সুস্নাত চৌধুরী

মহাশূন্যের লিটল ম্যাগাজিন

২০০০ সালের মার্চ মাসেই ৫০০০ পয়েন্টের শিখর ছুঁয়ে ফেলেছিল ন্যাসড্যাক। পরের বছরই বিন লাদেনের ফুঁ স্তব্ধ করে দিয়েছিল মার্কিন মুলুক, শিউরে উঠেছিল বিশ্ব। আর, এর চার বছরের মধ্যে, মানে, দশকের প্রায় মাঝামাঝি, ২০০৫ সালে, পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি দেশের মধ্যে যে-খেলা চলত, সেই ক্রিকেটে, শুরু হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক ‘কু-কুড়ি’ পদ্ধতি। আপাত বিচ্ছিন্ন তিনটি ঘটনা এই ইঙ্গিতই করে যে পুঁজি, সন্ত্রাস, আর বিনোদন – এই তিন মশলায় মাখো-মাখো হয়ে কীভাবে একটা সময়ের ম্যারিনেশন সম্পন্ন হয়েছিল। গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পর পৃথিবীর প্রাণীদের সেই প্রথম কোনো সহস্রাব্দের সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করা। আর আশার বেলুন ওড়াতে ওড়াতে অচিরেই জেনে যাওয়া, তাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। নতুন মিলেনিয়ামে সূর্যটা একই আছে, বদলায়নি। Y2K আসলে একটা শর্ট ফিল্‌মের নাম।
শূন্য দশকে এসে আশা-র বিপরীতার্থক শব্দ আর নিরাশা রইল না; হয়ে গেল আশাহীনতা। এই নিরপেক্ষ নিস্পৃহার জন্ম শূন্য দশকে। গত শতকের নয়ের দশকে যে বিশ্বায়ন ও নয়া অর্থনীতির বীজ বপন, আর আজ যে কানে তার গুঁজে রেললাইন পেরোনো – এই দু-এর মাঝখানে শূন্য দশকের দোকানপাট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই দশকটিকেই মনে হয় আন্তর্জাতিকভাবে অদ্যাবধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গোটা পৃথিবীটাকে তোমার হাতের মুঠোর মধ্যে এনে তোমাকেও তোমার হাতের মুঠোর মধ্যে আটকে ফেলার নানা অসম্ভব তরিকা মানুষ আবিষ্কার করে ফেলতে থাকল মূলত এই সময়েই। ক্রমে তার মাথার পিছনে জ্যোতির মতো ফুটে উঠতে লাগল ওই নিরপেক্ষ নিস্পৃহার অন্ধকার ছায়া। আর জীবনের চারধারে তার ঘোরাফেরা হয়ে যেতে থাকল লুজ ইলেকট্রনের মতো।
সময়ের এই বারকোড কি ছাপা হয়েছিল শূন্য দশকের বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে? আজ পিছু ফিরে সেই প্রশ্ন করলে শুরুতে খানিক দোলাচল তৈরি হয়। অনেক পত্রিকা আর কর্মকাণ্ডের ছবিই ভেসে ওঠে, যার অর্ধেককে মনে পড়ে সম্ভাবনাময়ের অপঘাতের খতিয়ান হিসেবে, আর বাকি অর্ধেক সৃজনশীলতার অভ্যাস। দোলাচলের মধ্যেই নিজের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি সব তছনছ করে দেওয়া ভয়ংকর বেপরোয়া কিছু করতেই পারেনি শূন্য দশকের লিটল ম্যাগাজিন, যা সৃষ্টির সফল উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভরপুর? যা উত্তীর্ণ? ‘সফল’ কিংবা ‘উত্তীর্ণ’ শব্দগুলির সংজ্ঞার্থের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে যাব না, কিন্তু প্রথম উত্তর আসে আমার, না, পারেনি। এইখানে আমার দোলাচল হয়তো বাড়িয়ে দেবে ‘অ্যান্টি বায়োটিক’ কি ‘হুডিনির তাঁবু’। কিন্তু আরও ভেবে আমি বলব, শূন্য দশকের কোনো লিটল ম্যাগাজিনকেই দোলাচলের মধ্যে থাকা আমার মন বাংলা লিটল ম্যাগাজিন-ঐতিহ্যের চিহ্নিত বিস্ফোরণগুলির সমমানের ভাবতে পারছে না। অতীত নিদর্শনগুলিকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ধকসম্পন্ন তো নয়ই। কাউন্টার যদি করতেই হয়, আমি আমার সময়কেই করব। আমাকেই করব। গুণমানের বিচারে যাচ্ছি না, সামগ্রিক অভিঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ঈষৎ অগ্রজ ‘গান্ধার’ কি ‘বিজল্প’, ‘নাটমন্দির’ কি ‘দাহপত্র’-র সমগোত্রীয়ও শূন্য দশকের কোনো লিটল ম্যাগাজিনকে এখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছে না। ‘ভাইরাস’, ‘কৌরব’, ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’, ‘শত জলঝর্ণার ধ্বনি’ – এসব তো অনেক পরের কথা। কিন্তু এরপরও আমার দোলাচল অব্যাহত থেকে যায়।
ফের উত্তর আসে। এই যে ‘এক’ না থাকা, ‘অদ্বিতীয়’ খুঁজে না পাওয়া, এ-ই আসলে সময়ের বারকোড নয় কি? হ্যাঁ, যুগলক্ষণ। আর এইখানেই শূন্য দশকের পত্রপত্রিকার সাফল্য। যোগ্যতা থাক বা না-থাক, সে অমরত্বকে হেলায় অস্বীকার করেছে, কিন্তু সময়কে অস্বীকার করতে চায়নি এক মুহূর্তের জন্যও। গাছের পেড়ে ও তলার কুড়িয়ে প্রতিষ্ঠান এবং তার প্রায় সমার্থক প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা – দুই-ই অর্থহীন করে দিয়েছেন শূন্য দশকের কবিরা। প্রতিষ্ঠানকে সাফ করতে গিয়ে সিনিয়রদের একাংশের দ্বিচারিতা ধরা পড়ে গিয়েছিল অনেকদিন, শূন্য সে-কাজ সাফল্যের সঙ্গে সালটে নিয়েছে অল্প বয়সেই। মাপা মাত্রায় অন্ত্যমিলবিহীন কবিতা লিখে বা না লিখে। তবে কিনা, বাণিজ্যিক কাগজে লেখা বেরোলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে হয়, সেই পত্রিকা শেয়ার করতে বাধা দিলে তার বিজ্ঞাপন পোস্টিয়েই টিকে থাকার লড়াই চালাতে হয়, এই প্রবণতা বাংলা কবিতায় শূন্য দশক ও তার পরবর্তী সময়ের অবদান। শুধু কবিরাই নন, এ-সময়ের সম্পাদকরাও দৈনিকের দেড় লাইন রিভিউ সমান দক্ষতায় ফেসবুকে আছড়ে ফেলছেন সমানে। এমনকী পেইড বিজ্ঞাপনও! না, এ তাঁদের দোষ-গুণ কি না সেই বিচারে যাচ্ছিই না; আমি বলতে চাইছি, এ একেবারেই সময়ের অভ্যাস। আসলে সময়কে গায়ে লেপটে নিয়েই সে সময়ের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে। দাঁড়িয়েছে। কীভাবে? বলছি।

রৌদ্ৰছায়া ১৬, জানুয়ারি ২০১৩

ধরা যাক, নয়ের দশকের একদম শেষদিক নাগাদ পূর্ব মেদিনীপুর থেকে প্রকাশিত হতে থাকে অর্ণব পণ্ডা সম্পাদিত ‘রৌদ্রছায়া’। একে আমি শূন্যের পত্রিকাই বলব। তোমার পা কোথায় রয়েছে, বড়োকথা নয়। তোমার ভারকেন্দ্র কোথায়, তার উপরেই সূচিত হওয়া উচিত তোমার অবস্থান। এই ‘রৌদ্রছায়া’, আমার বিবেচনায় শূন্য দশকেরই একটি পত্রিকা, ২০১৩ সালে, তাদের ষোড়শ সংখ্যার পৃষ্ঠপ্রচ্ছদে ধাতব লাইনো হরফে লিখছে –

 হয়তো আর বেরুবে না রৌদ্রছায়া। এবং সম্ভবত লেটার প্রেস থেকে প্রকাশিত পৃথিবীর শেষ ছোটো পত্রিকাটি পাঠ করছেন আপনি। কেননা, যে লেটার প্রেস থেকে এটি প্রকাশ হতো, এই সংখ্যা প্রকাশের পরই সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। আর লেটার প্রেস ছাড়া রৌদ্রছায়া? এখনো ভেবে ওঠা যায়নি। প্রায় পনেরো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। তরুণরাই ছিল এই পত্রিকার প্রাণ। পোকা ও পাতার যে সম্পর্ক রৌদ্রছায়ার সঙ্গে তরুণ কবিদের ছিল সেই সম্পর্ক। আর ছিল বন্ধুত্বের অভিজ্ঞান। এইসব সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে গেল কি না বোঝা যাবে এবার। শাদা পাতাগুলি ধাতব আওয়াজ নিয়ে শেষবার ফুটে উঠছে বর্ণমালায়। মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে একা সম্পাদক; বাইরে পৌষ মাসের গ্রামীণ বিকেল – তাতে হেলানো রয়েছে তার সাইকেল। কয়েকটি পাখির কিচিরমিচির শুধু মিশে গেল শেষ মুদ্রণে... সত্যি, আর বেরুবে না রৌদ্রছায়া?

এ-ই শূন্য দশকের অন্তর্ঘাত। এ-ই তার সময়ের সদ্‌বিম্ব। হ্যাঁ, সে সফল। হয়তো এইরকমই তার নিরপেক্ষ নিস্পৃহা।

বৃষ্টিদিন, জানুয়ারি ২০০৫

অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বৃষ্টিদিন’ প্রকাশিত হত কলকাতা থেকেই। পরিচালক-দ্বয় নব্বইয়ের, কিন্তু এঁদের আশকারা অনেকখানি ছিল শূন্য দশকের কাছে! ২০০৮ সালের সংখ্যা শুরুতে তাঁরা লিখছেন যে মাপা মাত্রার কবিতাটি, তার শেষদিকটি এইরকম –

             সেই	হাবাগোবা লোকের মিছিলে
             তাই	আমরা এখন আরও বেশি
             আর	ধ্বংস নয়, সৃষ্টির কথা বলি
             আর	রক্ত নয়, বৃষ্টির কথা বলি

সময়ের শিরা ও ধমনিতেই যে সৃষ্টিশীলতা, তার অনুসন্ধান দেখতে পাওয়া যায় এখানে। ‘বুদ্ধিসুদ্ধি’-ওলা মানুষের উলটো দিকে দাঁড়ানো, আম জনতার সঙ্গে মিশে যাওয়া, নিজেকে এক থেকে অনেক করে তোলার রাজনীতি শুধু এই চারটি পঙ্‌ক্তিতে নয়, নানাভাবে ছড়িয়ে রয়েছে গোটা শূন্য দশকেই।
মুশকিল হল, ঢাকার অনিকেত শামীম সম্পাদিত ‘লোক’ কিংবা চট্টগ্রামের সাইদুল ইসলাম, নায়েম লিটু, অঞ্জন সরকার জিমি সম্পাদিত ‘চর্যাপদ’ – এসব পত্রিকার একাধিক সংখ্যা আমি তারিয়ে তারিয়ে পড়লেও আহমেদুর রসীদের ‘শুদ্ধস্বর’, ইকরাম মোহনের ‘রাশপ্রিন্ট’ বা শূন্য দশকেরই ‘চারবাক’, ‘শিরদাঁড়া’, ‘মুক্তগদ্য’, ‘জেব্রা’, ‘বিন্দু’ – বাংলাদেশের এমন ঢের পত্রিকা আমি এখনও চাক্ষুষ করার সুযোগ পাইনি। তবে আমার সৌভাগ্য, আমি ‘বৃষ্টিদিন’ (‘বৃষ্টিদিন’-এর ভারকেন্দ্র শূন্য দশকেই, আমার বিবেচনায়) হোক বা পুরুলিয়ার ‘অরন্ধন’, হাওড়ার ‘লালন’, ‘দুয়েন্দে’, বর্ধমানের ‘বিন্দুবিসর্গ’, হুগলির ‘অ্যাশট্রে’ পড়ার সুযোগ পেয়েছি ধারাবাহিকভাবে। সুযোগ পেয়েছি ‘যৌথখামার’, ‘হিল্লোল’, ‘প্রতিষেধক’, ‘যাপনচিত্র’, ‘মেঘজন্ম’ বা ‘উত্তরকাল’ হাতে তুলে নেওয়ার। উত্তর ২৪ পরগনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘শূন্য দশক’ পত্রিকা, ২০১১ সালে ‘বৈখরী ভাষ্য’ প্রকাশ করেছে ‘শূন্য দশক’ সংকলন। এসব অসামান্য পত্রিকা, সংকলনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা সময়ের সঙ্গে আমি নিজেকে জুড়ে নিতে চেয়েছি অক্ষম পাঠক হিসেবে। ক্রেতা হিসেবে।

হিল্লোল, ফেব্রুয়ারি ২০০৫
অরন্ধন, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংকলন, আগস্ট ২০০৪
লালন, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, শ্রাবণ ১৪০৭
বৈখরী ভাষ্য, ২০১১

 

শূন্য দশকের শেষভাগ আবিশ্ব টলিয়ে দিয়েছিল রিসেশন। আর পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এই সময়েই

মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন। একদিকে মিলেনিয়ামের স্বপ্নভঙ্গ, আরেক দিকে নতুন স্বপ্ন দেখার প্রবল প্রয়াস। এই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের লিটল ম্যাগাজিনের এমন কোনো কাজ কি ছিল, যা হাতে নিয়ে রক্ত ফুটতে থাকবে কোনো ইশকুল-পালানো কিশোরের? কিংবা একইসঙ্গে, যা পঞ্চাশ বছর পরও মানুষ লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজবে? এইখানে তর্ক আসবে। কেউ নিশ্চয় কোনো উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, শূন্য দশকে তর্কাতীতভাবে ‘উল্লেখযোগ্য’ কোনো কাজ নেই। আর এটাই তার টিপছাপ। শুনতে গমগম করবে, কিন্তু, আসলে, সে-ই সময়!
ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, বাংলা কবিতার দশকওয়াড়ি উত্থান-পতনের গ্রাফ নাকি সাইন (Sine) কার্ভের মতো। শুধু বিজ্ঞানেই নয়, সাহিত্যেও, এমনকী জীবনেও, সমীকরণ ও সূত্রের উপযোগিতা হল তা স্বল্প আয়াসে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। বিষয়ের গোড়ায় না পৌঁছে, আগা স্পর্শ না করেও, সেই বিষয়টি সম্বন্ধে একটা চলনসই ধারণা তৈরি করে ফেলা যায়। সূত্র ও সমীকরণ মুখস্ত করে পরীক্ষায় পাশ মার্ক তো বটেই, লেটার পর্যন্তও জোটে। যেকোনো দশক বিভাজনের মধ্যেও সমীকরণ ও সূত্র রচনার এই শর্টকাট মেথড কাজ করে বলে মনে হয়েছে। হয়তো এ-লেখার মধ্যেও সেরকমই ঘটছে। তা ঘটুক, হাজার শব্দ পেরিয়ে এসে আর কীই-বা করা যাবে! কিন্তু আমি মনে মনে দেখতে চাইছি শূন্য দশকের লিটল ম্যাগাজিনের লেখচিত্রটি। জানি, তা সরলরৈখিক। সময়, অর্থাৎ কিনা এক্স অক্ষের সমান্তরাল, তার একদিকে ঢেউ খেলানো নব্বই, আরেক দিকে ‘দশমিক’-‘গপ’-‘ভাগাড়’-‘আঙ্গিক’-এর প্রথম দশক। আমার প্রশ্ন এখন একটাই, শূন্যের এই সরলরেখাটি শূন্যের উপর দিয়ে গিয়েছে, না নীচ দিয়ে? এ-উত্তর পেতে আমাদের আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। সামনেই আরেকটা নতুন দশক। নতুন কবিতা। আর, একেবারে নতুন সব লিটল ম্যাগাজিন। ফেসবুক নিশ্চয় যথাসময়ে জানাবে।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment