মেহিকোর কবিতা: দাবিদ উয়ের্তা (David Huerta)
দাবিদ উয়ের্তার বিষয়ে কথা শুরুর আগে নিজেকে কিছু কৈফেয়ত দেওয়া দরকার। এই লেখা পাঠকদেরও। এই কথাগুলো আমার বলে রাখা দরকার খানিকটা ভূমিকার ছলে, খানিকটা নিজের কবিতা চর্চার পরিধির কৈফেয়ত হিসেবে। খানিকটা নিজের অস্থিরতা কীভাবে নিয়ে ফেলেছিল আরও আরও কবিতার দিকে তা নিজেকেই স্মরণ করানোর জন্য, নির্লেখ দিনে। ২০১০ সালে আসা এক আত্মীক উপলব্ধি আমাকে সবরকমের আখ্যান পড়া ও চর্চা করা থেকে বিরত রেখেছে। ২০১২ থেকে সম্পূর্ণ। আমাদের চারপাশের দুনিয়ার লোকেদের অন্যভাষার সাহিত্য বলতে শুধু তত্ত্ব বা উপন্যাসের নাম ছোঁড়া আমাকে উশকে দেয়। কবিতা তো সহজলোভ্য নয়। বাজারে পাওয়া মুশকিল। যাঁরা ধ্রূপদী সঙ্গীতের চর্চা করেন তাঁরা যেমন মূলত সেই ধরণের সঙ্গীতের চারপাশে বেশি ঘুরে বেড়ান, হয়ত সামান্য খোঁজ রাখেন অন্যান্য ধরণের গানের, তেমনি কবির চর্চা অন্যান্য দেশে। আরও বেশি করে কবিতার কাছে থাকাই আমার উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যেই আরও গভীর তলদেশ। অন্যান্য দেশের চর্চা। তার মধ্যে দেখেছি তাঁরা বিশেষত্বে বা স্পেশিয়ালাইজেশান এ আস্থা রাখেন। গার্সিয়া মার্কেস এর কাছে কেউ সমসাময়িক কবিতা বা টমাস ট্রান্সট্রোমের এর কাছে কেউ সমসাময়িক উপন্যাস নিয়ে মন্তব্য চান না। আমি ‘বৌদ্ধ লেখমালা’ বইটির কবিতাগুলো লেখার সময় আখ্যান ও কবিতার দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তার আগের কয়েক বছরে লিখেও ফেলেছিলাম কিছু আখ্যান। কিন্তু হচ্ছিল না। আমাদের প্রচল কবিতা যেমন আমার প্রকাশ মাধ্যম নয়, তেমনই নয় আখ্যান। খুঁজছিলাম নিজের প্রকাশ মাধ্যম। আমি দৃঢ় ও নিশ্চিতভাবে কবিতাকে পাই ২০১০ সালে। আর চেষ্টা করি যাতে আরও বেশি করে কবিতা পড়া যায়। শেখা যায় প্রবণতা। বিশেষত সমসাময়িক কবিতার। যেখানে বাজার সম্ভাবনা শূন্য। সঙ্গে আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের উদ্দীপনা, কবিতা বিষয়ে আরও খনন। আমি বিশেষত্বের প্রতি আরও বেশি করে টান অনুভব করি।
আমার সবসময় মনে হয়েছে একধরণের বড় অভিঘাত আনা কবিতা কখনই বিশ্বের কোনও এক ভাষায় সীমাবদ্ধ হতে পারে না। সবসময় খুঁজে বেড়িয়েছি অফিশিয়াল কালচারের বাইরের কিছু অবয়ব। ফলে আমার রাস্তা সব সময় বেঁকে গেছে ক্লোন সাহিত্য থেকে দূরে। বাংলায় যখন বাংলা কবিতায় জড়িয়ে যাই সেই নব্বই দশকে তখন তা ঘটে জমিল সৈয়দের হাত ধরে ফলে স্বাভাবিকের অধিকারে পেয়েছি সুব্রত সরকার, মণীন্দ্র গুপ্ত বা অঞ্জলি দাশ। (কিন্তু তখন বয়সটা নিতান্তই বিশের গোড়ায় হওয়ায়, দীর্ঘকায় বা শ্মশ্রুবহুল কবিদের টান বেশি জন্মেছে, ভিড়েছি সহজ নকলে, বেরোতে সময় গেছে বছর দশেক) তেমনই স্পেনীয় ভাষার কবিতার অপরে চলে গেছি একই রকমের টান থেকে। সেই টান থেকেই খনন।
এস্পানিয়া বা স্পেনের কবিতা সম্পর্কে পরে আসব, কিন্তু সেই দেশের হাত ধরেই আমার লাতিন আমেরিকার কবিতার কাছে যাওয়া। এবং পাকে চক্রে আমার সংযোগ হয়ে যায় প্রত্যক্ষ। এক নির্লেখ সময় ২০১৬। শেষ হয়ে গেছে ঋতু দ্বিপ্রহর। প্রায় একবছর কবিতার দেখা নেই। আমার কর্মস্থলের গ্রন্থাগারে দীর্ঘশ্বাস ফেলা প্রায় সমগ্র ইস্পানো দুনিয়ার সমসাময়িক কবিতা আমি চষে ফেলি সেই খননকালে। স্পেনীয় কবি বন্ধুদের দেওয়া তালিকা, নিজের খুঁটে দেখার অভ্যাস। তেমনভাবে মেদুসারিও নামক সংকলনটির কাছে। যার কথা আগেই বলেছি।
এই সংকলনেই আমি আবিষ্কার করি দাবিদকে। কোথাও উচ্চকিত নতুন রকমের কবিতা লেখার কথা বলা নেই। কিন্তু আছে পরতে পরতে নবীন। তাঁর সম্পর্কে পড়তে গিয়ে জানলাম তাঁর চারশো পৃষ্ঠার আখ্যানসূত্রহীন দীর্ঘ কবিতা “অনারোগ্য” বিষয়ে। বইটা আমাদের লাইব্রেরিতে ছিল না। কিন্ডল পাওয়া গেল। আমি রুদ্ধশ্বাস পড়ে ফেললাম নটি অধ্যায়ে বিভক্ত সেই সমসাময়িক কবিতার আকরগ্রন্থ। তারপর তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব। বৈদ্যুতিন। আমি তাঁর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিই। ২০১৭ সালে অনারোগ্য বা Incurable নামক কবিতাটির তিরিশ বছর উদযাপন হল। বেরলো স্মারক গ্রন্থ। সেখানে এই অধমেরও লেখার সুযোগ ঘটে। সেখানে আমি লিপিবদ্ধ করি আমার দাবিদ আবিষ্কারের কথা।
কী সেই আবিষ্কার? এক নতুন ভাষা, নতুন আঙ্গিকে কবিতাকে দেখতে চাওয়া। সেই নতুন আঙ্গিক অনেকাংশেই অচেনা লাগে আমাদের, কারণ তা অধিকাংশ সময়ে শুধু আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং নির্মাণ নির্ভর। আমাদের চিরচেনা কবিতাকে তার চিরচেনা চেহারা থেকে বের করে আনা। সেই কবে গদ্য–মাধ্যমে কবিতা লেখা দিয়ে শুরু হয়েছিল কবিতা লেখা। দাবিদ ও নববারোকদের হাতে এসে সে পেল আরেক ভঙ্গি। আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতায় এই ভঙ্গি বিরল। আমার মত ক্ষুদ্র পাঠকের পরিধিতে একেবারেই নেই এই কবিতার জ্ঞান। যদিও দাবিদ নিজে লিখেছেন তাঁর বীজ লেসামা লিমা ও লুইস দে গোংগোরা (১৬ শতকের স্পেনীয় কবি, গার্সিয়া লোরকাদের হাতে পুনরাবিষ্কৃত), হ্যাঁ, সব ভাষাতেই থাকে বীজ, নতুন সম্ভাবনার, এক প্রজন্মের গোপন আগুন জ্বলে ওঠে অন্য প্রজন্মের হাতে। আগের পর্বে লিখেছিলাম নববারোকদের বৈশিষ্ট্য বই–দীর্ঘ কবিতা। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই ৩০০ পাতার একক দীর্ঘ কবিতা আছে। তেমনই দাবিদের অনারোগ্য। আখ্যানসূত্র নেই, কিন্তু আছে অভিজ্ঞতা, প্রতিটা স্তবক চমকে দেয় তার বিস্তারে। আছে জ্ঞান চর্চার টুকরো। আছে প্রতিটা পদক্ষেপে ঝলসে ওঠা নতুনের পাঠ। প্রসঙ্গত বলা দরকার, দাবিদ উয়ের্তার বাবা এফ্রাইন উয়ের্তা মেহিকোর এক প্রধান কবি, ওক্তাবিও পাসের সমসাময়িক। তাঁকে আমরা অনায়াসে মেহিকোর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (কবিতার সামাজিক অবস্থানে, কবিতার ধরনে নয়) বলতে পারি। যদিও দাবিদের খুব ছোটবেলাতেই তাঁর বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, কিন্তু দাবিদের কবি হিসেবে বেড়ে ওঠায় বাবার শিক্ষা ছিল। সাক্ষাৎকারে অস্বীকার করলেও আমরা দেখতে পাই লিরিক কবিতা থেকে থেকে তাঁর ছিটকে যাওয়া। মধুসূদনের লিখনরীতি থেকে জীবনানন্দ দাশ যতটা আলাদা, এফ্রাইন উয়ের্তা থেকে দাবিদ উয়ের্তা ঠিক ততটাই দূরে।
দাবিদের সঙ্গে বহু ইমেইল বিনিময়ে উঠে এসেছে তাঁর নববারোক প্রসঙ্গ। আমি বলেছিলাম এই নববারোক আসলে আমাদের সমস্ত গ্রীষ্মমণ্ডলের। এই উদাত্ত আম বা লিচু গাছ। অজস্র তার পল্লবিত দিক। একদিকে তার নুয়ে আসা, অন্য দিকে তার বসন্ত নির্ঘোষ মুকুলে। ঝিরঝরে ছায়া। বারোকরীতির যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য নবজাগরণকালে উঠে এসেছিল, অর্থাৎ অতিরিক্ত বলে কিছু নেই, আছে দীর্ঘ আলাপ ও বিস্তার। আছে চারুকাজ। আছে সুকারু নির্মাণ। অথচ সে নির্মাণ প্রকৃতি থেকেই নেওয়া। একটা কথা মনে রাখতে হবে যখন বারোকরীতি তখনই উপনিবেশের সবচেয়ে বেশি বাড়। ইউরোপের নবজাগরণ আসলে উপনিবেশের টাকায় প্রযোজিত বললে কম হবে। অতএব এই কবিতাতে তথ্যের চূর্ণ মিশে থাকবে কাব্যিক আবডালে। আর এই মিশ্রণেই জন্ম নিয়েছে এখনকার আমেরিকার poesía documental। এঁরা স্লোগানের পরিবর্তে বেছে নিচ্ছেন ইতিহাসের আবডাল, ছড়িয়ে যাচ্ছেন নানা শাখায়। কবিতা হয়ে উঠছে জটিল, কারণ এখন আর তার “গণ” হয়ে ওঠার দায় নেই। কবির নেই সামাজিকভাবে কবি হয়ে ওঠার দায়। অর্থাৎ কবিতা হয়ে উঠেছে আরও সাহসী। যদিও দাবিদ সাক্ষাৎকারে সবিনয়ে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন সাদা পাতার উপর একটা লাইন লেখাই যথেষ্ট সাহসের, তাই আলাদা করে তিনি সাহসের কথা বলতে চান না। তাঁর কবিতাই তাঁর হয়ে কথা বলুক এটাই তিনি চান।
আমরা যাঁরা তাঁর পাঠক আমরা লক্ষ্য করি কীভাবে তিনি সহজলোভ্য বাস্তব থেকে বেরিয়ে মেতে উঠছেন নির্মাণের এক আদিম স্পিরিটে। পরোয়া করছেন না কবিতার শ্রোতাকে, বরং আরো বেশি করে পাঠ নির্ভর হয়ে উঠছে তাঁর কবিতা। আরও অসহায় ভাবে মেধানির্ভর। যেভাবে প্রাচীন বারোক রীতি জীবন পেয়েছিল স্থাপত্যে প্রকৃতির অনুসরণে। যেখানে সুর বিস্তারপ্রবণ, যেমনটা বা ভিভাল্ডি। যেখানে স্থাপত্য বিরাট ও নকশাবহুল। যেখানে এঁরা নতুন করে দেখতে চান কবিতার আদিম বিস্তৃত চেহারা, যেখানে সে গীতিকবিতার ছোট আকারে সীমাবদ্ধ নয়। যেখানে অতিরিক্ত বলে কিছু ছিল না, বরং ছিল প্রাচুর্যে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করা, তেমনি দাবিদের কবিতা। বা নববারোক পাঠশালায় দীক্ষিত কবিদের। তাঁরা বেছে নিয়েছেন এমন এক পথ, যা মেধাবী মননের পরিচর্যার জন্য জরুরি। যাঁদের বাক্স বাজানো আবেগের ঢক্কানিনাদ, বা কলেজ কলিজার কবিতা, বা খবরের কাগজ থেকে তোলা কবিতায় বুদ্ধি বা মস্তিষ্কের খোরাক হয় না, তাঁদের জন্যই এই কবিতা।