সেলিম মল্লিক

এক উদ্বৃত্ত মানুষের কবিতা

শম্ভু রক্ষিতের প্রয়াণের দিন, তাঁরই সমবয়সি একজন কবিকে সোসাল মিডিয়ায় মন্তব্য করতে দেখেছি যে, শম্ভুর মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হল ‘এক অসম্ভবের যাপন’। এবং তারপর আরও অনেকেই ওই কথাটি মাঢ়ীতে চেপে জাবর কেটেছেন। সবারই লক্ষ্য শম্ভুর ব্যক্তিজীবন যাপনের দিকে। এভাবেই আমরা প্রায় সকলেই তাঁর জীবনযাপনে কৌতূহলী হয়ে তাঁর কবিতাকে নজর করিনি সেভাবে। আর তাঁর জীবনানুষঙ্গে যে তাঁর কবিতাকে খোঁজা অহেতুক, তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। ‘কবির ভিতর-বাহির অপাংক্তেয়’, তাই কবিতাকে জীবনচরিতে খুঁজতে চাওয়া, আসলে কবিতাকেও অপাংক্তেয় করে দেখার দুরভিসন্ধি বই আর-কিছু নয়। অথচ আমরা খেয়াল করলামই না, আমাদের চিরাচরিত কবিতাচর্চার পাশে তাঁর কবিতা কতবড়ো অসম্ভবের সাধনার সিদ্ধি হয়ে পর্বতপ্রমাণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের জীবনের সাপেক্ষে তাঁর জীবনকে ধারণা করলেও, নিজেদের কবিতার প্রেক্ষিতে দণ্ডিত আমরা তাঁর কাব্যিক অভিজ্ঞানকে ধারণা করবার সামর্থ্য আজও অর্জন করলাম না। অবশ্য পাঠকের ব্যাপারে তিনি নিজে নিশ্চিন্ত ছিলেন। একবার পোষ্য এক বেড়াল দেখিয়ে বলেছিলেন, সে-ই হল তাঁর কবিতার ‘একমাত্র প্রকৃত পাঠক’। ‘প্রকৃত পাঠক’ যে তিনি পাননি বাংলা কবিতার বিশাল পাঠকবৃত্তের মধ্যে, তাঁর কবিতার প্রকৃত পাঠোদ্ধার যে সেভাবে হতে দেখেননি তিনি, তা-ই হয়তো কথাটির কূটাভাস। কিন্তু আমরাও কি দেখেছি? বোধ হয় না। কিন্তু কেন? আমাদের কবিতা পড়ার যাবতীয় দৃষ্টি, তা সে ঋগ্বেদ-কথিত ‘সুবাসা জায়া ও তার অধিকারী পুরুষ’-এর মতো কবিতা ও কবিতাপাঠকের সম্পর্ক হোক, কিংবা প্রাচীন রসবেত্তাদের মতে সহৃদয়ের সমভাবাপন্নতাই হোক, এসব শম্ভু রক্ষিতের কবিতার পাঠের ক্ষেত্রে খাটে না। বরং তাঁর কবিতাকে কবিতা ছাড়িয়ে গিয়ে অনেক বেশি উপভোগ করা সম্ভব। তার জন্য হয় আমাদের একেবারে অকৃত্রিম স্বভাবের অনুগামী হতে হবে প্রকৃত অর্থে ওই ‘বেড়াল’-এর মতো, নয়তো আধুনিক বিশ্বের দার্শনিক চিন্তাগুলির দরজায় কড়া নাড়তে হবে। মোদ্দাকথা, তাঁর কবিতাকে কবিতা আঁকড়ে থেকে পাওয়া যাবে না। আর্কেটাইপ, মিথ, রূপক, উপমা সবই আসে তাঁর কবিতায়, আসে উদ্ভাসিত হয়ে বিলুপ্ত হওয়ার জন্য। যেন বৌদ্ধ ক্ষণভঙ্গবাদের কাব্যিক কাঠামো। এত ভঙ্গিল, এত ক্ষণজন্মা— সম্পূর্ণ মূর্ত কাব্যপ্রতিমা শেষপর্যন্ত গড়ে উঠবেই না। আর আমরা কাব্যপ্রতিমাকেই কবিতা বলে ভাবতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। রূপে মুগ্ধ হই, ভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ি, ছন্দে সাম্য অনুভব করি, বাচ্যার্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা আবিষ্কার করে ভেতরে আহ্লাদ জন্মায়। শম্ভু রক্ষিতের কবিতা হাতুড়ি মেরে এই সবকিছুকেই চুরমার করে দেয়। শম্ভুর কবিতা নিয়ে একটি আলোচনায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য জাক দেরিদার সূত্রে লিখেছেন, “জরাথুস্ত্র বা নিটশের হাতুড়ি তার সঙ্গেই কথা বাঁধে, আলাপ জমায়, যার তিন নম্বর কান আছে”। এই তিন নম্বর কানওয়ালা পাঠকের জন্য শম্ভু রক্ষিতের কবিতা অপেক্ষা করতে করতে নিজেই নিজেকে ‘আত্মসাৎ ও আক্রমণ’ করে। তাঁর কবিতার ‘আমি’ ‘ধ্রুব বিশ্লেষণ ও স্থির বিষয়বস্তুতে ক্লান্ত’। কবি চিরন্তন সরকার কথাপ্রসঙ্গে একবার মোক্ষম একটি কথা বলেছিলেন: শম্ভু রক্ষিতের কবিতা কবিতার মধ্যে নয়, উদ্ভূত ক্লাইমেটে ছড়িয়ে থাকে। ওই ক্লাইমেটের শক্তি ও প্রভাব এত তীব্র যে, সে পাঠককে ভূতগ্রস্তের মতো আকৃষ্ট করে দাঁড় করিয়ে রাখে। বোঝাবুঝি পরের কথা, আগে ঘাড় ধরিয়ে পড়িয়ে নেয়। পড়িয়ে ছেড়ে দেয় অপরের মধ্যে। অপরের চিন্তায় পাঠক মশগুল থাকেন। তিনি নিজের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায়ও এরই ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘রহস্যহীন’ তাঁর কবিতাগুলো জীবন ও কল্পনাকে একসুতোয় বেঁধে নাড়াচাড়া করলে “বাস্তবের সত্যের থেকেও কবিতাগুলোর সত্য অনেক উজ্জ্বল হবে ও প্রভাব বিস্তার করবে।” জেনের ধারণার সঙ্গে মেলে তাঁর কবিতার একটি-দুটি বৈশিষ্ট্য। জেনের মতোই, তাঁর কবিতা কিছুই নয়, জানতে চাইলে কিছুই জানা যায় না, জিজ্ঞাসা করলে নিরুত্তর থাকে। জেনের মতোই, তাঁর কবিতা সবকিছুই একসঙ্গে, আপনা হতে জানান দেয়, অপ্রশ্নের কানে গুঁজে দেয় সপাট জবাব। পাঠক জেনশিষ্যের মতো, পড়তে পড়তে বিভ্রান্ত হন, কোয়ানে কোয়ানে তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে, চকিতেই আবার সটোরি লাভ করেন যেকোনো মুহূর্তে। সটোরি অর্জন করতে, শম্ভু রক্ষিতের পাঠককে, তাঁর চিত্ত থেকে, এতদিনের কবিতাকে পাওয়ার যে-তরিকা, সেসব মুছে দিয়ে, বেকুবের মতো হাতড়ে যেতে হবে।

 

জেনের প্রসঙ্গটি খুব নির্দিষ্ট অভিপ্রায়ে উল্লেখ করতে মন চাইল, তবে তত্ত্বগত দিক থেকে জেন আর শম্ভুর কবিতার ভূমিকে এক করা যায় না কোনোভাবেই। কোয়ান সটোরির বিষয়টি ভাববার মতো এ-ক্ষেত্রে। জেনের কোয়ান আপাতভাবে হেঁয়ালিপূর্ণ প্রশ্নাবলী, যা শিষ্যের প্রতি গুরু ছুড়ে দেন। শম্ভুর কবিতা লাইনের পর লাইন ধাঁধার পাহাড় দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠকের সামনে। নিবিষ্ট পাঠক তাকে অতিক্রম করে কবিতার কূটগুলো ভেঙে শাঁস খুঁজে পান। এবং তা অতর্কিতে মাথায় কাজ করতে শুরু করে দেয়। সটোরিও তা-ই, কোয়ানের মীমাংসা, অনির্বচনীয় উপলব্ধি, আকস্মিক লাভ হয়, বুদ্ধির ছিপ ফেলে ধরা যায় না। যদিও আক্ষরিক অর্থে কোনো স্থির মীমাংসায় উপনীত হতে চায় না কবিতা, হয়তো মীমাংসার ইশারা মেলে, যা অনেক সময় কূটস্থ। জেনে-শম্ভুতে একটা কৌশলগত মিল ভেবেছি মাত্র। কিন্তু তুমুল সম্বন্ধ পাই হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহাকার সিদ্ধাচার্যদের সঙ্গে। যেন তাঁদেরই পুনর্জন্ম। অন্তেবাসী। প্রান্তজীবী। তাঁতি তেলি ডোম প্রভৃতির মতোই সহজ জীবনকেই সঙ্গী করে অনিশ্চয়ের দিকে বয়ে চলা। আত্মজৈবনিক ছাঁচের ‘আমাদের প্রেম’ কবিতায় এক প্রান্তবর্তী পরিবেশে ‘মহাপৃথিবী’ নামের বসতবাড়ির দেখা মেলে। এবং ওই ‘মহাপৃথিবী’ যেন সুপরিকল্পিত বন্দোবস্তপ্রবণ পৃথিবীর সমান্তরালে প্রতিরোধের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। চর্যাগানও ‘মূল ধারা’র প্রতিরোধী। শম্ভু রক্ষিতের ‘রাজনীতি’র পরিণতিও তা-ই। আর শম্ভুর কবিতার ‘আলি-কালি’র পেছনে যে ‘সন্ধাভাষা’র কবিতার মতোই শম্ভুর নিজস্ব ‘রূপক শব্দ’ ব্যবহারের ভূমিকা থেকে গেছে, সেই ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাপারে কেউ নিশ্চয় দীর্ঘ পরিসরে আলোচনা করবেন ভবিষ্যতে।

 

‘বেড়াল’ আবার ঘুরে এল মনের দেয়াল ঘেঁষে। বেড়ালের কথা বলাটি যে শম্ভু রক্ষিতের কোনো প্রক্ষিপ্ত উচ্চারণ নয়, একটা ঘটনার উল্লেখ করে তাকে দেখা যেতে পারে। তখন সিঙ্গুরে কৃষকের জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বাম সরকার। বিভিন্নভাবে নানান জায়গায় তার প্রতিবাদও চলছে। মেধা পাটেকরের পথসভাকে বাঞ্চাল করেছে পুলিশ। সে-সময় চন্দননগরের গঙ্গার ধারের একটি অতিথিশালায় রাত্রে শম্ভু রক্ষিত ছিলেন। আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলাম তার। ভোররাতে ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি গঙ্গার পাড়ে গিয়ে বিচিত্র সব ‘অর্থহীন’ আওয়াজ করছেন। চিৎকার শুনে রাতপ্রহরীর দল এসে ওহেন কাণ্ড করার কারণ জানতে চাইলে, তিনি বলেন: চাষযোগ্য জমি কেড়ে নিচ্ছে সরকার, আমরা ভূমি হারাতে বসেছি, মানুষের ভাষায় এর প্রতিবাদ করে প্রতিকার হবে না, তাই পশুপাখির ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তিনি। এই জবাবের সামনে আর-একবার মানুষের সামাজিক ব্যাবহারিক ভাষার অভিমুখগুলির জীর্ণতা প্রশ্নের মুখে পড়ল। এতদিনে অনেক চিন্তকই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, মানুষের সভ্যতা দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্ষমতা কর্তৃক বিশ্বাসযোগ্য রূপে পরিবেশিত শত শত গল্পের বনিয়াদে। মানুষের ভাষার এযাবৎ সর্বোত্তম বিকাশকে মাথায় রেখেও বলতে হবে, ভাষার বিবর্তনও ওই গল্পের চৌহদ্দির মধ্যেই স্বস্তি পায়। যে-কারণে ক্ষমতাহীনের ভাষাকে ‘অশিষ্ট’ আর ‘ইতর’ বলে ফেলতে গিয়ে আমরা ক্ষণমুহূর্তও কুণ্ঠিত হই না। ভাষার স্বীকৃত অন্বয়গুলোকেই আমরা অনিবার্য মনে করি। শম্ভু রক্ষিতের ‘বেড়াল’ সেই তথাকথিত অন্বয়ের বাইরের ‘অসংলগ্ন’ বিন্যাসকে থাবা চাটতে চাটতে আস্বাদন করে। শুধু কি তা-ই? আমরা কি আমাদের অস্তিত্বের আশপাশে, অস্তিত্বের মধ্যে পশুকে দেখতে পাই না কখনো? আর সেই পশুর যে-ভাষা, তা কি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিসরে সাবলীল? অথচ ব্যক্তি সে-ভাষায় মুক্ত আনন্দ অনুভব করে। ক্ষমতা তাকে চিনতে চায় না। অকৃত্রিম স্বভাবের অনাবিল ভাষায় ক্ষমতা অস্বস্তি বোধ করে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা অসাধ্য জেনে অগ্রাহ্য করে। শম্ভু রক্ষিতের কবিতার ভাষার দিকে সাহিত্যের মান্য প্রতিষ্ঠান আর মান্যবরেরা যে আড়চোখে তাকান, তা ওই পাখি-পড়ানো ভাষাশিক্ষার জের। ওই শিক্ষাটুকু অগ্রাহ্য করে তাঁর কবিতা পড়লে, কত অনায়াসে বুঝে নেওয়া সম্ভব তাঁর কবিতার ভাষা কোন ‘অনির্ণীত’ যুক্তিতে জগৎ বা বিশ্বকে প্রতিফলিত করছে। বিকট কোনো আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে মুখোশ দেখে ফেললে যেমন দ্রষ্টা ভয় পেয়ে ক্রোধে আয়না ভেঙে ফেলে, এবং তারপর ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরই মুখের চৌচির দশা দেখে আর্তনাদ করে ওঠে, শম্ভুর কবিতার অশৃঙ্খলিত ল্যাঙ্গুয়েজ মিররের সম্মুখে কায়েমি ভাষায় অভ্যস্ত মানুষেরও অবস্থা তা-ই। ভূত দেখতে থাকে। বড়ো সুবিধের পাত্র ছিলেন না শম্ভু রক্ষিত। খিকখিক শব্দে হাসতে হাসতে বলেই ফেলেছিলেন যে, তিনি ভূতেদের জন্য লেখেন।

 

লেখকের মৃত্যুর কথা বলেছেন এ-যুগের বরিষ্ঠ চিন্তক। ‘মৃত লেখক’ যখন ‘জ্যান্ত পাঠক’ হিসেবে লেখাটির ওপর ঝুঁকে পড়েন, তখন যদি পূর্বজন্মের স্মৃতি পেয়ে বসে, তখন যদি অতৃপ্ত আত্মার মতো লেখকের লিখনকালীন অতৃপ্তিগুলো উঁকি দিতে শুরু করে লেখার আনাচেকানাচে, তাহলে লেখকের পাঠক হয়েও লেখকের ভূত থেকে আর নিস্তার পাওয়ার জো থাকে না। তা ছাড়া ‘আমি’র মৃত্যু, লিখতে লিখতে যা ঘটে, পড়তে পড়তে তারই ভূত যেন দেখা দেয়। ‘কবিতার ভূত’ মাথায় চড়লে কীভাবে যেন ‘আমির ভূত’ খেল শুরু করে। অনির্বাণ ভট্টাচার্য তাঁর সন্দর্ভে লিখেছেন, “শম্ভু রক্ষিতের পরের পর কবিতায় সত্তা এক পরিমিত অপরবোধের মধ্যে দিয়ে নিজেকে জড়ো করে অথবা খুলে হাট করে দেয়, এক মায়াক্রূর কূটাভাসের জালে আটকে পড়া, ঝুলে থাকা আমি, জাগর কিংবা ঘুমের ঘোরে, প্রকৃতিজ বস্তুসকলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখনো ইন্দ্রিয়তার বাইরে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে, কখনো আবার শরীরের সীমারেখায় একান্ত নিজস্ব সংবেদনের প্রতিটি পরশ অনুভব করে করে নিজে নিজের কাছে ফিরে আসে।” মণীন্দ্র গুপ্ত ‘মানুষহীন অবিরাম সময়ের জন্যে’ কবিতাকে অবিকৃত ও সক্রিয় রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। মানুষ রইবে না, অথচ কবিতা থাকবে, কে পড়বে তবে? পঞ্চভূতে নিহিত চৈতন্যকে এই সূত্রে নতুন করে ধারণা করবার প্রয়াস করতে হবে।

 

তবু, আমরা কারা তাঁর পাঠক হতে পারি, এবং পারি কোন যোগ্যতায়? নির্দিষ্ট করে বলতে পারা মুশকিল। ভাবতে পারি, ভাবতেই পারি। কবিতার সংক্রমণে আস্থা ছিল শম্ভু রক্ষিতের। কবিতা নামক ‘বস্তু’টি ‘বাইরের জগতে’ ‘অস্পষ্ট ও প্রাণহীন’ পড়ে থাকে। অনুকূল আধার পেলেই, সেখানে প্রবেশ করে, উজ্জীবিত ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এমতো ভাবনায় তিনি কবিতার জনয়িতা ও পাঠকের কাব্যিক সংস্কার অবান্তর করে ‘উৎকৃষ্ট চিত্ত’ ও ‘চিন্তার সারবত্তা’-কে অপরিসীম শুধু নয়, অনপেক্ষ মূল্য দিয়েছেন। তাঁর কবিতা পড়তে শুরু করেই আমরা হাড়ে-মজ্জায় মালুম পেয়েছি, সংস্কার থেকে তাদের পড়ে ফেলা আসাধ্য, সেসবের জন্মও হয়নি সেভাবে, তারা শম্ভুর উৎকৃষ্ট চিত্ত ও চিন্তার সারাংশে স্বয়ম্ভু, পাঠককেও পুরোনো প্রচল ধরতাই ছেড়ে দিয়েই তাদের ধরতে প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। গণ্ডমূর্খরা যদিও প্লেটোকে অনুধাবন না করেই আত্মজ্ঞানীকে নির্বাসনে পাঠাতে তৎপর হয়ে ওঠে। অতএব পেটরোগা রিপাবলিকখেকো ভূতেরা যে শম্ভু রক্ষিতকে সইতে পারবেন না, তা বলাই বাহুল্য।

 

সইতে না-পারাটা অনেক দিক দিয়েই না-পারা। নবারুণ ভট্টাচার্য এক বক্তৃতায় ঋত্বিক ঘটককে যে-অর্থে ‘উদ্বৃত্ত মানুষ’ বলেছিলেন, সেই অর্থে শম্ভু রক্ষিতও সমাজসংসার আর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের চোখে ‘উদ্বৃত্ত’। এঁকে নিয়ে তাই আমরা যতই বিগলিত হই-না-কেন, আমাদের অস্বস্তি খুঁজলে, তার অন্ত পাওয়া দুষ্কর। আমাদের বিশ্বাস আর আয়েশের চেনা চৌকো ছকগুলো ভেঙে মুচড়ে তাদের বাহুগুলোকে যেভাবে শম্ভু রক্ষিত, শম্ভু রক্ষিতেরা বিপর্যস্ত করেন, তাতে সহজ নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা নয়। আর নিশ্চিন্ত হলে এ-কথা স্বীকার করে নিতে কুণ্ঠা রইত না যে, “কবিতা আসলে হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক ক্রিয়েটিভিটি”। বরং ‘আর্যামির গরমমশলা’ ছড়ানো সৌন্দর্যের ধনতান্ত্রিক ধারণাতে আস্থাশীল বলেই, ভাবতে এবং ভাবাতে পছন্দ করি— কবিতা নেহাত সুকুমার কলা ও বৃত্তি, তার চলন ও বলন মন্দমধুর হাওয়ার মতো। কিন্তু শম্ভু রক্ষিত যে বুঝেছিলেন “কবিতা মানুষের সবচেয়ে বিপজ্জনক সম্পত্তি”। 

 

এক হাতের তালির শব্দ নিয়ে একটা প্রসিদ্ধ জেন গল্প আছে। যা আসলে সব শব্দ উত্তীর্ণ হওয়ার জেন। যা আসলে ধ্বনিহীন ধ্বনির রাজ্যে পৌঁছোনোর রাস্তা। শম্ভু রক্ষিতের কবিতার পথও ওই পন্থা। অনেকভাবে অনেক উপায়ে শম্ভু রক্ষিতের কবিতাকে বিবেচনা করতে হবে। সমাজবিদ্যা, রাজনীতি, বিবিধ দার্শনিক প্রস্থান— কত দিকেই-না মুখ বাড়িয়ে রয়েছে তাঁর লিখনাবলী। কত চিন্তার প্রান্তর পড়ে আছে তাদের দশ দিকে।

 

প্রসঙ্গত, চর্যাপদের আলো-আঁধারির রূপক ‘সন্ধ্যাভাষা’ আর ‘সন্ধাভাষা’ এক নয়। ‘সন্ধাভাষা’ ‘সন্ধ্’ ধাতু-নিষ্পন্ন অভিপ্রায়ের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে ‘আলি’ স্বরবর্ণ, ‘কালি’ ব্যাঞ্জনবর্ণ এবং ‘রূপক’ ও ‘রূপক শব্দ’ এক জিনিস নয়। সে যাই হোক, জেনের সঙ্গে শম্ভু রক্ষিতের কবিতার সম্পর্ক ও বিরোধ, চর্যায় আরও কত দূর সম্পর্কিত, ‘বেড়াল’ বা ‘ভূত’-এর মেটাফর আর-কোন সব দরজা খুলে দেয়! এদের ধরে ধরে অনেক কিছুই বলা সম্ভব। আমার অক্ষম অভিলাষ শুধু মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই ছেড়ে দিয়েছে। এসব নিয়ে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, চিরন্তন সরকার, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতো কেউ একদিন-না-একদিন নিবিড় ও বিস্তৃত সন্দর্ভ রচনা করবেন, আশা করি।

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment