জ্যোতির্ময় মুখার্জি

জ্যোতির্ময় মুখার্জির কবিতাগুচ্ছ

শেষ ডুবুরি

যখন দিগন্ত হয়ে যায় পালক, তুমি দোষারোপ করো না
এই তো দেখো কেমন কাঁধ ছুঁয়ে আছে আশ্রয়

এইভাবে মুহূর্তরা নদী হতে পারে
এইসব জীর্ণ রুমাল, তবু কী আশ্চর্য দূরের নৌকারা আলাপচারিতায় ডেকে নিলো আমাকে

এসো আমরা দুজন আজ ডুবুরি হয়ে যাই
সেই শেষ ডুবুরি, যে মুক্তো খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে গেছিল পাথর-খাঁজে

 

এইসব হাসি ও প্রার্থনা

এইসব হাসি ও প্রার্থনা, মৃত হতে হতে পাখি হয়ে গেলে, দীর্ঘ সাঁকোর উপর জেগে থাকে ভয়।

অবিরাম ধাক্কা মারছে হাত। ভিতরে ও বাইরে দরজা ঠেলে ঠেলে হেঁটে যাচ্ছে কিছু মানুষ।
ওদের সন্ততি সুখে থাক। এ দোষ তাদের নয়।

হে মুসাফির, তোমার জুঁই ফুলটিকে প্রশ্ন করো, মৃতদেহের পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলে ওকে, ও কি ভালোবাসবে তোমাকে আবার ?

 

বালিসোহাগের তিল

কথোপকথনের মাঝে জমে ওঠে যে অন্ধকার, তার মধ্যে একটা বেহায়া চিঠি রাখলাম। তুমি হয়তো ভুল করে সূর্যাস্ত ভাবছো

আদতে চিঠিটা এসেছিল শেষ বর্ষায়। লিখেছিলে তোমার কোনও ব‍্যক্তিগত বিকেল নেই। তোমার মেঘেরা কিতকিত খেলতে আসে না উঠোন জুড়ে। তোমার পুকুরে হুটোপুটি করেনি কোনও দুপুর-বালক। তোমার নিজস্ব শুকতারাটিও কুমিরডাঙ্গা খেলেনি শেষ রাতে

অভিযোগ হয়তো সামান‍্যই। তবু, যখন প্রদীপ রাখলে শাঁখ-সন্ধ্যায়। যখন শরীর শুধুমাত্র একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি। যখন আগুন নয়, আলো হলে। তখনই দেখে নিয়েছিলাম তোমার খোলা পিঠে, এক আকাশ মেঘ জমে আছে। জেনেছিলাম, নখের’ও কথা থাকে, যেভাবে ছায়া ঢাকে রোদ। হয়তো, পাঁজরের নিচেই লুকিয়ে থাকে অন্তর্ধানের গল্প

‘গগনে বাদল, নয়নে বাদল জীবনে বাদল ছাইয়া;
এসো হে আমার বাদলের বঁধু, চাতকিনী আছে চাহিয়া।’
.
.
ছায়ার ভিতর হারিয়ে গিয়ে ক্রমে জেগে থাকুক কিছু মাতাল জন্মধ্বনি। জবাবি চিঠিতে তাই, আস্ত এক নদীর কাছে রেখে গেলাম তোমার বালিসোহাগের তিল

 

অথচ প্রকাশ‍্য নয়

অথচ প্রকাশ‍্য নয়, এইসব আশ্বিনের শস্যক্ষেত। প্রতিটি দৃশ্যের মতোই এইসব তাপ ও অঙ্গীকার মিশে থাকে আমাদের জন্মগত ডানায়। তারপর প্রিয় পাখিটি উড়ে গেলে প্রতিটি পাতা, প্রতিটি আধফোটা ঘাস এসে বুকে মুখ ঘষে প্রশ্ন করে, এখনও বৃষ্টি হয়নি কেন ?

এসব ছাড়িয়েও যা কিছু রূঢ় বাস্তবতা আমাদের স্বপ্নে ও ছায়ায়। তাদের বড়ো হতে দাও। ওরা উড়তে শিখে গেলে কোনো একদিন। প্রিয় পাখিটি ফিরে এসে ডানাহীন। বলবে, ঠিক জানি না কতটা ভিজলে বৃষ্টি হওয়া যায়।

 

নর্তকী

ফিরে আসতেই হয়, আঙুল খুলতে গিয়েও মুঠো হয়ে যায় নর্তকী। হাতের নাগাল ছাড়িয়ে দু-হাত তবু ঘুরে ঘুরে শিশুদের মতো হাততালি দিয়ে ওঠে। ওরা জানে না, স্তব্ধতা কোনও এক মৃত্যুর নাম

কপালে মৃত্যু মুছো না

আঁচল সরিয়ে উঠে আসছে শিশু। পাতাগুলি কাঁপছে এবং ডালগুলি। কিছুটা ঝোপঝাড়, খালি গা, অরণ‍্যের খুব কাছে। শরীর’ও আজ পাখি হতে ভয় পায়

তবু জানি, প্রতিটি রাতেই বাঁশি বাজা আবশ্যক
তবু জানি, প্রতিটি রাতেই মেঘ হয়ে যায় পাখি

আমার থেকে কয়েক গজ দূরে, গান গেয়ে গেল যে’কটি মানুষ। কলিংবেল টিপলেই তারা কিন্তু পাখি হতে পারতো। কিন্তু, আমরা হাততালি দিতে ভুলে গেছি। আমরা হাততালি দিতে ভয় পাই। আমরা প্রত‍্যেকেই ব‍্যস্ত আমাদের ব‍্যক্তিগত জানলায়। নর্তকী’ও ব‍্যস্ত হাতে মুছে ফেলে রাত শেষে স্তনের টুকরোগুলি

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment