তৃষ্ণা বসাক

গভীর হৃদয় ক্ষতঃ নীলাঞ্জন হাজরার কবিতা

‘দূরত্ব
ভূগোলের হয় না
ইতিহাসের হয়’

 

পরপর কয়েকটা সাম্প্রতিক বলিউড সিনেমা সাজালে মনে হয় এই কথাটাই নানান গল্পের মোড়কে উঠে আসে বারবার। বীর জারা, বজরঙ্গী ভাইজান, রাজি, মান্টো, গোল্ড, উরি, পরমাণু বা রোমিও আকবর ওয়াল্টার – এইসব সিনেমাতেই একটা সীমান্ত আছে, যার দুদিকে দুই দেশ, যারা একসময় এক ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শেষ মরণ কামড় , ধর্মীয় সুড়সুড়ি আর মসনদের লড়াই –এসব যাদের দু টুকরো করে দিয়েছে। দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে কম সাহিত্য রচনা হয়নি।  ‘মান্টো’ সিনেমায় সে যন্ত্রণা ধরা আছে। আছে নো ম্যান্স ল্যান্ডে অবাক হয়ে দাঁড়ানো টোবাটেক সিং এর কথা।  আর এক উর্দু কথাকার কিষণ চন্দর, দুই দেশের নিরীহ মানুষের রক্তে স্নান করা তাঁর পেশোয়ার এক্সপ্রেস কে ভুলতে পারে? ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ সিনেমার বালক মিলখা  একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখেছিল তার বাবা মায়ের লাশ, সেও যখন বিখ্যাত হবার পর সেই বাড়ি ফিরে যায় কাঁটাতার পেরিয়ে, তখন সমস্ত রাজনৈতিক জটিলতা, কূটনীতির ব্যকরণ ছাপিয়ে ওঠে একজন গৃহহারা ব্যক্তিমানুষের যন্ত্রণা, যার ভারত পাকিস্তান নেই, হিন্দু মুসলমান নেই, সীমান্ত নেই। ‘রাজি’ সিনেমা   পাকিস্তানী মানেই রাক্ষস , শত্রু – আমাদের এমন ধারণায় চিড় ধরায়। গুপ্তচর সেহমত বিবাহসূত্রে পাকিস্তানের যে পরিবারে গিয়ে পড়ে, তাদের দেখে আমরা অবাক হয়ে ভাবি এমন একটি ভদ্র পরিশীলিত পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে যেকোন বাবা মা’ই নিশ্চিন্ত হবেন, কিন্তু দেশের কাজে ব্রতী সেহমত বাধ্য হয় সেই পরিবারের বহুবছরের পরিচারক এমনকি ভাসুরকেও সরিয়ে দিতে দুনিয়া থেকে, দেশের কাজ আর প্রেম এই দোটানায় তছনছ হতে হতে সে রিভলবার উঁচিয়ে দাঁড়ায় তার ভালবাসার মানুষটির সামনে। তখন ক’জন দর্শকের মনে থাকে একজন পাকিস্তানীকে খতম করার পবিত্র কাজ এটি? তারাও কি দ্বিধাদীর্ণ হয় না  উচ্চকিত দেশপ্রেম আর  ব্যক্তিগত মানবিক মূল্যবোধের টানাপোড়েনে? কিন্তু সেই একক বিবেকী মানুষের কাছে পৌছনর দূরত্ব অনতিক্রম্য। সে পথে হাঁটতে পারেন বুঝি কেবল কবিরাই।

দু দেশের প্রেক্ষাপট হোক বা পালটে যাওয়া সময়, সম্পর্কহীনতা বা শহরের নিচে লুকিয়ে থাকা আর একটা শহর-

‘এই শহরের নিচে
অন্য একটা শহর আছে
বেনাম
বেনাম শুধু নয়
অদৃশ্য’

 

নীলাঞ্জনের কবিতায় সেই  বেনাম অদৃশ্য শহরের একলা মানুষ, কান্নাচাপা মানুষ বারবার। আমি সেই মুখোশ ফেরিওয়ালা (কবিতীর্থ, ২০০৯) থেকে হৃদয়ে পানীয় জল নেই (উর্বী, ২০১০) হয়ে সাম্প্রতিক অনাথ দূরত্বেরা- করাচীর কবিতা (ধানসিঁড়ি, ২০১৮) তে বারবার উঁকি মারে সীমান্ত, তা দুটি দেশের মধ্যে হোক বা দুটি মানুষের মধ্যে। গঙ্গার মুখোশ পরে ভেসে যাওয়া এক নদীর পাশে দাঁড়িয়ে কবি দেখেন বিশ্বাসের কোন নিজস্ব মুখ তাঁর কোন  আয়নার কাছে নেই।

 

‘অজস্র শুঁয়োপোকার
মসৃণ নীরবতা উঠে আসবে এইবার
আঙ্গুল বেয়ে আমার চামড়ায়’
আর মনে হয়
‘ভালবাসার মতই বুঝি
দূরত্বেরও হৃদয় ছাড়া অপরাজেয় আর কোন দুর্গ নেই’

 

কবিতাগুলি আর্তনাদ করে বলে ’তুমি আমার সীমানা হয়ো না’

 

সত্যিকারের সীমান্তে এসে এই দূরত্বেরা অনাথ। কে মারে, কে মরে- ঘাতক আর হত’র বিভেদরেখা মুছে যায়। মনে পড়ে যায় বেলারুশিয়ান সাহিত্যিক শ্বেতলানা অ্যালক্সিভিচের নোবেল বক্তৃতা-

 

‘আমি দেখলাম জান আমি দেখলাম শত শত জোয়ান পুরুষ সেখানে পড়ে। সৈনিকের পোশাক তাদের পরনে, সেই ঝলমলে পোশাকে রক্তের দাগ, চোখ আকাশের দিকে তুলে ঘোড়া আর হাতির লাশের পাশাপাশি,তারা পড়ে আছে, সারিসারি। নিস্পন্দ। কী সুন্দর চেহারা তাদের কী বলব! আমার খুব কষ্ট হল জান। দু’পক্ষের সৈন্যের জন্যেই আমার কষ্ট হল।’

 

‘প্রথমবার যাকে মারি, সে একজন জার্মান… আমি দশ বছর বয়সেই চলে গেছিলাম পার্টিসানের হাতে। এই জার্মানটা আহত অবস্থায় মাটিতে পড়েছিল.. আমাকে ওরা বলল লোকটার পিস্তলটা তুলে নিতে। আমি ছুটে গেলাম, সে পিস্তলটা দুহাত দিয়ে বাগিয়ে ধরে সোজা তাক করল আমার দিকে, কিন্তু সে প্রথমে গুলিটা করতে পারেনি, আমি পেরেছিলাম..’

(বেলারুশিয়ান সাহিত্যিক শ্বেতলানা অ্যালক্সিভিচের নোবেল বক্তৃতা, অনুবাদ অমিত দেবনাথ, ২০১৫)

 

অথচ সীমান্তকে জিইয়ে রাখতে হয়, জিইয়ে রাখতে হয় পক্ষ বিপক্ষকে, নইলে শূন্যগর্ভ রাজনীতির ভাঁড়ারে টান পড়ে, মুনাফায় টান পড়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীর। আমাদের রোজকার শব্দ ভান্ডারে জমে ওঠে টেররিস্ট, সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো শব্দ। কিছ দিন আগে বহতা অংশুমালীর এক ফেসবুক পোস্টে রাজনীতির বাইরের মানুষের বিপন্নতা ফুটে উঠতে দেখলাম।

 

‘বিরাজ কয়েকদিন আগে একটা কথা জিগেস করেছিল। সেটা হল, একজন টেররিস্ট কী করে এত সরল দেখতে হয়। এটা খুব দরকারি কথা আমার মতে। আমাদের চারদিকের পোড় খাওয়া ধান্দাবাজ মানুষের মুখে তার ধান্দার ছাপ থাকে। মৌলবিদের মুখেও সেই ছাপ। কিন্তু টেররিস্ট ছোকরাদের মুখ বালকের মতো সরল অনেক সময়েই। কারণ তারা বিশ্বাস করে তারা ভালো কাজ করছে। তাদের মনে সেই বিশ্বাস ছোটবেলা থেকে গেঁথে দেওয়া আছে। ছোটবেলা থেকে ধর্মগত অন্ধশিক্ষা। যে মনে করছে পৃথিবীর অনেকগুলো কাফের মুক্ত করলে সে অনন্ত স্বর্গপ্রাপ্ত হবে , তাকে কী দিয়ে ঠেকানো যায়? একমাত্র বিজ্ঞান দিয়ে। ইতিহাস শিক্ষা দিয়ে। প্রযুক্তিবিদ্যা নয় শুধু। কম বয়স থেকে উদার বিজ্ঞানশিক্ষা। যা ওই মিথ্যে স্বর্গগুলোকে ধবংস করে দেবে। শিক্ষা, সুযোগ, শাসন, নাগরিকত্ব। কোন সরকার তা করে না,  খালি ‘সাচ্চা ইসলাম’ কেমন ‘সাচ্চা হিন্দু’ কেমন এইসব ঢপবাজি চলছে। এই সব সরল চেহারার বালক, যুবক যারা যেহেতু সাধারণ স্বার্থের উপরে উঠে ভালো কাজ করছে, নিজের প্রাণ দিয়ে, এদের ম্যানিপুলেট করতেই থাকবে হিন্দু রাক্ষস, মুসলিম রাক্ষস, গোধরা রাক্ষস, মানুষের কলজে খাওয়া সব রাজনীতিক। রক্ষা নেই। এই সব সাধারণ মানুষ, সাধারণ সেনা তারা মরবেই। আমাদের রক্ষা নেই। সেনাবাহিনীর মানুষজন মারা গেলে সেই একই গভীর দুঃখ বাদে অন্য কোন উত্তেজনা আমার স্নায়ুকে পীড়িত করে না। যুদ্ধের প্র্য়োজনে যুদ্ধ করতেই হতে পারে। কিন্তু সেই প্রয়োজনের আগে কত প্রিভেন্টিভ মেজার নেওয়া যে বাকি থেকে গেল।

কাশ্মীরের ওই কাটা ঘা রেখে দিয়ে সরকার ভিখিরি মায়ের মত ভাড়া করা বাচ্চার ঘায়ে বসা মাছির মতো অজুহাতে ভোট ভিক্ষে করে নেবে।

করবেই। আমাদের রক্ষা নেই। টেররিস্ট ঘাড়ের কাছে এলে আমিও আকুল হয়ে তাকে মারতেই চাইব। কিন্তু টেররিস্ট বানাবার কারখানা যে রাষ্ট্রযন্ত্র বন্ধ করতে পারল না, তাকে ঘেন্না করিআমি হিন্দু রাষ্ট্র চাই না, শরিয়ত রাষ্ট্র তো অবশ্যই চাই না। একটা কড়া হেডমাস্টার চাইছে দুপক্ষকেই কান ধরে উঠবোস করাবে। চাই, কিন্তু পাই কই?

আমি রাজনীতি কম বুঝি। খবর কম পড়ি। কিন্তু স্বাধীনতার পরে এতগুলো বছর গেল। অথচ একটা জায়গায় নানান উপায়ে র‍্যাডিকালিজম বন্ধ করা গেল না, নাহ, এটা বিশ্বাস করি না।

 

(বহতা অংশুমালী, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২ঃ ৫৯। ফেসবুক পোস্ট)

 

আর এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার প্রেক্ষাপটে, ঘৃণার সীমান্ত দিয়ে চুপিসারে সীমান্তরক্ষীর চোখে ধুলো দিয়ে পাচার হচ্ছে হৃদয়, বিনিময় হচ্ছে কবিতার, সীমান্তের ওপারে থাকা বন্ধুর জন্য বিনিদ্র উদ্বেগে রাত কাটছে আর এসব গোপন নথিই তো কবিতা হয়ে ওঠে নীলাঞ্জনের কলমে।

 

ঘৃণার সীমান্তের ওপারের কাউকে আমি চিনি না
ঘৃণার সীমান্তের এপারের কাউকে আমি
করিনা কাপুরের কাছে তালিম-নেওয়া
ফ্লায়িং কিস পাঠাচ্ছিলাম না
ভোরের হাওয়ার বুকে লুকিয়ে

(১৭)

 

কিন্তু আমাদের চকিত দৃষ্টি বিনিময়ের
সাঁকো পেরিয়েই একমাত্র
পৌছান সম্ভব আমার হৃদয়ে
আমি জানি
তুমি চাও না যে
ঘৃণা বা ভালবাসা কোনো পক্ষই
আমার হৃদয়কে
ফের গুম করুক

(১৮)

 

তোমার রোমকূপ রোমকূপ থেকে ফুটে ফুটে ওঠা জাফরান খেত
ঝরনা
এখানে সাঁজোয়া গাড়ির ধর্ষণের দাগ
ওখানে ধর্ষণের গন্ধ-ভরা বারুদের বাতাস
দমকে দমকে কান্নায় ভেসে গেছে
সব স্মৃতি
তোমার বুকের উপত্যকায়

(১৯)

 

দিনে দিনে অসম্ভব হয়ে উঠছে
কথাগুলো পাচার করা

 

আমার দুহাতে ধরা তোমার উজ্জ্বল মুখ
মেটাল ডিটেক্টর, এক্স রে মেশিন, সন্দিগ্ধ গ্লাভস-এর তল্লাশির সময়ে
চালাতে হল
একগোছা ফুলের সুগন্ধ বলে

 

তোমার ব্রেসিয়ার
খুলে ফেলার প্রথম ভোরকে
পাচার করেছি
কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে
মখমল সবুজ আদিগন্ত মনে পড়ার
বুগিয়াল উপত্যকা বলে

(৩১)

 

হৃদয়ের
বিস্তীর্ণ উপকূলে শুট অ্যাট সাইট
এক্স রে মেশিন, মেটাল ডিটেক্টর
নির্দয় আঙ্গুলের তল্লাশিতে
খুলে ফেলা হতে থাকল প্রতিটা
চিঠি, পার্সেল, চুমু, ফ্রেট কন্টেনার, অশ্রুবিন্দু

 

স্তনে লেগে থাকা দুধের ফোঁটা

(৩২)

 

ডুবুরি –হৃদয়
আর কত লাশ রেখে যাবে
সন্তানের তপ্ত কপালে?
রেখে যাবে
নীল লোনা জলের ভীষণ পিপাসাঘেরা
এ কোন

 

জমিন?
ক্ষমা কোরো না কখনো
ঈশ্বর

 

(৩)

 

হয়তো কোন শীত সন্ধ্যায়
দুহাতে ক্ষত বিক্ষত করে
নিজের দুই কান
টিভি স্ক্রিন ভেঙে
পেশোয়ারের মৃত শিশুদের
আর্তনাদ
থেকে
পালাতে পালাতে
তুমি এক ছুটে
গিয়ে দাঁড়াবে ছাদে

 

আসমানে মুখ তুলে
চিৎকার করে উঠবে
আল্লাহ

(১)

 

হৃদয়ে পানীয় জলের কবি শুনে উঠতে পারেননি
‘আক্রান্ত জঙ্গলে কান পেতে
মেট্রো রেলের গহ্বরে
হারিয়ে যাওয়া মানুষের ধবনিপ্রতীক’

 

চোখের জলের মতো জ্যোৎস্নায় ভেসে গেছে চরাচর। ভুল দরজায় থেঁতলে গেছে কচি মেয়েটার তর্জনী। সেই মুহূর্তগুলোর নথিকার নীলাঞ্জন এই পর্যায়ে এসে দেখে ফেলছেন ভালবাসার অনাবৃত অক্ষর, সীমান্ত উপেক্ষা করে খুঁজে চলেছেন স্বজনের হাত, বুঝতে চাইছেন পাকিস্তানি ট্যাংকের ওপর বসন্তের চেয়ে বর্ষা কেন গভীরতর চিহ্ন রেখে যায়। কার মতো? রবীন্দ্রনাথের গানের মতো! হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন। আর এখানেই তিনি সমসাময়িক কবিদের চেয়ে একেবারে অন্য গোত্রের। আলুলায়িত সংস্কৃতি নয়, তিনি বহন করেন উপমহাদেশ ব্যাপৃত এক বৃহত্তর বোধ। তাইতো বলতে পারেন

 

যদি অতর্কিতে হামলা করা স্মৃতির
কণ্ঠনালী কেটে ফেলতে
তুমি টেনে নাও সেই ছোরা
ক্ষত খুলে যাবে
ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে
আমার স্বর
যা কোন সীমান্তে
কেউ আটকাতে পারবে না
শোনা আর না-শোনার মাঝখানের
সীমান্তে
কিংবা দু-দেশের মাঝখানের

 

এর পাশাপাশি রাখি সেই অকুতোভয় কিশোরীর আকুল জিজ্ঞাসা

 

‘শক্তিশালী দেশগুলি সবসময় যুদ্ধ করতে তৎপর কিন্তু শান্তি আনতে পারে না কেন তারা? মানুষকে বন্দুক দেওয়া এত সহজ, কিন্তু বই দেওয়া এত কঠিন কেন? ট্যাংক বানানো এত সহজ অথচ স্কুল বানানো এত কঠিন কেন?’

(নোবেল বক্তৃতা- ৭ ডিসেম্বর ২০১৮, মালালা ইউসুফজাই, অনুবাদঃ মহাশ্বেতা)

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment