হেডিং পড়ামাত্র, পাঠক, আপনি ভাবলেন, কোথায়, কোথায় সেই জায়গা! তাহলে ‘রথ দেখা কলা বেচা’—র মতো সেখানে একটা টুর, হালকা বেড়ুবেড়ু তো বটেই (ওটা ফাউ) আর ফেরার বেলা কাঁধে বগলে মাথায় করে পেঁয়াজ ভর্তি বস্তা। আহা! ‘ঘুরতে গিয়ে আমার জন্য কী আনলি?’ বলা আত্মীয়স্বজনও পেঁয়াজ—সম স্তরে স্তরে খুশি। পিঠপিছে নিন্দে করা আত্মীয়, বন্ধুবলয়ের কাছেও উপহার পৌঁছনো মাত্র ঝাঁঝ গায়েব। আরও কী কী প্ল্যানিং হতে পারে, ভেবে নিন। জায়গার নাম বলছি।
তার আগে, একটা স্বীকারোক্তি প্রয়োজন। পেঁয়াজের দামখানা পড়ামাত্র হয় আপনি চমকে গিয়েছিলেন, কিংবা ভেবেছিলেন কোনও রূপকথা, তাই তো? মোটমাট, বাস্তবের গন্ধ খানিক নট নট ঠেকেছিল।
এবার একটা জিজ্ঞাসা। পাঁচ বছর আগে পেঁয়াজের দাম কত ছিল, মনে আছে? পেঁয়াজ ছাড়ুন; আলু, চাল, ডাল– আপনার দিনাতিপাতের রোজগেরে অবশ্য জরুরি পণ্যের দাম আপনার নস্টালজিয়ায় আছে কি? আচ্ছা পাঁচ বছর একটু বেশি হয়ে গেল? তিন বছর, দু’ বছর অন্তত? কত করে বাড়ল, সেই ‘ক্রনোলজি’—ও মনে পড়ছে না সঠিকভাবে?
ওয়েলকাম টু শক! আচমনের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত!
কথা হল, কখন আমরা শক খাই? কখন আমরা আচম্বিতে পড়ি, চমকে যাই? যখন খারাপ কিছু হয়, তখন? উঁহু। ভালও আমাদের চমকিত করে। তাহলে?
আমরা চমকে যাই সেসবেই, যা আমাদের অতীত ও অভিজ্ঞতারহিত। যখন, সেই চমকে দেওয়ার ঘটনার ব্যাখ্যা আমাদের কাছে থাকে না। যখন, ইতিহাসের পাতা এলোমেলো হয়ে যায়। যখন, আমরা স্মৃতিভ্রষ্ট হই। স্মৃতিবিচ্যুত হই।
পেঁয়াজের দাম যখন ১২০ টাকা হল, আমরা চমকে গিয়েছিলাম। তারপর নানা হাবজি—গাবজি পেরিয়ে, খবর হল– বাজারে পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকায় নেমেছে! আপনার হোলসেল বাজারে যাওয়া হয় না, পাড়ার পাইকারি বাজারে সান্ধ্যবাজার সারেন। গতকালও সেখানে পেঁয়াজ ১২০—ই যাচ্ছিল, আজ গিয়ে দেখলেন ৮০ টাকা। মার দিয়া কেল্লা! ৪০ টাকা কম! আপনার স্নায়ুতে স্নায়ুতে খানিক আরাম বোধ খেলছে ততক্ষণে। আজ অমলেটে বেশি পেঁয়াজ তো হবেই হবে!
কিন্তু, এই চল্লিশ টাকার খেলাপিতে আপনি ভুলে গিয়েছেন, পেঁয়াজ আগের আগের মাসেই ২৫ টাকায় যাচ্ছিল। আপনার মন বলছে ৪০ টাকা বাঁচানো গেল, কিন্তু পকেট থেকে বেরল সেই ৮০ টাকাই, যা কিনা হওয়ার কথা ছিল ২৫!
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আপনি শক খেলেন। কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, আপনি থিতু—বস্থায় ফিরে এলেন, নিজেকে আপনার স্বাভাবিক মনে হল, কিন্তু পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থা কীরকম ছিল, তা আর মনে রইল কি? এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে ডাক্তার বললেন– এই তো মশাই, আপনি একদম ঠিক আছেন!
আপনি কি আশ্বস্ত হবেন? ডাক্তার বলেছেন যখন, আপনার অস্বস্তি আপনার মনে হওয়াই কেবল– এই ভেবে বেরিয়ে আসতে পারবেন? মনের ভিতর খুঁতখুঁত থেকে যাবে না? আপনি তখন ভাববেন না কি যে, আরেকটা ডাক্তার দেখিয়ে নিলে ভাল হয়?
দাঁতের ব্যথার গল্প মনে আছে? একজন লোক দাঁতের ব্যথায় ছটফট করতে করতে ডেনটিস্টের কাছে গেল। ডাক্তার সব শুনে বুঝে লোকটিকে বললেন, ‘হাতটা বাড়াও দিকি!’ হাত বাড়াতে না বাড়াতে ডাক্তার দিলেন কষে হাতুড়ি ওই হাতের ওপর। হাতের ব্যথায় মাগো বাবাগো করতেই, ডাক্তার বললেন– কী হল, চ্যাঁচাচ্ছেন কেন? রোগী বলল, হাতে ব্যথা করে উঠল যে! ‘যাক, দাঁতে ব্যথা তো আর হচ্ছে না!’
অর্থাৎ, দিকভ্রষ্ট করে দেওয়া, বিস্মৃত করে দেওয়া আরও কর্কশ কোনও স্মৃতি দিয়ে। শক দেওয়া!
ঠিক এমনি করেই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় প্রশ্ন ওঠে না কি?
ভেবে দেখুন, শুধু পেঁয়াজকে নিয়েই ক্রাইসিস তৈরি করা হয়েছিল এখানে। কিন্তু, যদি সেই অপেক্ষক হয়ে নেমে আসে গোটা অর্থনীতিটাই? এবং যেখানে কিনা বলা হচ্ছে– সরকার যদি জনগণের জন্য ভর্তুকি, অনুদান, প্রকল্প বন্ধ করে দেয়, ইচ্ছাকৃত ক্রাইসিস তৈরি করে, তাহলেও ডোন্ট ওয়ারি, মানুষ নিজে থেকেই সেই ক্রাইসিস কাটিয়ে উঠতে পারবে!
অর্থাৎ শক খাওয়ার পর, নিজে থেকেই মানুষ নাকি সেই শক কাটিয়ে উঠবে এবং এগিয়ে যাবে নিজের স্বভাবে!
আপনার পকেটে দশ টাকা আছে সকালে। রাতের দিকে কিছু না করেই এমনি এমনি আপনার পকেটে কুড়ি টাকা হয়ে যাবে?
কিন্তু, এই তত্ত্বই এখন বহুবিদিত।
এই তত্ত্বের জনক মিলটন ফ্রিডম্যান। তিনি কে, কখন, কীভাবে তাঁর উদ্ভব, সে কথায় আসছি পরে।
এখন কথা হল, এই ‘শক থেরাপি’ জিনিসটাই বা কী?
শব্দগত অর্থ হাতড়ালে মানে দাঁড়ায়– শক দেওয়া হচ্ছে এবং সেটাই নাকি ‘থেরাপি’ অর্থাৎ শুশ্রূষা। এর বাংলা করা যেতে পারে ‘মারৌষধ’। ছোটবেলায় যখন ডানপিটেমো করতাম, বাবা বলত, ‘মার দরকার মার। ওটাই এই ডানপিটামির ওষুধ!’ বাবা—ই এই ‘মারৌষধ’ তর্জমাটি করেছিলেন। কিন্তু, এই প্রক্রিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঠান্ডা যুদ্ধের কালে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বা আজকের তৃতীয় বিশ্বের দেশেও কোন সুচারু উপায়ে ইনজেক্ট করে দেওয়া হল, তা কৌতূহলের বিষয় বইকি। এবং, এই মুহূর্তে যদি বলি, আপনি আমি আমরা প্রত্যেকে এই মারৌষধ—এর মেডিকেশনে পেশেন্ট বা শিকার বা গিনিপিগ বা অর্ধমৃত– খানিক অস্বস্তি হবে? আমরা কি চাইব না এখান থেকে বেরিয়ে আসতে? আর যাঁদের অস্বস্তি হচ্ছে না, অস্বীকারের উক্তি ভিতরজুড়ে থই খুঁজছে, এই প্রত্যেক রূপের উদ্দেশ্যে–
অতীত চারানো যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। কিন্তু ক্লেশ কাটছে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯২৯—এ পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতির রেশ তখনও কাটেনি। তার উপর আবার ধাক্কা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও নেমে এল। অভাব, অনটন, অপুষ্টি, অর্থাভাব, জীবনযাপনের মান তলানিতে। যেন শূন্য থেকে শুরু সব। ভারত থেকে ব্রিটিশ তাদের লোটাকম্বল গোটাচ্ছে, দেশ স্বাধীন হচ্ছে। স্বাধীন, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম প্রভৃতি পরিচয় নিয়ে সংবিধান রচিত হচ্ছে। প্রত্যেক মানুষের শিক্ষা থেকে শুরু করে ধর্মাচরণে সমান অধিকারের বাণী লিখিত হচ্ছে। অভুক্ত মানুষের দেশ। মানুষকে খাওয়াতে পরাতে হবে, জীবনযাপনে সুস্থিতি দিতে হবে, গরিবের কথা ভাবতে হবে, দলিতের শিক্ষা ভাবতে হবে, সকলের জন্য কাজ থাকতে হবে। এই সমস্ত ভেবে অর্থনীতির পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে। এবং তা হচ্ছে অর্থনীতির সোশ্যালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে।
কী এই সোশ্যালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি? সহজ ভাষায়– সরকারের মধ্যস্থতায় অর্থনীতি। যা কিছু লেনদেন, সবই হবে সরকারের আওতাধীন। এবং সরকারের কী কাজ? সমস্ত শ্রেণির কথা ভাবা তো বটেই, তার সঙ্গে দরিদ্র শ্রেণি, নীচুতলার মানুষ, যারা জাত—বর্ণ—ধর্ম বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার– তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দুইভাবেই। মোদ্দাকথা, সমস্ত বিভেদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা। গত শতকের পাঁচের দশক সেটা।
এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির অর্থনীতির অন্যতম সফল পথিকৃৎ জন মেইনার্ড কেন্স। কে ইনি, কী তাঁর তত্ত্ব– এসব জানতে যদি ইচ্ছে না—ও করে, তাহলে এই একই কথা ভারতের কে বলেছেন আমরা কি জানি না? স্বামী বিবেকানন্দ। দরিদ্রের সেবা, নীচু শ্রেণির মানুষের প্রতি জীবনকে বলিপ্রদত্ত করা, তাদের মধ্যেই আছে শিব, নারায়ণ। ‘নরনারায়ণ সেবা’—র কথা বলছেন তিনি। জাতি—কর্ম—বর্ণের বিভেদ কাটিয়ে তিনি বলছেন, মুচি—মেথর আমার ভাই। তাঁর কথায় মান্যতা দিচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আজাদ হিন্দ বাহিনী হয়ে উঠছে তার অন্যতম স্বরূপ। সাম্যের গান গাওয়া হচ্ছে। এমনকী গীতাও বলছে– প্রয়োজনের বাইরে যা কিছু, তা সমর্পণ করো। কাম অর্থাৎ কামনা থেকে মুক্ত হও, নিষ্কাম কর্মের সাধনা করো। যেখানে, কর্ম এবং কর্মজনিত ফলের দুঃখ বা আশা থাকবে না। আহুতি দাও। ‘কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’। যার সহজ বাংলা– অত খাই খাই কোরো না। কাজ করো, বাঁচো, ফলের আশা কোরো না। জীবনের আশায় মেতে যেও না। পস্তাবে।
এসবের সফল রাজনৈতিক তত্ত্ব সংশ্লেষ সাম্যবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পুঁজিবাদ ক্রমশ শীর্ষ হয়ে উঠছে, তার বিরুদ্ধে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের কথা বলছে, সমানাধিকারের কথা বলছে। এর থেকে ভাল কী হতে পারে?
তা সেই সোশ্যালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি তখন মার্কিন মুলুক থেকে শুরু করে রাশিয়া, ভারত, চিলি, ইংল্যান্ড সর্বত্রক্ষেত্রে বিরাজমান। কারণ, সত্যিই তো– অর্থনীতি সমগ্র রূপে চাঙ্গা হয় তখনই যখন দেশজুড়ে সকলের জন্য থাকে কাজ, শিক্ষার সুবিধা, সুস্বাস্থ্যের ভাবনা।
কিন্তু, যারা পুঁজিপতি, যাদের আওতায় চাকরি, আড়ত, যারা জমিদার– তাদের এই নীতি পছন্দ হবে কেন?
চাকর বা কর্মী কাজ করবে, তার স্বাস্থ্য—জীবন—মন—পকেট সব সুস্থ থাকলে তার সঙ্গে পুঁজিপতিদের তফাত কী থাকল, আর এতকিছুর খেয়াল যদি মালিককে রাখতে হয়, তাহলে মালিক আয়েস করবেন কখন? আর তাছাড়া, সাম্য চলে এলে বাস্তুতন্ত্রের পিরামিডটাই ভেঙে যাবে যে! কেউ কাউকে খাবে, তাকে অন্য কেউ খাবে– এই খাদ্য—খাদক সম্পর্ক– এটাই তো দস্তুর!
সুতরাং ‘সাম্য’ ধারণা হয়েই থেকে যাওয়া। সাম্য ইজ বিউটিফুল অ্যান্ড অ্যাবস্ট্রাক্ট। সাম্য—র চিন্তাই মানবজাতির দ্বন্দ্ব।
আর এই দ্বন্দ্বকেই উলটো হাতে কাজে লাগালেন মিলটন ফ্রিডম্যান। কীভাবে? খানিক গৌরচন্দ্রিকা দরকার।
সেটাও পাঁচের দশক। ’২৯—এর অর্থনৈতিক সংকট আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছে আমেরিকা। রাশিয়াও। দুই প্রভাবশালীতম দেশ। কেন্স—এর তত্ত্বকে সঙ্গী করে। রুজভেল্ট বলছেন– সবার কাজ চাই, এ আর কী এমন কঠিন বিষয়! কাজ হবে, তাহলেই অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়াবে। ভয়—কে ভয় পাব না, এটাই আমাদের নীতি। এবং তা হলও। সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে ভর্তুকি বাড়ল, অনুদান বাড়ল স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে।
আর ওদিকে, তাদেরকেও ছাড়িয়ে তখন উঠছে সাম্যবাদী ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রগুলি– চিলি, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল। সেখানে সমস্ত রূপে সোশ্যালিস্ট অর্থনীতি।
কিন্তু, অন্যতম পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, আমেরিকা, কতক্ষণই বা তার দাঁত—নখ লুকিয়ে থাকতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে তারা হারিয়েছে বটে। হিটলারকে তারা দমন করেছে। কিন্তু, হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, দমননীতিও তারা জেনেছে। কীভাবে আখের গোছানো যায় এসব থেকে, তা কি আর অজানা? শুরু হল গবেষণা। সূক্ষ্ম, সুচারু উপায়ে।
অ্যালান মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট। মনোরোগের চিকিৎসালয়। রিহ্যাব। সেখানের বিশিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক ড. এওয়ান ক্যামেরন। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ধারণা তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের। তাঁর নামে রোগীদের ইতস্তত অভিযোগ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু হু কেয়ার্স! রাষ্ট্র তো তাঁর পক্ষে। কেন? কারণ তাঁর গবেষণা। ইলেকট্রিক শক দিয়ে দিয়ে একজন পরিণত মানুষকে এমনই এক স্তরে নিয়ে যাওয়া, যেখানে তার আর কোনও অতীত থাকে না। নিজেকে সে নতুন কেউ হিসাবে ঠাওরায়। এবং তেমন মানুষকে নতুন করে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ।
ভেবে দেখুন, একজন মানুষ তার শারীরিক ব্যথা বোধ করতে পারে যখন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মনে রেখে, সেই অনুভূতি কেমন; আর সে যখন নিজেকেও জানে না, নিজেকে চিনতেও পারে না, যেখানে নিজের কোনও অতীত বোধ থাকে না, তখন সেই শারীরিক ব্যথা কীরকম অনুভূতি?
কোনও দুর্ঘটনায় হাত—পা বাদ গেলে কী হবে, অন্ধ হয়ে গেলে কী হবে– তার কিছু আন্দাজ আমরা নিজেরা করতে পারি। কিন্তু, এমন এক দুর্ঘটনা হল, যেখানে আমি আর আমিকে ভাবতে পারি না, আমার কোনও ভাবনাশক্তি নেই সর্বোপরি, আমি আর স্বপ্ন দেখতে পাই না। এই রোবোটিক পর্যায় আরও বেশি কষ্টের নয় কি? কিন্তু রোবোট হয়ে গেলে তো কষ্টও রইল না, কারণ বোধই তো নেই!
ঠিক এটাই ড. ক্যামেরন—এর চাওয়া। তাঁর গবেষণা। কী কী করলেন তিনি? শুধুই কি রোগীদের শক দেওয়ার পরীক্ষা? না। তার সঙ্গে– সবসময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখা। রোগী তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার তখনই করবে, যখন তাকে বলা হবে। তাকে হাগতে বলা হলেই, সে হাগতে যাবে। পিঠ চুলকোলে পরে, চুলকনো চলবে না। তাকে চুলকোতে বলা হলেই একমাত্র সে চুলকোবে। মোটকথা, তার নিজের উপর কোনও অধিকার থাকবে না, সে হবে চালিত। রক্ত—মাংসের রোবোট। খেলনা।
এবং এইসব পেরিয়ে যখন সেই মানুষ সম্পূর্ণভাবে নিজের প্রতি সমস্ত অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে, সেই মানুষ হবে নতুন এক সভ্যতার স্বরূপ! হ্যাঁ, এমনটাই মনে করতেন নয়, বিশ্বাস করতেন ড. ক্যামেরন। আর তাঁকে রোগী সরবরাহ করত মার্কিন সেনাবাহিনী অর্থাৎ মিলিটারি ফোর্স!
ব্যাপারটা বেশ মজার ঠেকল চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যানের। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কী করে কাজে লাগানো যায়, ভাবতে ভাবতে তিনি পেলেন এই: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও যদি এভাবে পূর্বাবস্থা লোপ করিয়ে দেওয়া যায়, সরকার যদি হাত গুটিয়ে নেয়, যদি ক্রাইসিস তৈরি হয়, তাহলে সেখান থেকে কাটিয়ে উঠে যে অর্থনীতি তৈরি হবে, তা—ই একমাত্র পুঁজিবাদের বৈষম্যকে ভেঙে দিতে পারবে। সেখানে হবে সবাই সমান!
‘পুঁজিবাদ’ তরজমাটি হালকা করে ধার করে নিলেন ফ্রিডম্যান। মার্কসের সাম্যবাদের অ্যান্টি থিসিস রচনা করলেন। কোন রূপে? ওই যে, তিনি বললেন, ‘সেখানে হবে সবাই সমান’। রাজার কাছে যা আছে, টুনির কাছেও তা—ই আছে। এবং জন্ম নিল: ফ্রি মার্কেট ইকোনমি। খোলা বাজার অর্থনীতি। বললেন, এই অর্থনীতিতে সাম্য নিয়ে মাথাব্যথাই নেই। কারণ, এই নীতি প্রয়োগ মাত্র সাম্য এসে যাবে। খোলা বাজার মানেই তো স্বাধীনতা, অর্থাৎ গণতন্ত্র ততই রক্ষিত হবে! এর চেয়ে সুদিন আর কী বা চাইতে পারে মানুষ?
সুদিন! অর্থাৎ, ‘আচ্ছে দিন’। কিছু কি মিলে গেল?
আরও একটি চিরুনি চালানো হোক।
সমস্যা হল, এই ফ্রি মার্কেট ইকোনমি হুট করে নিজেদের উপর প্রয়োগ করে পরীক্ষা করাটা একটি বেশিই সাহসিকতা হয়ে যাবে না কি? মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে প্রচুর জল্পনা—কল্পনা শেষে ফ্রিডম্যান বুদ্ধি দিলেন, আরে অন্য দেশে দেখা যাক না প্রয়োগ করে!
কিন্তু কী উপায়ে?
হুট করে তো একটি দেশে অন্য একটি দেশ অর্থনীতি প্রয়োগ করে দিতে পারে না।
ছয়ের দশক। আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশের তালিকায় ঢুকে পড়া কিছু দেশ তখন রীতিমতো উন্নয়নশীল। হুড়মুড়িয়ে এগোচ্ছে। মার্কিন মুলুককে, রাশিয়াকে শিক্ষায়, বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ফিসফিসে, কিন্তু দৃপ্ত। এদের মধ্যে অন্যতম: চিলি।
চিলি তখন শিক্ষাক্ষেত্রে তুমুল। দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৮৯ শতাংশ। সালভাদোর আয়েন্দে—র ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট সরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, শিল্পক্ষেত্রে ঢেলে খরচ করছে সেই সরকার। স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে দুধ, পাউরুটি। পড়াশোনা করতে এসে যেন কোনওরকম পুষ্টির অভাব না হয়। আর, দেশবাসীর ‘স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং’ যাচ্ছেতাই রকমের ভালর দিকে।
ব্যস। তাতেই ভয় ঢুকে গেল মার্কিনিদের। প্রতিস্পৃহা। তাদের মতো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডকে এগিয়ে যাবে এই ছোট্ট একটা দেশ, তাও আবার তাদের চৌহদ্দিতেই!
ফ্রি মার্কেট ইকোনমি প্রয়োগ করা হোক এখানেই! অভিসন্ধি শুরু হয়ে গেল।
চিলির অর্থনীতিশাস্ত্রের তুখড় পড়ুয়াদের স্কলারশিপ দিয়ে চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য আবেদন জানাল মার্কিন প্রশাসন। কার অধীনে পড়বে তারা? মিলটন ফ্রিডম্যানের! প্রথম বিশ্ব ডাকছে। ছাত্ররা গেলও। পাঠ শুরুও হয়ে গেল। রীতিমতো তুমুল পরিচিতি ও পেটেন্ট নিয়ে চিলিয়ান ছাত্রছাত্রী ফিরে গেলেন চিলিতে। যোগদান করলেন দেশের অর্থনীতি মন্ত্রকে (এঁরা আরও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বেন আগামী অতীতে, পরিচিত হবেন ‘চিকাগো বয়েজ’ নামে)। তার সঙ্গে, ‘সিআইএ’—এর তরফে চিলির সীমান্ত অঞ্চলে প্রেসিডেন্ট আয়েন্দে—র নামে বিরোধী প্রচার শুরু হল।
কীরকম সেই প্রচার?
এই যে সীমান্তবাসীরা, তোমাদের জীবন আসলে তলানিতে ঠেকে আছে। দুনিয়া এখন কোথায় এগিয়ে গিয়েছে, আর তোমরা কোথায় পড়ে আছ। তোমাদের জীবনে কোনও সুরক্ষা নেই। অন্য দেশের মানুষ তো তোমাদের বেদখল করে দেবে। সরকারি স্কুলে কিছুই তো পড়ানো হয় না, ওই দুধ—পাউরুটি দিয়ে অকারণ খরচ করছে সরকার। তোমাদের করের টাকা তছরুপ করছে। তোমরা কি জানো প্রাইভেট স্কুলে কত ভাল পড়া হয়? তোমরা এই সরকারের অধীনে চাকরি করে মরছ, জানো কি এই পরিশ্রম ব্যবসায় দিলে কত লাভ করতে পারবে তোমরা?
আবার খানিক চেনা চেনা লাগছে?
কয়েক বছরও গেল না, শান্ত সেই দেশে, দেশ জুড়ে আয়েন্দের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠল জনগণ। বন্ধ দিনের পর দিন। সীমান্তের চাষবাস থেকে প্রাপ্ত শাকসবজি, গমের ট্রাক ধর্মঘট ঘোষণা করল ওই ‘সিআইএ’—এর প্ররোচনায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ল হু হু করে। কিছু মাস যাওয়ার পর দোকানপাট ধর্মঘট ডাকল। আর তাদের শান্ত করার জন্য সেই চিকাগো ফেরত অর্থনীতিবিদরা আয়েন্দে—কে পরামর্শ দিলেন– কী করছ বস্! ফ্রি মার্কেট ইকোনমি নামাও। শক দাও। যারা তোমার দেওয়া অনুদান বোঝে না, তাদের থেকে তুলে দাও সেসব সুবিধা!
আয়েন্দে মানতে চাননি। কিন্তু মার্কিনরা ছাড়ার পাত্র নয়। কয়েক মাসের মধ্যে চিলিতে গণ বিপ্লব হল। খুন করা হল আয়েন্দে—কে। আর মার্কিনিদের তোয়ানো আবির্ভাব ঘটল আগুস্তো পিনোচে—র। জেনারেল প্রেসিডেন্ট হিসাবে। দ্য ফার্স্ট প্রোমোটেড গ্রেট ডিক্টেটর আফটার সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার!
ফ্রি মার্কেট ইকোনমি প্রযুক্ত হল চিলি—তে। প্রথম। শিক্ষাক্ষেত্রে অনুদান কমে গেল। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও। শিল্পক্ষেত্রেও। (আবার খানিক চেনা চেনা ঠেকছে কি?) শিল্পক্ষেত্র ঢুকল মার্কিন মুলুকের। ক্রীতদাসের মতো কর্মী নিয়োগ হল। শুধু পেট ভরাতেই তাদের ব্যয় হত মাসিক আয়ের ৭৪ শতাংশ! বাকি সব তো দূর। স্কুলে স্কুলে দুধ বন্ধ হল। ১৭ বছর চলল পিনোচে—র শাসন। চিলির উন্নয়ন ধসে গেল পুরোপুরি। পর্যবসিত হল তৃতীয় বিশ্ব দেশে। বিস্ময়ের কথা হল, ফ্রিডম্যানের তত্ত্বানুযায়ী, সাম্য তো দূর, অর্থনীতির উদ্ভাস দূরস্থান, চিলি—তে মুদ্রাস্ফীতি হল ৩৭৫ শতাংশ, যা এখনও অবধি সর্বোচ্চ!
আজও চিলি সেই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। কীরকম ছিল তাদের স্বাভাবিক অবস্থা, জীবনযাপন– তারা বিস্মৃত হয়েছে।
ক্রমশ এই ফ্রি মার্কেট ইকোনমি ঢুকে পড়ল চিলি থেকে আর্জন্টেনিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকোয়। এই দেশের অবস্থান আজ কোথায়, আমাদের জানা বাকি নেই।
এখন প্রশ্ন ওঠে ‘ফ্রি মার্কেট ইকোনমি’ কীরকম?
এই অর্থনীতি অনুযায়ী, যে দেশে এই অর্থনীতি লাগু, সেখানে সরকারের হাতে কিছু থাকবে না। মানে সরকারি অনুদান, ভর্তুকি, মোদ্দাকথা পাবলিক সেক্টরে সরকারি ব্যয়ের কোনও জায়গা থাকবে না। লেনদেন যা কিছু, হবে সরাসরি ক্রেতা ও প্রস্তুতকারক বা বিক্রেতার সঙ্গে, কিংবা বলা ভাল সবটাই হবে বেসরকারি। হাতে হাতে। যে যার নিজের মতো জীবন ভোগ করবে। তার অওকাত থাকলে সে নিজেই গুছিয়ে নেবে, কিংবা পারবে না। অর্থাৎ, যে গরিব, তার যদি ক্ষমতা থাকে সে ধনী হবে। তার কাছে তো বাজার খোলা। সে করুক তার ক্ষমতায়। নিক ধার চড়া সুদে, ধার করে পড়াশোনা করুক– বাজারে টিকে থাকার ক্ষমতা থাকলে সে নিজেই বাজার ধরে নেবে। অর্থাৎ ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।
‘গরিব’ শ্রেণিকে উদাহরণে টেনে তাকে তার সমূহ সম্ভাবনার কথা বলা হল। কিন্তু, যেভাবে কথাটা বলা হল না, তা হল: ধনীরা আরও ধনী হবে। তার কাছে তো ক্ষমতা আছেই। সে আরও ক্ষমতাবান হবে।
বলা হল না: ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’। এই প্রতিশ্রুতি রইল না।
স্বভাবতই, পুঁজিপতিদের এই অর্থনীতি ভাল লাগতে তো বাধ্য!
এর হাতেনাতে প্রমাণ চাই?
সাতের দশকের আগে শিল্পপতিদের আয় ছিল তাদের সাধারণ একজন কর্মীর ১০ গুণ, বড় জোর ৪০ গুণ। ২০০৭ সালের মধ্যে, এই আয়ের ব্যবধান হয়ে দাঁড়াল ৪০০ গুণ! আজ এই ২০২০ সালে তা কত গুণ, হে পাঠক, সাধারণ ঐকিক নিয়ম প্রয়োগ করে দেখে নিন। চক্রবৃদ্ধির অঙ্ক না হয় বাদই দিলাম।
কিন্তু, কথা হল, ফ্রি মার্কেট তো ফ্রিডম্যানের মতে থেরাপি। একটি বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন– জনগণ, আমি অর্থনীতিবিদ নই। আমি হলাম তোমাদের অর্থনীতির ডাক্তার। তোমরা যে শক—এ আছ, সেখান থেকে আমি তোমাদের তুলে আনব। আমি হলাম পরিত্রাতা।
তার মানে কী দাঁড়াল? শক ছাড়া, থেরাপি কীভাবে হবে! অসুস্থতা না থাকলে চিকিৎসার সুযোগ তো নেই। তাই শক—এর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল বইকি! এবং, শক ছাড়া সম্পূর্ণ মতে ফ্রি মার্কেট ইকোনমি প্রয়োগ সম্ভবই নয়। কারণ, জনগণের সামনে, তাদের সচেতন অবস্থায় সরকারের তরফে জনগণের জন্য সমস্ত সুবিধা তুলে নেওয়া হবে, এরকমটা কি সম্ভব?
আপনার বাড়ি থেকে আপনারই জিনিস আপনার চোখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাবে কেউ, এমনটা কি হয়? হয় স্মৃতিভ্রষ্ট করতে হবে, কিংবা দিকভ্রষ্ট, যখন চুপিসাড়ে সরকার সব বিকিয়ে দেবে। তার জন্য চাই সংকট। তা প্রাকৃতিক, বানানো প্রাকৃতিক, বা দেশের খুব পুরনো কোনও ঘা—কে উসকে তা সমকালীন করে তোলা।
চিলির শক তো জানালামই আগে। পরবর্তীতে, যে যে মানুষ পিনোচে সরকারের বিরুদ্ধে কথা তুলেছিল, তাদের সকলকে গ্রেফতার করা হয়। এবং দেশ জুড়ে গড়ে তোলা হয় ডিটেনশন ক্যাম্প। তাতেও যখন কুলোয়নি, চিলি—র ‘ন্যাশনাল স্টেডিয়াম’ই হয়ে উঠছিল সেই দেশের বৃহত্তম ডিটেনশন ক্যাম্প। মানুষকে ঢলে ঢলে পোরা হয় সেখানে। ১৯৭৪—এর ফুটবল বিশ্বকাপে সেই স্টেডিয়ামেই আয়োজিত হয়েছিল কোয়ালিফায়ার রাউন্ড। সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম চিলি। সোভিয়েত খেলতে অস্বীকার করে। ওপেন গোল হয়। মাঠে একা চিলি বিপরীতের গোল পোস্টে বল ঢুকিয়ে ফাইনালে চলে যায়। সে ঘটনা কার না জানা। কিন্তু নেপথ্যের ঘটনা কতজনেরই বা জানা? প্রায় লাখ খানেক মানুষের মৃত্যু হয় পিনোচে—র শাসনকালে।
ব্রাজিল, উরুগুয়ে—তে ফ্রি মার্কেট ইকোনমির অবতারণার আগে সেখানে শক দেওয়া হয়েছিল অকস্মাৎ গণতন্ত্র তুলে দিয়ে। স্বৈরতন্ত্রের খাপ বসিয়েছিল দেশের মিলিটারি। একই সময়ে, আর্জেন্টিনায় হঠাৎ করে মানুষ গায়েব হয়ে যেতে শুরু করল। দিনেদাহাড়ে। দেশে সুরক্ষার অভাবের নামে মিলিটারি শাসন লাগু করলেন রাফায়েল ভিদেলা (আবার খানিক চেনা লাগছে?)। এবং ফ্রি মার্কেট ইকোনমি লাগু হল। পুরোদমে। বিরোধীদের একধার থেকে গ্রেফতার করা হল। তৈরি হল ডিটেনশন ক্যাম্প। লাখো লাখো লোককে মারা হল। মেয়েদের করা হল ধর্ষণ। যারা পোয়াতি হল, তাদের মারা হল সন্তান প্রসবের পর। আর সেই সন্তানরা বেড়ে উঠল মিলিটারির কোনও না কোনও সেনার পরিবারে বা আত্মীয়বাড়িতে। কেন? সেই সন্তানদের শিখিয়ে পড়িয়ে এই বৃহত্তর অভিসন্ধির শরিক করা হবে! আর এসব তাদের শিখিয়েছিল ‘সিআইএ’ এজেন্টরাই। মিলিটারি স্কুল অফ আমেরিকা—র ‘টরচার টেকনিক’। বছর যেতে না যেতে দেশে দেউলিয়া হয়ে গেল কৃষকরা। শ্রমিকদের মাইনে কমল ৪০ শতাংশ। ছোট ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু, ঘটনা হল, চিলিতে বা আর্জেন্টিনায় ফ্রি মার্কেট ইকোনমি প্রয়োগের কথা আমরা চার দশক আগেও জানতাম না। মার্কিনিরা সন্তর্পণে গোপন রেখেছিল তাদের লম্বা হাতখানি। আমরা শুধু জানতে পারি, ‘আয়রন লেডি’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের ১৯৭৯—তে মহাসমারোহে আয়োজন করে লাগু করেছিলেন এই অর্থনীতি। তবে, শুরুতে তঁার এই প্রয়োগে শক ছিল না। কারণ, তিনি সর্বপ্রথমে আয়কর কমালেন চূড়ান্ত হারে (আবার চেনা লাগছে, উল্লেখ করলাম– কিছুদিন আগেই নির্মলা সীতারমণের আয়কর হ্রাসের নীতি?)। সবাই ভাবল, সাধু সাধু! আয়কর কমছে মানে পকেটে এবার টাকা থাকবে। কিন্তু ভুলে গেল, পুঁজিপতিদের পকেটে টাকা ঢুকবে তারও বেশি। টাকার বণ্টন আরও বৈষম্যমূলক হয়ে উঠবে। আর তারপরেই, রাতারাতি সরকারের ব্যয় প্রায় তুলে দিল থ্যাচার সরকার। সরকারের অধিকার উঠিয়ে দেওয়া হল পেট্রোলিয়াম থেকে শুরু করে জল, বিদ্যুৎ, শিল্প, শিক্ষা, গ্যাস, টেলিফোন, এয়ারলাইন, তেল। সব বেসরকারি হাতে বিক্রি হল। টেন্ডার দেওয়া হল এমনকী কাউন্সিল সার্ভিসের বাড়িঘরেরও। পুলিশ ফোর্সেরও ঘটল বেসরকারীকরণ। থ্যাচার বললেন– আমি এমন এক অর্থনীতি আনছি যা, কয়েক মাসের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির এতকালীন সংকটকে ধুয়ে দেবে।
বাস্তবে যা হল, তা উলোটপুরাণ। তিন বছরের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ল দ্বিগুণ! ১৯৮৬—তে ব্রিটেন মুখ থুবড়ে পড়ল। যা অর্থনীতির জগতে ‘বিগ ব্যাং’ নামে পরিচিত।
আজকের ভারতের সঙ্গে চেনা চেনা ঠেকছে এসব?
এখন প্রসঙ্গ উঠবে, এই ফ্রি মার্কেট ভারত তো নিল ১৯৯১ সালে। কিন্তু, সেটা খুবই কম শতাংশে। স্বয়ং সম্পূর্ণ ব্যবসার রাস্তা বিদেশি সংস্থাদের প্রায় ছিল না। বেশিরভাগটাই হত সরকারের মধ্যস্থতায়। কিন্তু, ততটুকুতেও এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল তৎকালীন বিরোধী পক্ষ এবং আজকের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি, তথা এনডিএ পক্ষ। কেন বিদেশি সংস্থাকে ঢোকানো হবে। ২০১০ নাগাদ ৪৯-৫১ শতাংশ শেয়ারের ভিত্তি তৈরি হল। দেশ জুড়ে ভারত বন্ধ শুরু হল। ২০১২-তে পরিস্থিতি তুঙ্গে। যন্তরমন্তরের সামনে নীতীন গড়করি ভাষণ দিলেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আমেরিকার পা চাটা!
আর আজ? বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, ২০১৪ থেকে ২০১৫-র মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদেশি সংস্থার প্রবেশ ৮০ শতাংশ সুনিশ্চিত হল। আজ তা ১০০ শতাংশ। এবং সরকারি আওতাধীন যে পরিসরগুলি, সেখানে প্রবেশ আজ ৮০ শতাংশ। খুব শিগগির আরও ২৫টি সেক্টর থেকে সরকারি হস্তক্ষেপ উঠে যেতে চলেছে। সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ হবে!
ভারতে এই অর্থনীতি লাগু হওয়ার শুরু ছিল খানিক নিয়তি স্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়নও যখন আটের দশকে খোলা বাজারে ভরসা করল, তখন বিশ্বে লাগল আসল আগুন। খোলা বাজারের অর্থনীতিতে ফ্রিডম্যান যে গণতন্ত্রের ফাঁস ঝুলিয়েছিলেন, তা সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণকে। এতকালের কমিউনিস্ট অথোরিটারিয়ান শাসন কে—ই বা চাইবে। কিন্তু তাদের জানা ছিল না চিলির কথা, চিলিতে মার্কিন সন্ত্রাসের কথা। তারা দেখল মার্গারেট থ্যাচারের ব্রিটেনকে। দেখল তাদের চুপিসাড়ে প্রোপাগান্ডামূলক ঝাঁ চকচকে ইংরেজি সিনেমা, স্বাধীনতার বাড়া। জিন্স, ম্যাকডোনাল্ড, গাড়িতে জিপিএস, খুলে—আম জীবন, দেখল সারারাত জেগে থাকা শহর। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গর্ভাচেভ নিরুপায়। দেশ জুড়ে বিক্ষোভ আরও সমাগত। কিন্তু তিনি কেন্সের তত্ত্ব ও ফ্রি মার্কেট মিলিয়েমিশিয়ে অর্থনীতি চাইলেন। কিন্তু নয়ের দশকের শুরুতে ‘জি৭ সামিট’—এ তাঁকে সাবধান করে দিল ইউরোপীয় ও মার্কিন কূটকুল, ওসব মধ্যস্থতা চলবে না। হয় এসপার নয় ওসপার। নয়তো তুমি তোমার নিশ্চিন্ত শাসনব্যবস্থা, ক্ষমতা পাচ্ছ না। ফ্রি মার্কেট যাবে না ওখানে। এবং তা এল। সম্পূর্ণরূপে। কী হল তারপর? সোভিয়েতের ভাঙন। গণতন্ত্র ক’টা জায়গায় এল, ঝাঁ চকচকে জীবনও বা এল কই।
ঘটনাচক্রে, বিশ্বের অন্যতম দু’টি রাষ্ট্রে ফ্রি মার্কেট চলে এল। বাকি দেশও আর যায় কোথায়। পুঁজিবাদ ঘুরে গেল পুরোপুরি ফ্রি মার্কেটের দিকে। তাকে ঘোরানো হল। তারই ফল ভারতে ’৯১—এর ফ্রি মার্কেট পলিসি আনয়ন। কিন্তু, ভারতে যে প্রবেশ ছিল নিয়তির, তাকে হাড়ে হাড়ে বাস্তব করে ছাড়ল বিজেপি সরকার।
তৎকালীন কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার সরকারি ক্ষেত্র বিক্রি করতে যায়নি। ২০১৪—য় বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার, তথা বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসা মাত্র, ২০১৫ সালে সর্বপ্রথমে চুপিসাড়ে ‘কোল ইন্ডিয়া’ বেচে দিল। সে খবর কার জানা? তারপর বেচল নৌপথে কার্গোবাহী ‘কনকর’—কে। আজ রেলপথ জানছি। জানছি সরকারি টেলিকম ‘বিএসএনএল’ বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা। জানছি ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ বিক্রির কথা। জানছি দেশ জুড়ে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। শিক্ষাখাতে অর্থ বরাদ্দ কমিয়েছে এই সরকার, সে কথাও জানছি।
আর কী জানছি?
সুরক্ষা খাতে টাকা ঢালছে তারা। দেশের সুরক্ষা চাই। (ভিদেলা—র নীতি মনে পড়ছে? আর্জেন্টিনার স্বৈরতন্ত্র?)
আপনারা ভাবছেন, এ সব তো ফলাফল। তথাকথিত ফ্রি মার্কেটের ‘শক থেরাপি’র থেরাপি বলছি। শক কই?
এবার ভাবুন।
শক ১– রাতারাতি নোটবন্দি। যে কারণে করা হল, সেই কালোটাকা ফিরল? প্রশ্ন করুন। ক্ষুদ্র শিল্প ধূলিসাৎ। মানুষের হাতে টাকা নেই। চাষবাস বন্ধ করে বহু বহু চাষি ভানুমতীর খেলা দেখাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমাজের তলার শ্রেণির মানুষরা, যারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে। বেকারত্ব বাড়ল চক্রবৃদ্ধিতে। এবং বিজেপি কি এর স্বীকার করল? না। বরং, বলল এসবই পূর্ববর্তী সরকারের দোষে। ক্রাইসিস তৈরি হয়ে গেল তবে। শক লাগল। এবার থেরাপি। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র বেশে আনা হল বিদেশি বাজারকে। ক্রীতদাসের রেটে চাকরি জুটল। (চিলি প্রসঙ্গ মনে পড়ছে?) সরকারের হাত থেকে চাকরি ফসকে যাচ্ছে এ কথা আমরা কি বুঝলাম? না। আমরা শুনলাম, সরকার বলছে ব্যবসা করো। শুনলাম না– চাকরি চেও না। সরকারের কাছে চাকরি নেই। খোলা বাজারে ব্যবসা করো।
এখন আপনি ভাবছেন। ভাল তো। ব্যবসা করব।
এখন আপনি ভাবছেন, খোলা বাজারের অর্থনীতি। বড়লোক হওয়ার চান্স আগে ছিল না। এখন তো হল।
আপনি ভেবে এসেছেন, আপনি গরিব। কিন্তু গরিব হতে আপনি কখনওই চান না। হাতে টাকা থাকুক, অভাব না হোক– আপনি চান। সকলেই চায়।
আপনি তাই ভেবেছেন, বড়লোক হওয়ার সুযোগ তো করেছে এই বাজার। রেসে তো নেমেছি।
কিন্তু, আপনি বুঝলেন না, আপনি যে রেসে নেমেছেন, সেই রেসের খেলার মজা নিচ্ছে পুঁজিপতিরা। গ্যালারিতে বসে। আর আপনার উপর বাজি লড়ানো হয়েছে।
শক ২– সকাল এগারোটায় বিরোধী পক্ষকে না জানিয়ে, কোনও ডায়লগে না গিয়ে ৩৭০ ধারার বিলোপ করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। প্রেসিডেন্টকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়ার পর, বিরোধী পক্ষকে বলছেন, এবার আমরা আলোচনায় আসতে পারি। বিরোধী পক্ষ তো ছেড়েই দিলাম, কাশ্মীরের প্রশাসনের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনায় গেল না তো বটেই। তাদের আটক করে রাখা হল আগে থেকে। ১৪০ ধারা জারি করা হল আগের দিন। এগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি? প্রসঙ্গত, কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল কিছু শর্তে। সেই শর্তই ৩৭০ ধারা। সেই শর্ত ভঙ্গ দু’-পক্ষের আলোচনা ব্যতীত হতে পারে না। কিন্তু সেটাই হল। (এবার, এই নিয়ে কথা বললে পরে, বিজেপি সমর্থকরা কাশ্মীরী পণ্ডিতদের কথা তুলে আনে। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় কাশ্মীরী পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে এই সরকার? উত্তর পাবেন না। কারণ, কাশ্মীরী পণ্ডিতরা এখন রাজনীতির পুতুল। তাদের ব্যবহার করা হবে।)
শক ৩– নোটবন্দি পেরিয়ে এবার আসা যাক ভোটবন্দি-তে। যে তামাম ১৩৫ কোটি দেশবাসী, নাগরিক ভোট দিয়ে এই সরকারকে এনেছে, তাদেরই নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর– থ্রি ফিংগারস স্যালুট। কন্ট্রোল, অল্ট, ডিলিট।
অনেকে ভাবছেন, সমস্যা একমাত্র সেই মুসলিমদের, যারা ভারতীয় নয়। খুব সহজ হিসেব দিই। এনপিআর-এর মাধ্যমে আপনাকে প্রশ্ন করা হবে বিভিন্ন। সেসব প্রশ্নের উত্তর কোনওরকম সন্দেহজনক লাগলে, আপনার কাছে চাওয়া হবে কাগজ। সেই কাগজ অনুযায়ী আপনার তথ্যে কিঞ্চিৎ ঘাটতি, যেমন আপনার মা-বাবা, বা আপনার মা-বাবার মা-বাবার তথ্য যদি অসম্পূর্ণ হয়, তবে আপনি হবেন ‘ডাউটফুল সিটিজেন’। এবার যে-ই না, আপনি ‘ডাউটফুল’ হিসাবে এনআরসি-র খাতায় নতিভুক্ত হলেন, আপনাকে ১২০ দিন সময় দেওয়া হবে ট্রাইবুনালে গিয়ে যে, আপনি এ দেশেরই। আর যেই না সেই ফর্ম আপনাকে ফিল-আপ করতে হবে, সেখানে থাকবে দু’টি স্থান। যেহেতু আপনি ডাউটফুল, আপনাকে টিক দিতে হবে হয় মাইগ্রেন্ট কিংবা ইমিগ্রেন্ট হিসাবে। এবং আপনি বাধ্য, কারণ আপনার আর কোনও উপায় নেই। এবং তৎক্ষণাৎ আপনি আর দেশের নাগরিক রইলেন না। রইলেন কেবল দেশবাসী হয়ে। আপনার কোনও নাগরিক অধিকার থাকল না। আপনি ভোটাধিকার খোয়ালেন। দেশভাগের ঘা নিয়ে, চরম লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের ইতিহাস বইতে বইতে এই দেশে শেষমেশ নাগরিকত্বের সন্দেহ মেঘ ছড়াল।
এখন অনেকে ভাবছেন, আপনি বেঁচে যাবেন।
কিন্তু, এখানে ধর্ম নির্বিশেষে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নারী। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, নারী মাত্রই শিকড়ছিন্ন। বিয়ের আগে তাদের এক পদবি, বিয়ের পর অন্য। সেই রূপে দুইরকম তথ্যনথি। পদবি যদি না-ও বা বদলায়, সমাজের নিয়মানুবর্তিতায় তার ঠিকানা খণ্ডিত। সে কারও কন্যা, কিংবা কারও স্ত্রী। দুই পরিচয়ের ফাঁড়া। নাগরিকত্বের প্রশ্নে গরমিল তৈরি হওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা নারীদের। অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ নারী।
আর আর্জেন্টিনায় নারীদের কী হয়েছিল, কী রূপে তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল, লিখেছি পূর্বে।
৮. এবং ডিটেনশন ক্যাম্প। আসামে এনআরসি বলবৎ করার কাজে যেসব কর্মী মোতায়েন করা, তাদেরও পরিবার থেকে এমনকী নাম কাটা গিয়েছে তালিকায়। সুতরাং, আপনি রাষ্ট্রের কাটাকুটি খেলার প্রিভিলেজড জল্লাদের কাজ করতেও হয়তো পারেন, কিন্তু তাতে আপনার আশঙ্কা কমে যাবে না।
উপরোক্ত পয়েন্টগুলির আগে যে দীর্ঘ অতীত চারণের চেষ্টা করলাম, তার সঙ্গে পয়েন্টগুলি সাদৃশ্য দেখুন। দেখুন তার ফলাফলের সাদৃশ্য। বুঝুন, আপনি কতখানি স্বাভাবিক আছেন? কতখানি দেশ আপনার হয়ে আছে?
একটা কথা মনে রাখা জরুরি। প্রয়োজনের তাগিদেই আদর্শের জন্ম। এবং কোনও আদর্শই ক্ষমতায় এলে আদর্শমুখর থাকে না। মানুষের মতো, মানুষের গড়া প্রত্যেকটা নির্মাণে ‘মানুষমাত্রই ভুল’—এর মতো ভুলচুক ঢুকে রয়ে আছে। তাকে বারবার প্রশ্ন করতে হবে। কখনও জাতীয়তাবাদ ঠিক মনে হবে, কখনও মনে হবে সাম্যবাদ ঠিক। কিন্তু মনে রাখবেন, ক্ষমতায় এসে এর প্রতিনিধিরা কেউ—ই স্বৈরতন্ত্র ফলাতে ছাড়েনি। আর তার চেয়েও বড় কথা– আদর্শের নীতিতে রাজনীতি কখনওই ছিল না পুরোপুরি। এর সঙ্গে অর্থনীতি ঢুকে রয়েছে তীব্রভাবে।
ফ্রি মার্কেট ইকোনমি পুঁজির বৈষম্যকে সুস্থ করতে আসেনি। সে বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করতে চায়। পুঁজিপতি অর্থাৎ টাকার গদিতে বসে থাকা বিজনেস টাইকুনদের সর্বেসর্বা করতে তৎপর। এবং আপামর সাধারণ খেটে খাওয়া, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণিকে এই নীতি কেবল ‘বড়লোক হওয়ার ১০১ উপায়’-এর বই খুড়োর কলে ঝুলিয়ে রেখেছে। তারা কেবল ছুটবে। তারা ১০ গুণ আয় করবে, সেখান থেকে ৪০০ গুণ আয় করবে পুঁজিপতিরা।
এই নীতি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের নীতি। আপনাদের কাছে সহজতম উদাহরণ ফেসবুক। সে ইনস্টাগ্রাম, হোয়াট্সঅ্যাপ সকলকে কিনে নিয়েছে।
ফ্লিপকার্ট কিনে নিয়েছিল স্ন্যাপডিল-কে। ফ্লিপকার্ট-কে কিনে নিয়েছে ওয়ালমার্ট।
বড়বাজার মাছি তাড়াচ্ছে। হোলসেল মার্কেট তৈরির দিকে এগিয়ে আসছে অ্যামাজন। যখন তখন ‘সেল’ লাগিয়ে ভর্তুকির খেলা খেলছে তারা। গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, হগ মার্কেটের মতো বাজারে কায়কম্মে পাপক্ষয়ে ব্যবসা চলছে। কারণ, অনলাইন মার্কেটের মতো ছাড় দিতে পেরে উঠছে না। আর আপনিও ভাবছেন, কতটা কম খরচে ঠিকঠাক জিনিস পাওয়া যায়।
দিকে দিকে ইংরেজি মাধ্যম মুখ্য হয়ে উঠছে। সেখানে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে উঠতে চাইছে এ দেশে হিন্দি। রাজ্যে চাইছে সেখানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা। এ রাজ্যে যেমন বাংলা।
পরিসর যদি একটু ছোট করা হয়, কলকাতায় রাঢ় বাংলা কবেই হয়ে উঠেছে প্রধান বাংলা। ঝাড়খণ্ডী, রাজবংশী, কামরূপী প্রভৃতি আঞ্চলিক রূপভেদ ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে।
মেনস্ট্রিম বনাম প্যারালালের বিরোধকে ঘোরতর করে দিতে চায় এই নীতি। কোনও আপস নয়। ‘জোর যার মুলুক তার’-কে মান্যতা দেয় এই অর্থনৈতিক মেডিকেশন। যে অ্যাচিভমেন্ট, স্বীকৃতি, অহং-এর চর্চা আমাদের ভিতরে হয়ে চলে, তাকে বাজার করেছে এই নীতি। এতকিছুর সমষ্টিগত রূপ এই অর্থনীতির মূলনীতি।
তার চেয়েও বড় কথা, এর অভিপ্রায় প্রচণ্ড রূপে আদিম। যে একক আধিপত্যের তরজাকে এই নীতি লালনপালন করে, মানবপ্রজাতি তথা হোমো স্যাপিয়েন্স তার বিবর্তনের প্রাক্কালে, তার মানুষ হয়ে ওঠার দৌড়ে এই খেলাই খেলেছিল। একক হওয়ার নীতি। হোমো নিয়ান্ডারথাল, হোমো ইরেক্টাস, হোমো ডেনিসোভা প্রভৃতি আরও হাজারেরও বেশি মনুষ্যপ্রজাতিকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্স একক মানুষ হয়ে উঠেছিল এই বিশ্বে।
তারপর, তার বৈচিত্র ঘটেছে বহু রূপে। বহু স্তরে। বিভিন্ন প্রেক্ষিতে।
তার মানে কি, চিরাচরিত সেই সার্ভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট-এর খেলা? যোগ্যতমের উদ্বর্তন? সেই সময় কি রেখেছি আমরা নিজেদের জন্য পৃথিবীতে? একক হতে হতে হতে হতে একা হয়ে যাওয়ার আড়ষ্টতা কি হ্যালুসিনেট করছে না? করছে।
তাহলে রুজভেল্টের ওই যে কথাখানি– একটাই কাজ এখন, ভয়কে ভয় করব না– মনে করা আশু প্রয়োজন।
কিন্তু কীভাবেই বা ভয় করব না? সাহস অর্জন করব কীভাবে? এই সাম্রাজ্যবাদী, ফ্যাসিস্ট, স্বায়ত্তশাসনকামী, স্বৈরতন্ত্র ও সর্বোপরি শীর্ষতনয় পুঁজিবাদের জরাকে ঘায়েল করব কীভাবে?
প্রথমত, সভ্যতার এই প্রান্তে এসে ক্যাপিটালিজম-কে অস্বীকার করা আর সম্ভব নয়। কিন্তু, দরকার এমন এক ক্যাপিটালিস্ট নীতি, যার বিবেকবোধ রয়েছে। যে ক্যাপিটাল বা পুঁজির নীতি মানবাধিকারের কথা কথা বলে।
দরিদ্র শ্রেণির মানুষরা বহুকাল লাঞ্ছিত, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের হাতে শুধু টাকা গুঁজে দিয়ে চলবে না। তাদের হৃত সম্মান ফেরত দিতে হবে। তারা তাদের আত্মসম্মান ফেরত চায়।
বিশ্বায়নের নামে যে উচকিত জিনিসপত্র গেলানো হয়েছে, সেসব থামিয়ে সর্বক্ষেত্রে ও সর্বতোভাবে তার বিস্তার দরকার। এমন এক ক্যাপিটালিজম, যা আসলে ওই নরনারায়ণ সেবামুখী।
মানবাধিকারের ভিত্তিগুলিকে পুষ্টি দিয়ে এগোতে হবে, সেটাই দাবি। তৃণমূল স্তর থেকে সেই দাবি উঠে আসবে। রাস্তাঘাট, যানবাহন, পরিবারতন্ত্র, অফিসকাছারি সর্বত্র মানুষের জীবনযাপনে মানবৃদ্ধিতে যা আবশ্যক। আর নিজেকেও হতে হবে ততটাই সচেতন। আপনার হয়ে কেউ বলে দেবে না যেমন, তেমনই আপনি বললে, আরও একজন সেই অধিকারের কথা বলার সাহস পাবে। নিজেকে সচেতন হতে হবে।
আপাতত একটা উপায় দিয়ে রাখি।
সজাগ থাকুন। চোখ কান খোলা রাখুন। কথার প্যাঁচ ধরুন।
আমি লিখেছিলাম– এখানে আকাশ নীল ও পেঁয়াজ দশ টাকা। দশ টাকায় কতখানি, তা উল্লেখ করিনি। বিকৃত ইতিহাস, বিকৃত খবর, বিকৃত তথ্য যাচাই করুন। সজাগ থাকুন। কারণ, আপনার অস্তিত্বের প্রশ্ন উঠেছে এই দেশে। আপনার ইতিহাসকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।