(সম্পাদকের কথাঃ ২০১৭-এর খুব সম্ভবত সেপ্টেম্বর, আকাশে নীল সবে থাবা বসাতে শুরু করেছে। বহুদিনের একটা ইচ্ছে সেদিন অবয়ব পেল। বিকাশদা, বিকাশ গণচৌধুরি নিয়ে গেলেন মণীন্দ্র গুপ্ত ও দেবারতি মিত্র’র বাড়ি। তখন তাঁর সারা শরীরে চর্মরোগটা সবে ছড়িয়েছে। অল্প সময়ের সাক্ষাৎ। দুনিয়াদারি’তে ওঁদের যৌথ সাক্ষাৎকার নেব, এই ছিল অভিপ্রায়। ভয় ও সাহসের মিশ্র-অনুভূতি সমেত কথাটা পাড়তে, সম্মতও হয়েছিলেন আনন্দের সঙ্গে। শুধু বলেছিলেন—‘একটু সেরে উঠি, তারপরই একদিন এসো তোমরা, আড্ডা দেব।’ সেই আড্ডাটা মুলতুবি রয়ে গেছে। আসার সময় ওঁরা ওপার বাংলার কবি অনুপ চণ্ডালের দুটি কবিতার বই উপহার দেন। সেই সূত্র ধরে আমরা যোগাযোগ করি কবির সঙ্গে।)
সময়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ
দেখলাম, সময় বসে আছেন। সরু, ছোট, একটা সর্বোচ্চ-সাধারণ খাটের ওপর তিনি, সময়— বসে আছেন— মণীন্দ্র গুপ্ত! এই আমার প্রথম দেখা। সাল-তারিখের কিছু কি দরকার আছে? এসব তো কেবল মানুষের; মহাকালের কোনো সাল-তারিখ নেই তার শুধু ‘থাকা’ আছে, আর তার অন্তহীন মনের মধ্যে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, তুচ্ছ ও মহৎ সব যতনে গেঁথে-রাখা আছে। তবু যেহেতু মানুষের সীমাবদ্ধ মন, সাক্ষাতের সাল-তারিখ সব অক্ষয় হয়ে থাকে পাসপোর্ট নামক এক অদ্ভুত পুস্তিকায়। তা সে যতই ‘সুবর্ণরেখা’ হোক, দেশ বিভক্তই! কাঁটাতারে ঝুলে না থেকে, নিয়ম-মাফিক পেরিয়ে, তাঁর কাছে প্রথম যাওয়ার দিন তাই সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই প্রথম দেখা ছিল কেবল আমার নয়, আমাদের। ওঁরা প্রথমেই আমাদের পরিচয় পাতালেন রাম-রহিম-জন: অনুপ চন্ডাল, মোস্তাফিজ কারিগর, হেনরি লুইস।
ভাবনা ও উদ্যোগ-আয়োজন সব যার, সে মোস্তাফিজ কারিগর, তরুণ কবি ও চিত্রকর, আমার প্রাণের ভাই। ফোন নম্বর, যোগিয়া বাড়ির পথনিশানা সব যোগাড়-যন্তর তারই। নির্ধারিত সময়ে, যা সম্ভবত বেলা এগার-বারোটা, আমরা গেলাম। দেখলাম, প্রথম! প্রথম পা ছুঁয়ে আমার প্রণাম কবিতার যুগলমূর্তিকে!
আমরা বসেছি ছোট ঘরটার মধ্যে চেয়ারে-মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মেঝেতে বসতে পেরেই ভাল— আহা, ভূমিতলে, চরণতলে বসবার অনুভূতি! কথা এটা-ওটা বলছে মোস্তাফিজ, বলছে লুইস। ‘অক্ষয় মালবেরি’ ধ’রে বরিশালের, তাঁর জন্মভূমির, জন্মভিটের কথা এবং আরও…। কিন্তু আমি দেখছি আমার কোনো কথা যেন নেই; দেখছি আমার বুকের মধ্যে ভাব ও আবেগ বেলাকে অতিক্রম করছে অথচ কথা কিছু যেন নেই। থাকতে পারে কী কথা? এমন যখন পরিস্থিতি যেখানে দুজন সাতাশ ও একজন চল্লিশ এসেছে তাঁরই জন্মদেশ থেকে, যা আজ পরদেশ, যেখানে যেতে তাঁরও হাতে নিতে হবে পাসপোর্ট নামক এক অদ্ভুত পুস্তিকা, তখন কথা মানে তো আগন্তুকদের টুকরো-টুকরো প্রশ্ন ও তাঁর জবাব, তাই নয়? কিন্তু আমি খুব ভীষণ প্রশ্নহীন হই। আকাশ কিম্বা সমুদ্র কিম্বা পর্বতের কাছে আমরা কি কোনো স্পষ্ট, নির্দিষ্ট প্রশ্ন নিয়ে যাই? কিম্বা যদি যাওয়ার বেলা তেমন যাইও, গিয়ে, সমুখে দাঁড়িয়ে, আমরা সম্পূর্ণ প্রশ্নহীন হয়ে পড়ি না কি? তাই, কথা আমার ছিল না কোনো। আর যখন তিনি কিছু বলছিলেন মানুষের ভাষায়, কোনো-এক অমৃতবৃক্ষ থেকে এক-একটি সুপক্ব ফলের ঝরে-পড়ার মতো মনে হচ্ছিল তাকে। মন অঞ্জলি পেতে নিচ্ছিল তা!
মাঝখানে অর্ঘ্যদান পর্ব। অগ্রজের অঘোষিত অধিকারে আমিই দিলাম আমার তখন-পর্যন্ত-প্রকাশিত দুটো বই: ‘বহি চলে নীল- নামশূন্য’ ও ‘গার্হস্থ্য’। দিল মোস্তাফিজ। লুইসও। দেবারিত মিত্র ‘বহি চলে নীল- নামশূন্য’ হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। একসময় মণীন্দ্র গুপ্তর মনোযোগ আকর্ষণ করে তাঁকে পড়ে শোনালেন প্রথম কবিতার মাঝ থেকে শেষ পর্যন্ত। আমি কুন্ঠাকাতর আনন্দ নিয়ে নতমুখে রইলাম। তারপর, আরও যা-কিছু বললেন দুজনে, আমার মনেই গোছানো থাক; শুধু সেসব কথার মধ্যেকার আশীর্বাদটুকু এইখানে লিখি।
ঘড়িবন্দী সময়ের হিসেবে ঘন্টা-দুইয়ের-কম পরে আমরা ছেড়ে এলাম যোগিয়াতীর্থ। দুজনেই ঘর ছেড়ে সিঁড়ির মুখে এসে যুগলে দাঁড়ালেন; “আবার দেখা হবে, আবার এস”, বললেন; সিঁড়ি বাঁক ঘোরা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে বিদায় জানালেন হাত নেড়ে। যা বলা হয় নি: কথাপ্রসঙ্গে, মাঝে মাঝে তাঁর হঠাৎ মুখ টিপে হেসে ওঠা কেমন যে বিস্ময়ের! বার বার এসে কিছুক্ষণ শুধু নিশ্চুপ বসে থাকবার বাসনা নিয়ে ফিরে আসা হল!
বাসনা নিয়ে বারংবার
একবার, সে ছিল হয়ত দ্বিতীয়, আমি আর মোস্তাফিজ, সঙ্গে একরাম ভাই, কবি একরাম আলি। আমরা দুজন পৌঁছে গিয়েছিলাম আগেই; একরাম ভাই একটু পর। পথের বিলম্ব সামান্য ছিল, কিন্তু আরও একটু সময় তাঁর গিয়েছিল বাজারে সফেদা ফল খুঁজতে, মণীন্দ্র বাবুর প্রিয় জেনে। সেদিন একরাম ভাই পান নি; শুধু খবরটা আমাদের জানা হয়েছিল, যাদের বাংলাদেশি উঠোনে গাছ আছে সফেদা ফলের। আর, কী কথা হয়েছিল সেদিন? হয়েছিল, যেমন হতে পারে!
পরের বারও আমরা তিন। লুইসের স্থলে নাসরিন, সে আমার বোন, মোস্তাফিজের স্ত্রী। হ্যাঁ, পাসপোর্ট না দেখেই মনে পড়ছে, সে ছিল পনেরোর শীত, ডিসেম্বর। ও বছরের আরম্ভে আমার আরও তিনটে বই বেরিয়েছিল— সকলি সমাধিলিপি, রসস্তব, Haiku in Autumn Days। ‘সকলি সমাধিলিপি’ নামটা দুজনেই খুব পছন্দ করেছিলেন। দেবারতিদি বললেন: “তুমি কবি তাই অমন লিখেছ, আসলে তোমার এমন ভাবার বয়স হয় নি, কী-বা এমন বয়স তোমার!” শুনে, লজ্জা- পাওয়া খুশি লেগেছিল নিশ্চয়! তবে বইগুলো ওঁদের হাতে দিয়েছি সত্যিই অর্ঘ্যরূপে শুধু; ওঁরা পড়বেন, কিছু বলবেন— এমন আশা করাটা ওঁদের ওপর অবিচার করা হত। তবু সেবার আর একটু সাহস করেছিলাম: অনুনয় করে আব্দার করেছিলাম আমার পরের বই ‘কেউ তবে গাহিতেছে গান- ভ্রমাকুল’-এর প্রচ্ছদটা করে দিতে। তার আগে প্রচ্ছদকথা হয়েছে অনেক। তাঁর হাতের প্রচ্ছদসম্বলিত রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর ‘ব্রহ্ম ও পুঁতির মউরি’ আমার সংগ্রহের অন্যতম প্রিয় গ্রন্থ; অন্যতম প্রিয় কবি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘হলুদ বনে কলুদ ফুল’-এর প্রচ্ছদও মণীন্দ্র গুপ্তর, যার ফটোচিত্র শুধু দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি দেখে। এইসব কথার সূত্রে এসেছে পরমা, এসেছে এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা, আবহমান বাংলা কবিতা…। আর আমার আবেদন শুনে বললেন: “আমি কি আর এখন পারব? হাত কাঁপে, তুলি ধরতে পারি না!” দেবারতি মিত্র বললেন “দাও না, ওরা যখন বলছে! কাগজ কেটে যেভাবে করো ওভাবে একটা কিছু করে দিও।” উনি সম্মত হলেন। দিদি একটা খাতা খুলে দিয়ে বললেন: “এখানে বইয়ের নাম আর তোমার নাম লিখে দাও।” সময়ের প্রসঙ্গে বলা হল উনি যখন পারবেন তখন করলেই হবে, কারণ বইটার কবিতাগুলো তখন লেখা হয়ে চলেছে, ফলে প্রকাশের কোনো সময় স্থির হয় নি। পরবর্তীতে আমি আবার কবে যাব, সেইটুকু শুধু জেনে রাখলেন। তাঁর হাতের স্পর্শ যুক্ত হয়ে থাকবে— এই সৌভাগ্যের অনুভূতিই সেবারের প্রধান প্রাপ্তি!
ফোন ধ’রে, পরিচয় পেয়ে, আমি কলকাতা এসেছি শুনে, দিদি বললেন: “তোমার প্রচ্ছদ হয়ে গেছে, নিয়ে যাও।” সেবারও আমরা দুই ভাই। থরো থরো বুকে প্রচ্ছদটা হাতে নিলাম, কাগজ-কোলাজে করা। হাতে দিতে দিতে বললেন: “তোমাদের পছন্দ না হলে কিন্তু ছাপবে না।” বার বার এই কথা। দিদি বলছেন: “ওদের মনে হয় ভাল লাগে নি। মোস্তাফিজ নিজে শিল্পী, এত প্রচ্ছদ আঁকে, এটা পছন্দ হয় নি।” আমরা বিব্রত হলাম খুব— আমাদের একটু কম ভাললাগাকে গোপন ক’রে কীভাবে আমরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করব! কিন্তু প্রচ্ছদটা অন্যরকম কেমন করেই-বা হতে পারত? আমি শুধু, ওঁদের কথা মতো, বইটার নাম ‘কেউ তবে গাহিতেছে গান- ভ্রমাকুল’ লিখে দিয়েছিলাম; কবিতাগুলোর প্রকৃতি বা সামগ্রিক আবহ বিষয়ে একটি কথাও বলি নি, বলা অশোভন হবে ভেবে। ফলে, কয়েকটা বৃক্ষের মোটিফের পাশে ভ্রমাকুল গায়ককে যে নাগরিক ইমেজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, সেইটুকু ছিল কবিতার গ্রামীণ আবহের সাথে বেমিল। তবু তা ছিল আমাদের জন্য অক্ষয় উপহার, সৌভাগ্য-স্মারক! সেবার কলেজ স্ট্রিট থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর ‘বাড়ির কপালে চাঁদ’। একটু লিখে দিতে বললাম। নীল কালিতে লিখলেন: অনুপ চন্ডালকে সস্নেহে মণীন্দ্র গুপ্ত; আর এই তিনের মাঝখানে কয়েকটি আঁচড়ে এঁকে দিলেন আমার অবয়ব! এই যে এখন লিখতে লিখতে দেখছি তাঁর সেই লেখা আর আঁকা!
পরমাশিস- চিরপ্রেরণা:
কিন্তু সেকথা বলতে গেলে কিছুটা নিরুপায় আত্মস্তুতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, ক্ষমা করবেন। সে-যাত্রা মোস্তাফিজের সাথে মেলে নি। সতেরোর ফেব্রুয়ারিতে, শীত-বসন্তের সন্ধিকালে ‘কেউ তবে গাহিতেছে গান- ভ্রমাকুল’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই আমি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম কবে তাঁর হাতে বইটা তুলে দেব! কারণ এর মধ্যে তাঁর সুস্থতা কমে গিয়েছিল অনেক, জানতাম। প্রায় এক বছর আগে প্রচ্ছদটা পেয়েছি তাঁর হাত থেকে আর সেই বই প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও কোনোভাবে বিফল যদি হই তাঁকে দেখাতে, সে-অপরাধ মোচন জীবনে হবে না। অবশেষে মে মাসের পয়লা দিনে সীমানা পেরিয়ে বনগাঁ স্টেশন থেকে ট্রেন ধ’রে দমদম জংশন নেমে মেট্রো ধ’রে কবি নজরুল নেমে পায়ে হেঁটে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত ও কবি দেবারতি মিত্র’র বাসভবনে। তখন সময় বেলা পোহাবার। আমার সঙ্গী বন্ধু উদয়শংকর। আমরা দুজন ঘরে পেলাম আর দুই সাক্ষাৎপ্রার্থীকে। পরিচয় হল দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য ও শুচিশ্রী রায়। দীপকরঞ্জন—‘অনুমাত্রিক’ তাঁর পত্রিকা। সদ্যপ্রকাশিত ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার মে ২০১৭ সংখ্যায় দীপকরঞ্জন নিয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্তর দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার; সেই পত্রিকা দেখাতে ও দিতে তাঁরা এসেছেন। আমরাও তাঁর প্রচ্ছদচিত্রিত বই তাঁকে দেখাতে ও দিতে। দেখে ঝলমল হেসে বললেন: “আমার করা? এমনই করেছিলাম?” আমি হাত জোড় করে উচ্ছ্বাসভরেই বললাম, “হ্যাঁ, এটাই করেছিলেন, কিন্তু আমি আর মোস্তাফিজ আপনার কাছে মনে মনে মাফ চেয়ে নিয়ে একটা কাজ করেছি— এখানে যে বিল্ডিং আর রাস্তার লাইটপোস্ট ছিল সেগুলো বাদেই কাভারটা মোস্তাফিজ দাঁড় করিয়েছে।” উনি তেমনি উচ্ছ্বলভাবেই বললেন: “ঠিকই করেছ— ভালই হয়েছে মোস্তাফিজ নিজের মতো করে নিয়েছে।” আর দেবারতিদিও বলতে থাকলেন— “খুব ভাল হয়েছে, খুব ভাল হয়েছে! মোস্তাফিজকে বোলো ও যেন আমার একটা বইয়ের কাভার করে দেয়।” সেই অপরাধ ছিল পবিত্র, আর পেলাম ওঁদের প্রশ্রয়, তাই ততটা কাহিল হয়ে আমাকে পড়তে হল না। তৃপ্ত মন নিয়েই বেরোলাম। সে রাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল আদম-সম্পাদক কবিবন্ধু গৌতম মন্ডলের সঙ্গে তাঁর ব্যারাকপুরের ডেরায়।
সকাল আটটার দিকে আমরা বেরোবার জন্যে প্রস্তুত। গৌতম যাবেন কৃষ্ণনগর, আমি টালাপার্কে কবি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। হঠাৎ গৌতমের ফোন বাজল; একটু কথার পর গৌতম আমাকে দিয়ে বললেন— দেবারতিদি ফোন করেছেন। আমি ফোন নিয়ে সাড়া দিতেই তিনি বললেন, “অনুপ, তোমার বইটা কাল রাতে আমি পড়েছি, আজ সকালেও। একটা কথা শোনো— তুমি তো সব দেখেছ আমরা কেমন আছি; এই অবস্থায় এই বয়সে আমাদের জীবনে কোনো ঘটনা ঘটে না— তোমার বইটা পড়া আমার জীবনের একটা ঘটনা। তোমাকে বলছি, আমার খুব ভাল লেগেছে।” এরপর আরও বলে চললেন পেন্সিলে দাগিয়ে কবিতাগুলো পড়ার কথা, বিভিন্ন কবিতা ধ’রে ধ’রে কিছু কথা সেসব সম্পূর্ণ লেখা এখানে অসংযমের পরিচয় হবে। আমি আপ্লুত, নির্বাক হয়ে রয়ে শেষে শুধু বলালম, “আমাকে আশীর্বাদ করবেন।” কিন্তু সেদিন দুপুরবেলা বন্ধু গৌতম আবার ফোন করে বললেন যে দেবারতিদি ফোন করতে বলেছেন। ফোন করলাম সেই দুপুরেই। আরও অনেক বললেন; আমার জীবনযাপন কাজকর্ম বিষয়ে জানতে চাইলেন কিছু কিছু; জানালেন যে তিনি কয়েকজনকে এরই মধ্যে ফোন করে বলেছেন বইটার কথা। আমি বললাম বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় তাঁর সদ্যপ্রকাশিত ‘মহাপয়ারামৃত গীতা’ বইটা ওঁকে উপহার পাঠিয়েছেন আমার হাতে, সেটা দিতে আমি পরের দিন যাব।
পরের দিন পরিচয় হল কবি শংকর লাহিড়ীর সঙ্গে। কয়েক বছর আগে তাঁর ‘উত্তরমালা, বেরিয়ে এসো প্লীজ’ আমার ভাল লেগেছিল আর আজ এইখানে দেখা! এরপর আমার জীবনের একটি মহামুহূর্ত এখানে দেখা দেবে। তার আগে আমি দেখে নিচ্ছি দেবারতি মিত্রের নিজের হাতে পেন্সিলের দাগ ও বিভিন্ন চিহ্নভরা বইখানা। মণীন্দ্র গুপ্ত বসে আছেন— শরীরটা কত জীর্ণ হয়েছে, একটা ভীষণ চর্মব্যাধি অসম্ভব পীড়িত করে চলেছে অনেকদিন— কিন্তু কোনো ক্লান্তি অবসাদ বা হতাশার কথা কোনোদিন মুখে নেই। কিন্তু কথা বলতে কষ্ট হত, তাই চাইতাম ওঁকে যেন বিশেষ কিছু বলতে না হয়। কয়েকবার শুধু শুনেছি, “এখন আর কবিতা আসে না!” নিজেই কবিতার প্রতিমূর্তিরূপে বসে থাকেন, আজও আছেন ওই খাটের ওপর, আমি পাশে গিয়ে বসলাম। ধীরে ধীরে মৃদুস্বরে বললেন, “দেখো, আমাদের তো বয়েস হয়েছে, একটা কথা বুঝি, কবিতা যদি মনকে নাড়াই না দিল তবে তা কিসের কবিতা? অনেকে অনেকভাবে লেখেন ও (দেবারতি মিত্র) আমাকে পড়ে শুনিয়েছে, তোমার কবিতা ভাল।” পথনির্দেশ হয়ে, পাথেয় হয়ে রইল এই কথা!
শেষ পর্ব
এক.
অনুসূর্যার তখনও দুই হতে কিছু বাকি। তার প্রথম কলকাতা আসা মায়ের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। মুকুন্দপুর আর এন টেগোর হসপিটালের পাশে একটা হোটেলে মা-বাবার সঙ্গে তার প্রথম কলকাতা-রাত্রি। কিন্তু চিকিৎসা প্রক্রিয়ার বিরসতায় মনকে শুধু পীড়িত করে রাখলেই চলবে! ভাষাশেখার প্রথম পর্বেই সে শিখে নিয়েছে ভারী ভারী শব্দের নাম— রামকিংকর, রমেন্দ্রকুমার, মণীন্দ্র গুপ্ত, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়…। তাই প্রথম রাত্রির পরের দিনেই তার কবিতীর্থযাত্রা। কিন্তু মুকুন্দপুর থেকে গড়িয়া পর্যন্ত গাড়িতে সে কিছুতেই মণীন্দ্র গুপ্ত বলবে না— সে যাচ্ছে রমেন্দ্রকুমারের বাড়ি! সেকথা শুনে কী খুশি হলেন ওঁরা! দিদি বললেন, “রমেনবাবুর নামটা খুব পছন্দ হয়েছে ওর!” কিছুটা সময় ওর চঞ্চলতায়, হাসি ও কান্নায় মুখর হয়ে উঠল যোগিয়া বাড়ি। আর আমাদের, বাসন্তী ও আমার, পরম প্রাপ্তি— ওর মাথায় ওঁদের আশীর্বাদের হাত!
পরের দিন খুব সামান্য সময়ের জন্যে একা গিয়েছিলাম দেবারতিদি’র পরামর্শক্রমে আমার কয়েকটা বই রেখে আসতে। বেশ কিছুদিন হল মণীন্দ্র বাবুর চর্মব্যাধিটা বেড়েছে— পা দুটো খুব ফোলা, একটু ফেটে-ফেটে যাওয়া। গতদিন দিদি বার বার বিচলিত, বলছিলেন, “ডাক্তার বলেছেন এটা ছোঁয়াচে নয় তবু তোমাদের ছোট মেয়ে…।” কিন্তু সেদিন, এই একার দিনে, শেষ মুহূর্তটা করুণ হয়ে উঠল! আমি সেবারের শেষ প্রণাম করলাম পা ছুঁয়ে। দিদি তো প্রণাম-মুহূর্তে বললেনই, “পায়ে হাত দিও না”, তারপর আবার বললেন, “তোমার ঘরে ছোট মেয়ে রয়েছে, হোটেলে গিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে ফেলো।” বললাম, “না, না, কিচ্ছু হবে না।” “না তুমি বরং এখান থেকেই হাতটা একটু ধুয়ে যাও”— বলেই নিজের হাতে কল খুলে দিলেন। হাত ধুতে হল, ইস্, এটা হয়? প্রণাম ক’রে এভাবে কেউ হাত ধোয়! আবার অন্যদিকে মায়ের আদেশ!
দুই.
“এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।” আর সবচেয়ে বেশি নাম-ডাক জীবনানন্দ ও মণীন্দ্রর দেশের ইলিশের- বরিশালের। কিন্তু দেশ ভাগাভাগি- কাঁটাতার আছে- নিয়ম-মাফিক মানুষ যদি-বা যাবে, ইলিশ যাবে না। তবু যাবে, গোপন কড়ি গুঁজে দিলে যাবে। বেশ, তাই হবে! ইলিশের পণ সে যাবেই কাঁটাতার অস্বীকার ক’রে মনসাবাড়ি থেকে যোগিয়াবাড়ি! তাকে দেখে কী বিমল হেসে ওঠেন প্রাচীন বরিশাল!
তিন.
ঢুকেই এমন আঘাত কখনো পাই নি! ঠিক সেই খাটের ’পরে সময় বসে আছেন— গায়ে এই প্রথম জামা নেই, রাখতে পারেন নি, চর্মব্যাধিটা হৈ-হৈ করছে; পা দুটো আরও ফোলা, অপরস ঝরছে। সামনে লেখার খাতা খোলা— ঘুমহীন রাতের গভীর অবধি ও দিনের সমস্ত জুড়ে ব্যাধিযন্ত্রণা নিঃশব্দে সয়ে তবু … ! ব্যথা-বিবশ মন নিয়ে তবু সেদিন পরমার দেখা পেলাম। একেবারে উপরের একটা তাকে যেন এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা-র সংখ্যা দেখতে পেলাম। ওঁদের অনুমতি নিয়ে দেখতে চাইলাম। দেখি অনেক পরমাও। নীচে এনে বিহ্বল দেখতে থাকলাম এবং না-বলে পারলাম না, “যেসব সংখ্যার একাধিক কপি আছে তা থেকে আমি দু-একটা নিতে পারি?” বললেন, “না। দিতে দিতে আর এগুলোই আছে। একটা সংকলনের কথা চলছে, হয়ে যাক, তারপর।” “ছবি তুলব?” “সে তোমার যত ইচ্ছে!” পরমার ছবিই সম্বল— সে-ই কম কী! কিন্তু কম কিছু রয়েই গেল— প্রণাম করতে সেদিন নিজেই আর পারি নি, শেষ প্রণাম তাই আর করতে পারি নি!
চার.
যেতেই পারি নি! সতেরোর ডিসেম্বরের শেষে কয়েকটা দিন কলকাতায় আবারও অনুসূর্যা আর ওর মা-কে নিয়ে। সারাক্ষণ কষ্ট পেয়ে তবু একটু সময় ক’রে যেতে পারি নি! শুধু শুধু ফোন ধরার কষ্ট ওঁদের দিতে চাই নি ব’লে ফোনও করি নি। গেলে, যেতে পারলে, এই শীতেই হত শেষ দেখা!
অশেষের মাঝে তাঁর যাত্রা এবং তারপর আমরা
শেষ রাত্রি:
মাঘী পূর্ণিমার পবিত্র চাঁদেও গ্রহণ লাগে, ভাবা যায়! সত্যিই, সে ছিল মাঘী পূর্ণিমার নাতিহিম রাত— যে-রাত পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের! আর খবরটা প্রথম এল সেই প্রথম তিনজনের একজন থেকে। লুইস লিখেছে, আর সঙ্গে সেদিনের কিছু ফটোগ্রাফ। মোস্তাফিজকে বললাম: আমাদের দুজনের দীর্ঘশ্বাস মিলিত হল! আর রাত তখন বারোটা এগারো, ওয়াহিদাকে লিখলাম: এমন মধ্যরাতে প্রিয়জন হারানোর খবর পেলাম, জানো! কবি মণীন্দ্র গুপ্ত নেই!! পরদিন ভোরে ওয়াহিদা গভীর লিখেছিল। শূন্যতায় আচ্ছন্ন আমি নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম শুধু লিখেছিলাম:
কে এমন রাতে চলে যেতে পারে?
তিনিই পারেন প্রথম মণীন্দ্র গুপ্ত!
শূন্য যাত্রা:
ট্রেনে উঠে, বসে, অনেকটা চলার পর, এখন সময় হল বলার, কলকাতা যাচ্ছি। বইমেলাটা এবার উপলক্ষ্য; লক্ষ্য, মণীন্দ্র গুপ্তর শূন্য খাটখানা দেখে আসা, দেবারতি মিত্রর সামনে কিছুক্ষণ কিছুই-না-ব’লে ব’সে আসা। কত যে স্নেহস্মৃতি! সেদিন তুমি বলার পর বুঝেছিলাম, অনুভূতিটাকে হাহাকারই বলতে হবে! শূন্যতায় আরও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। ‘আরও’ বলছি তার কারণ মৃত্যুবোধজাত শূন্যতা আমাকে আচ্ছন্ন করেই রাখে; ক্রমশ বেশি বেশি বুঝতে পারছি, সর্বময় এক মায়া এবং ছেড়ে-যাওয়ার বেদনা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই দিনযাপনে বলো, কবিতাযাপনে বলো, এই-ই আমার সব! লিখেছিলাম ওয়াহিদাকে। কিন্তু প্রথম বন্ধ পেলাম যোগিয়া বাড়ির চেনা দুয়ার। সেই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, সেই সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে, ধীরে ধীরে নেমে, রাস্তায়… যেন নিরাশ্রয়— আমার যাত্রা শূন্য রয়ে গেল!