মৌ ভট্টাচার্য

এথেনার দেশ—এথেন্সে

পায়ের তলায় সর্ষে

অ্যাক্রোপোলিস-আর-পার্থেনন

চলল ভোলা রইলো ঝোলা এই ভেবে বেরিয়ে পড়তে পারলে আর কোনো চিন্তাই থাকে না। ডেস্টিনেশন গ্রীস ও টার্কি। মার্চ মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি  ফিরছিলাম, অটোয় বসে অনন্ত অপেক্ষা অন্য যাত্রীদের জন্য। বসন্ত নেমে আসা হলুদ হ্যালোজেনের আলোর সাদার্ন এভিনিউ, কাছের বন্ধুরা যে যার মতো বেড়াতে গেছে, কোনো পিছুটান না রেখেই আমিও মাথার মধ্যে প্ল্যান বানাতে থাকলাম। দু তিন বছর আগে আমি আর অদ্রীশ ভেবেছিলাম যাব, আমাদের সেই অসম্পূর্ণ ইচ্ছের বাস্তব রূপ দিতে। পৃথিবীর ইতিহাসের আদিতম রূপকে চিনে নিতে। লিস্টে ছিল রোম, গ্রীস আর ইজিপ্ট। রোম দেখা হয়ে গেছে। এইবার গ্রীস পরেরবার ইজিপ্ট। গ্রীস যাওয়ার পথে টার্কিকেও যুক্ত করলাম কারণ দুটো দেশ কাছাকাছি। ফ্লাইটের টিকিট সস্তা হয়। ভাবা মতো কাজ। কোথায় কোথায় যাব তার ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চ করা। আমাদের তো সম্পত্তি বলতে বড় ফ্ল্যাট নেই, গাড়ি কেনার চাপ নেই, বন্ধুদের সাথে পয়সাকড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতা নেই, আছে কিছু বই, সিনেমা, গান আর পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ।

প্ল্যান প্রোগ্রাম রেডি যাওয়ার দিন এল। ব্যাগ গোছানো হল। চেক লিস্ট মিলিয়ে নেওয়ার পালা শেষ। জার্নিটা বেশ লম্বা। সস্তার টিকিটে যা হয়। কলাকাতা থেকে দিল্লি, এয়ারপোর্টে সারা রাতের অপেক্ষা। তারপর পরেরদিন সকালে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ইস্তানবুল, সেখানে আবার অপেক্ষা চার ঘন্টার; অবশেষে এক ঘন্টায় এথেন্স পৌঁছানো। দিল্লি

অ্যাক্রোপোলিস চত্বর প্রাচীনকালে যেমন দেখতে ছিল

এয়ারপোর্টে ইন্টারন্যাশনাল লাউন্জে অপেক্ষা করতে ভালোই লাগে। কত মানুষের আনাগোনা সারারাত ধরে। তারা কেউ নিজের দেশে ফিরছে তো কেউ চাকরি করতে পাড়ি দিচ্ছে দূরের কোনো দেশে। আবার কোনো বয়স্ক মানুষ একাই যাচ্ছে তার ছেলেমেয়ের কাছে সদূর আমেরিকায় । এইসব দেখে কফি খেয়ে দুটি ফরাসি মেয়ের সঙ্গে তাদের রাজস্থান বেড়াতে আসার গল্প শুনতে শুনতে রাত পেরিয়ে গেল। তারা বলল ‘ইন্ডিয়া ইস এ গ্রেট কান্ট্রি’, কত ভাষা, কত রঙ আর কত কালচার। আবার আসতে চায়, হিমালয় দেখতে।

আলো ক্রমে আসিতেছে

এনসিয়েন্ট অ্যাগোডার একটা অংশের সামনে

চেক ইন সেরে নিরপত্তার বেড়া পেরিয়ে অবশেষে বসলাম আমার সিট এ। আকাশে তখন সূর্যের প্রথম আলো, যেন কোন অনাদিকালের সুর শুনিয়ে গেল কানে কানে। ভোরের ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া। সবশেষের সিট কিন্তু জানালার দিকে। আমার পাশে আরেকটি জায়গা। পাঞ্জাবিদের একটা বড় গ্রুপ গ্রীস যাচ্ছে আমার সঙ্গে বেড়াতে। তাদের জন্য অনুবাদকের কাজ করতে করতে বাকি রাস্তা পেরিয়ে যাওয়া। সকালের নরম রোদ আর প্রাতরাশে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে টার্কিশ ডিলাইটের মিষ্টি আবেগের স্বাদ নিতে নিতে চোখ জুড়ে অনিদ্রাজনিত ঘুম নেমে এল। হঠাৎ বিমান সেবিকার সুমিষ্ট ঘোষনা, কিছুক্ষনের মধ্যই আমরা নামতে চলেছি ইস্তানবুলে, আতাতুর্ক বিমানবন্দরে। নজরুলের কবিতা মনে পডে গেল “কামাল পাশা”। যে মানুষ জন্ম দিয়েছেন আধুনিক তুরস্কের। তাঁর হাত ধরেই তাদের দেশে এসেছে মুক্তি আর গণতন্ত্র।

 

 

 

এনসিয়েন্ট অ্যাগোডা

ইস্তানবুল এয়ারপোর্টটি বেশ বড়। তবে বসার জায়গার বেশ অভাব। অজস্র দোকান । সেখানেও আমার কাজ হল অনুবাদকের। কয়েকজন বাংলাদেশী অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁদের দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাঁরা পড়ে বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁদের ফ্লাইট কখন কী ইত্যাদি, দীর্ঘদিন ধরে ভারত বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করার সূত্রেই বোধহয় কোথায় যেন তাদের প্রতি একটা সহানুভূতি অনুভব করি। আমি তাদেরকে সাহায্য করলাম আর শুনলাম তাদের গল্প। বাংলাদেশ গরীব, কত মানুষ কাজের জন্য অন্য দেশে যায় , সেখানে অনেক সময়েই তাদের ওপর অন্যায় অত্যাচার চলে অবশেষে মানুষগুলোকে প্রায় কপর্দক শূন্য হয়ে নিজের দেশে ফিরতে হয়। এঁদের সঙ্গেও তাই হয়েছে। এঁদের একজন ফরিদপুর থেকে অন্যজন রাজশাহী’র, এক বছর আগে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন কাজ করতে, কলের মিস্ত্রি। সেখানে সামরিক শাসন। নিরাপত্তার বালাই নেই। তাঁরা তাঁদের পয়সাকড়িও ঠিকঠাক পান নি। অতএব, সিদ্ধান্ত দেশে ফেরার। কাজের জায়গায় চুরিচামারি মারধোর, রাস্তায় বেরলে ছিনতাই আর মেয়েদের ওপর অত্যাচারের কথাই বলছিলেন তাঁরা। বিদেশে বাংলায় কথা বলছে এমন একজনকে পেয়ে তাঁরা বেশ খুশি। তাঁদের ফ্লাইটের সময়ে এগিয়ে এলে তাঁরা চলে গেলে আর অন্যদের কাছে এই অনুবাদকের দরকার পড়ে নি।
ইস্তানবুল এয়ারপোর্টের মজা হল সারি সারি দোকানে টাকিশ ডিলাইট সাজানো বিভিন্ন স্বাদের, কোনোটা পেস্তা দেওয়া তো কোনটাএলাচ, আলমন্ড নানাধরনের,টেস্ট পিস হিসেবে যত খুশি খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ওয়াই ফাই আধ ঘন্টার জন্য থাকে তারপর চলে যায়। স্টার বাকস বা কোনো দোকানে কফি অথবা কোনো খাবার খেলে অনেকক্ষন ওয়াই ফাই পাওয়া যায়। স্টারবাকস এ বসে গত কয়েক ঘন্টায় জমে থাকা মেসেজের টুংটাং জবাব দিতে না দিতেই বেলা গডিয়ে বিকেল। আবার নিরাপত্তার বেড়া টপকানো। লাইনে দঁডিয়ে পডলাম। আবার টাকিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট তবে এবার যাত্রা এক ঘন্টার। ফ্লাইট ছাড়তে যত দেরী হচ্ছে ততই আমার টেনশন বাডছে এথেন্সে পৌঁছোতে দেরী হবে, এয়াটপোট থেকে হোটেল বেশ দূর। সোলো ট্রিপ বা একা থাকার মজা যেমন আছে তেমন তার ভালো খারাপ সবকিছুর দায় নিজের। যাইহোক এইবার ঘোষণা ফ্লাইট ছাড়বে। ফ্লাইটে উঠে দেখলাম আমার মাঝের সিট, দুপাশে দুজন গ্রীক সুপুরুষ। ফ্লাইট ছাড়ল , পুরো যাত্রাটাই এজিয়ান সি র ওপর দিয়ে। এদিক ওদিক টুকটাক কথা বলতে বলতে ভালো রকম আড্ডা জমে গেল পাশের গ্রীক পুরুষ জর্জ এর সঙ্গে। কিছুক্ষন বাদে জানলা দিয়ে হঠাৎ দেখতে পেলাম নীচে এথেন্স শহর আলোর মালায় সেজে রয়েছে যেন আমাকে ওয়েলকাম জানাচ্ছে হাজার হাজার বছরের সাক্ষী হয়ে দঁাডিয়ে থাকা ইতিহাস।

সহযাত্রী জজ এথেন্স কয়েন মিউজিয়ামের কিউরেটর। আমাকে অতরাতে হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা সেই করল। আমার পয়সা যাতে কম লাগে সেইজন্য কোনওভাবেই ট্যাক্সি নিতে দেওয়া হল না, এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রোতে দশ ইউরো দিয়ে সিনতাগমা স্টেশন সেখান থেকে জজ চলে গেল তার রাস্তায়। আর আমি অন্য ট্রেন ধরে ‘মোস্ট নটরিয়াস প্লেস অফ এথেন্স’। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওমোনিয়া তে পৌঁছালাম , রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ হোটেলে। এরপর শুধু ঘুমের অপেক্ষা, সারাদিনের ক্লান্তির পর নরম বিছানার ওম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। বাইরে তখনও অস্তগামী সূযের শেষ পরশটুকু লেগে আছে।

ছিটকিনি উপাখ্যান

সুপ্রভাত এথেন্স। বেড়াতে যাওয়ার উত্তেজনা আমার ভেতরে এতটাই থাকে যে নতুন কোনো জায়গায় ঘুম আসতে চায় না, তার ওপর অল্পস্বল্প জেটল্যাগ। পরের দিন সকালে ছটার মধ্যে ঘুম ভেঙে গেল। বন্ধু নাজেস দা বলে দিয়েছিল যে সকাল সকাল এক্রোপোলিস দেখতে যেতে, নাহলে ভিড় বেড়ে যাবে। স্নান সারতে বাথরুমে গেছি। অতি আধুনিক সব কল কব্জা নেডেচেডে অবসন্ন শরীর জুড়ে নেমে এল ঠান্ডা জলের ধারা। স্নান সেরে দরজা খুলব , কী বিপত্তি দরজা খোলে না। অনেক টানাটানি করেও শেষে যখন খুলেছে না দরজা তখন বোঝা গেল লক হয়ে গেছে। এদিকে বাথরুমে এমারজেন্সি কল করার কোনো ফোন ও নেই যা কোনোকোনো হোটেলে থাকে। একটা ছোট্টো জানলা ছিল সেটা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম যে আমার ঘরটি হোটেলের পেছনের দিকে। যাইহোক সেখান দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার, “ প্লিস হেল্প মি”, আমার ওই আওয়াজে কাছাকাছি বাড়ি থেকে কুকুর চিৎকার করে উঠল, কিন্তু কোনো মানুষ সাড়া দিল না। সময় যাচ্ছে চিৎকারের সঙ্গে কিন্তু উত্তর আসে না। হঠাৎ একজন পুরুষের গলা, তাকে জানালাম আমি হোটেলের বাথরুমে আটকে আছি, আমার রুম নম্বর দিয়ে বললাম হোটেলের রিসেপশনে জানাতে যাতে তারা আমাকে উদ্ধার করতে পারে। সেইমত কাজ ও হল। হোটেলের লোক এসে দরজা খুলে আমাকে বলে দিয়ে গেলেন আর যেন বাথরুমের দরজা বন্ধ না করি যেহেতু আমি একাই আছি অতএব দরজা বন্ধ করার কোনো দরকার নেই সে অর্থে। এরপর যতদিন যেখানেই গেছি হোটেলে বাথরুমের দরজা বন্ধ নৈব নৈব চ। কথা না বাড়িয়ে প্রাতরাশে গ্রীক স্যালাড ফল এইসব খেয়ে রওনা হলাম এক্রোপোলিস দেখতে।

আগের দিন রাতে জর্জ বলেছিল যে ওমনিয়া মানে যেখানে আমার হোটেল সেটি মোস্ট নটরিয়াস প্লেস ইন এথেন্স। তখন বুঝিনি পরে বিস্তারিত জানতে পারলাম। জায়গাটা খুব সেন্ট্রালি  লোকেটেড।কিন্তু বেশিরভাগ এশিয়ান মানে বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, ইরানি, কুদিশ, আফগানিস্তানি রা থাকে। সেখানে তারা তাদের দোকান চালায়। গ্রীস হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার গেটওয়ে। একবার ঢুকে পড়তে পারলেই বাদবাকি সেনঙ্গেন দেশগুলোতে ঢুকে পড়া কোনো ব্যাপারই নয়। গ্রীসের ওপর এই নিয়ে জার্মানি, ফ্রান্স আর স্পেনের মতো বড় দেশগুলো দাদাগিরি চালায়। বেআইনিভাবে যারা ঢুকছে তাদের দায়িত্ব গ্রীসকেই নিতে হবে। ওমনিয়াতে এমন বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশকারীরাই থাকে মূলত। তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে, মাঝে মাঝে গোলাগুলি চলে এমনকি পুলিশ ও এখানে আসতে ভয় পায়। তারা নিজেরাই তাদের অঞ্চলের দাদা । গ্রীস কিন্তু  অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বেশ চাপেই থাকে। সহযাত্রী জর্জ সতর্কবানী দিয়েছিল রাত বারোটার মধ্যে হোটেলে ফিরে আসতে। যথারীতি সে সতর্কবানী কানে পৌঁছালেও মর্মে প্রবেশ করে নি।

রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম অনেক ছোটো ছোটো দোকান। বেশীরভাগ দোকান চালায় বাংলাদেশীরা। এমনই একটা দোকানে ঢুকলাম সিম নিতে। বাংলাদেশী মানুষ বাংলায় কথা বলছি দেখলে তাঁদের সহমর্মিতা বেড়ে যায়। তাঁর থেকে সিম কিনলে তিনি আমাকে বাংলাদেশের আতিথ্য সহকারে এক বোতল জল উপহার দিলেন আর বললেন “আপা খুব গরম তো পানিটা কাজে লাগবে”। অচেনা মানুষের এই বন্ধুত্ব প্রাণে বাজে। দেশে চেনা বন্ধুরাই এমন ব্যবহার করেনা।

হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি

অ্যাক্রোপোলিস স্লোপের এন্ট্রান্স
অ্যাক্রোপোলিস মিউজিয়াম

ঝকঝকে নীল আকাশ, সামারে ইউরোপ যেমন হয়। পাথরের রাস্তায় হাই হিলের আওয়াজ। রঙ বেরঙের পসার পেরিয়ে ঢুকলাম মেট্রোতে। এক্রোপোলিস দেখতে। মন ভালো করা আবহাওয়া, মানুষজনও কেমন খুশি খুশি, গরমের ছুটি কাটাতে, এক্রোপোলিসের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম টিকিটের জন্য বিশাল লাইন পডে গেছে। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বন্ধুত্ব হয়ে গেল স্পেন থেকে আসা জেসিকা’র সঙ্গে। ও আর ওর পুরুষ বন্ধুটির সাথে গল্প করতে করতে লাইন এগোলো। এক্রোপোলিস স্লোপে পৌঁছেলাম, টিকিট দেখিয়ে ঢুকলাম এর ভেতরে।ঝকঝকে রোদে নীল আকাশের মাথা ফুঁডে দূরে দাঁডিয়ে আছে পাথেনন এর মন্দির। অনেকটা উঁচুতে উঠে সেখানে পৌঁছানো। বিদেশীদের সাথে পা মিলিয়ে আমিও চললাম। কোনো ভারতীয়কে সে পথে দেখা গেল না।
প্রাচীন গ্রীসে এক একটা নগর নিয়ে গড়ে উঠত নগর রাষ্ট্র। আবার নগররাষ্ট্রগুলোর প্রত্যকের এক একটা নিজস্ব দেবতা ছিল যার ওপরে নগরের ভালোমন্দ, সুরক্ষা সবকিছু নির্ভর করত। এথেন্সের দেখভালের জন্য এক্রোপোলিসে পার্থেনন নামে এথেনার রাজকীয় দেবমন্দির ছিল। এর যা কিছু শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, স্থাপত্য সব কিছুই ছিল দেবী এথেনার গৌরবের বাহক। এই মন্দিরের পৃষ্টপোষক হলেন স্বৎং দেবী এথেনা। এথেন্সের গৌরবের যুগে এই মন্দির গড়ে ওঠে।
এক্রোপোলিস স্লোপ পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর পার্থেনন চত্বরে উঠতে সময় লাগল প্রায় আধ ঘন্টা। পার্থেনন চত্বরে উঠেই সারা এথেন্স শহরটা দেখা যায়। একপাশে পার্থেনন মন্দির যার এক অংশে সারাইয়ের কাজ হচ্ছে। অন্যদিকে মন্দিরের ভাঙা কিছু ধ্বংসাবশেষ। নিজেকে ইতিহাসের সাথে হারিয়ে ফেলা। কত কত কত হাজার বছর ধরে দাঁডিয়ে আছে ইতিহাস , এর ওপর বিভিন্ন দেশের আগ্রাসন, কতবার ভেঙ্গেছে আবার তৈরি হয়েছে পুড়েছ গেছে তাও সে রয়েছে তার মহিমায় অটুট হয়ে। প্রাচীন গ্রীকরা বিশ্বাস করত বারোজন দেবতাকে। কিন্তু এখন যা গ্রীসের অবস্থা সেখান থেকে তাদের এই দেবতারা উদ্ধার করতে পারে নি দু:খ সেখানেই।ঋণের বোঝা বয়ে চলেছে আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের দাদাগিরি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । এথেন্স শহরের যেখানেই যাওয়া যাবে সেখান থেকেই দেখা যাবে এক্রোপোলিস উঁকিঝুঁকি মারছে। পাওয়ার অফ কন্ট্রোল দেবী এথেনার হাতে। সব দাদাগিরিকে তোয়াক্কা করে দেবী এথেনা এখনও তার শহরকে রক্ষা করে চলেছে।

এইবার নামার পালা। নামার রাস্তার মাঝখানে একটা এ্যম্পিথিয়েটার। সেই সময়ে সাধারণ মানুষরা এসে জড়ো হত, তাদের বিনোদনের জায়গা ছিল এটা। রোদ বাড়ছে, গরম বাড়ছে, জল তেষ্টা পাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশের দেওয়া জলপান করতে করতে নামছি। নেমে এসেই পাওয়া গেল ছোটো ছোটো কিছু দোকান। দোকানগুলো পেরিয়ে সোজা হাঁটলেই এক্রোপোলিস মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি দেখার মত। সমস্ত ইতিহাস ধরা আছে সেখানে। গেট দিয়ে ঢুকেই সক্রেটিসের মূর্তি।  সেটির পাশ দিয়ে তিনতলা অবধি উঠে দেখে নিতে হবে পুরো মিউজিয়ামটি। তিনতলার একটা ঘরে বড় স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে ইতিহাস, কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মধ্যে দিয়ে বোঝানো হচ্ছে তার স্ট্রাকচার, কিভাবে তৈরি হয়েছিল, খুব সুন্দর করে বানান ভিডিওটি।

গ্রীক সালাদ, রিসোটো, গ্রীক কফি আর ওয়াইন

এক্রোপোলিস মিউজিয়াম দেখা শেষ করতে করতে বেলা গড়িয়ে দুপুর। পেটে খিদে, এত হাঁটাহাঁটি করে সকালের সব খাবার হজম হয়ে গেছে। এইবার দৌড়চ্ছি এক গ্রীক সুপুরষের সাথে দেখা করতে, যাকে কলকাতার অনেকেই চেনেন। তার গবেষনার সূত্রে সে দুবার কলকাতায় এসেছিল, আমার চেনা একমাত্র গ্রীক, আলেকজান্ডারের পরে, ভরসা তার ওপর। আগেও দেখেছি যে স্থানীয় কোনো মানুষ চেনা থাকলে ঘুরে বেড়ানো অনেক সুনির্দিষ্ট হয়। এবারেও তাই হল বন্ধু স্ট্রাভরস’র গাইডেন্সে। নাজেস দা আমাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আগেই। আলাপ আন্তর্জালে আর বন্ধুত্ব হল এথেন্সে এসে। আলো ঝলমল শহরে মিউজিয়ামের বাইরে বেরিয়ে এসে যদি দেখা যায় ছ’ফুটের ওপর লম্বা কোনো উন্নতনাসা গ্রীক পুরুষ অপেক্ষা করছে তাহলে সেই বেড়ানোতে অন্য এক মাত্রা যোগ হয়। হাতে কি কোনো অলিভ পাতা ছিল আজ আর মনে পড়ে না।

 

সালাদ, সুভলাকি, হালুয়া, ক্যাশে অ্যালফ্রেডো

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আকাশে তখন থমকিয়ে আছে মেঘ

মনাস্তিরাকি স্কোয়ার

অলিভ, উইলো আর মেপেলের সারি দিয়ে সাজানো এথেন্স শহর। পাহাড়ি চড়াই উৎরাই ভেঙে আমি চলেছি স্ট্রাভরস্ এর সাঙ্গে লাঞ্চ সারতে। এক্রোপোলিস মিউজিয়ামের পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেই যে জায়গাটা এল তার নাম প্লাকা। অনেক দোকান রঙ বেরঙের জিনিসে সাজানো। মূলত টুরিস্টদের জন্য। একটা দোকানে অনেক বাদ্যযন্ত্র সাজানো, সেখানে বোজুকি দেখলাম। রেবেটিকো জনর এর মিউজিকের সাথে এটি ব্যবহৃত হয়। গ্রীসে খুবই জনপ্রিয়। এই যন্ত্রটির গ্রীসে আমদানি হয় মূলত ১৯২২ -১৯২৯ এর এশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে। সেই সময়ে গ্রীসের আদি বাসিন্দারা নিজের দেশে ফেরত আসে টার্কি থেকে যন্ত্রটিকে নিয়ে। এর আওয়াজে এক অদ্ভুত বিষাদময়তা আছে। ম্যান্ডোলিনের আওয়াজের কাছাকাছি খানিকটা। শেখার ইচ্ছে আপাতত মনের মধ্যে রেখেই রাস্তা পেরলাম, কোনো এক অথেন্টিক গ্রীক রেস্টুরেন্টের খোঁজে।

রোমান অ্যাগোডা
জিউসের মন্দির চত্বর

হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি এথেন্সে। আমার গ্রীক বন্ধু বলল বাঙালী মেয়ে কলকাতা থেকে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে এসেছে অসময়ে। গ্রীক স্যালাড, গ্রীক রিসোটো আর গ্রীক ওয়াইনের সঙ্গে লাঞ্চ সারলাম। কফির মূর্ছনা থেকে শুরু করে গ্রীসের অথনৈতিক অবস্থা ও অ্যাঞ্জেলোপুলস সবই উঠে এলো সেই আড্ডায়। আমার যাওয়ার পনেরো দিন আগে এথেন্স থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড হয়। বলা হয়েছিল সেটি দাবানল। প্রায় একশ’র বেশি মানুষ মারা যায় সেখানে। থিও অ্যাঞ্জেলোপুলসের বাড়ি সেখানে ছিল, সেই বাড়িতে তাঁর চিঠিপত্র এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ওঁর মৃত্যুটাই তো যথেষ্ট বিতর্কিত, শেষে এই ঘটনা চিন্তাশীল মানুষদের মনে আরও সন্দেহ তৈরি করে, তাঁরা মনে করেন এটা সম্ভবত অন্তর্ঘাত। সমস্ত প্রমাণ লোপাট করতেই আগুন লাগানো হয়। এইসব কথাবার্তা শেষে আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। এক পশলা বৃষ্টি শেষে আবার ঝকঝকে রোদ, বিকেল গড়িয়ে আসছে, সূর্যাস্ত হতে হতে প্রায় সাড়ে সাতটা।
এথেন্সের অলিগলি দিয়ে ঘুরে বেড়ানো অসামান্য অভিজ্ঞতা, যেন ইতিহাসের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা। স্ট্রাভরস বলছিলো যে এই প্রজন্ম সেই ইতিহাসে আর আস্থা রাখে না, তারা তাদের অন্ন বাসস্থানের যোগাড় করবে নাকি বারোজন দেবতাকে নিয়ে মেতে থাকবে। তা করলে তো তাদের সংসার চলবে না। মিথোলজিকে তারা সম্মান দিতে পারে কিন্তু আস্থা রাখার কোনো প্রশ্নই নেই।
খুব কষ্ট হচ্ছিল ওদের তরুণ প্রজন্মের কথা শুনে। দেশের অর্থনীতির ওপর ভরসা নেই। বড় শহরগুলোতে চাকরির অবস্থা বেশ খারাপ। বেশীরভাগ অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা তাই সিজনে আইল্যান্ডে কাজ করতে চলে যায়। সেখানে যেমন পয়সা বেশী তেমন পরিশ্রম বেশি আর কোনো ছুটি নেই। অক্টোবরের শেষে ছুটিতে বাড়ি আসা। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে চায়, সেখানে চাকরি আছে পয়সাও আছে, কিন্তু ভাষার সমস্যা, এরা ততটা ভালো ইংরিজি জানে না। ইংরিজির দাদাগিরিতে তারা পিছিয়ে পড়ছে।

 

প্রহরীর মত রাত জাগে ভালোবাসা

এখানেই ছিল একসময় অ্যারিস্টটলের ফিলোসফিক্যাল স্কুল

অস্ত যাওয়া সূর্যের সঙ্গে মন খারাপ করা সন্ধ্যা নেমে এল শহর জুড়ে। এ শহর আমার নয় অথচ মনে হয় কতদিন ধরে আমি চিনি। আলেকজান্ডারের হাত ধরে, আ্যরিস্টটলের চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়ে। স্ট্রাভরস খানিকটা আগেই বিদায় নিয়েছে, পরের দিন দেখা হবে এই আশা দিয়ে। যাওয়ার আগে কয়েকটা পাবের হদিশ দিয়ে গেছে। সেইমত সিনতাগমা স্কোয়ারের কাছে একটা পাবে বসে আছি আর ভাবছি এই রাস্তা দিয়েই হয়তো হেঁটেছিলেন তাঁরা, যাঁরা সারা পৃথিবীকে শিখিয়েছেন চিন্তা করতে। কফি-কাপে তুফান তুলেছিলেন, তর্ক করেছিলেন। দূরে দেখা যাচ্ছে আলো ঝলমল এক্রোপোলিস, দেবী এথেনার মন্দির। কোনো কাঁসার ঘন্টার কলরব নেই। শুধু পড়ে আছে নিস্তব্ধতায় জড়ানো শূন্যতা। হাওয়া দোলা দেয় উইলো গাছের গায়ে। পাথরের রাস্তায় শব্দ তুলে হেঁটে যায় কোনো গ্রীক সুন্দরী। আর আমি ফিরি আমার হোটেলের ঘরে নীরব ইতিহাসকে সাক্ষী করে পরের দিনের অপেক্ষায়।

 

 

ধুম লেগেছে হৃৎকমলে

কমলা রঙের রোদের আভা ছডিয়ে পড়ল ঘরের ব্যালকনি জুড়ে, ঘুম ভাঙল । আবার ছুটতে হবে দেখে নিতে হবে আজই যতটা দেখতে পারা যায় তারপর কয়েকদিন তো ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে কাটানো। ইতিহাসকে নিয়ে নীল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া।

অলিম্পিয়ান গার্ডেন

দিনের শুরু হল জিউসের মন্দির দেখে। আ্যক্রোপোলিস থেকে নেমে এসে একটু দক্ষিণ-পুব দিকে হাঁটলেই প্লাকার পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তা ক্রস করে এই মন্দির চত্বর। মন্দিরের নাম হয়েছে অলিম্পিয়ান দেবতাদের হেড জিউসের নামে। মন্দিরের অবস্হান শহরের ঠিক মাঝখানে।চত্বরটা বেশ বড। বড় বড় কলামের বেশ কিছু ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। আমার মতো বেশ কিছু টুরিস্ট। আলাপ হল ব্রাজিলের মেয়ে মারিয়ার সঙ্গে। সে ও তার বান্ধবী এসেছে তার পঁচিশতম জন্মদিন পালন করতে। কালকেই তারা সানতোরিনি চলে যাবে যাওয়ার আগে একদিনের জন্য এথেন্সে। তাদের অনুরোধে ছবি তুলে দিলাম। সোলো ট্রিপে বেরিয়ে দেখলাম আমার মতো অনেকেই এভাবে বেরিয়ে পড়েছে আর সেলফি তুলে তুলে ক্লান্ত হয়ে অন্য মানুষদের অনুরোধ করছে ছবি তুলে দিতে। এ যেন চেইন সিস্টেম, তুমি আমার ছবি তুলে দিলে আমার ছবিও যে তুমি তুলে দেবে এটাই স্বাভাবিক। এমনভাবে ছবি তোলার পরিস্থিতিতে আমিও যখন আবদ্ধ তখন আলাপ হল লি-এর সঙ্গে। লি এসেছে চীন থেকে। সাধারণত চীনারা দল বেঁধে বেড়াতে ভালোবাসে। কিন্তু লি একা। জিউসের মন্দির দেখতে দেখতে আমাকে অনুরোধ করল ওর ছবি তুলে দিতে। গ্রীক পুরুষের ভঙ্গিমায় দু’হাত ছড়িয়ে পেশি ফুলিয়ে দাঁড়ালো ছোটখাটো চেহারার লি। দ্বিতীয় পোজের সময়ে মহা মুশকিলে পড়লাম। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি চাইছে, অবশেষে বুঝলাম যে সারা পৃথিবীকে যেমন তারা নিজেদের কব্জায় রাখতে চায় সেইরকম লি তার ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পুরো মন্দির তুলে ধরেছে এমন পোজ দিয়ে ছবি তুলতে চায়। লি এর হাত থেকে নিস্তার পেতে বেশ সময়ে লাগল, জানি না এক চীনাকে কতটা সাহায্য করতে পেরেছিলাম সেদিন পৃথিবীকে জয় করার পথে। তবে একজন সামান্য বাঙালী, মধ্যবিত্ত মেয়ে হিসেবে আমার অত ক্ষমতা প্রমাণের আকাঙ্ক্ষা নেই বলে লি কে দিয়ে আমার ছবি তোলানোর সাহস দেখাই নি।

দূরে দেখা যাচ্ছে পার্থেনানের মন্দির
রোমান অ্যাগোডা (2)

যে আলেকডান্ডারকে খুঁজছিলাম তার দেখা মেলে নি প্রথম দুদিনে। অবশেষে দেখা মিলল তাঁর, ওয়ার মিউজিয়ামে। যে যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছে গ্রীকরা তার প্রথম সারিতেই আলেকজান্ডার। সুদূর গ্রীস থেকে পারস্য হয়ে তার রাজ্য বিস্তার ভারতবর্ষ অবধি ছড়িয়ে ছিল। সেই ইতিহাসই ধরা আছে এই মিউজিয়ামে। শিহরণ হয়, মন বিশ্বাস করতে চায় না যে আমি সেই দেশেই দাঁড়িয়ে। রাজা ফিলিপের ছেলে তিনি ম্যাসিডোনিয়ার রাজপুত্র। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। তার আগেই বিপুল পৃথিবী জয় করে গেছেন। তিনি ছিলেন আ্যরিস্টটলের শিষ্য, তাঁর কাছেই নিয়েছিলেন দর্শন আর নীতিশিক্ষার পাঠ। মিউজিয়াম দেখা শেষ করে আরেকটা মিউজিয়ামের দিকে এগিয়ে চললাম, বাইজান্টাইন মিউজিয়াম। যখনই ইউরোপের অন্য কোনো শহরে গেছি দেখেছি মিউজিয়ামগুলোর বৈশিষ্ট হল সেখানে কিছু না কিছু স্পেশাল শো চলে। বাইজান্টাইন মিউজিয়ামে স্পেশাল শো চলছিল সেই সময়ের ম্যুরাল আর্ট নিয়ে। কত রঙ সেই ম্যুরাল আর্টগুলোয়। গ্লাস পেইন্টিং আর মুরাল রঙ বেরঙের। এমনভাবে আলো দিয়ে সাজানো যেন রঙের একটা মায়াময় জাল বুনেছে ঘরের মধ্যে। মিউজিয়াম দেখে এক কাপ গ্রীক কফি নিয়ে বসে পরের গন্তব্য এ্যরিস্টটলের ফিলসফিকাল স্কুলের হদিশ করতে লাগলাম। কেউ প্রায় বলতে পারছে না। এক গ্রীক সুন্দরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি তো বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন যেন ‘এর আর কিছু অস্তিত্ব আছে নাকি’ এমন ভাব! তারপরেই আ্যপল ফোনের সাহায্য নিয়ে খুঁজতে লেগে গেলেন এ্যরিস্টটলকে। যাইহোক বিফল হয়ে যখন এদিক ওদিক ঘুরছি তখন দেখলাম বাইজেন্টাইন মিউজিয়ামের পাশেই ভাঙাচোরা কিছু পড়ে আছে, চারপাশ বাঁধানো আর আর্কিওলজি বিভাগের বোর্ডে কিছু লেখা , পড়ে বুঝলাম এই সেই স্কুল। অবশেষে খুঁজে পেলাম। সারা বিশ্বের ইন্টালেকচুয়ালিজম ও দর্শন-চর্চার শুরু যার হাত ধরে। তরুণ প্রজন্ম অনেকে তার হদিশ জানেই না। হায় আ্যরিস্টটল হায় তোমার দর্শন। অলিভ রোদ নেমে আসা এথেন্সে আমি থমকে দাঁডিয়ে। মনের মধ্যে অজস্র নাম তখন। এমন অনুভূতি অনেকদিন আগে হয়েছিল যখন স্পেনে রেইনি সোফিয়া মিউজিয়ামে প্রথম গুয়েরনিকা দেখি। পা চলছিলনা। নীরব। কিছু কিছু মুহূর্তকে তো শুধু অনুভূতি দিয়ে জারিত করতে হয়। সেখানে নিজের জানা বোঝা স্থবির হয়ে থাক। ওখান থেকে হাঁটতে শুরু করলাম মনাস্তিরাকি মেট্রো স্টেশনের দিকে।

 

রোমান অ্যাগোডা (3)

এথেন্সে এসে অনেকের মনে হতেই পারে যে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু ভাঙা পাথর দেখে যাচ্ছে।  কিন্তু ওই ভাঙা পাথরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গল্প আর ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাওয়ার মজা যে নিতে পারবে তার কাছে সেটা অমূল্য। আমার ভালো লাগে ইতিহাসকে খুঁজতে, শুধু সৌন্দর্য টানে না আমাকে। তাই ছুটলাম আবার রোমান আ্যগডা আর এনসিয়েন্ট আ্যগোডা দেখতে। আ্যগোডা মানে পুরাকালের বাজার। এই বাজারগুলো ছিল সাধারণ মানুষদের জন্য। এখানে জিনিসপত্র বিক্রি হত। মানুষজন জড় হত, তর্ক করত, আড্ডা দিত। একদিকে আছে প্রাচীন গ্রীসের সেই বাজার এলাকা অন্যদিকে রোমান সম্রাটরা যখন গ্রীস দখল করেছিলো তাদের সময়ের বাজারের অস্তিত্ব। এখনো একদিকে বাজার আছে অন্যদিকে রোম সম্রাট হেরেডিয়ানের লাইব্রেরি, তার রাজত্বপাট।
মনেস্তিরাকি মেট্রো স্টেশনে থেকে ওপরে উঠলেই যে চত্বর সেখানে বাঁদিকে গেলে এনসিয়ান্ট আ্যগোডা ডানদিকে রোমান আ্যগোডা। মাঝখানে খুব সুন্দর একটা চার্চ। বাইজান্টাইন-এর সময়ের ম্যুরাল আর্ট দিয়ে সাজানো। গ্রীসে নানা সময়ে নানা শক্তির আগ্রাসন ঘটেছে আর তাদের রাজত্বকালে তারা শিল্পকলায় সাংস্কৃততে যে ছাপ ছেড়ে গেছে তা দিয়েই তৈরি হয়েছে আধুনিক গ্রীস।
গ্রীসে গিয়ে সুভলাকি খাব না তা তো হতেই পারে না। এটি অন্যতম বিখ্যাত খাবার। কাবাবের মতো দেখতে, মাংস দিয়ে তৈরি। যা কলকাতায় ফিরে এসে বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। যে মাংস দিয়ে ওরা তৈরি করে সেই মাংস এখানে পাওয়া যায় না তাই স্বাদ ও সেরকম হয় না। শুধু সুভলাকি নয় এর সঙ্গে আছে মুসাকা, হালুয়া, গ্রীক কফি, গ্রীক স্যালাড আরো কত কিছু। বাকলাভা আর গ্রীক কফি নিয়ে টার্কিসদের সঙ্গে গ্রীকদের বেশ ঝগড়া, টার্কিসরা মনে করে এসবই তাদের, গ্রীকরা এসব ছিনিয়ে নিয়ে তাদের প্রশংসা নিজেরা কুড়োচ্ছে।

প্যানেপিস্তিমিয় মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষা স্টাভরসের জন্য। চলে যাওয়ার আগেরদিন এমন কিছু  জায়গায় গেলাম যেগুলোর ট্যুরিস্টরা যায় না। একদম অন্য এক শহর। যেখানে ড্রাগ বিক্রেতা, ড্রাগ নেয় যারা, আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের লোকজন, আ্যনার্কিস্ট, অন্য ধরনের চিন্তাধারার মানুষজন এই অঞ্চলে জড়ো হন। সময় কাটান। জায়গার নাম এক্সারসিয়া। শহরের একপাশে। আলো ছায়া নেমে আসা শেষ বিকেলে রঙ বেরঙের গ্রাফিত্তির মাঝে আমরা দাঁড়িয়ে। দেওয়াল জুড়ে রঙের মেলা। বিভিন্ন দেওয়ালে বিভিন্ন রঙের কম্বিনেশন। তারই মধ্যে এক জায়গায় দেখলাম একটা বাচ্চার ছবি মাঝখানে আর চারপাশে গ্রাফিত্তি। জানতে চাইলে স্টাভরস জানালো যে কিছুদিন আগে এক বাচ্চা কোনো এক অজানা কারণে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, তার স্মৃতিতে ওই গ্রাফিত্তি। গিয়ে বসলাম একটা ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্টে। পাশের বাড়ি থেকে একটা লালপতাকা ঝুলছিল। স্ট্রাভরস উত্তেজিত হয়ে বলল এই পতাকাটি আ্যানার্কিস্টদের, এখানে মোটামুটি তাদের রাজত্ব চলে। প্রত্যেক সপ্তাহে শুক্রবার এসে পুলিশ গুলি চালায়। মানে জানান দিয়ে যায়— আমরা আছি, তবে খুব কিছু করে উঠতে পারে না। আবার যে কে সেই , রাস্তায় ওপেনলি ড্রাগ বিক্রি হতে থাকে। লোকজনদের মধ্যে একটা চাপা কী যেন চলেছে! গ্রীক বন্ধুটি আমাকে শুধু বেশি ছবি তুলতে বারণ করল। ক্যামেরা ব্যগে ঢুকিয়ে হাঁটছি, এই অঞ্চলে রাস্তা বেশ চওড়া, তবে অপরিষ্কার, সাজানো পার্ক আছে বটে তবে সেখানে কেউ শুয়ে আছে ড্রাগ নিয়ে, কেউ বা তর্ক করছে। দেখলাম দুজন মারপিট করার উদ্যোগ নিচ্ছে, কোনো হিস্যায় অসুবিধা হয়েছে হয়তো। বাঁদিকে ঘুরেই পলিটেকনিক কলেজ, যেখান থেকে বেশ কিছুদিন আগেই একটা বড় ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। ফেরার পথে দেখলাম একা ঘেটো মতো জায়গা। জানতে চাইলে স্টাভরস জানালো যে ওখানে বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশকারিরা থাকে। ও নিজে একটা সংস্থায় কাজ করে এদের নিয়ে। এখানে কিছু শেল্টার হোম আছে যেখানে বাচ্চারা থাকে, তাদের আ্যসাইলাম-সিকার হিশেবে জায়গা দিতে গ্রীস সরকার যাতে স্বীকার করে সেই কাজ তারা করছে ইউ এন এইচ সি আর -এর সঙ্গে। এ অভিজ্ঞতা একদম আলাদা , কোনোদিন ও কোনো দেশে টুরিস্ট হয়ে গিয়ে এইরকমভাবে শহরকে দেখা যায় না।

দেওয়ালও কথা বলে

সন্ধে নামল অবশেষে। সূর্যাস্তের রঙে মিলিয়ে যাওয়া কনে দেখা আলোয় শেষবারের মতো দেখলাম তাকে। অনেক না বলা গল্প রয়ে গেল। অনেক না বোঝা দু:খের অনুভূতি শেয়ার করা হল না। জানা হল না ইতিহাসের কত গোপন মোড়। শুধু নীল আকাশের মাঝে উজ্জ্বল পার্থেনন, আ্যক্রেপোলিস, প্লাকা, রোমান, অটোমান, বাইজান্টাইন সবার স্পর্শ অমলিন হয়ে আছে। এখনও মাঝে মাঝে কানে বাজে করুণ বোজুকির সুর, মন খারাপের গান আর ভুলতে না পারা সব স্মৃতি যা ক্যামেরায়ও বন্দী করতে পারিনি।

অস্তে গেলা দিনমণি…

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment