— সাকিনগুঙা তুই এহানে মরলি?
— হ মইরলাম।
— তা মরলি, মরলি… এহানে কেন?
— হ মইরলাম।
— এইডা তোর জমিন? এহানে মরার আগে দুইবার ভাবস নাই? জমিনের পুকামাকড়ও নাদান কইব তোরে।
— হ মইরলাম।
সাকিনগুঙার ঠোঁট দুটো যেন হাল্কা নড়ল! আলতাফ চোখ কচলায়।
শ্মশানের ব্যস্ততায় একা এক খাটিয়ায় শোয়া সাকিনগুঙা তখন মাছি চুমাচ্ছে। মাথা ঘ’ষে ঘ’ষে মাছির কত বিড়বিড়ে আমোদ! আলতাফের হুঁশ হয়, মরা মাইনষের ঠোঁটও তো মরা। সে চোখ তুলে বাকিদের খোঁজে।
সাটিন, বেনো, কাত্তিক অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে। অন্যরা এদিক-সেদিক। ওপাশে, অফিসটা পেরোলেই গঙ্গা। গঙ্গারও ওপারে এখন আগুন, শহর জ্বলছে। মানুষ সেই আগুন পেরিয়ে পোড়াতে এনেছে প্রিয় মৃত শরীরদের। নদীর লাগোয়া ব’লে আলতাফের ঠাণ্ডা লাগে। ভিতরে চুল্লি-ঘরের সামনে এখন আগের লাশ রেডি হচ্ছে। হিন্দিতে কাঁদছে লোকজন। বড়োলোক লাশ — শোয়ানো বডির থেকে সোনার বালা, চেন খুলে নিচ্ছে পরিবার। কনট্রাস্টে চুল্লি-ঘরের বাইরে খাটিয়ায় সাকিনগুঙার গরীব লাশ — ময়লাচিট্টা লুঙ্গি, খালি গা। আর সবটাতেই একই রকম হলুদ আলো।
আলতাফ মন দিয়ে দেখে। মানুষ পোড়ানোর এই কল আর তাকে ঘিরে এত কারবার, এসবই অজানা নতুন তার কাছে — কেমন যেন লেপের ফুটো দিয়ে জাগনা মানুষ দেখার মতো। এখানের লোকজন এসব জানে। তয় এইবার দেশে ফিরা আম্মারে এইগুলা কওয়ার পর তার তব্দা খাওয়া মুখটা চোখে নড়ে — “আল্লা রে! বিদেশ থিকা কত আজব খবর নিয়া আইছে আমার আলতাফ!”
গেলবার ইদের সময় ফিরে আম্মাকে বলেছিল সাকিনগুঙার কথা। এবার ফিরলে বলবে তার লাশ পোড়ানো। শোনা যায় সাকিনগুঙা তাদের দেশের মানুষ আছিল। হাবা মানুষ। হাজার খোঁচালেও এক দুই কথার বেশি কিছু পারত না।
— মুল্লারা খুব খারাপ না সাকিনগুঙা?
— হ খারাপ।
— কেন? তোর পুঙা মারছিল?
— হ।
— আর হেঁদুরা? খারাপ না ভালো?
— হ খারাপ।
— হোই। হেঁদুরা আবার খারাপ কেন? হেঁদুরাও তোর পুঙা মারছিল নাকি?
— হ।
— বোকচোদ। নিজের পুঙা কে মারছিল নিজেই জানো না। নুনু কাটা ছিল না গোটা দেখস নাই?
সাকিনগুঙার মতই আরেকজনকে চিনত আলতাফ ছেলেবেলায় — জিনে-কাটা-নুরুদ্দিন, সেও অমনি।
— নুরুদ্দিন ইন্ডিয়া বালা না পাকিস্তান?
— পাকিস্তান।
— ও নুরুদ্দিন তবে পাকিস্তান বালা না ইন্ডিয়া?
— ইন্ডিয়া।
এই শেষ শব্দের খেলাটা সবাই জানত। আর নুরুদ্দিনরে বুরবক বানাত। এই নুরুদ্দিন বা সাকিনগুঙা এদের কেউই যেন ঠিক পুরা মানুষ নয়। এরা বাকি লোকের তামাশার মশলা। খয়ের সুপারি চুনের মতো ব’সে থাকে — হাওয়া লাগে, রোদ লাগে, রাস্তার ধুলো লাগে। সাকিনগুঙা সিমেন্ট আর বালি মেশায়, পানি মেশায় — একের ভাগ দুইয়ের ভাগ… দুপুরবেলা মুড়ি ছাতু, বিকেলে কোদাল হাত পা ধুয়ে বাসায় ফেরা।
— সাকিনগুঙা ফেরো?
— হ।
— কই ফেরো? বাসায়?
— হ।
— তা, কই তোমার বাসা?
সাকিনগুঙা চুপ। চটির আগা দিয়ে মাটি রগড়াচ্ছে। চোখ সেই মাটিতে।
— কী গো, কই তোমার বাসা?
— অহ-অক — সাকিনগুঙা টেনে টেনে আওয়াজের সাথে আওয়াজ মেশাত, পানি মেশাত, সিমেন্ট মেশাত — অক-অহ-অক-অহ…
— কী কও? সাকিন কই?
— অহ-অহ-অক-অহ…
খালি দম ছাড়ত ঘনঘন। অক্ষর টেনে টেনে ছিঁড়ত। যেন এক ঠিকানা গাঁথতে চায় তা দিয়ে। মাথা নিচু। চটির আগায় মাটি রগড়াচ্ছে আর ওই অহ-অহ-অক-অক…
— একাত্তরে ওপারে ওর ঘরদোর নাকি সব জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কেউ বলে বউ মেয়েকে চুদে আগুনে ফেলে গেছল খান সেনার দল।
— তুমি জানলে কোত্থেকে?
— লোক বলে। তা বাদে আর কোথায় জানব? ওর সাথে যারা সব এসছিল ওর দেশ থেকে, তাদের মুখেই। মালটা নাকি ঠিকানা বলতে পারে না… মাথায় বন্দুকের বাড়ি-টাড়ি খেয়ে থাকবে… “সাকিন কই” জানতে চাইলেই অ্যাঁউঁগ্যাঁউঁ আওয়াজ বেরোয় মুখ দিয়ে।
— সেই থেকেই নাম সাকিনগুঙা?
— তাই তো মনে হয়। রসিক লোক—কী বলো—যে নামটা দিয়েছিল?
— হুঁহুঁ… তা আর বলতে! ওর সাথে বাকি যারা এসছিল তারা এখন কই?
— এ্যাদ্দিনে সবাই দ্যাখো এদিক সেদিক আখের গুছিয়েছে। সাকিনগুঙার মতো হাবা নাকি? খালতলার ঝুপরি, ভেঙে দেওয়ার পর স্টেশন-পারের ঝুপরি, ভেঙে দেওয়ার পর আবার খালতলার ঝুপরি… বেড়াল কুকুরের জাত। একখানে খ্যাদালে আরখানে।
সাকিনগুঙা জোগাড়ে খাটত বাবুভাইয়ের কাছে। আলতাফও। বর্ডার ফাঁকি দিয়ে আসা লেবার ব’লে আলতাফের দু’শ টাকা দিন, বাকি জোগাড়ের চেয়ে একশ কম। পার্টির থেকে সাড়ে-তিনশ, আড়াইশ — পঞ্চাশ রাখত বাবুভাই। এটাই নিয়ম। পার্টিকে একটু গায়ে পড়েই বলত, “লেবারদের থেকে কমিশন খাব! ছি ছি… ও বান্দা আমি নই।”
প্রথম প্রথম আলতাফের কেমন যানি একা-বোকা লাগত এপারে। সবাই তফাত করে — তার কথা বলার ধরণ, কাজকম্ম সবই নাকি বেহুদা। আম্মা বলল,
— কয়টা দিন সবুর কর বাপ, তর হারু চাচা কাম দেখতাসে ঢাকায়।
— ওগো লগে থাকন যায় না। আমারে খ্যাপায়।
— তুই চুপ থাহিস, কিছু অইব না।
কিন্তু চুপ থাকার ফল হলো উলটো। কমার বদলে উৎপাত আরও জোর। আলতাফের নকল করাটা একরকম আমোদ হয়ে উঠল।
— ওই দ্যাখ, আলতাফ কাঁধে ক’রে বাস নিয়ে যাচ্ছে। ও আলতাফ বাসগুলারে নিজের পুঙার গ্যারেজে ঢুকা।
চুপ থাকতে থাকতে আলতাফের কেমন ভয় হত — নুরুদ্দিন বা সাকিনগুঙার মত তামাশার মশলা হতে সে চায় না। কিন্তু… কেমন যানি হয়ে যাচ্ছে। ফুঁসে ওঠার জন্য শরীর মনের যে তাকতটুকু দরকার সেটা কেমন পাচ্ছে না। যেন তার গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে সবটাই। একটা গোঁত্তা মারতে হবে…
তারপর এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একদিন এক ফন্দি আঁটল আলতাফ। তাকে নিয়ে মজা তামাশা বাড়লেই — কিচ্ছু না — সে হেসে ইশারা করত সাকিনগুঙার দিকে,
— সাকিনগুঙারে জিগাও, সে কী কয়…
ম্যাজিকের মতো কাজ করল এই ফিকির। মজাকি করতে আসা লোকজন ধীরে ধীরে আলতাফকে ছেড়ে দিল। তখন সে বিন্দাস ওদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি খেত। আর ওরা আলতাফকে দেখিয়ে সাকিনগুঙাকে বলত,
— এই মুল্লাটাই তর ঘর পুড়াইছে না? সাকিনগুঙা দ্যাখ ত এরে। এই না?
আলতাফ ফিক ফিক ক’রে হাসত। আর সাকিনগুঙা মাথা না তুলেই কোদালে সিমেন্ট বালি মেশাতে মেশাতে বলত — হ।
আলতাফ সাকিনগুঙার মুখ থেকে মাছিগুলো তাড়ায়। আঙুলের হাল্কা চাপ দিয়ে হাঁ হয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো বন্ধ করে। সাকিনগুঙার কী যানি একটা ভালো নাম আছিল… বাবলু ভাই না ডাকতো?…ভাবতে ভাবতেই খেয়াল হয়, এহন তো হেই নামই ডাকতাছে!
“সুবল মাহাতো… সুবল মাহাতোর লোক কে আছে? এই ডাক্তার সার্টিফিকেটের সাথে আই-কার্ড লাগবে। ভোটার বা আধার বা রেশন কার্ড কিছু আছে?” — অফিসঘর থেকে চিৎকার ক’রে হাঁকছে। সাটিন, কাত্তিক, বেনো ঢোকে অফিসের ভেতর।
দুই.
গঙ্গার ধারটায় আলো খুবই কম, যেক’টা ল্যাম্পপোস্ট বরাদ্দ তার বেশিটাই ঘাটের কাছে। এখানে দাঁড়িয়ে বাঁদিকে ঘাটটা দেখা যায়, এদিক-ওদিক ছড়ানো ছেটানো বসার বেঞ্চগুলো। ভজাকে লাশের কাছে রেখে আলতাফ মুততে উঠেছিল। মোতার পর একটা বিড়ি টানতে আসে। চাঁদের আলোয়, শ্মশান বিল্ডিং-এর ছাদে কতগুলো বাঁদর। তাদের সুখের জড়াজড়ি দেখতে দেখতে — আজব — হঠাত শাহিদুল আর মোকাররমের কথা মনে পড়ল আলতাফের। জিগরি দোস্ত আছিল। শেষ, বর্ডার পেরোন একসঙ্গে। তারপর ওরা দিল্লি, ইঁট ভাঁটার কাজে… আলতাফ এদিকে। দিল্লিতে থাকা নাকি আরও প্যাঁচাল… শাহিদুল বলছিল…
— আমাকেও ডাকতে পারতে… আমিও এট্টু মারতাম।
আওয়াজে আলতাফ দেখল কাছেই একটা বেঞ্চে রাজু শুয়ে, খানিক মদ টেনে মৌতাতে, আর তার পায়ের কাছে বসে ড্রাইভারটা ঘ্যাঙাচ্ছে,
— আমাকে জানালে না অব্দি। বলো এটা ঠিক করলে, বলো?
— তুমি বাঁ… গাড়ি চালাবে মদ খেয়ে? অ্যাঁ?
— আরে এট্টু খেলে কী হয়? তারপর আজ তো রাস্তায় লোকও নেই। এ দাও না মাইরি দাও না…
— আরে বাল ঘেনিও না তো… বলছি মদ নেই… ওই ওদিকে দ্যাখো হনুগুলো আছে, যাও গিয়ে ওদের মাই চোষো…
— ধ্যার… কী ভুলভাল বলো… এ দাও না…
— রামায়ণ পড়োনি বাঁ…? হনুর বুকে রাম থাকে জানো না? যাও… চোষো গিয়ে…
রাজু পাশ ফেরে। ড্রাইভার আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে উঠে যায়। রাতের গঙ্গার দিকে মুখ ফেরায় আলতাফ। বিড়ি খেতে খেতে ওপারের আলো আর ছায়া দ্যাখে, দূরে ফাঁকা বালি ব্রিজ দ্যাখে। শহরে মানুষ নেই, রাস্তায় রাস্তায় শুধু পুলিশের ভ্যান। আগুন জ্বলছে চারদিকে।
— আলতাফ নাকি রে? বিড়ি দে না একটা…
কাম সারছে! শান্তি মতন বিড়িও খাওয়া যায় না এদের জ্বালায়। — আলতাফ পকেট দেখল, মাত্র তিনটে।
বিড়ি ধরিয়ে থুতু ফেলে রাজু।
— বালটা আর মরার দিন পেল না বাঁ… — মোবাইল দ্যাখে — দেড়টা বাজতে চলল, ওদিকে কদ্দুর কিছু জানিস?
ঘাড় নাড়ায় আলতাফ — সাটিনরা কাগজপত্তর নিয়া ঢুকতাছে দেখলাম।
— কাল আর কাজে যাওয়া হবে না।
আলতাফ একবার তাকায় রাজুর দিকে — কোর্ট চত্বরে এক চায়ের গুমটি চালায়। শহরের এই হালতে কাজে যাওয়ার কথা কী কইরা ভাবে কেউ আল্লাই জানে!
সাকিনগুঙা মারা যায় বিকেল ছ’টার দিকে। হাসপাতালের তিনতলা থেকেই দূরের আগুনগুলো দেখা যাচ্ছিল, দোকান বাজার সমস্ত বন্ধ। তবু ওর মধ্যেই কী ক’রে কী সব ঠিকঠাক জোগাড় হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে কাগজপত্তর ক’রে, মরা সাজিয়ে, গাড়ি নিয়ে সাতটার মধ্যে সবাই তৈরিই ছিল — শোনা যায়, কার্ফু জারি হয়েছে… পরে কেউ বলে কার্ফু নয়, ১৪৪ ধারা। গত চারদিন ধ’রেই শহরের অবস্থা খারাপ। সরকারী কোন এক নীতির বিরুদ্ধে জনগণ পথে নেমেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ, টিভিতে দেখাচ্ছে গোটা দেশেই নাকি এক অবস্থা। বিক্ষোভে কোথাও লোকজন বাস জ্বালাচ্ছে, রেল লাইন ওপড়াচ্ছে, আবার কোথাও কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তায় — মিছিলে। সারাক্ষণ টিভিতে এই নিয়েই কথা। প্রথম কয়েকদিন এরকমই চলল। তারপর কাল রাত থেকে শোনা গেল সরকারের পার্টির লোকজনও পালটা আক্রমণে নেমেছে। দিকে দিকে আগুন, গুলি… দোকান পুড়ছে, বস্তি পুড়ছে, স্কুল কলেজ সিনেমাহল সব পুড়ছে… পুলিশ সরকারের পার্টির হয়ে লড়ছে। গুলি চালাচ্ছে ছাত্রদের ওপর, প্রতিবাদ করতে আসা সাধারণ মানুষের ওপর। গোটা দেশে যেন এক দাঙ্গা লেগেছে। সরকারের সাথে সাধারণ মানুষের দাঙ্গা, রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে দেশবাসীর দাঙ্গা।
এই সবের মধ্যে লাশ নিয়ে হাসপাতালেই কেটে গেল আরও প্রায় চার ঘণ্টা। অনেকেই বলছিল, ১৪৪ ধারায় নাকি লাশের গাড়ি ছেড়ে দেবে, তবু এসব কথাবার্তা, নানা ভয় আশঙ্কা জানা-অজানা প্রশ্নোত্তরে সময় গেল অনেক। রাস্তায় নেমে, যতটা ভাবা হচ্ছিল ততটা অসুবিধা কিন্তু কিছু হলো না — চার জায়গায় গাড়ি চেক করল, এটা সেটা জানতে চাইল। আধঘণ্টার রাস্তা লাগল প্রায় আড়াই ঘণ্টা। রাত একটার দিক ক’রে সাকিনগুঙার লাশ এসে পৌঁছল শ্মশানে।
— আক্রম আর সেলিমের কেস শুনেছিস?
আলতাফ ঘাড়া নাড়ে।
— পুলিশ গাঁড়ে বাম্বু দিয়ে দিয়েছে। দুপুরে নামাজের পর পুরো পল্টন নেমেছিল মিছিলে। অনেককটাকে তুলেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে এই দুই গান্ডু।
আলতাফ খুব আস্তে ধীরে শুধু জিজ্ঞেস করে — কী হইসিল?
— কী আবার হইবে? যা হওয়ার তাই হয়েছে। বাল… সরকারের খেলাফ নাড়া লাগাবে, অফিস দোকান ভাঙবে, পুলিশ ধরবে না?
আলতাফ চুপ ক’রে থাকে। তার দেখাটা ইঁদুরের মতন। গর্তের ভিতর থেকে দেখা বায়োস্কোপ লাগে। যে বায়োস্কোপের পর্দা তার জীবনের আকার আয়তনের চেয়ে অনেক বড়, বিশাল। যার আলোয় ধাঁধা লাগে আলতাফের, চরিত্রগুলোর কী, কেন, কীভাবে সব জট পাকানো ঘোর। তার জীবনের চেনা আরাম, চেনা উৎকণ্ঠা, চেনা বিপদ এর বাইরে সে যেন এক ভুলভুলাইয়া। কিছুই বোঝে না আলতাফ, শুধু চেয়ে থাকে — কথা বলা লোকটার দাঁত দ্যাখে ঠোঁট দ্যাখে নাক দ্যাখে… প্রথমবার এপারে আনার আগে নাইমুল দালাল কত নিয়ম বোঝাল, একটু ভুল হইলেই বিএসএফের গুলিতে ঢিচক্যাঁও… আলতাফ খুব যে সবকিছু বোঝে তা নয় তবে নিয়মগুলো বুঝে নিচ্ছিল, এটুকু বুঝছিল একদিকে নিয়ম মানা আরদিকে মইরা যাওয়া। এইটাই। মরলে কেমন খারাপ লাগে সেটা যদিও বোঝেনি। নাইমুল খবর-কাগজ কাটিং দেখিয়েছিল, দালালের টাকা ফাঁকি দিয়া সীমান্ত পারাইতে গেলে কী হয় — ছবিতে একটা মেয়ে-ঢিচক্যাঁও কাঁটাতারে ঝুলে আছে। আলতাফের গা শিরিশির করছিল, যদি একটাও ভুল হয় — সেও অমন এক ছেলে-ঢিচক্যাঁও আরও আরও ঢিচক্যাঁওয়ের সাথে কাঁটাতারে ঝুলে আছে… “হারু চাচা ঢাকায় কাম কবে দিবে আম্মা?”
— আল্লাহুরা বহুত বাড় বেড়েছিল… — রাজু ঢোঁক গেলে। খেয়াল পড়ে আলতাফও মুসলমান — কিছু মনে করিস না ভাই, তুইও মুসলমান, কিন্তু ভেবে বল এই যেখানে সেখানে নামাজ পড়া, কথায় কথায় ছোরা চাকু তলোয়ার নিয়ে নেমে পড়া এসব কী ভালো? বল… এই সরকার হেব্বি টাইট… একদম ডোজ দিয়ে দিয়েছে…
“কোরাপ্টেড গণতন্ত্র রাজতন্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বুঝলে?” — রাজু, আলতাফ দু’জনই লক্ষ্য করে একটু দূরে অন্ধকারে ঘাসের ওপর শঙ্করদা, বেঞ্চ ধ’রে মাতাল ব’সে আছে — ষাট পেরিয়েছে গেল বছর, অনেক আগে জীবনের গোড়ায় নাকি ইউনিয়ান টিউনিয়ান করত, পরে সব ছেড়ে শুধু সারাদিন দাবা খেলে আর রাতে চুল্লুর ঠেক… সাকিনগুঙার দোস্তো ছিল নাকি, চুল্লুদোস্ত।
— রাজতন্ত্রে… — শরীরটা ঘাস থেকে বেঞ্চে টেনে তুলতে তুলতে স্বরটাকেও টানে শঙ্করদা — তবু কোনোদিন ভালো রাজা পাওয়ার আশা থাকে… ম্যানিপুলেটেড, কোরাপ্টেড গণতন্ত্রে সেটুকুও থাকে না… এর শেষ একমাত্র সিভিল ওয়ারে… আই রিপিট…
— এই ভাঁট বকা শুরু হলো বাঁ… — রাজু আলতাফের দিকে মুখ ফেরায় — মাল খেয়ে খেয়ে কোনদিন মরবে বালটা। বাঁ… হজম হয় না তো খায় কেন?
পিছনে তখনও শঙ্কর বুড়ো “আই রিপিট… আই রিপিট”…
রাজু আলতাফকে বলে — তোকে একটা কথা বলি ভাই, কিছু মনে করিস না, তোর ভালোর জন্যই।
আলতাফ তাকিয়ে থাকে।
— তুই দেশে ফিরে যা। এখানে হেবি বাওয়াল চলছে। ঘুসপেটিয়াদের ধরছে সব জায়গায়। কোনদিন কোথায় ফেঁসে যাবি…
আলতাফ তাকিয়ে থাকে। তাকে চুপ থাকতে দেখে রাজু আবার বলে,
— বাঁ… একটা দেশ চেয়েছিলি… দেওয়া হয়েছে তোদের। আর কী চাস? নিজেদের দেশে নিজেরা থাক। এখানে আসিস কেন বাঁ…?
আলতাফ তাকিয়েই থাকে। রাজু একটা দেশ দিয়েছে, অথচ সেটা পাওয়ার আনন্দ তার হয় না। সে ব্যাপারটাই ঠিকঠাক বোঝে না। সে বোঝে, খিদে পায় — তাই খেতে হয়, টাকা লাগে, কাজ লাগে — ওদিকে কাজ পায়নি, এখানে এসে করছে। সারাক্ষণ এটা-সেটা লোকানোর মধ্যে দিয়ে আলতাফ টের পায় যে সে খুব খারাপ করছে বাকি মানুষের… কিন্তু অনেক ভেবেও সেই খারাপ কাজটাকে সে চিনতে পারে না। তবে আলতাফ এখন আগের চেয়ে খানিক সেয়ানা, তার এই বুঝতে না পারাগুলো সে ঢাকতে শিখেছে। কথা ঘুরিয়ে বলে,
— গুমটিগুলায় সব আগুন দিতাছে, তোমার গুমটিডার খবর কিছু পাইলা?
— আমারটায় আগুন কেন? আমি মুসলমান? — গলা ভারী হয় রাজুর।
— তোমার তিন না চার গুমটি পরেই তো জনাব আলির গুমটি। হোইডাই যদি দেয়?
— দিলে দেবে বাঁ… আমার কী?
আলতাফ হাসে, — কী যে কও তুমি! আগুন তো ছড়ায়…
রাজু কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাধা পড়ে। বেনোকে হঠাতই হন্তদন্ত এগিয়ে আসতে দেখা যায় তাদের দিকে। সে বাবুভাইকে খুঁজছিল।
— এদিকটায় তো আসেনি। কী হয়েছে গো বেনোদা?
বেনো ইলেকট্রিক অফিসে পোল পোঁতার কাজ করে, পাড়ার বাকি লেবারদের মধ্যে তার একটা সম্মান আছে। বাবুভাইয়ের সাথে খাতিরও।
— আরে বাজে বাওয়াল দিচ্ছে অফিসের লোকগুলো। বলছে, মরা পোড়াতে দেবো না নিয়ে যাও এখান থেকে।
— বাপ-কা-রাজ নাকি?
— কাগজপত্র চাইছে। ডাক্তারের কাগজ দিলাম। নাহ… তার আধার, ভোটার-কার্ড দাও।
— নেই?
— বাল নাকি তুই? কয়েকটা কাপড়, একটা বিছানা, একটা চটের ব্যাগ… এই সম্পত্তি ছেড়ে গেছে। তার নাকি পরিচয়পত্র! গাল ভরা নাম/ ঝাঁটে ঘোরে চাম…
তিন.
অফিসে ঢুকে ওরা দেখল বাবুভাই ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁচেছে। ছোট্ট অফিসটায় তাদেরই লোকজনের ভিড়। বেনো আর রাজু এগিয়ে বাবুভাইয়ের পাশে দাঁড়ায়। দরজার কাছে আলতাফ, দ্যাখে, তাদের পিছন পিছন শঙ্কর বুড়োও এসেছে।
— আপনারা সবাই মিলে এমন ভিড় করছেন কেন? — টেবিলে কাগজ ওলটানো লোকটা বিরক্ত — বললাম তো, আই কার্ড ছাড়া পুড়তে দেওয়া যাবে না।
বাবুভাই — একটু কনসিডার করুন দাদা। বুঝতেই তো পারছেন গরীব লেখাপড়া-না-জানা মানুষ। কার্ড-টার্ড কি এদের থাকে? বলুন… এসব তো আপনি-আমি বুঝি, এরা বোঝে?
— মরা নিয়ে যান।
— ডাক্তার সার্টিফিকেট তো রয়েছে।
পাশ থেকে কাত্তিক ফুট কাটে — আমাদের গ্রামে তো শুধু ডাক্তারের কাগজ দেখালেই পোড়ানো যায়।
— তবে আর কী? ওই তো… ওনার গ্রামে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিন।
বাবুভাই হাত দেখায় কাত্তিককে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করে,
— ডাক্তার সার্টিফিকেটে কাজ চলবে না?
— আরে কতবার বলব একই কথা? চলবে না।
টেবিলে তার পাশে বসা লোকটা এবার বুঝিয়ে বলে — ডাক্তার সার্টিফিকেট থেকে বোঝা যাচ্ছে কোনো এক সুবল মাহাতো মারা গেছে আজ সন্ধেবেলা। কিন্তু এই লাশই যে সেই সুবল মাহাতো তা ফটো আইডি ছাড়া কী ক’রে প্রমাণ হয়? এমনও তো হতে পারে আপনারা কাউকে মেরে সুবল মাহাতোর নামে চালাচ্ছেন।
— ছি ছি কী বলছেন! এদের দেখে আপনাদের খুনি মার্ডারার মনে হচ্ছে, অ্যাঁ? আমি নিজে এলাকায় একজন রেপুটেড মানুষ। যেকোন কাউকে জিজ্ঞেস করবেন।
— আরে আজব মুশকিল! রুল… এটা রুল… মনে হওয়াহওয়ির কোনো জায়গাই নেই।
বেনো একটু হিসাব কষে বলে — এ যদি খুন করা লাশ হয়, তবে ডাক্তার যে লাশের কাগজ দিয়েছে সেই লাশটা কোথায়?
— এটা কি ডিটেকটিভ সিনেমা হচ্ছে? — টেবিলের রাগী লোকটা হ্যা হ্যা ক’রে হেসে ফ্যালে — বেশ যদি তাই হয়, এই তো মরেছে পাঁচটা তিপান্ন, ধরুন নটার মধ্যে বডি জ্বালিয়ে দিয়েছেন, তারপর খুন ক’রে আরেকজনকে এনেছেন ওই একই কাগজে। এই দাঙ্গার বাজারে কে কী করছে তার কি ঠিকাছে?
— একটা যা-হোক ব্যবস্থা তো করুন। এত রাতে আমরা এই লাশ নিয়ে ব’সে থাকব? — বাবুভাই বলে।
— দেখুন ভিড় সরান। তখন থেকে একটাই কথা বারবার কেন বলতে হচ্ছে আপনাদের? আইডেন্টিটি কার্ড ছাড়া লাশকে পুড়তে দেওয়া যাবে না।
“এটা কী হচ্ছে, হ্যাঁ, কী হচ্ছে?” — মাতাল শঙ্করের চিৎকারে সবাই চমকে তাকায় — “সুবল কি ভোট দিতে চাইছে, বাড়ি বানাতে চাইছে, চাকরি?” বাবুভাই তাকে থামানোর চেষ্টা করে, কাত্তিককে বলে সরিয়ে নিয়ে যেতে। অফিসের দালান দিয়ে শঙ্করকে তার চিৎকার সমেত টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই — “লোকটা মরে গেছে… পোড়াবি… আই-কার্ড… জল খাব ছাড়… হিপোক্রিট… হাত ছাড়… দাঙ্গায় দাউ দাউ ক’রে… পুড়ছে… রেপ ক’রে… পোড়াচ্ছে… ছাড়… হাত ছাড়… সৎকারের জন্য আই-কার্ড? ওকে তো… তোরা তোদের সিস্টেমেরই অংশ হতে দিসনি… এখন ওর সৎকারটাও… আইকার্ড… তোদের করা জনগণনাতেই নেই রে… অন্তত বিড়ি সিগারেট মনে ক’রে জ্বালা… জ্বালিয়ে দে। হিপোক্রিট… মুতি… তোদের চিতার সিস্টেমে আমি মুতি… আই রিপিট…”
বাবুভাই এর মধ্যেই বলতে থাকে — উনি একটু মেন্টাল আছেন। কিছু… খারাপ ভাবে নেবেন না।
— এবার আপনারা ভিড় সরান। প্লিজ।
— আরেকবার একটু ভেবে দেখুন। রাস্তাঘাটেও তো মানুষ মরে, তাদের কি আই-কার্ড থাকে সবার? বলুন…
— আপনিও তো ওই ওনার মতোই বলছেন, ওই যে বলল, দাঙ্গায় রেপে… আরে দাদা ওগুলো পুলিশ কেস। ওভাবে রাস্তায় বডি পড়ে থাকলে পুলিশ তুলে নিয়ে মর্গে দেয়, দেখা হয় খুন না নেচারাল ডেথ, পুলিশ রেকর্ড হয়। আপনারাও যদি তেমন কিছু চান তো থানায় রিপোর্ট করুন।
— কোনো উপায়ই কি তবে নেই? — পকেট থেকে মোবাইল বার করে বাবুভাই।
— আছে — একটু আগের সেই বুঝিয়ে বলা লোকটি তার কলিগকে থামিয়ে বলে — একটা উপায় আছে। উনি যেখানে থাকতেন সেখানকার কাউন্সিলার বা মিউনিসিপালিটির ভাইস-চেয়ারপারসন / চেয়ারপারসন কাউকে ধরুন। ধ’রে একটা সার্টিফিকেট বার করিয়ে নিন। তাতে ওনার যেন ছবিও থাকে। আগের ছবি না থাকলে এই অবস্থাতেই একটা ছবি তুলে মেরে দিন।
— বাড়িঘর তো সেরকম কিছু ওর ছিল না। ঝুপড়িতে বেআইনিভাবে থাকত। ভোটার কার্ডের লিস্টেও কখনো নাম ছিল না। অসুবিধা হবে না?
— কথা বলে দেখুন। কিছু যদি করা যায়। আমাদের খালি কোনো হায়ার অথরিটি ওনাকে সুবল মাহাতো ব’লে লিখে দিলেই হলো।
এরপর ভিড়টা নানা ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কেউ কেউ রইল লাশের কাছে, কেউ গঙ্গার দিকটায় গেল, আর এক দল বাবুভাইয়ের সাথে চাতালের এদিক-ওদিক করতে থাকল। বাবুভাই মোবাইলে তখন কানেক্সন করছে — না, পোড়াতে দিচ্ছে না তো। বলছে, লাশের নাকি আই-কার্ড লাগবে। আমার আন্ডারে কাজ করত। না-না বাড়িঘর কিছু ছিল না। না ভোটার আইডিও না। তুমি লাশটাকে একটা ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দিয়ে দাও না, ঝামেলা চোকে।
লাশের কাছে বাবলু ব’সে ঝিমোচ্ছে দেখে আলতাফ তার পাশে গিয়ে বসল। বাবলু তারই সাথে জোগাড়ে খাটে। এখানে আসার পর থেকে ওকে খুঁজে পায়নি। কোথায় নেশা করছিল কে জানে। বাবলুকে ঠেলে আলাপ করার চেষ্টা করে আলতাফ, “কী হইসে শুনছস?” কিছুই হয় না, বাবলু “হুঁ” ব’লে যেমন ঝিমোচ্ছিল তেমনই ঝিমোতে থাকে। আলতাফ দেখে বাবুভাইদের। বাবুভাই তখন মোবাইল নামিয়ে পরামর্শ করছে বেনোর সাথে, বাকিরাও রয়েছে।
— কী করা যায় বলত? কাউন্সিলার বিনোদ ঝাকে ফোন করলাম, ও যেখানে থাকত… ওই খালতলা… ওটা তো বিনোদদারই ব্লকে পড়ে। কিন্তু বে-আইনি জমি, বাড়ির ঠিকানা-পত্তর কিচ্ছু ছিল না ফলে কাউন্সেলার সোজা বলল করবে না। ভাইস-চেয়ারম্যান রীনাদি ফোনই তুলল না এত রাতে। চেয়ারম্যান সতীনাথদা গেছে শ্বশুরবাড়ি, কাল বিকেলে ফিরবে। কী করি এবার?
— কাল সকালে রীনাদি উঠলে ক’রে দেবে না?
— করতে পারে, কিন্তু সেও তো আরও পাঁচ ঘণ্টা… আর যদি ইন কেস না করে তবে তো কাল রাত অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বডি এভাবে এখানে রাখতে দেবে অতক্ষণ?
চার.
না। রাখতে দেবে না। শ্মশান কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল, অতক্ষণ এখানে এভাবে লাশ ফেলে রাখতে দিতে তারা পারবে না।
ড্রাইভার বলল — এই চলে মাইরি? এর’ম চলে মাইরি… বলো? যে লাশ নিয়ে এলাম সে লাশ নিয়েই আবার ফিরতে হবে!
রাজু বলল — দেখলে তো বাঁ… মদ না খেতে দিয়ে ভালই করেছি।
আর শ্মশান থেকে লাশ গাড়ি চেপে চলল তার মিউনিসিপালিটি — তার পরিচয়পত্র আনতে।
শঙ্কর বলল — আই রিপিট…
ছোটাহাতির কেবিনে ড্রাইভারের পাশে বসল বাবুভাই আর বেনো, বাকিরা পিছনে লাশের সাথে। গভীর রাত আর ১৪৪ ধারা মিলিয়ে রাস্তা পুরো নিস্তব্ধ, জনমানুষহীন। শুধু আগুন জ্বলছে একা-একা, দূরে কাছে বিভিন্ন জায়গায়। আসার সময়ও বোধহয় এতটা ছিল না। বাড়ল কীভাবে!
“কেউ নিভায় না এগুলারে?” আলতাফ জিজ্ঞেস করে বাবলুকে।
গাড়ি চালু হওয়ার পর ঝাঁকুনিতে বাবলুর ঝিম কেটেছে। সে এখন শহরের উঁচু উঁচু হোর্ডিং দেখছে বিস্ময়ে। আলতাফের কথার উত্তরে অমনই এক হোর্ডিং-এর দিকে আঙুল দেখায়,
— হে হে… জাঙ্গুটা ফুটো।
আলতাফ তাকায়। বিশাল এক হোর্ডিং-এর বিশাল এক মাচো। জাঙিয়া প’রে, ভি দেখিয়ে। বেচারা মাচো জানে না, তার হোর্ডিঙেই ফুটো।
— লাশ তুমি কার?
সবাই একটু চমকে তাকায়। লাশের কপালে একটা হাত রেখে শঙ্কর আপনমনে খুব আস্তে বলে চলেছে। একবার, দু’বার… “লাশ তুমি কার?”
এবার কে যেন পাশ থেকে বলে উঠল — সাকিনগুঙার।
লাশ তুমি কার
সাকিনগুঙার
লাশ তুমি কার
সাকিনগুঙার
দেশ তুমি কার
সাকিনগুঙার
গোটা গাড়ির মধ্যে চাপা গলায় গুনগুন করতে থাকে এই ধ্বনি। ঠিক হয়ত স্লোগান নয়, কাউকে জাগানোর জন্য নয়… বরং স্বগতোক্তির মতো, নিজেরা জেগে থাকার মতো এই ধ্বনি দিতে থাকে ওরা। আসার সময়ও ১৪৪-এর কারণে হরিবোল দেওয়া হয়নি, একেবারে বারণ করে দিয়েছিল বাবুভাই। এখন এই নতুন হরিবোল তাদের দিব্য লাগছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা গাড়ি চাপা আওয়াজের চিড়িয়াখানা হয়ে ওঠে।
রাজু বলছে, “কুত্তাও নিজের পাড়া নিজে বোঝে বাঁ… মানুষ বুঝবে না? মানুষ তো আরও সব্য”
বাকিরা বোল দিচ্ছে, “লাশ তুমি কার?”
বাবলু দ্যাখাচ্ছে, “কাটা গলায় গয়না পরেছে… কাটা গলায় গয়না পরেছে” দেখা যাচ্ছে সোনার বিজ্ঞাপনে গয়না ভর্তি মহিলার মাথা সমেত ভেঙে গেছে হোর্ডিং।
বেনো কেবিনের জানলা থেকে মাথা বার ক’রে বলল — আরে থাম তোরা। পুলিশ আসছে। একদম চুপ।
আর সাথে সাথেই যেন কোনো ষড়যন্ত্রকারী দল… অস্ত্র সাজাচ্ছিল… চুপ ক’রে গেল, সমস্ত সরঞ্জাম লুকিয়ে।
দ্যাখা গেল পুলিশের ভ্যান থামল একটা। কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর, গাড়ির পিছনে এসে লাশ চেক করে তারা চ’লে গেল। একটু এগোতেই আবার একটা ভ্যান। আবার একই রকম ঘটনা। কিন্তু তারপর অনেকক্ষণ কেটে গেল আর কোনো পুলিশ ভ্যান দেখা গেল না। গাড়ির ভিতরের চাপা আওয়াজগুলো ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। একটা বড়সড় পোড়া জায়গার পাশ দিয়ে যেতে যেতে গাড়িটা হঠাতই থামে।
বাজে গন্ধ জায়গাটায়। পাশেই প্রায় পাঁচ ছ’টা ঝুপড়ি জ্বালানো হয়েছিল, এখনও কিছুটা আগুন জ্বলছে। কেবিন থেকে বাবুভাই আর বেনো নেমে আসে। গাড়ির পিছনে এসে চাপা গলায় বাবুভাই বলে,
— শোনো, সন্ধে থেকে যথেষ্ট হয়রানি হয়েছে সবার। এ’ লাশ নিয়ে আর হিল্লি-দিল্লি করে কোনো লাভ নেই। দাঙ্গার বাজার। এখানটায় ফেলে দিই। কিছুটা হলেও আগুন পাবে। সকালে পুলিশ এসে বাকি যেটুকু প’ড়ে থাকবে তুলে নিয়ে যাবে নাহয়।
বেনো বলে — হিন্দুর লাশ, একটা হিল্লে তো করতে হবে। নাকি? একদমই আগুন পাচ্ছিল না সে জা’গায় একটু হলেও তো পাচ্ছে। কী বলো?
কেউ কিছু বলল না। এমনকি শঙ্করও আপনমনে কোন এক নিঃশব্দ ভয়েস ওভারে লিপ দিয়ে চলেছিল — লাশ তুমি কার… লাশ তুমি কার… তার ঠোঁটে কাঁপতে থাকা সেই আওয়াজহীন গানের দিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই কেউ তাকাল না।
সাবধানে সাকিনগুঙার লাশ নামানো হচ্ছিল। বাবুভাই আস্তে, ধীরে, কুইক এইসব ব’লে তদবির করতে থাকে। সবাইকে নামতে হবে না। কেবল কাত্তিক আর বেনো মিলে ধরাধরি ক’রে বডিটা ঝুপড়িগুলোর পাশে নিয়ে গিয়ে রাখল। এদিক ওদিক তাকায় বাবুভাই। চাপা গলায় বলে, “তাড়াতাড়ি কর বেনো। এই বাজারে পুলিশ কখন যে চ’লে আসে! কুইক কুইক…”
কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো না। লাশটা আগুনে ছোঁড়ার জন্য তুলতে যাবে ঠিক সে মুহূর্তেই পাশের গলি থেকে বেরোনো এক পুলিশ ভ্যান ঘুরে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। ব্যাপারটা এতই অকষ্মাৎ, কেউ কিছু বোঝার, সামলানোর আগেই ঘটে গেল সব। “ভিড় কেন?”, “কীসের গাড়ি”, “কী হচ্ছে এত রাতে?” এই সব নিরীহ প্রশ্ন’র থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুলিশের নজর পড়ল মূল কাহিনিতে,
— কার লাশ এটা? খুন করেছিস নাকি?
বাবুভাই কিছু বলতে যায় কিন্তু সেসব শোনার আগেই অফিসার এগিয়ে যায় গাড়ির পিছনদিকে।
— এই নেমে আয় নেমে আয় সবাই নেমে আয়। সব ক’টাকে সার্চ করো, গাড়িটাও সার্চ করো।
কিন্তু সার্চে যখন কিছুই পাওয়া গেল না — বাবুভাইও ততক্ষণে নানা অনুনয় বিনয় মাখিয়ে গোটা ঘটনাটাই মোটামুটি সংক্ষেপে বলে দিয়েছে — অফিসারের ব্যবহার একটু নরম হলো। সে বাকিদের গাড়িতে উঠতে ব’লে বাবুভাইকে বলল,
— কিন্তু যা করছিলেন, সেটাও তো বে-আইনি। চার্জ দেওয়া যায় জানেন?
— স্যার ভুল হয়ে গেছে স্যার।
— কোনো আই-কার্ড নেই?
— না স্যার কিছুই নেই। একা একটা ঝুপড়িতে থাকত স্যার।
— ভারতীয় নাগরিক তো?
— হ্যাঁ স্যার। ১৯৭১-এ ওইপার থেকে এসেছিল।
— কী বলছেন? এতদিনে একটাও কাগজ বানাতে পারেনি? ল্যালাক্ষ্যাপা ছিল নাকি?
পুলিশ দেখলেই আলতাফের কেমন বুক ধড়ফড় করে। সার্চের সময় সে কোনোরকমে নিজেকে সামলে রেখেছিল, খালি মনে হয় এই বুঝি ধইরা ফেলে! এখন গাড়ির মধ্যে গুটিয়ে ব’সে চোখটা একটু বার ক’রে সে দেখছিল সবটা। বাবলু গুঁতো মারে বিড়ির জন্য। পকেটের শেষ দুটো বিড়ির একটা বার ক’রে বাবলুকে দেয় আলতাফ।
— আপনারা এমন সব বিষয়ে ফাঁসান না… — অফিসারের স্বরে বন্ধুত্বের ছোঁয়া — কী আর করা যাবে, আপনারাও তো বিপদেই পড়েছেন। পুলিশের চাকরি করলেও মনুষ্যত্ব তো আর যায়নি। মানুষের বিপদে মানুষই তো পাশে দাঁড়ায়। তাই না?
নাকে বিড়ির ধোঁয়া লাগতে থাকায় আলতাফের নিজেরও একটা বিড়ি ধরাতে ইচ্ছা হয়। এর আগে সে কোনোদিনও পুলিশের এত কাছে ব’সে বিড়ি খাওয়ার কথা ভাবতে পারনি। কিন্তু এখন বাবলুকে দেখে একটু সাহস পায় — কেউ তো কিছু বলছে না ওকে, ঘুরেও তাকাচ্ছে না — আলতাফ পকেটের শেষ বিড়িটা ধরায়।
— ঠিক আছে, এত রাতে লাশ নিয়ে আর কোথায় ফিরবেন? জালিয়ে দিন এখানেই।
অফিসারের অভয়ে বাবুভাই কৃতজ্ঞতায় হাত জোড় করে, একগাল নিশ্চিন্তির হাসি নিয়ে — স্যার!
— তবে আমাদের কথাটাও একটু ভাববেন। বেশি না আট দিলেই হবে।
— স্যার… অত…
— এর আগে আরেকটা বড় আগুন আছে। দশ বারোখানা দোকান জ্বলছে একসাথে। যদি ভালো করে দাহ করতে চান তো ওখানেও বন্দোবস্ত করতে পারি। এই একটু আগেই। দেখিয়ে দিচ্ছি। তবে ওটার কিন্তু বারো নেব। দরকার পড়লে নিজেরাও খানিকটা আগুন লাগিয়ে নিতে পারেন। আমাদের ফুল কোয়াপরেশান পাবেন।
ছোটাহাতির মধ্যে ব’সে বিড়বিড় করছিল শঙ্কর, “মানুষের প্রথম আবিষ্কার… আগুন… পাথরে পাথরে ঠক… ভুস… ঠক-ভুস… সভ্যতার শুরুয়াত… হাঃ…”। আলতাফ বিড়ি খেতে খেতে দেখে, বাবুভাইকে থামিয়ে অফিসার একাই ব’লে চলেছে।
— আর যদি আরও ভালোভাবে, পুলিশ প্রোটেকশনে পোড়াতে চান তবে সামনে একটা স্কুল বাড়িতে আগুন জ্বলছে… ওখানে নিয়ে যেতে পারি, দু’জন কনস্টেবলও দিয়ে দেবো। ঘি-টি যদি থেকে থাকে লাগিয়ে টাগিয়ে পুরুত থাকলে পুরুত বসিয়ে প্রপার সৎকার করতে পারবেন। ওটার কিন্তু একটু বেশিই চার্জ। কুড়ি পড়বে।
— মানে স্যার… বুঝতেই তো পারছেন…
শঙ্কর খেয়ালই করেনি কখন তার নিঃশব্দ ভয়েস ওভারের শব্দগুলো আওয়াজ করতে শুরু করেছে। সে দাঁড়িয়ে উঠতেই আচমকা তার গলা দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসে — লাশ তুমি কার/ সাকিনগুঙার/ দেশ তুমি কার/ সাকিনগুঙার… সে নিজেও টের পায় একটু পরে, আর কেউ তো গানটা গাইছে না… চুপ থাকতে থাকতে চুপ থাকার যে জাড্য তৈরি হয় তার মাঝে কেমন এক অদ্ভুত খ্যানখ্যানে আওয়াজ বেরোল তার গলা দিয়ে। সে ব’সে পড়ে। সবাই অবাক তাকিয়ে ছিল। ঘোর কাটতে অফিসার কিছু বলার আগে বাবুভাই চেঁচিয়ে ওঠে, “অনেক ল্যাওড়ামি দেখছি তোমার সন্ধে থেকে… এখানে সবাই টেনশনে ফেঁসে আর তুমি মাতলামি মারাচ্ছ?” তারপর অফিসারের দিকে ফিরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে, “সরি স্যার। এদের নিয়ে না, কালঘাম ছুটে যায়!”
— রিল্যাক্স রিল্যাক্স… কে মালটা? কী রে কই? ওঠাব নাকি ভ্যানে? যাবি লক-আপে?
শঙ্কর চুপ ক’রে মিশে থাকে নিস্তব্ধতায়। অফিসার বাবুভাইকে বলে,
— ছাড়ুন। এবার কোনটায় পোড়াবেন সেটা বলুন। রেট যা ছিল সবই তো বললাম।
— যদি একটু কনসিডার করেন ভালো হয়। মানে এটা তো মানবিকতা করছি স্যার, বুঝতেই তো পারছেন ফ্রি সার্ভিস।
বিড়িটা শেষ হয়ে এসেছিল। আলতাফ সেই প্রায় নিভে আসা বিড়ির মুখে আগুনটাকে দ্যাখে। সে জানে, এই মুহূর্তে তার দিকে কারও নজর নেই। সে এও জানে এই নিভু-নিভু আগুনটা কোনোকিছুকেই জ্বালাতে বা পোড়াতে পারবে না। তাই খুব সাবধানে সে বিড়ির ওই শেষ অংশটুকু, ছুঁড়ে মারল, পুলিশ ভ্যানের মাথায়।