আলাপে বিস্তারে জয় গোস্বামী
সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনার বইগুলো যদি প্রথম থেকে পড়া যায় ভালো করে তাহলে দেখা যাবে যে একটা বই থেকে আরেকটা বই – জার্নিটা যত এগিয়েছে – অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ হয়ে উঠেছে। ব্যতিক্রমও আছে। যেমন ‘আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো’, ‘পাগলী, তোমার সঙ্গে’র পর যখন ‘গোল্লা’ আসছে, সেটা একটা ব্যতিক্রম মনে হয়।
জয়ঃ না, ‘আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো’ আর ‘গোল্লা’ একই বইমেলায় একইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। মানে, একইসঙ্গে দু’রকম লেখা লিখেছি।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা! ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’ তো এর পরের জার্নি। কিন্তু সেটাও অতটা কমিউনিকেটিভ নয় বলে আমার মনে হয়।
জয়ঃ না। (সম্মত হয়ে)
সঙ্ঘমিত্রাঃ ‘সূর্য-পোড়া ছাই’ও…
জয়ঃ সেটা ’৯৯ সালে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ এবং ‘মৌতাত মহেশ্বর’ও…
জয়ঃ ২০০৫।
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ। আপনি উৎপলকুমারের কবিতাপ্রসঙ্গে বাচ্যার্থ অতিক্রম করে যাওয়ার কথা বলেছেন। আপনার নিজের লেখাতেও অনেক এমন আছে। তো, এই কমিউনিকেটিভ হয়ে ওঠার সঙ্গে বাচ্যার্থকে অতিক্রম করা লেখার কি কোনো বিরোধিতা আছে বলে মনে হয়?
জয়ঃ একেকসময় একেকরকম লেখা আসে। যখন যে ধরণের লেখা মাথায় আসছে, যেরকম কথা আসছে সেগুলোই লিখি। কোনো লেখা হয়তো কমিউনিকেটিভ হয়। কোনো বই হয়তো কমিউনিকেটিভ হয়। আবার কখনো হয়তো বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে যাওয়ার একটা ঝোঁক মনের মধ্যে জেগে ওঠে, তখন সেইটাই লিখি। এটা যে আগে থেকে কিছু স্থির করা থাকে তা নয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা! এই যে শেষ বইটা ‘প্রাণহরা সন্দেশ’ –এটা পড়তে গিয়ে একজায়গায় পেলাম – ‘আবার দুর্বোধ্যে যাবো/ যা বুঝিনি, সেরকম সচল দুর্গমে’। এটা কি কোনো সিদ্ধান্ত?
জয়ঃ না, লেখার সময়ে ওইটাই মাথায় এসেছে। এটা যে আমি কোনো ম্যানিফেস্টোর আকারে বলছি তা নয়। লিখতে গিয়ে ওইরকম মাথায় এসেছে, ওইটাই লিখেছি। তবে, এটা খুব সত্যি যে কবিতা দুর্গমও হয়। খুব সহজে … খুব সুবোধ্য যে সব কবিতা হবে এমন নয়। এমন অনেক কবিতা হয় যে কবিতা দুর্গম – তার মধ্যে অনেক অর্থস্তর থাকে – অনেক সঙ্কেত থাকে। সেধরণের কবিতার প্রতিও আমার আকর্ষণ আছে। গভীর আকর্ষণ আছে। এখন নিজে আগে থেকে স্থির করে যে এবার এরকম লেখা লিখবো… এটা কিছু স্থির করা যায় না। যেরকম এসেছে সেরকমই লিখে যাওয়া।
অনিমিখঃ আপনি লিখেছিলেন ‘রেখেছি নরম করে পাথরের খরস্রোতা ফুল’…
সঙ্ঘমিত্রাঃ ‘এর কোনো অর্থ নেই’ … ‘আলেয়া হ্রদ’-এ ছিল।
অনিমিখঃ এবং প্রথম দিকের বইগুলিতে তো বটেই, পরবর্তীকালেও বিভিন্নসময় ফিরে ফিরে এসেছে … খুব অদ্ভুত অদ্ভুত ইমেজ তৈরি হয়েছে লেখায়… আপনি আরেকটা কথাও বলছিলেন যে এখন সবটা খুলে বলে দেবার একটা চল হয়েছে…
জয়ঃ হ্যাঁ, একটা রেওয়াজ দেখা যায়…
অনিমিখঃ এখনকার কবিতায় আরও বেশি করে… এখন কি পাঠক যে লেখা আপনি প্রথমদিকে লিখেছেন…
সঙ্ঘমিত্রাঃ ওই যে ‘কুমীর চোয়াল খুলে শুয়েছিল জ্বলজ্বলে খিদের গরজে। / আমাকে জলের নীচে ব্রহ্মচারিণীর দাঁত ধরেছিল পা-য়,’ … (দাঁতঃ আলেয়া হ্রদ)
অনিমিখঃ এখন যদি লিখতে আসতেন … এখন পাঠকেরও পাঠরীতি অনেকটা বদলে গেছে মনে হয়…
জয়ঃ আমার জীবনে একটা জিনিষ হয়েছে, সেটা আমার প্রথম জীবনে ঘটেছে বলে পরবর্তী জীবনে থেকে গেছে – প্রথম জীবনে যখন আমি লিখতাম তখন এই যে পাঠক কী নিচ্ছে সেটা বুঝবার আমার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। কেননা আমি ডাকে কবিতা পাঠাতাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ধরা যাক আমি দশটা পত্রিকায়- তখন ‘অমৃত’ বলে একটা পত্রিকা বেরত- আর ‘দেশ’ তো ছিলই – এই দেশ আর অমৃত রাণাঘাট স্টেশনে পাওয়া যেত। অমৃত পত্রিকায় অনেক লিটল ম্যাগাজিনের ঠিকানা থাকত। যুগান্তর পত্রিকাগোষ্ঠী প্রকাশ করত, সাপ্তাহিক পত্রিকা। অনেক লিটল ম্যাগাজিনের রিভিউ থাকত, তার তলায় ঠিকানা থাকত। এছাড়া কলকাতায় এসে, শিয়ালদা থেকে হেঁটে পাতিরামে গিয়ে, পাতিরামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক পত্রিকা দেখতাম। কিছু কিনেও নিয়ে যেতাম। সেইসব পত্রিকায় কবিতা পাঠাতাম। আমি হয়তো দশটা পত্রিকায় কবিতা পাঠালাম – নিজে নিজে পাঠাতাম কিন্তু! এমন নয় যে তারা আমার কাছে চেয়ে নিচ্ছেন! আমার কাছে কেউ কবিতা চাইবেন তবে আমি পাঠাব, এইরকম বিলাসিতা করবার বা ধারণা করবার… মানে আমার কাছে কেউ কবিতা কেন চাইবে? এটা আমি ভাবতেই পারতাম না! ফলে, আমি নিজেই দশটা কাগজে কবিতা পাঠালাম, ছাপা হল হয়তো চারটে কাগজে। এবার এই যে চারটে কাগজে ছাপা হল – সেই কবিতাগুলো কি আমি তখনই দেখতে পেলাম? না, দেখতে পেলাম না। পত্রিকাগুলো বেরতে হয়তো চারমাস থেকে ছ’মাস সময় লাগল। তারপর পত্রিকাগুলো ডাকে আমার বাড়িতে এল। এই যে ছ’মাস পরে আমি একটা প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি অর্থাৎ আমার কবিতাগুলো ছাপা হয়েছে – এই ছ’মাসে কিন্তু আমার আরও অনেক কবিতা লেখা হয়ে গেছে। ফলে, পাঠকের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার যে অভিজ্ঞতা বা অপেক্ষা করে থাকার যে অভিজ্ঞতা – সেইটা আমার জীবনে তুলনায় কম ছিল। বেশি ছিল লেখার তাগিদ। মানে…
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ… একটু থামাচ্ছি… আপনার ‘নিজের রবীন্দ্রনাথ’-এ একটা গদ্যেও পেয়েছিলাম যে, একজন লেখককে তো খুঁজতে হবে তার নিজের ভেতরে আজও বলবার মতো সে কিছু পাচ্ছে কিনা। পেলে, তার জন্য নতুন কোনও ভাষা সে খুঁজে আনতে পারছে কিনা। অন্যরা শুনতে চাইছে বলেই বলাটা তো স্বধর্ম হারানো। সেইসঙ্গে ‘রাজা’ নাটকের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছিলেন যে এক অদৃশ্য সুরঙ্গমা আমার ভেতরের সুদর্শনা’কে সতর্ক করে। ওই ৫৩ থেকে ৫৬ – যে সময় কবিতা লেখা হচ্ছিল না –
জয়ঃ হ্যাঁ… হ্যাঁ… ওইসময় কিছু লিখিনি … (ঘাড় নেড়ে)… আমার ৫৩ থেকে ৫৬ বছর বয়স পর্যন্ত আমি কোনো কবিতা লিখিনি। সেটা এমন অবস্থায় যখন আমার কবিতার চাহিদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমি কবিতা লিখলে বা না লিখলেও পত্রিকা থেকে কবিতা চাওয়া হয়। আমার এই তিপ্পান্ন বছর বয়স থেকে ছাপ্পান্ন বছর বয়সটা যেমন, আমার প্রথম জীবনটা তেমন ছিল না। ফলে, আমি পাঠক কী ভাবছে – পাঠকের পছন্দ হচ্ছে কিনা – এটার দিকে তাকিয়ে থাকার যে মনোভাব সেটা আমার মধ্যে গড়ে উঠবার সুযোগ পায়নি। অপরপক্ষে যেটা ছিল, সেটা হচ্ছে – লেখা আসত মাথায়। ওই যে কবিতাগুলো পাঠিয়ে দিলাম – পাঠিয়ে দেওয়ার পরের দিনও কিন্তু আমি লিখছি! লিখে চলেছি। ফলে, লেখা এলে সেটা লিখে ফেলা বা লেখার চেষ্টা করা… চেষ্টা করাই আমি বলবো… মানে, লেখা তো … একটা অজানা থেকে আরেকটা অজানার দিকে যাওয়া! সুতরাং আমি পাঠক নিয়ে যে খুব ভেবেছি কখনো এমনটা নয়। ভাববার অবকাশ পাইনি। অল্পবয়সের জীবনে পাঠক নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিল না। সেই যে প্রবণতাটা আমার মধ্যে ছিল, সেটা বেশি বয়সেও আমার মধ্যে স্থায়ী হয়ে গেছে। এই আর কী!
অনিমিখঃ এই যে কেউ চাইবে কিনা না ভেবেই কবিতা পাঠাতেন, এটা কি কবিতাসংগ্রহ-১ বেরনোর সময় অবধি?
জয়ঃ না, না। তখন পর্যন্ত নয়। সত্তরের দশকে এটা ছিল। আমার কবিতা প্রথম ছাপা হয় আজ থেকে ৪৫ বছর আগে…
সঙ্ঘমিত্রাঃ তিয়াত্তরে?
জয়ঃ তিয়াত্তরে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ ‘সীমান্ত সাহিত্য’ পত্রিকাতেই কি?
জয়ঃ ‘হোমশিখা’ বলে একটা কাগজে বেরিয়েছিল। কৃষ্ণনগর থেকে বেরতো। আরেকটা কাগজে বেরিয়েছিল, তার নাম ছিল ‘পদক্ষেপ’। কাঁচরাপাড়া থেকে বেরতো। আর বনগাঁ থেকে বেরতো ‘সীমান্ত সাহিত্য’। এই কাগজেও ছাপা হয়েছিল। তিনটে বিভিন্ন কবিতা একইসঙ্গে, একটা পুজোর সময় তিনটি বিভিন্ন কাগজে বেরিয়েছিল।
সঙ্ঘমিত্রাঃ যদিও একবার বলেছেন তবু আরেকবার আমি বলি, এই যে একটা বই থেকে আরেকটা বইয়ের জার্নিটা এত আলাদা – বিশেষত ‘ভুতুমভগবান’-এর পর ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা?’ – আমার কাছে মনে হয় বেশ অনেকটা লাফ। আমি যদি রিলেট করতে পারি… ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ থেকে ‘ভুতুমভগবান’ পর্যন্ত …
জয়ঃ ঠিক দশ বছর! ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭।
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ। তারপরে ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা?’য় ঢোকার পর মনে হয় যে কবিতাগুলো অনেকটা থিতু। ওই ট্রান্স অনেকটা থিতু হয়েছে মনে হয়। যদিও পরবর্তীকালে সেই ট্রান্স আবার থেকে থেকেই ফিরে এসেছে…
জয়ঃ অভিজ্ঞতার বদলের সঙ্গে। তখন অভিজ্ঞতার বদল হয়েছিল। ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা?’ যখন লিখেছি, তখন আমি প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম। ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা?’র মধ্যে একটা কমা আছে। ঘুমিয়েছ’র পর একটা কমা আর ঝাউপাতা’র পরে একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন আছে। আসলে, প্রথমে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়। সেই সম্পর্ক তিনমাস স্থায়ী হয়েছিল, কিন্তু ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়ার ফলে যেসব যন্ত্রণা আমি পেয়েছিলাম, সেই যন্ত্রণার দিকটা ‘ভুতুমভগবান’-এ আছে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কিন্তু তার সঙ্গে শহরজীবনের রিরংসা’ও তো আছে!
জয়ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই যে কষ্টের জায়গাটা সেটা আর ব্যক্তিগত কষ্টের মধ্যে না রেখে চারদিকের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে ভুতুমভগবানের মধ্যে আছে। কিন্তু, মেয়েটির সঙ্গে যখন সম্পর্ক রয়েছে তখন যে সব কবিতা লিখেছিলাম, সেগুলো রয়েছে ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা?’র ভেতর। ঘুমিয়েছ’র পরে কেন একটি কমা? কারণ, তারপরে আরও একটি মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়। সেই মেয়েটি আবার এই মেয়েটির পরিচিত। সে যখন জানতে পারে যে এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেছে তখন সে এগিয়ে আসে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, বোন?
জয়ঃ না, প্রত্যক্ষভাবে বোন ছিল না। কিন্তু ওর থেকে বয়সে ছোটো ছিল।
এখন, এই যে ‘ঘুমিয়েছ’ এবং ‘ঝাউপাতা’ – এরা দু’জন আলাদা দুটি নারী। তাই একটা কমা দিয়ে তাদের পৃথক করা হয়েছে। ওই দ্বিতীয়জন যে, তার সঙ্গেও আর সম্পর্ক থাকেনি। কিন্তু বইটা যখন বেরোয় তখন আমি মাধুর্য আছে এমন কবিতাই নির্বাচন করেছিলাম। আমি দেখলাম, কিছু অন্যরকম লেখা হয়েছে – সেগুলোকে একটা পাত্রে স্থাপিত করলাম।
অনিমিখঃ আপনার ‘প্রেমের কবিতা’ যে সংকলন বইটা, সেটা খুবই হাতে হাতে ফেরে। সেখান থেকে প্রচুর মানুষ মুখস্থ বলতে পারেন কবিতা। কিন্তু আপনার সম্পূর্ণ কবিতাসমগ্র যদি প্রথম থেকে পড়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে বারবার অনেক ধ্বংসের কথা রক্তের কথা… ইংরেজিতে যাকে বলে gory images আছে আর কী… এই বিপরীতার্থক দু’ধরনের তিনধরনের ইমেজ যেন বারবার বড়ো একটা ফার্নেসের মধ্যে ওলটোপালট খাচ্ছে …
জয়ঃ এই ফার্নেস কথাটা খুব সুপ্রযুক্ত হল। আসলে ভেতরদিকটা তো শতচ্ছিন্ন! মনের ভেতরটা শতচ্ছিন্ন বলে ওইসব রক্তপাতের ছিটে বা ঝলক কবিতাগুলোতে দেখা যায়। আবার কখনো কখনো জীবনে নরম মেঘ এসেছে। এসে রোদ্দুর আড়াল করেছে। তখন তার সূত্রে কিছু কবিতা এসেছে। কিন্তু যন্ত্রণার ভাবটাই বেশি।
আর ‘প্রেমের কবিতা’ বলে যে সংকলনটা পাওয়া যায় সেটাকে কোনো বই হিসেবে না ধরাই ভালো। কারণ, সেই সংকলনে, প্রকাশকের কথায়, বিভিন্ন বই থেকে প্রেমের কবিতা তুলে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিল। ফলে, ওকে একটা বই হিসেবে দেখার কোনো মানে হয় না।
অনিমিখঃ পুরনো কবিতা নিজের, পড়েন এখনো?
জয়ঃ নাহ্ (জোর দিয়ে)
সঙ্ঘমিত্রাঃ কখনোই না? (বিস্ময়)
জয়ঃ যে লেখাকে ছেড়ে আসি তাকে তো আর পড়ি না! যার জন্য আমাকে অনেকসময় লাইন বললে নিজের মনে করতে অসুবিধে হয়। নিজে তো আর পড়ি না!
অনিমিখঃ খুব অবাক হলাম!
জয়ঃ পড়িনা কীরকম… আমি প্রুফ দেখার সময় পড়ি।
অনিমিখঃ সে তো নতুন বইয়ের ক্ষেত্রে?
জয়ঃ শুধু নতুন বইয়ের ক্ষেত্রে। এমনকি যে কবিতাসংগ্রহগুলো বেরোয়, তার প্রুফও আমি নিজে দেখিনা। প্রকাশকের লোকেরা দেখেন।
অনিমিখঃ কেন এরকম? মানে, ‘আলেয়া হ্রদ’ আপনি এখন আর পড়েন না?
জয়ঃ না না না। যে কবিতা লিখে চলে এসেছি একবার সে কবিতা আর ফিরে পড়ি না। নিজের কবিতা যে পড়তে ইচ্ছে করে তাও নয়। ‘গোঁসাইবাগান’ আমি মাঝে মাঝে পড়ি … পড়ি এইজন্যে যে কার উপর লিখেছি… কী কী কথা লিখেছি আগে … সেই কথাগুলো আবার লিখছি কিনা সেটার
সম্বন্ধে সতর্ক হবার জন্যে মাঝেমাঝে পড়ি। গদ্যলেখাতে অনেকসময় আগে যা লিখেছি পরে সেই কথাটা আবার লিখলাম, কারণ আমার সেই কথাটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে… সুতরাং সেই কথাটা পাঠককে আরেকবার মনে করিয়ে দিই – ফলে আরেকবার লিখি। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এমন যেন না হয়, এইটাই চেয়েছি।
অনিমিখঃ নিজের কবিতার মধ্যে তো একরকম ওম থাকে। নিজের যাত্রাপথটাকেও তো দেখতে ইচ্ছে হয় –
জয়ঃ আমি তো কবিতার যে অনুষ্ঠানগুলো হয়, তাতেও কবিতা পড়ি না! ফলে, আমার নিজের কবিতা পড়া আর হয়ে ওঠে না! এবং আমি লেখার পর যে বাড়িতে কাউকে ডেকে শোনাব এমনও সুযোগ হয় না। ফলে, ওই যা লিখলাম লিখলাম! বই হওয়ার সময় প্রুফ দেখি।
অনিমিখঃ মনে হয় যে কাউকে লেখা দেখাতে বা শোনাতে পারলে ভালো হত?
জয়ঃ সংশয় হয় খুব! সবসময়ই মনে হয় যে এটা কি হল?
অনিমিখঃ লেখা আসার প্রক্রিয়াটা কীরকম? মানে, আমি খুব অর্বাচীনভাবেই আমার নিজের কথা বলি – কবিতা তো অনেকরকমভাবেই আসে – আমরা যারা কবিতা লিখি সবাই সেটা জানি – গভীরতম কবিতা যখন আসে… সেটাও বোঝা যায় – তখন যেন মনে হয় একটা অস্পষ্ট কুয়াশার ভেতর হাঁটছি… একটা ছবি আছে কোথাও… কিন্তু ছবিটা ঠিক কীরকম ঠিক টের পাচ্ছিনা… মেঘগুলো সরাতে সরাতে… আস্তে আস্তে… নিজের মাথার ভেতরে ঘন হয়ে বসতে বসতে একটা কিছু ছবি ফুটে উঠবার উপক্রম হয়… আপনার ক্ষেত্রে কীরকম?
জয়ঃ ওই যে বললাম যে একটা unknown থেকে যাত্রা শুরু হয় আরেকটা unknown এ গিয়ে পৌঁছয়! আমি একটা কথা আগে কয়েকবার বলেছি দু’একটা সাক্ষাৎকারে – সে কথাটাই এখানে বলছি – সেটা হল একটা কবিতা যখন লিখছি… সে কবিতার যখন আমি অষ্টম বা নবম লাইনে রয়েছি, বা চোদ্দো বা ষোলো লাইনে রয়েছি, তখনো আমি জানিনা এই কবিতাটা উনিশ লাইনে শেষ হবে নাকি … । দীর্ঘকবিতার ক্ষেত্রে বোঝা যায় – যে এই কবিতাটা অনেকটা লম্বা হবে, সেটা ভেতরে টের পাওয়া যায়। কারণ দীর্ঘকবিতা আমি অনেক লিখেছি একসময়।
কিন্তু এইটা টের পাইনা যে কবিতাটা বাইশ লাইনে শেষ হবে নাকি সাতচল্লিশ লাইনে শেষ হবে নাকি একশো পঁচিশ লাইনে পৌঁছবে। একটা কবিতার মধ্যে যখন রয়েছি আমি… যখন কবিতাটা লিখে চলেছি তখন আমি টের পাইনা যে এটা কোনখানে যাবে। এতোখানি অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যে যাত্রা, সে যাত্রা সম্পর্কে কাউকে কিছু স্থিরীকৃত করে বলা কি যায়? নিজেই তো বুঝতে পারছি না!
আমার অল্প বয়সে আমি সনেট লেখার অভ্যেস করেছি। আমার কবিতাসংগ্রহ ১ম খন্ডে – শুধু ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ নয় – অগ্রন্থিত কবিতা’র মধ্যেও কিছু আছে। আবার ২য় খন্ড কবিতাসংগ্রহের মধ্যেও দু’একটি আছে। তো, আমি বেশিরভাগই বাতিল করেছিলাম। ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ যখন বেরোয়, তখন ১৭টা কবিতা আমি মোট লিখেছি ওই ১৪ দিনে। কিন্তু বইতে নিয়েছি আমি সাতটা আর একটা কবিতা যেটা সনেটের সীমা ছাড়িয়ে গেছিল। ‘ক্রিসমাস’ নামে যে কবিতা। ১৭টা কবিতা লেখার পর আমি ৮টা কবিতা তার থেকে নির্বাচন করেছি। তেমনি, আমি যখন সনেট লেখার অভ্যাস করেছি, সেখান থেকে অনেক কবিতা ‘কবি ও কবিতা’ পত্রিকায় জগদীশ ভট্টাচার্য –
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, রবীন্দ্র গবেষক?
জয়ঃ হ্যাঁ। জগদীশ ভট্টাচার্য সেই ‘কবি ও কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, তিনি অনেক কবিতা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই সব কবিতা আমি যে বইতে নিয়েছি, তা নয়। কোনো বইতেই আমি গ্রহণ করিনি। অগ্রন্থিত’তে মাঝে মাঝে কিছু আছে। ওইটা একটা চেষ্টা ছিল যে, আমার হাতের উপর যাতে একটা বশ থাকে, নিয়ন্ত্রণ আসে। তার জন্যে আমি সনেট লেখার অভ্যেস করেছিলাম। কিন্তু আমি পরবর্তী জীবনে, মানে, যখন আমার বই বেরতে লাগলো… তখন যে আমি এই অভ্যেসটাকে ধরে রাখলাম তা নয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ একজন লেখকের কি সনেট লেখাটা আবশ্যিক?
জয়ঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতেন জরুরি।
অনিমিখঃ আপনি কী বলেন?
জয়ঃ আমি আমার অল্প বয়সে চেষ্টা করেছি। নিজের হাতের ওপর নিয়ন্ত্রণটা যাতে থাকে। মানে, আমার মনে হত যে- কবিতারই তো এটা একটা রূপ – এটা আমার জানা থাকা ভালো। এজন্যই আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওই বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্যই পরবর্তী কাজ। মানে, পরবর্তী সময়ে মনে হল— এই বন্ধনটার মধ্যে থাকবো না। কিন্তু ওই বন্ধনের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন হয় আমার – আমার শব্দের সম্পর্কটা কেমন হয় – সেইটা বোঝার একটা চেষ্টা।
অনিমিখঃ বুঝতে পেরেছি। অনেকে বলেন আর কি যে, কবি হতে গেলে কিছু কিছু সার্টিফিকেটের দরকার হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সনেট লিখতে পারা। এরকম কোনো ব্যাপার…
জয়ঃ না না। এটা একটা চেষ্টা ছিল নিজের দিকে দ্যাখার। যে, আমার সঙ্গে এই সনেট নামক রূপবন্ধটার সম্পর্কটা কেমন দাঁড়াচ্ছে। এটুকুই। এটা নিজের ওপর নিজের একটা পরীক্ষা আর কী!
অনিমিখঃ আপনি ‘রাণাঘাট লোকাল’এ সম্ভবত লিখেছিলেন ছন্দের ব্যাপারে যে এখন মনে হয় এক মাত্রা আধমাত্রা এদিক ওদিক হলে কিছু এসে যায়না… আমি ‘প্রাণহরা সন্দেশ’ এও সরাসরি লেখা এরকম উল্লেখ পেলাম যে দু’মাত্রা কম হল। কিন্তু ওই একই কলাম লেখায় আপনি ওই পুরনো কথা লিখেছিলেন… নব্বই দশকের… আজকে যারা নব্বইয়ের প্রতিষ্ঠিত কবি তারা কীভাবে আসতেন আপনার কাছে এবং আপনি ছন্দ ঠিক করে দিতেন… এরকম কিছু …
জয়ঃ না, প্রথম জীবনে না জিনিষটা জেনে রাখা দরকার! এখন আমার অবশ্য সেকথা মনে হয় না। কিন্তু তখন তো একজায়গায় চাকরি করতাম… চাকরি করার সময় এটা মনে রাখতে হত যে যাদের লেখা আমি ছাপছি তাদের যেন ভুল ছন্দের লেখা না ছাপি। ছন্দে যদি তারা লেখে তাহলে যেন ঠিকটাই লেখে। একেবারে নতুন তো তারা! তাদের একটা ভুল ছন্দের লেখা ছাপানোটা ঠিক নয়।
এখন আমার অবশ্য তা মনে হয় না। এখন আমার মনে হয় যে, কবিতার অন্তরটা কী বলছে… কবিতার মনটা কী বলছে… সেটাই শেষপর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তখন…তারপর তো কুড়ি বছরের বেশি সময় কেটে গেছে… যে গতিবিধি তা অনেক পালটে গেছে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমি এইটুকু বুঝেছি যে কবিতার মধ্যে যা থাকে… অন্তরটা যা বলে… সেইটাই প্রধান গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ। আর অন্তরের সঙ্গে বাইরের ফর্ম একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে – এমন তো কমই দেখা যায়! যে, ফর্মের দিক দিয়েও সেটা খুব চোখে পড়ার মতো হল, আবার তার অন্তরও রইল খুব জাগ্রত হয়ে – এটা করা খুব শক্ত। সকলেই এই চেষ্টাই করে চলেছি আমরা। কিন্তু পারি আর কে?
সঙ্ঘমিত্রাঃ কিন্তু ওই যে কথাটা ‘নিজের রবীন্দ্রনাথ’এ বলেছিলেন – ২০০৮ সালে বেরিয়েছিল বইটা- যে একটা কবিতা লেখবার জন্য আমি দিনের পর দিন রাত জেগে বসে থাকি জানলার কাছে। আমি যে কবিতাটা লিখতে চাইছি সে কবিতাটার দেখা এখনো পাইনি। মানে, সেটা এখনও মনে হয়?
জয়ঃ হ্যাঁ।
সঙ্ঘমিত্রাঃ প্রায় ৩৯-৪০টা বই বেরিয়ে যাওয়ার পরও…
জয়ঃ আমার চল্লিশটার বেশি বই।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কাব্যগ্রন্থ?
জয়ঃ ৪১ টা কাব্যগ্রন্থ।
হ্যাঁ, এইটাই হচ্ছে কথা যে লেখা যখন আসবে… ওই যে ও যেটা বলছিল… যে একটা অস্পষ্ট মেঘের মতো কুয়াশার মতো একটা জিনিষ… আমি তার মধ্য দিয়ে চলেছি… সেটা আস্তে আস্তে আদল নিচ্ছে। একদম প্রথমে একটু দেখা দেয়। তারপর আমি তার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পথ চলতে পারবো কিনা… সে চলে আমি তার সঙ্গে সঙ্গে চলি… ওই একটা আছে না জীবনানন্দের… আমি থামি, সেও থেমে যায়… এবং সেই কথাটা বোঝা যায় না – আবার পুরনো কথাটা বলি – যে আমি যখন একটা কবিতার ১৩ লাইনে রয়েছি তখনো জানিনা যে সে ২১ লাইনে শেষ হবে না ৪৭ লাইনে। তো, এই যে অনিশ্চয়তা… এই অনিশ্চয়তায় ভর করে আমি অন্য কোনো কবিকে বলতে পারি না যে আপনার এরকম লেখা উচিত। বা অন্যদের এরকম লেখা উচিত। এটা কখনও বলতে পারি না। আমি বলিও নি কোনোদিন।
কিন্তু আমি যখন চাকরি করতাম তখন আমার কাছে কেউ কবিতা নিয়ে এলে – সে যদি ছন্দে সেই কবিতাটা লিখে থাকে – তাহলে ছন্দটা যাতে নির্ভুল হয়, সেইটা দেখতাম। যে দু’মাত্রা কম আছে কি দু’মাত্রা বেশি আছে। এইগুলোকে ঠিক করতে হতো। এই আর কী!
এখন মনে হয়, এই কাজটা করেছি পুরো চাকরিসূত্রে। একটা ভুল ছন্দের কবিতা ছাপানো তো ঠিক নয়! এখন আমি কবিতার মধ্যে যে ছন্দের দিকটা, সেটা আর খেয়াল করি না। শুধু অন্তরে কী আছে সেটাই দেখি।
অনিমিখঃ আচ্ছা জয়দা, এরকম কখনো হয়েছে যে আপনি নিজে বুঝতে পারছেন যে এখানে ছন্দের একটু গোলমাল হচ্ছে… তবু অন্তরটাকে দেখানোর জন্য নিজেই নিজের কবিতায় ভুল ছন্দ রেখেছেন?
জয়ঃ হ্যাঁ, রেখেছি। (জোর দিয়ে) দু’মাত্রা কম বেশি রেখেছি।
আমার কবিতায় রেখেছিলাম এরকম যে – এখানে একটু ফাঁক থেকে গেল… সেখান থেকে গাছ বেরিয়ে এল। এটা ছিল ‘একান্নবর্তী’ বলে একটা বইতে। আমার বাবা কে নিয়ে লেখা একটা কবিতা। তাতে, একটা জায়গায় দু’মাত্রা কম আছে – সেখান দিয়ে একটা গাছ বেরিয়ে এল।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, স্বরবৃত্তে – জীবনানন্দ ব্যতিক্রম –
জয়ঃ এই ব্যতিক্রম কথাটা যে মনে রেখেছ, এটা খুব ভালো। খুব ভালো যে, জীবনানন্দ ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমকে কখনো অনুসরণ করতে নেই।
সঙ্ঘমিত্রাঃ স্বরবৃত্তে কি গভীর কবিতা লেখা সম্ভব?
জয়ঃ হ্যাঁ, লেখা যায়। নিশ্চয়ই লেখা যায়। শঙ্খ ঘোষের আছে। শক্তির প্রথম দিকের লেখায় আছে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ… শঙ্খ ঘোষের আছে।
অনিমিখঃ এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। একটা তো তথাকথিত সমান্তরাল ধারা আছে, সব সাহিত্যক্ষেত্রেই আছে – সেখানে সিনট্যাক্টিকাল জটিলতা… অন্যরকম কিছু প্রচেষ্টা… ব্যাকরণকে ভাঙা… অসম্ভবের প্রতি একটা আকর্ষণ – এইধরণের লক্ষ্মণগুলো দেখা যায়।
আপনার কবিতায়- অসম্ভবের সঙ্গে অসম্ভবের বিয়ে দেওয়ার যে কথাটা কবিতা সম্পর্কে বলা হয় – সেটা বরাবর আছে। আপনি একবার বলছিলেন উৎপলকুমারের কবিতা প্রসঙ্গে যে – ‘ঘুম আর মোমিনপুরের মাঝামাঝি একটুকরো বারান্দা রয়েছে’ – এখানে কীভাবে একক বদলে দিলেন কবি। এইরকম একক বদলে দেওয়া উচ্চারণ আপনার কবিতায় প্রচুর আছে। সেটা আপনি ছন্দকাঠামোর মধ্যে রেখেছেন। কোথাও কোথাও অন্ত্যমিলেও আছে, আবার কোথাও অন্ত্যমিল নেই কিন্তু পুরোদস্তুর ছন্দকাঠামোর মধ্যে আছে। সেই লিরিসিজমের কারণেই হয়তো যারা সমান্তরাল ধারার পাঠক, তারা ব্যাপারটা অতটা খেয়াল করেন নি। যে কী অসাধারণ ইমেজ এখানে ব্যবহার করা হয়েছে!
জয়ঃ তারা ওইধরনের পাঠক নন, তারা প্রথমত কবি। কবিদের মধ্যে এইধরনের জিনিষ থাকে যে এখন যেরকম হচ্ছে আমি সেই জিনিষটা করবো না, আমি অন্যরকম করবো। এটা আরেকরকম মনোগঠন। আমার ওইধরনের মনোগঠন কোনোদিন ছিল না। এখন চারপাশে এইরকম লেখা হচ্ছে – অতএব আমাকে এমন কিছু লিখতে হবে – একটা নতুন পথ আনতে হবে… এই মনোগঠন আমার কোনোদিন ছিল না। আমার মাথায় যেরকম ধরনের লেখা এসেছে আমি সেইরকম লিখে গেছি। আর অল্পবয়সে… মানে আমার ২৫ বছর ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত… আমি রূপবন্ধের যে প্রকরণগুলো আছে সেগুলোকে অনুসরণ করে দেখতে চেয়েছি যে, আমার সঙ্গে কবিতার কীরকম সম্পর্ক দাঁড়ায়!
অনিমিখঃ খেলা?
জয়ঃ খেলা নয়… এটা একটা কঠিন পদ্ধতি… যেমন ‘সেসটিনা’ বলে আমি একটা ফর্মের অনুসরণ করেছিলাম। ‘শুভ আগুন শুভ ছাই’ বলে আমার একটা কবিতা আছে। তার মধ্যে এটা আছে। তারপর ‘জিভ’ বলে আমার একটা কবিতা আছে, তাতে আছে। এটা ইতালিয়ান মিলের শৃঙ্খল। তারপর কবিতাসংগ্রহ ২য় খন্ডে অগ্রন্থিত কবিতার মধ্যে ‘জাল’ বলে একটা কবিতা আছে। দীর্ঘকবিতা। খুব জটিল মিলবিন্যাস! কেন এই চেষ্টা করেছি? আমার লেখার সঙ্গে এই জিনিষটার কোনো সম্পর্ক দাঁড়ায় কিনা- সেটাই তখন দেখতে চেয়েছি।
অনিমিখঃ স্বদেশ সেন আমার খুব প্রিয় কবি। তিনি লিখেছিলেন ‘নীল রবারের থাবা পড়ে গেছে আকাশের গায়’ – আকাশের সুনীল হয়ে ওঠার ব্যাপারটাকে যে এরকম অদ্ভুত নতুনভাবে বলা হল! সেটা নিয়ে একশ্রেণির পাঠক যতটা উচ্ছ্বসিত… কিন্তু আপনার ‘পাথরের খরস্রোতা ফুল’ … হয়তো ওই কাঠামোর ভেতরে রয়েছে বলে অতটা চোখে পড়েনি…
জয়ঃ এইধরনের পাঠকদের ক্ষেত্রে একটা জিনিষ হতে পারে যে তারা যেই দেখল যে এটাকে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে তখন তারা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করল। আরেকটা কারণ আমার জীবনে হয়েছে। সেটা হচ্ছে যে আমি স্বীকৃতি পেয়েছি। আমি যদি স্বীকৃতি না পেয়ে রাণাঘাটেই পড়ে থাকতাম, তাহলে এই ধরণের পাঠকদের মনোযোগ আমার প্রতি থাকত। আমার প্রথম জীবনে – যখন আমি লিখতে শুরু করেছি – তখন কিন্তু কৌরবে আমার লেখা বেরিয়েছে!
পরবর্তীকালে যখন আমি স্বীকৃতি পেলাম… আনন্দ পুরস্কার পেলাম… এবং আস্তে আস্তে জনস্বীকৃতি পেতে শুরু করলাম… তখনই এদের অংশটা পুরোটাই দূরে চলে গেল। শুধু কৌরব নয়, লিটল ম্যাগাজিনের যে লেখকরা তারা তখন কিন্তু আমাকে পরিত্যাগ করলেন বলা যায়।
অনিমিখঃ মানে, পাঠ-টা বড়ো কথা হল না?
জয়ঃ না, এটা হল কিন্তু! মানে, জনস্বীকৃতি যখন আমি পেলাম, লিটল ম্যাগাজিনের যে জগত – তা আমাকে পরিহার করল।
অনিমিখঃ অথচ আপনি যত পত্রপত্রিকা পড়েন… মানে, আমার নিজের মনে আছে ২০০৬-এ আপনার সঙ্গে যখন আমার প্রথম আলাপ হয় – তখন আমার বইও বেরোয়নি… দু’একটা লিটল ম্যাগাজিনে সামান্য লেখা বেরিয়েছে – আপনি তখনই আমার কবিতার লাইন বলে দিয়েছিলেন। এটা অনেকের সঙ্গেই হয়েছে! আপনি তরুণতম কবির কবিতার লাইন মুখস্থ বলতে পারেন। এতটা গভীরভাবে তরুণদের কবিতা পড়া এবং সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষায় যা লেখালিখি হচ্ছে এইভাবে পড়েন… তবুও আপনাকে একটা প্রত্যাখ্যান বা অন্য গ্রহের মানুষ – এরকম একটা ধারণা করার একটা ব্যাপার চালু আছে…
জয়ঃ আমি তাতে যে খুব গভীরভাবে আহত হয়েছি এমন বলতে পারি না। আমার জীবনে কষ্ট পাওয়ার মতো আঘাত পাওয়ার মতো এমন অনেক জীবন সম্পর্কিত ঘটনা আছে যে … আমি এত অপমানিত হয়েছি … রোগশয্যায় এত কষ্ট ভোগ করেছি… আমার জীবনে আমি এত দারিদ্র্যভোগ করেছি… এখনো আমি আমার পরিবারকে যে একটা নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা দিতে পেরেছি তা নয়। যে বাড়িটায় থাকি এটা একটা ভাড়াবাড়ি। গড়িয়ার যে ফ্ল্যাটটা ছিল সেটা আমার নিজের ছিল। কিন্তু আনন্দবাজার ছেড়ে দেওয়ার পর … আনন্দবাজারের কাছে কিছু ঋণ ছিল… আমাকে সেগুলো শোধ করার জন্য ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে দিতে হয়। তারপর থেকে আমি আর নিজের ফ্ল্যাট তৈরি করতে পারিনি – পারব, এই আশা ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি সরকারি একটা আবাসনে ভাড়া থাকি। ফলে, আমার নিজের জীবনে নিজের অন্তর্গত কষ্ট এমন অনেক আছে যে, ওঁদের সম্পর্কে আমি চিন্তা করি না। ওঁদের মনে হয়েছে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন! কিন্তু, আমার তো বইও বেরিয়েছে! আর পাঠকরা বইও পড়েছেন। কারণ প্রতি বছরে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে আমাকে একটা রয়ালটি স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়। তাতে, কোন বই কত বিক্রি হয়েছে তার একটা হিসেব থাকে। তো, আমি এটা দেখে অবাক হয়ে যাই যে এতজন অজানা মানুষ আমার কবিতা পড়েছেন! সুতরাং জানা মানুষেরা যদি দূরে চলে গিয়ে থাকে… আর সবচেয়ে বড় কথা হল আমি আমার পরের কবিতাটা কী করে লিখব আমি জানি না! এতখানি একটা সংশয়পূর্ণ বিষয় নিয়ে আমি কী করে একটা দৃঢ়তার ভাব নিজের মধ্যে রাখি! এমন হতে পারে তাঁরা যেটা বলছেন সেটা সত্যি। আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই নি। পরের লেখাটা কী করে লিখব সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছি। এই আরকী!
অনিমিখঃ এই সুদৃঢ় ভাবের কথা যখন হল, বলি—কবির সিগনেচার বলে একটা কথা শুনি অনেকের মুখে। যে, কবির কবিতা থেকে কবির নাম মুছে দিলেও কোন কবির কবিতা চেনা যায়। অথচ আপনার এই যে ৪১টা কাব্যগ্রন্থ, এতরকম বাঁকবদল আপনার কবিতায় আছে, বই থেকে বইয়ে—বিভিন্ন সময়খন্ড জুড়ে… সিগনেচার নিয়ে ভেবেছেন?
জয়ঃ না, তা ভাবি নি। একইরকম লেখায় দাগা বুলিয়ে যাওয়াটা… তাছাড়া আমার মাথায় যখন যা এসেছে… আর এটা কীরকম ধরনের… মানে একটা মাথা খুঁড়ে ফেলার মতো বলা যায়… দেওয়ালে মাথা দিয়ে একটা ধাক্কা দিলাম, একটা গর্ত হয়ে গেল। সেই গর্ত দিয়ে হয়ত আগুন বেরিয়ে আসছে। হয়ত জল বেরিয়ে আসছে। আমি জানি না কী বেরিয়ে আসবে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ এতরকমের লেখা, সবচেয়ে বড় কথা এটাই!
জয়ঃ ওই না-জানা থেকেই। সবটাই না-জানা থেকে। মানে যদি আমি জানতাম… তবে এটাও খুব সত্যি কথা এই যে, তোমাদের সঙ্গে এই কথাটা বলতে বলতে আমার মনে হচ্ছে এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে তোমাদের মতো এত নিখুঁতভাবে এত ধারাবাহিকভাবে আমার লেখা কেউ পড়েছে এমন লোক পাওয়াও মুশকিল।
সঙ্ঘমিত্রাঃ না না, এটা মোটেও ঠিক নয় (হাসি…)
অনিমিখঃ না না, তা কেন!
জয়ঃ কারও হাতে হয়ত শেষের দিকে কিছু লেখা পড়ল, কারও হাতে হয়ত প্রথমদিকে কিছু লেখা পড়ল… এই আর কী! এত ধারাবাহিকভাবে কেউ পড়েছে, প্রশ্ন করছে – এ আমি দেখতে পাইনি।
অনিমিখঃ না… কবিকে তো এরকমভাবেই পড়া উচিত! রাহুল পুরকায়স্থ একটা কথা বলছিলেন সেদিন, যে—কোনও কবির প্রতি যদি আমার আগ্রহ জন্মায়, তাহলে তিনি খারাপ লিখছেন না ভালো লিখছেন সেটা আর আমার কাছে ম্যাটার করে না। আমি দেখি যে তিনি কী লিখছেন। কোন রাস্তা ধরে যাচ্ছেন? কোন কোন রাস্তায় হাঁটলেন? এইপ্রসঙ্গে আপনার কথাও এসেছিল। এটাই তো পাঠ-প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। একজন কবির যাত্রাপথকে অনুসরণ করা।
সঙ্ঘমিত্রাঃ এবার একটা কথা বলি, যদি এমনটা হত—কবিতাকে কোনও সুনির্দিষ্ট অর্থে নিয়ে যেতে হচ্ছে না, তাহলে তার যে আনন্দ…
জয়ঃ খুব আনন্দ।
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ। তো সেই অর্থকে অতিক্রম করে যাওয়া বা…
জয়ঃ অর্থের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া…
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ … এবং কোথাও পৌঁছতে হবে এমন কোনও দায় নেই…
জয়ঃ হ্যাঁ, জানিনা…
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ…
জয়ঃ হ্যাঁ, সেই জায়গাটা জানিনা।
সঙ্ঘমিত্রাঃ এরকম তো শক্তির অজস্র কবিতা আছে। আপনার অজস্র কবিতা আছে। বিশেষত আমার ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’র কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত ওখানেই ছিল—‘আত্মজীবনীর অংশ’, ‘লাঠি লিখিত কবিতা’, ‘আলো সম্পর্কে প্রবন্ধ’… নামে তিনটি সিরিজ-কবিতা।
জয়ঃ হুঁ…
সঙ্ঘমিত্রাঃ সেখানে লক্ষ্য করেছিলাম, কবিতার উপাদান সেইভাবে প্রায় কিছুই ছিল না! অথচ কবিতাগুলো কোথায় পৌঁছে গেল! এটা উৎপল করেছেন। শক্তি করেছেন।
অনিমিখঃ কবিতার উপাদান বলে আলাদাভাবে হয়ত সেভাবে কিছু হয় না।
সঙ্ঘমিত্রাঃ ঠিক। এই যে দুমড়ে-মুচড়ে দেখা, এটা অসামান্য।
জয়ঃ ওই যে বললাম একটা কথা—দেওয়ালে মাথা ঠোকার মতো। দেওয়ালে মাথা ঠুকছি, আর দেওয়ালে একটা গর্ত হয়ে যাচ্ছে। জানিনা এখানে আগুন বেরবে না জল বেরবে। হয়ত হল্কার মতো আগুন বেরলো। স্রোতের মতো জলোচ্ছ্বাস ছুটে এল। দেওয়ালের গর্তটা থেকে। সেইরকম দেওয়ালে মাথা ঠোকা আর কী। এইরকম চেষ্টাই বলা যায়। মানে… একটা যদি আদর্শ থাকত, একটা যদি নীতি থাকত…
অনিমিখঃ ম্যানিফেস্টো?
জয়ঃ একটা যদি কিছু থাকত যে—আমি এইরকম লিখতে চাই। এরকমটা আমার মধ্যে তৈরিই হয়নি। আমি একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি, অনেকের মধ্যেই দেখেছি, এই জিনিষটা তৈরি হয়েছে, সিগনেচার তৈরি হয়েছে, তারপর সেই সিগনেচারকে তাঁরা অনুসরণ করে গেছেন। এখন তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। দোষ আমি দিতে চাই না। এই সিগনেচারটা তো তিনি তৈরি করেছেন, তিনি তৈরি করেছেন যখন সেটা তিনি অনুসরণ করতেই পারেন।
সঙ্ঘমিত্রাঃ না… প্রত্যেকটা বইয়ে এই যে সিগনেচার তৈরি করা, এবং সেটা আবার ভেঙে ফেলা—এটাও তো একটা সিগনেচার! ধরা যাক…
জয়ঃ এটা তোমরা দুজন ছাড়া আর কেউ লক্ষ্য করেছে বলে আমি জানি না…
সঙ্ঘমিত্রাঃ (হাসি…) না না, মোটেও এমনটা নয়… এটা বাড়াবাড়ি… (হাসি)
(তিনজনেরই সম্মিলিত হাসি)
জয়ঃ এই সাক্ষাৎকারটা দিতে গিয়ে, এই আজকের কথাবার্তার মধ্যে… তোমরা আমার কাছে যা শুনছ, যা জানছ, আমি যে নিজে কতখানি লাভবান হচ্ছি … কী বলব। তোমরা যেভাবে পড়েছ, এভাবে কেউ পড়েছে বলে তো আমার মনে হয় না।
অনিমিখঃ না না… এমন নয়…
জয়ঃ এই যে ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’ থেকে সঙ্ঘমিত্রা লাইন মুখস্থ বলল… আর ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’ বেরিয়েছিল আজ থেকে ২৪ বছর আগে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আমি তো পড়েছি ২০০৪-৫ নাগাদ।
জয়ঃ তাও তো আজকে ১৪-১৫ বছর হয়ে গেল!
সঙ্ঘমিত্রাঃ আসলে এটা তো একটা পাঠ-প্রক্রিয়া। ধরা যাক, আমার কোনও একটা কবিতা ভালো লেগেছিল, পরে আবার একসময় মনে হল—কবিতাটা আরেকবার পড়া যাক। অনেকটা পরে হয়ত। এমনটা তো হয়।
জয়ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ…
(হঠাৎ টেবিলে রাখা বই- মারিও পুজো’র একটা থ্রিলারে চোখ পড়ে যাওয়ায়— সেটা দেখিয়ে বললেন ‘আমি এসব পড়ি। সাধারণত সাহিত্যিকরা এসব পড়েন না।’)
অনিমিখঃ থ্রিলার?
জয়ঃ থ্রিলার। কিন্তু এখানে জানার অনেককিছু আছে।
অনিমিখঃ আচ্ছা। এবার তাহলে আরেকটা প্রশ্ন করি। বাচ্যার্থ অতিক্রম করে যাওয়া নিয়ে অনেক কথা হল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তো আবার গোঁসাইবাগান লিখছেন, সেখানে দেখছি যে—আপনি যে কবিতাগুলো নিয়ে লিখছেন, সেগুলি খুব কমিউনিকেটিভ কবিতা।
জয়ঃ হ্যাঁ।
অনিমিখঃ এর কারণ কী?
জয়ঃ এটা খুব সংগত প্রশ্ন। এবং গুরুতর প্রশ্ন। সেটা হচ্ছে, আমি যখন উপন্যাস লিখেছি, তখনও এবং আমি যখন কবিতা লিখছি তখন তো বটেই, আমি কখনও আমার লেখা কে পড়বে, তার কী প্রতিক্রিয়া হবে, এটা নিয়ে মাথা ঘামাই নি। আমার যা এসেছে আমি লিখে গেছি। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও, কবিতার ক্ষেত্রেও। কিন্তু, আমি যখন কবিতা-সম্পর্কিত নিবন্ধ লিখতে শুরু করি… প্রথম আমি কবিতা-সম্বন্ধিত নিবন্ধ লিখি ১৯৯৪ সালে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে ‘আলো অন্ধকার আয়ু’ বলে একটা গদ্য আমি লিখেছিলাম, ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। পরবর্তীকালে ‘জয়ের শঙ্খ’ বইতে এটা পাওয়া যায়। তখন আমি প্রথমেই ঠিক করে নিলাম—আমার টার্গেট অডিয়েন্স কে? অর্থাৎ আমি যে কবিতা নিয়ে লিখব… সেই কবিতাগুলো সম্পর্কে আমার প্রথম জীবনের একটা অভিজ্ঞতা কাজ করল। সেটা হচ্ছে, আমার প্রথম জীবনে আমি যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন আমি পাগলের মতো বই হাতড়াতাম। যে, কবিতা সম্পর্কে কোনও বই পাওয়া যায় কিনা। যে বইতে কবিতা বিষয়ে সহজভাবে কিছু বলা আছে। কিন্তু আমি তখন কোনও বই সেরকম পাই নি। যে বই-ই পড়তাম, সে বইয়ে এত রেফারেন্স থাকত, যে, সেই রেফারেন্সগুলো খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়াত। আমি সেই রেফারেন্স অনেক খুঁজে বের করেছিলাম পরে। তো, আমি যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন কী করলাম, যে… আমার জীবনে ওই কবিতার লাইনগুলো কীভাবে ঢুকে পড়ছে – আর যেভাবে চিনির দ্রবণের মধ্যে সুতো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, আর আস্তে আস্তে তার মধ্যে ক্রিস্টালের মতো চিনি জমাট বাঁধে, মিছরি তৈরি হয়, সেইভাবে কবিতার লাইনটা আমার জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্যে নেমে যাচ্ছে। এবং পাশের অভিজ্ঞতাগুলো জমাট বাঁধছে। জমাট বেঁধে একটা অর্থ তৈরি করছে। আর দুনম্বর হচ্ছে, কিছু কিছু কবিতা আছে যা আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। অর্থাৎ আমার অভিজ্ঞতা সেই কবিতার কাছাকাছি পৌঁছয় নি। ধরা যাক, আমাকে যেতে হবে এখান থেকে রাণাঘাট। আমি ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনটা ব্যারাকপুর পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল। আমার যেতে হবে রাণাঘাট। কিন্তু আমি ব্যারাকপুর পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেলাম। আমার অভিজ্ঞতা ব্যারাকপুর পর্যন্ত আছে। রাণাঘাট অব্দি যায় নি। কেমন? ফলে, আমার অভিজ্ঞতার স্বল্পতা রয়েছে। ফলে, আমার অভিজ্ঞতার স্বল্পতা যেখানে সেটা পরিপূর্ণ করার জন্য আমাকে আরও ভাবতে হবে যে, এই কবিতা কী অভিজ্ঞতার কথা বলছে? জীবনানন্দের অনেক কবিতার ক্ষেত্রে এমন কথা মনে হয়েছে। যে, কবিতা এমন অভিজ্ঞতার কথা বলছে… রবীন্দ্রনাথের অনেক গান সম্বন্ধে এমন কথা বলা যায়। যে, এ কবিতা এমন কথা বলছে…
সঙ্ঘমিত্রাঃ যে… এমন অনুভূতি আমার আগে হয়ত ছিল না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে সেখানে নিয়ে গেল!
জয়ঃ আমার ছিল না, হ্যাঁ… এইবার সেই অভিজ্ঞতার দিকে আমি যাত্রা শুরু করলাম। আমি এই যাত্রা শুরু করার কবিতাগুলোকে বাদ দিয়ে রাখলাম। কারণ, আমি লিখছি এমন পাঠকদের জন্যে… আমি স্থির করলাম টার্গেট অডিয়েন্স। তেমন পাঠকদের জন্য, যারা আমার মতো অল্পবয়সে খুঁজছে যে কী করে কবিতার মধ্যে ঢোকা যায়। সেইজন্যে আমি অপেক্ষাকৃত সহজগম্য কবিতা খুঁজে বার করলাম আলোচনা করবার জন্য।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আমি একটু ইন্টেরাপ্ট করছি…
জয়ঃ হ্যাঁ…
সঙ্ঘমিত্রাঃ না বলে পারছি না। অনেক বছর আগে ‘বৈদগ্ধ’ একটা জীবনানন্দ সংখ্যা করেছিল।
জয়ঃ হ্যাঁ।
সঙ্ঘমিত্রাঃ অনেক বছর আগে।
জয়ঃ ১৯৯৯।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আমি ২০০৩ নাগাদ ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম। সেখানে আপনার একটা লেখা ছিল।
জয়ঃ হুঁ…
সঙ্ঘমিত্রাঃ সেখানে জীবনানন্দের ‘সেইসব শেয়ালেরা’ কবিতাটা নিয়ে আপনার একটা সুদীর্ঘ আলোচনা ছিল।
জয়ঃ হ্যাঁ।
সঙ্ঘমিত্রাঃ সেখানে, ‘সেইসব শেয়ালেরা’ কবিতার শেষ দুলাইন (…সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে/ আমারো নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে।’) সম্পর্কে বলেছিলেন…
জয়ঃ হ্যাঁ, যে আমি বুঝতে পারিনি…
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, সাতাশ বছর ধরে ওই শেষ দুলাইন বুঝতে পারেননি, বলেছিলেন!
জয়ঃ হুঁ… হুঁ…
সঙ্ঘমিত্রাঃ এখনও কি তাই মনে হয়?
জয়ঃ সেটা এখনও মনে হয়, শেষ দুলাইন আমি এখনও বুঝতে পারি নি। এটা এখনও মনে হয়।
(খানিকটা থেমে) আমি বলছি উৎপলের কবিতা, কী শক্তির কবিতা, শঙ্খ ঘোষের অনেক কবিতা, আলোক সরকারের কবিতা (জোর দিয়ে), এঁদের অনেক কবিতা আছে… আমার পড়ে মনে হয়—বুঝতে পারিনি। কিন্তু কবিতাগুলো ভালো লাগে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, এরকম তো অনেক কবিতা হয়… আমি হয়ত বুঝতে পারছি না, কিন্তু ভালো লাগে। একটা টান অনুভব করি।
জয়ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটা টান ভেতর থেকে থাকে কবিতার সম্পর্কে। এই চারজন। শক্তি, উৎপল, শঙ্খ, আলোক। জীবনানন্দ সম্পর্কে তো মনে হয়ই। আর রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, এমন কি মনে হয়—গানে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে অনেক বেশি খুলেছেন? বা নিজের কথাটা বলতে পেরেছেন?
জয়ঃ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এতধরনের রূপের চর্চা করেছেন… এবং কবিতাকে এতরকমভাবে ভেঙেছেন…
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, একদম শেষ বয়স অব্দি।
জয়ঃ শেষ বয়স অবধি। ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে চলে আসছেন। কেমন? এই যে গদ্যকবিতা, এই জিনিষকে এখন আর কেউ গদ্যকবিতা বলে বলে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন গদ্যকবিতা লিখলেন তখন সেই কবিতাকে বলা হল—‘গোবিতা’! রবীন্দ্রনাথকেও তো একথা শুনতে হয়েছে! যেহেতু উনি গদ্যে লিখছেন। তো, গদ্যকবিতা অব্দি উনি চলে যেতে পারলেন, এবং শেষজীবনেও ভাঙতে ভাঙতে টুকরো টুকরো লাইন, ছোট ছোট লাইনে ভাঙা কবিতা লিখলেন… কতরকম কবিতায় যে উনি গেছেন! একথা ঠিকই যে কবিতা থেকে গানে উনি নিজেকে বেশি প্রকাশ করতে পেরেছেন। গানটা ছিল ওঁর কাছে একটা ধরবার মতন লাঠি। যে লাঠিটা ধরে উনি যেকোনও পথ পার হতে পারতেন।
সঙ্ঘমিত্রাঃ এবং গানের জন্য উনি কত লড়েছেন! ওই যে উনি ফর্ম ভাঙছেন। ক্লাসিক্যাল রীতিতে যখন গান রচনা করছেন। খানদানি কাঠামোর ভেতরেই সুরের ও তালের নতুনত্ব আনছেন; এমনকি সেখানে পল্লীগানের সুরও ইনজেক্ট করছেন!
জয়ঃ হ্যাঁ… হ্যাঁ…
সঙ্ঘমিত্রাঃ এবং একটা লোক ওরকম দৈত্যের মতো লড়ছেন! কোথাও কোনো আপোষ করেন নি। অনেকে বলেন যে, উনি মেনে নিয়েছিলেন… কিন্তু আসলে উনি ওটা ঘুরিয়ে বলেছিলেন যে— ক্লাসিক্যাল আমাদের কাছে দাবি করে নিখুঁত পুনরাবৃত্তি। আমরা কি জড় পদার্থ? আমাদের কি কিছুমাত্র নতুনত্ব থাকবে না? নতুনের পথে ভুল করে যাওয়াও ভালো। তাই বলি আমার গান যদি শিখতে চাও, নিরালায়, স্বগত, নাওয়ার ঘরে কিংবা এমনি সব জায়গায়—গলা ছেড়ে গাবে। … ভারতীয় সংগীত বলে প্রকান্ড যে একটা ব্যাপার আছে, আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা… এই যে, একটা মানুষ এই তাগিদটা অনুভব করছে… সেটা…
জয়ঃ সেটা খুব বড়ো কথা। আর একটা বড়ো কথা হল এই যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের জন্য যে একটা নিয়মবিধি চালু করে গিয়েছিলেন – যে একটা মিউজিক বোর্ড থাকবে – তার কারণ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের মতো বড়ো কবি তো আমাদের দেশে গান লেখেন নি! রবীন্দ্রনাথ খুব বড়ো কবি ছিলেন।
সঙ্ঘমিত্রাঃ গানটাও কবিতাই! আমি কবিতা হিসেবে পড়ি।
জয়ঃ হ্যাঁ। অতবড়ো একজন কবি গান লিখছেন … নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর তাঁর কবিতা ফরাসি ভাষায় অনূদিত হচ্ছে… স্পেনে অনুবাদ হচ্ছে… ইংরিজিতে অনুবাদ হচ্ছে… মানে, আমি বলছি… নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন এরকম অন্তত তিনজন ওঁর কবিতা অনুবাদ করেছেন। একজন হচ্ছেন হিমেনেথ। স্পেন। একজন হচ্ছেন আঁদ্রে জিদ। আরেকজন হচ্ছেন সাঁ জন পার্স। ফরাসি। ইয়েটস অনুবাদ করেছেন। এঁরা কিন্তু সবাই নোবেল প্রাইজ পাওয়া কবি। নোবেল প্রাইজ পাওয়া কবিরা যখন এঁর কবিতা অনুবাদ করছেন তখন সে লোকটা তো আর যেমন তেমন কবি নয়! সেগুলো ছিল Song Offerings – বাংলা গীতাঞ্জলির যে গদ্য অনুবাদ – সেই গীতাঞ্জলির গান যখন কেউ গাইছে, তাকে সতর্ক হতে হবে না? অতোবড়ো কবি তো গানগুলো লিখেছেন! মানে, আমি বলতে চাইছি রবীন্দ্রনাথের মাপের একজন কবি যখন গান লিখছেন … তিনি যখন তাতে সুর বসাচ্ছেন… তিনি শব্দগুলোর প্রতি যথেষ্ট নজর রেখে সুর বসাচ্ছেন। হয়তো এটা সতর্কভাবে করছেন না, স্বতঃস্ফুর্তভাবে হচ্ছে। কিন্তু স্বতস্ফুর্তভাবে করলেও কিন্তু ওটা ওরকমভাবেই হয়। শক্তি যেমন স্বতস্ফুর্তভাবে কবিতা লিখতেন! সেরকম স্বতস্ফুর্তভাবেই উনি সুর দিচ্ছেন! কিন্তু গানের শব্দগুলোর প্রতি অত্যন্ত সুবিচার করে উনি সুর বসাচ্ছেন।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কখনো কখনও তো উনি সুরটাই আগে দিচ্ছেন, কথাটা পরে…
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ গানের যে কবিতারূপ – আমার পড়া ভুল হয়তো – গানের কবিতারূপে কিন্তু আমার মনে হয়েছে পরীক্ষা নিরীক্ষা অনেক বেশি। যেমন, ধরুন, খুব সহজ গান – ছোটোবেলা থেকে গেয়ে আসি… একদিন হঠাৎ করে মনে হল যে এটা নিয়ে অ্যাদ্দিন তো এরকম করে ভাবিনি – ‘মনে রবে কিনা রবে আমারে/ সে আমার মনে নাই মনে নাই’ – এই ‘মনে নাই’ এর অর্থটা যে কী?
জয়ঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!
অনিমিখঃ মানে, আমাকে মনে থাকবে কিনা – এই সংশয়? সেটা আমার ভেতরে আছে নাকি আমি সেটা ভাবছি না, ভুলে গেছি – কতোরকম অর্থের এখানে একটা ধাঁধা তৈরি করা হয়েছে!
জয়ঃ অথচ ‘মনে’ কথাটা এখানে কতবার ব্যবহার করা হল! আমরা একটা কথাকে দু’বার ব্যবহার করতে কতবার ভাবব! অথচ উনি ওই দু’লাইনের মধ্যে তিনবার ‘মনে’ কথাটা ব্যবহার করলেন। তাতে কি রসের একটুও হানি হল? বরং একটা নতুন রস তৈরি হল।
অনিমিখঃ তার মানে, কবিতার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম বেঁধে দেওয়া যায় না।
জয়ঃ না, যে লিখছে সে লিখতে লিখতে একটা নিয়ম তৈরি করে। লেখা হয়ে যাবার পর আমরা একটা নিয়ম দেখতে পাই। তারপরে, সে সেই নিয়মটা থেকে স্খলিত হয়ে যায়। পরবর্তী কবিতার দিকে যখন যাবে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের কথা যখন হচ্ছে, তখন বলি। ‘রবীন্দ্রনাথ কেমন করে লিখতেন’ -অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের একটা বই ছিল। সেখানে উনি বলছেন—রবীন্দ্রনাথের এরকম নাকি হত, উনি লিখতে লিখতে কারও সঙ্গে দেখা করতে উঠতেন বা কেউ এলে কথাও বলতেন দিব্যি। তো, রবীন্দ্রনাথকে এব্যাপারে পরে জিজ্ঞেস করা হলে উনি বলেছিলেন কবিতা লেখার সময়ে কেউ এলে ওঁর নাকি কোনও ক্ষতি হয় না! বরং ব্রেক কষে রাখেন উনি খানিকটা। ভাষা সংহত হয়, ভাব দানা বেঁধে ওঠার অবকাশ পায়। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এটা আপনার ক্ষেত্রে কখনও হয়েছে?
জয়ঃ না, বাধা পড়েছে। কিন্তু সেটাকে বাধা হিসেবেই আমি দেখেছি। রবীন্দ্রনাথের তো আর দ্বিতীয় তুলনা হয় না! এরকম হয়তো আমারও হয়েছে যে, লিখতে লিখতে উঠে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে বা কিছু কাজ করতে হয়েছে – তখন সেটা বাধা হিসেবেই আমার কাছে এসেছে।
অনিমিখঃ ধরুন একটা লেখার মাঝামাঝি আছেন… একটু আভাষ পাওয়া যাচ্ছে লেখাটার… বাধা আসার পর লিখতে বসলে সেই অভিমুখটা কি পালটে যায়?
জয়ঃ কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তক্ষুণি আমি আবার ফিরে আসি না। আমি বিরতিটাকে স্বীকার করে নিই। কবিতাটা পড়তে থাকি যতটা লিখেছি… লাইনগুলো কীভাবে আসছে… সেটাকে অনুসরণ করতে থাকি… পড়তে পড়তে কী হল… তখন মাথার মধ্যে আবার নতুন লাইন জেগে ওঠে।
অনিমিখঃ একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল আপনার সঙ্গে আমার। আপনি বলছিলেন… শেষবয়সে, যখন সবাই বলছে যে শক্তি আর লিখতে পারেন না… তখনও শক্তি একটা লাইন লিখেছিলেন ‘বৃদ্ধ মনঃ ছিল নাকি তোমার শরীরে’… আপনি বলছিলেন যে কারো কারো ক্ষেত্রে একটা আশ্চর্য ব্যাপার হয় যে, সুরাপান আর কবিতা – দুটো একসঙ্গে যুক্ত থাকে…
জয়ঃ শক্তিদা নাকি এরকম একটা কথা কখনো বলেছিলেন যে – মদ্য আমাকে পদ্যের কাছে টেনে আনে। অন্যদের লেখায় পড়েছি যে শক্তি নাকি বলেছিলেন এরকম।
অনিমিখঃ এরকম একটা ধারণা চালু আছে আমাদের সৃজনশীল লোকেদের জগতে যে মদ্যপান নাকি খুব একটা আবশ্যিক ব্যাপার আর কি… আপনি বলেছিলেন যে সেটা শক্তির ক্ষেত্রে সত্য, সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়…
জয়ঃ হ্যাঁ, শক্তির ক্ষেত্রে সত্য। সবার ক্ষেত্রে সত্য হবে তা নয়। আরেকজন শক্তি কোথায়? কিন্তু সুরাপানকারী কবি তো আমরা অনেক দেখেছি, তাই না? কিন্তু আরেকজন শক্তি কি দেখেছি আর?
অনিমিখঃ আরেকটা কথা আপনি বলেছিলেন… শক্তির সুরা ছাড়ানোর একটা চিকিৎসা করা হয়েছিল পরিবারের পক্ষ থেকে…
জয়ঃ হ্যাঁ… । এই কথাটা আমি শুনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। যে, দু’বার শক্তিকে সুরা ছাড়ানোর জন্য চিকিৎসা করা হয়েছিল। সে চিকিৎসার ফল নাকি ভালো হয়নি। মানে, শক্তির জীবনের ওপর সে চিকিৎসার ফল ভালো হয়নি।
শক্তির শেষদিকের কবিতাকে কবি-পাঠকেরা স্বীকার করেন না।
অনিমিখঃ আপনার কী মনে হয় শক্তির শেষজীবনের লেখা সম্পর্কে?
জয়ঃ আমার মনে হয় শক্তির পরিবর্তন হয়েছিল। জীবনের কারণে শক্তি’র ভেতরে পরিবর্তন এসেছিল।
‘এখনো আমি পুরনো এক বকের মতো সাদা’ – ওঁর শেষদিকের কবিতা। জীবদ্দশায় বেরনো শেষ বই ‘জঙ্গল বিষাদে আছে’ – তার বোধহয় প্রথম কবিতা। ‘এখনো আমি পুরনো এক বকের মতো সাদা’…
অনিমিখঃ পুরনো ! মানে, যদি শুধু ‘বকের মতো সাদা’ বলতেন তাহলে হত না। কিন্তু ‘পুরনো’ এক বকের মতো সাদা!
আচ্ছা, শক্তি এবং উৎপলকুমার – আপনি সান্নিধ্য পেয়েছেন এরকম দুই সিনিয়র কবি…
জয়ঃ আমি শক্তির সান্নিধ্যে কখনো ছিলাম না। আমি এক অফিসে চাকরি করেছি, প্রায় রোজই দেখেছি… কিন্তু শক্তির সান্নিধ্য যেটাকে বলে সেটা আমি নিতে যাইনি কখনো। আমি ওঁর কবিতা খুবই পছন্দ করতাম। খুবই ভালোবাসতাম। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর আটবছর পরে প্রথম আমি ওঁকে নিয়ে লিখি—‘হে দগ্ধ হে অপ্রত্যাশিত’। শক্তির মৃত্যুর পরে ওঁকে নিয়ে লেখার একটা ধুম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন আমি চুপ করে ছিলাম। মৃত্যুর আটবছর পর আমি ওঁকে নিয়ে প্রথম লিখি।
অনিমিখঃ এটা ঠিক যে, শক্তিকে নিয়ে যা লেখা হয়, বলা হয় বেশিটাই ওঁর মিথগুলো নিয়ে। ওঁর জীবনযাপনের মিথ নিয়ে।
জয়ঃ আর আমার সঙ্গে শক্তির… শক্তিকে নিয়ে যিনি লিখছেন সেই লেখকের সঙ্গে শক্তির ব্যক্তিগত সম্পর্ক কতটা ছিল, তাকে কতটা স্নেহ করতেন, বা তাকে কী কী বলেছেন কবে বলেছেন—এইসব কথাবার্তাই লেখা হয়। শক্তির শব্দের সূক্ষ্মতা নিয়ে লেখা হয় না।
অনিমিখঃ তবে সমীর সেনগুপ্ত’র যে বইটা আছে…
জয়ঃ বইটা খুব ভালো বই।
অনিমিখঃ হ্যাঁ… সেখানে একটা কথা সমীর সেনগুপ্ত বলেছিলেন যে—শক্তির মতো এমন অনুপস্থিত মানুষ আমি আর দেখিনি। মানে সবকিছুর মধ্যেই আছেন, চারদিকে এত তাঁর মদ্যপান, ঘুরেবেড়ানো, নানা হৈহল্লার মধ্যে থেকেও প্রবল নাকি অনুপস্থিত থাকতেন ভেতরে ভেতরে। এটা নাকি বোঝা যেত।
জয়ঃ খুব ভালো কথা লিখেছেন। তা নাহলে অতবড় কবি হয়!
‘মনঃ ছিল নাকি তোমার শরীরে’? এই যে ‘মনঃ’… ‘বৃদ্ধ মনঃ ছিল নাকি তোমার শরীরে?’—এই যে ‘মনঃ’ কথাটা ব্যবহার করলেন, এটা কোথা থেকে করলেন উনি? প্রথমে বলছেন ‘অদ্ভুত দুঃখের গন্ধ তোমার শরীরে/ বৃদ্ধ, মনঃ ছিল নাকি তোমার শরীরে!’—এই যে ‘মনঃ’—যেন নিজেকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছেন! তোমার কি মন ছিল না?—এইটা বলতে গিয়ে উনি ‘মনঃ’ বললেন। এই ‘মনঃ’ কোথা থেকে পেলেন? এইটা তিনি ‘তব মনঃকোকনদে’—মধুসূদন থেকে নিয়ে এলেন। আর এতদিন পরে মধুসূদন থেকে আনলেন যে, মধুসূদনের প্রভাব একে বলা যায় না। এটিকে বলা যায় মধুসূদনের কবিতার একটি প্রকরণের নবজন্ম হল। মধুসূদনের নবজন্ম হল শক্তির মধ্যে। নতুন হয়ে গেল। হঠাৎ ‘মনঃ’ বলে বিসর্গ দিয়ে দেওয়া কল্পনা করা যায় না!
শক্তি ওই ‘এত কবি কেন?’—এসব লিখে ঠিক কাজ করেন নি। ওগুলো লিখে ওঁর কী হয়েছিল… সকলে ওঁর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।
অনিমিখঃ আচ্ছা।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনার প্রথম উপন্যাস ‘মনোরমের উপন্যাস’—তারপর থেকে যত উপন্যাস লিখেছেন অ্যাসাইনমেন্টে?
জয়ঃ হ্যাঁ… যত উপন্যাস লিখেছি অ্যাসাইনমেন্টে লিখেছি। কবিতাও লিখেছি অ্যাসানমেন্টে।
আমি ‘মা নিষাদ’ বলেও একটা কবিতা লিখেছিলাম, যেটা ‘দেশ’-এ বেরিয়েছিল, সেই কবিতাটা তো সম্পূর্ণই… কবিতায় একটা সম্পাদকীয় লিখতে বলা হয়েছিল আমাকে, তো সেটা লিখতে গিয়ে আমার দাঁড়ালো একটা দীর্ঘ কবিতা। এবং সেটা কবিতা হিশেবে ‘দেশ’-এ ছাপা হল। কবিতায় একটা সম্পাদকীয় লেখা হবে এবং সেটা এক পাতার মধ্যে থাকবে—এটাই ছিল নির্দেশ। কিন্তু লিখতে গিয়ে একটা দীর্ঘ কবিতা হয়ে গেল। তখন সেই দীর্ঘ-কবিতাটা ‘দেশ’-এ ছাপা হল। ১৯৯৮ সালে। আরেকটা কবিতা আছে ‘আমার দোতারা’। ‘আমার দোতারা’র জন্য আমাকে বলে রেখেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। ওঁর একটা পত্রিকা ছিল- ধ্রুবপদ নামে। ‘ধ্রুবপদ’-এ উনি বাউল-ফকিরদের নিয়ে একটা সংখ্যা করেন, সেখানে আমাকে বলেছিলেন বাউল-ফকিরদের নিয়ে একটা কবিতা লিখে দিতে। এখন ওটা হয়ত ‘দেশ’-এ বেরোয়নি, কিন্তু ওটাও ফরমায়েশি লেখা।
অনিমিখঃ আচ্ছা… কবিতার ক্ষেত্রে যেটা বলছেন দেওয়ালে মাথা ঠুকে গর্ত করে লেখার ব্যাপারটা… কিন্তু উপন্যাসের ক্ষেত্রে সেরকমভাবে খোঁজার চেষ্টা করেননি কেন? উপন্যাসে যেটা হয়েছে, আপনার জীবনটাকে পুরো দেখা যাচ্ছে।
জয়ঃ একটা কোথাও থাক। একটা কোথাও থাক… কার মধ্যে দিয়ে গেলাম, মানে, আজকে যারা কবিতা পড়ছে, আজকে যারা আমায় চেনে, যারা আমাকে অপছন্দ করে বা আমাকে পছন্দ করে, শুধু তারাই তো নয়, আমার অচেনা তো অনেক মানুষ আছে, তাদের কাছে এই চিহ্নটা থাক—যে আমি—আমার জীবনটা কেমন ছিল। কী কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমি গেলাম। আর দুনম্বর কথা হচ্ছে, আমার ওইটাই লিখতে ইচ্ছে করেছে। ওইটাই লিখতে ইচ্ছে করেছে…
অনিমিখঃ আচ্ছা…
জয়ঃ জীবনটাকে যদি দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে, এই লোকটার জীবনটা এইরকম আর এই লোকটা কবিতায় এইরকম। এটাও বোঝা যাবে। কোথাও দুটোর মধ্যে সেতু তৈরি হবে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ সেতু তৈরি হয়। তৈরি হয়…
জয়ঃ শক্তির একটা কবিতা পড়ে শোনাই কেমন?
কবিতাটা… এই কবিতাটা পড়ছি। কবিতাটা পড়তে পড়তে মনে হবে একই কথা বারবার বলে যাচ্ছেন। কিন্তু কোথায় বড় কবি সেটাও বোঝা যাবে…
শামুকের শুকনো খোল পড়ে আছে চোখের সুমুখে
দীর্ঘদিনই আছে
মাঝে মাঝে দেখি
দ্রষ্টব্য তেমন কিছু নয়।
অতি সাধারণ খোল পড়ে আছে বাগানের কোণে
ক্ষতি কী? যেমন আছে থাক।
শুনেছি, শামুকে চুন দেয়।
দেয় আরও কিছু?
দিতে পারে, নেবার যে নেবে।
আমার নেবার কিছু নেই,
মাঝে মাঝে, মনে মনে, আমি ওর মধ্যে গিয়ে শুই।
যখন লুকোতে চাই
সব কিছু জটিলতা থেকে।
ওর মধ্যে জটিলতা নেই
জানি। (শামুক-খোল/ শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
এই যে এতক্ষণ বলতে বলতে এলেন একই কথা। হঠাৎ ‘মাঝে মাঝে, মনে মনে, আমি ওর মধ্যে গিয়ে শুই’—শামুকের শুকনো খোল পড়ে আছে, সেটার মধ্যে গিয়ে ‘মাঝে মাঝে, মনে মনে, আমি ওর মধ্যে গিয়ে শুই’… এইখানটায় বোঝা গেল যে, একটা শামুকের খোলা পড়ে আছে তাই নিয়ে লিখছেন, শুধু তাই নয়, লুকোতে চায়। ‘যখন লুকোতে চাই/ সব কিছু জটিলতা থেকে’… খুব অদ্ভুত না? অথচ কবিতাটা শুরু হয়েছে যখন তখন মনে হয় যে কিছুই নেই কবিতাটার মধ্যে। হঠাৎ একটা লাইনে এসে বলল… এটা হচ্ছে ওঁর একদম শেষ দিকের লেখা। ‘শামুক-খোল’ কবিতাটার নাম। শামুকখোল নামে একধরণের পাখিও আছে।
অনিমিখঃ হ্যাঁ।
জয়ঃ একটা কবিতা লিখছেন একদম শেষ দিকে। আমি তখন দেশ পত্রিকায় চাকরি করি। শক্তি সকালবেলায় আসতেন, এসে একটা কবিতা জমা দিতেন।
সঙ্ঘমিত্রাঃ রোজ?
জয়ঃ মাঝে মাঝে।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা।
জয়ঃ উনি সাগরদার ঘরে এসে কবিতাটা জমা দিতেন। সাগরদার ঘর থেকে সাইন হয়ে কবিতাটা আমার কাছে চলে আসত। আমি সেই কবিতা মার্কিং করে প্রেসে পাঠাতাম। প্রুফ দেখতাম। পাতায় দিতাম, এইসব। তখন কম্পিউটারে কম্পোজ করার ব্যাপারটা আসেনি। এবার একটা কবিতা দিয়েছেন উনি ‘ঈশ্বরের দু বাগানে জল/ একটিতে আমি বসে/ অন্যটিতে অনন্য কিশোরী’… মানে এই যে ‘ঈশ্বরের দু বাগানে জল’—এইলাইনটা তো ভাবতেই পারা যায় না! কী মানে হবে এর! এবং পুরো কবিতাটার মধ্যে কিন্তু এটা আর কোথাও বিস্তৃত ব্যাখা নেই কিন্তু; ঈশ্বরের দু বাগানে জল—বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। ‘ঈশ্বরের দু বাগানে জল’—কী মানে হবে এর! ‘একটিতে আমি বসে/ অন্যটিতে অনন্য কিশোরী’।
অনিমিখঃ ঈশ্বর বলতে কখনও আমার থেকে দূরের কিছু মনে হচ্ছে না এখানে!
জয়ঃ না…
অনিমিখঃ খুব লৌকিক একটা ছবি ভেসে উঠছে।
জয়ঃ কিন্তু ‘ঈশ্বরের দু বাগানে জল’—এটাকে ভাবতেই পারা যায় না! ঈশ্বরের একটি বাগান আছে—তার দুটি বাগান আছে… এই যে এত ধাপ—এসবের মধ্যে গেলেনই না! ‘ঈশ্বরের দু বাগানে জল’… এটা ‘জঙ্গল বিষাদে আছে’—বইটার মধ্যে আছে, কবিতাটা।
খারাপ তো বলেই দেওয়া যায়। খারাপ বলা কিছু আশ্চর্যের? খারাপ তো বলেই দেওয়া যায়…
অনিমিখঃ আচ্ছা জয়দা, এটা কি সত্যি—উৎপলকুমার সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন নাকি আনন্দ-পুরস্কার পাওয়ার পরে যে—উৎপল ছন্দ জানেন না? এটা কি সত্যি? লিখিত আকারে আছে?
জয়ঃ আমি জানি না। এটা আমি জানি না। উৎপল ছন্দ জানতেন। উনি ছন্দের যে বিভিন্নরকম কাজ, বিভিন্নরকম কারুকৃতি সেটা দেখান নি। তবে ছন্দ উনি জানতেন।
কিন্তু আমাকে যেটা কষ্ট দেয়, সেটা হচ্ছে যে, কবিতা-সংসারে এত ঘৃণা এবং প্রতিযোগিতাবোধের বসবাস। এটা আমাকে কষ্ট দেয় খুব। আমি এটাকে উপেক্ষা করে চলি। কিন্তু টের পাই যে, এটা খুব ভালোভাবে বসবাস করছে। অপরের প্রতি ঘৃণা এবং প্রতিযোগিতাবোধ। এটা কবিতা-সংসারে না থাকলেই ভালো হত। কারণ, এমনি যে সমাজটা চলেছে, সে সমাজটার মধ্যে এটা আছে। অল্পকিছু লোক কবিতা নিয়ে বাঁচে। তাদের মধ্যে এটা না থাকলেই ভালো হত।
অনিমিখঃ এবং তাদের এই দুনিয়াকে নিয়ে বৃহত্তর দুনিয়াটার কিছু আসে-যায় না।
জয়ঃ কিছু এসে-যায় না। বৃহত্তর দুনিয়ার কিছু এসে-যায় না।
অনিমিখঃ আমি যেখানে চাকরি করতে যাই অতবড় প্রমিনেন্ট টাউন, কিন্তু সেখানে ‘দেশ’ পত্রিকার নাম ভালোভাবে শোনেনি, এমন প্রচুর লোক আছেন। তাহলে কিসের কবিখ্যাতি নিয়ে আমরা এত মারপিট করি?
জয়ঃ জায়গাটার নাম কী? হলদিয়া?
অনিমিখঃ হুঁ…
জয়ঃ রাজনীতি অধ্যুষিত জায়গা না?
অনিমিখঃ হ্যাঁ।
জয়ঃ কবিতার মধ্যেও তো রাজনীতি ঢুকে পড়েছে।
অনিমিখঃ একজন নতুন লিখতে আসা তরুণ কবির কাছে এখন সময়টা খুব কঠিন। মনে হয় আরকি। আপনারা ভালো বলতে পারবেন।
জয়ঃ সে একবার যদি আঁচ পেয়ে যায়—আসলে ভেতরটা এরকম, তাহলে তার কবিতা লেখার ইচ্ছেটাই চলে যাবে।
অনিমিখঃ হুঁ… সে যেমন ঠিক আবার এখন চটজলদি ব্যাপারগুলো খুব বেশি তো… মানে খুব সহজেই মানুষের প্রতিক্রিয়া জানা যায়। যেমন আপনার লেখালিখির শুরুর দিকে বললেন ছ’মাস পর আসত প্রতিক্রিয়া…
জয়ঃ হ্যাঁ
অনিমিখঃ বা যেমন ধরুন সেই সুতাহাটা থেকে শ্যামলকান্তি দাশ আপনাকে চিঠি লিখতেন…
জয়ঃ হ্যাঁ
অনিমিখঃ সেরকম ব্যাপারগুলো তো এখন নেই। এখন সঙ্গে সঙ্গে… মানে আমি এক্ষুণি লিখে সঙ্গে সঙ্গেই আমি সবাইকে জানিয়ে দিতে পারব, অনলাইনে।
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লাইক-কমেন্ট পড়তে থাকে। দেখা যায় যে নানান স্তরের নানান মেরিটের লেখার তলায় একজন পাঠক বা কবি-পাঠক বলা ভালো, একই বা প্রায় একই কমেন্ট করছেন। সঙ্গে সঙ্গে বাহবা জুটে যায়। ফলে নানান পথে যাওয়ার ইচ্ছে, নিজেকে বিপদে ফেলবার ইচ্ছেটাই চলে যায়।
জয়ঃ এই যে নিজেকে বিপদে ফেলবার ইচ্ছে, এটা একটা মারাত্মক কথা। ঝুঁকি নেবার ইচ্ছে।
অনিমিখঃ এখন এটাও ঠিক, আমাদের মনে যে কবির ক্ল্যাসিক ধারণা আছে…
(কেউ আসায় উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেন। তারপর নিজের চেয়ারে ফিরতে ফিরতে বলেন)
জয়ঃ লুকিয়ে কী করব? উপন্যাসে বা গদ্যলেখায়, নিজেকে লুকিয়ে কী করব? অবশ্য কেউ কেউ একথা বলতে পারেন—তোমার জীবন জেনে অন্যের কী লাভ? এ প্রশ্ন করা যায় কিন্তু। তুমি তোমার জীবনে কী অবস্থায় আছ, সেকথা জেনে অন্যের কী লাভ? আমরা কেন পড়ব? এটা খুব সঙ্গত প্রশ্ন। এ-প্রশ্নের উত্তরে আমি নীরবই থাকব। দোষ স্বীকার করে নেব। কিন্তু আমার মনে হয় যে, আমি মানুষটা কী— সেটাই তো কবিতায় লিখি। সেটা আমি উপন্যাসেও লিখি।
অনিমিখঃ আপনার সঙ্গে একবার পন্ডিত রবিশংকরের দেখা হয়েছিল।
জয়ঃ হ্যাঁ, দেখা হয়েছিল।
অনিমিখঃ এবং আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন—আপনার কী কোনো আক্ষেপ আছে? উনি তখন বলেছিলেন—ভালোভাবে মনে হয় রেওয়াজ করিনি।
জয়ঃ বলেছিলেন।
অনিমিখঃ এটা আমাকে বলার পর আপনি বলেছিলেন, আপনার নিজের ক্ষেত্রেও নাকি তাই মনে হয়… এটা কি ঠিক?
জয়ঃ (খানিকক্ষণ চুপ থেকে, একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে) হ্যাঁ… এটা তো ঠিক বটেই। আরও মন দেওয়া উচিত ছিল।
অনিমিখঃ মন দেওয়া… মানে, এরকম কি যে—এই এই জায়গাগুলো এখনও এক্সপ্লোর করা হল না… এরকম কিছু আছে?
জয়ঃ কোনও একটা জায়গা যে দেখতে পাই তা নয় তো… একটা জায়গা যে দেখতে পাই—এই জায়গাটা আমার এক্সপ্লোর করা হল না, তা তো নয়! যা কিছু লিখেছি, না বুঝেই লিখেছি। লিখতে গিয়ে ওরকম হয়ে গেছে।
অনিমিখঃ আচ্ছা বলছিলাম, কবি সম্পর্কে যে ক্ল্যাসিক ধারণা, যে—কবি তার কল্পনা নিয়েই থাকেন, তার গায়ে অঙ্গার বা কালির ছিটে কিছু লাগেনা, লাগলেও স্খলিত হয়ে যায়, সবকিছুর মধ্যে দিয়ে তিনি হেঁটে যেতে পারেন, তো… এইধারণাটুকু আসলে বোধহয় খুব একটা সত্য নয়?
জয়ঃ আমার জীবনে সত্য নয়। আমার জীবনে সত্য নয়…
অনিমিখঃ কবিতা লিখতে এলে তো…
জয়ঃ অপমান ভোগ করতে হয়।
অনিমিখঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ।
জয়ঃ অপমান ভোগ করতে হয়।
অনিমিখঃ এই যে এত বাহবা, পুরস্কার, রাজনীতির মতো শিবির, এর মধ্যে পড়ে এখন যে ছেলেটি বা মেয়েটি লিখতে আসছে, সে কিভাবে থাকবে? সবকিছু থেকে কি দূরে থাকা সম্ভব?
জয়ঃ না। দূরে থাকা সম্ভব নয়। তাকে খুব পরীক্ষা দিতে হবে। এপর্যন্ত বলতে পারি আমি। সে খুব সংকটে পড়বে। আমি কলকাতা থেকে দূরে থাকতাম বলে আমি না একটা জিনিষ জানি, মানি, যে, দৈব একটা ব্যাপার আছে। আমি একটা কবিতা লিখতে পারব কিনা এটা দৈবাধীন।
সঙ্ঘমিত্রাঃ পল ভ্যালেরি’র একটা কথা আছে যে প্রথম লাইনটা আসে স্বর্গ থেকে।
জয়ঃ স্বর্গ থেকে। বাকিটা তুমি তৈরি করে নাও। তা দৈবের একটা ব্যাপার তো আছেই। আমার প্রথম জীবনটা, সাঁইত্রিশ বছর বয়স অব্দি কলকাতা থেকে দূরে ছিলাম। কলকাতা থেকে দূরে থাকার সুবিধেটা কী সেটা পরবর্তী বয়সে বুঝেছি। যখন নিজেকে প্রস্তুত করার সময়টা, তখন কোনও…
সঙ্ঘমিত্রাঃ বিঘ্নিত হতে পারেনি?
জয়ঃ হ্যাঁ… একমন দিয়ে কাজ করতে পেরেছি। মানে চেষ্টা করতে পেরেছি আর কী। একাগ্র থাকতে পেরেছি। তখন দারিদ্র্য এসেছে। শোক এসেছে। ব্যাধি এসেছে। কিন্তু কলকাতা থেকে দূরে থাকার যে সুবিধেটা সেটা পেয়েছি। আজকে তো কত প্রলোভন! নতুন যে লিখতে আসছে, তার সামনে কত প্রলোভন। সে যদি নিজেকে ঠিক রাখতে পারে, তাহলে সে নিজের জোরেই পারবে। সে নিজের মধ্যে দিয়েই, নিজের বিচারবুদ্ধি বলেই সে স্থির করে নেবে যে—আমার কোনটা করা উচিত।
সেই অর্থে আমি তো কোনও লিটিল ম্যাগাজিন বের করিনি। আর কোনও একটা সাহিত্য গোষ্ঠী যাকে বলে, তার মধ্যেও আমি ছিলাম না। কোনও সাহিত্য-গোষ্ঠীর মধ্যে আমি ছিলাম না। কখনও পত্রিকাও বের করিনি।
অনিমিখঃ তার মানে কি মণীন্দ্র গুপ্ত যেমন বলেছিলেন—ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে তোমার বইটিকে কালের গর্ভে নিক্ষেপ করো, এরকম?
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ এরকম অমরত্বের ধারণাটাই ঠিক?
জয়ঃ অমরত্ব নিয়ে আমি চিন্তা করি নি। কারণ মৃত্যুর পরে তো আর কবিতা লিখতে পারব না। কবিতা লেখার কোনও সুযোগ থাকবে না। বেঁচে যতদিন রয়েছি ততদিন লেখার সুযোগ। ফলে, অমরত্ব কথাটা তো আসে মৃত্যুর পর। তাই না! মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত কথাটা। আমি ওসব ভাবি না। আমার মৃত্যুর পরে আমার কবিতা পড়বে বা কিছু… আমি অজানা অচেনা পাঠকদের কথা ভাবি, যাদের আমি চিনি না। কিন্তু তাদের কাছে আমি একটা ডায়রির মতো, দিনলিপির মতো আমার এই যে কবিতা হোক, লেখা হোক, উপন্যাস হোক—এগুলো লিখে রেখে যেতে চাই। তাদের আমি পৌঁছে দিতে চাই। আর তাছাড়া কবিতা লিখতে এখনও আমার খুব ইচ্ছে করে! কখনও কখনও কয়েকমাস কবিতা লেখা হয় না। এমনও হয়। হয় না যখন জোর করি না।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট এলে?
জয়ঃ হুঁ? হ্যাঁ… ওইসময় অ্যাসাইনমেন্ট আবার আমাকে লেখায় ফিরিয়ে আনে। অ্যাসাইনমেন্ট এলে তখন আবার লেখায় ফিরে আসতে হয়।
অনিমিখঃ তার মানে কখনও কাজেও লাগে অ্যাসাইনমেন্টটা?
জয়ঃ হ্যাঁ, কাজেও লাগে।
(খানিকক্ষণ চুপ থেকে) আমি একটা জিনিষ বলছি, অ্যাসাইনমেন্ট নানা রকমের হয়। যেমন তোমাকে কোনও লিটিল ম্যাগাজিন থেকে বলল—আমাদের চারটে কবিতা দাও। তখন তোমার কাছে কোনও কবিতা নেই। এবার তারা নিয়মিত মেসেজ করে কী ফোন করে তাগাদা দিতে থাকল, যে—আমাকে চারটে কবিতা পাঠাও, আমাদের কাগজের জন্য। ওটা কিন্তু একরকম অ্যাসাইনমেন্ট।
অনিমিখঃ হ্যাঁ।
সঙ্ঘমিত্রাঃ একদমই তাই।
জয়ঃ তাই না?
অনিমিখঃ বন্ধুবিচ্ছেদও হয় এজন্য।
জয়ঃ লেখা দিতে না পারলে?
অনিমিখঃ হ্যাঁ…
জয়ঃ অন্যের অবস্থা বুঝতে চায় না যে, এটাই আমার একটা… একটা সংকট। অন্যের অবস্থা বুঝতে চায় না…
গদ্য লেখা আমাকে লিখিয়েছেন সাগরময় ঘোষ। গদ্য লেখায় আমার একেবারেই কোনওরকম ঝোঁক ছিল না। আমি যখন চাকরি করিনা ‘দেশ’ পত্রিকায়, তখন থেকেই আমাকে দিয়ে গদ্য লেখাতেন সাগরময় ঘোষ। তারপর আমি যখন চাকরিতে ঢুকলাম, তখন আমায় গদ্য লেখার জন্য চাপ দিলেন। তখন আবার গদ্য লেখা লেখা শুরু করলাম। লিখতে লিখতে আমার একটা অভিজ্ঞতা হল। এই গদ্য লিখতে একসময় আমার মনে হল—এমন এমন কিছু অভিজ্ঞতা- অনুভব আছে, যা কবিতায় প্রকাশিত হয় না। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা- অনুভব আছে যা গদ্যরূপ দাবি করে। যেমন এই যে বললাম ‘আলো অন্ধকার আয়ু’ শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে যে গদ্য, সেটা গদ্যরূপ ছাড়া আর লেখা যেত না। সেটাও কিন্তু ‘দেশ’ পত্রিকার তাগাদাতেই আমি লিখেছিলাম। আমাকে শঙ্খ ঘোষ বলা হয় নি। আমাকে বলা হয়েছিল, আমার ভালোলাগা একটা বই নিয়ে লিখতে। তখন আমি শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে লিখি। পরবর্তীকালে তো আমি গোঁসাইবাগান তিনখন্ডে লিখেছি। এই যে উপায় একটা আমার সামনে আবিষ্কৃত হল, বড় সম্পাদক কিন্তু এইটা করেন। কার ভেতরে কী আছে, সেটা তিনি একটা অনুমান করে, তাকে দিয়ে সেই কাজটা করিয়ে নেন। এটা আমি ঋতুপর্ণ ঘোষের ক্ষেত্রেও দেখেছি। ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাকে দিয়ে এমন সব লেখা লিখিয়েছে, যেটা আমি ভাবি নি। আমার ধারণায় ছিল না। যেমন ‘ফেসবুক’ বলে আমার একটা বই আছে, সেই বই-এর যে লেখা, সেগুলো ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাকে তাগাদা দিয়ে লিখিয়েছেন। রোববার পত্রিকায় তখন আমি কাজ করি। আমি আসলে তাকে গল্পচ্ছলে অনেকসময় বলতাম যে, এরকম একটা ঘটনা… এরকম একটা ঘটনা… তখন ও আমাকে বলল—তুমি এগুলো লেখো; চন্দ্রিল তুই একটা নাম দিয়ে দে তো জয়ের কলামটার। তখন চন্দ্রিল একটা নাম দিয়ে দিল, ‘ফেসবুক’ বলে। তখন ফেসবুক নতুন এসেছে। আমি তখন লিখতে শুরু করলাম। বা গোঁসাইবাগান… এটাও ঋতু’র কথাতেই লেখা। নাহলে কবিতা নিয়ে এরকম বছরের পর বছর লিখে যাব… সাতবছর টানা লিখেছিলাম তখন। এই যে লিখে যাব… ঋতুর মৃত্যুর পর আমার মনের মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতা এবং বিষাদ কাজ করল। আরও নানা কারণ ছিল। আমি গোঁসাইবাগান লেখাটা বন্ধ করে দিলাম। এখন আবার শুরু করেছি। অনিন্দ্য বলল—আপনি গোঁসাইবাগান’টা লিখুন, ওটা আমাদের খুব পপুলার কলাম ছিল। সেইজন্য আবার শুরু করেছি।
গোঁসাইবাগান নামটা ঋতুপর্ণ দিয়েছিল। আমি কবিতা নিয়ে কিছু লিখতে বসলে লেখাটা হবে, ভেতর থেকে কিছু বেরবে আরকি… এটা অনুমান করে একজন সম্পাদক বলছে— জয়, কবিতা নিয়ে তোমার যা মনে হয়, লেখো। এটা কিন্তু সম্পাদকদের… আমি বলছি বিচক্ষণতা।
সঙ্ঘমিত্রাঃ উনি সম্পাদকীয়টাও সুন্দর লিখতেন।
জয়ঃ খুব সুন্দর লিখতেন। খুব ভালো লিখতেন।
অনিমিখঃ এত তরুণতম কবির লেখা পড়েন। লিটিল ম্যাগাজিন এভাবে খুঁটিয়ে পড়েন। আমরা নিজেরাও তো লিটিল ম্যাগাজিন পুরোটা পড়ে উঠতে পারি না।
জয়ঃ একটু ধৈর্য লাগে। একটু ধৈর্য্য লাগে…
তেমনি তো আমার ফুকো-দেরিদা পড়া হয় নি। এটাও তো ঠিক যে, আমি ফুকো-দেরিদা এসব পড়িনি। এগুলো জানি না।
(সম্মিলিত হাসি তিনজনের)।
সঙ্ঘমিত্রাঃ আপনি যে চিন্তাগুলো করেন অনেকসময়, ফুকো- দেরিদা সেটা একটা মেথডের ভিতর নিয়ে এসেছেন, তাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন…
অনিমিখঃ রোলা বার্থের একটা কথা আছে—লেখার পর লেখাটা আর লেখকের থাকে না। ডেথ অফ অথারশিপ।
সঙ্ঘমিত্রাঃ অথচ জীবনানন্দ বলেছিলেন—একজন কবির ভালো পাঠক সে নিজে। খুব অদ্ভুত লাগে ভাবলে!
জয়ঃ খুব অদ্ভুত লাগে না? সত্যি… হয়ত জীবনানন্দের ক্ষেত্রে এটা বলা সম্ভব ছিল, কেননা জীবনানন্দ’র সত্যিকারের পাঠক ছিল না তো…
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ, অন্তত তাঁর জীবৎকালে।
জয়ঃ হ্যাঁ… ওই যে একশ বাষট্টিটা কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবিতা হিশেবে রয়েছে, তাও তো বিরাম মুখোপাধ্যায় বেছে নিয়েছিলেন। জীবনানন্দ একটা রহস্য। নিশ্চয়ই।
অনিমিখঃ অন্যের লেখা পড়লে কি প্রভাব চলে আসার আশঙ্কা থাকে?
জয়ঃ যত কবিতা জীবনে পড়েছি, সকলের কাছ থেকেই তো কিছু না কিছু শিখেছি। যে লেখা খুব ভালো, সে-লেখা যেমন বলেছে—কোন পথ অনুসরণ করা উচিত নয়।
অনিমিখঃ যে লেখা ভালো, সে লেখা বলেছে?
জয়ঃ সেই লেখা বলেছে যে, কোন পথ অনুসরণ করা উচিত নয়। যে পথ খুব ভালো, সেই পথে গেলে তো মরে যাব!
সঙ্ঘমিত্রাঃ আচ্ছা, আচ্ছা!
জয়ঃ তাই না? যে লেখা ভালো সেই লেখা তো বলে দেবে—এই পথ অনুসরণ করা উচিত নয়। রবীন্দ্র-অনুসারী কবিদের কী হয়েছিল, মনে নেই? আর যে লেখা তত ভালো নয়, সে লেখা এই সতর্কতা দেয় যে—তোমার লেখা পড়েও কারও কিন্তু এরকম মনে হতে পারে। এই-ই… আমার লেখাও কি এরকম হয়ে গেল? এরকম উত্তীর্ণ হল না? এই ভয়টা জন্মায়। ফলে, সবধরণের লেখা থেকেই কিছু না কিছু শেখার থাকে।
অনিমিখঃ ফেসবুকে, সেদিন নবীনতম কিছু কবি, তাদের এখনও বই বেরোয়নি, তারা আলোচনা করছিল দেখলাম—ওরে বাবা, আমি এখন আর কারও লেখা পড়ছি না! পড়লেই কোথায় এখন নিজের লেখায় চলে আসবে। আজকাল খুব চুরি হচ্ছে লেখা আরকি!(হাসি)… অবশ্য ভালো লেখে তারা।
অবশ্য এলিয়টের সেই কথাটা বলা চলে—ট্রাডিশান এন্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট। কেউ তো আমরা একা একা দাঁড়িয়ে নেই!
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ জয়দা, একটা প্রশ্ন… আমাদের সহযোগী বন্ধু, দেবব্রত জানতে চাইছিল—
জয়ঃ কর বিশ্বাস?
অনিমিখঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ… যে, শূন্য দশকের কবিতা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে আপনার কী মত?
জয়ঃ আমার ধারণা, খুব ভালো। ওরা খুব সচেতন।
অনিমিখঃ আবার অনেকে অভিযোগ করে—সুগ্রথিত নয়।
জয়ঃ কী? খুব সুগঠিত নয়?
অনিমিখঃ সুগ্রথিত নয়। খুব ছন্নছাড়া ধরনের আরকি!
জয়ঃ সে তো কবিদের সঙ্গে কবিদের নিয়ে যে একটা গোষ্ঠীবদ্ধতা, সেটা হয়ত তৈরি হয় নি। কিন্তু সেটা তো একদিকে ভালোই হয়েছে। স্বাধীনভাবে লিখতে পারছে সবাই। গোষ্ঠীবদ্ধতা অনেকসময় ক্ষতি করে। জয়যুক্ত হয় গোষ্ঠীবদ্ধতা, এটা ঠিক। গোষ্ঠীবদ্ধতা জয়যুক্ত হয়। কারণ, একসঙ্গে অনেকে মিলে আমি বলছি তোমার লেখাটা ভালো, তুমি বলছ আমার লেখাটা ভালো, আমরা দুজনে মিলে বলছি সঙ্ঘমিত্রার লেখাটা ভালো, সঙ্ঘমিত্রা বলছে আমাদের দুজনের লেখাটা ভালো। এইভাবে যে একটা চক্র তৈরি হয়, সেই সার্কেলটা… একা পথ চলবার থেকে এক দঙ্গল মিলে পথ চলার বাধাটা তো কম, ফলে, সেই গোষ্ঠীবদ্ধতা অনেকসময় জয়যুক্ত হয়। কিন্তু কবির ক্ষেত্রে একাকিত্ব বোধহয় দরকার। একাকিত্ব বোধহয় দরকার।
অনিমিখঃ নব্বই দশকের কবিরা খুব তাড়াতাড়ি খ্যাতি লাভ করেছেন। তাদের লেখার সময়কালেই। তারপর শূন্যদশক। তখন অনেকগুলো টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট ঘটে যায়। চিন্তাজগৎটা ওলোটপালট হয়ে যায়। অনলাইন মিডিয়াগুলো আসার ফলে কবিতা লিখে এখন খুব তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি।
জয়ঃ হুঁ…
অনিমিখঃ এই সবমিলিয়ে ব্যাপারটা কেমন লাগে? এই নব্বইয়ের পর শূন্য। এবং শূন্যের চেহারাটা বোধহয় এখনও তৈরি হয় নি।
জয়ঃ কিন্তু শূন্যের চেহারাটা তৈরি হয়ে যাবে, ভালো করে ধরা যাবে দ্বিতীয় দশকে। কারণ, নব্বই দশকের চেহারাটা ভালো করে ধরা গেছে প্রথম দশকে।
নব্বই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও অনেক বেশি পেয়েছে।
অনিমিখঃ হুঁ
জয়ঃ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি অনেক বেশি পেয়েছে নব্বই।
অনিমিখঃ সেটাই কি একটা কারণ যে, আমাদের এক তরুণতম বন্ধু, সতীর্থ—সুমন সাধু, ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ার সময় ডিসার্টেশান পেপারের জন্য একটা সমীক্ষা চালিয়েছিল, সেখানে বেশিরভাগ মানুষজন বলেছেন নব্বই দশকের পর আর কবিতা লেখা হয় নি। শূন্য দশক কী—সেটা তারা জানেন না। কোনও ধারণাই নেই।
জয়ঃ সে কী!
অনিমিখঃ হ্যাঁ। সেটাও কি স্বীকৃতির কারণে কেবলমাত্র? কী মনে হয়?
জয়ঃ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি—ওটাই একটা কারণ।
পেপারটা কি করতে পেরেছিল শেষপর্যন্ত? করেছিল না?
সঙ্ঘঃ হ্যাঁ…
জয়ঃ শূন্য দশকের অস্তিত্বই নেই বলছে?
অনিমিখঃ হ্যাঁ। খুব সাম্প্রতিককালে ফেসবুকে আবার একজন বলেছেন, শূন্যদশক নাকি দুর্বোধ্যতার প্রাচীর।
জয়ঃ না, একধরনের কবিতা লেখা হয় যা বিবৃতিমূলক। যেটা পড়া মাত্র, আসলে পড়া বলা উচিত নয়, শোনা মাত্র, আবৃত্তিকারের মুখে শোনামাত্র তার অর্থ ধরতে পারে সবাই। এরকম একধরনের লেখা হয়। এ তো মানতেই হবে। একটা কথা বলার আছে, এই যে বিবৃতি আকারের কবিতা, বিবৃতি ধরণের কবিতা, এইকবিতার মধ্যে বহুমাত্রিক অর্থস্তর থাকে না। একটিই অর্থ থাকে। যেটা প্রথমবার পড়ার পরেই পরিস্ফুট হয়ে যায়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ দ্বিতীয়বার আর কবিতাটার কাছে ফেরার দরকার হয় না।
জয়ঃ দ্বিতীয়বার আর কবিতাটা পড়ার দরকার হয় না।
এরা যাঁরা প্রধানত বিবৃতিমূলক কবিতা লেখেন, তাঁদের ভেতরে একধরনের আক্রমণাত্মক মনোভাব থাকে। আমি এটা লক্ষ করে দেখেছি। আক্রমণাত্মক মনোভাব থাকে সেইসব কবিদের প্রতি, যাঁরা বিবৃতিমূলক কবিতা লেখেন না। অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত। যাঁরা বিবৃতিমূলক কবিতা লেখেন না, সাংকেতিক কবিতা লেখেন, তাঁরা অনেকটা নির্বিবাদী হন। চুপচাপ থাকেন। কিন্তু বিবৃতির দিকে যাঁদের লক্ষ্য তাঁরা একটু আক্রমণাত্মক হন।
অনিমিখঃ আবৃত্তি কি কবিতার ক্ষতি করে?
জয়ঃ যদি কোনও কবি আবৃত্তি যে কবিতা হল সেই কবিতাকেই কবিতার সর্বোত্তম মান বলে ভাবেন, এবং সেরকম কবিতাই বারবার লিখে চলেন, তাহলে তো ক্ষতিকর একটা অবস্থা তৈরি হয় বইকি! সংকেতধর্ম হারিয়ে যাওয়া আর সংবাদধর্ম এসে পড়া এ তো খুব দুঃখকর একটা বিষয়। যে কবিতার মধ্যে সংবাদধর্ম এসে পড়ছে। সংকেতধর্ম দূরে চলে যাচ্ছে কবিতা থেকে। সংকেতধর্ম দূরে যাওয়াটা খুব চিন্তার বিষয়। আমি যা বলছি তার মধ্যে যদি বিভিন্ন অর্থস্তর না যোগ করতে পারি, তাহলে বলছি কেন?
সঙ্ঘমিত্রাঃ মানে যে কথাটা আমি গল্পে বলতে পারি, প্রবন্ধে বলতে পারি, বা যেকথাটা আমি ফিচার লেখায় বলতে পারি, সেটা কেন আমি কবিতায় বলতে যাব? আলাদা করে কেন কবিতার ফর্ম দরকার হবে কেন তার জন্য?
জয়ঃ এটাই তো বুঝতে পারি না। এটাই বুঝতে পারি না।
অনিমিখঃ সংবাদ মূলত কাব্য—এইধরণের কথাও আছে…
জয়ঃ যিনি, সংবাদ মূলত কাব্য—এই কথাটা লিখেছিলেন, বিষ্ণু দে, তাঁর কবিতা কিন্তু সাংবাদিকতাধর্মী নয়। কেবল বিবৃতিমূলক ছিল না তাঁর কবিতা। জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন। বিষ্ণু দে’র কবিতা নিয়ে তখন খুব আলোচনা হত। এখন বিষ্ণু দে একদম দিগন্তের বাইরে চলে গেছেন। বিষ্ণু দে’র আর কোনও আলোচনা হয় না।
আনিমিখঃ আমার সমর সেনের কবিতা খুব ভালো লাগে। কিছু বছর আগে চল্লিশের দশকের কবিদের নিয়ে একটা লেখা লিখতে হয়েছিল। তখন আবার চল্লিশের দশকের কবিদের ভালোভাবে পড়তে শুরু করি। আগে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কিছু কবিতা পড়েছিলাম। ‘মিছিলের কবি’ হিশেবে খানিকটা সরিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তখন আবার পড়তে গিয়ে দেখলাম, কী অসামান্য!
জয়ঃ কী অসামান্য! আমার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের খুব কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
অনিমিখঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো বোধহয় শেষদিকে দীর্ঘদিন লেখালিখি সেভাবে করতে পারেন নি?
জয়ঃ লেখালিখি করতেন। কিন্তু ওঁকে কবিসমাজ পরিত্যাগ করেছিল। কারণ, ওই যে রাজনৈতিক দলটা চৌত্রিশ বছর ছিল, তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার জন্য ওঁকে একরমভাবে পরিত্যাগই করা হয়। শেষের দিকে অসুস্থ ছিলেন খুব।
(খানিকক্ষণ চুপ থেকে)
বিবৃতিমূলক কবিতা যদি সভায় সফল হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়, তাহলে বিবৃতিমূলক কবিতার অনুসারী বেড়ে ওঠে। এটা একটা চিন্তার কথা।
অনিমিখঃ আমাদের সামান্য পনের ষোল বছরের কবিতালেখার সময়কাল, তবুও মাঝেমাঝেই মনে হয়—আমরা প্রথম যখন লিখতে এসেছিলাম, সেই সময় থেকে এইসময়টা অনেকটা বদলে গেছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
জয়ঃ এখন বহির্মুখী হয়ে পড়েছে।
অনিমিখঃ মানে, আপনাদের কেমন লাগে? এতগুলো বছর কাটিয়ে এসে? সেইসময়টার সঙ্গে এইসময়টার তো একেবারেই কোনও সংযোগই থাকার কথা নয়…
জয়ঃ আমি ফেসবুক করিনা। ফেসবুক নেই আমার। আমি এই ইন্টারনেট জগতের খবরও রাখি না। কিন্তু কানে এসে পৌঁছয় অনেক কথা। এই ফেসবুকের জগতের কথা। ইন্টারনেটের জগতের কথা। কানে এসে পৌঁছয়। আরেকটা ব্যাপারে আমি অবাক হয়ে যাই, যে, লেখা বেরলো, ছাপা হল, ধরা যাক কোনও সংবাদপত্রে। সেই লেখাটারই লেখক, সেইদিনই, ফেসবুকে দিয়ে দিলেন। অর্থাৎ তিনি নিশ্চিন্ত নন, যে, পত্রিকায় ছাপা হওয়া কবিতাটা, লেখাটা, হয়ত গদ্য লেখা, সবাই পড়বে বলে। বা যে ক’জন পড়বে, তা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। তিনি ফেসবুকে দিয়ে দিলেন কারণ, তাঁর ফেসবুকে…
অনিমিখঃ অনুসরণকারীর…
জয়ঃ সংখ্যা অনেক বেশি। এই যে একটা বাড়তি তৎপরতা, এটা বোধহয় লেখকের মনের ক্ষেত্রে, কবির মনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। এই মনটাই তো ছায়া ফেলবে পরে লেখায়! এই অতিরিক্ত তৎপরতার ফলে যে মন তৈরি হচ্ছে সেই মনের মধ্যে সংকেতপ্রবণতা কমে যায়। সংকেত করার ইচ্ছে কমে যায়। তার মনে হবে—দ্রুত পাঠককে আকর্ষণ করি। এবং পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য সে সংকেত বিসর্জন দেবে। কারণ, সংকেত মানেই তো একটা পরীক্ষা। যে… আমার লেখাটি পাঠকের তিনবার-চারবার-পাঁচবার পড়ার দরকার হবে। পাঠকের অত সময় কোথায়—এই কথা ভেবে যদি কেউ সংকেত বিসর্জন দেন, ওই পথে না যান, তাহলে কবিতা তার অর্থস্তর হারাতে থাকে। কবিতা যদি একাধিক অর্থস্তর বঞ্চিত হয়– তবে সে কবিতা হয়ে পড়ে কেবলই সংবাদ। তাই সংকেতধর্ম এবং সংবাদধর্ম—এ’দুটির মধ্যে সংবাদধর্মেরই প্রাবল্য আজকে বেশি।
অনিমিখঃ তথাকথিত পাঠক বা অল্প লেখক-পাঠক তাদের মনগঠন বা চর্চাটাও এখন অনেক পালটে গেছে। এখন যেটা শুনি নাকি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই বিক্রি হয় না!
সঙ্ঘমিত্রাঃ এটা কি সত্যি?
জয়ঃ আমিও শুনেছি।
অনিমিখঃ মানে তাঁরা পূর্বসূরিদের কবিতাই পড়েন না। কিংবদন্তীদের কবিতাই পড়েন না।
জয়ঃ কাদের কবিতা পড়েন তাহলে? শক্তিকে যদি কেউ না পড়ে, শঙ্খ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু যদি না পড়েন, তাহলে কাকে পড়েন?
অনিমিখঃ উৎপলকুমার বসু তো খুবই অপঠিত। উৎপলকুমার বসু বললেই সবাই ওই ‘মন মানে না বৃষ্টি হল এত/সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পাড়ে/ আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল/ স্পর্শ করি জলের অধিকারে…’—এটাই বলে।
জয়ঃ অথচ এটা উৎপল বসুর সিগনেচার লেখা নয়।
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ। প্রতিনিধিস্থানীয় লেখা নয়।
জয়ঃ ‘স্পর্শ করি জলের অধিকারে’… এটাই বলে?
অনিমিখঃ হ্যাঁ, ‘মন মানে না বৃষ্টি হল এত’… এর মধ্যে যেহেতু একটা ছবি পাওয়া যাচ্ছে, যদিও এর মধ্যেও অনেককিছু আছে… তাঁরা হয়ত সেই অর্থটাও খুঁড়তে যান না। আমি তো ভাবছিলাম—‘ডুবো নদীর পাড়ে’… কথাটাই তো কী অসামান্য!
জয়ঃ কী দারুণ কথা না! ‘ডুবো নদীর পাড়ে’…
অনিমিখঃ মন মানে না কেন! কিন্তু যেহেতু একটু নরম-একটু পেলবতা আছে, সেটা ধরতে পেরে যান…
জয়ঃ ‘সমস্ত রাত ডুবো নদীর পাড়ে’ বললেও কী অবাক লাগে না! ডুবো নদীটা কী নদী? ‘মন মানে না বৃষ্টি হল এত’—এটাও কিন্তু খুব আশ্চর্যের! তাই না? ‘মন মানে না বৃষ্টি হল এত’…
সঙ্ঘমিত্রাঃ অনেক বৃষ্টি হল, বুঝলাম। কিন্তু মন মানে না কেন!
(এরপর চা পান। এবং অন্যান্য বিষয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। রেকর্ডার অফ থাকে। তারপর ‘সূর্য-পোড়া ছাই’কে কেন্দ্র করে আবার কথা জমে ওঠে। যে বইটা মূলত ট্রামে ফেরার পথে লিখিত হয়েছিল বলে জানান তিনি।)
জয়ঃ ১৯৯৯ সালে প্রথম বইটা (সূর্য-পোড়া ছাই) বেরোয়। ট্রামটা থামল আমিও থামলাম। তখন আর মাথায় কবিতা আসছে না। আবার ট্রামটা চলতে শুরু করল। যেই ট্রামটা চলতে শুরু করল, আবার মাথায় কবিতার লাইন আসতে শুরু করল। স্পেসের পর লাইনগুলো এল। ‘সূর্যপোড়া ছাই’ বইটা লক্ষ্য করে দেখবে, ছোট ছোট লাইন, দু-তিনটে লাইন, তারপর একটা স্পেস। দু-লাইন, তারপর একটা স্পেস। তিনলাইন একটা স্পেস। এই স্পেসগুলো এসেছে… সব ট্রামগুলো থেমেছে… তাই স্পেসগুলো এসেছে। কারণ, ওই জায়গাটা তখন আর চিন্তা করতে পারছি না আমি। স্পেস দিয়ে দিয়েছি। আবার যেই ট্রামটা চলতে শুরু করছে বাকি অংশটা আসছে। প্রথম দু’তিনদিন আমি দেখলাম, ট্রামে করে ফিরলে কবিতা আসছে, তখন আমি নিয়মিত ট্রামে করে ফিরতে শুরু করলাম। এবং এইভাবে সমস্ত বইটাই আমার ট্রামের মধ্যে লেখা। বইটার মধ্যে মহাজগতের কথা আছে। কিন্তু আমি তো তখন সেইরকম কোনও আবহের মধ্যে ছিলাম না। কলকাতায় ভিড়, ধোঁয়া…
সঙ্ঘমিত্রাঃ তারমধ্যে হিউমারও রয়েছে।
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ আপনি একটা জায়গায় যেতে গিয়ে ভেঙে দিয়ে বলছেন—‘ওরে পড়ে যাবি, ওরে পড়ে যাবি, ডাকতে ডাকতে আমি/ বল্মীকের স্তূপ ভেঙে সমাজ সংসারে ছুটে আসি’
জয়ঃ হ্যাঁ… হ্যাঁ…
অনিমিখঃ এই হিউমারটা বরাবরই ছিল আপনার কবিতায়। এর প্রয়োগ কিন্তু খুব কম দেখা যায়। কবিতায় হিউমারকে এনে কবিতায় সংকেতধর্মীতা এবং তার অর্থস্তর বাঁচিয়ে রাখা, ভীষণ কঠিন কাজ। কখনও কখনও হিউমার আনতে গিয়ে দেখি যে, শুধুই সেটা হিউমার হয়ে যাচ্ছে।
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ কিন্তু আপনি যে বলছেন আপনি মহাজগতের মধ্যে ছিলেন না, ছিলেন না বটে, কিন্তু মহাজাগতিক নানা চেতনা আপনার মধ্যে ঘুরেফিরে আসে। সোমক রায়চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা আপনি অনেকবার বলেছেন।
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ কবিও তো ওঁদের মতোই সন্ধানী? সবাই সন্ধান করছেন।
জয়ঃ ওঁরাও যেমন সন্ধান করছেন, কবিও সেরকম সন্ধান করছেন। ঠিক তাই।
অনিমিখঃ আমার মনে হয় যাঁরা বিভিন্ন শাখায় কাজ করেন, তাঁদের পরস্পরের মধ্যে যদি যোগাযোগটা আরেকটু সহজ হত…
(দরজায় এইসময় বেল বাজলে উঠে গিয়ে খুলে দিয়ে ফিরতে ফিরতে বললেন…)
জয়ঃ পাঁচমাস লিখিনি, একথা ভেবে আমার নার্ভাস লাগল, জান তো? এখন আমি তোমাদের সামনে বসে হিশেব করলাম।
অনিমিখঃ কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে কী মনে হয়? কবিতার ‘অনুবাদ’ হয়?
জয়ঃ না, অনুবাদ না হলেও হওয়া তো দরকার। কারণ, তা নাহলে আমরা অন্যভাষার কবিতার স্বাদ পাব কিভাবে? এত যে বুদ্ধদেব বসু’কে ভালোবাসি… বুদ্ধদেব বসু’র একটা প্রবণতা… আমার মনে হয় অনুবাদের ক্ষেত্রে কবিতার ক্ষতি করে। সেটা হচ্ছে বুদ্ধদেব বসু ছন্দ এবং মিল যেরকম যেরকম ভাবে কবিতায় রয়েছে, সেটাকে আদ্যন্ত অনুসরণ করতেন। ওইটায় ক্ষতি হয়ে যায়। তুমি অনুবাদ কবিতায় যদি মিল দিতে যাও, তাহলে ক্ষতিই করবে। মূল থেকে সরে যাবে।
অনিমিখঃ একেবারে মূলানুগ হলেও ব্যাপারটা শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে যায়…
জয়ঃ হ্যাঁ, তা ঠিক।
অনিমিখঃ আমি এখন কিছু কিছু অনুবাদ করার চেষ্টা করি। আমি এই দু’এর মধ্যপন্থা অবলম্বন করার কথা ভাবি আরকি। যেখানে মনে হচ্ছে, মূল ভাবটা পড়ে, সে যদি আমার ভাষায় লিখত… কাঠামোটা ঠিক রেখেই… হয়ত এমন একটা এক্সপ্রেশান রয়েছে, যা ওই ভাষাতেই মানাচ্ছে। তখন আমি ভাবি তার ওই যে মনটা আছে, সেই মনটা যদি আমার ভাষায় ধরা যেত, তাহলে এক্সপ্রেশানটা কিরকম হত? অর্থাৎ আমিই আমাকে খানিকটা…
জয়ঃ এগিয়ে দেওয়া?
অনিমিখঃ হ্যাঁ… প্রয়োগ করলাম। এক্ষেত্রে ট্রানশ্লেট না বলে ট্রানসক্রিয়েট বলা ভালো।
জয়ঃ ট্রানসক্রিয়েট বলা ভালো, ঠিক। বুদ্ধদেব বসু যে বোদলেয়ারের অনুবাদ করেছেন, তা ট্রানসক্রিয়েশানই।
সঙ্ঘমিত্রাঃ ভূমিকা…
জয়ঃ হ্যাঁ… ভূমিকা, তারপর ওই যে টীকা, ব্যাখ্যা, জীবন সম্পর্কে লেখা…
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ… দারুণ। পড়তে খুব ভালো লাগে।
জয়ঃ আর মনে হয়, একটা উপন্যাস পড়লাম যেন।
সঙ্ঘমিত্রাঃ হ্যাঁ
জয়ঃ অথচ এটা সত্য ঘটনা!
অনিমিখঃ প্রসাদগুণ মারাত্মক!
জয়ঃ হ্যাঁ? মারাত্মক!
(খানিকক্ষণ থেমে)
আমার কিন্তু সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা খুব ভালো লাগে।
অনিমিখঃ আমাদের বাংলা কাব্যজগতে এটা কোনও গলদ কিনা জানিনা, সবাই খুব তীব্রভাবে সিগনেচার খুঁজতে চায়। কোনও কবির ধরনটিকে যেন বুঝে নেওয়া যায়! যেন একটা কোনও স্বতসিদ্ধ স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেওয়া যায়। না দিতে পারলে খুব অস্বস্তি পাঠকের।
জয়ঃ খুব মুশকিলের ব্যাপার।
অনিমিখঃ সেই যে আগে কেউ কেউ চিঠি লিখে জানাত সতীর্থরা, বা কোনও সভায় দেখা হলে নিশ্চয়ই আলোচনা হত কবিতা নিয়ে, এগুলো কি মিস করেন?
জয়ঃ না না না… মিস করি না। ওগুলো সময়ের অপব্যবহার। কারণ যে জিনিষটা নিয়ে এতগুলো বছর রয়েছি, সেই জিনিষটাই বুঝতে পারি না! ওই যে বললাম যে লেখাটা সতেরো লাইনে শেষ হবে না পঁয়তাল্লিশ লাইনে গিয়ে পৌঁছবে, এটাই বুঝতে পারি না আমি! তখন আর সেটা নিয়ে বন্ধুবৃত্ত গড়ে তুলে লাভ কী? বরং নিজেই একটু চেষ্টা করা ভালো। নিজে চেষ্টা করলে তাও সময়টার একটা সদব্যবহার হয়।
অনিমিখঃ বন্ধুতার একটা অন্য দিকও আছে…
জয়ঃ না, যুগে যুগে, দেশে দেশে বন্ধুবৃত্ত গড়ে উঠেছে। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, পশ্চিমবঙ্গে তো হয়েইছে…
অনিমিখঃ প্যারিসে খুব বেশি…
জয়ঃ প্যারিসে হয়েছে, আমেরিকায় হয়েছে। বিট জেনারেশান যেমন। আমাদের এখানে যেমন কৃত্তিবাস ছিল, যেমন ‘কবিতা’ ছিল…
সঙ্ঘমিত্রাঃ ‘পরিচয়’ ছিল…
জয়ঃ ‘পরিচয়’ ছিল… একটা কাগজকে ঘিরে কয়েকজন কবির একটা বন্ধুবৃত্ত গড়ে উঠত।
অনিমিখঃ কৃত্তিবাসে আপনি সেভাবে যান নি কখনও?
জয়ঃ কৃত্তিবাসে রাণাঘাট থেকে ডাকে পাঠানো লেখা আমার দু’বার ছাপা হয়েছিল। একবার ‘৭৫ সালে, একবার ‘৭৭ সালে।
অনিমিখঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে যে একটা…
জয়ঃ আমি যখন ‘দেশ’ পত্রিকায় চাকরি করতাম, তখন ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। তখন তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি আর সুনীলদা একই ঘরে বসতাম। তবে রোববারে সকালের দিকটায় কখনও যাই নি। আমি যেতাম সন্ধেবেলা। ওঁর সঙ্গে অফিস ফেরত চলে যেতাম। উনি বলতেন—কি তুমি এককাপ চা খেয়ে যাবে নাকি? তখন ওঁর সঙ্গে উপরে উঠে গেলাম।
অনিমিখঃ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নাকি বলেছেন যে, ফেসবুক ক্রিয়েটিভ সলিচ্যুড নষ্ট করে দিচ্ছে।
জয়ঃ তা তো বটেই…
অনিমিখঃ কিন্তু এটাকে তো বাদ দেওয়াও যাবে না।
সঙ্ঘমিত্রাঃ কিছু ভালো দিকও আছে।
অনিমিখঃ তা আছে। যেমন আমি অন্যভাষা থেকে যে অনুবাদ করি, তার যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। অনুবাদের আগে আমি সেই কবির সঙ্গে কথাবার্তা বলি কিছুটা, যদি দেখি তাঁর সঙ্গে আমার ভাবনার কিছুটা সাযুজ্য পাচ্ছি, তবেই এগোই। এই যোগাযোগটা ফেসবুক আমাকে সাহায্য করছে।
জয়ঃ তা ঠিক।
অনিমিখঃ সম্প্রতি ইতালিয়ান কবিদের নিয়ে কিছু কাজ করছি। আমি ইংরেজি থেকেই করছি। সেখানে একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম তাঁরা ধরা যাক, প্যারিস হামলা নিয়ে কবিতা লিখছেন, বা সাম্প্রতিক কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে, হয়ত অভিবাসন সমস্যা নিয়ে, ইতালির সরকার খুব অপ্রেসিভ সরকার, এখন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কেউ লিখছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তাঁরা কিন্তু বিবৃতিধর্মী লেখা লিখছেন না সেই প্রতিবাদী লেখা লিখতে গিয়ে। সেই কবিতায় সংকেত থাকছে। অর্থস্তর থাকছে। এক্সপ্রেশানে নানা মোচড় থাকছে।
জয়ঃ বাহ, খুব ভালো। খুব ভালো। তুমি এগুলো অনুবাদ করছ?
অনিমিখঃ হ্যাঁ, করছি…
জয়ঃ বই করে বার করো। যাতে সামগ্রিক রূপটা আমরা পাই।
অনিমিখঃ আপনার লেখালিখিকে রাণাঘাটের সবাই কিভাবে নিতেন?
জয়ঃ আমি ‘দেশ’ পত্রিকায় যে লেখালিখি করতাম, সেটা কেউ জানত না। প্রথমবার যখন আনন্দ পুরস্কার পেলাম, তখন সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে আমার বাড়ির উঠোন জনাকীর্ণ হয়ে গেল। সবাই দেখতে এসেছে যে, এই লোকটাই আমি কিনা! তখন কাগজের প্রথম পাতায় ছবি বেরিয়েছিল। ওইটা নিয়ে আমার একটা কবিতা আছে—‘আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো’। সবাই এসে তখন জিজ্ঞেস করতে লাগল— তুই লিখতিস? তুই লিখিস? তুমি লিখতে? তাই নাকি? আমি জানতাম না তো! তুমি কতদিন হ’ল লেখ?… তখন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল। কারণ, আমি তো শুধু ঘুরে বেড়াতাম, আর তো সেভাবে কেউ কিছু দেখত না। বেকার ছেলে ঘুরে বেড়ায় চুপচাপ… এই আরকি। হঠাৎ একদিন কাগজে ছবি দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। আমার বাড়ির উঠোন জনাকীর্ণ হয়ে গেল। সে এক আশ্চর্য দিন ছিল! এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম যে কী বলব!
অনিমিখঃ যেন একটা গোপন ঘরের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল!
জয়ঃ হ্যাঁ…
অনিমিখঃ তারপরে সবাই যখন জেনে গেল, তারপরেও তো আপনি কিছুদিন রাণাঘাটে ছিলেন?
জয়ঃ তারপরেও আমি কিছুদিন ছিলাম।
অনিমিখঃ তখন কি লোকে বিস্ময়ের চোখে তাকাত?
জয়ঃ তখন আর কোনও প্রতিরোধ সহ্য করতে হয় নি। মানে, সাধারণ লোকের কাছ থেকে আরকি। কিন্তু ইতিমধ্যে কবিরা আমাকে ত্যাগ করল। কবিদের সঙ্গে যতটুকু যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল… ত্যাগ করতে লাগল। আনন্দ থেকে বই বেরনোর পরেই ত্যাগ করেছিল। ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা?’ যখন বেরলো, তখন থেকেই ত্যাগ করল।
তবে ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার সবসময় ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি হয়ত চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ওঁর বাড়িতে আর যাওয়া হত না। কিন্তু উনি বইমেলায় বা কোথাও দেখা হলে সবসময় ভালো ব্যবহার করতেন। ওঁর ব্যবহারে আমি কখনও কোনও মালিন্য দেখিনি। সেটা অবশ্য ফেসবুক যুগের অনেক আগেকার কথা।
খুব ভালো লাগল। চমৎকার একটি সাক্ষাৎকার।
ধন্যবাদ!
খুব ভালো ও উপকারী লাগল … ধন্যবাদ
ধন্যবাদ জানবেন।
এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি পড়ানোর জন্য দুনিয়াদারীকে ধন্যবাদ। অনেক বিষয় জানা গেলো। কবিতার সাথে সময়, মনোনিবেশের প্রাসঙ্গিকতা, অন্য কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ, কবিতার বিরূপ জগৎ, এবং লেখায় ব্যক্তি জীবনের প্রতিফলন এসব বিষয় হয়তো অনেকভাবেই পড়েছি কিংবা পড়িইনি, কিন্তু এখানে দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়লাম। বোধহয় আরো অনেকবার এ সাক্ষাতকারটির কাছে আসবো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দুর্জয়!
অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ! আগেও কবির সাক্ষাৎকার পড়েছি, এমন মনোগ্রাহী খুব কমই পড়েছি।
ভালোলাগা জানবেন।
ওনার প্রত্যেকটি উত্তর থেকেই মনে হয় কিছু শিখতে পারলাম। ফেসবুক আর একদম তরুণতম কবিদের জন্য যা বলেছেন তা অসামান্য। বই বা লেখার পরিমাণ এতো বেশী হওয়ার জন্য সামগ্রিক একটা ফ্রেমে ওনাকে ধরা যায় না বাকিদের মতো। এই সাক্ষাৎকার টা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক ধন্যবাদ!
অসামান্য। তুলোনাহীন।
অনেক ধন্যবাদ দীপ।
ভালোবাসা অনিমিখ ও সঙ্ঘমিত্রা কে ,সাক্ষাৎকারের গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক ক্লাসিক আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।পড়তে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে,এরকম কিছুই চাইছিলাম।অনবদ্য কাজ।আমাদের ভাবনাকে অনেকটা এগিয়ে রাখছে দুনিয়াদারী।কেয়া বাত।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বরাবর দুনিয়াদারির সঙ্গে থাকবেন, এই প্রত্যাশা।
অসম্ভব ভাল সাক্ষাৎকার।
অনেক ধন্যবাদ।
দুর্দান্ত এক সাক্ষাৎকার।
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি সাক্ষাৎকার। মনের অনেক প্রশ্ন, অনেক দ্বন্দ্ব দূর করলো। এতো বিস্তারিত এবং সুপঠিত সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্যে দুই কবিকে অজস্র ধন্যবাদ 🙂
জয় গোস্বামীর এমন রসগ্রাহী সাক্ষাৎকার আগে পড়েছি মনে পড়ছে না। খুব ভালো ভালো প্রশ্ন করে অনেক বেশি জানার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তার ফলে শুধু কাষ্ঠল আলাপ হয়েছে বলব না, কথায় সুন্দর ভাব ছিল। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত উপভোগ করলাম।
Sakkhatkarti eman aanek bishoy tule enache ja amader kabita samparkito aaro gabheer bhabnake
ushke dai. Team Duniyadaari ke antarik abinandan.