প্লাতা নদী –
ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দে মাতোয়ারা চারিদিক। জলের আওয়াজ কোথা থেকে শুরু, কোথায় শেষ কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে ধু ধু অন্ধকার। অন্ধকারের অন্তরঙ্গ থেকে ফুটে উঠেছে রঙ বেরঙের কতগুলি আলোর বিন্দু। কখনও তা উজ্জ্বল আবার কখনও ঝাপসা। অনেকটা বেশি পাওয়ারের চশমা পড়লে যেমন দেখতে পাই। প্লাতা নদীর ধার বরাবর রয়েছে কাঠের রাস্তা। আমার পা ফেলার আওয়াজ ছলাৎছলাৎ শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে , চোখ গোল্লা গোল্লা পাকিয়ে, ঈষৎ ঝুঁকে, দেখে নিলাম, কাঠের তক্তার নীচে কি আছে ? যদি ভেঙ্গে যায় কোথায় গিয়ে পড়ব জলে? সাঁতার তো একটুও জানি না। না জল নয়, আমার শরীরের নীচে আলো আঁধারে চিকচিক করছে বালি। যাক, এইবার নিশ্চিন্তে হেঁটে যেতে পারি।
গরমকাল প্রায় শেষের দিকে। ফুরফুরে হাওয়ায় বালির উপর গা মেলিয়ে বসে আছে এক যুগল। তাদের শরীর দুটি থেকে ঝরে পড়ছে আলো আর পাগুলি ছুঁয়ে আছে প্লাতা নদীর জলকে। দূরে কংক্রিটের রাস্তার এক জোরালো আলো থেকে আমার দীর্ঘকায় ছায়ার প্রতিবিম্ব বালির উপর। অথচ আমি খুব বেঁটে মানুষ। এগিয়ে চলেছি, কাঠের তক্তা বরাবর। এইখানে বলে রাখা ভালো, কাঠের রাস্তাটি আঁকাবাঁকা। যত এগোচ্ছি, জলের সাথে দূরত্ব ক্রমশ কমে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে চেয়ে দেখি, আমার ছায়াগুলি এখন জলের উপর আছাড় খেয়ে ভাঙছে আবার গড়ছে। গড়ছে আবার ভাঙছে। তুচ্ছ, খন্ড, স্বল্পায়ু মুহুর্তগুলির মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম বেশ কয়েকঘন্টার জন্য। আশেপাশে মানুষজন প্রায় নেই। উরুগুয়ের জনসংখ্যা যে খুবই কম তা প্রথম দিনেই বুঝতে পারলাম। অন্ধকারের মধ্যে চোখ বুলিয়ে ভাবছি, ঠিক কোন দিকে আর্জেন্টিনা হবে? আমি যদি সোজা অন্ধকারের মাঝ দিয়ে চলতে থাকি তবে কি আর্জেন্টিনা পৌঁছে যাব? নাকি ডানদিকে? নাকি বাঁ দিকে? দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। শুধু এইটুকু জানি, আমার পিছনে কংক্রিটের রাস্তা, তারপরে কতগুলি ধূসর বাড়ির জঙ্গল, আবার কংক্রিটের রাস্তা, সেটা পেরোলেই উত্তাল আতলান্তিক সাগর। কাঠের রাস্তা থেকে খুঁজতে লাগলাম সিঁড়ি। রাতের অন্ধকারে অতলান্তিকের রূপ দেখতে খুব ইচ্ছা।
বিলাসবহুল বাড়িগুলি থেকে আলো এসে পড়ছে ঢিবিঢিবি বালির উপর। বালির আড়ালে সমুদ্র দেখার উপায় নেই। পা দিতেই হবে বালিতে। হাওয়াতে, চুলে মুখ আমার ঢেকে গেল। কোথায় পা রাখছি দেখতে পাচ্ছি না। বালির গভীরে ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ। হাটার গতিও কমে গেছে। ঢিবিটার উঁচু জায়গাটাতে গিয়ে এক ঝলক অতলান্তিককে দেখতে চাই। এমনিতে, আলোময় সমুদ্রসৈকত আমার ভালো লাগে না,কেমন যেন রাত্রির সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। হাপাতে হাপাতে উঁচুতে এসে পৌঁছেছি। দূরে কালো সমদ্রের জলআকাশের সাথে মিশে গেছে। জল স্পর্শ করার খুব ইচ্ছা কিন্তু সাঁতার জানি না যে। তাই রাতের অন্ধকারে জলকে বিভীষিকা লাগে অথচ ঐ বিভীষিকার মুখোমুখি বসে থাকার মজাই আলাদা। ওহ! মনে পড়ে গেল, এই বিচটার নাম তো স্প্যানিশে “প্রায়া ভাবা”। দুঃসাহসিকতার নাগাল মেলে কি? আমার অন্তর্নিহিত সাহসটা তবে আরও একটু বেড়ে যাক। এগিয়ে চললাম আলোর দিকে। দূরে বালির মধ্য থেকে রঙ বেরঙের কতগুলি গঠন দেখা যাচ্ছে। হাতের পাঁচটি আঙুল বালি ফুঁড়ে বেড়িয়ে আছে, যেন, সমুদ্রের জলে ডুবে যাওয়া কারোর হাতছানি। দিনের পর রাত, রাতের পর রাত, রাতের পর আলো, আলোর পর অন্ধকার, এই হাতছানি চিরস্থায়ী।
ফ্ল্যাশব্যাক- পুন্তে দেল এস্তের ম্যাপে দেখেছিলাম বটে প্রায়া ব্রাভা বীচে চিলিয়ান ইরারাজেবেল শিল্পীর এই স্থাপত্যের ছবি। এখন, রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন আলোতে রঙিন হাতছানি ডাকছে আমাকে দূর থেকে। কাছে গেলাম। বিভীষিকার সাথে , দুঃসাহসের মাঝে, হাতছানির চারিদিকে পাক খেতে লাগলাম। আশেপাশে কেউ নেই তো? ছোট্ট করে একটু গেয়ে নিই তবে “ আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা – তরিতে পারি শকতি যেন রয়।” আরও কয়েকটা লাইন গাওয়া যেতেই পারত, কিন্তু ঘড়ি বলছে রাতের বারোটা বেজে গেছে। সকালের আলোতে আর একবার প্লাতা নদীর সৌন্দর্য দেখতে আসতেই হবে। আপাতত ঘুমের দেশে পাড়ি দিই।
শরতের রোদ ঝলমল আকাশ, রয়েছে আমার দু চোখ ভরে।নীলাভ মরুভূমি। হাল্কা হাওয়ায় মাথা নাড়াচ্ছে গাছের সবুজ পাতা। এমন রঙমাঝারে ছিন্নমস্তকে ঝুলে আছে কয়েকটি রক্তাভ জবাফুল। জবাফুলের এমন বড় চেহারা আমি জন্মকালেও দেখিনি। পাশেই রাখা সারি সারি গাঁদা ফুলের গাছ। এ কি আশ্চর্য! এইখানকার সব ফুলই যে আমার খুব পরিচিত। হাঁটছি, হাঁটছি, বাড়ির পর বাড়ির জুড়ে জবাফুল গাঁদাফুলের গাছ। ফুলগুলো ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে,জুম ইন জুম আউট, ক্যামেরায় বন্দী করে রাখার চেষ্টা। আকাশ, রোদ, ফুল, বালি, প্লাতা নদী আর আমি। বালির উপরে কাঠের সাঁকোটা এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। রাতের অন্ধকারে যেগুলি ঢাকা ছিল – ডান দিকে উঁচু বাড়ি , বাঁ দিকে জাহাজের মাস্তুলের জটলা , সামনে অনন্ত জলরাশি। কাঠের সাঁকোটা ঠিক যেখানে শেষ সেখানে কাশফুলের নাচন। সামনে থেকে কাশফুল দেখব, হাতে নিয়ে দেখব, নেড়েচেড়ে দেখব , মুখের উপর কাশফুলের গুচ্ছ ফেলব।
“বাংলার ফুলের মুখ আমি দেখিয়াছি উরুগুয়েতে, দেখিয়াছি জবাফুল, গাঁদাফুল, কাশফুলে রে”। কখনো ভাবতে পারিনি প্লাতা নদীর ধারে কাশফুল দেখব! হাওয়ার দাপটে নুইয়ে পড়া কাশফুলের ভিতর থেকে এক ফালি রোদ মুখে এসে পড়তেই চোখ আমার বুজে গেল। “শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।” রোদে ঝোলসে যাচ্ছে বালি, সমুদ্রের জল , জাহাজের পাল। ক্লান্তিহীন ঢেউয়ের মধ্যে স্নান সেরে উঠে এলো এক বুড়ো। তার পিঠ বেয়ে জল চুইয়ে পড়ছে। একদল ছেলে মেয়ে এক্ষুনি নামবে সমুদ্রস্নানে। দূরে ডানদিকে জাহাজের মাস্তুলগুলো যেখানে দেখা যাচ্ছে সম্ভবত পোর্ট হবে। নদী বরাবর এগিয়ে চলেছি বন্দরের দিকে। যেতে যেতে – শ্যাওলামাখা পাথরের উপর আছড় সমুদ্রের জলের, জলের উপরের জাহাজগুলি উত্তাল, পোর্টে ঢোকার মুখে কাঠের বেঞ্চি। সমুদ্রের দিকে মুখ করে বেঞ্চিতে বসে থাকব আমি ঘন্টাখানেক।
কাসা পুয়েব্লো –
পোর্টে বেশিক্ষণ বসে থাকার উপায় নেই। কার্লোস ভিলারোর নির্মিত কলা ভবন দেখতে যেতে হবে। এর আগে এই শিল্পীর নাম শুনিনি অথচ উরুগাইতে আসার কথা ঠিক হতেই ট্যুরিজমের বইপত্তর ঘাটলেই এই শিল্পীর নির্মিত রঙ চংেএ বাড়ির ছবি দেখতে পেতাম। সমুদ্রের ধারে এমন শিল্পকলা দেখতে তো হবেই।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস ছাড়বে। প্লাতা নদীর দেহে সূর্যাস্ত দেখতে আবার ফিরে আসব তাই বেশি দেরি করলে ফিরতেও দেরি হয়ে যাবে তো! ভাঙা পর্তুগীজ দিয়ে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে বাস পেয়ে গেলাম। ১৫ মিনিট যেতেই বাসের ড্রাইভার জনমানবহীন এলাকায় নামিয়ে দিয়ে বলে, এইখানেই কাসা পুয়েব্লো। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম কোন সাইনবোর্ড আছে কিনা? না কোথাও কিছু নেই। কি করব এইবার? ফিরে যাওয়ার পথে বাসের স্টপেজটাই বা কোথায়? উল্টো দিকে একটি রাস্তা সোজা নেমে গেছে অতলান্তিকের দিকে। তবে ওদিকেই যাই। সব রাস্তাই যখন অচেনা তখন আর আলাদা করে ভয় পেয়ে কাজ নেই। হাঁটছি, হাঁটছি আর হাঁটছি। হারিয়ে তো যেতেই পারি! কিন্তু কেন যাব? দুদিকের কাশফুলের সারি দিয়ে চলেছি। কলা ভবন না দেখতে পাই তো সমুদ্রকে ছুঁয়ে আবার ফিরে আসব বা কাশফুলের সাথে একটু খেলে নেব। গাইডবুকে দেখে এসেছিলাম, গ্রীসের সানতোরিনি দ্বীপের মতই নীল সমুদ্রের উপর সাদা ধবধবে কাসা পুয়েব্লো দেখতে ভারি সুন্দর! আহা! কি মনোরম দৃশ্য অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
কিন্তু ঠিক করে পৌঁছাতে পারলেই হয়। যেতে যেতে আবার মুশকিল! রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে, কলা ভবনের সন্ধান তো এখনও পাইনি, কি করি? ইতিমধ্যে বড় এক গাড়ি এসে থামল আমার সামনে,চমকে গেলাম। গাড়ি থেকে একজন বেড়িয়ে স্প্যানিশে জিগায় “ কাসা পুয়েব্লো কোথায়, জানো?” তখন আর ভয় নয় বেশ হাসি পেল, কাকে জিজ্ঞাসা করছে? আমি নিজেই তো এতক্ষণ উদভ্রান্তের মত হাঁটছিলাম।
-“ আমিও জানি না। সোজা হেঁটে চলেছি সমুদ্রের দিকে”। গাড়িটি দেখলাম আমার অনুমেয় পথেই গেল। তা বেশ। কাশফুলের ঝারি এখন শেষ, উঁচু রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে আমার দুদিকেই নীল জলের মরুভূমি, দূরে সাদা কয়েকটি পাঁচিল । রাস্তার ধারে লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। তার মানে ঠিক পথেই এসেছি। বুঝলাম, আমার পাশ দিয়ে সোঁ সোঁ করে যে গাড়িগুলো যাচ্ছিল তাদের প্রত্যেকেরই গন্তব্য একই ছিল। যাই হোক,আমার হাঁটা পথটা ভুল হলে আর্ট গ্যালারিটা ঘুরতে আরও বেশি সময় লেগে যেত। ঐদিকে সূর্যাস্ত তো আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। অবশেষে কাসা পুয়েব্লো খুঁজে নিজেকে কেমন যেন একটু বেশ সাহসী লাগছে।
উরুগুয়াইন শিল্পী কার্লোস ভিলারো তার বাড়িটি বানিয়েছিলেন নীল সমুদ্রের উপরে সাদা পাখির বাসার মত। ভিতরে আছে মিউসিয়াম আর আর্ট গ্যালারি। নীচু দরজা , ঘরের দেওয়ালের গায়ে ঝুলে পড়েছে লজ্জাবতী গাছেরা, মাথার উপরে আয়তকার আকাশ,এদিক ওদিক সরু কাঠের সিঁড়ি, প্রস্থান বাহির সব জগাখিচুড়ি । গোলকধাধার মধ্যেই সামনের একটি ঘর বেছে নিলাম। ঘর ভর্তি বড় বড় রঙিন ছবি টাঙানো। কতগুলি মাছ, দুপাশে মানুষের মুণ্ডু, নীচে একটি সংখ্যার চাকা, আমাকে ডাকল। স্প্যানিশে লেখা ছবির নাম, যার অর্থ “খেলেছিলাম, মাছেদের নিয়মে”। এক থালা সাজানো মাছ হাতে এক মহিলা দাঁড়িয়ে, পাশেই থাকা ছবিটির নাম – জেলেনি,আনা। আনার পরেই রয়েছে আনকোরা রঙে সৃষ্ট দাড়াওয়ালা বিশাল এক চিংড়ি। সোনালী, নীলাভ, শ্যামলা মাছের কিলবিল সারা ঘর জুড়ে। একের পর এক ছবি দেখে মুগ্ধ , ভিলারিওর আঁকার নেশা লেগে গেছে। জানলার বাইরের দৃশ্যে, শারদীয় মেঘ অতলান্তিকের জলের সাথে লুকোচুরি খেলছে আর ভিতরের দৃশ্যে আলোকিত দুর্বোধ্য ছবিগুলি।
সমুদ্রের ধারের পাখির বাসা ছেড়ে যেতে মন নাহি চায়। এইখানে যদি রোজ আসতে পারতাম! কি শান্তশিষ্ট জীবন! মহা হিংসে হলো ঐ কাসা পুয়েব্লোর সিকিউরিটি গার্ডগুলোর প্রতি। তবে হিংসা যে ভয়ের কাছে পরাজিত। খেয়াল হলো ফেরার পথের সেই জনমানবহীন রাস্তা! তাও আবার বাস কোথা থেকে পাবো জানি না। দেরি না করে তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়াটাই ভালো। অগত্যা সাজানো কাশফুলের বীথি অতিক্রম করে বাসের রাস্তায় এসে পৌছালাম কিন্তু কিন্তু কিন্তু বাস কোথায় দাঁড়াবে কাকে জিজ্ঞাসা করব? আদৌ বাস এইখানে দাঁড়ায় তো! ভাগ্যক্রমে চোখে পড়ে, দূরে এক বুড়ি ফ্লাস্ক ও একটা কাপ হাতে দাঁড়িয়ে তার সাথে এক মধ্য বয়স্ক পুরুষ। বাসের স্টপেজ কোথায় হয়তো তারা জানবে। আমি পর্তুগিজে জিজ্ঞাসা করায় স্প্যানিশে জানাল, তারাও জানে না। কি মুশকিল! কি করি এইবার!
তার পরের প্রশ্নটা যা হয়,
-“তুমি কোন দেশের ? কোথা থেকে আসছ?”
-“আমি ব্রাসিল থেকে আসছি কিন্তু আমি ইন্ডিয়ান।”
ভদ্রলোক বুড়ির সাথে গুজুরগুজুর করে আমাকে বলে
-“ আমি আর আমার মা ঐ শহরের দিকেই যাচ্ছি, তুমি চাইলে আমাদের গাড়িতে করে তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি”।
উত্তম প্রস্তাব পেয়ে খুশিতে গদগদ, মুহূর্তে রাজী, উঠে পড়লাম গাড়িতে।শুনেছি,ব্রাসিলের মত চুরি ছিনতাই উরুগাইতে হয় না তাই একটু সাহস পেলাম বৈকি! কিছুক্ষণের মধ্যেই বকবক শুরু হল, প্রসঙ্গ ব্রাসিলের অর্থনৈতিক টালমাটাল। সামনের সিট থেকে বুড়ি কাপে চুমুক দিতে দিতে আলোচনার সাথে ঘাড় মেলাচ্ছেন কিন্তু মুখে কিছুই বলছেন না। সম্ভবত , পর্তুগিজে কথা বলতে পারবেন না বলেই চুপ আছেন। আমাদের মধ্যে নাম বিনিময় হয়ে গিয়েছে , আমার নাম বোঝানো এক বিশাল জ্বালা। বিদেশিদের কাছে আমার নামের সঠিক উচ্চারণ শেখাতে গিয়ে যে জীবনে কত সময় নষ্ট করেছি! তো জ্বালা থেকে রেহাই পেতে নামের জটলা ছেড়ে উরুগুয়ের সেই গরীব প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকার কথা জানতে চাইলাম। চালকের আসনে বসে থাকা ভদ্রলোকটি প্রেসিডেন্টের নাম শুনেই মুচকি হেসে বললেন “ রাজনৈতিক লোকেদের কথা বাদ দাও। সারা বিশ্ব জানে উনি সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট, আদপে তা সত্য নয়।” তা বটে, নেতারা তিলকে তাল করতে ওস্তাদ। কথাপ্রসঙ্গ এ চলে এলো ইউরোপিয়ান রাজনীতি, ভারতীয় বিফ থুরি বিপ কালচার ইত্যাদি ইত্যাদি।
উরুগুয়ে খুব ছোট্ট দেশ তার সব ছোট্টখাট্টো শহর তাই একটু বকবক করতে না করতেই প্লাতা নদীর ধারের বন্দরে পৌঁছে গেলাম। গাড়ির মধ্যের কথোপকথনে সবাই খুশি, ফোন নাম্বার আদানপ্রদান করে বুড়ি আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ক্ষণিকের অতিথিকে বিদায় জানাল।
সূর্য গলে পড়ছে নদীর জলে , যেখানে যা থাকার সব আছে। আকাশের গায়ে বাঘের মত ডোরাকাটা দাগ ফেলেছে জাহাজের মাস্তুলগুলি। চুপিচুপি উড়ে যাচ্ছে গোধূলিমাখা পাখিরা। দূরে সেপিয়া রঙে ঢেকে গেছে পাহাড়। ঝলসে যাওয়া শরতের মেঘ একাকী নীরব, আমি আর সূর্যাস্ত তখন মুখোমুখি।
প্লাসা –
একটি রাস্তা, দুটি রাস্তা, তিনটে রাস্তা, চারটে রাস্তার মধ্য থেকে জেগে উঠছে জিলিপির মত হাইওয়েগুলো। বড় কোন শহরে এলেই গোলকধাঁধা লাগে। মন্তেভিদেওর বাস টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে যা যা দেখলাম – অজস্র রাস্তা মিলেমিশে চওড়া একখানি মোড়, বাসেদের কিলবিল, অগণিত মানুষ কাছে দূরে, এরা সবাই কি উরুগুয়ানো? কাউকে পর্তুগীজে পথনির্দেশ জিজ্ঞাসা করতেই পারি। গোলকধাঁধার ফাঁদ থেকে নিস্তার পেতে একটা ট্যাক্সি নিলাম, ঠিকানা দেখাতেই ট্যাক্সিওয়ালার সাথে কোন কথার প্রয়োজন হলো না। কথা বলবই বা কি করে? ট্যাক্সির সামনেকার আসনের সাথে পিছনের যাত্রীর সামনে কাঁচের শক্ত দেওয়াল। কি দমবন্ধকর অবস্থা। উরুগুয়ের ট্যাক্সি একদম পছন্দ হয়নি। অচেনা রাস্তার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছি, ইউরোপিয়ান কায়দার ঝুলন্ত বারান্দাগুলি জানলার পাশ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, আড়াল থেকে উঁকি মারছে অজানা পথগুলো, আমি, নিশ্চিন্ত, গাড়ির চালক জানে আমার গন্তব্য। হোটেলে ব্যাগপত্র রেখেই মন্তেভিদেওর ওলিগলির রহস্য মোচনে বেড়িয়ে পড়লাম।
ম্যাপ থেকে দেখে নিয়েছি সোজা রাস্তা বরাবর হাঁটলেই পেয়ে যাব প্লাসা ইন্ডিপেন্ডেসিয়া। কোথাও ঘুরতে গেলে আমি একেবারে কাগজ কুড়ানি হয়ে যাই। যা যা কাগজ পাই সব ব্যাগে পুরে ফেলি। পোস্টকার্ডের ম্যাপ, হোটেল, রেস্তোরাঁ, সমুদ্রভ্রমণ, নাচ গান, আশেপাশের শহর বৃত্তান্ত কিছুই বাদ দিই না। যখন যা চাইব সব যেন পেয়ে যাই আমার ঝুলিতে।
চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে দেখছি নতুন শহর, রবিবার সকাল, বেশিরভাগ দোকানপাট সব বন্ধ, লোকজনের হাতে যক্ষের ধনের মত মাতের ফ্লাক্স ও গ্লাস, বাড়িগুলি ক্রমশ পুরানো হচ্ছে, কয়েক পা এগোলেই পরের পর পিয়াজ্জা। সাদা ধবধবে মূর্তি খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনর্গল জল ঝরছে এঞ্জেলের মুখ থেকে,মুখের মধ্যে জল নিয়ে ঝাপটাঝাঁপটি করছে ধূসর পায়রারা, পায়রাকে দানা খাওয়াচ্ছে এক ভিখারি, ভিখারির মাথায় পড়েছে গাছেদের ছায়া, ছায়ার নীচের বেঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে কয়েকজন, কয়েকজন মানুষ সাক্ষী থাকছে এই প্রবাহমানতার।
ম্যাপ খুলে দেখে নিলাম, আরও কয়েকটা পিয়াজ্জা পেরোলেই প্লাজা ইন্ডিপেন্ডেন্সিয়া আবার সেইখান থেকে আরও এগোলেই গ্যালারি অতিক্রম সোজা সমুদ্রের ধারে। যাতায়াতের পথে যা যা দর্শনীয় ক্ষণিকের তরে সেখানে থেমে যাব। নির্জন রাস্তাঘাট, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যাস্ত হবে, রবিবার সন্ধেবেলায় কেমন যেন বিষণ্ণ পরিবেশ। আবার আর একটা প্লাসা বা পিয়াজা। কালো পাথরের তৈরি কোন এক যুদ্ধেরদৃশ্যকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে আছে জল। কয়েকটা ফোয়ারার মুখও দেখা যাচ্ছে, হয়তো রাতে তা দিয়ে মূর্তিটিকে আলোকিত করে। নিঃসঙ্গ প্লাসা, সবুজ বেঞ্চিগুলো চেয়ে আছে কখন কোন এক পথিক এসে বসবে তার কোলে ? বেঞ্চের উপর বসে মৃদু হাওয়ায় হলুদ পাতাদের নাচন, দেখছি, মূর্তিটায় প্রত্যেকেই প্রত্যেককে জড়িয়ে আছে, ক্ষণিকের অতিথিরা আসছে যাচ্ছে, মূর্তির নীচে জলের উপর শরতের মেঘের ছায়া, আমি ম্যাপ বের করে দেখলাম আর কতটা ?
প্লাজা ইন্ডেপেন্ডিসিয়ার ঠিক উল্টোদিকে নাকি একটা লম্বা বাড়ি আছে , এক সময় সেটা দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং ছিল। আর ঐ প্লাজা পেরোলেই পোর্টের রাস্তা শুরু হবে। তা এখনও দুই কিমি দূরে। ঠিক করলাম,অন্ধকার হওয়ার আগেই বন্দরে পৌঁছে যাব। প্লাসা ফাবিনিকে পিছনে ফেলে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ কোন এক ইউরোপিয়ান শহরের মধ্যে প্রবেশ করছি। রাস্তার দুধারে দীর্ঘকায় দরজা, ক্লাসিক স্টাইলের বাড়িগুলি কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি! একটু এগোতেই প্লাজা ইন্ডিপেন্ডেন্সিয়া এসেহাজির। শেষ বেলার আলো এসে পড়ছে প্লাসার মধ্যিখানের থামের উপরে থাকা আরতিগাসের স্ট্যাচুর গায়ে। চক্ষ্যস্থির হতে বাধ্য,পাথুরে রঙের উরুগুয়ান হিরো আরতিগাস বসে আছেন ঘোড়ার উপরে তার পাশ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে তালগাছ, চারিধারের বাড়িগুলিতে ইউরোপিয়ান নকশা। যেন মনে হচ্ছে, ইতালির এক শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। দেওয়ালের গায়ে লেখা ইতালিয়ান শিল্পী কার্লো জুক্কি প্যারিসের এক রাস্তার আদলে বানিয়েছিলেন এই প্লাসা। এখন আমার পিছনে সূর্যের সোনালী হেঁয়ালিকে সামনে সেই এককালের সর্বোচ্চ বাড়ি ডানদিকে প্লাতা নদী মিশেছে আটলান্টিক সাগরে আর বাঁদিকে শৌখিন দোকানের পসরা। প্রথম দেখাতে সামনের লম্বা বাড়িটা এমন কিছু উঁচু লাগছিল না কিন্তু ছবি তুলতে গিয়ে বুঝলাম ক্যামেরার স্ক্রিনে পা থেকে মাথা সর্বাঙ্গ কিছুতেই ধরছে না অবশেষে মাটিতে বসে কিছুটা চেষ্টা করা গেল। অজানা শহর, কত শত বিস্ময়! ব্রাসিলে থাকাকালীন বুঝিনি উরুগুয়েতে এসে ইউরোপের ছোঁয়া পাব। প্লাজার ঠিক বাইরেই দেখতে পাচ্ছি উরুগুয়ের বিখ্যাত সোলিস থিয়েটার। একে দেখে কোলকাতার সেই টাউন হলের কথা মনে পড়ল। রোদ আর একদম নেই, প্লাতা নদী ও আতলান্তিকের মিলনস্থলের দিকে হাটতে লাগলাম। সাজানো বড় বড় বেশ কয়েকটি বইয়ের দোকান আজ রবিবার বলে বন্ধ , তার মানে পরে আবার একদিন ফিরে আসতে হবে বই কেনার জন্য। দোকানের পর দোকান, কয়েকটি প্লাসা অতিক্রম করে পৌছালাম বন্দরে। ভীষণ শান্ত সমুদ্র, জাহাজের পেট্রোলের গন্ধ ভেসে আসছে, জলের ধার ঘেঁসে লাইন দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে মাছের ছিপ ফেলে বসে আছে বুড়োবুড়ি ছুঁড়োছুঁড়ি। না, এইখানের সমুদ্রকে বা প্লাতা নদীকে পুন্তে দেল এসচের মত মায়াময়ী লাগল না। অনেকটা বিশাল, অসীম, যাকে ছুঁতে ভয় লাগে।অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পথ ধরে আবার ফিরে গেলাম। অন্ধকারে ছোট প্লাসাগুলি একেবারেই নিস্তব্ধ শুধু কয়েকফোটা আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছে বার রেস্তোরাগুলি থেকে। এতক্ষণে আমার মধ্যপ্রদেশ ডাক দিয়েছে। হোটেলে একটু জিরিয়ে নিয়েই খেতে বেরবো।
মাতাম্ব্রে
আজ একখানা ট্রাডিশিনাল উরুগুয়ান রসনার স্বাদ পেতে চাই। । খাবারের ব্যাপারে আমি আবার অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে। গুচ্ছ কয়েক রিভিউ হজম করে এক জায়গায় মাতাহাম্ব্রে খাওয়ার শখ হল। মাতার মানে পর্তুগীজ এবং স্প্যানিশে খুন আর হাম্ব্রে মানে স্প্যানিশে ক্ষুধা। আমার ক্ষুধাকে খুন করতে হাজির হয়েছি ‘এল ফোগোন’ নামের এক রেস্তোরাঁতে। বাইরে ছুটির দিনের রাত্রি নিস্তব্ধ হলেও রেস্তোরার ভিতরে অন্য এক পৃথিবী। প্রায় সব টেবিলের উপর থেকেই উঁকি মারছে মাথারা। এক কোণে ছোট এক টেবিলে আমার স্থান হল। বসা মাত্রই ইতালিয়ান পট্রেটের মত এক মহিলা এসে জানালেন এখন হ্যাপি আওয়ার চলছে অতএব এক গ্লাস হোয়াইট ওয়াইন ফ্রি। মাতাম্ব্রের সাথে হোয়াইট ওয়াইন, এই যুগলবন্দী ভাবতেই খিদে আর ও বেড়ে গেল। এখনও ১০ মিনিট অপেক্ষা। চারিদিকে টেবিলে চকচকে কাঁচের গ্লাস থেকে ঠিকরে পড়ছে আলোর আঁকিবুঁকি, সাদা প্লেটের উপরে স্টিলের কাঁটা চামচের নাচন, কোথাও প্লেট ভর্তি কোথাও আবার শূন্য, শূন্য থেকে ফুটে উঠছে উচ্ছিষ্ট খাবারের কিছু অংশ। কিছু অংশের লোকেদের মুখ নড়ছে খাবারে কেউ বা কথা বলতেই ব্যস্ত, ব্যস্ত আমার সামনের টেবিলে বসে থাকা “জিভে প্রেম করে যেই জন” এক প্রেমিক যুগল। তারা একে অপরের জিভে জিভ লাগিয়ে স্বাদ গ্রহণে মত্ত। এমনই মূহূর্তে, গোল্লা পাকানো পর্কের চাকতির মধ্যে সবুজ পাতার সস দিয়ে মাখানো মাতাম্ব্রে এখন আমার প্লেটে, মন চলো নিজ ভক্ষণে। গোলাপী পর্কের প্রতিটা স্তরের সাথে মাখানো সবুজ চিমিচুরি সস, চামচ দিয়ে কেটে মুখে দিতেই নরম তুলতুলে মাংস থেকে হাল্কা দুধের গন্ধ বেড়িয়ে আসছে সাথে এক চুমুক হোয়াইটওয়াইন, ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি উপাদেয় জগতে। মাতাম্ব্রে না খেলে উরগুয়ে ভ্রমণ পূর্ণ হত না। বেশি রাত না করে হোটেলের ঘরে ফিরে যেতে হবে আগামীকাল যাব কলোনীয়া দেল সাক্রামেন্তো।
ঐতিহাসিক নদী তীরে পায়চারি –
মন্তেভিদেও থেকে প্রায় আড়াই ঘন্টা বাসের যাত্রায় এসে পৌছালাম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ শহর কোলনীয়া দেল সাক্রামেন্তোতে। এক সময় এইখানে পর্তুগীজদের কলোনি ছিল। বাস টার্মিনাল থেকে একটু এগোলেই পুরানো দিনের কালো চৌকো চৌকো স্টোনের রাস্তা, রাস্তার মাঝে গর্তে পা ঢুকে গিয়ে ধীর হয়ে যাচ্ছে চলার গতি। রাস্তাটা একটু উঁচু, ইউরোপিয়ান ঘরানার বাড়িগুলি একে অপরের উপর শুয়ে আছে। প্রায় ১৫ মিনিট হাঁটার পর পোড়া ইটের পুরানো পাঁচিল বিস্তীর্ণভাবে আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে। পোড়ো জমি, ধ্বসে যাওয়া ঘর, অকেজো কামান,ফাটল ধরা পাঁচিল, শরতের আকাশ, প্লাতা নদীর শান্ত জল, কোলোনীয়া দেল সাক্রামেন্তো পরস্পর জড়িয়ে আছে একসাথে। এবড়ো খেবড়ো পাথরের স্তুপের মাথা থেকে দেখা যাচ্ছে নিস্তব্ধ এক জাহাজ ভেসে চলেছে নদীর জলে । একটি লোক পারে দাঁড়িয়ে সেইদৃশ্য দেখছে। সেও যাত্রী আমিও যাত্রী। জাহাজটা কোথা থেকে আসছে আর কোথায় যাচ্ছে তার কোন আন্দাজ নেই। ভিতরে কি আদৌ কোন যাত্রী আছে নাকি শূন্য ? দূরে ঘড়ি ঘর থেকে বারোটা বেজে উঠল। রোদের তেজ বাড়ছে ক্রমশ।পাথরের স্তূপ থেকে নেমে বাকি অলিগলির গোপনীয়তা উন্মোচনে এগোলাম।
প্রথম গলি, সরু স্টোনের রাস্তা, নাম তার স্ট্রিট অফ সাই,এতই লাজুকে রাস্তা যে আমি ব্যতীত আর অন্য কোন দর্শক নেই সেখানে। রস্তার দুপাশে দুটি বাড়ির দরজা , সারাক্ষণ খোলাই থাকে । একটি রান্নাঘর। তার সামনে থেকে পিছন ঘুরে তাকালে রাস্তার শুরুতে শেষে কেউ নেই। অপর পারে একটি জামাকাপড়ের দোকান তার মধ্যে ভূতুড়ে জামাকাপড়গুলি উড়ছে। কিচেনের দিকেই পা বাড়াতেই, নীচু সিলিং, ঘুপচি ঘর, উপর দিকে ঝুলছে বাসন,রূপালী স্টিলের বাসনগুলি চকচক করছে অন্ধকার ঘরে, ঘরের মধ্য দিয়ে আরেকটা ঘর, ঘরের দুদিকেই দরজা, দরজার পাশে ফোকলা ইটের উপর সোনালী বাঁধানো ছবি, পাশে ছবির মত সাজানো রান্নাঘর, রান্নাঘরের মধ্যে রশুন, কেটলি, থেমে থাকা কাঠের ঘড়ি, পিতলের কাপ, শুকিয়ে যাওয়া ফুল, ছুঁড়ি যে যেখানে থাকার সবাই ছবির মত বসে আছে। দরজা পেরিয়ে পরের ঘর, দেওয়াল ভর্তি সাজানো পাথর, ছবি, মাটির মূর্তি, নির্জনতা, গোলোকধাঁধার মত । ধোঁয়া বেরোচ্ছে কফির কাপ থেকে। হেঁশেল শেষ হতেই কফির দোকান তারপর দরজা, রাস্তা, আলো। সকালবেলাতেও ঘুপচি ঘরে থাকলে আমার খুব দুঃখ হয়।
দ্বিতীয় গলি, প্রথম গলির থেকে অপেক্ষাকৃত চওড়া, ঢালু, সোজা নেমে গেছে প্লাতা নদীর ধারে, সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে নীল জলের উঁকি, রাস্তার দুপাশে কংক্রিটের দেওয়াল আঁটকে দিয়েছে নদীকে। যেতে ইচ্ছে করলো না। এরপর পরপর বেশ কতগুলি মিউসিয়াম, তার মধ্যে আছে আদিকালের রাজা রানীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। কাঁচের বাক্সের গায়ে আটকানো প্রাণহীন জমকালো জামা, ক্ষয়ে যাওয়া আয়নাতে আমার মুখের ছায়া পড়েছে ঘরের চারিপাশের দেওয়ালে। পুরানো দিনের মিটিং রুমের বড় বড় রাজকীয় চেয়ারগুলি শূন্য। পাঁচটি মিউসিয়াম দেখার পর বদ্ধ ঘরে আর ঢুকব না ঠিক করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোর মাতোয়ারা নিভে যাবে তার আগে প্লাতা নদীর ধার দিয়ে একটু ঘুরে নিই। “আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো” দিয়ে কিছুটা যেতেই দেখি সমুদ্রের উপর দূর পর্যন্ত কাঠের পাটাতন পাতা আর তার দুদিকে ছোট ছোট নিজস্ব পালতোলা বোট, নৌকো টলটল করছে। ঐতিহাসিক শহরের সূর্যাস্ত দেখব বলে অপেক্ষা করে আছি। শুনেছিলাম কলোনীয়া থেকে বোটে বুয়েনোস আইরেস খুব সহজেই যাওয়া যায়। যদিও সেই ভ্রমণের সুযোগ আমার নেই। আলাদা ভিসা বানাতে হবে কিনা ? পশ্চিমের মেঘ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে রোদ। রোদের ঝলসানিতে আমার চোখে ধাঁ ধাঁ। অঞ্চলটা বেশি বড় নয় আর এই ব্রাসিলে থাকার পর থেকে সব জায়গাকেই পুচকি লাগে। তিন ঘন্টার মধ্যে প্রতিটি অলিগলির রহস্যভেদ হয়ে গেল। টিকিট অনুযায়ী বাস ধরার সময় এসে হাজির। উল্টোদিকে ক্ষয়ে যাওয়া শহরকে রেখে ফিরে আসছি মন্তেভিদেওর দিকে।
পরের দিন দুপুরেই ফ্লাইট সাওপাওলোতে ফিরব। কয়েকটা বই না কিনলেই নয়! ফেরার দিন সকাল সকাল উঁকিঝুঁকি শুরু সেই বিখ্যাত বইয়ের দোকানগুলিতে। মারিও বেনেদেত্তির বই চাই ইংলিশে। অথবাওনেত্তির কোন বই? না , কয়েকঘন্টা খোঁজাখুঁজির পরেও না পেয়ে অবশেষে স্প্যানিশেই তাদেরকে ব্যাগবন্দী করলাম। কোন এককালে পর্তুগীজ একটু দক্ষ হলে স্প্যানিশ শিখব, সেই আশায় কবে থেকে বসে আছি! যাই হোক, আপাতত তল্পিতল্পা গোটানোর পালা। ইতালিয়ান কারুকাজ, ঝুলন্ত বারান্দাগুলি ধেয়ে আসছে সেই দমবন্ধকর ট্যাক্সির জানলা দিয়ে। কোথায় যেন পড়েছিলাম এই উরুগুয়াইকে নিয়ে এক সময় আর্হেন্টিনা আর ব্রাসিলের খুব ঝগড়া ছিল। উরুগুয়াই কোন দেশের অধীনে যাবে ব্রাসিলে নাকি আর্হেন্টিনাতে? যেটুকু দেখেছি দেশটিকে ব্রাসিলের সাথে এই ইউরোপিয়ান উরুগুয়ের নিদেনপক্ষে কোনই মিল নেই। এই প্রথমবার এলাম উরুগুয়াইতে, দেশটির সম্বন্ধে আংশিক রোমাঞ্চ উদ্ঘাটন করেছি বটে তবে আবার কখনও ফিরে এলে হয়তো তাকে আরও অন্যভাবে চিনতে, জানতে পারব। উরুগুয়াই ভ্রমণ আর তার সাথে সহবাসের কিছু মুহূর্ত সাক্ষী হয়ে থাকল ক্যামেরাবন্দী কিছু ছবিতে ও লেখায়।