লেখকের সূচনাকথাঃ শোনা যায় পীর মৈমনশাহর নামেই মৈমনসিংহ। অবিভক্ত বাংলার সব চেয়ে বড় জেলা ছিল মৈমনসিংহ। পূর্ববঙ্গ গীতিকার সিংহভাগ রচিত হয়েছিল এই জেলায়। গীতিকার কাহিনি আমাকে মুগ্ধ করেছিল বহুদিন। প্রেম আর বিরহই কাহিনিগুলির মূল সুর। ্তার ভিতরে লুকিয়ে আছে চলমান জীবন এবং সামাজিক চিত্র। মহুয়া, মলুয়া, কমলা, কাজলরেখা, কঙ্ক ও লীলা, আয়না বিবি……কত যে অপরূপ কাহিনিমালা। ময়মনসিংহ বা মৈমনসিংহ গীতিকা এপারের রঙ্গমঞ্চে এসেছে কয়েকটি। সেই সব নাটক গীতিকার অংশ বিশেষ। কিন্তু গীতিকার বাইরে যায়নি। সুরটি ধরেছে। গীতিকার ভিতরে চলিষ্ণু বঙ্গ দেশের রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম সেই গীতিকার কোনো কাহিনি পুনর্নির্মাণ করব। এই কারণেই মৈমনসিংহ জেলার কথা খুঁজতে খুঁজতে যা পেয়েছি, তা অমূল্য সম্পদ। মৈমনসিংহ বা ময়মনসিংহ জেলার সাবেক নেত্রকোনা মহকুমা,হাল নেত্রকোনা জেলার সুসঙ্গ দুর্গাপুরের কমলা সায়র খনন নিয়ে এক কাহিনি পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে আমি পেয়ে যাই নেত্রকোনার অন্য ইতিহাস যা নেই গীতিকায়।
গারো পাহাড়, পূর্ব ধলার কথা আমি মায়ের কাছে শুনেছি শৈশবে। বাবা অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক সায়েবের ঋণ সালিশী বোর্ডের সার্কেল অফিসার ছিলেন। হ্যাঁ, মৈমনসিংহ ছিল তাঁর কর্মস্থল। আমার জন্মের অনেক আগের কথা। বাবা চাষীদের ঋণ মকুবের শুনানি করতে যেতেন নেত্রকোনা, পূর্বধলা, সুসঙ্গ দুর্গাপুর। কী জানি, মা-ই কি আমার ভিতরে মৈমনসিংহ জেলার ইতিহাস অনুসন্ধানের আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন? আমি মায়ের বলা, গারো পাহাড়ের কোলে সুসঙ্গ দুর্গাপুর গিয়েছিলাম প্রবল শীতের সময়। মেঘলা, কুয়াশা। কুয়াশার ভিতর থেকে মুখ বাড়াচ্ছে জনপদ, মানুষজন, চাঁদ বিনোদ ( মলুয়া পালা ) , আয়না বিবি। যাওয়ার আগে নেত্রকোনা শহরের বাসিন্দা পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ ৮৪ বছরে অতি তরুণ যতীন সরকার এবং তাঁর ভাই অধ্যাপক মতীন সরকারের সঙ্গে গল্প করতে করতে পেয়েছি কিছু সূত্র। অবশ্য সেই সব সূত্র সংগ্রহের জন্য আমি যাইনি। গিয়েছিলাম সুসঙ্গ দুর্গাপুর দেখতে। কমলা সায়র দেখতে। ভেবেছিলাম মজে যাওয়া কমলা সায়রে জল আনব, হয়ে গেল অন্য কিছু। ফিরে এসে হলো। কুয়াশার ভিতর থেকে এল তা। এই উপাখ্যান যা আমি লিখছি তা মৈমনসিংহ গীতিকার বাইরে যা আছে, সেই কাহিনি। ইতিহাস, কল্পনা, বোধ, দর্শন সব মিলিয়ে এই কাহিনি। নেত্রকোনা যেতে বাংলাদেশের লেখক রুমা মোদক ও অঞ্জন আচার্য সাহায্য করেছিলেন। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা তাঁদের।
বিপুল সোমের হাতে যে পান্ডুলিপি তা নিয়ে সে করবে কী ? সমস্ত রাত, সমস্ত দিন পড়তে পড়তে মনে হয়েছে অসম্পূর্ণ। কুমুদিনীর মৃত্যু সুধীন্দ্র সোমকে টলিয়ে দিয়েছিল। সুধীন্দ্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন একা একা। তখন তাঁর ছেলে বিদেশে। তিনি থাকতে ফেরেনি। সুধীন্দ্র গেলেন কোথায় ? বিপুল তার স্ত্রী অজন্তাকে জিজ্ঞেস করে, তার কী করা উচিত ?
সুধীন্দ্র নিরুদ্দেশ হয়েছেন ছমাসের উপর। তার ছেলে প্লাবন এসে খোঁজ করে শেষ অবধি না পেয়ে ফিরে গেছে। সে বিদেশী নাগরিক। ইউ এস এ-র সবুজ কার্ড ধারী। বাবা তার কাছে কিছুতেই যেতে চায়নি। সে ঐ কথাই বলেছিল এসে। বিপুলের কাছেও এসেছিল সে। ক্ষোভ জানিয়েছিল, বাবা তার জন্য কিছুই করেনি। যা করেছে তা সে নিজে। বাবা শুধু বদলি হয়েছে চাকরিতে। সে কোনো ভালো ইস্কুলেও পড়েনি পর্যন্ত। বারবার ইস্কুল বদল করতে হয়েছে বাবার বদলির কারণে। সে যে আজ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেনশিপ পেতে যাচ্ছে, সবই তার কৃতিত্বে। তার বউ লিলিয়ান সাহায্য করেছে তা সত্য। সে কোথায় থাকে, না সান দিয়েগো। বিপুল বিস্মিত হয়নি। মনে হয়েছিল সুধীন্দ্র খুব কষ্টে গেছেন। মনে হয়েছিল ছেলে এবং তার বউ বেঁচেছে। নিয়েই যায়নি তারা। এই বিষয়ে একটি ঘটনা বিপুল জানে। খুব ভাল জানে। সুধীন্দ্র বলেছিলেন বিপুলকে। হাতে বিদেশ ভ্রমণের রেখা না থাকলে কি বিদেশযাত্রা হয় ? সুধীন্দ্র বলেছিলেন, তাঁদের দুজনের কারোর হাতেই বিদেশ ভ্রমণের চিহ্ন নেই। তাই ইউ, এস, এ যাওয়া হয়নি। তবে নেত্রকোনা যাবেন তাঁরা। নেত্রকোনা বিদেশ নয়। তাঁরা বিশ্বাস করেন না তাঁদের বিরিশিরি, সোমেশ্বরী নদী, বহেরাতলী, গারো পাহাড় বিদেশ হতে পারে ?
আচ্ছা, সুধীন্দ্রের পক্ষে সম্ভব কি নেত্রকোনা হয়ে সুসঙ্গ দুর্গাপুর যাওয়া ? সে বহুদূর। উত্তর-পুবে। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা জেলার গায়ে। গারো পাহাড়ের নিচে। কিন্তু সুধীন্দ্রর একটি নোট আছে এই আখ্যানের নিচে। সেই নোট বিপুলকে ভাবিয়েছে।
“ এই আখ্যান আমি ও আমার সহধর্মিণী প্রয়াতা কুমুদিনী সোম কল্পিত। ইহার ভিতরে যা কিছু সৌন্দর্য এবং অপরূপকথা রচনা করা গেছে, তা কুমুদিনীর জন্যই সম্ভব হয়েছে। কুমুদিনী বলত তার ভিতরে হাজং উপজাতির রক্ত প্রবাহিত। হাজং নেত্রী কুমুদিনী হাজঙের নামে তার নাম। আমার স্ত্রী কুমুদিনীর পিতার নাম সুস্থিরচন্দ্র সরকার। গ্রামটি সুসঙ্গ দুর্গাপুর সংলগ্ন বিরিশিরি গ্রামের উত্তর পশ্চিমে মুরারিগঞ্জ। তারই পার্শ্ববর্তী গ্রাম বহেরাতলী। বহেরাতলীতেই এক হাজং পরিবারে বীরাঙ্গনা কুমুদিনীর জন্ম। বহেরাতলী সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিমে। আমার স্ত্রী কুমুদিনী বলত, সে আবার ফিরে যেতে চায়, বিরিশিরি, কমলা সায়রের নিকটে। হয়তো সে গিয়েছে সেখানেই। মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনি সেই স্থলে না গিয়ে সম্পূর্ণ করা যায় না। কিন্তু তা অসম্পূর্ণ রয়েই গেল কুমুদিনীর অকাল প্রয়াণে। আমি এখন কী করব জানি না। মনে হয় একবার গিয়ে কমলাসায়রের পাড়ে গিয়ে বসি। একবার গিয়ে সোমেশ্বরী নদীর পারে বসি। যাই যাই করছে মন। আমার মন বলছে যাই বহেরাতলীতে কুমুদিনী হাজঙের বাড়ি। মনে হয় টংকো আন্দোলনের কথা শুনে আসি মণি সিং-এর কাছে গিয়ে। মণি সিং বেঁচে আছেন কি না জানি না। সে আমলের কেউই তো আর বেঁচে নেই। যে মানুষ কিছু করতে চায় দেশ ও দশের জন্য, তার জন্য একটি জীবন বড় সংক্ষিপ্ত সময়। আমার স্ত্রী কুমুদিনী নিশ্চয় তার পিতৃকুল মাতৃকুলের মাটিতে এতদিনে পৌঁছে গিয়েছে। আমি কী করব জানি না।”
অজন্তা বলল, ছেলে বাবার খোঁজই করল না তো, তুমি কী করবে ?
বিপুল বলে, আমি ভাবছি নেত্রকোনা যাব।
কেন ? অজন্তা বিরক্ত হলো, বলল, যে দেশ ছেড়ে এসেছ, সেই দেশের জন্য তোমাদের এত আকুলি-বিকুলি দেখে অবাক লাগে।
বিপুল বলল, এটা আগে ছিল না, এখন হয়েছে।
হওয়ার তো কারণ দেখি না।
বিপুল বলল, শিকড় যদি টান দেয়।
অজন্তা হাসে, ওসব বানানো কথা, শিকড় আবার কী, আর যদি সত্যিই টান দেয়, তা নিয়ে মাথা খারাপ করা ঠিক নয়, ঘর থেকে বেরোতে পারলেই মানুষ বড় হয়ে ওঠে, নাহলে মানুষ দেশ-দেশান্তরে গিয়ে বসতি গড়তে পারত না, সব নিজ নিজ গাঁয়ে পড়ে থাকত, এদেশে জন্ম, সমস্ত জীবন কাটালে এদেশে, আর শিকড় ঐ দেশে, এ হয় নাকি ?
বিপুল চুপ করে থাকে। অজন্তার বাড়ি হুগলি জেলায়। আদি সপ্তগ্রাম পেরিয়ে মগরা। সেখানে একটি নদী আছে, কুন্তী। সেখানে অজন্তাদের কাকা-জেঠারা মিলে কয়েক শরিকের বাড়ি। পিসিদেরও অংশ আছে। অজন্তার বাবা চুচুড়ায় বাড়ি করেছেন। অজন্তার বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। অজন্তা জানে না বিপুলের হাতে যে পান্ডুলিপি তার ভিতরে কী আছে। বিপুল বলল, তুমি তো বাংলা সাহিত্য পড়েছিলে বি, এ, এম,এ-তে।
হ্যাঁ, পড়েছিলাম।
ময়মনসিংহ গীতিকার কথা জান না ?
কেন জানব না ?
কোথায় লেখা হয়েছিল জানো ?
কেন ময়মনসিংহে।
বিপুল তখন বলে, ময়মনসিংহ এক মস্ত জেলা। তার উত্তর পূর্ব কোণে নেত্রকোনা। নেত্রকোনা ছিল একটি মহকুমা। সেই মহকুমা এখন জেলা হয়ে গেছে। নেত্রকোনা থেকে মাইল চল্লিশ সুসঙ্গ দুর্গাপুর। সেই গঞ্জ এবং তার আশপাশের গ্রাম থেকেই উঠে এসেছিল এই গান। দীনেশ্চন্দ্র সেন সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্রকুমার দে নামে এক গ্রামীন সংগ্রাহকের মাধ্যমে। চন্দ্রকুমারের বাড়ি নেত্রকোনায়। আর ময়মনসিংহ-গীতিকার গ্রাম্য গীতিকার, কবিরা সকলেই প্রায় নেত্রকোনার গ্রামের মানুষ। সব কাহিনিই প্রায় ঐ অঞ্চলের। শুনতে শুনতে অজন্তা বলে, সেখানে তোমাদের বাড়ি ছিল ?
ছিল। বিপুল জবাব দেয়।
অজন্তা চুপ করে থাকে। অদ্ভুত লাগছে। নেত্রকোনার কথা সে শুনেছে তার শাশুড়ি মায়ের কাছে। তাঁর বাপের বাড়ি ছিল কংস নদীর এপারে, গ্রামের নাম পূর্ব ধলা। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনি বলতেন অজন্তাকে। অজন্তা কমলাসায়রের কথা শুনেছিল তাঁর মুখে। নেত্রকোনা বলতে তিনি অজ্ঞান ছিলেন। শাশুড়ি মা চলে গেছেন বছর পনের। অজন্তা অবাক হলো এতদিন বাদে। সত্যিই যাবে বিপুল ? অজন্তার তো মনে হয় কবিরা যা লেখেন সবই কল্পনা। ময়মনসিংহ গীতিকার সবটাই কল্পনা। সেই সব গ্রাম দিঘির অস্তিত্ব কি ছিল সত্যি ? কমলা সায়র কি সত্যিই আছে ? হতে পারে নাকি ?
বিপুল বলল, মনে হয় সুধীন্দ্র সোম সেই সুসঙ্গ দুর্গাপুরের দিকেই গেছেন, মানুষটাকে এইভাবে হারিয়ে যেতে দেওয়া কি ঠিক ?
অজন্তা বলল, এ তোমার অনুমান, সে অনেকদূর, ওঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
বিপুল বলল, তাহলে কোথায় যাবেন ?
অজন্তা বলল, স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষ যে কোথায় যাবেন কে বলতে পারবে, আমার বন্ধু রঞ্জনার বাবা অমনি হারিয়ে গেছেন, কত খোঁজা হয়েছে, পাওয়া যায়নি।
বিপুল বলল, কিন্তু সুধীনকাকা তো স্মৃতিভ্রষ্ট হননি।
অজন্তা বলল, হয়েছিলেন কি না তুমি না জানতেও পারো।
বিপুল বলল, আমার মনে হচ্ছে উনি নেত্রকোনাতেই গেছেন।
এই সব কথার ভিতরে তাদের কন্যা বলল, বাবা যদি যেতে চায় যাক না মা, তুমিও যেতে পারো।
অজন্তা মাথা নাড়ে। সে মেয়েকে ফেলে যাবে না। সে গেলে মেয়েকেও যেতে হবে। কিন্তু মেয়ে বলছে সে যেতে পারে যদি কক্স বাজার, চট্টগ্রাম কিংবা বরিশালের কুয়াকাটা দেখাতে নিয়ে যায় বাবা। বিপুল মাথা নাড়ে। এবার সে নেত্রকোনা যাবে সুধীন্দ্র সোমের খোঁজে। সুসঙ্গ দুর্গাপুর যাবে নেত্রকোনা থেকে। সে এক নিতান্ত গ্রামই। সে যাবে সুধীন্দ্রর সন্ধানে। ঘুরতে নয়।
শেষ পর্যন্ত বিপুল যে একা যাবে, তাইই ঠিক হলো। বিপুল একা অতদূর যাবে ? বিপুল বলল, তাইই যাবে। সে একটা টান টের পাচ্ছিল। তার সঙ্গে সুধীন্দ্র-কুমুদিনী বিরচিত সোমেশ্বরী গাঙের পারের কাহিনির পান্ডুলিপির একটি কপি। বিপুল বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে লাইন দিয়ে ভিসার আবেদন জমা দিল। ভিসা পেল এক মাসের। এখন শীত। তার আগে বর্ষা গেছে। বর্ষায় বাংলাদেশের কোথাও কোথাও বন্যা হয়েছে। ভেসেছে গ্রাম জনপদ। বর্ষায় কোথাও যাওয়া যায় না। ডিসেম্বরের শেষে রওনা হলো বিপুল। একা। একটি কাঁধে ঝোলান হাত ব্যাগ এবং একটি ট্রলি ব্যাগ টেনে এয়ারপোর্টে। ঢাকা যাবে, ঢাকা থেকে যাবে নেত্রকোনা। কী করে যাবে ? ঢাকায় থেকে খোঁজ নেবে, হয় বাস, না হয় ট্রেন, ট্রেন কি আছে ? বুঝতে পারছি না। ঢাকায় গিয়ে খোঁজ নেব।
বিপুল চেক-ইনের পর অপেক্ষা করছিল ফ্লাইটের। তখন ফোন এসেছিল মেয়ের। মেয়ের সঙ্গেই কথা হচ্ছিল। এখন মেয়ে বলছে, সে-ও যেতে পারত। খুব ভুল করেছে। বাবা কী ভাবে নেত্রকোনা যাবে ? বাবা যেন বাংলাদেশের একটা সিম কার্ড নেয় ঢাকা বিমান বন্দর থেকে। নেট রিচার্জ করে নেয়। যোগাযোগ যেন থাকে। বাবার এই কাজটা ঠিক হয়নি। একা একা ভিনদেশে যাওয়া অনুচিত হয়েছে। তার এক সময় কথা শেষ হলো, বিপুলের পাশে বসা বছর চল্লিশের এক সুদর্শন ব্যক্তি তার দিকে ঝুঁকে এল, স্যার কি নেত্রকোনা যাবেন ?
আপনি ? বিপুল সেই সদ্য যৌবরাজ্য অতিক্রান্ত ব্যক্তিকে খুঁটিয়ে দেখল। গৌর বর্ণ, দীঘল চেহারা, মাথা ভরা কাঁচা-পাকা চুল। চোখ দুটি উজ্জ্বল, গালে পাতলা দাড়ি। নীল জিনস এবং চেক শার্ট আর জ্যাকেট ও মাথা জড়ানো এক মাফলার। পায়ে বেল্ট লাগানো জুতো।
আমি কেউ না, আমি ইমতিয়াজ আলি চন্দ্রকুমার। লোকটি বলল।
নেত্রকোনা চেনেন ?
আধ ময়লা রঙের মধ্যম উচ্চতার লোকটি বলল, জ্বি, চিনি, আমার কাজ ওখেনে।
আপনি কী কাজ করেন ?
জি, আমি খবরিয়া ইমতিয়াজ, মানষি কয় খবরিয়া চন্দকুমার, আমাদের বংশের সকলে সাংবাদিক, কবি, আমাদের বংশের বাণেশ্বর খবরিয়ার কথা এখনো ওদিকের গাঁয়ে গাঁয়ে শুনা যায়।
বাণেশ্বর খবরিয়া ! সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল বিপুল। খবরিয়া মানে, সেই খবরিয়া। খবরিয়ার নাম কি চন্দকুমার ছিল। না না না। বাণেশ্বর খবরিয়া। কুমুদিনী এবং সুধীন্দ্র যে কাহিনি রচনা করেছেন, তা তো বাণেশ্বর খবরিয়ার গড়া খবর। তৈরি করা খবর। খবর তৈরি না করলে বাণেশ্বরের পেটে ভাত জোটে না। মুখরোচক খবর না হলে গাঁয়ের মানুষ শুনতই না। গা গরম করা খবর, কিসসা কাহিনি বললে লোকে খুশি হয়ে চাল ডাল, দুধ, ঘি মাখন দিয়ে যেত, ধামাভরা মুড়কি, মুড়ি, নাড়ু, তক্তি নিয়ে আসত। চন্দ্রকুমার। ইনি চন্দ্রকুমার ? চন্দ্রকুমার দে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন গীতিকা। ইমতিয়াজ আলীর নামের শেষে চন্দ্রকুমার আছে।
জ্বি, ইমতিয়াজ বলল, চন্দ্রকুমার আমার বাংলা নাম, আমার দেশে এমনি নাম রাখে, লোকে আমারে চাঁদু বলে চেনে, চাঁদু খবরিয়া, জার্নালিস্ট।
আপনি কি নেত্রকোনা যাবেন ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
জ্বি, ফিরে যাচ্ছি।
কলকাতা এসেছিলেন ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
জ্বি, তাই, আমার কাছে একটা খবর ছিল, যাচাই করতে এসেছিলাম।
নড়ে বসে বিপুল, খবর মানে ?
জ্বি, কলকাতার উপকন্ঠে নাকি একটা সায়র কেটেছিল সুসঙ্গ দুর্গাপুরের মানুষ তার নাম কমলাসায়র দিয়েছিল তারা, সেই সায়র কিনে নিয়েছে এক বিল্ডিং ব্যবসায়ী, বুজিয়ে দিচ্ছে।
আপনাকে এই কথা বলল কে ?
জ্বি, আমি খবরিয়া, খবর পেয়েছিলাম।
খবর কে দিল ? জিজ্ঞেস করল বিপুল।
খবর এসেছিল, কিন্তু কি করে এসেছিল তা বলতে পারব না। বলল চন্দ্রকুমার।
কেউ কি বলেছিল ?
তাও বলা যাবে না, আসলে খবরের সোর্স গোপন রাখাই আমাদের নিয়ম।
দেখেছেন কমলা সায়র ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
জ্বি, দেখিনি, মানে আমি কলকাতায় দিশাহারা হয়ে ঘুরলাম, কেউ বলতে পারল না।
বিপুল বলল, আপনার দেশে এই খবর কি খুব বড় খবর হতো ?
জ্বি, তা হয়তো হতো না, কিন্তু একটা দাম থাকত তার, আমার ব্যাড লাক, কলকাতার লোক কলকাতার খবর রাখে না। খবরিয়া ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল।
বিপুল চুপ করে থাকে। শুনেছিল সায়র বাঁচাও কমিটি হয়েছে এক। আপাতত বন্ধ হয়েছে সায়র বুজানো। এর ভিতরে কী হয়েছে তা জানে না বিপুল। অনেকদিন সোমেশ্বরী কলোনিতে যাওয়া হয়নি তার। শুনেছে বিদেশ থেকে সুধীন্দ্রর ছেলে প্লাবন বাড়ি প্রমোটিঙে দিচ্ছে। প্রমোটার বড় একটা ফ্ল্যাট দিয়েছে সাময়িকভাবে। সুধীন্দ্র ফিরলে সেই ফ্ল্যাটে থাকবেন। সোমেশ্বরী কলোনির যে ছিল সুধীন্দ্রর ছেলের সহপাঠী, এখন কাউন্সিলরের দক্ষিণ হস্ত, সেই অনিমেষই নাকি বেনামে প্রমোটিং করছে। কলকাতা এবং তার সন্নিহিত এলাকায় জলাভূমি আর থাকবে না। আগ্রাসী উন্নয়ন সব কিছুকে গ্রাস করে নিচ্ছে। কিন্তু এই ঘটনা শুধু কলকাতা কেন , যে কোনো শহরই এইভাবে বড় হয়ে উঠছে। জলাভূমি রক্ষাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
ফ্লাইটের বোর্ডিং শুরু হয়নি। ইমতিয়াজ আলী বলল, একটা কথা শুনিসি, কলকাতায় কেডা যেন গীতিকা নোতন করে লিখেসে ?
এ খবর কে দিল আপনাকে ? বিপুল অবাক, মিথ্যে করে বলল, আমি তো জানিনে।
খবর এসে যায়, খবর পাওয়া এবং খবর করা আমাদের সাত পুরুষের কাজ। চন্দ্রকুমার বেশ বুক চিতিয়ে বলল কথাটা।
বিপুল সোম চুপ করে থাকল। তার মনে হতে লাগল সুধীন্দ্র গেছেন নেত্রকোনা, সুসঙ্গ দুর্গাপুর। সুধীন্দ্র কি খবর দিয়েছেন ? তাঁর কাছ থেকে খবর পেয়ে ইমতিয়াজ আলী কলকাতা এসেছে ? ইমতিয়াজ তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি নেত্রকোনা যাসসেন কেন ?
সুসঙ্গ দুর্গাপুর যাব।
কেন তা জিজ্ঞেস করতিসি।
বিপুল বলল, এমনি, মৈমনসিংহ গীতিকার কমলা সায়র আর সোমেশ্বরী নদী দেখতে।
শুধু দেখতেই যাসসেন ?
হুঁ, গারো পাহাড়, কুমুদিনী হাজঙের গ্রাম।
আপনি কি সাংবাদিক ?
না, আমি সাধারণ একজন।
আপনি সাধারণ হলি কি চিটাগাঙ, বরিশাল কুয়াকাটা না গিইয়া সুসঙ্গ দুর্গাপুর ?
তখন বিপুল বলল, সে অনেক কথা, বলা যাবে, এখন বোর্ডিং শুরু, উঠুন।
২
তাকে একটা সাধারণ হোটেলে তুলেছিল ইমতিয়াজ। কমলাপুর রেল স্টেশনের কাছেই ছিল হোটেল। সাধারণ ঘর, তবে পরিচ্ছন্ন। পাশের ঘরে ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ হোটেলে ঢুকে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে গেল। ঢাকায় এসেছে, খবর কিছু নিতে হবে তো। খবর পাবে সে তার গাঁয়ের অনুপ সরকারের কাছে গেলে। অনুপ একটা প্রাইভেট কলেজে বাংলা পড়ায়। আর শখের সাংবাদিকতা করতে চায়। কবিতা লেখে। তার অনেক গুণ। তার কাছে খবর থাকে। কীভাবে থাকে তা বলতে পারবে না চন্দ্রকুমার। এমন হতে পারে অনুপ সরকার সেই খবরটা পেয়েছিল, যে মৈমনসিংহ গীতিকা নতুন করে লিখছেন কেউ। অনুপ কী করে খবর পায় ? সুধীন্দ্রর সঙ্গে অনুপের দেখা হয়েছিল? তখন সুধীন্দ্র কি বলেছিলেন তাঁর পান্ডুলিপির কথা। গল্প করেছিলেন। গল্প কি খবর হয় ? মৈমনসিংহ গীতিকার নতুন এক কাহিনি রচনা করেছেন এক অখ্যাত লেখক। তা খবর হবে কী করে ?
বিপুল একা হোটেলের ব্যালকনি থেকে রাস্তা দেখছে। রেল ষ্টেশন কাছে। টিকিট কিনে আনবে চন্দ্রকুমার। তেমন কথা হয়েছে। বিপুল দেখছিল নিচের রাস্তায় রিকশা যাচ্ছে আর আসছে। রিকশা আর রিকশা। মুখোমুখি রিকশা। রাস্তায় সব আটকে গেছে। লোক চলাচলের পথ বিশেষ নেই। এত মানুষ! রাস্তায় তাকিয়েই ছিল বিপুল। আচমকা চোখে পড়ল, পড়েই গেল হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়েছে একজন। বিপুল হাত তুলল, অনিমেষ! সোমেশ্বরী কলোনির সেই অনিমেষ, যে কমলা সায়র ভরাট করার প্রথম সমর্থক। অনিমেষ কেন ? অনিমেষ কবে এল ? বিপুলের মনে হলো অনিমেষও এসেছে সুধীন্দ্রর খোঁজে। সুধীন্দ্রকে খুঁজতে বেরিয়েছে তার পুত্র প্লাবনের কথায়। অথবা পান্ডুলিপির খোঁজে এসেছে অনিমেষ ? তাই কি ? পান্ডুলিপি নিয়ে কী করবে অনিমেষ ? অনিমেষ কি জানে মৈমনসিংহ গীতিকার কথা ? তাহলে এমন হতে পারে, যাকে দেখল বিপুল, সে অনিমেষ নয়, অন্য কেউ। সে ভুল করেছে। লোকটা রাস্তার সঙ্গে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল রেল স্টেশনের দিকে।
সে হাত তুলেছিল। কিন্তু অনিমেষ ভ্রুক্ষেপ করেনি। অনিমেষ ভাবেইনি যে এই কমলাপুর রেল স্টেশনের পাশের হোটেলে তার চেনা কেউ থাকতে পারে। আর অনিমেষের সঙ্গে এক সন্ধ্যায় আলাপ হয়েছিল বিপুলের। অনিমেষ তাকে মনে রাখতে না পারে। রাখার কথা নয়। বিপুলকে উদ্বিগ্ন করে অনিমেষ অদৃশ্য হলো। বিপুল বাংলাদেশের সিম ভরেছে এয়ারপোর্টে পাসপোর্ট দেখিয়ে। ফোন করল চন্দ্রকুমারকে। ট্রেন সেই রাত ১১টা ৫০-এ। কখন ফিরবে সে ? একা একা কত সময় কাটানো যায় ? চন্দ্রকুমার বলল, আসছে, সে আসলে অনুপের কাছে অনেক খবর পেয়েছে। ফিরে বলবে। বিপুল ভাবছিল, দুদিন আগেও চন্দ্রকুমারকে সে চিনত না। বাণেশ্বর খবরিয়ার বংশের কেউ যে এখনো খবরের সন্ধানে ঘুরতে পারে, তা ছিল ভাবনার অতীত।
ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার এল আরো এক ঘন্টা বাদে। আজ শীতের কামড় আছে। উত্তুরে বাতাস আছে। ইমতিয়াজ তার ঘরে এসে বসল, বলল, কিন্তু স্যার আপনি কে , আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো
কেন, আমি আপনারে নিয়ে খুব সমস্যায় আছি।
কেন আমাকে নিয়ে সমস্যা কিসের ? বিপুল বিব্রত হয়ে পড়ল।
নেত্রকোনা যাবেন, সুসঙ্গ দুর্গাপুর যাবেন, কিন্তু কেন ?
জানতে পারবেন।
বলেই দেন, আমি শুধু ভাবতেসি, আপনার সঙ্গে দেখা হবে কেন যদি না কারণ থাকে ?
বিপুল জিজ্ঞেস করে, অকারণে কারোর সঙ্গে দেখা হয় না ?
না হয় না, সব কিছুর একটা কারণ থাকে, বিনি কারণে কি গাছের পাতা নড়ে ?
আপনি কি ভগবানের কথা বলছেন ?
ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, না, আমি বলতেসি, আমি নেত্রকোনার লোক, খবরিয়া বাণেশ্বরের বংশধর, খবর খুঁজে খুঁজে ইন্ডিয়ায় চলে গেলাম, কেন গেলাম, না আমার পূর্ব পুরুষ বাণেশ্বর খবরিয়ারে নিয়ে একটা কাহিনি লিখা হইসে তা শুনেসি, আর সে দেশে……
কথা থামিয়ে দিল বিপুল, বলল, আপনাকে কে বলল, আপনার পূর্ব পুরুষকে নিয়ে কাহিনি রচনা হয়েছে ?
সেইডা বলা যাবে না, কিন্তু কথাটা কি সত্যি না ?
আমি কী করে বলব ? বিপুল বিস্ময় প্রকাশ করল।
তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা হলো কেন ? বলে ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়েই আছে বিপুলের মুখের দিকে। চোখে চোখ।
বিপুল চুপ। এ তো অদ্ভুত মানুষ! কোন জায়গা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ? বলছে তার সঙ্গে বিপুলের দেখা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হয়ে গেল কারণ হওয়ার কথা ছিল। জীবন প্রবাহিত হওয়ার একটা পরিকল্পনা, ধরুন ডিজাইন থাকে। তা থেকে ব্যত্যয় হবার উপায় নেই। বিমান বন্দরে বিপুল ফোনে মেয়ের সঙ্গে নেত্রকোনার কথা বলতে তার কানে এল তা। সে যদি বিপুলের পাশের চেয়ারে না বসে থাকত, কিছুই জানতে পারত না, একটা লোক ইন্ডিয়া থেকে সুসঙ্গ দুর্গাপুর যাচ্ছে বিনি কারণে তা তো হতে পারে না। সে অন্য চেয়ারেই বসেছিল। কিন্তু কী মনে হতে বিপুলের পাশে এসে বসে। মনে হয়েছিল বসা উচিত। বিপুল তখন ফোন করছে মেয়েকে। ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, তার কৌতুহল হয়েছিল লোকটা কী কথা বলছে তা শোনে। তার এমন অভ্যেস আছে। অভ্যেসটা ভালো না জানে, কিন্তু এই অভ্যাস থেকে সে অনেক খবর সংগ্রহ করতে পেরেছে। ইমতিয়াজের মনে হচ্ছে সে কিছু পাবে বলেই বিপুলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কলকাতা বিমান বন্দরে। সে তো খবর আনতেই গিয়েছিল। কিন্তু শূন্যহাতে ফিরেছে। তার ফেরার কথা ছিল ট্রেনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিমানে ফেরা স্থির করে কোনো খবরই না পেয়ে। বিমানে ফেরাই ছিল যেন তার না জানা এক পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত। বিমানে না ফিরলে বিপুল সোমের সঙ্গে তার দেখা হতো না। দেখা না হলে এই মুহূর্তের জন্ম হতো না। শুনতে শুনতে বিপুলের মনে হলো সে এই হোটেলে না উঠলে অনিমেষকে সে দেখতে পেত না, যদি সে অনিমেষ হয়। বিপুল বলল, সে নেত্রকোনা যাবে তার পিতৃপুরুষের ভিটে দেখতে।
এতদিন আসেননি যে ?
বিপুল বলে, টান বোধ করেনি।
আপনি কী সেই ভিটে পাবেন দুর্গাপুরে ?
জানিনে। বিপুলের সংক্ষিপ্ত জবাব।
দেখুন স্যার আমি বাণেশ্বর খবরিয়ার বংশধর, আমি টের পাই আর কিছু, আপনি কারে খুঁজতে যাসসেন দুর্গাপুরে?
আমি কি বলেছি তাই ? বিপুল অবাক। এ যে দেখি চোখের দিকে চেয়ে মনের কথা পড়তে পারে।
ইমতিয়াজ বলে, ইয়েস বলেসেন।
কখন বললাম ?
কলকাতা বিমান বন্দরে।
সত্যি বলেছি ?
আমারে না, আপনার কন্যা কাজলরেখারে।
আমার কন্যার নাম কাজলরেখা, তাও জানেন ?
ইয়েস স্যার, কাজলরেখা বলে ডাকলেন একবার, কিন্তু কাজলরেখার কাহিনি জানেন স্যার ? ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলে।
জানি। বলল বিপুল।
তার জীবন খুব দুঃখের হয়েছিল।
বিপুল বলল, সীতা নাম কি রাখে না, কাজলরেখা যেন বর্ষার মেঘের নিচে নদী।
জ্বি, ঠিক কইসেন, কিন্তু আপনি কারে খুঁজতি যাসসেন ?
আমি কি সেই কথা বলেছি ? বিপুল এতক্ষণে বুঝতে পারছে যে সে এমন এক লোকের পাল্লায় পড়েছে যার কাছে কোনো কিছুই লুকোনো কঠিন।
বলেননি স্যার, কিন্তু মেয়েরে তো বলেসেন।
কী বলেছি ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
একজনরে খুঁজতি যাসসেন।
বিপুল বলল, হ্যাঁ, তাই, আপনাকে আমি বলতাম চন্দ্রকুমার, কিন্তু তা নেত্রকোনায় নেমে।
তাহলে দ্যাখেন, খবরিয়া সব জানতি পারে, আমার পূর্বপুরুষ বাণেশ্বর খবরিয়া বামুনের বাড়ি ঢুকে তার তিন বউয়ের কাছ থেকে তাদের মনের কথা সব বের করে এনেছিল, তা জানেন ?
চমকে ওঠে বিপুল। এই কথা তো লিখেছেন সুধীন্দ্র আর কুমুদিনী। তা কি সত্য কথা ? এমন কি হয়েছিল ? বিপুল তার সঙ্গের পান্ডুলিপি নিয়ে সতর্ক। তাই সে কৌতুহল নিবারণ করল। তবু বলল, এই কাহিনি কোথায় লেখা আছে ?
একটা বইয়ে, আলেয়া বুক ডিপো থেকে বেরিয়েছিল, আমার গাঁয়ের কবি ইসমাইল আলী খান লিখেছিল,
প্রথমে কলম ধরি স্মরণ করি, প্রভু নিরঞ্জনে।
তারপর কবিতা লেখিতে বইলাম দেখিয়া নয়নে,
বিশ্ব পরয়ারে এ সংসারে, যা কিছু বানায়।
সব কিছু বানাইছে মাওলায় নিজের মহিমায়…।
তারপর ? বিপুল জিজ্ঞেস করল তারপর কী ?
আমি তো জানিনি তারপর কী ? বলল ইমতিয়াজ।
কেন জানেন না ?
কী করে জানব, ছুটোবেলায় এই গীত শুনা হতো উঠানে বসে, ভুলি মেরিসি।
তার মধ্যে কি ছিল যে বামুনের তিন বউ, খবরিয়া বামুনের ঘরে গেল ?
ছিল কি না ছিল তা বলতি পারব না। ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, আসলে এই যে ঘটনা তা ঘটেছিল কি না তা স্থির সঠিক করে বলা যাবে না, আর একজন তা বানাইসে এমন হতি পারে, সব কিছু বানাইসে মওলায় নিজ মহিমায়।
সেই মওলা তো খোদা, ভগবান।
মানুষের ভিতর তিনি থাকেন, না হলি মানুষ কী করে মৈমনসিং গীতিকা লেখে ? বলল চন্দ্রকুমার ইমতিয়াজ।
কিন্তু খবরিয়া বাণেশ্বর যে বামুনের ঘরে গেল, সেই বামুন বুড়ো, তার তিন বউ, এই কাহিনি কে শোনালো ? বিপুল জিজ্ঞেস করল।
বামুন যে বুড়া ছিল ইডা কে বলল স্যার, আমি তো বলিনি। চন্দ্রকুমার ইমতিয়াজ আলী এবার বাগে পেয়েছে বিপুলকে। সত্যি সে তো বলেনি বামুন বুড়ো ছিল, বিপুল বলল কেন, তাহলে বিপুল জানে। কী জানে, না খবরিয়া বাণেশ্বরের সেই কাহিনি। কিন্তু বিপুল সেই পথে গেল না, উলটে জিজ্ঞেস করে, কাহিনিটা কোথায় শুনেছে ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার?
আমি শুনিসি কোথায়, কিন্তু কবে শুনিসি, ছুটোবেলায় না বড়বেলায় তা বলতি পারব না, বলতি পারব না এখেনে শুনিসি না সেখেনে শুনিসি, ইসমাইল আলী খান লিখিসিল না অন্য কেউ লিখিসিল, কিন্তু আমি শুনিসি, আর যখন শুনিসি সেই বাণেশ্বররের খবর নিয়ে নয়া কাহিনি লিখা হইসে ইন্ডিয়ায়, আমার মনে হলো ইন্ডিয়ায় গিয়ে খোঁজ করি। বলতে বলতে চন্দ্রকুমার ইমতিয়াজ একটু থামল। নতুন কথা খুঁজে বের করছে মনের ভিতর থেকে, বলল, আমার নাম চন্দ্রকুমার, আমার দাদাজির নাম, মানে আমার ঠাকুরদার একটা নাম ছিল চন্দ্রধর, সে মনসামঙ্গলের চন্দ্রধর বণিক, সাপের দেশ তো, সে কথা যাক, তিনি হাজঙ মাতার কথা শুনাতেন গীতের মতো করে। থামল ইমতিয়াজ।
কুমুদিনী হাজঙ ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
জ্বি , সঙ্গে রাশিমণি হাজঙ, হাজঙমাতা রাশিমণি।
বিপুল বলল, সে কুমুদিনী হাজঙের নাম জানে, মানে শুনেছে, রাশিমনির নাম শোনেনি ভালো করে। হয়তো শুনেছিল, কিন্তু মনে নেই।
তা বললি হবে, রাশিমণি হলেন হাজঙ মাতা, তিনি কুমুদিনীরে বাঁচান ইংরেজ সেপাইদের হাত থেকে, আপনি জন্মভূমি দেখতে আসসেন, রাশিমণিরে না চিনলি হবে ? ইমতিয়াজ বলল, আমার দাদাজি বলত,
কুমুদিনী, সরসী তিনি, ছিলেন টঙ্কের সময়
অতিথচন্দ্রর কনিয়া তিনি, কনিয়া নির্ভয়।
রাশিমণি হাজঙ মাতা, অতি বীরাঙ্গনা,
কুমুদিনীরে উদ্ধার করেন, গুলিবিদ্ধ কনিয়া।
বিপুল বলে, আমাকে রাশিমণির কথা শুনান।
দেখুন স্যার, আমি খবরিয়া, সিম্পিল খবরিয়া, খবর বেচে খাই, আমার পাক্ষিকপত্র দুর্গাপুর টাইমস, তাতে আমি চাদ্দিকের খবর লিখি, আমার ক্ষমতা নাই আমি একটা নোতন মৈমনসিং গীতিকা লিখি, আমার পূর্বপুরুষ বাণেশ্বর খবরিয়ারও সে ক্ষমতা ছিল না, আমি চাই কেউ নোতন করে লিখুক ই কাহিনি।
বিপুল বলল, আপনাদের ঐ অঞ্চলের মানুষ কেউ লিখুন নতুন গীতিকা।
ভাবতিসি স্যার, আমি ছাপব সে কাহিনি, সেই গীতিকা, কিন্তু লিখার লোক কই ?
হাতি ধরা হাতি বেচা, অতি লাভের কাম,
হাজং জাতি ই কাম করে না পেইসিল দাম।
গারো পাহাড় তাহার দেশ, সিমসাং নদী
সোমেশ্বরী নাম হইল, না হইত যদি।
হাজং জাতি, বীর অতি, হাতি খেদাইয়া ধরে,
ভাত জুটে না মাড় জুটে না, না খাইয়া মরে।
বিপুল অবাক, কার সামনে বসে আছে ? সুধীন্দ্র যদি থাকতেন এখানে, সঙ্গে কুমুদিনী! বিপুল টের পায় এই লোকটির সঙ্গে দেখা না হলে, সে দুর্গাপুরে গিয়ে কী করত ? একটা পাণ্ডুলিপি দিয়ে কী খুঁজত ? সুধীন্দ্র এসেছেন কি আসেননি, তার কোনো ঠিক নেই, আর সুধীন্দ্র যে কাহিনি লিখেছেন, তা তাঁর কল্পনা, তার সঙ্গে বাস্তবের যোগ কোথায় ? খবরিয়া ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার যে হাতিখেদা আন্দোলনের কথা বলছে, তা কেন লেখেননি সুধীন্দ্র ?
নদীর নাম সোমেশ্বরী, তার আসল নাম সিমসাং। গারো পাহাড় থেকে নেমেছে সেই নদী, নদী দেখলে চক্ষে পানি এসে যাবে স্যার। যে গাঙের কথা শুনে এসেছ স্যার তুমি, সে গাঙ, রাজা সোমেশ্বর পাঠকের নামে যে গাঙের নাম সোমেশ্বরী হলো, সেই গাঙে বর্ষা ব্যতীত পানি থাকে না। গাঙ এসেছে ইন্ডিয়া থেকে, ইন্ডিয়াতেই গাঙের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে, ইন্ডিয়ার মেঘালয় রাজ্যের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া ঝর্নার পানি আর রমফা নদীর পানি মিলে যে সোমেশ্বরী গাঙ নেমেছিল গারো পাহাড়ের গা দিয়ে, হাজঙ পিতা হাজঙ মাতা যে গাঙ নিয়ে নেমেছিল মৈমনসিংহ গীতিকার এই দেশে, স্যার, সে গাঙ আর নাই, পানিছাড়া একটা গাঙ দেখলে চক্ষে পানি এসে যাবে স্যার।
কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেল ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার খবরিয়া। বিপুল সোম বুঝতে পারছিল যা জেনেছে তার চেয়ে অনেক বেশি জানেনি। মৈমনসিংহ গীতিকা ছিল, তার কথা নিয়ে তারা দেশ ছেড়েছিল। কিন্তু আরো যা ছিল সত্য, তা ফেলে গিয়েছিল। সত্য ছেড়ে সীমান্ত পার হয়ে গিয়েছিল তারা পার্টিশন হয়ে গেলে। সত্য হাতিখেদা আন্দোলন, হাজঙ কৃষকদের বিদ্রোহ টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে, রাশিমণির মৃত্যু, কুমুদিনির বিদ্রোহ। সেই কথাই বলতে চাইছে ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার। বিপুল সব রেকর্ড করছিল। কেন করছিল তা জানে না। কিছু না হোক কাজলরেখা আর তার মা অজন্তা শুনতে পারবে তো।
(চলবে)