অনির্বাণ ভট্টাচার্য

টু স্যার, উইথ লাভ

রেস্পেক্টেড স্যার,

          চিঠির তো একটা সাব্জেক্ট হয়? পড়িয়েছিলেন তো? কী লিখব? পিছু ফেরা? হিসেব নিকেশ? না স্যার, ওটা ব্ল্যাঙ্ক থাকুক। ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্কস। ওপারে গিয়ে দেখা টেখা হবে স্যার? সেসব হয় নাকি? আমি তো মেট্রোর দরজাটা জানি। একবার বন্ধ হয়ে চলতে শুরু করলে তার দরজা অন্তত সেই স্টেশনে আর থামবে না। তাই …

হাত তুলতাম। একটা, অনেকগুলো। রেড ফ্ল্যাগ ধরা ছবিগুলোর মতো। আপনি পড়া ধরতেন। পড়া মানে ইতিহাস। ইতিহাস মানে ম্যানচেস্টারের সুতো, শিল্প বিপ্লব কিংবা চটকল ধর্মঘট। অবনী স্যার। অবনী। আধেকলীন হৃদয়ে আমি পড়াশুনোর কাছাকাছি কিছু একটা ঘাঁটি অবসরে। আপনি, আপনারা প্রজ্ঞার দূরগামী স্টেশনে একা। ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়েন। ওখানে কার কার সঙ্গে দেখা হয় আপনাদের? দেখা বলতে প্রণব সিংহের কথা মনে পড়ছে। উচ্চতা, হাঁটা, স্বর, আমি ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি একজনকে দেখেছিলাম। বিশ্বাস করুন স্যার, আমি আপনাকে কোনোদিন সেভাবে হেডু বলে ডাকতে পারিনি। কারণ আমার ওই দেখাটা মনে আছে এখনও। মাসখানেক আগের একটা পুরনো প্রাইজ নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা, স্কুল প্রেমিসেস। অ্যাসেম্বলিতে আমি। ক্ল্যাপ্স। আপনার চলে যাওয়ার দিন আঠেরো বছর পেরনো এক বিস্মৃতি। আপনি বেঁচে ছিলেন এখনও? খবর পাইনি। চলে যাওয়ার ব্রেকিং নিউজ। আপনার কথামতো কোনও স্মরণসভা হবে না স্কুলে। কেন? কিসের অভিমানে? আঠেরো বছর কিছু কিছু দিতেও শেখায় স্যার। দেওয়া মানে যতটা দেওয়া বোঝায়, কখনো দিয়ে ফেলে তার চেয়েও বেশি। আমাদের স্কুলটা ছাড়িয়ে একটু চলে যান বোলপুর স্টেশন পেরিয়ে ওপারের দিকে। শুঁড়িপাড়া। সঞ্জীব দাস। রেলশ্রমিক। কন্ট্যাক্টের। চারপাশের বস্তি, হাভাতে ছেলেমেয়েগুলোর বাড়ি। খিস্তি, উকুন আর চায়ের পাতার সংসার। সঞ্জীব বেছে বেছে কচিকাঁচা জড়ো করেছেন। বই, খাতা, বোর্ড…। কেন ডট দিলাম জানেন? ঠিক এই জায়গাটা বলতে গিয়ে কিছু একটা করে উঠল গলার কাছটা। নাকে…মুখে। আপনাকে বোঝানো যাবে না। আর তাছাড়া, জেনারেশন গ্যাপটা তো যায়নি। তো, যেকথা বলছিলেম, বজরং শিশু শিক্ষা মন্দির। জানেন স্যার, সঞ্জীবের স্বপ্নের প্ল্যাটফর্মে বাচ্চাগুলো হাত তোলে, পরীক্ষা দেয়…। আরও আছে। চাচানপুর। বাঁকুড়া। রেবা মুর্মু। মায়ের নামে লক্ষ্মী মুর্মু প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি সাহায্যের বাইরে। পড়া, খাবার টিচারদের খরচায়। তবে একটা লাইনে দাঁড়াতে হবে। বাচ্চাগুলো খেলবে খড়ের গাদায়। তবে শুরুতে একবার প্রেয়ারে দাঁড়াতে হবে স্যার। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। ওটাই গান। প্রেয়ার। বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত এক সমাজব্যবস্থায় আলো, শিক্ষা, রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন। জানেন স্যার, শান্তিনিকেতন থেকে আনাইকোটি কতদূর? আনাইকোটি। তামিলনাডু। কোয়েম্বাটুর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। প্রেমা রঙ্গচারীর ‘বিদ্যা বানম’। স্কুল। যার অর্থ – লার্নিং ইন দ্য ফরেস্ট। অরণ্য। শেখা। আদিবাসী আর দলিতদের জন্য বিনা খরচে। বাকিদের ২০০ করে। এইটুকু করতে হয় স্যার। অন্তত দাঁড়াক ওরা। কালো ভারত। অরণ্যচারী ভারত। পিছরে বর্গ ভারত। জানেন স্যার, স্কুলটার একটা বার্ষিক প্রোজেক্ট ডে থাকে। ওরা ঝরঝরে ইংরাজিতে কী নিয়ে ডিবেট চালায়? জি এম ক্রপ। ওরা জানে টয়োটা নামটা এসছে জাপানি টয়োডা থেকে। যার অর্থ উর্বর ধানক্ষেত। হন্ডা মানে রুট ফিল্ড। কৃষি। জমি। ঘাম। কর্পোরেট পৃথিবীর বিস্মৃতি। এরা ভোলেনি স্যার। তবে, দেশের সরকারি কোনও শিক্ষা বোর্ডের অ্যাফিলিয়েশন পেতে ওদের কালঘাম ছুটতে হয়। সাত বছর পেরোল বিদ্যা বানম। এখনও জোটেনি। অ্যাফিলিয়েশন। সম্মান। দেশ। মাটি। এই সেদিনও চানু স্যারকে দেখলাম। মাটির দিকে তাকিয়ে আনমনে হাঁটা। আমাকে মনে নেই। দেখলে হয়ত প্রথাগত প্রণামে লজ্জা পাবেন। এড়িয়ে যাই। দূর থেকে দেখি। টিমটিম আলোর মনীষা গ্রন্থালয়ে পড়াশুনো করছেন। সাদা ধুতি, চাদর, চশমা। হাটায় আত্মবিশ্বাস। বয়স? ধুর …। তুড়ি মারা। প্রহ্লাদ কাটোলেকে চেনেন স্যার? মহারাষ্ট্রের ওয়াদার ধাধরে গ্রামের প্রহ্লাদ। স্বপ্ন। প্রত্যন্ত ধাধরের গ্রামে লাইব্রেরি, জড়ো করা আরও কিছু শিক্ষক। পড়ার সঙ্গে কৃষির মিশেল। সিলেবাসে, বোধে, ব্যবহারিক চেতনায়। ফোকটেল, ব্যোমকেশ বক্সী, হানা’স সুটকেস …। সীমান্ত বলে কিছু হয় না স্যার। ভাষা বলেও কিছু হয় না। হয় শুধু ইচ্ছে। মুম্বই থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে প্রহ্লাদ ৯২টি ছাত্রছাত্রীও পেয়ে গেছেন। আদিবাসী। ৪৮টি মেয়ে, ৪৪টি ছেলে। ওরা পড়ে, খেলে, কথা বলে, একসাথে। হয়ত ভালোওবাসে। একসাথে। পার্থ স্যার। ক্লাস নাইন টেন। আপনার গলায় প্রথম যখন টেনিসন শুনি, তখন আর্ট বুঝতাম না। তবে আমরা যারা প্রেসিডেন্সি পাইনি, শঙ্খবাবু পাইনি, তাদের কাছে আপনি, আপনারা ফরিস্তা ছিলেন। তখনো, ম্যাট্রিকুলেশন না পেরনো ছেলেদের মধ্যে বায়রন, শেলী, কোলরিজ – শুধু এই নামগুলোই না, নামগুলোর ভেতরের জীবনবোধগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া আপনার দীর্ঘ, কৃশকায়, উদাত্তকণ্ঠী এক বন্ধুমুখকে বড় মিস করি স্যার। যদি দেখা হত, কথা হত এখনও, আপনাকে নিয়ে যমুনা ব্যাঙ্ক মেট্রো স্টেশনে যেতাম। দিল্লি। ব্ল্যাকবোর্ড, চক, খাতা, বই। এটুকু তো কমন। মজাটা অন্য কোথাও স্যার। এদের মাথার ওপর ছাদ নেই। বাচ্চাগুলো স্টেশনের পিলার দিয়ে ঘেরা জায়গাটায় এতদিন হাভাতের মতো ঘুরত। মা’বাবারা স্থানীয় রাজেশকে বললেন। পড়াতে। রাজেশ মানে রাজেশ কুমার শর্মা। মাঝবয়সী। রাজেশ বিএসসি শেষ করতে পারেননি। গরিবি। শিকারপুরের কাছে একটা দোকান চালান। তার সঙ্গে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে মেট্রো স্টেশনের মাথার ওপরের গর্জনের নিচে সবার অলক্ষ্যে বসে পড়েন ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে। ভাষা, বিজ্ঞান। মেট্রো কর্তৃপক্ষের সাহায্য পেয়েছেন। দেয়াল জুড়ে কালো রং করে দিয়েছে ওরা। ব্ল্যাকবোর্ড। উঁচু কিছু পোডিয়াম বানিয়ে দিয়েছে। স্যারেদের দাঁড়ানো, বসার জায়গা। কিছুটা রাজেশ পড়ান, যেটুকু সময় পারেন না, রাজেশের ভাই মিটিয়ে দেন। আরও কিছু মানুষ আসেন। গেস্ট টিচার। সামনে আগ্রহে তাকিয়ে থাকা ২০০র বেশি স্বপ্নকন্থী। মেঘালয়ের খারাঙ্গের অঙ্গনওয়ারী ১৫ বছর ধরে চলে আসছে। তেরেসা। তেরেসা সাবং। একা। হ্যাঁ স্যার, সাত বছর ধরে হারাতে হারাতে একা। পাঁচ বছরের একটি মেয়ে ওর দাদাদিদিদের পিঠে করে আসে। তেরেসা ওকে, ওদের পড়ান। জীবনবোধ। ভালবাসা। সিলেবাসের বাইরে ওগুলোও তো আছে, তাই না স্যার? স্কুল, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এক বন্ধুর কাছে আমার ব্যক্তিগত অনেকটা বড় হওয়া কেটেছে। বন্ধুই তো। প্রকৃত শিক্ষক তো বন্ধুই। আমাদের ছোট্ট মফঃস্বলটায় স্কুল ছিল বেশ কয়েকটা। বাড়ির লাগোয়া বাগানও। স্কুলবাগান নামটা কি সেজন্যই? অভিজ্ঞান স্যারের ইংরিজি টিউশনিতে প্রেম, রাত পেরনো চার পাঁচজন যুবকের উদ্ধত অশালীনতা, এবং তার পরেও থেকে যাওয়া আজ ক্লাস শেষের লুই ফিশারের গান্ধীজি, ওয়ার্ডসওয়ার্থের একলা মেয়ে কিংবা ডিলামেয়ারের ওই বাড়িটা। লিসেনার্স। আপনাদের ক্লাসে আমি, আমরা জাস্ট সাম অফ দ্য মেয়ার লিসেনার্স স্যার। ভিলেজ ফোকস। আর আপনারা বায়োস্কোপ দেখানোর প্রোজেক্টর ম্যান। এখন যখন পড়তে পড়তে বছর বিয়াল্লিশের শান্তি কুঞ্জনের নামটা পাই, সেই শান্তি যে তামিল গুডালুর গ্রামের বিদ্যোদয় স্কুল তৈরি করেছিলেন সেই নাইন্টিসে, তাও প্রচারের বাইরে থাকা মূলত কিছু পেনিয়ান আদিবাসীদের নিয়ে, শেখালেন আদিবাসী নাচগানের সঙ্গে অঙ্ক-বিজ্ঞান-ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, তখন গল্পটা কোথাও যেন এসে এক্কেবারে মিলে যায় স্যার। আপনি, শান্তি, সঞ্জীব, রাজেশ, প্রেমা, রেবা – আপনারা সবাই একরকম। বড্ড ভালো। বড্ড। বিশ্বাস করুন স্যার। আবার সেই নাকে গলায় চোখে জ্বালাটা ফিরে আসছে। উত্তরবঙ্গের নাগ্রাকাটায় কলকাতার আলিপুর থেকে নাবালিকা অজিতা টোপ্পো বছর তিরিশ আগে যখন বিয়ে হয়ে এলেন, কাউকে পাননি। চাবাগান, অসুখ, ডাক্তার, শিক্ষা। সব কেমন যেন ধোঁয়াশা। জড়ো করলেন। মাল, মশলা, সঙ্গী। কামারাদেরি। একটা স্কুল। প্রথমে মাসে কুড়ি টাকা করে নিতেন। তৈরি হল রোসা ল্যান্ড প্রাইমারি। চাবাগানের বাচ্চাগুলোকে নিয়ে। সঙ্গে কিছু বড়রাও।

গল্পটা বাড়তেই থাকবে স্যার। এরকম অসম্পূর্ণতার জন্য মাফ করবেন। আমাদের অনেকেই এই দোষ থেকে বেরোতে পারল না। গল্পটা শুরু করে ম্যাচ থেকে হারিয়ে গেল হঠাৎ। আপনারাও ওদিকে যোগাযোগহীনতার বেঞ্চে বসে কী যে ছাই করছেন। মাঝে মাঝে টুপটাপ করে চলে যাওয়াটাই শিখিয়ে যেতে পারলেন। বাদবাকি …। ফেরার তো রাস্তা নেই। হেরাক্লিটাস মনে পড়ল। একজন মানুষ এক নদীতে দুবার স্নান করতে পারে না। কারণ মানুষটা আর আগের মতো নেই, আর জলটাও পাল্টে পাল্টে গেছে। যাই হোক, চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। শরীরটাও। আর ভাল লাগছে না। আজ আসি।

বাই দ্য ওয়ে, হ্যাপি টিচার্স ডে স্যার …  

           

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment