সৌরভ হোসেন

খোদাবক্সপিরের মোজেজা

“লাইলাহা ইল্লালা…লাইলাহা ইল্লালা…, আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ…।“

সবেমাত্র ‘জিকির’ শুরু হয়েছে, আর তাতেই পিরহুজুর ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেছেন! তাঁর ফর্সা মুখটা চাঁদের মতো জ্বলছে! এ আলোকেই মেজালরা বলে ‘নূরের আলো’। মেজাল খুউব চালাক। ‘জিকির’ তুলতে তুলতে একবার চোখ বন্ধ করছে, আর একবার আঁড় চোখে পিরহুজুরের দিকে ফিক করে তাকাচ্ছে। তার উল্টো দিকে মুখ করে বসে থাকা সাদেক রেজা ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে। আর মনে মনে খিস্তি দিচ্ছে। গোলাম আর ইজাজুল তখন জিকিরের বোলে ঘোর হয়ে আসমানি হয়ে গেছে। এরা সবাই আইবুড়ো টগবগে তরুণ। কারোরই বয়স কুঁড়ি পার হয়নি। তবে বিছানায় স্বপ্নদোষের ঠেলাই সবারই লুঙ্গি ভেজে। বুড়ো বলতে গেলে, বদর মণ্ডল। মুখে এক গাল কাঁচাপাকা সুন্নত দাড়ি। চুলেও পাক ধরেছে। মাথায় বকন গরুটার ঘাসের বোঝা তুলতে গেলেই কাঁধ কট করে ওঠে। তিনি পিরহুজুরের পিছনে জিকিরাচ্ছন্ন হয়ে আছেন। কিছুটা পাকা মাথা ফর্সা রঙের সাদেকের। হাবেভাবে তার মধ্যে একটা মোড়লভাবও আছে। মুখে খুচখুচে দাড়ির সাদেক মেজালকে চোখে চোখে সতর্ক করছে, এই ব্যাটা অ কী কচ্ছিস? ফাজলামি বন্ধ কর। কিন্তু এঁচোড় পাকা মেজাল সাদেকের চোখ টাটানোকে গেরাহ্যই করছে না। আচমকা পিরহুজুর গেঙিয়ে উঠলেন, “হক রব্বানা হক, হক রব্বানা হক।“

আসলে তিনি তাঁর অন্তর দৃষ্টি দিয়ে এতক্ষণ মেজালের ফাঁকিবাজিটা দেখছিলেন। শব্দের হুঙ্কারে সতর্ক করলেন। তিনি অন্য কোনও কথা বললেন না। না দুনিয়াদারির না পরকালের। আবারও একবার উচ্চস্বরে ‘হক রব্বানা হক’ বলে জিকিরে মগ্ন হলেন। পিরহুজুরের আচরণ দেখে, সাদেক মেজালকে ফিসফিস করে বলল, ”জিকিরচুরি বন্ধ কর। তা না হইলে তোর পাছায় পিঁড়ি লেগি যাবে। ত্যাখুন দেখবি মজা।“

‘জিকির’ তোলার সময় ফাঁকি দিলে বা বদমাইশি করলে অর্থাৎ মন উড়ু উড়ু করলে তাকে ‘জিকিরচুরি’ বলে। পিরহুজুরের ইশারায় মেজাল ভয়ে কুঁকড়ে গেল! তার নাড়ির ভেতরে আজাব গজবের ভয় সেঁধিয়ে গেল। সে তখন চোখ বন্ধ করে একনাগাড়ে ‘লাইলাহা ইল্লালা’ বলে পাকা মুসল্লির মতো ‘জিকির’ এ মজে গেল। মেজালের পাকামু দেখে সাদেক মিচকি হাসল। মনে মনে বলল, ঠাপ কাকে বলে দ্যাখ। ‘জিকির’এর আওয়াজে মসজিদটা গমগম করতে লাগল। ছাদ দেওয়ালও যেন আল্লাহর নাম নিচ্ছে। হাওয়া বাতাসও আল্লাহ আল্লাহ করছে। সাদেকরা খোদাবক্সপিরের সাথে এভাবে প্রায় রাতে ‘জিকির’ তোলে। আমল ইবাদত করে। আল্লাহর নাম নেয়। ‘জিকির তোলা’ যার তার কম্ম নয়। নিয়ম করে ইত্তেকাফ(আত্মার ধ্যান) করতে হবে। খাঁটি ইমানদার ব্যক্তি হতে হবে। শুধু ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ করলেই তো আর জিকির উঠবে না? নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করতে হয়। বলেন, খোদাবক্সপির।

ডুগডুগে ফর্সা চেহারা। মাঝারি উচ্চতার পাকানে শরীর। ঘন সুচাল দাড়ি। গোঁফ খুঁট করে চাঁছা। মাথায় কাঁচাপাকা বাবরি চুল। কাজল টানা চোখ। সবসময় সুরমা লাগানো থাকে। চিথল কানের ভাঁজে গোঁজা থাকে আতরের তুলো। সে সুগন্ধ শুনে সাদেকরা বলে, ‘আল্লাহর ফেরেশতার ঘ্রাণ’। টিকালো নাক। কপালে নামাজের কালো ঘটা। মাথায় সবসময়ের মদীনা ফেট্টি। যেন আল্লাহর ফেরেস্তার মুখ। এই তল্লাটে এবং আশপাশের গাঁ গেরামে তাঁর খুউব নামডাক। প্রচুর সাকরেদ তাঁর। খোদাবক্সপির বললেই সবাই ‘সেলাম’ ঠুকে। তাঁর আদি বাড়ি কোথায় কেউ বলতে পারে না। পিরহুজুরকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন, আমার আর সাকিন কি রে, সবই তো আল্লাহর, তিনিই তো সারাজাহানের মালিক। তাঁর প্রথম আস্তানা ছিল বড় ভৈরবের পাড় লাগোয়া তরতিপুর গ্রামে। ভৈরবের নীল কালো পানি আর খোদাবক্সপিরের গলার জিকিরের আওয়াজ সে নদীকে আসমানের নদী বানিয়ে তুলত। সেখানে এখনও প্রতিবছর ‘উরস’ হয়। উরসের মেলা বসে। পরবর্তীতে তাঁর ‘সাকরেদ’দের অনুরোধে এই দস্তুরপাড়াগ্রামে ঘাঁটি গাড়েন খোদাবক্সপির। বড়ঘাট্টাবিল লাগোয়া মাটির এক কুঠরি ঘরই তার ইহকালের জান্নাত। মাটির দেওয়ালের ওপরে খড়ের ছাউনি। ফালি উঠোনে কাগজি লেবুর গাছ। বাড়ির পিছনে ঘরের চালা ছুঁয়ে এক ঝাড় সিঙ্গাপুরি কলাগাছ মটকা ছায়া করে আছে। সে ছায়ার আড়াল দিয়ে খিলখিল করে আসমানের রোদ পড়লে লোকে বলে, ওই দ্যাখ আল্লাহ খোদাবক্সপিরকে নূরের আলো দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছেন! খোদাবক্সপির আবার অন্য দিকে নাম করা ‘ঘরামি’। মাটির দেওয়াল গাঁথা আর চালা-ছাউনিতে তাঁর আসমানি হাত। সবাই বলে, আল্লাহর ফেরেস্তার হাত। এ হাতে ঘর বানালে সে ঘর কক্ষণও ভেঙে পড়বে না। আল্লার আযাব গজবও নেমে আসবে না।

খোদাবক্সপির ‘মারফতি’ মতের বিশ্বাসী হওয়াই, এ গ্রামের বেশ কিছু ‘শরিয়তি’ মতবাদের লোকেরা তাঁকে মেনে নিতে পারে না। তারা বলে এসব ‘বুজরকি’, ‘শেরেকি’। মাঝে মধ্যেই দুই মতবাদীদের মধ্যে মতাদর্শ নিয়ে জোর টক্কর লেগে যায়। তক্কাতক্কি হয়। বাক-বিতণ্ডা হয়। কোনও কোনও দিন বচসা থেকে হাতাহাতিও লেগে যায়। কিন্তু খোদাবক্সপিরের অনুগামী বেশি থাকায় তারা বল’এ পেরে উঠতে পারে না। খোদাবক্সপির খুউব সাদামাটা মানুষ। নিরঅহংকারি। তাঁকে কেউ কখনও রাগতে দেখেনি! রাগ অভিমানের কথা বললে, তিনি বলেন, ইহজীবন আর কদিনের? আজ শরীরে রক্ত আছে কাল মাটি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, দুনিয়াদারির ওপর রাগ হলে কাফন আর কবরের কথা ভেবো। দেখবে, রাগ মুহূর্তে পানি হয়ে গেছে। এই সাধারণ রক্ত-মাংসের শরীরেই একটু একটু করে দানা বেঁধে ছিল পিরত্ব। তিনি জিনকে মুরিদ করতে পারেন।

 

দুই.

 

ভর দুপুর। গোরস্থানটা ঝিম মেরে ঘুমোচ্ছে। ভাট পিটুলি কেশে ঘাসের জঙ্গল বুন বেঁধে আছে। পাশের ডহর থেকে ভেসে আসছে কাদামাটির সোঁদা গন্ধ। তার ছুকছুক পানিতে লম্ফঝম্ফ খেলছে পানির পোকা। একটা কোলাব্যাঙ তড়াক করে ডাঙ্গা থেকে পানিতে লাফ মারল। ঝিনুকের মতো আকৃতির চওড়া গোরস্থানটা পূর্বে বড়ঘাট্টাবিল থেকে পশ্চিমে পদারবাগান পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় জুম্মাবারে ‘কবরজিয়ারত’ করতে আসেন পিরহুজুর। জুম্মার নামাজের পর পরেই মুখে আল্লাহর দোআ-কালাম আউড়াতে আউড়াতে সাগরেদদের নিয়ে তিনি সোজা কবরস্থানে চলে আসেন। আজ আসতে একটু দেরি হল। মসজিদে শিন্নি বিতরণ হচ্ছিল, তাতে আটকা পড়ে গেছিলেন। খোদাবক্সপির গোরস্থানের একেবারে মাঝে, যেখানে পাকুর গাছটা আধখানা আকাশ ঘিরে রয়েছে, সেখানে দোআ পড়তে পড়তে দাঁড়ালেন। মেজাল আজও একটা ফন্দি এঁটেছে। সে পিরহুজুরের ক্ষমতা পরখ করতে চায়। সে নিজের চোখে দেখতে চায়, খোদাবক্সপিরের অলৌকিক ক্ষমতা।

“হুজুর আমার দাদোর(ঠাকুরদা) কবরটা কতি করি আছে, বুলতি পারবেন? ঘেরাঘুরি নাই বুলি, সব কবরগুলানই তো মিশি গেলছে! তাই ঠিক করি জাগাডা বুঝতি পাচ্ছি ন্যা!” আচমকা প্রশ্নটা করে বসল, মেজাল। তারপর চোখ লুকিয়ে সাদেকের দিকে একবার তাকাল। আসলে সে ঠিকই জানে, তার দাদোর কবরটা আছে পাকুর গাছটা থেকে ফুট দশেক পশ্চিমে উঁচু ঢিবিটার কাছে। কিন্তু সে দেখতে চায়ল, খোদাবক্সপির ঠিক ঠিক বলতে পারেন কি না। পীরহুজুর যদি সাধারণ মানুষ হন তাহলে তাঁর বলতে পারার কথাই না, কারণ তার দাদো যখন মারা যান তখন খোদাবক্সপির এ গাঁয়ে আসেননি। মেজাল এমন প্রশ্ন করায়, সাদেক বাঁকা চোখে তার দিকে ধা করে তাকাল। গোলামও চোখ গরম করল। কিন্তু মেজাল ওসব পরোয়া করল না। খোদাবক্সপির চোখ জোড়া বন্ধ করলেন। মিনমিন করে কি সব দোআ পড়লেন। তারপর চোখ জোড়া বন্ধ থাকা অবস্থাতেই গড়গড় করে বলতে লাগলেন, “তুমি যেখেনে দাঁড়ি আছ, সেখেন থেকি কিছুটা হেঁটি তুমার ডান দিকে যাও। ঠিক পাকুর গাছটা থেকি নাক সুজা পশ্চিমে দেড় মানুষ লম্বা দূরত্ব যাও। গিয়িছ?” চোখ বন্ধ করে জানতে চায়লেন খোদাবক্সপির। হড়বড় করে জায়গাটায় হেঁটে গিয়ে একটা গা কাঁটা দেওয়া ভয়ের ঢোক গিলে থতমত করে বলল মেজাল, “হ্যাঁ, হুজুর, এসছি।“

“ওখেনেই তুমার দাদো আবুবাক্কার সেখের কবর আছে।“ চোখের পাতা বন্ধ করেই বললেন খোদাবক্সপির। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে মেজালের দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বললেন, “যেখেনে সেখেনে ক্ষমতা যাচাই কত্তে নাই, মেজাল।  আমল খাঁটাতে নাই। এসব গোপন জিনিস। লিজের মধ্যেই চেপি থুতে হয়। তুমি এ ভুল আর করো না।“

মেজালকে সতর্ক করলেন খোদাবক্সপির। মেজালুও পিরহুজুরের রুহানি (অলৌকিক) ক্ষমতার আঁচ পেয়ে ভয়ে গুটিসুটি মেরে গেল। তার চোখ জোড়া তখন ভয়ে ঘোলা হয়ে গেছে। সে থপ থপ করে হেঁটে এসে পিরহুজুরের দুই হাত জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “আমাকে মাপ করেন হুজুর। আমার ভুল হয়ি গেলছে। আমি আর কুনুদিন এ বেওয়াদপি করব না।“

পাশ থেকে সাদেক মনে মনে বিড়বিড় করে, দ্যাখ ব্যাটা এবার কেমন লাগে। কতবার কানের গোঁড়াই ঘ্যানঘ্যান করে বললাম, ওসব পরীক্ষানিরীক্ষা করতে যাসনে, পিরহুজুরের কাছে জিন মুরিদ করা থাকে। তোকে ফ্যাসাদে ফেলে দিবেন। ব্যাটা আমার কথা গেরাহ্যই করলা না। এখন দ্যাখ মজা!

সেই দিনের পর থেকে মেজালের মধ্যে অদ্ভূত পরিবর্তন দেখা দিল। গাঁয়ের এঁচোড় পাকা ছেলে রাতারাতি পাকা নমাজী বনে গেল! মুখে দাড়ি ছেড়ে দিল! মাথায় একভাঁজের ফেজ টুপি লাগাল! কথায় কথায় আল্লাহর নাম নিতে লাগল। যেন আঠারোআনা আলেম! সে সবসময় খোদাবক্সপিরের সাথে আঁঠার মতো লেগে থাকল। তার মতিগতি দেখে, গাঁয়ের সবাই বলতে লাগল, খোদাবক্সপির মনে হয় মরার আগে মেজালকেই তাঁর পিরত্বটা দিয়ে যাবেন। মেজাল রাতের অন্ধকারে পিরহুজুরের কাছ থেকে নেক আমলের তালিম নিতে লাগল। খোদাবক্সপিরও মেজালের নিষ্ঠা আর ভক্তি দেখে, তাকেই তাঁর উত্তরসূরি ভাবতে লাগলেন। তাকে আলেমের পাঠ দিতে লাগলেন।

“দ্যাখো মেজাল, এ পথ বড্ড কঠিন। অনেক দুআ-কালাম আমলনামার মধ্যে দিয়ী যাতে হবে। তুমি পারবা?”

“জী হুজুর, পারব। আপনার দুআ সঙ্গে থাকলেই পারব, ইনশাল্লাহ।“ মাথা নত করে উত্তর দিল মেজাল। তারপর আলতো করে চোখ তুলে জানতে চাইল, “হুজুর, আল্লাহকে পাবার সহজ পথ কী?”

“আল্লাহকে পাবার সহজ পথ নাই বাপ। লিজের মধ্যে ইমান আনতে হবে। লিজেকে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ কত্তে হবে। আল্লাহকে য্যামুন ভালবাসতে হবে, ঠিক ত্যামুনই আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিকে ভালবাসতে হবে। মুনে রাইখো, শুধু নমাজ-রুজা করেই আল্লাহকে পাওয়া যাবে না। তারজন্য কঠিন আমল কত্তে হবে। সঠিক ইবাদত কত্তে হবে। লিয়ম করি ইত্তেকাফ কত্তে হবে। লিজের হাড়মজ্জায় এলেম আনতে হবে।“

‘হুজুর, আপনি কি জিন দেখিছেন?”

“আল্লাহ, ফেরেশতা, জিন আর ইনসান সৃষ্টি করিছেন । নূর থেকি ফেরেশতা, আগুন থেকি জিন আর মাটি থেকি ইনসান বানিছেন। জিন আর ইনসানদের কাজকর্মের দেখভাল আর হিসেব নিকেশ রাখার দায়িত্ব দিয়ছেন ফেরেশতাদের। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে এটাও ঠিক করি দিয়ছেন যে, ইহকালে জীবিত অবস্থায় মানুষ খালি চোখে জিনদের দেখতে পাবে না, কিন্তু জিনরা মানুষদের দেখতে পাবে। তবে মানুষ যে অ্যাকেবারেই জিনদের দেখতে পাবে না, সেটা লয়। সেই ধারের ও ভারের নেক আমল থাকলে মানুষও জিনদের ইহকালে দেখতে পাবে।“

“জিনরা কি খুউব বদ হয়?”

“মানুষের মধ্যে য্যামুন ভালোমন্দ আছে, ঠিক ত্যামুনই জিনদের মধ্যেও ভালোমন্দ আছে। অদের মধ্যেও ‘ফিরকা’ আছে। একটা জিনিস মুনে রাইখো, আল্লাহ কেবলমাত্র জিন আর ইনসানদের জন্যে বেহেশত আর জাহান্নাম বানিছেন। তবে বদ জিনরা মানুষদের খুব জ্বালায়। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বুলি, হযরত আবু ইউসুফ সারুজী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, একবার এক মহিলা মদীনা শরীফে এক ব্যক্তির কাছে এসে বুলল, ‘আমরা তুমাদের বসতির কাছে নেমিছি, অতএব তুমি আমাকে বিয়ে করে লাও।‘ তো লোকটি সেই মহিলাকে বিয়ে কল্লো। রাত হলে সে নারীর রূপ ধরে স্বামীর কাছে আসত। একবার সেই জিন মহিলাটি স্বামীর কাছে এসে বুলল, ‘আমরা এবার চলি যাব, অতএব তুমি আমাকে তালাক দাও।‘ পরবর্তী কালে একবার সেই লোকটি মদীনা শহরের কুনু এক রাস্তা দিয়ি যাচ্ছিল, হঠাৎ তার লজরে পল্লো সেই জিন মহিলাটি দানাশস্য বহনকারীদের থেকি রাস্তায় পড়ি থাকা দানা কুড়াচ্ছে। তা দেখি লোকটি বুলল, ‘আরে, তুমি এখানে দানা কুড়াচ্ছ?’ একথা শুনে মহিলাটি তার দিকে চোখ তুলি তাকাল এবং বুলল, ‘তুমি কুন চোখ দিয়ি আমাকে দেখিছ?’ লোকটি বুলল, ‘দুই চোখ দিয়িই।‘ মহিলাটি ত্যাখুন লিজের আঙুল দিয়ি ইশারা কল্লো যার ফলে লোকটির চোখ উপড়ি বাইরে বেরিয়ে পল্লো। সুতরাং জিনরা খারাপ হলে, কিন্তু মারাত্বক হতে পারে। সবথেকে খারাপ জিন ফিরকা ‘শীআহ’।“

“হুজুর, ‘জিন মুরিদ করা’ জিনিসটা কী?”

“জিন বশ করি তাবে আনাকে ‘জিন মুরিদ করা’ বুলে। এটা যার তার কম্ম লয়। যারা প্রচণ্ড নেক আমল করেন, যাঁদের মধ্যে রুহানি ক্ষমতা আছে, তাঁরাই পারেন।“

“হুজুর, রুহ সম্বন্ধে কিছু বুলুন।“

“রুহু অর্থাৎ আত্মাই হল সব। আল্লাহ কেয়ামতের দিন রোজ হাশরের ময়দানে শুধুমাত্র এই আত্মারই বিচার করবেন। মুনে রাইখো, শরীল একটা খোল মাত্র। রুহ ওখানে কেবলমাত্র বাসা বাঁধে, এই যা। মল্লেই এই শরীল পঞ্চভূতে বিলিন হয়ি যাবে।“

“কিন্তু মানুষ মল্লেই কি তার রুহু সরাসরি আল্লার খাতায় জমা হয়ি যায়?”

“না, রুহু শরীল ছাড়ার আড়াই দিন পর আল্লাহর খাতায় জমা হয়। আর যারা পাপি রুহু তাদের সহজে আল্লাহর খাতায় জমা হতে চায় না। তারা ছটফট করি ব্যাড়ায়।“

“হুজুর, এই পাপি রুহু কুনগুলো?”

“যারা আত্মহত্যা করে তাদের রুহুকে ‘পাপি রুহু’ বুলে। এরা খুউব বদ হয়। মানুষের ক্ষতি করে। ভয় দ্যাখায়। গাছে গাছে চড়ি ব্যাড়ায়।“

গা ছমছম করে ওঠে মেজালের। সে ভয়ে পাগুলোকে আরও গুটিয়ে বসল। আশপাশে ঘুলি মারল। মনে মনে পিরহুজুরের শেখানো দোআ পড়তে লাগল। সিজদায় যাওয়ার মতো করে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। মিনমিন করে বলল, “হুজুর, অ্যাতদিনের পাপক্ষয় কী করি হবে?”

