বিশ্বদীপ দে

গল্পের বাড়ি

এ বাড়ির গল্প আমাকে লিখতে হতই। আজ না হোক কাল। যদিও গল্পের আসল লেখক আমি নই। আমার ঠাকুরদা বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। আর এগুলো আসলে গল্পও নয়। সত্যি ঘটনা। কিন্তু কে না জানে সময়ের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসতে আসতে যে কোনও সত্যির গায়েই গল্পের মুচমুচে সোনালি রং এসে লাগে।

খুব ছোটবেলা থেকেই গল্পগুলো আমাকে বলত দাদু। মানে যখনই আমাকে পেত। গরমের ছুটি, পুজোর ছুটিতে আমি আমাদের মছলন্দপুরের পুরোনো বাড়িতে যেতাম। কবেকার এক জীর্ণ বাড়ি। মস্ত মস্ত অনেকগুলো ঘর, প্রশস্ত রোয়াক, উঠোন। বাড়ির থেকে দূরে কুয়োতলা। আসলে কুয়ো নয়, ইঁদারা। পরিত্যক্ত গোয়ালঘর। পিছনদিকে একটা পুকুরও ছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ততদিনে সেটা কচুরিপানায় ভরে গেছে।

আমাকে পেলেই দাদু তার গল্পের ঝুলি খুলে বসত। শুধু গল্প নয়, গল্প বলার সময় দাদুর অভিব্যক্তিগুলোও আমার মুখস্ত হয়ে যেত। মান্ধাতার আমলের পুরোনো এই বাড়ির রোয়াকে বসে শেষ বিকেলের আলোয় দেখতাম, দাদুর মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে নরম আলোছায়ার জাফরি।

সামান্য থেমে থেমে দাদু উচ্চারণ করত, ‘সবাই বলত, ওই পুকুরধারের তেঁতুল গাছটায় ভূত থাকে। আমরা সবাই জানতাম। তাই খুব দুপুরে কিংবা রাতের বেলায় ওদিকে কারও যাওয়া বারণ ছিল। কিন্তু আমি তখন ছোট, আমার সবেতেই কৌতূহল। মাঝে মাঝে আমি একলা গিয়ে তেঁতুল গাছের তলায় বসে থাকতাম। বিশেষ করে দুপুরবেলায়। এমনিতেই লোকে বলে, ভন্যি দুপুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা। তা আমাকে কিন্তু কেউ কোনওদিন ঢিল ছুড়ে মারেনি।’

—তার মানে ভূত ছিল না?

আমার বালক-কণ্ঠের আকুলতায় দাদু হাসতেন। বলত, ‘সন্ধে হয়ে আসছে, তোমার ভয় করবে না তো?’ আমি ঘাড় নাড়তাম। যদিও চারপাশের নিভে আসা আলোয় আশপাশের কতরকম আলো-আঁধারির মধ্যে বসে গা ছমছম করত। প্রাচীন বাড়িটার ভাঙাচোরা শরীরের ভেতর থেকে একটা আতঙ্ক চোরা ঘূর্ণির মতো আমার শরীরে পাক খেয়ে যেত। তবুও আমি দুদিকে ঘাড় নাড়তাম, ‘নাহ্‌। ভয় করবে না। তুমি বলো।’

দাদুর কণ্ঠস্বর ঘন হয়ে আসত, ‘ঢিল না মারলেও তাকে আমি অনুভব করেছি, জানো? মাঝে মাঝেই দেখতাম, চারপাশে কোনও হাওয়া নেই। কিন্তু গাছের শরীর লুটোপুটি খাচ্ছে হাওয়ায়! যেন একটা ঝড়কে কেউ ওই গাছের পাতায় বন্দি করে রেখেছে। তুমিই বলো, কিছু যদি না-ই থাকবে, তাহলে অমন হাওয়া দিত কেমন করে?’

আমি দাদুর গা ঘেঁষে আসতাম, ‘থাক থাক, আর বলার দরকার নেই।’

শুনে হো হো করে হেসে উঠত দাদু, ‘খুব যে বললে ভয় করবে না?’ তারপর সামান্য থেমে সস্নেহে বলত, ‘আচ্ছা থাক, তাহলে আমি তুতু-ভুতুর গল্প বলি শোনো।’

—তুতু-ভুতু? তারা আবার কারা?

—দুটো ইয়াব্বড় কাতলা মাছ। আমার বাবা পুষেছিলেন মাছদুটোকে। ওদের জন্য রুপোর নথ গড়ে দিয়েছিলেন। আমি তখন তোমার মতোই ছোট। বাবার সঙ্গে মাছকে খাওয়াতে যেতাম। যেদিন বাবা ব্যস্ত থাকতেন, সেদিন আশুকাকা, এবাড়ির কবেকার কাজের লোক, তিনি যেতেন। বাবার কড়া নির্দেশ ছিল, তুতু-ভুতুকে খেতে না দিয়ে কেউ খেতে পারবে না।

—ওরা খেয়ে যেত?

—যেত তো। বিশেষ করে বাবার ডাকে তো একবারেই ছুটে আসত। বাবা জলের ওপরে হাত রেখে অদ্ভুত কায়দায় ডাকতেন ওদের। ওরা এসে বাবার হাত থেকে ভাত খেয়ে যেত। তারপর জলের ছায়ায় ওদের কাঁপা কাঁপা শরীরগুলো আবার ভুস করে ডুব দিত জলের গভীরে।

—সত্যি?

আলতো হেসে উঠে পড়ত দাদু। আমি বুঝতে পারতাম, এখন আর গল্প বলবে না মানুষটা। একটানা গল্প বলতে ভালোবাসত না দাদু। হয়তো হাঁপিয়ে যেত। কিংবা স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ত।

আবার পরে নিজের ইচ্ছেমতো কোনও একটা গল্পকে মনের কোণের তাক থেকে ঝেড়েঝুড়ে আমার সামনে নিয়ে আসত। এভাবেই শেষ বিকেলের আলোয় রোয়াকে বসে, খুব ভোরে উঠে বাগানে ঘুরতে ঘুরতে, রাত্রিবেলায় শুয়ে শুয়ে গল্পগুলো বলত দাদু।

কিন্তু একটা মানুষের স্টকে আর কত গল্প থাকতে পারে? কাজেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্প রিপিট হতে লাগল। যদিও আমি কোনওদিন সেটা দাদুকে বুঝতে দিতাম না। কোনওভাবেই চাইতাম না, দাদুর গল্প বলার গতিটা রুদ্ধ হোক। আসলে ছোট্টবেলা থেকে ওইসব গল্প শুনতে শুনতে আমার মধ্যে সেগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল। মনে হত, ওগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাই বারবার শুনলেও পুরোনো হত না।

আমার মামাবাড়ির দাদু বা আরও অনেককেই তাদের ছোটবেলার গল্প করতে দেখেছি। কিন্তু কারওরই দাদুর মতো গল্প বলার টেকনিক জানা ছিল না। দাদুর মধ্যে আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। গলার স্বরের প্রক্ষেপে উঁচু-নিচু নানা ঢেউ তুলতে জানত দাদু।  হাত দুটোকে মাঝে মাঝে গল্প বলতে বলতে মুখের সামনে নিয়ে আসত। গল্পের গতি অনুযায়ী কখনও আমার কাছে ঝুঁকে পড়ত, কখনও যেন একটু দূর থেকে বলত গল্পগুলো। সব মানুষের এই ক্ষমতা থাকে না। দাদুর ছিল। গল্পকে চোখের সামনে নিয়ে আসতে পারার ক্ষমতা। নইলে এমনিতে আমার দাদুর চেহারা এমন কিছু ইমপ্রেসিভ ছিল না। সাধারণ মাঝারি উচ্চতা। ঈষৎ চাপা গায়ের রং। কেবল চোখদুটো ছিল খুব তীক্ষ্ণ। গল্প বলতে শুরু করলেই মানুষটার কণ্ঠস্বর যেন চুম্বক হয়ে উঠত। আর চোখ দুটো আরও গভীর। সেই চোখের অতলান্ত কিনারায় ভেসে উঠত গল্পের ছায়া।

শুধু আমরাই যেতাম না, মাঝে মাঝে দাদুও আসত আমাদের বাড়িতে। লক্ষ করতাম, আমাদের টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে এলে দাদু গল্প বলতে চাইত না। খুব জোর করলে অবশ্য বলত। কিন্তু সেই গল্প যেন ঠিক জমত না। এখন বুঝি, ওই পুরোনো বাড়ির ব্যাকগ্রাউন্ডও দাদুর গল্পগুলোকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে সাহায্য করত। গল্প শুনতে শুনতেই চোখ চলে যেত এ বাড়ির পুরোনো কড়ি-বড়গা, লম্বা লম্বা জানলার শিক, সামান্য দূরের ইঁদারা, পরিত্যক্ত গোয়াল ঘর কিংবা চারপাশের গাছগাছালির দিকে। দেখতে দেখতে ভূতুড়ে তেঁতুল গাছের রহস্যময় হাওয়ায় আমার চুল এলোমেলো হয়ে যেত। স্পষ্ট শুনতে পেতাম জলের মধ্যে ভুউ-উ-শ শব্দ করে ডুব দিচ্ছে তুতু-ভুতু। দু-এক ফোঁটা জলের ছিটেও যেন আমার কপালে এসে লাগত।

দাদু যে কেবল ফ্যান্টাসি গল্প বলত তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝেই আশ্রয়প্রত্যাশী আত্মীয়রা এসে জুটত এ বাড়িতে। তাদের কথাও বলত দাদু। ‘কত লোকের যে আনাগোনা ছিল এ বাড়িতে। এমন তো নয়, আমরা বিরাট বড়লোক ছিলাম। বাবার ব্যবসায় ওঠাপড়া লেগেই থাকত। তবু কাউকে কোনওদিন ফেরাননি তিনি। কত আত্মীয়স্বজনের ছেলেপুলেরা এবাড়িতে থেকে পড়াশুনো করত। কত মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এ বাড়িতে নিয়ে এসে। মেয়ের বাবা তার যতটুকু সাধ্য করেছে, বাকিটা বাবাই করে দিত। পরে বড় হয়ে আমিও চেষ্টা করেছি, যার জন্য যতটুকু করা যায়। তোর বাবা-কাকাদের সঙ্গে তারাও পরিবারের একজন হয়ে থাকত।’

চরিত্রের অভাব ছিল না দাদুর গল্পে। এইসব গরিব আত্মীয়রা, তাদের ছেলেমেয়েরা দাদুর গল্পে ভিড় করে থাকত। শুনতে শুনতে সেই মানুষগুলোর সঙ্গে আমারও পরিচয় হয়ে যেত। তিনবারেও ম্যাট্রিক পাশ করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল অনন্ত সাহা, দাদুর মামাবাড়ির তরফের এক আত্মীয়। ওই ভূতুড়ে তেঁতুল গাছেই গলায় দড়ি দিতে গেছিল সে। শেষমেশ কে যেন দেখে ফেলে তাকে। পরের বছর সে পাশ করে। তারপর চাকরিও পেয়ে যায় কোন এক কারখানায়। যাওয়ার আগে দাদুর বাবার পায়ে ধরে কেঁদেছিল সে। বলেছিল, ‘আপনি না থাকলে কোথায় যে ভেসে যেতাম!’ দাদুর বাবা বলেছিলেন, ‘কোন চুলোয় আর যেতে। সিধে গিয়ে নরকে উঠতে। আর কক্ষনো জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবো না।’ বলতে বলতে দাদুর গলা ধরে আসত যেন, ‘খুব মনে আছে অনন্তদার মুখখানা। অথচ পাশ দেওয়ার পরে সেই যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, আর তো ফিরে আসেনি। কতবছর আগে দেখা, তবু স্পষ্ট মনে আছে। যেদিন আত্মহত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়ল, সেদিন ওর ওই থরথর করে কাঁপতে থাকা মুখটা আমি কোনওদিন ভুলব না।’

এরকমই কত চরিত্র! দাদুর গল্প বেয়ে এরা আবার এসে নামত পুরোনো এই বাড়ির উঠোনে। পা সামান্য খুঁড়িয়ে চলত আলপনা। দাদুর মাসতুতো বোন। তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। অথচ তাদের নিজেদের বাড়ি নেই, ভাড়াবাড়িতে থাকে। ‘তাই বিয়ে হয়েছিল এই বাড়িতেই। উঠোনের ওই দিকটায়।’ দাদু আঙুল দিয়ে দেখাতেন। ‘বিয়ের দিন গণ্ডগোল হয়েছিল তুমুল। বরকর্তা ছেলের বড়জ্যাঠা। তাঁর দাবি, মেয়ে খোঁড়া, এইটুকু পণে হবে না। আরও চাই।’ শেষমেশ দাদুর মধ্যস্থতায় বিয়েটা হয়েছিল। ‘সেই থেকে আলপনার আমার প্রতি ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল। প্রত্যেক বছর লক্ষ্মীপুজোর সময় এবাড়িতে আসত। কোথায় পুজো হত জানিস তো?’

বলতে বলতে দাদু পুজোর গল্পে ঢুকে পড়ত। আমার নাকে ধুপধুনোর গন্ধ এসে লাগত। ‘আলপনা প্রত্যেকবার আসত। ওর মা, মানে আমার মাসিও আসত। মাসি রোগা হলে কী হবে, পুজোর ভারী ভারী বাসনকোসন কী অনায়াসে নাড়াচাড়া করত!’

বাসনগুলো আমি দেখেছি। পুজোর ঘরও। কিন্তু সেখানে বসে পুজোর জোগাড় করত যারা, আলপনা দিত, ছোট ছোট লক্ষ্মীর পা আঁকত তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিত দাদু। তারা আমার চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে উঠত। ততদিনে আমি বড় হচ্ছি। দাদুর খুড়তুতো বোনের প্রেমে পড়ে যেতাম তার বর্ণনা শুনে।

‘একঢাল চুল ছিল ফুলির মাথায়। তার সঙ্গে অমন ফুটফুটে গায়ের রং! দারুণ গানের গলা ছিল জানিস। খুব সাধারণ গানও তার গলায় এমন আশ্চর্য খুলত, ভাবতে পারবি না। খুব ইচ্ছে ছিল রেডিয়োয় গান গাইবে, রেকর্ড বার করবে। যদিও সেসব হয়নি। সতেরোতেই তো বিয়ে হয়ে গেল অচিন্ত্যদার সঙ্গে। তবে গানের অভ্যেসটা ও ছাড়েনি। এলেই গান শোনাত।’ শুনতে শুনতে সেই অদেখা কিশোরীর অশ্রুত গানের কলি আমার মাথার মধ্যে বেজে উঠত।

এমনি সব গল্প। শুধু মানুষ নয়, জন্তু-জানোয়ারের গল্পও। জন্ম থেকে যে গোয়ালঘরকে আমি দেখেছি পরিত্যক্ত, সেখানেই একসময় থাকত কমলা। দুধ-সাদা রঙের একটা গোরু। তার আয়ত চোখের গভীরতার কথা বলার সময় নরম হয়ে যেত দাদুর কণ্ঠস্বর, ‘কী মায়া যে ছিল ওই অবলা জীবটার চোখে। দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যেত। আমরা ভাইবোনেরা যখনই ওখানে যেতাম, ওর গলকম্বলে হাত বুলিয়ে দিতাম। কী আরাম পেত, ভাবতে পারবি না। আমাদের আদর পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত।’ গল্প শুনতে শুনতে আমি স্পষ্ট শুনতে পেতাম, অন্ধকার গোয়ালঘর থেকে ভেসে আসছে, গরুর সুগম্ভীর হাম্বা ডাক।

দাদু বলতেন, ‘কমলার মতো গোল্লা-ফুটকিকেও আমরা খুব ভালোবাসতাম। তবে সে আরেকটু পরের কথা। তদ্দিনে তোর বাবা-কাকারা সব হয়ে গেছে। কোত্থেকে যে এসেছিল বেড়ালদুটো! আমাদের পাঁচিলের ওপরে এসে বসেছিল। মাসদুয়েক বয়স হবে বড়জোর। সেই থেকে এ বাড়ির বাসিন্দা। মনে আছে, তোর বাবা যখন প্রথমবার চাকরি পেয়ে বাড়ি ছেড়ে মজফফরপুরে যাবে, সেদিন ওর পায়ে এসে মাথা ঘসতে লাগল ফুটকি। ভাবটা এমন, যেও না। সেই দেখে তো তোর পিসি-কাকা-ঠাম্মার কান্না আরও বেড়ে গেল।’

দাদুর বলার ভঙ্গিটাই এমন, যে কোনও ঘটনাকে প্রজেকটর মেশিনে চাপিয়ে দিতে পারত। ‘তখন তোর বাবার বয়স কত, বড়জোর কুড়ি-একুশ। তোর মেজকা, ছোটকারা তখনও স্কুলে…’ দাদু বলছে আর আমি দেখতে পাচ্ছি দৃশ্যটা। ওই সময়ের বাবার চেহারাটা আমাদের অ্যালবামে দেখেছি। পাতলা সরু একটা শৌখিন গোঁফ। বেশ নায়কোচিত ভঙ্গিতে রাখা চুল, বড় ঝুলপি। বাবা বসে আছে মাথা ঝুঁকিয়ে। জুতোর ফিতে বাঁধা থামিয়ে বকছে ফুটকিকে। কিন্তু অভিমানী ফুটকি সেই বকুনিকে পাত্তা না দিয়ে মাথা ঘষছে বাবার বেল বটম প্যান্টের ঘেরে। পাশ থেকে দাদুও ধমক দিচ্ছে, ‘অ্যাই ছাড়, অমন করিস না। ও কি একেবারে চলে যাচ্ছে নাকি?’

বাবা কিন্তু ওই বাড়িতে আর পাকাপাকিভাবে ফেরেনি। মানে ফিরতে পারেনি। চাকরির কারণেই ঘুরে বেরিয়েছে বাইরে বাইরে। ঘুরতে ঘুরতেই বিয়ে। তারপর আমার জন্ম। এরপর কলকাতায় দু-কামরার ফ্ল্যাট। বাবা আর ফিরতে চায়নি।

দাদুর গল্পটা অবশ্য সেই সময়ের থেকে খুব বেশি সামনে আর এগোত না। কারণ পিসির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, ছোটকাও চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে গেল। এখন তো লন্ডনে। দাদুর ভাইরাও একে একে কবেই কেটে পড়েছিল। ফলে বাড়িটা ক্রমশ ফাঁকা হতে শুরু করেছিল। নিঃসন্তান মেজকা-মেজোকাকিমা আর ঠাম্মা। তারপর তো ঠাম্মাও চলে গেল অকস্মাৎ সেরিব্রাল স্ট্রোকে। আমি তখন থ্রিতে পড়ি।

এইসময় থেকেই আস্তে আস্তে দাদু তার গল্পগুলো আমাদের শোনাতে শুরু করে। তবে সত্যি বলতে কি, আমি ছাড়া অন্য কোনও ভাইবোন কিন্তু এই সব গল্পে কোনওদিন মজা পেত না। ওই তেঁতুল গাছের ভূত-টুত তবু ঠিক আছে। এর বেশি অন্য গল্পে তাদের মন ছিল না। তারা রূপকথার গল্প বা আরও অন্য গল্প শুনতে ভালোবাসত। দাদু সেসবও বলত, তবে কম। বলতে বলতে বাঁক নিয়ে আবার ঢুকে পড়ত এবাড়ির গল্পে।

ফলে ক্রমে দাদুর গল্পের শ্রোতা কমে যেতে লাগল। কিন্তু আমি কখনও দাদুর গল্পকে ছাড়তে পারিনি। একেক সময় বাবাও রেগে যেত। ‘কী এত বকাচ্ছিস বাবাকে! সারাক্ষণ কথা বলতে ভালো লাগে মানুষের!’ আসলে এ ছিল চোরা আক্রমণ, যার আসল লক্ষ্য ছিল দাদু। বাবা বহুদিন ধরেই চাইত, এ বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে দাদুকে কলকাতায় নিয়ে আসতে। মেজকা-মেজোকাকিমারাও চাইত। এবাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে কোনও ফ্ল্যাট-ট্যাটে উঠে যাওয়ার ইচ্ছে ওদের। দাদুকে বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে যেতে দিতে ওদেরও কোনও আপত্তি ছিল না।

সারাক্ষণ বুড়ো মানুষটা পুরোনো সময় আঁকড়ে পড়ে থাকুক, এটা বাবার পছন্দ ছিল না। সাধারণত এই সব নস্টালজিয়ায় বাবার অতটা উৎসাহ থাকত না। নইলে এ বাড়িতে জীবনের অতগুলো বছর কাটানোর পরেও বাবার স্টকে দু-একটার বেশি ছোটবেলার গল্প কোনওদিন শুনিনি।

সব মানুষ অতীতগামী হয় না। আমার অন্য খুড়তুতো ভাই-বোনেরাও আদ্যিকালের এই বাড়ি নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না। কিন্তু আমি দাদুর গল্পগুলোকে গ্রহণ করেছিলাম পরম আদরে। যে বাড়িতে কেবল বছরে দু-চারদিন বেড়াতে আসা ছাড়া আমার কোনও যোগ নেই, সেই বাড়িকে নিয়ে আমি মাঝেমধ্যে স্বপ্নও দেখতাম। স্বপ্নের ভেতরে অচেনা কিশোরীর গান ভেসে আসত। গোরুর নরম চোখের কাজলঘন মায়ার আবেশ লেগে থাকত। এক অদেখা সময় এসে পরম আহ্লাদে মাথা ঘষত আমার শরীরে। আরও কত কী দেখতাম। বছরের পর বছর ধরে শুনতে শুনতে আমার মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল আমার দাদুর বাড়ির একটা আস্ত রেপ্লিকা।

এ বাড়ির গল্প তাই আমাকে লিখতে হতই। আজ না হোক কাল। যদিও গল্পের আসল লেখক আমি নই। তবু আমি ছাড়া আর কেউ তো এ গল্প কখনও লিখত না।

অদিতি গল্পগুলো আগেও শুনেছে আমার কাছে। আমার বেশ কিছু গল্প বিভিন্ন জায়গায় ছাপা হওয়ার পরে ওই প্রথম বলল, ‘কী সব বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখছ। তোমার দাদুকে নিয়ে একটা গল্প লেখো। তোমার দাদু আর তোমাদের মছলন্দপুরের বাড়ি।’

ও বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মাথায় বিদ্যুচ্চমকের মতো একশো বছরের পুরোনো বাড়িটা তার অজস্র স্মৃতির সম্ভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনে হল, তাই তো। ও বাড়ির গল্প তো আমাকেই লিখতে হবে। এতদিন কেন লিখিনি!

জানতাম কাজটা খুব কঠিন। এতদিন ধরে শোনা এতগুলো গল্প, সেখান থেকে বাছাই করে কিছু কিছু ঘটনা রাখতে হবে। আর পুরো গল্পেরই প্রোটাগনিস্ট হিসেবে থাকবে দাদু। সারাজীবন এই বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছে মানুষটা। আজ বিরানব্বই বছরে পৌঁছে, যখন স্মৃতির ভেতরের সব ডালপালা কুড়ে কুড়ে খেয়ে নিয়েছে পার্কিনসনস ডিজিজ নামের বিচ্ছিরি এক অসুখ, তখনও কি মনের চোরা অন্দরে পোকায় কাটা গল্পের পাতার দু-চারটে অক্ষর মাঝে মাঝে জেগে ওঠে না চেতনায়?

এই দ্বন্দ্ব আর মনখারাপ নিয়েই লেখাটা গড়ে উঠেছিল। শেষ হওয়ার পরে অদিতি বা অন্য যাদেরই শুনিয়েছিলাম, সবারই ভালো লেগেছিল। ফলে ভরসা করে লেখাটা পাঠিয়ে দিলাম ‘মনোভূমি’ পত্রিকায়।

এর আগে আমার দুটো গল্প ওই পত্রিকা থেকে ফেরত এসেছে। কিন্তু আমার মন বলছিল, এই গল্পটার জোর অনেক বেশি। এটা সম্পাদকদের ভালো লাগবেই।

এবং আমি মোটেই ভুল ভাবিনি। মাসদুয়েকের মধ্যেই গল্পটা মনোনীত হয়ে যাওয়ার ফোন পেলাম। পাঁচ মাসের মাথায় ছেপে বেরোল গল্পটা।

বিখ্যাত পত্রিকায় গল্প বেরোনোর প্রতিক্রিয়াটা টের পেলাম এবার। ফোন, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক সর্বত্র মানুষ তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা জানাতে লাগল। অন্য আরও দুয়েকটা নামী জায়গা থেকেও লেখার জন্য বলল। কি-বোর্ড পেষা কেরানি থেকে রাতারাতি যেন আমি লেখক হয়ে উঠলাম।

গল্পটা বেরোনোর প্রায় তিন মাস পরে দাদু চলে গেল।

ততদিনে দাদু আর কাউকেই চিনতে পারত না। খাওয়া-বাথরুম সব ক্ষমতাই একে একে লোপ পেয়ে বিছানায় মিশে গিয়েছিল শরীরটা। আমি ইদানীং খুব একটা যেতাম না দাদুর বাড়ি। আসলে দাদুকে ওই অবস্থায় দেখতে আমার ভালো লাগত না। তাই আচমকা যখন দেখলাম এতদিন পরে, স্বাভাবিকভাবেই চমকে উঠেছিলাম।

আজ দাদুর শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গ। সারাদিনের ব্যস্ততার পরে এখন এই সন্ধেবেলা নিরিবিলিতে ছাদে বসে আছি। একটা সিগারেট ধরিয়েছি সবে, হঠাৎ ছাদের সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ পেলাম। ঈষৎ টেনে টেনে হাঁটার এই শব্দ আমি চিনি। বাবা আসছে বুঝতে পেরে সিগারেট ছুড়ে দিলাম বাইরের অন্ধকারে।

দু-চারটে সাধারণ কথাবার্তা চলল বাবা আর আমার মধ্যে। নীচে রোয়াকে নানা রকমের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অথচ কাল সকালের মধ্যে এ বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে। খালি মেজকা আর মেজোকাকিমা। এর মধ্যেই শুনলাম দু-একজন প্রোমোটার ঘুরে গেছে। মেজকা একরকম কথাও বলে রেখেছে। আসলে কথা চলছে অনেকদিন ধরেই। তবে শরিকি বাড়ি, বহু লোকের সই লাগবে। সেসব মিটে গেলে হয়তো এ বাড়ি বিক্রির কাজ সারা হয়ে যাবে। কিছুদিনের মধ্যে মেজকাকেই পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে দেওয়া হবে ঠিক হয়েছে, যাতে মেজকাই বাকিদের হয়ে কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

বাড়ি বিক্রি নিয়ে বাবা কিছু কথা বলল। কথা বলল আজকের অনুষ্ঠানের কিছু ব্যাপার-স্যাপার নিয়েও। কিন্তু তবু… আমি বুঝতে পারছিলাম, বাবা আরও কিছু বলতে চায়। কিন্তু কথা সাজিয়ে উঠতে পারছে না। এমনিতেই অন্তর্মুখী মানুষ। কোনওদিনই হইহই করে মনের কথা খুলে বলতে দেখিনি।

—তুমি কি আরও কিছু বলতে চাও?

অন্ধকার ছাদেও বুঝতে পারলাম, বাবা কেমন চমকে উঠল, ‘অ্যাঁ…? হ্যাঁ… ঠিকই ধরেছিস। একবার মনে হচ্ছে, কথাটা তোকে বলি। আবার মনে হচ্ছে থাক।’

—কেন থাকবে কেন? কী এমন কথা? বলোই না…

বাবা তবু সামান্য সময় চুপ করে থাকল। বুঝতে পারলাম, কথা জড়ো করছে। ঠাম্মির ধাত পেয়েছে বাবা। মাথা গুঁজে থাকার অভ্যেস। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ খুলল বাবা, ‘তোর গল্পটা আমি পড়েছি জানিস?’

অবাক হয়ে গেলাম। কই, এটা তো জানতাম না। গল্পটা বেরোনোর পর অদিতি বাবাকে নাকি দেখিয়েছিল পত্রিকাটা। বাবা স্বভাবমতো খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে ফেরতও দিয়ে দিয়েছিল। পড়েছিল বলে তো জানি না। আর যদি পড়েও থাকে, এতদিন পরে জানানোর কারণ কী?

আমি কিছু বলছি না দেখে বাবা বলল, ‘খুব সুন্দর লিখেছিস তুই। দারুণ ফুটিয়েছিস এই বাড়িটাকে।’

বুঝতে পারছি বাবা কেন আজ এই কথাটা বলছে। অল্প কথার মানুষ, খানিকটা নিরাবেগীও। তাই এতদিন বলেনি। কিন্তু আজ দাদু চলে যাওয়ার পর, যখন বাড়িটাও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে… নস্টালজিয়া তো আসবেই। যে বাড়িতে জীবনের এতগুলো বছর কাটল, সেটা নিয়ে স্মৃতিমেদুর হওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বললাম, ‘কিন্তু এই কথাটা বলতে এত হেজিটেট করছিলে কেন?’

বাবা অস্বস্তির হাসি হাসল, ‘না মানে… আরও কিছু কথা আছে…’

—আর কী কথা?

খুব অবাক লাগছে। বাবা এত কিন্তু কিন্তু করছে কেন? আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা তোলপাড় শুরু হল। কী এমন কথা যে বাবা এত দ্বিধা করছে!

বাবা বলতে শুরু করল, ‘তুই যা লিখেছিস তার সবটা সত্যি নয়। এতে অনেক মিথ্যে মিশে আছে।’

‘মানে?’ চমকে উঠলাম আমি, ‘কিন্তু দাদু যা যা বলেছে সবটাই তো আমি… হ্যাঁ, গল্পের খাতিরে কিছু কিছু চেঞ্জ হয়তো… কিন্তু এই গল্পটার ক্ষেত্রে আমি খুব বেশি কিছু বানাইনি।’

এতদিনের চেনা বাবার কণ্ঠস্বরও কেমন যেন ঠেকছিল আমার কানে, ‘না রে বাবান, সবটা তোকে বলেনি বাবা। মানে ঘুরিয়ে বলেছে। সত্যিটাকে গোপন করেছে।’ তারপর একটু নিচু স্বরে বলল, ‘মিথ্যে বলেছে।’

‘মিথ্যে?’ চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।

বাবা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ঠিক মিথ্যে হয়তো নয়, কিন্তু সত্যিটাকে পুরোটা না জানানো আসলে একরকমের মিথ্যে বলা। তোর দাদু তোকে যা যা গল্প বলেছে তাতে অনেক অর্ধসত্য মিশে আছে। যা মিথ্যেরই সামিল। মানুষটা যেমন পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে, তেমনই তার জেদের জন্যে অনেকের জীবনেও নেমে এসেছে অন্ধকার। তুই জানিস, ফুলিপিসির গান গাওয়া হয়নি আমার ঠাকুরদা আর বাবার জন্য? ওরাই জোর করে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। পিসির বাবা, মানে আমার কাকার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না প্রথমে। কিন্তু ভালো পাত্রের লোভ দেখিয়ে তাকে রাজি করানো হয়। যে ঠাকুরঘরের পুজোর গল্প এত শুনেছিস, জানিস বিয়ের পরে সেখানেই আমি ফুলিপিসিকে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুনেছি, বড়দা আর জ্যাঠার জন্যে আমার গানটা শেষ হয়ে গেল! এটা তোকে কোনওদিন বাবা বলেছিল? বলেনি। এরকম আরও আছে।’

কিছু বলতে পারছিলাম না। বাবার এমন কণ্ঠস্বর কোনওদিন শুনিনি। যেন কবেকার জমানো কথা জমে জমে পাথর হয়ে গেছিল। আজ সেই নিশ্চুপ পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে। পাথরগুলো গড়িয়ে আসছে ভারী শব্দ করে। সেই শব্দে আমার চিন্তাভাবনাগুলো ডুবে যাচ্ছিল।

—তুই জানিস, আমি কেন এই বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম?

সামান্য থামল বাবা। যেন দম নিল। তারপর আবার শুরু করল, ‘আমি একজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। সে নিয়ে তোকে বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। শুধু জেনে রাখ, বিয়েটা হয়নি স্রেফ বাবার জেদের জন্য। জাতপাতের দিক দিয়ে তারা আমাদের থেকে নিচু হওয়ায় বাবা আপত্তি তুলেছিল।’

আটষট্টির বাবা আর চল্লিশের আমি মুখোমুখি। তিন বছর আগে মা চলে গেছে। নিঃসঙ্গ এক পুরুষ তার সারা জীবনের নীরবতাকে আচমকাই খুলে দিচ্ছে পরিণত বয়স্ক ছেলের সামনে। মা কি জানত, বাবার জীবনে তার চলে আসাটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট? অ্যাক্সিডেন্ট ঠিক নয়, শ্রী বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের জেদের ফলে আচমকা একটা রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়ে খুলে গিয়েছিল একটা অন্য রাস্তা। সে রাস্তা দিয়েই মা’র প্রবেশ।

কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ। তারপর বাবাই মুখ খুলল, ‘আমি চাইনি তোকে কথাগুলো বলতে। কিন্তু মনে হল সত্যিটা তোরও জানা দরকার। তবে তুই ভাবিস না বাবার ওপর আমার আর রাগ আছে। সেসব রাগ কবে ধুয়েমুছে গেছে। তোর মায়ের সঙ্গে দিনগুলো সুখেই কেটেছে আমার। তবু কথাগুলো তোকে বললাম। আসলে তোর গল্পে তুই বাবাকে কেমন যেন দেবতার মতো করে এঁকেছিস। সেটা অনুচিত। মানুষের মাথায় কখনও জ্যোতির্বলয় আঁকতে নেই…’

বাবা আরও কিছু বলছিল। কিন্তু সেসব আমার মাথায় ঢুকছিল না। শুধু ভাবছিলাম, দৃশ্যটা আমায় লং শটে দেখিয়েছিল দাদু। এখন বাবার কথায় ক্লোজ শটে দেখতে পাচ্ছি। বাবা বসে জুতো পরছে। আর ফুটকি মাথা ঘষছে তার পায়ে। বাবার দু’চোখ ভরা অভিমান।

মাথার মধ্যে এতদিনের গল্পগুলো একসঙ্গে কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। বাবা তখনও বলে যাচ্ছে, ‘ভেবেছিলাম বলব না। কিন্তু ক’দিন ধরেই মনে হচ্ছে, তোর বোধহয় সবটা জানা দরকার… যে সুখী পরিবারের কথা বাবা তোকে বলত, সেটা কিন্তু সেরকম ছিল না মোটেই। আর পাঁচটা বাড়ির মতো এ বাড়িতেও অশান্তি লেগেই থাকত। কত ঝগড়া, কত মনোমালিন্য, মতানৈক্য… শুধু সুখ দিয়ে কোনও বাড়ির গল্প সম্পূর্ণ হয় না।’

মনে মনে বললাম, ‘ঠিক। সবটা জানাও দরকার ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু দাদু যে গল্পের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেত, সেটা কিন্তু এতে বদলে গেল না। সেই গল্পের বাড়িতে সবকিছু ঠিক দাদুর মনের মতো করেই হত। সেখানে কোনও অপ্রীতিকর কিছু ঘটত না। সবকিছু ভালোই হত শেষমেশ। এই বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাবে, কিন্তু ওই গল্পের বাড়িটা আমার কাছেই থাকবে। এটা দাদু আমাকে দিয়ে গেছেন।’

সেই বাড়ির গল্প তাই আমাকেই লিখতে হত। আজ না হোক কাল।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment