্রকল্পে, উপমায়-রূপকে

কবিতা লেখাই তাঁর একমাত্র কাজ নয়। আমৃত্যু ট্রান্সট্রোমার ছিলেন আনখশির এক খেটে খাওয়া মানুষ; নিজের পেশাগত কাজটুকু করার পর যেটুকু অবসর পেতেন তখনই কেবল কবিতা লেখার ফুরসত মিলতো

ট্রান্সট্রোমারের দীর্ঘদিনের বন্ধু সুইডিশ লেখক লারস গুস্তাফসন (Lars Gustafsson) এ-ব্যাপারে বলেছিলেন: ‘‘বড় কবিদের অনেকেই কবিতা লেখার বাইরে তেমন কিছুই করেন না। কিন্তু এই মানুষটা একজন মনোবিদ হিসেবে গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন কঠোর পরিশ্রম করে তাঁর লেখার ফুরসত মিলতো কেবল শনিবার বিকেলবেলায় আর অবসরের মুহুর্তে। প্রায়শই ছোট্ট গাদাগাদি করা এক ঘরে।’’ 

আর হয়তো এ কারণেই ১৯৬০ এর পুরো দশকে তার লেখা কবিতার সংখ্যা ৬০টিরও কম। লেখক হিসেবে পরিবার পরিজন, দেশ বা সমাজের কাছ থেকে আলাদা মনোযোগ বা সম্মান কোনোটাই চাননি। জনসঙ্ঘ থেকে নিজেকে বরং আড়ালেই রাখতে চেয়েছেন। লেখক-পরিচয় তাঁর পেশার পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠুক, কখনো চাননি। দুটোকে রাখতে চেয়েছেন আলাদা:”Transtromer split his time between his literary career and his psychology career since the mid-1960s.”

গুস্তাফসন আরো যোগ করেন,‘‘ ধারণা করি, তাঁর পাঠকরাও তাঁকে সেভাবেই জেনেছেন। তাঁর কবিতা খুবই আটপৌরে বিষয় নিয়ে রচিত। এমনসব বিষয় নিয়ে যা সব মানুষের জীবনে থাকে—–যেমন স্বপ্ন।’’

১৯৯০ সালে স্ট্রোক করার পর আমৃত্যু প্রায়-বাকরহিত ছিলেন কবিশরীরের ডানদিক অবশ। লেখালেখিও অনেকাংশে গিয়েছিল থমকে। কিন্তু তাঁর একহাতের নিপুণ আঙুলরাশি পিয়ানোতে তবু বইয়ে দিতে পারতো উচ্ছ্বল সুরের ঝর্না

সিদ্ধকাম তিনি আরো বহু ক্ষেত্রেই; খুবই উঁচুদরের এক পিয়ানোশিল্পীও যে তিনি! সেইসঙ্গে সুইডিশ ভাষায় তাঁর সময়ের সবচে খ্যাতিমান অনুবাদকদেরও একজন তিনি।পক্ষাঘাতের পরও ১৯৯৬ সালে ‘‘দ্য সরো গন্ডোলা’’ (“The Sorrow Gondola”) ও ‘‘দ্য গ্রেট এনিগমা’’(“The Great Enigma.”) নামের দুটি অসামান্য কবিতাবইয়ের পাশাপাশি বেরিয়েছিল আরো কটি অসামান্য বই। 

ট্রান্সট্রোমারের নোবেল পাওয়া নানা কারণে তাৎপর্যময়। ১৯৯৬ সালে পোলিশ কবি ভিস্লাভা সির্ম্বোস্কা (Wislawa Szymborska) নোবেল জেতার পর দীর্ঘ ১৬ বছর পুরস্কারবঞ্চিত ছিল কবি ও কবিতা। ট্রান্সট্রোমারের পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে কবিতা ভেঙে দেয় সেই অচলায়তন

পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে, সাংবাদিকদের করা এ-প্রশ্নে তাঁর উত্তর: খুব ভালো

স্বামীকে মনিকা বললেন, ‘‘এটা তো এক মহা সারপ্রাইজ, টোমাস। আমি জানি তুমিও অবাক হয়েছো। এতো-এতো বছর ধরে যতো জল্পনাই চলুক, তুমি আসলে ওসব একদমই আমলে নাওনি।’’

মনিকার ভাষায়, ‘‘টোমাস খুব খুশি এজন্যে যে, দীর্ঘ বিরতি শেষে পুরস্কৃত হয়েছে কবিতা।’’

কবি হিসেবে বিশ্বব্যাপী ট্রান্সট্রোমারের খ্যাতি বহু আগে থেকেই। কেবল সুইডিশ কবি হিসেবে নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সবচেপ্রভাবশালী স্ক্যানডিনিভীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত তিনি। কম করেও ৬০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা

ট্রান্সট্রোমার এমনই এক কবি যাকে, অনেক দেরিতে পুরস্কারটি দিয়ে সুইডিশ একাডেমি বরং দীর্ঘদিনের পাপমোচনই করলো। সুইডিশ বলে তিলার্ধ্ব পক্ষপাতের প্রশ্ন এখানে অবান্তর

অনেক দেরি করে তাঁকে নোবেল দেবার বিষয়ে সমসাময়িক সুইডিশ কবি বব হানসন (Bob Hansson ) তাঁর ব্লগে লিখলেন:‘‘সুইডিশ বিনয় অথবা সুইডিশ-হওয়ার-সুইডিশসুলভ-ভয়-জড়তা ট্রান্সট্রোমারের পুরস্কারপ্রাপ্তিকে কম করে হলেও ১০টা বছর পিছিয়ে দিয়েছে(“The Swedish modesty, or the Swedish fear of being Swedish, has postponed Transtromer’s award by at least 10 years.” )

ট্রান্সট্রোমারের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সুইডিশ একাডেমির পারমানেন্ট সেক্রেটারি পিটার এংলুন্ড(Peter Englund) কিছু প্রণিধানযোগ্য কথা বলেন: ‘‘…ভালো কবিতা এক বিক্রম। এটা আমাদের পৃথিবীর ছবিটাই দেয় বদলে; একে করে তোলে আরও স্বচ্ছ-সাবলীল, আরো তীক্ষ্ণ সেইসঙ্গে বাড়িয়ে দ্যায় উপলব্ধির সীমানা।টোমাস ট্রান্সট্রোমারের মৃদু অনুচ্চ স্বরকে আমরা খাটো করে যেন না দেখি। সেখানে আমাদের অস্তিত্বের বেশ কিছু বিস্ময় সতত বিরাজমান: স্মৃতি, ইতিহাস,মৃত্যু, প্রকৃতি। প্রকৃতি সেখানে ফেলনা নয় মোটে।প্রিয় টোমাস, আপনার কবিতা পড়ার পর নিজেকে অকিঞ্চিৎকর ভাবা অসম্ভব। অথবা ভুল কারণে পৃথিবীকে ভালোবাসাও সম্ভব নয় আর।আমাদের চেনা পৃথিবীতে আগে থেকেই বিরাজমান কিছুকে স্বচ্ছ করে তোলে আর মেলে ধরে বলেই মহৎ কবিতা মহৎ কবিতা হয়ে ওঠে না; বরং এই কারণেও যে, সত্যিকার অর্থেই তা বাড়িয়ে দিতে পারে চেনা পৃথিবীর সীমানা। এখানেই এর ক্ষমতা নিহিত।’’  

পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিজয়ীরা সাধারণত বিশেষ নোবেল বক্তৃতা পড়ে শোনান। তবে ট্রান্সট্রোমারের বেলায় তা হয়নি। গানে-রূপ-দেওয়া তাঁর বিভিন্ন সময়ে লেখা ১৩টি কবিতা গেয়ে শোনানো হয়। গুস্তাফ সোইকিস্ট (Gustaf Sjöqvist) –এর চেম্বার কয়ার এবং উপসালা চেম্বার সলোয়িস্ট যখন সুরে-সুরে পরিবেশন করছিল তাঁরই লেখা কবিতাগান, প্রায়-বাকরহিত ট্রান্সট্রোমার তখন সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন নিষ্পলক। স্টকহোমে দিনটা ছিল বুধবার

নোবেল জয়েরও আগে বহু আন্তর্জাতিক কবিতা-পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এসবের মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউস্টাড্ ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর লিটারেচার (the Neustadt International Prize for Literature), বোন্নিয়ের কবিতা পুরস্কার (Bonnier Award for Poetry), জার্মানির পেত্রার্ক পুরস্কার (Petrarch Prize), দ্য বেলমান প্রাইজ (the Bellman Prize), সুইডিশ একাডেমির নরডিক প্রাইজ ও দ্য অগাস্ট প্রাইজ (Nordic Prize, and the August Prize)

১৯৯৭ সালে সিটি অব ভাস্টেরাস (Västerås) কর্তৃপক্ষ স্পেশাল ট্রান্সট্রোমার প্রাইজ নামে তাঁর সম্মানে এক নতুন পুরস্কার প্রবর্তন করে। ২০০৭ সালে বিখ্যাত গ্রিফিন ট্রাস্ট (the Griffin Trust)–এর ট্রাস্টিবোর্ড কবিতায় জীবনব্যাপী অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে স্পেশাল লাইফটাইম রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ডে (special Lifetime Recognition Award) ভূষিত করে। অ্যানুয়েল গ্রিফিন কবিতাপুরস্কারও (annual Griffin Poetry Prize) এরাই দিয়ে থাকে

ট্রান্সট্রোমারের কবিতার অসামান্যতা প্রতিদিনের জীবনের অতি সামান্য বিষয় নিয়ে; সামান্যই সেখানে হয়ে ওঠে অসামান্য। ট্রান্সট্রোমারের স্বদেশি জীবনীলেখক স্তেফান বার্গস্টেন ( Staffan Bergsten) বলেছেন, মানুষ, প্রকৃতি আর অতিসাধারণ আটপৌরে বিষয়ের সমবায়ে গড়ে ওঠা তাঁর কবিতা পড়ে প্রতীতি হয়, ‘‘আড়ালে হয়তো রয়ে গেছে গহনতর কিছু। সেখানে নেই কোনো অচেনা শব্দবাহুল্য। সবার কাছেই কমবেশি বোধগম্য, তথাপি সেখানে অন্য এক মাত্রা থেকে যায়।’’

তিনি বাস্তবতায় নতুন প্রবেশাধিকার দেন পাঠকের চোখ আর কানকে। তাঁর কবিতা রচিত হয় তাঁর নিজেরই অভিজ্ঞতার জগৎ ঘিরে। আর এর ভেতর পোরা থাকে তাঁর সঙ্গীতপ্রেম, তাঁর প্রকৃতিপ্রেম। তাঁর কবিতায় এ-দুটোই পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। সেই সঙ্গে তাতে প্রচ্ছন্ন থাকে ইতিহাসচেতনা, মানব-অস্তিত্ব আর মৃত্যুচেতনা। আর এসবকিছুই উঠে আসে অসংখ্য অনাস্বাদিতপূর্ব চিত্রকল্পে, উপমায় আর রূপকে

‘‘তাঁর কবিতায় এক ধরনের নিরাভরণ আর সূচিভেদ্য অন্তর্মুখ আছে যা খুবই আকর্ষক’’–এই মূল্যায়ন ট্রান্সট্রোমারের নির্বাচিত কবিতার সম্পাদক পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী মার্কিন কবি রবার্ট হ্যাস (Robert Hass)-এর

ট্রান্সট্রোমারের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল স্টকহোমে। বাবা গোস্টা ছিলেন সাংবাদিক আর মা হিল্মি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু ট্রান্সট্রোমারের বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় যখন তাঁর বয়স মাত্র তিন। সেই থেকে বলতে গেলে বাবার সান্নিধ্য আর পাননি। মায়ের কাছেই বড় হন ট্রান্সট্রোমার। তবে স্বজনদের অকাতর স্নেহও পেয়েছেন। জীবনে মায়ের প্রভাব অপরিসীম; তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মনোগঠনে মায়ের বিরাট ভূমিকা ছিল। সুদীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে মায়ের প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলেছেন ট্রান্সট্রোমার

স্টকহোমে বেড়ে উঠলেও জীবনের অনেক বছর কেটেছে রুনমারো নামের কাছের এক দ্বীপে। আর যে জায়গাটিতে থাকতেন সেটির নাম ছিল সোডারমাম্ (Sodermalm)| তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় ওই দ্বীপের ভূ-দৃশ্যের বর্ণনা মেলে। তাঁর স্মৃতিকাতর কবিতাপুস্তক ‘‘বাল্টিকস’’ ও স্ট্রোক-পরবর্তীকালে লেখা স্মৃতিকথা ”Minnena ser mig (Memories Look at Me” লেখার প্রেরণাও নয়নাভিরাম ছোট্ট এই দ্বীপ

কিন্তু পরের দিকের কবিতাবলিতে প্রকৃতি-মুগ্ধতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নতুন-নতুন অনুভূতি যোগ হয়। আর তাতে উঠে আসে বিচিত্র অনুষঙ্গ——–সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভ্রমণ, প্রত্নতত্ত্ব আর প্রকৃতিবিজ্ঞান।
প্রথম জীবনে ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় মেতে উঠলেও পরে মূলত মুক্তক ছন্দই হয়ে ওঠে তাঁর ব্যসন ও আনন্দ। আর সেই সাথে তাঁর কবিতার কলেবরও ছোট হতে থাকে

ছোট্টবেলায় মৃত্যুভয় পেয়ে বসে তাঁকে। দুটো ঘটনা বলি। একবার থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলেন মায়ের সাথে। ফেরার সময় ভিড়ের চাপে মায়ের হাত থেকে ছিটকে যান। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। ছোট্ট ট্রান্সট্রোমার একাই বাড়ির পথ ধরলেন। কিন্তু ভর সন্ধ্যায় ছোট্ট একটা বাচ্চা কেন একা একা পথ হাঁটছে সে খোঁজ কেউ করলো না, কেউ ফিরেও তাকালো না। রাস্তা পার করে দিতে অনুরোধ করলেন কয়েকজনকে; অবশেষে এক লোক সদয় হয়ে হলেন। এটুকুতেই কর্তব্য শেষ করলেন তিনি। এই ঘটনা খুবই রেখাপাত করলো ট্রান্সট্রোমারের মনে

স্টকহোমের প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের (Natural History Museum) প্রবেশ-ফটকে ছিল দুটো অতিকায় হস্তি-কংকাল। ট্রান্সট্রোমারের ভাষায় কংকাল দুটো ছিলো ‘‘অলৌকিকের ফটক-পাহারাদার।’’ একবার সেই অতিকায় কংকালের স্কেচ আকঁলেন। কিন্তু ভয় পেলেন নিজের আঁকা সেই ছবি দেখেই। মৃত্যুভয়ও পেয়ে বসলো। ১৯৯০ সালে স্ট্রোক করার পর ১৯৯৩ সালে লেখা স্মৃতিকথায় এর বর্ণনা আছে:
”. . . as if I am coming closer to death itself.”

‘‘শীতের সূত্র’’ কবিতায়ও আছে ভয়চমকিত অনুভূতির বর্ণনা। আর ”Poetry East” পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রান্সট্রোমার বলেন, ‘‘প্রায়শই কবিতাটির কোথাও একটা কংকাল দেখা যায়, যার প্রতি পংক্তিতে আছে সমসংখ্যক অস্থি-মর্মর। সেটা আপনার জানার দরকার না হলেও আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ।’’

ট্রান্সট্রোমারের কবিতা পড়ে মাঝেমাঝে মনে হয় তিনি যেন আমাদের ছেড়ে দিয়েছেন এক প্রশ্নময় পৃথিবীতে। যেসব প্রশ্নের সহজ কোনো জবাব বা সমাধান নেই। আর পাঠক দাঁড়িয়ে থাকে এক অচেনা সীমান্তে; কেননা তিনি মনে করেন, ‘‘সীমান্তেই দেখা মেলে সত্যের– truth appears only at the borders.”

আর পথ যে হারায়, তাকেও খুঁজে নিতে হয় পথ; হারিয়ে ফেলা পথের ক্রমাগত অন্বেষণ তাঁকে ঘুমাতে দেয় না, বরং জাগিয়ে রাখে। এই পথ খোঁজাটাই হয়ে ওঠে ধ্যান। কবিতা তাঁর কাছে সক্রিয় ধ্যানেরই মতো। ১৯৭১ সালে হাঙ্গেরীয় কবিদের কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন ট্রান্সট্রোমার: কবিতারা হচ্ছে সক্রিয় ধ্যান…তারা আমাদের জাগিয়ে তুলতে চায়… ঘুম পাড়াতে নয়”— (”Poems are active meditations, they want to wake us up, not put us to sleep,”

পৃথিবীকে দেখার-জানার দুর্নিবার তৃষ্ণা সতত ভ্রমণপ্রিয়, ভ্রমণশীল কবি ট্রান্সট্রোমারকে পৃথিবীর নানা কোণে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেছে। পায়ের তলে সর্ষে ছিল তাঁর। সঙ্গীত ও চিত্রকলা তাঁর অন্য দুই প্রেম। স্বপ্ন ছিল অভিযাত্রী হবেন। সেটা না হওয়া গেলেও ভ্রমণই পুষিয়ে দিলো সেই খেদ

ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর দৃষ্টিকে করেছে স্বচ্ছ ও অনর্গল; তা থেকে জন্ম নিয়েছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা। ‘‘ইন দ্য নাইল ডেল্টা’’, ‘‘ইজমির অ্যাট থ্রি ও’ক্লক’’ ও ‘‘স্ট্রিটস ইন সাংহাই’’কবিতার নাম করা যায়। প্রথম দুটি কবিতায় দারিদ্র, অপশাসন ও মানুষের অসহায়ত্বকে দেখিয়েছেন। মিশরে গিয়ে দেখলেন তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্রের রূপ। সেটা ১৯৫৯ সাল। ভ্রমণসঙ্গী সদ্য-বিয়ে-করা স্ত্রী মনিকা। মনিকার বয়স তখন মাত্র ১৯। সেখানে অস্বাস্থ্যকর নোংরা হোটেলে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাদের। ‘‘ইন দ্য নাইল ডেল্টা’’ কবিতায় তিনি সেই নগ্ন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিরাবেগ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন সেই অভিজ্ঞতা: ” I have tried to write unsentimentally and nakedly as possible and mainly with monosyllabic words. well – we went to sleep in the indescribably dirty ex-hotel and then I dreamt what is in the poem….and then I dreamt what is in the poem…” .

এ যেনবা কোলরিজের স্বপ্নে-পাওয়া কবিতা ‘‘কুবলা খান’’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়।

আর তুরস্কের ইজমিরে গিয়ে দেখলেন ভিক্ষাবৃত্তির করুণ ছবি। ‘‘ইজমির অ্যাট থ্রি ও’ক্লক’’ বা ‘‘বেলা তিনটায় ইজমির’’ কবিতার শুরুটা হয়েছে এভাবে:
প্রায়-ফাঁকা রাস্তায় কিছুটা সামনেই দেখা গেল
দু’জন ভিখিরি; একজন নুলো–
সে চলেছে পিঠে চড়ে অন্যজনের।’’

এতো আসলে দারিদ্র্যমলিন তৃতীয় বিশ্বের জীবনেরই এক প্রতীকী রূপ! অথচ কিছু সমালোচক ট্রান্সট্রোমারের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন; যে ধরনের দায়বদ্ধতা আগেরবারের বিজয়ী পেরুভীয় লেখক মারিও ভার্গাস য়োসার মতো অন্য অনেকের মধ্যে দেখা যায়।য়োসার মতো প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি টোমাস। য়োসার মতো আগুনে-আঁচ স্বভাবও তার নয়। বরং ছিলেন আড়ালপ্রিয়। অনেকাংশে যেমন ছিলেন আমাদের জীবনানন্দ দাশ।সদা লোকের চোখ এড়িয়ে চলা, শান্ত-সমাহিত, নম্র-লাজুক ট্রান্সট্রোমার বরাবরই প্রত্যক্ষ রাজনীতি ও এর ক্লেদকে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন: ”Humble and unpretentious, Transtromer has always avoided political debates and has stayed out of the public eye.”

তাঁর কবিতায় রাজনীতির রঙমশাল জ্বলে না; তবে জীবনের আশ্চর্য সব রঙের দেখা মেলে সেখানে; যে রঙ অনুগ্র; শব্দেরাও মৃদু আর প্রায়-অনুচ্চারিত উষর সমুদ্রবেষ্টিত গ্রানিট-অরণ্যের পথে, চিরতুষারে ঢাকা বার্চ আর পাইনের বনে, শান্ত-স্তব্ধ লোকালয়ের আবছা ধূসর পটভূমির ভেতর, বাল্টিক সমুদ্রের ঢেউয়ের বিভঙ্গে, আর চির অনুজ্জ্বল এক সূর্যের ভেতর কতো মৃদু গুঞ্জরণ, শান্ত অচঞ্চল এক জগৎ চারপাশে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। পূর্ণচাঁদ-জেগে-থাকা আকাশের নিচে প্রকাণ্ড হাতছানির মতো খোলা প্রান্তর; হঠাৎই সেখানে এক রেলট্র্যাকের ওপর রাত ২টায় ট্রেন এসে থামে। বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের সাথে কোথায় যেন মিল; যেনবা ‘‘যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ।’’

মৃদু, নির্জন, চিরপ্রশমিত, স্বল্পবাক, মুগ্ধ, বিমূঢ় এক পথিকের, এক অন-লুকারের অভিজ্ঞতার জগৎ শুধু ব্যাপ্ত হতে থাকে পরকলার ভেতর; ছবির পর ছবি, অরণ্যে ছোট্ট কোনো পোকা নিখিলের অন্তহীন প্রাণ জাগিয়ে রাখে নিজের ভেতর; বনবেড়ালের পদচ্ছাপখচিত অরণ্যপথ, শাখা-শৃঙ্গের মুকুট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মদ্দা হরিণ, অতিকায় ওকগাছ, গুবরেপোকা—–দৃশ্যের ভেতরে দৃশ্য, স্ক্যানডিনিভীয় প্রকৃতির প্রগাঢ় নিবিড় একাকিত্ব। আর স্বপ্নের ভেতর জেগে থাকা ঘুমন্ত মানুষেরা অজানা গ্রহের পানে ডানা ভাসায় দূরে। আর পরক্ষণেই আচমকা ধাক্কায় তাদের স্বপ্ন খান খান। প্যারাশুটে চেপে তারা আবার নেমে আসে বাস্তবের রূঢ়-কঠিন মাটিতে। 

এই হচ্ছেন ট্রান্সট্রোমার।কবিতায় রাজনীতির চড়া রঙ বোলাননি তিনি; কিছু স্বদেশি কবি-সমালোচক তাঁর সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে কটাক্ষ করলেও দায়বদ্ধতা কারো চেয়ে কম ছিল না তাঁর।


অসামান্য কল্পনাপ্রতিভার পাশাপাশি জীবনের প্রতি ছিল তাঁর অপার মমতা; জীবনানন্দের মতো তাঁরও অন্বিষ্ট ছিল এমন এক জীবন উপরিতলের নয়, বরং মনোগহনের, অথবা ‘‘যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের…’’। মানুষের দু:খে কাতর শুধু নয়, বহুবার বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়েও দাঁড়িয়েছেন। ভারতের ভূপালে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিয়ন কার্বাইড লি:-এর ফ্যাক্টরির বিষাক্ত গ্যাস-দুর্ঘটনার পর বিপন্ন মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে ছুটে গিয়েছিলেন ট্রান্সট্রোমার। সেখানে কবিতা পাঠ করেন মালয়ালাম কবি কে. সচ্চিদানন্দনের সঙ্গে

ট্রান্সট্রোমারের কবিতা, এর অসামান্য চিত্রকল্পের সৌন্দর্য পাঠকের মনে সতত আলো জ্বালিয়ে রাখে; সে এক অনির্বচনীয় উদ্ভাস:

‘‘…কুকুরের ঘেউ এক গূঢ়লিপি
আঁকা আছে বাগানের উপরে হাওয়ায়
গাছকে বানিয়ে বোকা সে-বাগানে হলুদাভ ফল
আপনা থেকে নিচে ঝরে পড়ে।’’
(আবহচিত্র)


কী শানদার, কী ঘনবদ্ধ, আঁটসাট আর কেমন মিতবাক, বাহুল্যহীন ছোট্ট এই কবিতা। ‘‘গাছকে বানিয়ে বোকা সে-বাগানে হলুদাভ ফল/ আপনা থেকে নিচে ঝরে পড়ে..’’–এর মধ্য দিয়ে শেষমেষ তিনি খুঁজলেন বন্ধনমুক্তির পথ। বন্ধনমুক্তি আর অচলায়তন ভাঙাকেই সবচে বড় প্রেরণা করে তুলেছেন তিনি। আর পুরো কবিতাটা পড়লে পাওয়া যাবে তুলনারহিত উপমাও।


‘‘উপমার, চিত্র ও দৃশ্যকল্পের ওজের জাদুকরযেন তিনি। অলংকার-বাহুল্য ছাড়াই কবিতায় তিনি বুনে চলেন দুর্মর আর বলিষ্ঠ সব চিত্রকল্পমালা। তাঁর কবিতার সহজ আটপৌরে ভঙ্গিটাও তাঁরই যাপিত জীবনের আয়নাতে প্রতিফলিত।’’


ট্রান্সট্রোমারের কবিতার বড় যে গুণটা আমাকে টেনেছে তা হচ্ছে তাঁর আপাত সহজতা আর শাদামাটা শব্দে তাঁর সহজ প্রবেশাধিকার। সাহিত্যের সাধারণ পাঠকও তাই বিমুখ হন না; কঠিন কোনো দেয়ালে ধাক্কা খাওয়ার বদলে নিজেকেই আবিষ্কার করেন, নিজের মুখটাও দেখতে পান কবিতার জলের অয়নায়।


বোধ করি, ভালো কবিতার এ-ও এক বড় গুণ যে, এর ভেতরে থাকে একাধিক অর্থবাচকতা, নানামুখি ইন্টারপ্রিটেশনের স্কোপ বা স্পেস, ঢুকবার বেরোবার একাধিক খিড়কি ও দরোজা; ফলে পাঠক তার নিজের মতো অর্থ করে নেন, বা নিতে পারেন। ঢুকতে-বেরোতে ও জিরোতে পারেন। তবে এই আপাত সহজতাও বুঝিবা জাদুকরের আরেক ছলনা; আস্তিনের নিচে তিনি লুকিয়ে রাখেন এক ম্যাজিক ওয়ান্ড; লুকিয়ে রাখেন কোনো প্রিজম যার ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণে ঠিকরায় বিবিধ রঙ আর আলো! প্রত্যেক বড় কবিরই থাকে নিজস্ব সঙ্গীত (মিউজিক্যালিটি)। আর থাকে ভেতরে প্রবেশের বহুস্তর আমন্ত্রণ। আর থাকে রহস্যবিনাশের নানারকম চাবি।

‘‘ভারমিয়ার’’ কবিতার শেষ চরণগুলিতে আছে খোলা আমন্ত্রণ:
‘‘আর সেই শূন্যতা আমাদের দিকে তার মুখটি ঘুরিয়ে
ফিসফিস করে বলে:
শূন্য নই, উন্মুক্ত আমি।’’

 

অভূতপূর্ব উপমা-রূপক আর চিত্রকল্পের দেখা পাই তাঁর কবিতায়। ]]

 

 

অপার হেঁয়ালি

১.
লামাদের মঠ
সাথে ঝুলন্ত উদ্যান
রণচিত্রমালা।

২.
চিন্তারাশি অনড় নিশ্চল;
মোজাইক টালি যেন
প্রাসাদ-চত্বরে।

৩.
দাঁড়িয়ে ঝুল বারান্দায়
সূর্যালোকের খাঁচায়–
একটি রঙধনুর মতো

৪.
হালকা কুয়াশার গুঞ্জরণ,
মাছধরা নৌকা এক, দূরে–
জলরাশির ওপরে এক বিজয়-স্মারক।

৫.
নিরাশার দেয়াল–
আগমন আর চলে যাওয়া,
মুখাবয়বহীন ঘুঘুদল।

৬.
গায়ে রোদ মাখে এক মদ্দা হরিণ–
আহ্লাদে মাছি ওড়ে আর মাটির ওপর
ছায়াকে সেলাই করে যায়

৭.
বেদনাবিধুর এ-জলাভূমিতে
সদা চিরকাল–
ঝাঁকড়া পাইনের রুক্ষতা।

৮.
নভেম্বরের সূর্য–
আমার বিশাল ছায়া ভাসে,
ঝাপসা-আবছা হয়ে যায়।

৯.
মৃত্যু আমার ওপরে ঝুঁকে রয়–
আমি দাবার জটিল এক চাল
আর সে বাতলাতে পারে সমাধান।

১০.
সন্ধ্যারাগ—
তাকিয়ে আমার দিকে, বুলডগের
মুখের আদলে ওই টাগবোটগুলি।

১১.
উপত্যকা আর দানবের চলার পথ
খাড়া পাহাড়ের কোলে–
স্বপ্ন, হিমশৈল এক।

১২.
একটি পাহাড় বেয়ে বেয়ে
গনগনে ওই সূর্যতাপে–
আগুন গিলছে ছাগপাল ।

১৩.
বোকাদের পাঠাগারের তা’কে, এক
হিতোপদেশ-পুস্তক রাখা আছে
কেউ ছুঁয়েও দ্যাখে নি

১৪.
সে কেবল লিখেই চলেছে…
খাল-নালা উপচে পড়ে আঠালো তরলে ;
পুলসেরাত পাড়ি দিল তরী।

১৫.
ঘন এ-নিবিড় বনভূমি
কপর্দকহীন ঈশ্বরের অধিবাস–
দেয়ালেরা জেল্লা ছড়ায়।

১৬.
শাদা-কালো একটি শালিক
মাঠে মাঠে চলেছে নাছোড়
লাফিয়ে লাফিয়ে এঁকেবেঁকে।

১৭.
ভয়ে ম্রিয়মান ছায়াগুলি…
বেশুমার ব্যাঙের ছাতার ভিড়ে পথ
আমরা হারিয়ে ফেলেছি এই বনে।

১৮.
দেখো, আমি শান্ত বসে আছি
যেন এক তীরে-ভেড়া তরী–
এইখানে বেশ সুখে আছি।

১৯.
বাড়ন্ত ঘাসেরা …
মুখ তার, রহস্য-পাথর এক
হয়েছে লালিত স্মৃতিডোরে।

২০.
দরদালানের পাশে
বিশেষ প্রহরে এক
অন্ধ হাওয়া খানিক জিরোবে

২১.
খরশান সূর্য এখানে —
দূর অতীতের কালো এক
পালের মাস্তুল

২২.
ছাদজুড়ে ধরেছে ফাটল
আর এক মৃত লোক দেখছে আমায়–
এই মুখখানি…

২৩.
বৃষ্টির শোনো হু-হু শ্বাস…
সেখানে পৌঁছাবো, তাই আমি
চাপাস্বরে গূঢ়কথা বলি।

২৪.
মঞ্চে এক দৃশ্য উন্মোচন।
কেমন অদ্ভূত এক প্রসন্নতা–
অন্তর্গত স্বর।

২৫.
সমুদ্র প্রাচীর এক—
শঙ্খচিল কাঁদে আমি শুনি —
আমাদের ডাকে ইশারায়

২৬.
ঈশ্বরের লেজের বাতাস;
শব্দহীন গুলি ছুটে আসে–
প্রলম্বিত স্বপ্নসুখসার।

২৭.
ছাইরঙ নীরবতা–
নীলমূর্তি দানব চলেছে
সাগরের মৃদু হাওয়া বয় কুলু-কুলু

২৮.
ধীরগতি এবং প্রবল হাওয়া বয়
সমুদ্রতীরের পাঠাগার থেকে–
এখানে জিরিয়ে নেবো আমি

(মূল সুইডিশ থেকে করা Anatoly Kudryavitsky-i Abyev` The Great Mystery-র বাংলা ভাষান্তর )

 

ঝড়

হাঁটতে গিয়ে বিশাল একটা বুড়ো ওকগাছের সঙ্গে
হঠাৎ তার দেখা , শরৎ-সমুদ্রের কালচে সবুজ
দুর্গ-দেয়ালের পটভূমিতে অতিকায় শাখা-শিঙের মুকুট নিয়ে
পাথর-হয়ে-যাওয়া এক হরিণ যেন ।
উত্তুরে ঝড়ের দিন এলো। এসময় পেকে উঠবে
রোয়ানবেরি ফল। রাত্রি জেগে সে শোনে
ওকগাছটির অনেক উপরে নিজের আস্তাবলে
তারাপুঞ্জ বাজিয়ে চলেছে খুরধ্বনি।

#-(Robert Bly-এর ইংরেজি অনুবাদ The Storm -এর বাংলা ভাষান্তর)

 

কোকিল

বাড়িটার ঠিক উত্তর দিকটায় বার্চগাছের ডালে বসে ডেকে
গেল একটা কোকিল। ওর গলার স্বর এতোই চড়া যে
প্রথমে ভাবলাম, বুঝিবা কোকিলের ডাক নকল করে গাইছে
কোনো অপেরা গায়িকা। অবাক হয়ে পাখিটার দিকে
তাকালাম। কুহু ডেকে ওঠার সময় প্রতিবারই চাপকলের
হাতলের মতো উঠছে নামছে ওর লেজের পালক। পাখিটা
দু’পায়ে লাফাল, ঘুরে ওড়ার প্রস্তুতি নিল আর চারদিকে
ছড়িয়ে দিল গলার চিৎকার। তারপর ঝটিতি আকাশে উঠে
গজরাতে গজরাতে বাড়িটার ওপর দিয়ে উড়ে গেল দূরে,পশ্চিমে…

গ্রীষ্ম বুড়িয়ে যাচ্ছে আর সবকিছু বইছে অভিন্ন
এক বিষাদের সুরে। কুকুউলাস কানোরাস, ইউরোপের
কোকিল, গ্রীষ্মমণ্ডলে ফিরে যায়। সুইডেনে এর দিন
ফুরিয়েছে। এখানে ও স্বল্পকাল ছিল। এ-কোকিল আসলে
জায়ারের নাগরিক… ভ্রমণ এখন আর টানে না আমাকে।তবে
ভ্রমণ নিজেই আমাতে ভ্রমণ করে যায়। এই যে এখন আমি
ক্রমাগত কোনঠাসা, এই যে এখন বর্ষবৃত্তটি ক্রমশ বড়
হচ্ছে আর আমার দরকার হয়ে পড়ছে একজোড়া চশমা।
ঘটনার ঘনঘটা আমাদের সহ্যসীমা পার হয়ে যায়।
অবাক হবার মতো কিছু আর অবশিষ্ট নেই।

এসব ভাবনা বিশ্বস্ততার সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে আমাকে, ঠিক যেমন লিভিংস্টোনের
মমি করা মরদেহ আফ্রিকার ভেতর দিয়ে সোজা কাঁধে বয়ে এনেছিল সুসি আর চুমা।

#(Malena Mörling, Patty Crane I John F Dean–র ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা ভাষান্তর)

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment