প্রকাশনা জগতে ঋত পা রাখে ২০১৫ সাল। তখন নাম ছিল শুধুই ‘ঋত’। দলে ছিলাম আমরা তিনজন। আমি, সুমিতা সামন্ত এবং অন্য আরেক বন্ধু। ঠিক হয়েছিল ঋত প্রকাশ করবে শুধুমাত্র নানা বিষয়ের বই– কবিতা, গল্প, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। আমাদের প্রথম প্রকাশিত বই নীলা দত্ত-এর স্মৃতিকথা ‘ছিন্নমূলের ডায়েরি’। চারফর্মার পেপারব্যাক বই। শুরু হল তুমুল উদ্যম। ওই একটি বই নিয়েই তখন কত ভাবনা। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল বইপাড়ার বিপনন কেন্দ্রগুলি, বিশেষত দে’জ। স্থির হয়েছিল ঋত একবছর সময় হাতে নিয়ে বেশ কিছু বই প্রকাশ করবে, তারপর ২০১৭-র কলকাতা বইমেলায় পূর্ণমাত্রায় আত্মপ্রকাশ। উৎসাহ দিয়েছিলেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সবাই—লেখক, পাঠক, অগ্রজ প্রকাশক সকলেই।
একে একে প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি বই। কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত-এর ‘সমুদ্র থেকে আকাশ’ ও ‘মৃত শিশুদের জন্য টফি’-র পুনঃমুদ্রণ, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, রমা ঘোষ, অদিতি বসুরায়, দেবর্ষি সরকার প্রমুখের কবিতা। বর্ষীয়ান কবি কালীকৃষ্ণ গুহ-এর কবিতা সংগ্রহের প্রথম খণ্ড। প্রসাদরঞ্জন রায়-এর সম্পাদনায় পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল রামনাথ বিশ্বাসের সাইকেলে চেপে ব্রিটিশ ইস্ট-আফ্রিকা ভ্রমণের কাহিনি ‘অন্ধকারের আফ্রিকা’। মিমি রাধাকৃষ্ণন-এর গল্প সংকলন ‘অতীন্দ্রিয়’। মোটামুটি এইভাবে পসরা সাজিয়ে প্রথম বছরের বইমেলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল ঋত।
অনেক কষ্টে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা ২০১৭-য় একটি স্টল পাওয়া গিয়েছিল। যৌথভাবে অন্য একটি প্রকাশনার সঙ্গে স্টল নেওয়া হয়েছিল। এই পর্যায়ে এসে বলতেই হয় একজন মানুষের কথা এবং একটি সংস্থার কথা—শ্রদ্ধেয় সুধাংশুশেখর দে এবং দে’জ পাবলিশিং। ঋত-এর অগ্রগতির পথে প্রথম দিন থেকে এঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিপদে-আপদে তাঁরা সবসময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সুধাংশুজেঠু, অপুদার এই ঋণ আমরা মাথা পেতে স্বীকার করে নিই। তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন। বইপ্রকাশনা সম্পর্কে আমার অজস্র অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ধৈর্য ধরে।
বইমেলায় প্রথমবার আত্মপ্রকাশ করে ঋত যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছিল। মানুষ ভিড় করে বই কিনেছিলেন। প্রশংসা করেছিলেন মুক্ত কণ্ঠে। সকলে ভুল-ভ্রান্তি দেখিয়ে দিয়েছিলেন সস্নেহে। পত্র-পত্রিকায় কয়েকটি বইয়ের রিভিউও হয়েছিল। বলা যেতে পারে প্রাথমিক পা-ফেলাগুলো বেশ সামলে উতরে গিয়েছিলাম আমরা।
২
এরপরের ইতিহাস একাধারে ভাঙা-গড়ার। এমনিতেই কথায় বলে ‘অসাফল্যের ঘর-দোর থাকেনা, সাফল্যের ভাগ সবাই চায়।’ ভাগ-ভাগ আর ভাগ। চোখের সামনে দেখতে পেলাম লুকিয়ে থাকা মানসিক দূরত্বগুলো ক্রমশ হাঁ-করে গিলতে আসছে আমাদের। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো করে ভাবছে ‘আমার ভাগে কম পড়ে গেল না তো!’ ব্যাবসা শব্দটার সঙ্গে অর্থনীতির যোগাযোগ এতো ঘনিষ্ট যে, আর সামলানো গেল না। ২০১৮সালের মে মাসে দল ভেঙে গেল। ‘ঋত’ নাম ঠিকানা বদল করে ‘ঋত প্রকাশন’ নামে নবকলেবরে আত্মপ্রকাশ করল। ভাঙনের মাঝেও আমি আর সুমিতাদি (সামন্ত) রইলাম। তবে পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই যে, ২০১৮-য় গোটা বছরটা জুড়ে আমাদের নিয়মিত বইপ্রকাশের গতিতে ছেদ পড়েনি। সেই বছরও আমরা জীবনানন্দ দাশ-এর বহুবিতর্কিত উপন্যাস ‘নভেলের পাণ্ডুলিপি’ (সম্পাদনাঃ গৌতম মিত্র), ‘এক অখ্যাত আমলার আত্মদর্শন’ (দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়), চন্দ্রাবতী দেবীঃ স্মৃতিকথা ও অন্যান্য (সম্পাদনাঃ সুমিতা সামন্ত) বা ‘লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন’ (সম্পাদনাঃ মৌসুমী ভৌমিক)—এর মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত করি। সঙ্গে কিছু কবিতার বই।
কিছুটা ব্যক্তিগত বাকিটা নৈব্যক্তিক মাধ্যমে আর্থিক খেসারত দিয়ে ‘ঋত’-এর প্রকাশিত টাইটেলগুলিকে বাঁচানো গিয়েছিল ভাঙনের হাত থেকে। এখনও সেই সব বই নতুন করে ‘ঋত প্রকাশন’-এর নামে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বাধা কম আসেনি। নানারকমভাবে ঋত প্রকাশনের কাজের গতি রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছেশক্তির সামনে শেষপর্যন্ত বাধাবিপত্তির কাঁটা পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এসবই ঋত প্রকাশন-এর ইতিহাসের অংশ।
২০১৮ সালে আরেকটি বই প্রকাশ করে ঋত প্রকাশন প্রবল সাফল্য পায়—দেবতোষ ঘোষ-এর ‘তৃপ্তি মিত্রঃ অন্য বিনোদিনী’(ভূমিকা: শঙ্খ ঘোষ)। সুমিতাদি এবং আমি দুজনেই বলা যেতে পারে তৃপ্তি মিত্র-এর গুণগ্রাহী। আমার অবশ্য তাঁকে মঞ্চে অভিনয় করতে দেখার সৌভাগ্য জোটেনি। আমরা দু’জনেই আলাদা আলাদা সময়ে তৃপ্তি মিত্রকে নিয়ে কাজও করতে চেয়েছিলাম। সে সব কাজ কেন, কী কারনে করা হয়ে ওঠেনি সে কাহিনি আলোচনার পরিসর এখানে নেই। অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে তা নিয়ে কথা বলা যাবে। যাইহোক আমরা এগিয়ে চললাম ভালো বই পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা নিয়ে। প্রকাশিত হল নিত্যানন্দ প্রভুর প্রথম সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী জীবনীমূলক গ্রন্থ ‘করুণাবতার শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু’। এর আগে ঋত প্রকাশন আউট-এন্ড-আউট প্রবন্ধের বই প্রকাশ করেনি। শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন-এর তত্ত্বাবধানে গোপালচন্দ্র পাত্র এই গবেষণাপত্রটি নির্মাণ করেন বহুবছর আগে। পাঠক এই ব্যাতিক্রমী প্রয়াসটিকেও যথেষ্ট সদর্থকভাবে গ্রহণ করেছেন।
প্রায় একই সময়ে সমাদৃত হয়েছে একেবারে অন্যরকম একটি স্মৃতিকথামূলক লেখা। শ্যামশ্রী টুটু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘সেই শান্তিনিকেতন; আমার ঘর-বসত…’। পরিচিত বৃত্তের বাইরে লুকিয়ে থাকা শান্তিনিকেতন, তার অজানা কাহিনি এই বইটির উপজীব্য। কাছাকাছি সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল প্রয়াত কবি অমিতেশ মাইতি-এর কবিতা সমগ্র-১ (সম্পাদনাঃ সুমিতা সামন্ত)। ভূমিকা লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।
ঋত প্রকাশনের প্রথম ইংরেজি টাইটেল ‘Geomorphology of the Southern Singalila Range’ (Dr. Samir Kumar Samanta) ২০১৮-র শেষদিকেই প্রকাশিত হয়। এভাবেই আমরা ডানা মেলেছি ধীরে ধীরে। বইপাড়ার থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে একটি নিজস্ব বইঘর তৈরি হয়েছে ঋত প্রকাশনের। বন্ধুরা-পাঠকরা আসছেন। বই কিনছেন নিয়মিত। নতুন নতুন সম্পর্কের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সাদা পাতায় লেখা কালো অক্ষরের হাত ধরে।
৩
এখন আমাদের টাইটেলের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। গর্বের সঙ্গে বলতে পারি মোটামুটিভাবে প্রথমদিকে প্রকাশিত বইগুলিও আমরা এখনও পাঠকের হাতে নিয়মিত তুলে দিয়ে থাকি। নিতান্ত অপারগ না হলে চেষ্টা করি যেন বলতে না হয় ‘এই বইটি আর পাওয়া যায় না’ বা ‘ভবিষ্যতে পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই’।
২০১৯-এর কলকাতা বইমেলা এবং পরবর্তী সময়ে আমরা ভিন্নস্বাদের বাছাই করা কিছু বই প্রকাশ করেছি। জীবনানন্দ দাশ-এর লিটারারি বায়োগ্রাফি ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরিঃ জীবনানন্দের খোঁজে-১ম খণ্ড’ (গৌতম মিত্র), জয় গোস্বামীর আত্মজীবনীমূলক ডকুমেন্টারির চিত্রনাট্য নির্ভর গ্রন্থ ‘আত্মকথনে জয় গোস্বামী’ (মলয় দাশগুপ্ত), ‘কমলকুমার মজুমদার ও অঙ্কভাবনা’ (সম্পাদনাঃ নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ ও প্রশান্ত মাজি), সোমেশ্বর ভৌমিক-এর ‘মিডিয়া সময় সমাজ’, কালীকৃষ্ণ গুহ ও অমিতেশ মাইতি-এর কবিতা সমগ্র-২য় খণ্ড এবং টি.এস এলিয়ট-এর দি ওয়েস্টল্যান্ড ও ফোর কোয়ারট্রেটস-এর বাংলা ভাষায় প্রথম সম্পূর্ণ-সটীক অনুবাদ ‘বন্ধ্যা ভূমি ও চতুরঙ্গ’ (অনুবাদ ও টীকাঃ দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য) ইত্যাদি। এই বইটির একটি বিস্তৃত ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন শ্রীশঙ্খ ঘোষ।
ঋত প্রকাশনের আগামীদিনের পরিকল্পনাও বেশ বিস্তৃতই বলা যায়। প্রবন্ধ-অনুবাদ-সিনেমা-ভ্রমণ—এই সকল বিষয়ে আমরা প্রকাশ করতে চলেছি কিছু বই। খুব দ্রুতই প্রকাশ পাবে এম.আর.জেমস-এর গল্পের অনুবাদ সংকলন, চলচ্চিত্র বিষয়ে ‘স্মৃতি সত্তা ও সিনেমা’, মহাভারতকেন্দ্রিক গবেষণাপত্র, অন্যরকম তুরস্কের কথা ‘মেরহাবা তুর্কিয়ে’, বিখ্যাত ভাস্কর অজিত চক্রব্রতী-এর সামগ্রিক কাজ নিয়ে একটি সংকলন, পৃথিবীর বিভিন্ন সরোবর অভিযান বিষয়ে একটি বই ইত্যাদি। যেটুকু বলা সম্ভব হল তা থেকে আশা করি বোঝাতে পারছি যে বিষয়-নির্বাচনের ক্ষেত্রে আসলে একধরণের বৈচিত্র সৃষ্টির চেষ্টা আমরা করছি। সম্প্রতি মন্দ্রাক্রান্তা সেন ও অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায়-এর ‘বৃষ্টিদিন’ পত্রিকার পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগের সঙ্গে ঋত প্রকাশন যুক্ত হয়েছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। আমাদের পরিকল্পনার সবটা নানা কারণে এখনই প্রকাশ করতে না পারার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। পাঠককে অনুরোধ করবো এর জন্য একটু অপেক্ষা করতে।
ছোটোদের সাহিত্য নিয়েও কিছু কাজ করার চেষ্টা আমরা করেছি। পিনাকী ঠাকুর-এর ছোটোদের জন্য লেখা কবিতা ‘অঙ্কে যত ১০০ পেলে’, দীপান্বিতা রায়-এর গল্প বই ‘হালুমের বন্ধু’ ও ‘ব্যাঙের গান’, রমা ঘোষ-এর কিশোর-কাহিনি ‘টাবু’ ইত্যাদি তার অংশ। ভবিষ্যতেও আমরা খুদে পড়ুয়াদের স্বপ্নের অংশ হতে চাই।
পাঠক হিসেবে এইটুকু বুঝেছি যে, আজও শিল্পের ক্ষেত্রে ভালো কনটেন্ট খুব বড়ো ব্যাপার। তারপর তাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরা। একটা কথা এক্ষেত্রে বলতে চাই। আমাদের প্রচুর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর্থিক সমস্যা, লোকবলের অভাব, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্য—সব রকমই রয়েছে। তবু হাসিমুখে ঋত প্রকাশনকে গড়ে তোলাই একমাত্র লক্ষ্য। আমি জানি সবেমাত্র পথ-চলা শুরু হয়েছে। আরও আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। একাধারে আসবে আক্রমণ ও সমাদর। কী আর করা যাবে ঝড়ের ভয়ে নাও ভাসাব না, এমন মাঝি তো নই।