“আমল। আল্লাহর কাছে মুন থেকি ক্ষমা চাহাও। আল্লাহ পরম দয়ালু। রহমানের রহিম। তিনি নিশ্চয় ক্ষমা করবেন।“

মারফতি কথাগুলো বলেই খোদাবক্সপির জোরে জোরে ‘হক রব্বানা হক’ বলে গেংড়িয়ে উঠলেন। মেজাল ভয় পেয়ে তড়বড় করে, ‘আল্লা হু আকবার’ বলে ঠকাঠক সিজদা দিতে লাগল। খোদাবক্সপির তখন তার হাড়মজ্জা রক্ত-মাংসে মিশে গেছেন। মগজে দুনিয়াদারির তেল-নুন ফুড়ুৎ হয়ে আল্লাহর আসমানি দোআ-কালাম গেঁড়ে বসেছে।

 

তিন.

 

খোদাবক্সপির অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ‘কুতুব’ বনে গেলেন! অর্থাৎ আল্লাহর খুউব কাছের বান্দা বনে গেলেন। সাধারণত এত অল্প সময়ে কোন পির, পির থেকে কুতুব স্তরে উন্নিত হতে পারেন না। সেটা হতে গেলে আমলনামার অনেক স্তর পেরতে হয়। পির হচ্ছে মারফতি লাইনের সবচেয়ে প্রথম স্তর। সবচেয়ে উচ্চ স্তর হল ‘কুতুব’। এই স্তরে যাঁরা পৌঁছাতে পারেন, তাঁরা নাকি আশমানে আল্লাহর সঙ্গে ফেরেশতাদের ‘মিটিং’এ যোগদান করতে পারেন। এঁরা খুবই সম্মানের যোগ্য হন। পির-ফকির-দরবেশ-আম্বিয়া-আউলিয়া-গাউস-অলি-কুতুব, এইভাবে আমলের স্তরগুলি ওপরে ওঠে। কিন্তু খোদাবক্সর ক্ষেত্রে এতসব স্তরে পৌঁছতে হয়নি। তিনি একদিন মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন, হঠাৎ দেখলেন, গাছপালা-ঘরবাড়ি-পশুপাখি-জীবজন্তু-জগতের সমস্ত কিছু সিজদায় চলে যাচ্ছে ! এসব দেখে সঙ্গে সঙ্গে তিনিও সিজদায় নত হলেন । আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘পির’ থেকে সরাসরি ‘কুতুব’ স্তরে উন্নিত হলেন। এরকম ঘটনা খুব কম জনের ভাগ্যেই ঘটে। খোদাবক্সপির খুউব ঈমানদারপির বলেই তাঁর কপালে এরকম ঘটনা আল্লাহ লিখে দিয়েছিলেন। খোদাবক্সপির সাকরেদদের নিয়ে এ গাঁয়ে সে গাঁয়ের মসজিদে লোটাকম্বল বেঁধে রাতের বেলায় ‘জিকির’ করতে যেতে লাগলেন ।

সেবার গেলেন লোচনমাটি গেরামে। ঘরামি আর বাসনফেরিওয়ালাদের গেরাম বলে এ গেরামের একটা খ্যাতি আছে। ওখানে গিয়েই মাগরিবের নামাজ পড়লেন। পৌষের রাত। কনকনে শীত। চরাচর জুড়ে ঘন কুয়াশা। মাঠের ফসল সে কুয়াশায় জুবুথুবু হয়ে আছে। সবাই লেপ, কাথা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছেন। কিন্ত বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ আকাশে ঘন মেঘের উদয় হল! হাড়কাঁপানো জ্বাড়ের মধ্যেই কেমন যেন একটা গুমোট ভাব। হঠাৎ উত্তরে বাতাস থমকে গেল। বৃষ্টি নামবেই। এই অসময়ে বৃষ্টি! সবাই অবাক হল। এশার নামাজ শেষ হল। গাঁয়ের লোকে বলল, হুজুর আপনারা এই দুর্যোগে মসজিদে থাকেন না। মসজিদের চালা ফুটো। পানি পড়ে। লেপ-কাঁথা সব ভিজে জড়সড় হয়ে যাবে। তারপরে আকাশের দপদপানি দেখে ভালো লাগছে না। বাজটাজও পড়তে পারে।

খোদাবক্সপির বললেন, “সবই তো খোদাতালার ইচ্ছে। তিনি ভেজালে ভিজব। আপনারা আপন আপন বাড়ি চলি যান। আমাদের কথা একদম চিন্তা করবেন না। আমরা আল্লাহর মেহেরবানে ঠিক থেকি যাব। কুনু অসুবিধা হবে না, ইনশাল্লাহ।“

তারপর বারান্দার ছঞ্চে দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। তার অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখলেন, আল্লাহর ফেরেশতা মীকাঈল ডানাতে বৃষ্টি নিয়ে আসছেন। হাতে করে সে বৃষ্টি জমিনে নামানোর জন্যে আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় আছেন। কয়েকজন মুরুব্বি জোরাজুরি করেও যখন বুঝলেন, পিরহুজুর এ মসজিদ ছাড়বেন না তখন তারা হাল ছেড়ে দিলেন। গোলাম সেখ মসজিদের খড়ের চালার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখল, গোটা চালাটাই একেবারে ঝাঁঝরা। ফুটোর পর ফুটো। হলহল করে মেঘের পানি পড়বে। ফুটো দিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সে আর থাকতে না পেরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ”হুজুর, চরম ম্যাগ উইঠিছে! চড়াম চড়াম করি ম্যাগ ডাকছে! খ্যাচ খ্যাচ করি বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! আমাদের ইখানে থেকি যাওয়াটা কি ঠিক হল? কাহুর বাড়িতে ঢুকি পল্লিই তো হতোস?”

“গোলাম তুমার কাজ কী? ম্যাগের পানি মাপা না ‘আল্লাহর আমল’ করা?” ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে মিহি স্বরে আদেশভঙ্গী করলেন খোদাবক্সপির। গোলাম আর কোনও ‘রা’ করল না। সে পিরহুজুরের ইশারা বুঝে গেল। সবাই ‘জিকির’ তুলতে শুরু করল। মাঝখানে পিরহুজুরকে রেখে বাকিরা গোল হয়ে বসল। ‘লাইলাহা ইল্লালা’ বলে যেই ‘জিকির’ তোলা শুরু হয়েছে, অমনি ঝরঝর করে বাইরে বৃষ্টি নামল। অঝোর বৃষ্টি। কেউ বৃষ্টির দিকে নজর দিল না। ‘আমল’এ মগ্ন হয়ে গেল। যাকে বলে পিরে ক্ষির হয়ে যাওয়া। ‘জিকির’ মধ্যরাতে পড়ল। সবাই এবার উচ্চ স্বরে বলতে লাগল,

“হাসমি রাব্বি জালাল্লা

মাফি কালবে গাইরুল্লা

নুর মহাম্মদ সাল্লালা

হক লাইলাহা ইল্লালা।“

মাটির দেওয়ালের মসজিদটা তখন কাঁপতে শুরু করেছে! গমগম করছে ভেতরটা। মেজাল হঠাৎ করে পিরহুজুরের দিকে তাকিয়ে চোখ গোল্লা পাকিয়ে চমকে উঠল, “হাই আল্লা, ওটা কী!” মেজালের চিৎকারে বাকিদেরও ধ্যান ভেঙে গেল। সবার চক্ষু চড়কগাছ! কিন্তু সাহস করে কেউই পিরহুজুরকে ডাকতে পারছে না। তাঁর ধ্যান ভাঙাতে পারছে না। সবাই চোখ বড় বড় করে দেখছে, পিরহুজুরের ডান দিকের বুকটা বেলুনের মতো উঠছে আর নামছে! অনবরত ব্যাপারটা ঘটছে! সেই সঙ্গে সঙ্গে কপালের মাঝখান থেকে, একটা আলোর দ্যুতি নিক্ষেপিত হচ্ছে! “আমাকেই বুলতে হবে” বলে মেজাল সাহস করে পিরহুজুরের ধ্যান ভাঙিয়ে দুরুদুরু কণ্ঠে বলে উঠল, “হুজুর, আপনার বুকে অ্যা কী হচ্ছে! এভাবে বুক উঠানামা কচ্ছে ক্যানো? আপনি তো শ্বাস বন্ধ হয়ী মরি যাবেন! অ্যাক্ষুণই কবিরাজের কাছে চলেন।“

সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে! সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। অতি ধীরে ধীরে আলতো করে চোখের পাতা খুললেন খোদাবক্সপির। তারপর থুতনিটা বুকের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখলেন, ডানবুকটা উঠছে-নামছে। তিনি কয়েক মুহূর্ত পলকহীন চোখে দেখে একটা জোরে ফুঁ দিয়ে ধমকে উঠলেন, “এই কালেবজারি থাম।“

মুহূর্তের মধ্যে ওঠানামাটা থেমে গেল! উপস্থিত সকলে ‘থ’। আচমকা তারা উচ্চ স্বরে ‘হক রব্বানা হক’ বলে গর্জে উঠল। মুহুর্মুহু সিজদাহ দিতে লাগল। যেন মানুষগুলোর সাথে সাথে এবার ঘরটাও সিজদাহ দিতে লাগল। সিজদাহ দেওয়া শেষ হলে, মেজাল থতমত করে জিজ্ঞেস করল, “হুজুর, ‘কালেবজারি’ কী?”

খোদাবক্সপির হাঁটু পেড়ে বসে আছেন। থির মুখে শান্ত চোখ। দুই হাত দিয়ে মুখের দাঁড়িটা তিনবার নেড়ে বললেন, “’কালেবজারি’ হল ‘বোল ফুটানো’।“

“কীসের ‘বোল ফুটানো, হুজুর?” ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল, মেজাল। সে হাঁটুগুলোকে আর মেঝে চেপে বসল। মনের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। খোদাবক্সপির ব্যাখা করে বললেন, “’বোল ফুটানো’ বুলতে ‘জিকির’এর বোল ফুটানো। আমরা জিকির তোলার সুমায় মুখে যেসব দুআ-কালাম উচ্চারণ করি, সেসব একটা সময় জিকির তুলতে তুলতে যদি হৃদয়ে অর্থাৎ অন্তরে ধ্বনিত হয়, তাহলে তাকে ‘কালেবজারি’ বুলে।“

“হুজুর আমাদের ক্যানে ‘কালেবজারি’ হয় না?” পাশ থেকে প্রশ্নটা করল গোলাম। তার ভেতরের ধুকপুকানিটা এতক্ষণে থেমেছে। কয়রা চোখের শ্যামা মুখটায় তখন স্বস্থির ছাপ।

“তুমরা আমলের সেই স্তরে পৌঁছলে, তুমাদেরও ‘কালেবজারি’ লিশ্চয় হবে। তুমরা অ্যাখুনও সেই স্তরে পৌঁছাওনি। চলো, রাত চলি যাচ্ছে। ‘জিকির’এ মগ্ন হও।“ বলেই খোদাবক্সপির আবারও ‘জিকির’এ মগ্ন হলেন। এদিকে রাত পাতলা হয়ে আসছে। অন্ধকার ফুড়ে ঢুকছে চিকন আলো। ভোর দরজায় কড়া নাড়ছে। বৃষ্টি হচ্ছে, না হচ্ছে না, কারও সেদিকে খেয়ালই নেই। ‘ভোরের জিকির’এর বোল শুরু করলেন খোদাবক্সপির। সবাই তাতে কণ্ঠ মেলালেন,

“সোবহান আল্লাহ

সোবহানাল মাবুদ

হক লাইলাহা ইল্লালাহু

কারিমুল মাবুদ।“

‘জিকির’ করতে করতে ভোর হয়ে গেল। ‘ফজর’এর আযান দিল মেজাল। তার দরাজ গলা এ গাঁ পেরিয়ে তিন গাঁয়ে পৌঁছে গেল। ফজরের নামাজ পড়তে এসে মসজিদ চত্বর দেখে গেরামের মুরব্বি মুসল্লিদের চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল! তারা বিস্ময়ে হতবাক! এ তো মোজেজা! রাতে ঝমঝম করে এত বৃষ্টি হল, আর মসজিদের ভেতরে এক ফোঁটাও পানি নেই! লেপ-কাঁথাগুলোতে পানির ছোঁয়াও লাগেনি! অথচ অন্য দিন, মজাক করে এক ছটাক বৃষ্টি হলেই গোটা মসজিদটা পানিতে পাকিয়ে যায়। কাদায় খিচ খিচ করে। এ নিশ্চয় পিরহুজুরের মোজেজা! তারা সমস্বরে ‘সোভহান আল্লা’ ‘সোভহান আল্লা’ করতে লাগল।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment