১৪.
কুয়াশা কাটছে। সোমেশ্বরী নদী, দূরে গারো পাহাড়, নদীর বুকে এই শীতে ধু ধু বালুচর। মধ্যিখানে শীর্ণ জলরেখা। নদীর বুকে বালি তোলার লরি। নদী পার হয়ে দুর্গাপুরে প্রবেশ করছে তারা। সুসঙ্গ। রাজার সঙ্গ ছিল অতি মধুর, রাজা ছিলেন প্রজাপালক, তাই সুসঙ্গ। রাস্তা সংকীর্ণ। টোটো, অটো, ম্যাটাডোর, মিনি লরি, গরুর গাড়ি এক সঙ্গে লাইন মেরেছে, মুখোমুখি হয়েছে। অতীনের কথায় বিপুল জিজ্ঞেস করল, প্রজা পালক রাজা সিমসাং নদীর নাম নিজের নামে করতে সম্মতি দিলেন কেন ?
অতীন বললেন, একই নদীর নাম স্থানে স্থানে আলাদা হয়, আপনাদের ব্রহ্মপুত্র আরো পুবে অনেক উপরে, চিন দেশে সাংপো, বাংলাদেশে যমুনা, সেই যমুনাই আবার মেঘনা হয়েছে সমুদ্রের কাছে গিয়ে, সিমসাং যদি সোমেশ্বরী হয় ক্ষতি নেই, সিমসাং নাম তো রয়েছে গারোদের দেশে, আপনার মেঘালয়ে।
সোমেশ্বর পাঠক তো গারোদের রাজ্যকে নিজের রাজ্য করে তুলেছিলেন। বলল বিপুল।
যার শক্তি বেশি সেইই তো রাজ্য অধিকার করবে, যুদ্ধে গারোরা হেরে গিয়েছিল, মাটি কার হয়, দাপের। বলে অতীন বিষণ্ণ মুখে হাসলেন, তারপর বললেন, এর অন্য কাহিনিও আছে, বলা যাবে পাণ্ডুলিপি থেকে।
তাদের সি,এন,জি অটো দাঁড়িয়েছিল বিকট জ্যামে। তারা তিনজন সি,এন,জি, থেকে নেমে সেতুর রেলিং ধরে নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। অনেক দূরে গারো পাহাড় ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বিপুল জিজ্ঞেস করল, সত্যিই কি তুমি ভুলে গেছ লোকটার কথা, লোকটা এসে শুয়েছিল কমলা সায়রের পাড়ে, লোকটা এক পক্ষ শুয়ে ছিল, সে কমলা সায়রের সঙ্গে রাশিমনি হাজং আর কুমুদিনী হাজঙের নাম জড়িয়ে দিয়েছে, তুমি জান না সত্যি।
ওই যে বলসিল হেলাল, জ্বিনে ধরা মানুষের কথা, এরে তাই মনে হয় দাদা। চন্দ্রকুমার বলল, একটা লোককে জিজ্ঞেস করেও ওর কথার সত্যতা প্রমাণ হবে না দাদা। চন্দ্রকুমার বলল, পাগলা, নিজি নিজি বানায় সব।
কিন্তু ও বলছে সবাই ভুলে গেছে, লোকটা চলে যেতে তার কথাও সব মুছে গেছে।
এ কি শেলেট পেনসিলের লেখা যে মুছে যাবে ? বলল চন্দ্রকুমার, সব মিথ্যে,সারাদিন একা থাকে ওই ভিটেয়, ওর বিবি আর এক বেটা ছিল, চলি গেসে, অমন মানষির সঙ্গে কেডায় থাকবে, ও দিঘি পাহারা দেয়, কেন দেয় ? কী করতি দেয়, দিঘি কি আছে, সব তো সরকারের খাস জমি, আগে ছিল জমিদারের, রাজার, ওরে কেডা বেতন দেয় যে ও পাহারা দেয় ? বলল চন্দ্রকুমার। সে বাণেশ্বর খবরিয়ার বংশধর। অমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, অথচ সে ভুলে গেছে, তা কি হতে পারে ? তার পত্রিকায় ছাপা হতো নিশ্চয় তাহলে। কিছুই হয়নি, অথচ আমিরুল বলছে এত ঘটনা ঘটেছে। দিঘি আর নেই, অথচ তার পানিতে নেমে গেছে লোকটা। অতীন চুপ করে আছেন। তখন সেতুর জ্যাম কেটেছে। তা্রা গিয়ে সি,এন,জি,তে বসল। বিপুল ভাবছিল চন্দ্রকুমার বলছে সে বাণেশ্বর খবরিয়ার বংশধর। বাণেশ্বর খবরিয়া কে ? কেউ না। সুধীন্দ্র আর কুমুদিনীর কল্পনা। কল্পনার পুরুষ চন্দ্রকুমারের পূর্ব পুরুষ। চন্দ্রকুমারকেও তাহলে জ্বিনে ধরেছে। আর অতীন সরকার, তিনিও যে ভুলে গেছেন সুধীন্দ্রর কথা, তাও সত্য, তিনি তো বলেছেন, তাঁর কাছে একটা পাণ্ডুলিপি আছে, কে লিখেছে তা তিনি বলতে পারছেন না, কিন্তু তিনি নন, তিনি সেই পান্ডুলিপির ফাঁক-ফোঁকরগুলি ভরাট করছেন মাত্র। অতীনকে সেই পাণ্ডুলিপি দিয়ে গেছেন সুধীন্দ্রই। কিন্তু সুধীন্দ্রর কথা তিনি বলছেন না। ভুলে গেছেন ঠিক। ভুলে গেছেন অতীনের বড় ভাই নীতিনও। তাহলে অতীনকেও জ্বিনে ধরেছে ঠিক।আদি মৈমনসিংহর বাতাসে জ্বিনে নিঃশ্বাস ফেলে, সেই জ্বিন আসলে ফেরেস্তা। ফেরেস্তারা পালা গায়, গীতিকা রচনা করে। বিপুলের মনে হতে লাগল আমিরুলের সব কথা ঠিক। রানিকমলা ওই সায়র দান করে দিয়েছেন রাশিমণি আর কুমুদিনীকে। তাদের জন্যই সায়র খনন।
রাজার বাড়ি ঘুমিয়ে আছে। বুড়ো হয়েছে তো। দাপাদাপি কিছুই নেই। ঘোড়া শালে ঘোড়া নেই, হাতিশালে হাতি নেই। কোনোখানে কোনো কিছু নেই। জীর্ণ অট্টালিকা ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে। ক্ষুধিত পাষাণ। সুসঙ্গ রাজাদের এক এক শরিক এক এক সময় ত্যাগ করেছে এদেশ। তাদের ঘরের ছেলে মণি সিংহ, মণি সিংহর মা ছিলেন সুসঙ্গ রাজার বাড়ির কন্যা। কলকাতায় তাঁর বিবাহ। কলকাতায় থাকতেন। ১৯০১ সালে মণি সিংহর কলকাতায় জন্ম। গোড়ায় তিনি গান্ধিজীর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হন। তখন তাঁর কুড়ি বছর। এরপর ১৯২৫ এ মণি সিংহ বামপন্থায় আকৃষ্ট হন। কলকাতায় মেটেবুরুজে গিয়ে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিনি তখন সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু তখন মণি সিংহের মনে হয়েছিল, ক’জন উচ্চ পদস্থ রাজ কর্মচারীকে হত্যা করে দেশ স্বাধীন করা যাবে না। বিপ্লব করতে হবে। বিপ্লবেই ব্রিটিশ সরকার বিদায় নেবে। বিপ্লবের জন্য চাই অসম সাহসী মানুষ। তারা কারা ? না, তাঁর মাতুল গৃহ সুসঙ্গ দুর্গাপুরের হাজং উপজাতিরা। মণি সিংহ জানতেন হাজং উপজাতির হাতিখেদা বিদ্রোহের কথা। হাতিখেদা বিদ্রোহের জন্যই খেদাগুলি ভেঙে দেওয়া হয়। বন্ধ হয় হাজংদের দিয়ে হাতি ধরা। সেই হাজংদের সংগঠিত করতে পারলে বিপ্লব হবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। সুসঙ্গ দুর্গাপুর থেকে মাইল দশ দূরে কালিকাবাড়ি হাজং গ্রামে তিনি ও তাঁর কমরেড উপেন সান্যাল গিয়ে কাজ আরম্ভ করেন। কালিকাবাড়ি গিয়ে মণি সিংহ হাজং বাড়ি গিয়ে অন্ন গ্রহন এবং হাজংদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করেন। তিনি রাজার ভাগিনেয়, রাজবাড়ির মানুষ, তাঁকে বিশ্বাস করবে কেন তারা। টঙ্ক প্রথায় চাষ করে তারা ক্রমশ নিঃস্ব হচ্ছে তখন। হাতিখেদার মতোই টঙ্ক প্রথা তাদের কাছে বিভীষিকা। ১৯২৮ সালে মণি সিংহ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ এ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে। ১৯৩৫ এ মুক্তি পেয়ে মণি সিংহ অন্তরীন হয়ে থাকেন। তাঁর মা তখন পিতৃগৃহ সুসঙ্গ দুর্গাপুরে। ১৯৩৭ সালে তিনি মায়ের কাছে আসেন অন্তরীন থেকে মুক্ত হয়ে। এই সময়ে তিনি টঙ্ক প্রথার ভয়ঙ্করতা টের পান হাজংদের পল্লীতে গিয়ে হাজংদের সংগঠিত করতে গিয়ে। তিনি দুর্গাপুরের ভিতরেই ঘুরতে লাগলেন হাজং বসতিতে। বিনি নজরানায় জমি পেয়ে চাষীদের ঘাড়ে ঋণের পাহাড় চেপেছিল টঙ্ক প্রথার টঙ্কা শোধ করতে গিয়ে। সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজার এই খাজনা ছিল সব চেয়ে বেশি। শুধু হাজং নয়, গারো পাহাড়ের কোলের মুসলমান চাষীরাও টঙ্ক প্রথায় জমি নিয়ে ভয়ানক দুর্বিপাকে পড়েছিল। টঙ্ক প্রথা ছিল রাজা-জমিদারদের কৌশলে চাষীদের প্রতারিত হওয়া। এর চেয়ে নজরানা দিয়ে জমি নিয়ে বার্ষিক খাজনা, কিংবা ভাগে চাষ করায় চাষীরা বাঁচত। শুখা কিংবা বানায় তো ফসলের নির্দিষ্ট পরিমাণ দিতে হয় না। ফসল না হলে, উৎপাদিত ফসলের ভাগও নেই। খাজনাও মকুব হতো, যেহেতু খাজনা ছিল ফসল উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। প্রচুর চাষী অভাবের কারণে টঙ্ক প্রথায় জমি নিতে লাগল যখন, রাজার আদায়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে। টঙ্কের হার বছর বছর বাড়তে থাকে। প্রতি বছরই নীলামে ওঠে জমি, আর টঙ্কের পরিমাণ বাড়ে। চাষ না হলেও বার্ষিক টঙ্ক শোধ করতেই হবে। না শোধ করলে রাজা-জমিদারের অত্যাচার নেমে আসত চাষীদের উপর। টঙ্ক না শোধ করতে পারলে ঋণ জমত। এই ঋণ কখনোই মকুব করা হত না। বংশ পরম্পরায় চলত ঋণের ভার। উত্তরাধিকার সূত্রে ঋণের অধিকারী হতো চাষীর পুত্র, পৌত্র। জমি নিয়ে নিত রাজার গোমস্তা, কিন্তু ঋণ রেখে দিত। এতদিন সমস্তটা জানতেন না মণি সিংহ। তিনি টের পেলেন তাঁর বিলাস বৈভব সবই চাষীদের রক্ত নিংড়ানো টঙ্ক প্রথার জন্য। ১৯৩৭ সালে এক একরে ধান দিতে হতো পনের মণ। চাষীরা ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। মণি সিংহ নিজের মাতুল রাজ পরিবারের বিরুদ্ধেই চাষীদের নিয়ে বিদ্রোহ করলেন। মণি সিংহ সুসঙ্গ দুর্গাপুরে এসেছেন শুনে হাজংরা তাঁর নেতৃত্ব প্রার্থনা করেছিল। মণি সিংহ, হাজং স্বাধীনতা সংগ্রামী ললিত হাজং দাঁড়ালেন টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে। তখনো পাকিস্তান প্রস্তাব হয়নি। লাহোর অধিবেশন ১৯৩৯ সালে। সুসুঙ্গ দুর্গাপুরের রাজার পরিবার চিরকালের মতো এদেশ ছাড়বেন, তা ভাবেননি। কোনো কোনো শরিক চলে গিয়েছিল শিক্ষার আলোর জন্য কলকাতা। গোমস্তা, মোহরার, তসিলদাররাও ভাবেনি সুখের রাজত্ব ছেড়ে চলে যেতে হবে কোনোদিন।
আপনি এসব কথা লিখেছেন আপনার পান্ডুলিপিতে ? শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করে বিপুল।
আমার পাণ্ডুলিপি যে তা তো আমি বলিনি। অতীন সরকার বললেন।
বিপুল বলল, ১৯৪৭-এর নতুন বছর পড়তে, বৈশাখ পার করে, জৈষ্ট মাসে আমার ঠাকুরদা, বাবা, পিসিদের নিয়ে কলকাতা চলে যান।
তখন বোঝা গিয়েছিল ওই প্রথা আর থাকবে না, ৩১শে জানুয়ারি রাশিমণি আর সুরেন্দ্র হাজং শহীদ হয়েছিল কুমুদিনীকে বাঁচাতে গিয়ে, বেঁচেছিল কুমুদিনী।
আমাদের বাড়ির খোঁজে আমি আসিনি। বিপুল প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে চাপা গলায় বলল।
অতীন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ঠাকুরদা, বাবার কাছে এসব শোনেননি ?
না, তিনি এফিডেবিট করে পদবী বদল করে নিয়েছিলেন, সোমেশ্বরী, রাজার দেওয়া উপাধী। বিপুল নিম্ন স্বরে বলল, এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয়নি।
তখন সেই ভগ্নাবশেষ থেকে বেরিয়ে এল একজন। বিপুল চিনতে পেরেছে। কাঁখে একটি সন্তান, হার হাত ধরে আছে বছর ছয়-সাতের কন্যা। আয়না বিবি। কমলাপুর স্টেশনের সেই আয়না বিবি। পূর্ব ধলার আয়না বিবি। কংস নদীর ওপারে পূর্ব ধলা। নদী পার হয়ে এসেছে আয়না বিবি। সে মাথার কাপড় টেনে বিপুল আর চন্দ্রকুমারের দিকে তাকায় কিন্তু যেন চেনেই না, এমন করে রাস্তা পার হতে যায়। চন্দ্রকুমার ডাকে, আরে, তুমু তো আয়না বিবি, তুমার ভাই তো মোল্লা বদিউল ইসলাম, পূর্ব ধলায় ঘর, ইমামতি করে।
সে দাঁড়ায়, বলে, নাম আয়না বিবি ঠিকাসে, পূর্ব ধলা ঠিকাসে, কিন্তু কেন, আফনে কেডা ? বিভ্রান্ত লাগে তার চোখমুখ।
তুমি হাওর এক্সপ্রেসে আসনি, পরশু ? জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার, কমলাপুর স্টেশনে দেখা।
জ্বি কিসুই মনে থাকে না, ভুলি যাই সব, কবে আইসি, কহন আইসি ভুলি গিসি, মা বাপ নাই, ভাই মুরে খেদাই দেসে, আফনেরা মুরে চিনেন, মনে রেখিসেন, মুর নসিব, কিন্তু আরবে গিইসে যে, মুর সোয়ামি…। আয়না বিবি কথা থামিয়ে দেয়, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সকলের মুখ। তার চোখে চেনা মানুষের ছায়া তো পড়েনি, বিড়বিড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ইসব কথা কারে ক’তিসি, কেন ক’তিসি, মুর কপাল যেমন !
বিপুল অবাক, ভুলে গেল ? আশ্চর্য ! বিপুলের দিকে তাকিয়ে আছে আয়না বিবি। তারপর নিজ মনে বলল, মুই ঘুরতিসি মুর সোয়ামির জন্যি, মুই কি ফের শ্বশুরঘর ঘুরান যাব, ভাই বলিসে মুই চরিত্তহীনা, মুই কইতা পারিনি খোদার আরশ কইখানে, মুর ঠাই নাই, মুর সোয়ামিরে গুণ করিসে আরবের মাইয়্যা, মুর লাগবে না আসমানতারা কাপড়, মুরে নাকি ফের গাজিপুর যেতি হবে, আবার সে কী বলে তা বুজিনে, মুর মাথা খারাপ হই গিইসে।
বিপুল জিজ্ঞেস করে, এখেনে কোথায় এসেছিলে রাজার বাড়ি ?
জ্বি, আফনে কেডা দাদাভাই , মুর ভাই মুরে খেদাই দেসে, বলে আমারে শেল-কুকুর ছিঁড়ে খাবে। বিনবিন করতে করতে আঁচলে চোখের কোণ মুছল আয়না বিবি।
তুমি তো আয়না বিবি ? বলল বিপুল।
জ্বি, সেডা ঠিক আসে, কিন্তু আফনেরে মুই বুঝতি পারতিসিনে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আয়না বিবি।
তুমি তো পরশুদিন হাওর এক্সপ্রেসে এলে, কমলাপুর স্টেশনে দেখা হলো। বিপুল বলে, তুমি ইসলামি কিতাব কিনলে।
জ্বি, বলতি পারতিসিনে, মুই সোয়ামিরে খুঁজতিসি এদিকি, সে নাকি আরব থেকি চলি এইসে বাংলাদেশে, কিন্তু কুথায় আইসে তা কেউ কইতাসে না। বলতে লাগল আয়না বিবি, না আসে যদি, তাও বুঝা যাসসে না।
এখানে কবে এলে ? বিপুলের জিজ্ঞাসা ফুরোয় না।
জ্বি, ক’দিন আসসি,ক’দিন তা কইতি পারা যাবেনি, সেই বিষ্টির কাল হলো, সেই রোদ উঠল, ফের বিষ্টি হলো, ওই গাঙে পানি এল কত, পানিতি জমিন ভিটা বুড়ে গেল, তারপর জাড়ের কাল হলো, কিন্তু একটা জাড় না দুইটা জাড়, কইতে পারসিনি, জাড়ের পর পুষ্প ফুটিল, বনে বনে পঙ্খী ডাকা করিল, তারা বলাবলি করে মুর সোয়ামী নাকি আরব মুলুক থেকে ফিরা এইসে, ভাই তা বলল, সে নাকি এহেনে থাকে। আয়না বিবি বলল, খাড়ান, মুই পাউরুটি লিয়ে লি, ইয়াদের ক্ষুধা পাইসে, ক্ষুধায় শুকাই গেসে মুখ দুখানি…।
বিপুল বিস্ময় নয়, বিপুলের মনে হলো, সত্যি বলছে আয়না বিবি। দুই সন্তান নিয়ে সে কতকাল ধরে তার স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত……। আয়না বিবির স্বামী সেই উজ্জ্যাল সাধু গেল বাণিজ্যে,
অভাগিনী আয়না কান্দে, “ শুন পরাণের পতি।
দেওয়ায় ডাকিলে বান্দিও নায়ের কাছি”।।
অভাগিনী আয়না কান্দে “আমার মাথা খাও।
রাইত নিশিথে বন্ধু না বহিও নাও।।
তুমি দেখলে, সে কি ফিরেসে ? জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার।
জ্বি না, ভাই মুরে মিথ্যে কহি ঘরথুন বের করি দেসে, সে আরবেই রইসে মনে হয়। বলতে আয়না বিবি পথের ধারের দোকান থেকে পাউরুটি কিনতে গেলে চন্দ্রকুমার বলে, মুই তুমারে খরিদ করি দিসসি, তুমু টাহা কুথায় পাবা আয়নারানি, তুমু বসো ছা’ দুটা নিয়া।
অবাক আয়না বিবি বিড়বিড় করে, বলে, আয়নারানি, কী ক’ন আফনে, মুই আয়নারানি, কেউ কয় নাই কোনোদিন, দেন, কিনা দেন। বলে আয়না বিবি সরে দাঁড়ায়, বিপুলকে বলল, ভায়ের মনে দয়া মায়া নাই, আল্লা তারে ভালো রেখিসেন, রাখুন, মুই কিসুই বুঝতি পারিনে দাদা, মুর কেন এমন হয়।
কাঁখের বাচ্চা ঘুমিয়ে। তার মাথা ঢেকেছে আঁচলের অংশ দিয়ে। পাউরুটি আর সানকিতে রসগোল্লা নিয়ে এল চন্দ্রকুমার, বলল, দুকানের বেঞ্চিতে বসে খাওয়াও ওদের, নিজিও খাও, তুমার মুখখানিও শুকাই গেসে, এমনি ঘুরে বাঁচা যায় ?
আয়না বিবি মাথা নামায়, ফিসফিস করে, কী যে ক’ন আফনে খবরিয়া,ইমন কেউ কয় না আর!
রাজার বাড়িতে কেউ থাকে ? জিজ্ঞেস করল বিপুল।
জ্বি না, সব হূন্য দাদা। বলল আয়না বিবি, কত বড় বাড়ি রাজার, লক নাই একডাও, খোদার রাজ্যে চিরদিন কিসুই থাহে না।
এখন কোথায় যাচ্ছ ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
জ্বি, কী মনে হলো, ঘুরতিসি কতদিন, রাজার এই বাড়িতি নিশাকালে হুই, বিরিসিরি ফের যাই, যদি এসে থাকে, সে লক এসে যদি ভোল বদল করে থাকে, মুই কী করে তারে চিনব। বলল আয়নাবিবি। তারপর সে টিউবোয়েলের সমুখে যায়। কন্যাটিকে বলে, হাত ধুয়ে নে, এই তো পাইসিস, আল্লায় দিইসে।
চন্দ্রকুমার বলে, তুমার ভাই যে তুমারে বাপের ঘরে রাখসে না, তুমার তো অধিকার রইসে।
আয়না বিবি বলল, মেয়েমানুষের অধিকারডা কী, তা তো জানিনে মু।
তুমি এখন বিরিসিরি কুথায় যাবা ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে, শীতির বেলা পড়ি যাবে অহনই।
মেয়ের মুখে সানকি থেকে রসগোল্লার একটি তুলে নিয়ে দিতে দিতে আয়না বিবি বলল, যাব বলে বেরাইসি, যাব কি না জানিনে, কুথায় যাব জানিনে, মুর সদাগর আরবে গিয়া ফিরেনি না ফিরিসে জানিনি, সে কইসিল আসমানতারা কাপড় কিনসে, সে কাপড় কারে দিইসে জানিনি।
তুমার ভাই বের করি দিল, আর তুমি চলি এলে ? চন্দ্রকুমার বলল।
না, ভাই বলল, সে লক দুর্গাপুর আইসে, এহেনে বাড়ি কিনসে, মুই তা শুনি চলি এইসি সে কতদিন, তহন রোদ সিল খুব, গা পুরি যায়, ভাই আমারে নামাই দি গেসিল, কিন্তু সে লক দক্ষিণ পাড়ায় নাই, আমি ঘর ঘর গিইসি, মিথ্যে বলি ভাই এইডা করল।
চন্দ্রকুমার বলল, আবার ভাইয়ের বাড়ি যাও।
ভাই একই কথা কইবে, ভাই বলবে, সে দেশে আইসে। আয়না বিবি বিমর্ষ মুখে বলল, দেশে ফিরেনি।
অমুক মন্ডল পতি সে, আরবে গিইসে।
আসমানতারা কাপড়খানি সতীনে নিইসে।।
১৫.
আরব থেকে এসে থাকতিও তো পারে। চন্দ্রকুমার বলল, কতদিন ভিনদেশে থাকবে ?
জ্বি, এহেনে আসবে কেনে, সে তো গাজিপুর যাবে। বলল আয়না বিবি, অনেক লকেরে জিজ্ঞাস করসি, কতদিন ঘুরি ঘুরি দিনমানে, সাঁঝের বেলায়, আজানের পরে, সব লক কহে, অমন নামে কেউ নাই।
কী নাম কহ দেখি। চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
এই রাবিয়া, তুর বাপের নাম কী ? আয়না বিবি জিজ্ঞেস করল মেয়েকে। মেয়ের মুখের ভিতর পাউরুটির অংশ, সে গিলতে থাকে মায়ের কথার উত্তর দেওয়ার জন্য। উত্তর দিতে পারলেই যেন বাপের দেখা মিলে যাবে। মেয়ে রুটি গিলে নিয়ে বলল, লতিফ, মুর বাপ লতিফ মন্ডল, তার বাপ শুভান আলী মন্ডল, মুর দাদা।
চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে, কেমন চেহারা ?
মেয়ে চুপ করে থাকে। তার মুখে ভাষা জোগায় না। বাবা কেমন দেখতে? বাবার মতো। ভুলেই গেছে সে। আর আবছা মনে থাকলেও বর্ণনা করা তার সাধ্য নয়। তখন আয়না বিবি বলল, সুপুরুষ, লাম্বা মানুষ, মাথায় অনেক চুল, বাঁ চখের নিচে লম্বা কাটা দাগ, কিন্তু তা খারাপ সিল না। সলজ্জ স্বর আয়না বিবির, উনি খুব জুয়ান মানুষ, বলত, আরবে গিয়া রুগা হই গেসেন।
ভিডিও কোল করেসিল ? জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার।
ফুন কল, একটা মুবাইল কিনি দিয়ে গিসিল, সেইডা চুরি হই গেসে। আয়না বিবি বলল।
কী করে চুরি হলো ? জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার।
জ্বি, বলতি পারব না, গেসে মুর কপাল। বলল আয়না বিবি।
তাহলে সে ফোন করবে কী করে ? চন্দ্রকুমার বলে।
জ্বি, ফুন হয় না তো। বিড়বিড় করল আয়না বিবি।
ফোন না থাকলে ফোন করবে কী করে ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
কেনে তার ভাইয়ের ফুনে কল করা যায়। বিমর্ষ আয়না বিবি বলে।
সেইডা তো তুমার ফুন মা। বলে উঠল আয়না বিবির কন্যা রাবেয়া।
না, তা না, সে কিনসে। বলল আয়না বিবি, পুরানো ফুন কিনসে নাকি।
না, সিডা তুমার ফুন। বলে ওঠে রাবেয়া।
মাথা নাড়ে আয়না বিবি, মুর দেওর সফিক কিনসে, একেবারে এক ফুন, ফুন কি সব আলাদা, এক রকম হয়, তাই হইসে। বিড়বিড় করে আয়না বিবি, অমন কইতি নেই, সে তুমার চাচা।
চাচায় তুমারে ধরসিল কেন ? সাত বছরের রাবেয়া গরগর করে ওঠে।
এই তুই থামবি, ঘরের কথা বনেও বলতি নেই। বলে আয়না বিবি মাথা নিচু করে। তারপর বলে, সে লোক তো গাঁর ফুন দুকানে ফুন করতি পারে, করে না, কেন করে না ?
চন্দ্রকুমার বলে, তার ফোন নম্বর নাই ?
ফুনে লিখা সিল। আয়না বিবি উত্তর দেয়।
তোমার দেওরের কাসে সিলনি ? চন্দ্রকুমার বলে।
সইফ বলে, নাই, সে পাটি করে। আয়না বিবি বলে।
কোন পার্টি ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
সে বাস লরি পুড়ায়, খুব তার রোষ, মুরে খেদাই দিসে। আস্তে আস্তে নিজেকে ভাঙে আয়না বিবি, মুর ভাই যেমন নিঠুর, তেমনি নিঠুর সে…।
হায় ! বাড়ি নাই ঘর নাই কপাল পুড়া আমি গো।
নির্বান্ধব করিয়া আল্লা মোরে বনে পাঠাইলো গো।।
মা নাই বাপ নাই, সে মুর গর্ভ সোদরার ভাইরে।
পানির মুখে সেওলার মতো মু ভাসিয়া বেড়াই রে।।
সব কথা লিখা হবে, তার গায়ের রঙ ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
জ্বি, ময়লা রঙ, কিন্তু তাই ভালো, পুরুষের আবার রঙ কী কাজে লাগে ? আয়না বিবি বলল।
তার কোনো ছবি আছে ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
আয়না বিবি বলল, আছে, কিন্তু তা বিবাহের।
দেখাবা। চন্দ্রকুমার বলল, মুই খবরিয়া, এইডা খবর হবে, খবর হই যায় যদি, সে এদেশে ফিরে বিবাহ করলি, তুমি ব্যবস্থা নিতি পারবা, সে যদি এসি থাকে, খবর হই যাবে, তুমু জানতি পারবা।
আয়না বিবি বলল, বিবাহের ছবি না দেখালি খবর হয় না ?
হয় না। চন্দ্রকুমার জবাব দেয়, বরং বিবাহ কীভাবে হইসে তাও জানাতি হবে।
এ তো মুর নিজির কথা, কী করে বলি, সরম হয়। বল্লল আয়না বিবি।
কিন্তু না বললি হবে, সে লক যদি তুমারে ভুলি গিয়ে থাকে, বিবাহর পিকচার দিখে মনে পড়ে যাবে।
সে মুরে ভুলি গিইসে, এমন হতি পারে ? আয়না বিবি বিড়ম্বিত মুখে বলে।
জগতে সব কিসু হতি পারে। চন্দ্রকুমার বলে, তুমি তুমার বিবাহর কথা বলো।
জ্বি, সে লক আমার ্বাপের বাড়ি এইসিল এক বৈকালে, মুর বাপ ইসমাইল মিঞা তহন বেঁচে, সে আইসিল কেন জানিনে, নাও বাঁধিসিল গাঙের ধারে, পারেতে হিজল বিক্ষ, পানিতি পড়ে ডাল, কাছিতি নাও বান্ধি, দিইল সামাল, আগুন চাই, রান্ধিবে ভাত ডাইল, সঙ্গে কলমি ভাজা, আগুন আনিতে সে আইলো ভিটায় সুজা। সে ছিল বালুচর, বালুচর ভেঙে চরের ধারে শেষে এসে দেখে কুটির একখানি, বুড়া এক বসিয়া আছে, চখে বয় পানি। বিড়বিড় করে বলতে থাকে আয়না বিবি। মুই গিসি গাঙের পানি আনতি, কলসী লিয়া এসে দেখি, বসিয়া আছে সে, পুরুষ ভিনদেশী, পানি ছলকাইয়া পড়ে, তাকাইয়া দেখিসি। যেমন সোন্দর সে, তেমন যৈবন, এরে ছাড়ি কারে নিব, কী কথা কইবন ?
তারপর ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
চারি চক্ষু মিলন হইসে,সুখির বিতান্ত, বাপে কয়, বিবাহ দিয়া যাইবে বেহেস্ত। আয়না বিবি বিড়বিড় করে, বলে, গাজিপুর এক পুর মেঘনার ধারে, সেখেনে সেই লক সংসার করে, ঘরে ছিল মাতা পিতা, ছিল এক বুন, সংসার সুখের ছিল রমণীর গুণ, কিন্তু হইল যে কী করিয়া বলি, পীরিতির বহু দুঃখ বহু যাতনা মানি। আয়না বিবি বলতে বলতে আরক্ত হয়,ভিনদেশী পুরুষ সে সদাগরি করে, নাও লিয়া গাঙে গাঙে দেশে দেশে ঘুরে।
তারপর কী হয়েসিল ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
আসে না আসে না সে, কবে আসে ফিরা, বসি থাকি চরে গিয়া, নাও দেখি গিয়া। সে ছিল বসন্ত কাল, গেল কবে চলি, আইল বোশাখখ মাস, রোদি পুড়ি মরি, আষাঢ়ে আসিল মেঘ, শাদা আর কালো, মেঘ দেখি তার কথা মনে মনে আলোঝালো, ও মাঝি, মাঝি তুমু কোন দিশে ঘর, সদাগরে চিন তুমু, অমুক মন্ডল নাম।বর্ষায় পানি উথাল, বানা আসে ঘরে, বুড়া বাপ রোগে রোগে, যায় বুঝি মরে।
তুমার ভাই ? জিজ্ঞেস করে চন্দ্রকুমার।
ভাই মুর ভাই, সে থাকিতেও নাই, ভাই ছিল তার ভিটায়, বানা নাই সেথা, বাপেরে দিখে না সে, মনে লাগে ব্যথা, ব্যথা লাগে খবরিয়া আর কত কহি, দুঃখের গাঙখানি নিজ যায় বহি।
বাপ মরে গেল ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
মাথা নাড়ে আয়না বিবি, না, সেই বানা গেল, মরতি মরতি বেঁচি গেসে বাপ, বাপের সিল কঠিন জান, কেডা নেয় তা, শুখা বানা যাই হোক, বাঁচি থাকে পিতা। ভাই এসে বলে, কে এক মুল্লা বুড়া, তিনকুড়ি বয়েস, আয়নারে যাঞা করে, এমনি খায়েশ। শুনি মুই কেঁদে মরি, অভাগিনী আমি, কুথা গেস সদাগর, গাঙ ঝিমঝিমি।
সে বুড়ার ঘর কুথা ? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করে।
সে বুড়ার নাম সিল তিলোচন মিঞা, গয়লানি সিল তার, কুথায় ঘর জানিনি।
এখন তুমি করবে কী, কী ভেবেস মনে ? চন্দ্রকুমার খবর নেয়।
কী করিব মুই, দুর্গাপুর হলো, যাব ফির পূর্ব ধলা, ওদিকি খুঁজ নিব, যাব কলমাকান্দা, বারোহাটি, সিখেন থেকে মোহনগঞ্জ, হই খালিয়াজুড়ি, খুঁজি বেড়াব, সদাগর এয়েসে জানি,কংস নদী, বালিয়া নদী, শুনাই নদী, ধলা নদীর পানিতি কি খবর হয় নাই? বলল আয়না বিবি, মুর দুঃখ যাবেনি জানি,
যেই রে বিরক্কের তলে যাই আরে ছায়া পাওনের আশে রে।
পত্র ছেদা রৌদ্র লাগে দেখ কপালের দুষে রে।।
হায়, আসমানতারা কাপড়ের কথা সে কত বলিসে, কিন্তু দেয় নাই, এহন আমি কী করব জানিনে। কপালে হাত রাখল আয়না বিবি। তার কোলের ছোটটি তখন চোখ মেলল, বড় বড় চোখে মায়ের মুখ দেখতে লাগল। তাকে বুকে চেপে আয়না বিবি বলল, পথে পথে বড় হব ইয়ারা, মানষে ভালো মন্দ এক সঙ্গেই হয়, যে মুরে আসমানতারা কাপড় দিবে কয়, সে তাই খরিদ করে আর একজনেরে দেয়…।
তখন চন্দ্রকুমার বলল, তুমার টায়েম দিতা হবে, তারে খুঁজি বের করতি টায়েম তো দিতাই হবে, খবর নিতা হবে, মু খবরিয়া, নিব খবর।
কত দিন ধরে খুঁজতিসি তারে,কত দিন আর লাগব জানিনি। বলল আয়না বিবি।
মু একটা কথা বলতিসি, তুমারে কুথাও যেতি হবেনি, মু খুঁজি দেখব সে আরবে না এদেশে, এদেশে হলে এদেশের কুথায়, কোন গাঙ ধরৎ তার নৈকো গেসে কোন গাঙে, কোন পথ দিয়ে হেঁটে গেসে সে, বিবাহ করি থাকে যদি, সে কারে, কবে ?
মু কী করব তাইলে এখন, এডা একটা কাজ ছিল, এখন মু কী করব দুটা বাচ্চা লিয়া ? জিজ্ঞেস করে আয়না বিবি, সংসার ভাইস্যা গেছে তাই তারে খুঁজি, যদিও সে মুর হবেনি আর, সে কথাডা বুজি।
আচমকা আয়না বিবির হাত ধরে ফেলে চন্দ্রকুমার, বলে, মুর ঘরৎ আইথর চ আয়না বিবি।
হাত ধরাই থাকে, আয়না বিবি নিঝুম হয়ে গেছে যেন। নিঝুম এক বনতলে বোধ হয় দেখা হয়েছে দুজনের। চারিদিকে কেহ নাই। লোক-লজ্জার ভয় নাই। আয়না বিবি মুখ নিচু করে বলল, তুমার ঘরৎ বিবি নাই, সে কি মুরে পা রাখতা দিবে, খেদাইয়া দিবে না ?
নাই, মুর কেহ নাই, আছে এক বুড়ি মা, চখে দ্যাখে না, চন্দ্রকুমার বলল, দুখিনী মেয়ে মুর ঘরৎ থাকবি চ।
মুই তো একা নই গো, চখের দু’ তারা নিয়ে হাঁটি আমি, তারা দুইরে রাখি কার নিকট, কে নিবে ভার, তারাদের চখে দেখি মু, অন্ধ নাচার।
তারাও চলুক সাথে, মুই কি তোরে শুধু বলি আয়না, তারাও আসুক তারা, আসমানের দুই তারা।
চমকে ওঠে আয়না বিবি, কী কহিসো খবরিয়া, কী কহিসো কহ ফের ?
চখের তারা আসমানের তারা, নিয়ৎ ঘুরো পথে, আসমানতারা রাখি সে গিইসে আরব দিশে, ইডা বুঝ নাই মেয়্যা ? বলে চন্দ্রকুমার খবরিয়া যে কিনা সেই বাণেশ্বর খবরিয়ার আপনজন, যে বাণেশ্বর সুধীন্দ্র সোমের স্ত্রী কুমুদিনীর কল্পিত মাত্র। কল্পিত খবরিয়া কেউ, সেই বাণেশ্বরের আপন কেউ ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার আয়না বিবিরে বলছে নিয়ে যাবে তার ঘরে। কোথায় চন্দ্রকুমারের বাস, কোন গাঁয়ে তার ঘর ?
রাজ রাজেশ্বরী নামে এদেশে এক নদী ছিল। সেই নদী মরে গিয়ে পড়ে আছে রাজিয়া খাল। দক্ষিণে কেন্দুয়া যাও, কেন্দুয়ার পশ্চিমে আছে আইথর গ্রাম। সেই গ্রামে নাকি চন্দ্রকুমারের পূর্ব পুরুষের ঘর। কোন চন্দ্রকুমার, যে চন্দ্রকুমার মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করেছিলেন, গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে খবর নিয়ে বেড়িয়েছিলেন সুসঙ্গয় কেমনে খনন হলো রানির সায়র। সায়রে জল উঠল কেমনে। আহা, রানির জীবন বিসর্জন হলো কেমনে ? মলুয়া সুন্দরী কেমনে দেখেছিল ভুখা পেটের চান্দবিনোদকে, মহুয়া সুন্দরী কেমন করে বড় হলো বেদের নৌকোয় নৌকোয়। আর এই আয়না বিবি কেমন করে হারালো তার সওদাগরকে।
বিপুল এত সময় ধরে ঘোরের ভিতর ছিল দুজনের কথোপকথনে। তার সম্বিত ফেরে চন্দ্রকুমারের কথায়। বলল, তুমি কি আয়না বিবিকে সত্যিই নিয়ে যাবে বাড়ি ?
জ্বি হাঁ, আমার পূর্ব পুরুষ বাণেশ্বর খবরিয়া, আমাদের ওই আইথর গাঁয়ে চন্দ্রকুমার দের পূর্বপুরুষের বাস ছিল, আমি আয়না বিবিরে মুর ভিটায় নিয়া যাব, দুইটা সন্তান নিয়া রাস্তায় রাস্তায় কত দিন ঘুরবে ?
যদি তার স্বামী আরব থেকে ফিরে আসে ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
আসমানতারা রেখি গেসে, সে কেনে ফিরবে, আর ফিরে এলিও ভুলে গেসে আয়না বিবিরে। বলল চন্দ্রকুমার, আরব দিশে গিয়া ভুলিই যায় সব, ভুলি যাওয়া রীতি।
নাকি দাস হয়ে আছে শেখের বাড়িতে, সারাদিন বালি সরিয়ে দেয় উঠন থেকে, সেই তার কাজ। বলল বিপুল, কত লোক ফিরে আসে ভয় নিয়ে, কতজন ফিরতে পারে না, চাবুক খেয়ে মরে।
হায় হায় হায়, কে কইসে ইডা, সে যখন ফুন করত, কই তেমন তো বলে নাই। আয়না বিবি প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, হায় হায় হায়, সদাগর কোন দিকি যায়, মুরে না মনে থাকৎ, সুখি নাও বায়।
চন্দ্রকুমার বলে, ওইডা ভুল দাদা, ফিরা আসে নারী শ্রমিক, মুর গাঁর সাত যুবতী নারী গিসিল, দুইজন মরিসে সে দেশে, পাঁচজনের ভিতর তিনজনের মাথা খারাপ হই গেসে, আর দুজন বলতেসে সব থুয়ে এসিসে, বাপ বেটা, শেখেরা এবেলা সেবেলা তাদের দিয়া অকাম করাত, তার নাম মধুমালা, সে কত কান্নাকাটি করল এসে,
যাইও না যাইও না, সে দিশে, আরব মুলুক
ছিড়া খায় গোস ঝেন, বড় কষ্ট মাঈ
বাপ বেটা দুই শেখে, সকলি হারাই।
পুরুষ ভালই কাম করে, চ আয়না বিবি, মুর ঘরে চ, আসমানের দুই তারা নিয়া ঘুমাবি চ।
মধুমালা কে ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
গরিব মা বাপের মেয়ে, বরে নেয় না, তাই আরব গেল দু’টা টাহার জন্যি। বলল আয়না বিবি।
তুমি তারে চেন ? বিপুল অবাক।
হ চিনি, সোয়ামী খেদাইল যহন, পথে পথে ঘুরতিসিল, মুর সদাগরের সঙ্গে সেও গিসিল আরবে, তার নিকট জানিব সদাগরের খবর।
আয়না বিবির কথা শুনে চন্দ্রকুমার বিরক্ত হয়ে বলল, সদাগর সদাগর সদাগর করো, সদাগরে না পাইয়া কান্দনে মরো, মন নাই সদাগরের, ভুলিয়াছে সব, চন্দ্রকুমার খবরিয়া শুনে সেই রব।
আরও গিসিল কতজন, ফতেমা, নীলা আর কাঞ্চনমালা, তারা ফিরসে ? জিজ্ঞেস করে আয়না বিবি।
চলো, সবারেই জিগাবা তুমি। বলে চন্দ্রকুমার সি,এন,জি, অটো ডাক দেয়, ও ভাই, যাবা নাকি কেন্দুয়া, আইথর গাঁ, চলো।
আর সময় নিল না চন্দ্রকুমার। কতদূর যাবে, কত ঘন্টা ! সুসঙ্গ দুর্গাপুর একেবারে উত্তরে, আর আইথর দক্ষিণে। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত। নেত্রকোনা থেকে দুর্গাপুর যত পথ, আইথর অন্যদিকে তার দ্বিগুন পথ। শীতের বেলা ফুরোল বলে। বেলা ফুরোলে কুয়াশা নামবে। বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছতে পারবে না বাড়ি।রাত হয়ে যাবে। আজ কী তিথি ? চাঁদ কখন উঠবে ? কুয়াশায় পথ বোঝা যাবে না। রাস্তা ভালো না। কিন্তু যেতে হবেই। অটোতে আয়না বিবি দুই সন্তান নিয়ে পেছনে উঠল। দু’চোখ ভরে গেছে জলে। ড্রাইভারের পাশে বসল চন্দ্রকুমার। হাত নাড়ল। বলল, দাদা, গীতিকায় এমন হইসে কত, মুর পরদাদা, তার দাদা, বাণেশ্বর এমনি কত ভালো খবর দিয়া নিয়া করৎ কত ধামা ফল-পাকুড়, ধান্য কলাই নিয়া ঘরে ফিরসে। এইডা ধরেন বাণেশ্বরের খবর। হয় বাণেশ্বর বানাইসে, না হয় সত্যি ঘটসে, ঘটাইসে সে লোক।
১৬.
ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার উধাও হলো সি,এন,জি নিয়ে। এখন ? বিপুল আর অতীন পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কিছুই তো দেখা হয়নি। সেই বহেরাতলী গ্রাম, যেখানে হাজঙ মাতা রাশিমণি মরেছিল পুলিশের গুলিতে। পুলিশ এসেছিল টঙ্ক বিরোধী পুরুষদের ধরপাকড় করতে। তারা এখানেও জেলা পরিষদের বাংলোয় আশ্রয় নিয়েছে। থাকবে কদিন। একে পুবের দেশ তার উপর শীতকাল। কত তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে এল। চন্দ্রকুমারের মোবাইলে ফোন করল বিপুল যখন, রাত আটটা। ফোন ধরল আয়না বিবি। বলল, উনি ফুন মুর কাছে রেখি গেসেন দাদাভাই, মুরা এসি গেসি ।
সে কোথায় গেল ?
চাউল, ডাইল, আন্ডা, তেল, প্যাঁজ , আলু খরিদ করতি, রাতি খোয়া হবে কী? বলল আয়না বিবি।
এলে ফোন করতে বলো। বিপুল বলে।
জ্বি, বলব দাদা, এই ভিটে মুর খুব চিনা লাগতেসে। বলল আয়না বিবি, কেনে যে এমন লাগতেসে!
বিপুল অবাক হয়ে কথাটি শোনে। বাক্যহারা।
ই খবরিয়া লকটারেও খুব চিনা লাগতেসে দাদা। আয়না বিবি বিড়বিড় করে।
তোমার সঙ্গে কি তার দেখা হয়নি কমলাপুর স্টেশনে ?
জ্বি, মুর তা মনে পড়ে না, কিন্তু চিনা লাগতেসে বটে।
বিপুল জিজ্ঞেস করে,তোমার মেয়েরা কোথায় ?
আয়না বিবি বলে, উয়াদের নিয়েই তো সমিস্যা দাদাভাই।
কেন, ওরা কী করল ?
জ্বি, ছুটোটার বয়েস তো আড়াই, সে তার আব্বুরে চিনে না, উয়ার আব্বুরে কি সে দেখিসে, ফের মেয়ের জন্ম হতি সে রাগ করে আরব দেশ চলি গেল, কিন্তু ছুটোটা যে উনিরে ছাড়তেসে না, মেয়ে দুটারে নি উনি বাজারে গেসে।
বিপুল জিজ্ঞেস করল, ওরা চিনে ফেলেছে ?
কী করে চিনসে জানিনি, দুটাই কী চিনসে জানিনি, কিন্তু চিনসে নিচ্চয়, তেনার সঙ্গে কেমন চলি গেল। আয়না বিবি কাঁদল। তার চোখের জল দেখতে পায় যেন বিপুল। কান্নাটা আনন্দের না কষ্টের তা বুঝতে পারে না বিপুল। আয়না বিবির দুই মেয়ে নাকি বুঝতে পেরেছে এই লোকটা তাদের আব্বু। হায় হায় হায়, তাদের সে যত বলে, তাদের আব্বু ইনি নয়, তারা মানবেই না, বড়ডা কইসে এমন করলি আব্বু ফের চলি যাবে, আচ্ছা দাদা, ছুটোরা কি সব বুঝতি পারে আগে, চিনতি পারে আগে?
বিপুল চুপ করে থাকে। আয়না বিবি তার সমর্থন চাইছিল। চন্দ্রকুমারই তার হারিয়ে যাওয়া সদাগর স্বামী। সেই সমর্থন পেলে আয়না বিবির সংসার পেতে বসতে সুবিধে হবে। চন্দ্রকুমারকে গ্রহন করতে সুবিধে হবে। বিপুল এবং নেত্রকোনার মাস্টারবাবু বললেই সে নিশ্চিন্তে খবরিয়াকে চিনে নিতে পারে তার স্বামী লতিফ মন্ডল হিশেবে। তাতেই হয়ে যাবে সব। তার জীবনের দুঃখ যাবে। ছোটরা বুঝি ধরতে পারে যতই তুমি নিজের রূপ লুকিয়ে ঘুরে বেড়াও। তাদের চোখে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। সেই যে উজ্জ্যালা সদাগর, সে আসলে কি খবরিয়া ? নাও বেয়ে খবর বয়ে এসেছিল। সেই খবরিয়াকে এতদিন বাদে খুঁজে পেয়েছে আয়না বিবি ? আয়না বিবির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত মিল হয়েছিল সদাগরের। আয়না বিবি বলল, রাখসি দাদা, চুলো জ্বালাতি হবে, কেরাচিনটাই শুধু ছিল ঘরে, আপনি দেশে ফিরার আগে আসেন একদিন।
বিপুল অপেক্ষা করে ছিল, কখন চন্দ্রকুমার ফোন করে। কিন্তু করেনি। অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল বিপুল। কিন্তু এল না ফোন। অতীন বললেন, সংসার নিয়ে ব্যস্ত। খবরিয়া নিজের জন্য একটা খবর খুঁজে পেয়েছে অথবা তৈরি করেছে। অতীন কি তাঁর পান্ডুলিপিতে এই আয়না বিবি আর চন্দ্রকুমারের খবর যোগ করবেন ? অতীন কথাটা শুনতে পাননি, বললেন, আমাদের ক’দিন থাকতি হবে এখেনে, আপনার তাড়া নেই তো ?
আবার আসা হবে কি না জানি না, আপনার পান্ডুলিপির সাক্ষী থাকি। বিপুল বলল।
হ্যাঁ, তাই থাকুন, দলিল দস্তাবেজে সাক্ষী দরকার হয়, ফার্সি ভাষায় তারে কয় ইসাদি, আপনি এই পান্ডুলিপির ইসাদি, ফিরে যাওয়ার সময় স্বাক্ষর দিয়া যাবেন। অতীন বললেন।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল অনেক দেরিতে। অতীন স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে গেছেন। সকালে স্নান তাঁর বহুদিনের অভ্যেস। অতীন বললেন, দুইটা লোক আসছে গারো পাহাড়ের দিক থেকে, প্রবুদ্ধ আর সুবুদ্ধ।
বিপুল বলল, তাদের কথা লিখেছেন সুধীন্দ্রকাকা।
আমিও জানি তাদের। বললেন অতীন, কুয়াশা পড়েছে খুব, তারা যেন কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এল।
বিপুল বলল, আপনার পান্ডুলিপির ভিতরে আছে তো ?
আছে মনে হয়, কিন্তু তা না, আমি তো মর্নিংওয়াক করি, আজও করিসি, তারা দুই যুবক তখন কুয়াশার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল হুস করে, যেন কুয়াশার পুষ্করিণ থেকে মুখ তুলল ঘুরসে, ধবল আর শ্যাম বর্ণ পুরুষ, একজনের চোখ কটা, সেই অস্থিরচন্দ্রের মতো। ্বলে তাকিয়ে আছেন অতীন বিপুলের প্রতিক্রিয়ার জন্য। বিপুল অবাক না হয়ে বলল, প্লাবনের মতো।
সুধীন্দ্র সোমের পুত্র, সান দিয়েগো থাকে ?
বিপুল ঘাড় হেলিয়ে সমর্থন জানায়।
তারা যমজ হতে পারে, কিন্তু তারা সুষম নয়, দুজনে আলাদা, তারা সুসঙ্গ দেখতি লেগেসে এই কুয়াশার ভিতর, তারা খবর পেয়েসে কিছু একটা ঘটতে চলেছে এখানে, যে ধ্বংসস্তূপে আয়না বিবি ছিল, সেখেনেই নাকি উঠেছে, বলে রাজার বাড়ি আয়েস করে থাকা যায়।
ধ্বংসস্তূপে ?
হুঁ, তাই তো বলল।
বলল, প্রথমবার রাজার বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে পারেনি, হুকুম ছিল না।
প্রথমবার কবের কথা বলছে ? বিপুল জিজ্ঞেস করে। বিপুল আন্দাজ করতে পারছে। বিস্ময় ক্রমশ অতল তলে, তলহীনতায় পৌঁছে যাচ্ছে যেন। এই সব ঘটার কথা নয়, কিন্তু সাবেক মৈমনসিংহর মাটিতে এসব অসম্ভব কিছু নয়। গ্রামে গ্রামে কবি, গীতিকার কাহিনি রচনা করেছেন ছন্দে, তাঁরা কি সব মুছে গেছেন ? তা কী করে হবে ? কবিও আছেন, গীতিকাব্যের মানুষগুলিও আছেন। উত্তরাধিকার বহন করেই আছেন।
বিপুলের অনুমান বুঝি মিলে গেল। তারা, সুবুদ্ধ আর প্রবুদ্ধ এসেছিল সেই তখন, যখন রানি কমলার দিঘি খনন করা হয়েছিল। গীতিকাব্যের কাহিনি তো একটিই লেখা হয়েছিল কবি অধরচন্দ্রের কলমে, যা লেখা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি লেখা হয়নি। লেখা হয়নি কিন্তু ঘটেছিল কম নয়। যা ঘটেছিল কিংবা ঘটেওনি, মানুষ ভেবেছিল মাত্র, মানুষ বানিয়ে বানিয়ে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় বলেছিল সন্তান-সন্ততিদের কাছে, তা নিশ্চয় পড়ে আছে মাটিতে, গ্রামে গ্রামে তা সঞ্চিত হয়ে আছে মানুষের স্মৃতিতে। সেই স্মৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষের কাছে পৌঁছেছে। মানুষ তা গ্রহণ করছে। সুবুদ্ধ আর প্রবুদ্ধ দুইজন আবার কী এক খবর পেয়ে এসেছে।
কী খবর ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
তা জানা যায়নি। অতীন বললেন।
এমনি চলে এসেছে ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
এমনিই বলা যায়, আবার না বলা যায়ও। অতীন বললেন, তারা কিছু একটা শুনে এসেছে।
বিপুল চুপ করে থাকে। অতীন বলছিলেন, তারা নাকি দেখেছিল রানি কমলার আত্মোৎসর্গ। সায়রে জল উঠল। তখন কত সৈন্য সামন্ত, লেঠেল, লোক লস্কর,ইদানীং ক’বার এসে দ্যাখে কিছুই নেই। তাই তারা আসে। খবর পেয়েই আসে।
বিপুল বলল, একবার চন্দ্রকুমারকে আপনি ফোন করুন, খবরিয়া থাকবে না, এ কী করে হয় ?
মাথা নাড়েন অতীন, বললেন, অনেক বছর, ধরতে পারেন দুশো হবে, কম বেশি, যেমন আপনি ভাববেন, তাদের দেখা হয়েসে, ফোন না করা ভালো, সংসার পেতেছে।
এমন হয়, হতে পারে ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
অতীন বললেন, হতি পারে।
কী করে হতে পারে ?
সেডা বলা যাবে না, সব কিসু কি বলা যায় ? অতীন বললেন, আর সব কিসু জেনেই বা লাভ কী, দেখুন সোমবাবু, এদেশ অন্যরকম দেশ, এদেশে এত কবি জন্মেসিল আর এত গান লিখে গেসে, তা কী করে হয় , হতে পারে না তো? অতীন ঘুম ভাঙা বিপুলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে, আমি কি সাধে এদেশ ছেড়ে কোথাও যাই না ।
কেন যান না বুঝতে পারি না। বিপুল বলে।
মাটি টেনে রাখে, একদিন চন্দ্রকুমার আসে তো আর একদিন চান্দবিনোদ আসে, তো দুদিন বাদে নতুন গীতিকা নিয়ে আর কেউ আসে, একদিন কেউ এসে বলে, কবিরা যা লিখেনি, তা তিনি লিখসেন, উফ, আপনি থাকলে বুঝতেন কোথায় আছি, আমি বাইরে চলে গেলে তারা কোথায় যাবে? বলতে বলতে থেমে যান অতীন সরকার, দম নেন, আবার বলেন, যদি না থাকি, তবে ওই প্রবুদ্ধ সুবুদ্ধর সঙ্গে কি দেখা হতো, উরি বাপ, তারা নাকি গারো পাহাড়ের নিচে থাকে, কিন্তু বেড় দিয়ে পশ্চিমে, কতদূরে বসে খবর পেয়েসে।
বিপুল বলে, সে তো ইন্ডিয়া ?
ইন্ডিয়া হতে পারে আবার মিয়ানামার হতে পারে, আবার কোনোটাই না হতে পারে, তারা বলে চলে এল, এখেনে মানে সুসঙ্গ দেশে কিসু একটা ঘটবে, তার সাক্ষী হতে তারা এসেছে।
কিছু ঘটবে তা বলল কে ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
খবরিয়া।
কোন খবরিয়া, চন্দ্রকুমার ত আমাদের সঙ্গে ছিল। বিপুল বলে।
বাণেশ্বর কিংবা অধরচন্দ্র। অতীন নির্বিকার গলায় বললেন।
আশ্চর্য ! বিপুল স্থির দৃষ্টিতে অতীনের মুখখানি দেখতে থাকে। এই লোকটি কে ? কোনোদিন নেত্রকোনা জেলা ছেড়ে বেরোয় না। আপনিই কি অধরচন্দ্র কবির উত্তরাধিকার নিয়ে বসে আছেন মশায় ? আপনাকে চিনেই সুধীন্দ্র দিয়ে গেছেন পান্ডুলিপিটি।
অতীন বললেন, পুখরনি খননের সময় দুজন ছিল জেনেছি, তবে পাণ্ডুলিপি কি আমার, তা তো নয়, আমার কাছে একজন গচ্ছিত রেখে গেছেন, আমি তাঁরটা রক্ষে করতিসি শুধু। বললেন অতীন।
ঠিক কি তাই, পান্ডুলিপির ফাঁকগুলিকে আপনি ভরাট করছেন কেন ? জিজ্ঞেস করে বিপুল।
আমি না করলেও কেউ করবে, এসব কাজ কি পড়ে থাকে, ধরুন মলুয়া কাব্যের ভিতরে তো খাজনা আর টঙ্ক প্রথার কথা লেখা হয় নাই, কমলা সায়রেও না, এসব পরের ঘটনা হবে, হাতিখেদা তো করত হাজং জাতি, তা নাই, কিন্তু তখন না হলে, এখন তো হবে, তাই করছি আমি। অতীন বলেন, আমি কেউ না, মৈমনসিংহের মাটির গুণ এইটা, হয়তো সেই গীতিকবি অধরচন্দ্রই লিখে যাসসে।
তাইই হবে হয়তো, তখন রাজ রোষের ভয়ে লেখা না হলেও এখন লেখা হবে, বাকিটা কেউ না কেউ লিখবেই। বিপুল বলল।
বুজলাম, সায়র পাড়ের আমিরুলের কথা আপনি বিশ্বাস করেন ? জিজ্ঞেস করলেন অতীন।
বিপুল বলে, হতে পারে, না হতেও পারে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমার মনে হয় এই দিকার মানুষের হক আছে এমন দেখার, এমন না দেখার। বলে চুপ করে যান অতীন সরকার, তারপর ধীরে ধীরে বলেন, সত্যিই বলেছে, এখন সত্যিটা যদি কেউ সত্যি না মনে করে তবে তার কী যায় আসে, কিসুই না।
ওই সুবুদ্ধ প্রবুদ্ধ কি জানে সুধীন্দ্রর কথা ?
বলতে পারব না, কিন্তু কিসু একটা ঘটবে বলেই ওদের আসা। বললেন অতীন।
আমরা এখন কোথায় যাব ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
কুয়াশা কমুক একটু, বহেরাতলী, যেখেনে টঙ্ক আন্দোলনের বীজ বপন হয়েছিল প্রথম।
হাজং মাতা রাশিমনি আর কুমুদিনী হাজং ?
হ্যাঁ, তাঁদের মূর্তি আছে বিরিসিরিতে, আবার বহেরাতলীতে, মণি সিং যে আন্দোলনে হাজং চাষাদের সঙ্গে নিজেকে মেলালেন, সেই প্রথা তো তাঁর মাতৃকুলের। সুসঙ্গ রাজবাড়ি তাঁর মায়ের বাপের বাড়ি। মা তখন এখানে। মায়ের বয়স হয়েছে। মণি সিং ১৯৩৭ সালে কলকাতায় জেল থেকে বেরিয়েই নেত্রকোনা হয়ে সুসঙ্গ চলে আসেন। মণি সিং সুসঙ্গ এসেছেন শুনে টঙ্ক আন্দোলনের ভার তাঁর হাতে সমর্পণ করে হাজং চাষা এবং মুসলমান চাষারা নিশ্চিন্ত হতে চাইছিল। কমরেড মণি সিং পারবেন চাষাদের টঙ্ক প্রথার নিগড় থেকে মুক্ত করতে। এই সময়েই মণি সিং-এর সঙ্গে যোগাযোগ হয় আদিবাসি নেতা ললিত হাজঙের সঙ্গে। ললিত হাজং ছিলেন লেংগুরা গ্রামের মানুষ। তাঁর পারিবারিক অবস্থাও ভালো ছিল। কিন্তু তিনি মণি সিং এর সঙ্গে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে গেলেন। তাঁদের দাবি ছিল কয়েকটি, প্রথমত টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ। এই ভয়ানক প্রথা থেকে মুক্তি দিতেই হবে চাষাকে। যা চাষা টঙ্ক প্রথায় জমি চাষ করে, তাকে সেই জমির স্বত্ব দিতে হবে। রায়ত হবে সে। রায়ত বাৎসরিক খাজনা দেবে জমিদারকে। খাজনা হবে উৎপাদিত ফসলের হিশাবে। ফসল মরলে খাজনা মকুব। টঙ্ক প্রথায় যে বকেয়া খাজনা রয়েছে, সব মকুব করতে হবে। টঙ্কর খাজনা উত্তরাধিকারে বর্তাবে না। সর্ব শেষ দাবি ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। এই দাবি নিয়ে জনসভা হতে লাগলে, সুসঙ্গর জমিদার রাজার সঙ্গে মণি সিং-এর দূরত্ব বাড়ে। মণি সিং মায়ের কাছে গিয়ে অনুমতি নেন, তাঁর যে জমি টঙ্ক প্রথায় চাষ হয়, তা মুক্ত করে দিতে। মা গুল মামুদ আমাদের চাষা, গুল মামুদের টঙ্ক খাজনা মকুব, ধান মকুব করৎ দিইসি।
মা বললেন, তাঁর কিছু বলার নেই, চাষার কল্যাণ হলে তিনি আটকাবেন কেন।
মণি সিং মায়ের বলে বলীয়ান হয়ে চাষাদের নিয়ে আওয়াজ তুললেন, টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ চাই।
হাতিখেদা আন্দোলনের হাজং বিদ্রোহীদের তখন বয়স হয়েছে, বুড়োরা বলল, টঙ্ক হটাও, চাষা বাঁচাও।
বুড়ো গুণেন হাজং বলে, তখন ছিল পনের বৎসর, খুব লড়াই হইসিল। হাতিখেদা হইব না।
মণি সিং হাজং পল্লীতে গিয়ে হাতিখেদার কাহিনি শোনেন। তার জন্মের আগে হাতিখেদা বন্ধ করে দিয়েছিল হাজংরা। সেই আমলের কজন মাত্র বেঁচে আছে। আশি-পঁচাশি, নব্বই। তারা সব লড়াই করেছিল। একজন, মাধো হাজং বলল, সে দেখেছিল মনা সর্দারের মরণ। তার তখন বছর দশ। মা বাপের সঙ্গে গিয়েছিল রথের মেলার মাঠের ধারে। সকলে খুব উত্তেজিত ছিল। মনাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। আহা, সেই মরণ তার চোখের সমুখে এখনো ভাসে। তারপর কতদিন রাতে কেঁদে উঠেছে ঘুমের ঘোরে। মস্ত এক দাঁতাল হাতির পা নেমে আসছে তার বুকের উপর। সেই হাতিখেদা বন্ধ হতে কতদিন লেগেছিল তার মনে নেই। সবই এখন ভুল হয়। হাতিখেদা বন্ধ হতি নায়েব গুমস্তা এই টঙ্ক ঢুকালো রাজার মাথায়। মহেশ্বর গুমস্তা, মহেন্দ্র গুমস্তা সব্বোনাশ করৎ দিল হে। রাজার মাথায় এতখানি শয়তানি ছিল না হে। তা শুনে এক বছর তিরিশের হাজং চাষা বলল, মনা সর্দারের মরণ কি রাজা না জানতি হইসিল ? রাজা ভালো গুমস্তা খারাপ ইটা ঠিক না।
এখন তো গুমস্তাই চাপ দেয় বেশি। বলল মাধো হাজং।
রাজা কইসে অত টঙ্কা চাই, গুমস্তা তুমু জুগাড় করো। গুলু মিঞা বলল।
গুমস্তা কেনে বলে না, চাষারা খুব দুঃখ নিয়ে আছে। বলল মাধো হাজং।
গুমস্তারে দূর করে দেবে রাজা।
দিল দিল, গুমস্তা কেনে টঙ্কের জন্যি চাপ দিবে? মাধো হাজং বলে, মনা সর্দারৎ হাতি দিয়া চিপা মারার পেলান গুমস্তার ছিল, এইডা সবাই জানে।
তখন ললিত হাজং বলে, গুমস্তার উপর নির্ভর হলি কি টঙ্ক উঠব ?
তাইলে কী করি উঠবা ? দুখু হাজং জিজ্ঞেস করে। তার তিন সনের টঙ্ক বকেয়া। বানায় দুসনের ফসল গেছে। এক সনের ফসল নিজেই পেটে খেয়েছে আর লুকিয়ে বেচে দিয়েছে। সে ঠিক করছে পালিয়ে যাবে। না পালালে উপায় নাই। তার কথাই যেন মলুয়া পালায় লেখা হয়েছিল। সে তো অভাবে পালায়। না পালালে টঙ্ক শোধ করতে হবে। কিন্তু এই পর্যন্ত লিখে ভালোবাসার কথা লিখেছিল কবি। রাজার রোষ সহ্য করতে পারবে এমন জোর ছিল না তার। কিন্তু কথাটা ঠিকও নয়। মলুয়া তো দুখিনি নারীর কাহিনি। দেশে দুর্বিপাক হলে নারী দুখিনি হয় কোনো না কোনো কারণে। চাষার দেশে চাষা আর তার বউ কষ্টে থাকে কেন, ফসল আসে না ঘরে, তাই। দুখু হাজং শুনতে চাইছিল তার পক্ষে কোনো কথা হয় কি না। তার উপায় নেই বকেয়া শোধের। এ বছর যে ধান হয়েছে তাও সে সরিয়ে ফেলেছে পাহাড়ের ধারে, বনের আড়ালে খামার করে। বাড়ির উঠনে ধান ফেললেই রাজার লোক এসে সব তুলে নিয়ে যাবে। সেই লোক হয় গোমস্তা না হয় তসিলদার, সঙ্গে পুলিস, তার সঙ্গে বন্দুক । ললিত হাজং বলছে তখন, হাতিখেদা কি বন্ধ হইসিলা রাজার গুমস্তার দয়ায়, আমিন , গুমস্তার দয়া হলো তাই হাতিখেদা বন্ধ হলো ?
মাধো হাজং বলে, তা কেন হবে, তখন লড়াই হইসিল খুব, কতদিন রাত পাহাড়ে বনের ভিতর লুকাইসি, হায়!
সেই লড়াই আর বনের ভিতর আত্মগোপনের কথা পান্ডুলিপিতে সংযোজন করবেন অতীন, সেই কারণেই তো রয়ে যাওয়া এখানে এই কুয়াশাচ্ছন্ন গারো পাহাড়ের দেশে।
মণি সিং বলে, করিম শাহর নাম শুনেস কাকা ?
শুনিসি, নাকি সে পাগল ফকির ছিল ? বলল আরো বুড়ো একজন।
মাধো হাজং বলল, শেরপুরের করিম শাহ তো, ভগবান ছিল তিনি, ময় শুনিসি বাপের নিকট তার কথা।
মণি সিং বলে, তার কথা যদি শুনতে, তাইলে টঙ্ক নিয়া ভাবতে না কাকা।
ললিত হাজং বলে, পাগলপন্থী আন্দোলন কুম্পানির হাত থেকে শেরপুর নিয়ে স্বাধীন করে দিয়াসিল, জানো কাকা ?
মাধো হাজং বলে, শুনিসি, জানিনি কিসুই।
যদি শোনো, তাইলে বুঝবা চাষারাও পারে, পেরেসিল। ললিত হাজং বলে।
পান্ডুলিপির কথা শুনতে শুনতে বিপুল বলে, আমি তো পাগলপন্থী আন্দোলনের কথা জানি না মশায়।
অতীন বললেন, আপনার বাপ-ঠাকুরদা কি জানতেন না ?
বিপুল বলে, তাঁরা তো টঙ্কের কথাও বলেননি।
অতীন বললেন, আমার পান্ডুলিপিতে সব আছে, সবই জেনে যাবেন আফনে।
পাগল ফকির করিম শাহ কেডা ছিল কহ দেখি।
মণি সিং বলল, বলসি, বলা দরকার, না বললি বুঝবা না চাষায় কতটা পারে, কিন্তু সবারে ডাকো, তুমু একা শুনলি কী হবে, তুমু বুড়া হইসো কাকা, জুয়ানরা শুনুক, তাদের ভয় যাবে, বুঝবা মানুষ কতটা পারে…মানুষ বিপ্লব করিসিল রুশ দেশেরও আগে, ডাকো সবারে, করিম শাহর কথা আর চাষাদের বিপ্লবের কথা কহি।
সকলে অপেক্ষা করতে থাকে সকলের জন্য। জুয়ানরা আসে এক এক করে। মাথায় ক্ষীণ চাঁদ। অগণন নক্ষত্র। সকলে গোল হয়ে বসে। রাজার বেটা মণি সিং রাজার হেরে যাওয়ার কথা বলতে বসেছে। সে প্রায় একশো বছর বেশি আগের কথা। পৃথিবীর কোথাও হয়নি বিপ্লব। হয়েছিল শেরপুরে। আমাদের মৈমনসিঙের শেরপুরে। মণি সিং ও ললিত হাজং বলতে থাকেন যেন পূর্ব জন্মের কথা। পূর্ব জন্মের কথা না জানলে বিপ্লব হয় ?