শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

কবিতাকে তার হারানো চিহ্ন ফেরত দেওয়া

এই আলাপচারিতার একটা ছোট ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। দাবিদ উয়ের্তা (David Huerta) এস্পানিওল বা স্প্যানিশ ভাষার একজন প্রধান কবি। ওঁর জন্ম সিউদাদ দে মেহিকোতে ১৯৪৯ সালে। আমাদের হিসেবে ১৯৭০ এর দশকের কবি। শুরু থেকেই নববারোক কবিতা প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত। নানা সম্মানের মধ্যে মেহিকোর জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার ও রোমানিক ভাষা সমূহের সম্মিলিত সর্বোচ্চ সম্মান প্রেমিও ফিল পেয়েছেন। আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ ২০১৬ সালে। আমি তাঁর সঙ্গে গায়ে পড়েই ইমেইল এ আলাপ করি তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে। সেই থেকে উনি আমার কবিতা চর্চার এক প্রধান দিক প্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। আমাদের দীর্ঘ সব কথোপকথন এখনও জারি আছে। কারণ ওঁর কাছ থেকে শেখার শেষ নেই। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে যখন তাঁকে প্রেমিও ফিল দেওয়া হয় তখন আমারও কপালে জোটে এক বিরল সম্মান। পুরস্কারের অনুষ্ঠানে আমিই তাঁর সঙ্গে মেহিকোর মানুষজনের অর্থাৎ তাঁর নিজের দেশের মানুষের পরিচয় করিয়ে দিই এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায়। এইখানে আমার স্প্যানিশ ভাষায় নেওয়া সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করা হল বাংলায়। সেই দুরূহ ও পরিশ্রমসাধ্য কাজটি করেছেন, কলকাতার লোস ইস্পানোফিলোস নামক দলের এক প্রধান উদ্যোক্তা শুক্তি রায়। শুক্তিদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক একেবারেই আনুষ্ঠানিক নয়, তবুও তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানো এক জরুরি কাজ।   

– শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

‘কবিতাকে তার হারানো চিহ্ন ফেরত দেওয়া’ : দাবিদ উয়ের্তা’র সঙ্গে আলাপচারিতায় শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনুবাদঃ শুক্তি রায় 

 

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ  কবে থেকে লেখা শুরু করেছিলে তুমি ? সেই সময়ের কোনো কিছু কি মনে আছে তোমার ?

দাবিদ উয়ের্তাঃ আমি লিখতে শুরু করেছিলাম কিশোরবেলার শুরুর দিকেই। সারা পৃথিবীর সব কবিরাই যেমন করে থাকে। সত্যি বলতে কী, লেখা শুরু করার আগে খুব মন দিয়ে নানা কিছু পড়েছি আমি যেগুলি আমার মধ্যে খুব গভীর একটা প্রভাব রেখে গিয়েছিল (যাকে আমরা কুম্ভীলকবৃত্তির একেবারে প্রথম ধাপ বলতে পারি।)। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, ‘আমি কি এমন কিছু লিখে উঠতে পারব, যা আমি অন্য কবিদের মধ্যে দেখতে পেলে মুগ্ধ হই ? আমি কি আদ্যন্ত নিজের কবিতা লিখতে পারব ?’ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বা পাবলো নেরুদার মতো কবিদের কবিতা পড়ার পর ওই সামান্য কুম্ভীলকবৃত্তি আশ্রয় করে কবিতা লেখা, কিন্তু সেই সময় একটা বিশাল সিদ্ধান্তের মুহূর্ত ছিল কারণ ওই কবিদের ভাবনা এবং স্টাইল দুইই ছিল ভীষণভাবে অনুকরণ করার মতো। সে কারণেই আমার প্রথম কবিতাগুলো ছিল কৃত্রিম আবেগের, যা থেকে পরবর্তী সময়ে রচিত হবে কারো নিজস্ব স্টাইল, “নিজস্ব স্বর”। 

 

শুভ্রঃ আমার ধারণা প্রথম থেকেই তোমাকে এমন একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যা অন্যদের উপর প্রভাব ফেলেনি সেভাবে ; তা হল তোমার বাবার উপস্থিতি, যিনি মেক্সিকোর কবিতার ইতিহাসে চিরদিনের জন্য নিজের নাম খোদাই করে ফেলেছেন। শুরুতে কীভাবে তুমি নিতে এই বিষয়টা ? তুমি কি এই ব্যাপারটা থেকে পাশ কাটাতে চাইতে ? (আমার মনে পড়ে গেল লেসামা লিমার সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন, “সে-ই স্বেচ্ছাচারী যে মায়ের থেকে পালায়”। তোমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা মায়ের বদলে বাবা )

এই বিশেষ কপিটি এতকাল ছিল দাবিদের নিজের কাজের। এই বইটি থেকেই তিনি সব জায়গায় পড়তেন। লেখা আছে সেই কথাই।

দাবিদঃ আমার জীবনে এফ্রাইন উয়ের্তার উপস্থিতি কখনোই কোনো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেনি। কবি হিসেবেও না, বাবা হিসেবেও না। একেবারে কোনো সমস্যাই যে ছিল না, এমনটা নয়, কিন্তু সেগুলো নিয়ে আমি এখানে কথা বলতে চাই না কারণ সেগুলো আমার পারিবারিক জীবনের অংশ। আমি এ কথাই বলব যে আমার খুব ছোট বেলায় আমার বাবা মা বিবাহবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু আমার বাবা ভীষণ ভাবেই ছিলেন আমার জীবনে। প্রত্যেক সপ্তাহে উনি আসতেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি বলতে চাই যে আমি সেভাবে বলতে গেলে বাবাকে পাশে নিয়ে বড় হইনি ; আমি বড় হয়েছি আমার মা মিরেইয়া ব্রাবো-র সঙ্গে। ওই একই বাড়িতে আমার সঙ্গে থাকত আমার দুই বোন আন্দ্রেয়া আর এউখেনিয়া। আমার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে খুব বড় ভূমিকা ছিল আমার মায়ের, সম্ভবত আমার বাবার চেয়েও বেশি ছিল সেই ভূমিকা। মা লেখক ছিলেন না, যদিও তিনি লেখক হতেই পারতেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। আমার বাবা আমাকে সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রে অনেক সময় দিশা দেখিয়েছেন কিন্তু আমার কবি হয়ে ওঠার পথে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়াননি তিনি। বরং সাহয্য করেছেন আমার কবিতার প্রাথমিক শিক্ষার ভার ছেড়ে দিতেন তাঁর বন্ধুদের কাছে যাঁদের উপর তিনি ভরসা করতেন। গুয়াতেমালার কবি কার্লোস ইজেসকাস-এর মতো বন্ধুরাই ছিল আমার শিক্ষকের মতো। ও ছিল লেসামা লিমার এবং অন্যান্য কবিদের নিয়ে ওরিখেনেস  বলে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিগোষ্ঠী ছিল তখনকার কিউবাতে, তাদের সবারই খুব বন্ধু। সত্যি বলতে কী, আমাকে আমার বাবার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়নি কখনো। আমি তাঁর কাব্যশৈলীকে এড়িয়ে চলতাম কিন্তু কখনো তাঁকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবিনি বা রূপকধর্মিতার মাধ্যমে তাঁকে ধ্বংস করার চেষ্টা করিনি। 

 

শুভ্রঃ যখন তুমি প্রথম লিখতে শুরু করলে, তখন তোমার সঙ্গে কেমন ছিল তোমার বাবার সম্পর্ক ?

দাবিদঃ আমার সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক মোটের উপর ভালোই ছিল। শুরুর দিকে সে সম্পর্কে সাহিত্যের বাঁধন ততটা ছিল না। আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতাম বা স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখতাম। ওঁর সঙ্গে আমার সাহিত্যবন্ধন গড়ে উঠল আমার কিশোর বয়সে এবং সেটা ছিল আমার কাছে খুবই জরুরি উনি সেই সময় হাতে তুলে দিয়েছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কবিতার বই এবং বেশ কিছু উপন্যাস যার ফলে আমার মধ্যে ধারাবাহিকভাবে গল্প পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল তা সে ছোট গল্প, উপন্যাস বা জীবনী, যাই হোক না কেন । 

 

শুভ্রঃ  আমি তোমাকে আগেই লিখেছিলাম যে আমার জীবনের খুব মরমী একটা সময়ে তোমার কবিতার সংস্পর্শে এসেছিলাম আমি। আমার তখন কবিতা-তোতলামির সময় । তখন আমি হাতে পেয়েছিলাম বিখ্যাত ‘মেদুসারিও’ নামক কবিতা নববারোক রীতির কবিতা সংকলন। সেখানে আমি তোমার একটি গদ্যকবিতা আবিষ্কার করি। খুব শক্তিশালী ছিল সেই কবিতাটি এবং আমি এটাও বুঝতে পারি যে গদ্যের মাধ্যমে লেখা কবিতায় তোমার খুবই আগ্রহ আছে। তুমি যদি আমাদের কাছে ব্যক্ত করো সেই আগ্রহের কারণটা… 

দাবিদঃ  আমি সব সময়ই এই শৈলী (ফর্ম) টা খুব পছন্দ করে এসেছি। কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে এই ধারায় (‘genre’) লেখা আমার একটা বই। এই genre শব্দটাকে আমি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখলাম কারণ সাহিত্যধারাকে আদৌ কোনো genre দিয়ে ভাগ করা সম্ভব কী না এই নিয়ে আমার সংশয় আছে। আমার মনে হয় সাহিত্যকে কোনো genre এর মধ্যে আঁটানোর চেষ্টা করা মানে তার সম্ভাবনাকে আটকে দেওয়া। একই সঙ্গে সাহিত্যের তত্বের গুরুত্বকেও আমি ভীষণ ভাবে স্বীকার করি এবং genre এর সমস্যাকেও যথেষ্ট অনুধাবন করি।

 

শুভ্রঃ  গদ্যের মাধ্যমে কবিতার কথা বলতে গেলে মনে হয় যে স্পেনে কাব্যিক গদ্য কথাটা ব্যবহৃত হয় যার আসলে কোনো অর্থ নেই। আমার মতে আখ্যানই হোক, কবিতাই হোক, নাটকই হোক, প্রবন্ধই হোক, এগুলো সবই একটা করে মাধ্যম (যেমন একজন ভাস্কর ধাতু কিংবা পাথরকে তার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে)। তুমি কি এই genre গুলির প্রাথমিক পার্থক্যে বিশ্বাস করো না ? 

দাবিদঃ  আমার মতে সাহিত্যধারা বা genre পশ্চিমী ঐতিহ্যের অংশ এবং অন্য কোনো ঐতিহ্যেও কবিতার ক্ষেত্রে এটা একই রকম থাকবে। স্বল্প নিরূপিত ভাবে ভাবতে গেলে, কবিতাকে সাহিত্য ভাবা হয়ে থাকে। ব্যাখ্যাটা খুব সহজ… সভ্যতার শুরুতে তো কবিতাই ছিল তা সে হোমারের ছয় মাত্রার ছন্দই হোক আর ব্রোঞ্জ যুগের শ্লোকই হোক। কবিতার মাধ্যমেই দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষা থেকে আলাদা করা গিয়েছিল সাহিত্যের ভাষাকে। তারপর, এসেছে অন্যান্য সব রীতি যার মধ্যে আছে বাগ্মিতায় ভরা বিতর্ক থেকে শুরু করে দার্শনিক ধ্যানধারণা। এই মিডিয়ার যুগে সব কিছু ঝাপসা হয়ে মিলেমিশে গেছে একে অপরের সঙ্গে। সেই সব মিশে যাওয়া শৈলীগুলোর মধ্যে আছে ছন্দোবদ্ধ গদ্য থেকে গদ্যের ছন্দবিন্যাস পর্যন্ত সব কিছুই যাদের পরবর্তী দিনে হয়তো অভিহিত করা হবে genre নামে। কিন্তু এগুলি হল সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ আর একজন লেখক নিজে লেখার সময় এগুলিকে মনে রাখতে পারে না। 

 

শুভ্রঃ  এক এক সময় তো genre পাঠকের কাছে প্রতিবন্ধকতা মনে হতে পারে কিন্তু তোমার কি মনে হয় যে একটা সুন্দর আখ্যান কবিতার রূপ নিতে পারে ? অন্য দিকে আমি যখন আমার ক্লাসে গালেয়ানো-র লেখা পড়াই (ভালোবাসা আর যুদ্ধের দিনরাত) যাকে আমার ছাত্ররা (যারা খুব একটা কবিতা পড়ে না) কবিতা বলেই চিহ্নিত করে। এটা হয়তো তোমার genre সম্পর্কে সংশয়কেই প্রতিষ্ঠিত করে। আমার প্রশ্ন এই যে, এর পর আমরা বিভাজনহীন একটা অবস্থায় চলে যাব ? পদার্থ বিজ্ঞান খুঁজছে থিওরি অফ এভরিথিং, আবার জীববিজ্ঞান আবিষ্কার করছে একই সত্তার মধ্যে নানা ধরণের যৌনতার স্তর… 

দাবিদঃ  আমার তো মনে হয় আমি ইতিমধ্যেই তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ন্যারেশন বা আখ্যান নিয়ে কিছু বলার আছে আমার। কোনো একটা সময়ে পৃথিবীর এই অংশটায় আমাদের মনে হয়েছে যে সঠিক কারণ ছাড়া ইতিহাস বর্ণনা কবিতা হতে পারে না। এটা বর্বরতা। বলা হয়ে থাকে যে, ‘ঔপন্যাসিক এবং ছোট গল্পের লেখকরা ইতিহাস বর্ণনার দায়িত্বে; সে দায়িত্ব কবিদের নয়।’ এর ফলে কবিতা নিজেকে একটা রীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলল আর তা হল গীতিকাব্য রীতি। অথচ কবিতা তো চিরদিনই ইতিহাস বর্ণনা করে এসেছে… হোমার থেকে দান্তে, অ্যারিস্টো থেকে গঙ্গোরা, চসার থেকে মিল্টন আর শেক্সপীয়ার তো আছেনই। তারপর পুশকিন, ভিক্টর হিউগো, লেওপার্ডি ? আবার সংলাপ লেখার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। বলা হয়, ‘সংলাপ লেখা গল্প লিখিয়ে বা নাট্যকারের কাজ ; কবিরা সংলাপ লেখে না আর সেটা তাদের কাজও নয়।’ এটা আর এক প্রকারের বর্বরতা। গঙ্গোরার কবিতার প্রত্যুত্তরে লোপের লেখা সনেট সংলাপ আমার সব চেয়ে প্রিয় কবিতাগুলির অন্যতম। শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে সংলাপের মাধ্যমে কবিতা আছে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু অসাধারণ, যেমন লুইস দে গঙ্গোরার কবিতাগুলি। কবিতাকে শুধু গীতিকাব্যে নামিয়ে আনাটা… জীবনীমূলক তথ্যাবলী কে ‘কবিতায়ন’ এর নামে উৎসর্গ করা, আমি তোমাকে আগেই বলেছি শুভ্র, এক ধরনের ভুল ধারণার জন্ম দেয়। মহান মেক্সিকান কবি খোসে গোরোসতিসা বলেছেন, ‘আমরা গীতিকাব্যের সাম্রাজ্যে বাস করি’। তার সঙ্গে তিনি এই কথাটাও যোগ করেছেন, যে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই পথভ্রষ্ট হতে চায় না ‘ অনেকাংশেই।’

 

শুভ্রঃ  তুমি যদি এই বিভাজনে বিশ্বাস কর, তাহলে তোমার কাছে কবিতা মানে কী ?

দাবিদঃ  দেখো, আমি নিজেকে কবিতার সংজ্ঞায়নে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। কিন্তু যদি তার প্রয়োজন হয়ই, তবে আমি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের দেওয়া সংজ্ঞার কথা ভাবতে বলব, যিনি মোটামুটি এই কথা বলেছিলেন, ‘সব চেয়ে চমৎকার শব্দগুলিকে সব চেয়ে সুন্দর ভাবে বা সব চেয়ে অভিব্যক্তিময় ভাবে সাজানোর নাম কবিতা।’ এর মধ্যে কুৎসিত শব্দ থাকতে পারে, থাকতে পারে অশিষ্ট শব্দ, প্রযুক্তি জগতের শব্দ, ফাঁপা শব্দ কিন্তু সেগুলিই হল সব চেয়ে সুপ্রযুক্ত শব্দ। কবিতায় সেগুলোকে সাজানো হয় কবির ইচ্ছা অনুযায়ী, সবার আগে ঠিক সেই ভাবে যে ভাবে কবি তাদের মাধ্যমে কিছু বলতে চান।  

 

শুভ্রঃ  তুমি যখন গদ্যের মাধ্যমে কবিতা লেখা শুরু করলে, তখন তুমি কী ভাবে ছন্দকে নিয়ন্ত্রণে রাখলে ? (উদাহরণ হিসেবে, আমি যখন Versión [সংস্করণ] পড়া শুরু করি, তখন ‘বসন্ত’ কবিতায় দেখলাম en busca de un remedio, un saludable venono, una medicina de sombra [প্রতিকারের খোঁজে/ সুস্বাস্থ্যের বিষ/ ছায়ার ওষুধ] ) আমার মনে হয়েছিল যে ওই কবিতাটির ওখানেই শেষ হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু পরে অবাক হয়ে দেখলাম কবিতার শেষ লাইনগুলো ঃ es demasiado claro sentir en la tarde enorme… (এই বিশাল সন্ধ্যায় অতিস্পষ্ট বোঝাপড়া)… 

সাধারণভাবে আমি সেই শব্দের আওয়াজ সন্ধান করে চলি, যা আমাকে তৃপ্ত করবে, তা সে কবিতাতেই হোক বা গদ্যেই হোক, যা হল বর্ণনাতীত একটা অব্যক্ত অনুভব। আমি এ রকম অনুভব করি ঃ এটা এর চেয়ে সুস্পষ্ট বা এর চেয়ে পরিষ্কার হতে পারে না ; আর এর জন্য আমাকে আমার নিজের মননের গভীরে ডুব দিতে হয়, দেখতে হয় আমার ভিতরে এমন কিছু আছে কী না। লাইন ভেঙে লেখা  কবিতা কিন্তু আসলে অনেক বেশি খুঁতখুঁতে হয় আর তার মধ্যে থাকে বেশ কিছু আবছায়া অঞ্চল যার মধ্যে ঢুকে যায় ভেজাল (স্প্যানিশ প্রোসোমেত্রিকা, বা গদ্য ছন্দের কথা বলছি)। আমি আমার কবিতার পাঁচ মাত্রার ছন্দের ভিত্তি খুঁজি প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই। এছাড়া হতেই পারে না কারণ ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত স্প্যানিশ কবিতা (তার ইতালিয় উৎস সমেত) ‘এন্দেকাসিলাবো’ এবং ‘এপ্তাসিলাবো’ দ্বারা প্রভাবিত হবেই। আমি বলতে চাই সঠিকভাবে কবিতার লাইন লেখার চেয়ে জরুরি কিচ্ছু নেই, হয়ত আমাকে যারা পড়ছেন তাঁরা চমকে যাবেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে ইংরেজ কবি ডবলু এইচ অডেন এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। আর আবেগ বা অনুভূতির কথা বলতে গেলে ? আবেগ আর অনুভূতি তো সকলেরই আছে কিন্তু সবাই তো আর সনেট লিখতে পারে না বা কথাকে বাঁধতে পারে না ‘দেসিমা’ বা ‘ওক্তাবো রেয়াল’ ছন্দে। আর মুক্তছন্দে তো সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতার অভাব। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কবির স্বাধীনতা কিন্তু কখনোই অবাধ নয়। তার স্বাধীনতা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই। কবিতার ক্ষেত্রে আবেগ আর অনুভূতির একটা জরুরি জায়গা আছে ঠিকই কিন্তু তা একমাত্র জায়গা নয় এবং সবচেয়ে জরুরি জায়গাও নয়। আমাকে প্রায়ই ‘ফর্মালিস্ট’ হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় কিন্তু আমি যে সমানে বলি, ফর্ম বা বিন্যাস হল কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তুর ধারক, আমার সে কথা শোনে ক জন ?

শুভ্রঃ  এবারে বিষয়টা পুরোপুরি স্পষ্ট করে দিয়েছ তুমি। আমিও বিশ্বাস করি যে কবিতাকে সীমাবদ্ধ রাখা অথবা গতানুগতিক রীতিতে একে বেঁধে দেওয়া একটা ভুলই হয়েছিল। আমাদের মধ্য যুগের কথাও মনে রাখতে হবে। এই যে তুমি বললে, ‘বিষয়বস্তু ছাড়া কবিতা সম্ভবত ‘অর্থহীন শব্দ ব্যয়’ হয়ে ওঠে। 

কবির উপহার দেওয়া অনারোগ্য বইটির প্রথম সংস্করণের মলাট।

তোমার কাব্য সৃজনে ‘নভেম্বরের খাতা’ থেকে শুরু করে ‘ সংস্করণ’ হয়ে ‘অনারোগ্য’ পর্যন্ত যদি আমরা দেখি তাহলে যেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হল, যে তুমি কবিতার অনেকগুলি হারিয়ে যাওয়া চিহ্ন  ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছ। আমার প্রশ্ন হল এই যে, তুমি বইয়ের কথা ভাব কী ভাবে ? বইয়ের গঠন বা অবয়ব নিয়ে তোমার কী ধারণা ?

 

দাবিদঃ  তোমার কথায় যে ‘হারিয়ে যাওয়া চিহ্ন’  কথাগুলি এল, শুভ্র, সেটা খুব ভালো লাগল আমার। কবিতা তার চিহ্নগুলি  হারিয়ে ফেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, দীন মলিন হয়ে গেছে। তবে তার ব্যতিক্রমগুলি অসাধারণ ! ধরো ডেরেক  ওয়ালকটের কবিতা অথবা কোরাল ব্রাচোর কিংবা আদোনিস বা বেই তাও বা রাউল সুরিতার কবিতা। আর কবিতাকে তার হারিয়ে যাওয়া চিহ্ন ফিরিয়ে দেওয়ার কথাই যদি বলি, তুমি আমাকে ভাবার রসদ জুগিয়েছ। সম্ভবত সবটাই হারিয়ে যায় নি আর এতখানি দূরত্ব সত্বেও সেটা তুমি আর আমি বুঝতে পারছি  ভৌগোলিক দূরত্ব পার করে ইন্টারনেট আমাদের বেঁধে রেখেছে কাছাকাছি… আর আমরা আমাদের এত রকম চিন্তা ভাবনা বিনিময় করতে পারছি, সবগুলোর সঙ্গে সমানভাবে একমত হই আর নাই হই কথার বিনিময় হওয়া মানে সমস্ত পার্থক্য সমেতই একটা প্রাণময় যাত্রা শুরু হওয়া। কাফকার মতে বই হল এমন কুঠার যা দিয়ে একাকিত্বের বরফ ভাঙতে পারা যায়। এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলার নেই এই বিষয়ে।

আমি যখন একটা বইতে মনোনিবেশ করেছি, তখন আমার মনে এসেছে নানা রকম সঙ্গতির কথা তা সে ভালোবাসার জন্যই হোক বা ঐক্যের জন্যই হোক। আমার নিজের কয়েকটা বইয়ে তিনটে করে অংশ আছে আবার যেমন আমার অন্য বইগুলির মতো ‘নভেম্বরের খাতা’র কোনো সূচীপত্র নেই আমি আমার প্রকাশকদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলাম বইগুলিকে ওই ভাবেই প্রকাশ করতে। আবার কোনো কোনো বইয়ের একটা বিষয়বস্তু যেমন ‘কাহিনিরা’, যা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেমের সম্পর্কের জটিলতাকে বিবৃত করেছে। মাত্র কিছুদিন আগে আমি তো বেশ কেলেঙ্কারিই করে ফেলেছি কারণ আমি কোনো বিশেষ বিষয়বস্তু খুঁজে পাইনি আমার গদ্য কবিতার বইটির জন্য। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত আমার ‘অনারোগ্য’ বইটাতে ছিল ন’টা পরিচ্ছেদ। আমি অবশ্য ওদের ন’টা অধ্যায় বলতে চেয়েছিলাম উপন্যাসের অধ্যায়ের ধারণার জায়গা থেকে যার প্রতিটা অধ্যায়েই ছিল আমার নিজের জীবনের কাহিনির হালকা ছোঁয়া। সেই সময়টার যখন আমি সাংঘাতিক ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম মদের নেশায়। বইয়ের ন’টা অধ্যায় যেন ছিল আমার নতুন মানুষ হিসেবে পুনর্জন্মের ন’টা গর্ভাবস্থার মাস। যারা বইটার সঙ্গে মনে মনে একাত্ম হবে, তারা এটা সহজেই বুঝতে পারবে। সবে একটা প্রবন্ধের বই সম্পাদনা করলাম আমি। লিখিনি কিছু শুধু প্রস্তুত করলাম। লেখাগুলো আছে আগে থেকেই, আমি শুধু ওগুলোকে ঘষে মেজে সাজালাম ছাপতে যাওয়ার জন্য। 

 

শুভ্রঃ  প্রতিটি যুগেই, প্রতিটি রীতিতেই একটা আদর্শ (মার্কসীয়ই হোক আর ঐশ্বরিকই হোক) একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের শতকেই এই আদর্শগুলির বোধহয় খুব একটা স্থান নেই আর। এই বিশ্বাসহীনতার সময়ে তুমি তোমার মাঝ বয়স থেকে যা যা শিখে এসেছ, সেগুলোকে কী ভাবে কবিতায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাব ? তোমার মতে এখনকার সময়ে কী ভূমিকা হওয়া উচিত কবিতার ? 

আমাকে উৎসর্গ করা। লেখা আছে শুভ্রকে, গভীর স্নেহে, ¡গুয়াদালাখারাতে! এক বিরাট আলিঙ্গনসহ,

দাবিদঃ  আমি মনে করি কবিতার কাজ হল আমাদের নিজেদের মনের মধ্যে নিজেই একা লীন হয়ে বাঁচতে শেখানো। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে inscape বলে ইংরেজিতে একটা চমৎকার শব্দ আছে, যা স্প্যানিশে অনুবাদ করা মুশকিল। কথাটার মানে হল আমাদের নিজেদের অন্তর দৃশ্য। দেখো, আমার মনে হয় কবিতার ভূমিকা হল আমাদের এই অন্তর দৃশ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা, যা ক্রমাগত বাইরের জগতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। 

আর, আদর্শের কথা ! আমি আমার গোটা জীবন ধরেই বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাস রেখেছি, যদিও কঠোর ভাবে মার্ক্সিস্ট আমি নই আর খুব জঙ্গি মনোভাবও নেই আমার। এখন অবশ্য অনেক বছর যাবত আমি সব পার্টি থেকেই দূরে। আমি মানবাধিকারের সমর্থক, সমর্থন করি সেই সব সংগঠনকে যারা পরিবেশ রক্ষা এবং বন্যপ্রাণ রক্ষার জন্য সচেষ্ট। বামপন্থীদের মধ্যে সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রচণ্ড রকম সংবেদনশীলতার অভাব লক্ষ্য করেছি আমি। সেটা ভয় পাওয়ার মতো বিপজ্জনক। মেক্সিকোর অনেক বামপন্থীরা নিদান দিয়েছেন যে কবিতা কেবল ‘ধনীদের জন্যই’। তাই আমার পক্ষে এটা এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যে আমি এই ধরনের লোকজনের সঙ্গে চলব কিনা ! তাছাড়া, স্তালিনের আমলের রক্তাক্ত নারকীয় স্মৃতি ভুলে যাওয়াও সম্ভব নয়, যার ক্ষত দীর্ঘ দিন জুড়ে বয়ে বেড়াতে হবে বামপন্থীদের। মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য আমি মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম। তারপর অবশ্য পার্টিটাই উঠে যায়। এটা খুব মজার একটা বিষয় যে মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন ভারতীয়। তাঁর নাম মানবেন্দ্রনাথ রায়। তিনিও তোমার মতোই একজন বাঙালি ছিলেন।

 

শুভ্রঃ  কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, তোমার কি কখনো মনে হয় না কবিতার সঙ্গে শিল্পের অন্যান্য ধারাগুলিকে যুক্ত করা জরুরি?

দাবিদঃ  অনেক বছর ধরে আমি চিত্রকরদের সঙ্গে কাজ করেছি কিন্তু এখন সেই উৎসাহ হারিয়ে গেছে আমার। ওদের অনেক বেশি নজর থাকে বাজার আর অর্থের দিকে আর সেটা আমার মধ্যে অস্বাচ্ছন্দ তৈরি করে। তবে একটা ব্যতিক্রমও আছে ঃ আমার কাছে চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিস্কো তোলেদো দেশের সেরাদের অন্যতম। আমি ওঁর সঙ্গে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ এবং যখনই ও চেয়েছে, আমি তা করেওছি। ২০১৪ সালের নভেম্বরে ও আমাকে বলেছিল মেক্সিকোর একটা অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাওয়া মানে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক দল ছাত্রকে নিয়ে কবিতা লিখতে। আমি তা লিখেছিলাম। সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আয়োতসিনাপা’। কবিতাটা ওয়েবের মাধ্যমে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনূদিত হয় ২৩টি ভাষায় এই কবিতাটি আর আমার একার নয়। এই কবিতাটি সেই সব মানুষের যারা গোটা দেশের মানুষের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছিলেন ড্রাগ পাচারের ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যাওয়া ছাত্রদের সঙ্গে। তার মধ্যে আছে সরকারী স্তরের এবং পুলিশের আর সম্ভবত সেনা বাহিনীরও দুর্নীতির কথাও। আমি কিছু কিছু সঙ্গীত রচয়িতার সঙ্গেও হাত মিলিয়ে কাজ করেছি যদিও সেগুলির কথা খুব একটা বলা হয় না বা সামনে আসে না। আমার স্ত্রী বেরোনিকা মুরগিয়া নিজেও একজন অসাধারণ লেখক আর আছে একজন অসামান্য টাইপোগ্রাফার, খুয়ান পাস্কোয়ে… আমরা তিনজনে মিলে কিছু হাতে বানানো প্রকাশনা বের করেছি। এটা খুবই সম্ভব শুভ্র। হাতে লেখা কবিতা, গল্প এসব টাইপ করে বইয়ের রূপ দেওয়া !

 

 

শুভ্রঃ  নানা শতাব্দীর কথা বলতে গেলে, কবিতার পাঠকদের সম্পর্কে কী মনে হয় তোমার ? এখন তো কবিতার পাঠকরা আরো অন্যান্য শিল্প মাধ্যমেও অংশ নিয়ে ফেলছেন কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। ইতিহাসে এমনটা তো হয় নি আগে কখনো। তোমার কি মনে হয় আমরা আরো বেশি ঝুঁকি নিচ্ছি এই পরিস্থিতিতে ? আমাদের আরো বেশি সৃজনশীল করে তোলে ? 

 

দাবিদঃ  কবিতার পাঠক কবির চেয়েও বেশি করে বিরাজ করে সভ্যতার চূড়ায়। আমি এমন অনেক গুণী পাঠকদের সংস্পর্শে এসেছি যারা কখনো এক লাইন কবিতাও লেখেননি। আর যদি ঝুঁকির কথা বলো, তাহলে লেখা ব্যাপারটাই তো ঝুঁকির। একটার পর একটা শব্দ বসিয়ে মানুষের চিন্তার জগতকে আবিষ্কার করতে চাওয়া আর তারপর সেই প্রক্রিয়ার ভিতর থেকে অনন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করা ঃ এটা কিন্তু আমাজন বা গঙ্গায় নৌকা ভাসানোর মতো বা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে হেঁটে বেড়ানো অথবা মেরুজ্যোতির মধ্য দিয়ে উড়ে বেড়ানোর মতোই একটা ব্যাপার। এভাবে আমরা আমাদের সদবিবেচনা, মানসিক সুস্থিতি এবং অস্তিত্বের শান্তি সব কিছুকেই পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিই। কবিতার একটা উদ্দেশ্য হল স্বসুস্থিরতার অবস্থাকে ভাঙা অর্থাৎ সুস্থিরতা থেকে দূরে থাকা। শান্ত কবিতা হল দীর্ঘ সাধনার ফসল আর খুবই অন্য রকম এবং অনন্যসাধারণ একটা কিছু। 

 

 

শুভ্রঃ  কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে বলার সময়, অনেক সময়ই দেখেছি যে তোমার কবিতা তার নিজের ‘শরীর’কে বিষয়বস্তুতে পরিণত করে ফেলেছে। তুমি কি কিছু বলতে চাও এটা নিয়ে? 

দাবিদঃ  আমার মনে হয় কোনো না কোনো ভাবে সব কবিতাই তার নিজস্ব ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে থাকে আর সেভাবেই নিজেদের ব্যক্ত করে। তাছাড়াও, এমন একটা ধারণার অত্যন্ত লক্ষ্যণীয় বিষয় হল এই যে, যে কোনো কবিতাই কোনো না কোনো ভাবে কবিতার ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখে। হয়তো এটা একটু অতিকথন হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। অন্য ভাবেও এই ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে আর তা হল যা  ‘স্বপ্রাসঙ্গিকতা’। ওক্তাবিও পাস এভাবেই হয়তো ব্যক্ত করতেন ব্যাপারটাকে। উনি বলতেন যে এটা রেলগাড়ির শেষ কামরা থেকে ছিটকে আসা একটা বিন্দুর মতো। একটা স্বপ্রাসঙ্গিকতাসম্পন্ন কবিতা সহজ করে নিজেকে প্রকাশ করে। যেমন লোপে দে বেগা একটা সনেটের মাধ্যমেই বোঝাচ্ছেন যে কী করে সনেট লিখতে হয়। তিনি বলছেন, ‘দেখো কী ভাবে কোয়াট্রেট লেখে’ বা ‘আমি এখন ট্রিপলেট লেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে’। সেইগুলি পড়তে পড়তে আমরা বুঝি কীভাবে উনি কোয়াট্রেট লিখছেন বা কেমন করে ট্রিপলেট পড়তে হয়। এখানে ব্যাপারটা হল এই যে, কী ভাবে বিষয়বস্তু বা বিধিসম্মত ধারণাকে মেলাতে হয় এবং তাদের একত্রিত করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে আগে, যে কীভাবে গোইয়াকে নিয়ে লেখা রুবেন দারিয়ো-র ‘মোনোরিমো’ (যে কবিতার পুরোটাই একটা ছন্দেই লেখা হয়) র বিশেষত্বটা কী ? এই কাব্যরীতিতেই কেন লিখলেন তিনি ? এটা শুধু একটা আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। রুবেন দারিয়ো যে খুব একটা স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পী ছিলেন, এমনটা কিন্তু নয়। এই ট্রিপলেটগুলির ছন্দবিন্যাস থেকে বোঝা যায় যে কবি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গেই তার ছন্দ নির্বাচন করেছেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিধৃত আছে গোয়ার ছবি এবং স্কেচ নিয়ে তাঁর মনোভাব। তাই এগুলি হয়ে উঠেছে অমূল্য রত্ন বিশেষ। যাঁরা মনে করেন যে ছন্দ ব্যাপারটা অহেতুক অলংকার এবং অপ্রয়োজনীয়, তাঁরা ঠিক বলছেন না। একবার আমি একটা ছোট নিবন্ধ লিখেছিলাম এই বিষয়ে যখন আমার খুব প্রিয় কবি রবিনসন জেফারস আক্রান্ত হচ্ছিলেন সে সব সমালোচকদের দ্বারা, যাঁরা ছন্দকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। 

 

 

শুভ্রঃ  তোমার যাত্রাপথের একটা জিনিস আমাকে খুব অবাক করে আর তা হল যে তুমি মেহিকোর  কবিতার উজ্জ্বলতম কবিদের প্রজন্মভুক্ত হওয়া সত্বেও তুমি কবি হিসেবে নিজের যাত্রাপথকে কী ভাবে চিহ্নিত করলে ? অন্যদের তুলনায় তোমার কাজটা কি আরো বেশি কঠিন ছিল ? 

অনারোগ্য বইটির মধ্যে থাকা বুকমার্ক, তাতে দাবিদের ১৯৮৭ সালের ছবি।

 

দাবিদঃ  আমি জানি না আমি সচেতনভাবে কিছু করেছি কী না কিন্তু এটা বলতে পারি যে আমি এই বিষয়টা সব সময়ই মাথায় রেখেছি যে যদি আমি আমার ভালো লাগার বিষয়বস্তু এবং কাব্যরীতিকে গভীর ভাবে অন্বেষণ না করি, তবে সেগুলি হারিয়ে যাবে আর তখন আমার কবিতার খুব একটা মূল্য আর থাকবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়টা ছিল চাঁদের আয়নায় প্রতিফলিত সূর্যের আলোর মতো। আমি সেটাই লিখব যেটা শুধুমাত্র আমারই। যেটা কেবল আমিই লিখতে পারব, তার কোনো মূল্য থাক আর না থাক। একমাত্র সেটাই আমার কাছে অর্থবহ। আমি জানিনা যে আমি ঠিক এই পথেই চলেছি কী না। আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠকদের মধ্যে একজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘আপনার বাবা লিখতেন অণু কবিতা আর আপনি লিখেছেন ‘অনারোগ্য’, যেটা একটা ৪০০ পৃষ্ঠার কবিতা। এর চেয়ে স্পষ্ট ভাবে দুজনের পার্থক্য বোঝানো সম্ভব নয়।’ একভাবে কথাটা সত্যি হলেও সম্পূর্ণ ভাবে নয়। আমার অনেক কবিতাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জন্ম নিয়েছে আমার বাবার কবিতার ভিতর থেকে। বাবাকে এ ভাবে অনুসরণ করা আমার পক্ষে ঝুঁকি ছিল বটে কিন্তু আমি সেই ঝুঁকি নিয়েছি কারণ আমার গড়ে ওঠার পিছনে তাঁর অবদানকে আমি এভাবেই স্বীকৃতি দিতে চেয়েছি। আমি এফরাইন উয়ের্তার কবিতার অনুরাগী। 

 

 

শুভ্রঃ  তুমি তোমার কম বয়সের কথা বলেছ, তোমার প্রথম দিশারীদের কথাও বলেছ এবার বলো স্পেনের সুবর্ণ শতকের  কবিতার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের কথা। আমরা ওই যুগের কবিদের থেকে তরুণ কবিরা কী শিখবে ? তুমি কী শিখেছ ওঁদের কাছ থেকে ?

 

দাবিদঃ  সুবর্ণ শতকের ব্যাপ্তি ছিল ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে। সেই সময়ের কবিতা স্প্যানিশ ভাষায় লেখা আধুনিক কবিতার ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। যদি এই সত্যটা আমরা অস্বীকার করি, তাহলে স্পেনে  লেখা কবিতার সব কিছুই অস্বীকার করতে হয়; সেক্ষেত্রে আমরা স্প্যানিশ ভাষাতে লেখা কবিতা পড়ব কিন্তু তার ধারাবাহিকতার কথা জানব না। এটা হবে একজন মানুষের চিন্তা ভাবনার সঙ্গে বিন্ধুমাত্র পরিচিত না হয়ে তার নাম জানা, মুখ দেখে তাকে চিনতে পারার মতো। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু লেখককে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাঁরা যেন আর প্রাসঙ্গিকই নন। ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে কী বিশাল পার্থক্য আমাদের ! আমরা যদি শেক্সপিয়ার আর সেরভান্তেস-এর বার্ষিকী পালন দেখি, তাহলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। 

 

 

শুভ্রঃ  তুমি তো খোসে লেসামা লিমার কবিতার একটা বিশাল সমগ্র তৈরি করেছ। সেই অভিজ্ঞতার কিছু কথা বলো।

 

দাবিদঃ  এখন আর আমার সেই পরিস্থিতির কথা মনে নেই, যে পরিস্থিতিতে আমি ওই কাজটা করেছিলাম। আমার প্রচেষ্টায় ওই কিউবান কবির দ্বিতীয় কবিতাগুচ্ছ ছিল ওটা। প্রথমটা ছিল উনিবেরসিদাদ নাসিওনাল-এর উদ্যোগে করা একটা পুস্তিকা। আমার কাছে লেজামা লিমা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন  এবং এখনো আছেন অনেকগুলো কারণেই। আরো অনেক কারণের সঙ্গে এটা বলা খুবই জরুরি যে উনি প্রথম আমাকে এই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যে আমার কবিতাগুলিরও কিছু সাহিত্যমূল্য আছে। (ওঁর লেখা একটা চিঠিতে আমার প্রথম কবিতার বইটার একটা চমৎকার পর্যালোচনা ছিল) ; আরো অন্যান্য লেখার কথাও উল্লেখ করা জরুরি। তাদের মধ্যে কিছু লেখা নতুন আবার কিছু পুনরাবিষ্কৃত। গঙ্গোরা হলেন আমার সব চেয়ে প্রিয় কবি। আমি অন্যান্য ভাষায় লেখা কবিতাও পড়ি। যতটা আমার পক্ষে সম্ভব। আমি ভীষণ ভাবে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। 

 

 

শুভ্রঃ   তুমি “সারাজীবন ধরে লেখা একটা কবিতা”  বিষয়টায় বিশ্বাস করো ? তুমি যখন নিজের কবিতা সংগ্রহ ‘লা মাঞ্চা এল এল এসপেখো’ (আয়নায় দাগ) সংকলিত করলে, তখন কেমন ছিল তোমার অভিজ্ঞতা ? 

 

দাবিদঃ  বেশ অম্লমধুর ছিল সেটা, যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে ভালোই বলব আমি মূলত দুটো কারণে। আমি কবিতাগুলোর মধ্যে অনেক কিছু সংশোধন করতে পেরেছিলাম যা আমাকে ২০১৫ সালের জাতীয় পুরস্কার পেতে সাহায্য করেছিল। প্রথম কবিতাটির শিরোনাম ছিল ‘অনারোগ্য’ যা ছিল ১৯৮৭ সালে লেখা একটা দশ মাত্রা ছন্দ বিন্যাসের কবিতা। কবিতা সংগ্রহটা তৈরি করা খুবই পরিশ্রমসাধ্য ছিল যদিও আমার নিজের ক্ষমতাই নিজেই বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। ‘আমি লিখেছি এগুলো?’ আমি ভাবতাম। 

 

 

শুভ্রঃ  এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরিতে সাহায্য করা থেকে রাজনৈতিক পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লেখা পর্যন্ত তুমি তো এর আগে অনেক রকম পেশাতেই ছিলে। তুমি এখনো নানা রকম সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করে থাক। কী ভাবে এইসব কিছুকে এক জায়গায় আনো তুমি? 

আমরা গেছি মধ্যাহ্নভোজে। সঙ্গে রয়েছেন, মার্ক শেফার (দাবিদের ইংরেজি অনুবাদক ও কবি) ও গুয়াদালাখারা বইমেলার আয়োজকদের দুই প্রতিনিধি।

 

দাবিদঃ  তৃতীয় বিশ্বের, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার লেখকদের এই রকম অনেক কিছুকে এক জায়গায় আনতে শিখতে হয়। আমাকেও হয়েছে। আমি অনেক রকম পেশাতে হাত পাকিয়েছি। আমার সৌভাগ্য যে তার প্রত্যেকটাই কোনো না কোনো ভাবে সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। আমি প্রকাশনা সংস্থা, ফ্যাশন পত্রিকা এবং আমলাদের হয়ে কাজ করেছি (তাই আমাকে এমন এমন সব বক্তৃতা লিখতে হয়েছে যেখানে আসলে পার্টির প্রশংসা মধ্যে নিহিত মজার উপাদান কারো পক্ষে তেমন ভাবে বোঝাই সম্ভব নয়)। আমি এনসাইক্লোপিডিয়ার হয়ে কাজ করার সময় নানা ধরনের গুচ্ছ গুচ্ছ নিবন্ধ লিখেছি আবার ছাপার ভুলও শুধরেছি পাতার পাতার পর পাতা। এমন অবশ্য তার কোনোটাই আমি করিনা। আমি একজন সাহিত্য সাংবাদিক এবং নিয়মিত কলাম লেখক হিসেবেই কাজ করে চলেছি। এটা খুব বিশাল কোনো ব্যাপার নয়ঃ আমাদের দেশে এটা খুবই স্বাভাবিক যে একজন লেখক শুধুমাত্র লেখালেখির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পেরে ওঠেন না। যদিও মেক্সিকোতে সরকারের তরফ থেকে নানা রকম বৃত্তির একটা দারুণ ব্যবস্থা আছে, যা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। তা সত্বেও একজন লেখকের জীবন বেশ কঠিন এখানে এবং একটা ভদ্র জীবন যাপন করার জন্য আমাদের আরো অনেক কিছু করতে হয়। 

 

 

শুভ্রঃ  এমন অনেক কবি আছেন, যাঁরা ততটা সুপরিচিত নন অথবা প্রায়বিস্মৃত। তাঁদের মধ্যে কাদের কবিতা পড়তে তুমি উৎসাহ দেবে এই প্রজন্মকে ? 

 

দাবিদঃ  আমার বিচারে খাইমে রেইয়েস একজন অসাধারণ কবি। কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন তিনি। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম এবং আমি খুবই সম্মান করতাম ওঁকে। আমি রাউল গারদুনিয়ো এবং খোয়াকিন বাস্কেস আগিলার-এর কথাও বলব। এঁরা সবাই মেহিকোর কবি। নেস্তোর পেরলংগের আর্খেন্তিনার একজন অসামান্য কবি। তিনিও প্রয়াত হয়েছেন। ওই দেশের আর একজন কবি হলেন এক্তোর বিয়েল তেম্পারলি। 

 

শুভ্রঃ  শেষ করার আগে বলো কবিতার ক্ষেত্রে তোমার ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলির কথা ।

দাবিদঃ  আমি সব সময়ই পড়ে চলেছি আর এঁকে চলেছি কবিতার রেখাচিত্র। একটু আগেই বললাম যে আমি গদ্যে লেখা একটা কবিতার বই লিখছি, যেটা খুব বেগ দিচ্ছে আমায়, যা আমি সামলাতে পেরে উঠছি না।          

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment