দীপঙ্কর পাড়ুই

মুখোমুখি : সরাশিল্পী সুকুমার পাল

সরা মানে আমরা সাধারণত জানি মাটির তৈরি এক ধরনের পাত্র বা ঢাকনা। সরার উপরিতলে যে ছবি আঁকা হয় তাকে বলে সরাচিত্র। সরাচিত্র রীতিগত ভাবে লোকশিল্পের অন্তর্গত ।
লোক থেকেই উদ্ভুত শিল্পকেই আমরা সাধারণত লোকশিল্প বলি। লোক শিল্প এককভাবে গড়ে ওঠে না। গোষ্ঠীজীবন থেকে উঠে আসে লোকশিল্প।লোকসংস্কৃতিবিদ সুধীর চক্রবর্তী বলেছেন―”লোকশিল্পের মূল ভিত্তি হচ্ছে আত্মপ্রত‍্যয়, জন্মার্জিত সংস্কার, দীর্ঘদিনের ঐতিহ‍্যবাহিত শিল্পবোধ–এগুলো তারা পেয়ে গেছে।” লোকশিল্পের সঠিক সংজ্ঞা এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে এখনও সচেতনভাবে এ নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু একথা ঠিক যে লোকশিল্প সাধারণ লোকের জন‍্য সাধারণ লোকের সৃষ্টি। এর মধ‍্যে মিশে থাকে সমাজের নানা বিষয়। জীবনের প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ। মানুষের  উদ্ভাবনী ক্ষমতার মধ‍্য দিয়ে এই শিল্প গড়ে ওঠে। সেখানে অন‍্য শিল্পের সাথে লোকশিল্পের কোনো তফাৎ নেই। লোকশিল্পের কোন আন্তর্জাতিক স্টাইল নেই। এর মধ‍্যে রয়েছে এক অভূতপূর্ব সারল‍্য। সরাকে সমস্ত জায়গায় লক্ষ্মী বলা হয়ে থাকে। সরার উৎপত্তি মূলত বাংলাদেশের ঢাকা  , ফরিদপুর, বরিশাল জেলায়। সরা তৈরি করেন কুম্ভকার ,পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা । বাংলাদেশের যশোর জেলার কুম্ভকাররা নানা আকৃতির সরা বানান । সরা খুব উল্লেখযোগ‍্য স্থান দখল করেছে বাঙালির মনে। আবার চিত্রকর হিসাবে বরিশালের খলিশাকোটা অঞ্চলের নাম রয়েছে। ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরার বিশ্বে স্থান করে নিয়েছে রঙের বিন‍্যাস ও সরু রেখার জন‍্য। দেশভাগের পর কিছু সরাশিল্পী পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন এবং বিভিন্ন জায়গায় তারা ছড়িয়ে পড়েন। এরকম জায়গাগুলি হল  নদিয়া জেলার তাহেরপুর, পানিহাটি, সোদপুর, দত্তপুকুর ইত‍্যাদি।


তাহেরপুরের সরা 

নদিয়া জেলার অন্তর্গত তাহেরপুর একটি গ্রাম। এখানে একদল সরাশিল্পীর বসবাস। প্রায় ১২–১৫ পরিবার মিলে এখানে তিন-চারটি প্রজন্ম ধরে সরাচিত্র আঁকেন। এখানকার সরায় যে দেব-দেবীর ছবি আঁকা হয় সেগুলি হল― দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিক, রাধা-কৃষ্ণ, কদমতলায় কৃষ্ণ-রাধা, লক্ষ্মী-নারায়ণ, লক্ষ্মী, লক্ষ্মী-জয়া-বিজয়া, তবে তাহেরপুরের সরায় মূলত সাধারণ ফরিদপুর ও ঢাকাই সরার একটি মিশ্রিত শৈলীর বিকাশ বা মেলবন্ধন আমরা দেখতে পাই। শৈলীগতভাবে এদের সাদৃশ‍্য রয়েছে। বিষয়গত ভাবে সাদৃশ‍্য ও বৈসাদৃশ‍্যও রয়েছে। যেমন বিষয়গতভাবে দেখলে  তাহেরপুরে ময়ুরপঙ্খীসরায় বসা লক্ষ্মীর ছবি আমরা দেখি না । সরার বিন‍্যাস (কম্পোজিশান) অনুযায়ী –  রঙ ও গঠনগতভাবেও আলাদা। যেমন, গঠন আকৃতি অনুযায়ী কিছু কিছু ঢাকাই সরায় ধার বরাবর মাটির উঁচু বেড় দেওয়া থাকে যেটা তাহেরপুরে নেই। কম্পোজিশান অনুযায়ী দুটো, তিনটে, চারটে তল বা ভাগ দেখা যায়। ভাগ গুলিতে নানা দেবতা মানুষ অবস্থান করে। তাহেরপুরে দুটি তল বা ভাগ দেখা যায়। তাহেরপুরের সরায় রঙের উজ্জ্বলতা আমাদের মুগ্ধ করে আবার অন‍্যদিকে নকশা বা ডিজাইনে ফরিদপুর বা সুরেশ্বরী সরা একটি উল্লখযোগ‍্য নাম।

 অনেকদিন ধ‍রে পিন্টুদা(শিবশঙ্কর দাস) বলছিল চলো সময় করে তাহেরপুর। সরাশিল্প নিয়ে কিছু একটা করি । সময় হলো একদিন। দুজনায় পৌঁছে গেলাম। শান্ত দুপুর।  সরাগ্রামে ছুঁয়ে-ছেনে দেখলাম সরার আঁতুড়ঘর, নানা শিল্পীদের আত্মভূমি। প্রতিটা বাড়ির উঠোনে মেলা রয়েছে সরা , পুরো পরিবার কী এক নেশার ঘোরে কাজ করে চলেছেন, কেউ রঙ গুলছেন, কেউ রঙ করছেন সরায়, কেউ এঁকে চলেছেন একের পর এক সরা। অদ্ভুত আমাদের যৌথতার সংস্কৃতি। এই পর্বে রইল সরাশিল্পী সুকুমার পালের আত্মভূমির কথা )

■ আপনার নাম ও বয়স?

সুকুমার পাল, বয়স-৬২।

■ কত বছর ধরে সরা করছেন?

এই তো ৪৫-৫০বছর হয়ে গেল।

■ কী কী ধরণের সরা আপনি করেন?

একপুতুল, তিনপুতুল, পাঁচপুতুল, রাধা-কৃষ্ণ ,দুর্গামুর্তি, পাঁচরকমের পাঁচটা কোয়ালিটির সরা হয়।

 

■ আমরা আর একটা শুনেছিলাম ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরা – তার সম্বন্ধে জানেন?

হ‍্যাঁ, সুরেশ্বরী এটাই সেটা (একটা সরার দিকে তাকিয়ে)। আগে ছিল পুরনোত্ব এখন নতুনত্ব, একই জিনিস পুরনোভাবে চলছে। হ‍্যাঁ, আর এখন নতুন ভাবে চলে। আধুনিক যত জিনিসটা সৌন্দর্য করবে তত দর্শকের চোখে লাগবে, মালটা বিক্রি হবে।

■ আপনার জন্ম কি এখানেই?

না না বাংলাদেশে। হ‍্যাঁ, বাংলাদেশের করিমপুরের অন্তর্গত মাদারিপুর থার্ডডিভিশনে। ১৯৫৮ সালে আমরা এখানে চলে আসি।

■ আচ্ছা আপনারা কি সবসময়ই সরা বানান ?

না না, ঐ সময়ই আঁকি বিক্রি হয়ে যায়। যেমন ধরুন সরস্বতী পুজা গেল, ঐ সময়। তারপর থেকে মাটি করি, সরা বানানো শুরু। তারপর বড় আকারের অর্ডার মানে দাদন পেলে তখন বেশি করে বানান হয় আর কী।

■ আচ্ছা আপনারা কি প্রথম থেকেই সরাশিল্পের কাজ করতেন?

সরা ছিল আমাদের বাংলাদেশের। আমার বাপ- ঠাকুরদা তারা ঐ কামালী …ধানচালের ব‍্যবসা করত। তারপরে ঐ কলস মানে ঐ রসের হাঁড়ি- ওগুলা বানাত, মিষ্টির হাঁড়ি নানা রকমের। যাকে বলে কুমোরের কাজ আর কী… ওগুলো বানানো হত, যখন ওদেশে অভাব অনটন লাগল, তখন এদেশে চলে আসল। আসার পরে বাবা জানত না, এখানে তারই আত্মীয় ছিল, তাদের কাছ বসে বসে শিখেছে, বাবার থেকে আমি শিখেছি।

■ আপনার ছেলেমেয়ে ক’জন?

আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে সুমন্ত পাল ও হেমন্ত পাল। মেয়ে শম্পা পাল।

■ আচ্ছা এই লাল রঙের সরা এটাকে গনকা সরা বলছে?

এটা রাজ পরিবারের সরা, তারাই এটার পুজো করে ,তুমি আমি করতে পারব না। এই রকম আর কী।

■ আচ্ছা রাজপরিবারের কি কোন দেবতা থাকত?

থাকত বলেই হয়তো এটা করেছে। হ‍্যাঁ, প্রধানত দুর্গা, রাজপরিবারের দেবতা মানেই দুর্গা। একটা সময় সরা দিয়ে পুজো করা হত। তখনকার দিনে ওটা প্রথা ছিল। এই যে গনকা সরাটা(একটা সরা হাতে নিয়) এটা ও সরা। এটা রঙের ডিফারেন্স। লাল রঙ হচ্ছে কারণ লাল রঙ এখানে একটা রাজকীয় ব‍্যাপার। লাল রঙটার উপরে আরও বিভিন্ন রঙ দিয়ে সাজালে রাজকীয় রাজকীয় একটা ভাব। প্রথমে হলুদ, কালো, নীল নানা রকম রঙ। ওই রঙটা দিয়ে করতে হয়…প্লেন ঠাকুর করতে গেলেই হলুদ রঙটা লাগবেই, এটাই…

■ আপনাদের এটা বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে… আগামীরা কিছু শিখছে না!

শিখার ব‍্যাপার আছে…যেরকম ওয়ান..তারপর টু তারপর থিরি তারপর ফোর…

■ সরা বানানোর পদ্ধতিটা একটু বলুন?

…চাকে হয় না। হাতে হয়। এক একটা ডাইস আছে, আগে গোল বলের মত আছে, মাটিটা এ রকম গোল করা থাকবে। ওর পরে …এ রকম গোল চাকের মত করে ঘোরাতে হবে। এই ফিনিশিংটা আসবে তারপর আবার ওটাকে রোদে দিতে হবে, রোদে দেওয়ার পরে ওটা একটু শক্ত হবে, শক্ত হলে আবার এটাকে সেই পিটিয়ে পিটিয়ে …পুরো অ্যাডজাস্ট করতে হবে। করার পরে, এটাকে টেনে মাজন দিতে হবে। মাজন দেওয়ার পরে এটা ফিনিশিং হবে।মাটি অবস্তায় রোদে শুকিয়ে পুড়িয়ে নিলাম।

■ এ ক্ষেত্রে আপনি কি মাটি ব‍্যবহার করছেন?

এঁটেল মাটি।

■ এটা কি আপনাদের আলাদাভাবে মাটিটা কিনতে হয়?

এটা মাটি কিনে আনতে হয়। আলাদাভাবে কিনে আনতে হয়। ট্রাক্টর হিসাবে দাম। একটা ট্রাক্টর ১২–১৪ শ টাকা মত। মাঠের থেকে আসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে …আড়ংঘাটা, আমাদের এই চাষি কলোনি থেকে আসে।

■ আচ্ছা এবার রঙের ব‍্যাপারটা একটু বলুন বা কীভাবে রঙ বানাছেন?

রোদে শুকিয়ে পুড়িয়ে নেবার পর পুড়িয়ে নেবার পরে …এই যে পোড়া হয়ে গেল …এর পরে এটা খড়ি মাটি এইটা বীরভূম জেলায় হয় …এই খড়ি মাটিটা কিনে আনাতে হয়। কিনে আনার পর একে ভিজাতে হয়, ভিজিয়ে একে চটকিয়ে এক্কেবারে তালের মত করতে হয়। গায়ে দিলে এরকম সাদা হয় (সরার দিকে তাকিয়ে)। তারপরে শুকোতে হবে। শুকানোর পর ডলতে হবে মানে মাজতে হবে…ওই কাতা দিয়ে (কাতার দড়ি)ঝাড়ালো জিনিস দিয়ে এটা সাদা খড়ি করার পর করতে হয়। তারপরে রঙ গুলতে হবে।
(একটা সরার দিকে তাকিয়ে) এই কালো দাগটা আসবে …এটা আসবে …এটা আসবে(মানে রঙ) তারপরে এটা আসবে…এরপরে কালো দিয়ে লাইন তারপরে সাদা আসবে তারপর নকশা বা ফুল হবে…যাকে বলে লাল কাজ। লাল দিয়ে দিয়ে বর্ডারগুলো করতে হবে। কালো কাজ প্রথমে (বর্হিবন্ধনী)তারপর নীল কাজ, তারপর হলুদ রেখাটা হবে(মানে হলুদ রঙ) । এরপর আছে লাল তারপরে ফুল হবে …কমপ্লিট হয়ে গেল।
প্রথমে হলুদ, নীল দিয়ে বডিগুলো করছি। পরে হাত পা হলুদ দিয়ে করছি, তারপরে রেখা দিয়ে দিতে হবে। (একটা সরা হাতে নিয়ে) এই যে যেরকম হয়ে গেছে এটা এই যে …

■ আপনারা কী তুলি ব‍্যবহার করেছেন?

নিজেরা বানাই। আবার এই কেন …একটা ব্রাশ কিনতে হয় এই …তুলিটা কিনেছি এটিকে আমরা ভাঙব ভেঙে সেই মাপের প্রথম লাগবে, সরু করতে হবে…মোটা ক‍রতে হবে। এরপর সাদা কাজ করতে হবে।

■ রঙ বানাচ্ছেন কীভাবে একটু বলুন?

যে কোন রঙই হোক তার সাথে গঁদের আঠা। তেঁতুল এটার সাথে এই সাদা। কেমিক‍্যাল কোন রঙ আমরা ব‍্যবহার করি না। হয় না। কেমিক‍্যাল ঐ রঙ আনছিলাম …থিনারের কাজ সবাই বলে যে কেমিক‍্যাল রঙ দিয়ে করলে উজ্জ্বল হবে, ভালো হবে, এখন দেখি যে আমার ল‍্যাম্পোর কালিই ভালো। ল‍্যাম্পোটা ধরিয়ে তারপরে একটা সরা উপরে উলটো করে ধরে কালি দিতে হবে….

■আচ্ছা এই সরা বিক্রি করেন কীভাবে ও কোথায়?

বিক্রি মানে…বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে …মানে কেউ কেউ অ্যাডভান্স করে যায় আর কী। ৯০%বিক্রি হয়ে আছে আর কী। মানে দাদনের মত
ধরো তুমি ২০০মাল নিলা, খুচরা ভাবে বলি আর কী , এবার তুমি একশ টাকা দিয়া গেলা, আবার তুমি পুজোর সময় দিয়া দেবে, এই আর কী।

■ আপনি কোন সন্মাননা পেয়েছেন?

না আসলে আমি ঐ জায়গায় যাইনি,সময় করা হয়নি। অনেকে আসে…অনেক জায়গায় এক্সিবিশান থাকে ।

■ কোন পুরস্কার, রাজ‍্য সরকারের তরফ থেকে সাহায‍্য বা ভাতা পেয়েছেন?

কই কিছুই না, চেনেই না জানেই না এটা কী জিনিস! আমাদের কোনো আইডি কার্ডও নেই। পঞ্চায়েত থেকে এসেছিল কার্ড করার জন‍্যে, হয়নি, গুরুত্বহীন…

■ আচ্ছা নতুন প্রজন্ম কি এর মধ‍্যে আসছে মানে কাজ শিখতে চাইছে?

না না। কুড়ে কাজ…কুইড়া কাজ …। বাজার ঘুরে পাঁচটাকা ইনকাম করবে, এখানে বসে একশ টাকা করবে না। পয়সাও কম…
ভীষণ ভীষণ আকারে কম…। আমাদের যা পরিশ্রম, এই বার যে পুজোটা যাবে, পুজোর পরে ১৫ দিন বিশ্রাম পাই… তাও পাই না… ১৫ দিন পর আবার শুরু। ধাপে ধাপে ব‍্যাপারটা …এই যে যা সময় দিচ্ছি একটা মাল চিত্রি করতে, মানে চোখ ফোটাতে, অন্তত পক্ষে ১৫ মিনিট লাগবে। সারাদিনে ৩০–৩৫ টা হবে। কালো রেখা দিয়ে ঘন্টায় চার-পাঁচটা হয় ।

■তাহলে কি সরা বানানো বন্ধ হয়ে যাবে?

একদমই, তারপর দেখা যাবে পুজো বলেই কিছু থাকবে না হয়তো…পুজো থাকবে, মাটির জিনিসের কোনো মুল‍্যই থাকবে না। মুর্তি হবে না তো, ঐ প্লাস্টিকের সাহায‍্যে হবে…ঐ প্লাস্টিক সার্জারি হয়ে যাবে হা হা হা হা হা …এখনি তো সব চায়না দখল করেছে…

সাক্ষাৎকার স্থান : পালপাড়া, তাহেরপুর, নদিয়া

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment