হিন্দোল ভট্টাচার্য

বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ৬

লেখা ও লেখক

আসলে আমরা সারাজীবন ধরেই হয়ত এক একটা দিবাস্বপ্নের মধ্যে কাটাই। নিজেদের মনের মধ্যেই স্বীকার করতে পারি না বাস্তবতাকে। কারণ বাস্তবতার সংজ্ঞা বড়ই ক্ষণস্থায়ীত্বের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমরা কার্যকারণ সূত্রে না বাঁধলে অস্বস্তিতে পড়ে যাব নিজেরাই। ফলে একসাথে আমাদের মনে হয় অনেকগুলো জীবন চলতে থাকে। এই অনেক জীবনের মধ্যে আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলি। ওই যে স্বীকৃতির কথা, ভালোবাসার কথা, – এসব তো সামাজিক লেবেল। যতই আপনি মহান কবি হোন না কেন, এই সামাজিক লেবেলের ভূত আর তার সঙ্গে ক্ষমতার কৌশলের ক্লেদ আপনাকে তাড়া করবেই। এগুলি মনকে আরও তিক্ত, আরও ঘৃণ্য করে দেয়। শুরু যখন করেছিলেন লেখালেখি, তখন যে মনটা ছিল, তার সঙ্গে আর সম্পর্ক খুঁজে পান না কিছুর। এর ফলে যা আপনাকে দিতে পারত চরম জীবনীশক্তি, তা আপনার আয়ু কেড়ে নেয়। আপনি তখন জোর করে দর্শনকে বাস্তবতার সঙ্গে যোগ করার কথা ভাবতে শুরু করেন। নিজেকে মহান কবি বা লেখক ভেবে, ভাবতে শুরু করেন সেই সব কবি সাহিত্যিকদের কথা, যাঁরা মৃত্যুর পরে খ্যাতি পেয়েছেন। এসব নিয়েই ভাবেন। এসব ভাবতে ভাবতেই জীবন যায় ব্যাঙ্কে কাজ করা এক চাকুরের মতোই। অথচ আপনি নিজে সেই সব ব্যাঙ্কে কাজ করা চাকুরেদের চেয়ে উন্নত জীবনের অধিকারী হিসেবেই নিজেকে ভাবেন। ভাবেন আপনি রাজনৈতিক নেতা নন, আপনি অফিসের কেরানি নন, আপনি কবি, আপনি লেখক, আপনি সাহিত্যিক। কোনও কর্পোরেট সংস্কৃতি নির্মাণ করতে আপনি আসেন নি। এসবের মধ্যে হারিয়ে যায় অপ্রত্যাশিত। আপনি বুঝতে পারেন, অপ্রত্যাশিত আপনার লেখায় আর আসছে না, আপনি আর নিজেকে সমর্পণ করতে পারছেন না আবহমানকালীন লেখার কাছে। আপনি লিখতে জানেন, সেই কারণে তখন আপনি লেখক শুধু। আপনাকে সামাজিক ভাবে লেখক হিসেবে মান্য করা হয়, সেকারণে আপনি লেখক তখন। এ কারণে নয়, যে আপনি লেখার জন্য সমর্পণ করে আছেন। হয় আপনি ভাবেন এটা আমার প্রাপ্য, তবু পেলাম না, নয় আপনি ভাবেন এটা আমার প্রাপ্য নয়, তাই পেলাম না। অথচ আপনি এই সব নিয়েই ভাবেন। আর আপনি তখন লেখার আধার হন না, লেখা তখন আপনার সামাজিক পরিচয়ের আধার হয়ে যায়। ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। কারণ আপনি যা লিখবেন এর পর, তা অভ্যেস। সেই লেখায় অপ্রত্যাশিত নয় কিছুই। অপ্রত্যাশিত অনুপস্থিত। তাকে আর লিখতেই পারবেন না। কারণ সে ২+২=৫, ২+২=৪ নয়।

একটি গল্প মনে পড়ে এই সূত্রে। এক রাজার ছেলে জেন সাধনায় আকৃষ্ট হয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য এলো এক জেন সন্ন্যাসীর কাছে। সন্ন্যাসী তাকে বললেন- ভেবে দেখো, এ সাধনায় অনেককিছু ত্যাগ করতে হয়। তো, সেই ছেলে তো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নিজের বুদ্ধিবলে সে অনেককিছুই শিখে ফেলল। কিন্তু জেনপ্রাপ্তি তার হয়না কিছুতেই। সন্ন্যাসীর অন্যান্য শিষ্যদের মধ্যে সে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে উন্নতমনের মানুষ। বন্ধুদের মধ্যে প্রায় এক নেতাও বটে। নম্র, বিনয়ী, আবার প্রয়োজনে গর্জেও ওঠে। বছরের পর বছর যায়। সন্ন্যাসীর কাছে এবার সে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি কি জেন পাব না? সন্ন্যাসী শুধু বলেন- যোগ্য হয়ে ওঠ। আবার বছরের পর বছর যায়। সেই সন্ন্যাসীও মারা যান। বয়স বাড়ে রাজার ছেলের। মন আরও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সারাজীবন সে সাধনা করল, তবু জেন সে পেল না। একদিন নদীর ধারে সে চুপ করে বসে আছে। দেখল কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে একদল অশ্বারোহী যাচ্ছে একদিক থেকে আরেকদিকে। তারই রাজ্যের সেনাবাহিনী। কিন্তু তারা কেউ তাকে চিনতে পারল না। সে আরও মনখারাপ করে বসে আছে, এমন সময় সেনাপতি ছুটে এলেন। ‘আপনি এখানে এমনভাবে?
– তাতে কী! আপনারা তো কেউই চিনতে পারলেন না।
– এতে আর আমাদের দোষ কী?
– মানে, আমি আপনাদের রাজা, আমাকে চিনবেন না?
– আপনি থাকবেন সন্ন্যাসীর মতো, কাজ করবেন সন্ন্যাসীর মতো, আর আশা করবেন, আপনাকে লোকে জানবে রাজার মতো? তাও কি হয়?
মুহূর্তে যেন সবকিছু উজ্জ্বল হয়ে উঠল সন্ন্যাসীর কাছে। তাই তো! এ কী আশা আমার মনে? আমি তো যাপন করছি অন্য জীবন। আমার তো উদ্দেশ্য অন্য জীবন। অথচ মনে বাসনা রাজার মতো স্বীকৃতির!
আর কাউকে কিছু না বলে তিনি বেরিয়ে পড়লেন সব কিছু ছেড়ে। কারণ জানেন, এইবার শুরু হল তাঁর আসল শিক্ষার্থীর জীবন।
ভাবতাম, কেন আমি বুঝতে পারছি না সেই মৌন সন্ন্যাসীকে, যিনি শুধু জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। কেন বুঝতে পারছি না ইউরোপ ফেরত সেই ডাক্তার সন্ন্যাসীকে, এলোমেলো ভবঘুরে সেই বিদেশিকে, ছোট্ট পাহাড়ী শহরে বসে থাকা সেই ইঞ্জিনিয়ারকে, আপন মনে কবিতা লিখে যাওয়া পুরীর সেই কবিকে, কেন বুঝতে পারছি না, অগণিত সেই সব মানুষকে, যাঁদের আসলে কোনও পরিচয় নেই। যাঁরা সুদূরের দিকে চেয়ে বসে আছেন। পরে বুঝেছি, তাঁদের বোঝার যোগ্যতাই আমার মধ্যে তৈরি হয়নি। একটি সামান্য দৃশ্য- খরস্রোতা নদীর উপর ঝুঁকে থাকা বাঁশের সাঁকোর অভিমান ( ধন্যবাদ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত), সে যে কত অর্থ বহন করে থাকে নীরবে, তা আমার শব্দে ভারাক্রান্ত অন্তরে এসে টোকা দেয় না। বা, টোকা দিলেও, ঢুকতে পারে না। পাহাড়ের চূড়া জয় করতে গিয়ে যাঁরা বরফে হারিয়ে যান, হয়ত তাঁদের দেহ অবিকৃত থাকে বরফে, কিন্তু প্রাণ কি থাকে? স্বপ্ন কি থাকে? জার্নি কি থাকে? বরফ থেকে সরিয়ে নিলেও পচা গন্ধ টের পাওয়া যায়। এই অন্ধকারও সত্য। আবার কিছুই না করতে চাওয়া, বারবার হিমালয়ে ঘুরে বেড়ানো উদাসীনতাও সত্য। আমি তাকে না দেখতে পাই, সে তো আমায় দেখছে। এই ভক্তিযোগ যদি লেখার সঙ্গে লেখকের তৈরি হয়, তবে সেই লেখক যে ধীরে ধীরে সামাজিক ভাবে বিস্মৃত হতেও পারেন, এ কথা তো সত্য। কিন্তু যে বিপন্ন বিস্ময়গুলি এসে তাঁর জীবনে এনে দিচ্ছে কিছু অপ্রত্যাশিতকে, এও তো সত্য। এই দুই সত্যকেই স্বীকার করতে হবে। কারণ সত্য আসলে বহুমাত্রিক। আর সত্য নিজেও খুব অনিশ্চিত। এই যে এত কথা বলে যাচ্ছি, হয়ত এই সব কথা লিখে যাওয়ার বা বলে যাওয়ার কোনও মানে আছে বলেই লিখছি, অথচ এই সব লেখাই আগে হয়ে গেছে। আমার অভিজ্ঞতাগুলি বলা আগে হয়নি। মনে পড়ছে সেই লোকটির কথা, যার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অরুণাচল যাওয়ার সময়ে,বাসে। তিনি বলেছিলেন এ নিয়ে সাতবার তিনি এসেছেন এখানে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন? তিনি বলেছিলেন- প্রতিটি চেনা দৃশ্যই আসলে নতুন নতুন করে জন্ম নেয়, যখন দেখি। কারণ প্রকৃতি কোনও ফটোগ্রাফ নয়, প্রকৃতি একটি জীবন্ত ক্যানভাস। প্রকৃতির মন আছে, প্রকৃতি নিজেও তাকিয়ে থাকে। যখন আমি যাই, প্রকৃতি আমাকে নিয়েই সম্পূর্ণ হয়। যখন আপনি যান, প্রকৃতি আপনাকে নিয়েও সম্পূর্ণ হয়। আপনি আর প্রকৃতি একরকম, প্রকৃতি আর আমি আরেকরকম। আপনি দেখেন আমার সঙ্গে প্রকৃতিকে, আমি দেখি আপনার সঙ্গে প্রকৃতিকে। সব প্রকৃতি আলাদা, সব দৃশ্য আলাদা, সব দৃশ্যের মন আলাদা।

 

আধার ও আধেয়

মনে পড়ে এমন ব্যক্তির কথাও, যিনি পঞ্চাশবার কেদারনাথে গেছেন। আমার প্রথমে মনে হত কেন গেছেন? তার পর এখন আর এসব মনে হয় না। কারণ জানি, আমাদের সব চেনা অনুভূতিগুলি, দৃশ্যগুলি আসলে ভীষণই আলাদা। আপাত ভাবে সেগুলিকে আমাদের চেনা মনে হলেও, আসলে সেগুলি অচেনা, অনাবিষ্কৃত। অপ্রত্যাশিত-র সঙ্গে এই বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। চেনা খণ্ডের মধ্যেই অচেনা অখণ্ডকে চেনা, চিনতে পারা। তার জন্য অপেক্ষা করে থাকা। একজন মানুষ তো সেই কারণেই একটি লেখা নিয়ে পড়ে থাকে। একজন মানুষ এই কারণেই কারুবাসনায় নষ্ট হয়ে যায়। তার জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তবু তার এই আত্মধ্বংসী যাপনে না গিয়ে উপায় নেই। কারণ চেনার মধ্যে অচেনাকে খুঁজে চলার মধ্যে, অচেনার মধ্যে চেনাকে খুঁজে চলার মধ্যে হয়ত সেই বোধের জন্ম হয়, যা ধীরে ধীরে মানুষকে লীন করে দেয় তার ভাবনার মধ্যে, তার কারুবাসনার মধ্যে। যেমন এক পর্যটক পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের সঙ্গে লীন হয়ে যান। তখন তাঁকে আর দৃশ্যকে আলাদা ভাবে চেনা যায় না। মনে হয় যিনি দ্রষ্টা, তিনিই দৃশ্যের এক অংশ। আবার যিনি দৃশ্য, তিনিও দেখছেন দ্রষ্টাকে। এই পারস্পরিক অন্তঃসলিল স্রোত চলতে থাকে আজীবন। কারণ সেটাই নিয়তি। শব্দের ভিতরে যেমন নীরবতার এক আলো ও আঁধার ঘেরা জগৎ থাকে, তেমন নীরবতার ভিতরেও থাকে শব্দের জগৎ। জগতের সঙ্গে জগতের এই পারস্পরিক সংযোগের আবিষ্কারই শিল্পের মূল লক্ষ্য বলে মনে হয়। পাহাড় তা নিজে থেকেই ভ্রমণকারীর কাছে নিয়ে আসে। একটি সংযোগ। বৃহতের মধ্যে ক্ষুদ্রের মিলেমিশে যাওয়ার আকুতি। যে কোনও বড় শিল্পের মধ্যে যেমন থাকে ধ্যান, তেমন-ই থাকে এই আকুতি। এক ধীর প্রশান্ত দুঃখের আকুতি। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ছোট দুঃখে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়, কিন্তু বড় দুঃখে এক প্রশান্তি আসে। এই দুঃখই কি মানুষকে অনেক বেশি উদাসীন করে তোলে? কিন্তু একজন কবি যেমন উদাসীন, তেমনই আসক্ত। তিনি তো সন্ন্যাসী হতে আসেননি। কিন্তু সন্ন্যাস তার বুকের ভিতরে গোপনে কাজ করে সারাজীবন। বাইরে সে গৃহী, তাকে কোনও ছাঁচে ফেলা যায় না। কিন্তু অন্তরে সে সন্ন্যাসী। তবে এসবই কথার কথা মনে হতে পারে। আমার নিজেরও হয়, যদিও আমিই এসব লিখছি। প্রবল বিশ্বাসী হয়ে থাকার শান্তি আমার এখনও এলো না জীবনে, যদিও হিমালয় আমাকে বারবার শিক্ষা দেয় এটিই, যে চিরসংশয়ী যে, সে-ই পায় এগিয়ে যাওয়ার বিশ্বাস। হিমালয় আমার কাছে একটি প্রতীক। দুর্গম, ধ্যানস্থ, গোপন, সুন্দর, রুদ্র, উদাসীন, সহিষ্ণু এবং সর্বোপরি অনিশ্চয়তার প্রতীক। কিন্তু এই সবকিছুই কি জীবনের উদ্দেশ্যেও বলা যায় না? অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো আমাদের জীবন চিরবহমান। কোনও বিশ্রাম নেই, মণীন্দ্র গুপ্তের ভাষায় ক্লাইম্যাক্স-ও নেই। অনেকটা এ লেখার মতো। যেকোনও সময় শুরু হতে পারে, আবার শেষ হয়েও যেতে পারে। সত্যিই তো, আমাদের তো কোথাও যেতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। তার জন্য তো আমরা বেড়াতে বেরোইনি। তুমি কি সত্যিই কেউ? আদৌ তুমিই কি লিখছ? আমিই কি লিখছি? না কি আমরা শুধুমাত্র সেই অন্ধের মতো, যিনি জানেন, তিনি না দেখতে পেলেও হিমালয় তাঁকে দেখছেন। প্রায় জেন গল্পের মতোই কালো মেঘের নীচে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক সাদা বক, এই দৃশ্যে সমাধিস্থ হলেন শ্রী রামকৃষ্ণদেব। কেন? সে কি সুন্দরের মধ্যে এক অনির্বচনীয়কে দেখে?
সত্যিই আমরা আর কিছুই নই, উপলক্ষ্য ছাড়া। প্রকৃতি কথা বলার জন্য আমাদের বেছে নিচ্ছেন কখনও, কখনও নীরব করে রাখছেন। প্রকাশিত হচ্ছেন তিনি। অপ্রকাশিত থাকছেন তিনি। অপ্রত্যাশিত হয়ে নিজেকে সুরে, শব্দে, রঙে, রেখায়, দেবতায়, প্রেমে ইঙ্গিতের মতো প্রকাশ করছেন। আর আমরা অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো, অসমাপ্ত বাক্যের মতো, চেষ্টা করে চলেছি, যাতে উপযুক্ত আধার হয়ে উঠতে পারি কখনও।
কিন্তু, আমি যেমন প্রকৃতির আধার, প্রকৃতিও কি আমার আধার নন?

( শেষ )

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment