হিন্দোল ভট্টাচার্য

বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ৫

সমর্পণ

নিজেকে কারো কাছে এবং কোনও কিছুর কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দেওয়া খুব কঠিন কাজ। সমর্পণ করে দিলেই তো আর হল না, মনে মনে বিশ্বাস রাখতে হবে, নিজেকে বারবার বলতে হবে, যে আমি সমর্পিত। কিন্তু এই সমর্পণের অর্থ কী? আত্মবিলুপ্তি? আত্মলীন হয়ে যাওয়া? কবিতা লেখার সময়ে তো ঠিক এই কাজটিই ঘটে। কারণ কবিতা তো নিজেকে লেখার জন্য কবির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। কবি কেবল একজন আধার মাত্র। আর কিছু নয়। যখন অপ্রত্যাশিত স্পর্শের মতো, কবিতা আসে সেই কবির কাছে, তখন সে আত্মসমর্পণ-ই করে। লেখা হয়ে যাওয়ার পরে হয়ত, তার ‘আমি’ সত্তা লাফ দিয়ে পড়ে ঘাড়ের উপর।

জীবনের রাস্তাঘাট সব সময় মসৃণ হয় না। এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কথা হচ্ছে সেই অমসৃণ রাস্তাঘাটে কার হাত ধরে আছ? যার হাত ধরে আছ, সে নিজে হোঁচট খেতেই পারে, কিন্তু সেটাও বড় কথা না, কারণ অমসৃণ রাস্তায় হোঁচট না খাওয়াটাই অস্বাভাবিকতা। তবু সে তোমার হাত ধরে আছে কিনা, আর হোঁচট খেয়ে নিজে পড়ে যাওয়ার সময়, তোমাকে বাঁচিয়ে সে পড়ে যাচ্ছে কিনা, সেটাই আসল। কিন্তু এত সব তো একজীবনে বোঝা যায় না। কারণ রাস্তা অমসৃণ হলে সাবধানতা আসে। তখন সেই সাবধানতাবশত দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারে। আর অমসৃণ রাস্তায় চলতে চলতে অমসৃণ রাস্তায় চলাটাই কখনো কখনো অভ্যেস হয়ে যায়। অভ্যেস বড় কঠিন ব্যাপার। এই অভ্যেস যা করে, তা হল প্রত্যেকের নিজের নিজের এক একটা ধর্ম তৈরি করে। আর ধর্ম তৈরি করলেই মানুষ সেই ধর্মের দাস হয়ে দাঁড়ায়। তখন প্রেম যায় হাওয়ায় মিলিয়ে। তখন প্রেমের ধর্ম পালন করে যেতে হয় শুধু। তাকে আর যাই বলা হোক প্রেম বলে না। বলে অভ্যাস। কিন্তু কথা হল প্রেম কী? প্রীতিই বা কী? আর কীই বা ভালোবাসা? সে কি গাছের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসা অকারণ হাওয়ার মত অচেনা কিছু? যা মাঝেমাঝে আসে, আর রহস্যময় কোনও কোনও কথা বলে হারিয়ে যায়? খুব সুখের মুহূর্তের মধ্যেও মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় এই যে অনুভূতি, তা যেন ক্ষণিকের না হয়। আর অল্প মুহূর্তের জন্য মনে হয়, যে বা যারা নিজেরাই ক্ষণিকের, তারা কীভাবেই বা চাইতে পারে সব কিছুই অনন্তকালীন হোক? আসলে তো কিছুই অনন্তকালীন হয় না। একটি মুহূর্তকে আমরা অনন্ত ভাবতে পারি। আর যদি সেই মুহূর্তের মধ্য দিয়ে অনন্তকে টের পাই সত্যি সত্যি, তাহলে তা-ই হয়ত প্রেম। ভালোবাসার জন্য কোনো একটি দিন কেন, কোনো একটি জীবনও হয়ত যথেষ্ট নয়। 

মাঝেমাঝে মনের মধ্যে এক অকারণ বাঘ ডেকে ওঠে। তোমার কথা ভাবলেই আমার পার্বতী নদীর কথা মনে পড়ে যায়। গিয়েছিলাম হিমাচলে, হিমালয়ে। মণিকরণে পার্বতী নদীর উপরে যে ব্রিজ, সেখানে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ ধরে দেখে যাওয়া যায় তাকে। হয়ত, মণিকরণে যখন সে আসে, তখন সে কিশোরী। অদ্ভুত তার সৌন্দর্য। সেই নদীর পাড়ে হিমালয়ের পাহাড়। যদি চাও, তো একটু একটু করে উষ্ণ প্রস্রবণগুলি ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে হেঁটে যেতে পার। আমি হেঁটে গিয়েছিলাম অনেকটাই। এটাই আমার হিমালয়ে কাজ। হেঁটে যাওয়া। তো, সেই হেঁটে যেতে যেতে আকাশ ছোঁয়া গাছের তলায় নদীর ধারে বসেছিলাম যখন, সামনে ছিল পার্বতী নদী আর ওপারে ক্রমশ উঁচু হয়ে যাওয়া বুগিয়াল। আমার লক্ষ্য ছিল মালানী গ্রাম। কিন্তু তার আগে আমি এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখে চুপ করে বসেছিলাম আর ভুলে গিয়েছিলাম কোথায় যাব বলে হাঁটতে বেরিয়েছি। দেখলাম একটা গোটা পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা রঙের ভেড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রায় কয়েকশো ভেড়া। আর পাহাড়ের এক জায়গায় হিমাচলী পোশাকের এক মেষপালক কী নিশ্চিন্ত মনে বাঁশি বাজাচ্ছে। কাকে যে শোনাচ্ছে কেউ জানে না। কিন্তু বাঁশি বাজাচ্ছে। আর সেই বাঁশির সুর ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে হিমালয়ের পাহাড়ে পাহাড়ে। প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরছে। সেই সুর কি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে? সেই সুর কি কোথাও যেতে চাইছে? আর তুমি কবিতাপাঠের কথা বলছ! আমাদের চেয়ে সেই মেষপালক অনেক বেশি কবি। তার সমাজ নেই, শ্রোতা নেই, আর বাঁশি বাজিয়ে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। সে একা বাঁশি বাজায়। আর আমরা বলি আমরা সামাজিক নই, মূর্খ ইত্যাদি, আর ভীষণ, ভীষণ ভাবে সামাজিক হয়ে থাকি। কখনো কখনো মনে হয় আমরা সাংসারিক লোকের থেকেও বেশি সাংসারিক। কিন্তু সত্যিকারের কবি, প্রেমিক আসলে সেই মেষপালকের মত সুন্দর, একাকী, নির্জন। হ্যাঁ আমি প্রেমের কথাও বললাম। হয়ত দুজন না হলে ভালোবাসা হয় না। কিন্তু ভেবে দেখো তো, ভালোবাসা কী দুজনে মিলে আদৌ যায়? না কী ভালোবাসার জন্যও নিজের নিভৃতি দরকার পড়ে? তুমিই তো আসলে ভালোবাসছ তাকে, আর তোমার এই ভালোবাসার জন্য যে তোমার আর তার একাকীত্ব-র দরকার, তোমার বা তার নিজেদের আবিষ্কার করার দরকার, তা কী আদৌ দ্বৈতসংগীত? না কী সব প্রেম আসলে একাকী সংগীত? ওই যে যুবকের সাথে তোমার দেখা হল, যার সাথে হয়ত আর কোনদিন দেখা হবে না, ওই যে অশ্বক্ষুরাকৃতি খাতের গঙ্গার কাছে দাঁড়িয়ে তুমি অস্তিত্বের মধ্যেই নিয়ে নিলে প্রবহমানতাকে, এই মুহূর্তটিও আর কোনদিন আসবে না জীবনে। 
জীবন এমনই অপ্রত্যাশিত আনন্দ বা দু:খ নিয়ে আসে। আর আমাদের মায়াবী সত্তা না পারে তাকে গ্রহণ করতে, না পারে তাকে ভুলে যেতে। উচিত কি জানো? এক উদাসীন চোখ তৈরি করা। শতোপন্থ তালের পথে বসে থাকা সেই তরুণ মৌনী সাধু, যিনি বলেছিলেন – আমি তো তাকিয়ে থাকি। এইই আমার কাজ। আর কিছু বলার নেই, বোঝার নেই, দেখা ছাড়া। 
তুমি ভাবছ এমনভাবে ভাবলে তো আর কোন কাজই হবে না। হবে না তো। কাজ কে করতে চায়! কাজ তো আপনা থেকে হবে। কবিতা লেখা ছাড়া বাকি সব কাজ তো আমার নয়। ওগুলিকে আমি জোর করে করছি। কারণটিকে আবিষ্কার করেছি যুক্তি দিয়ে, পারম্পর্য দিয়ে। যেমন রাষ্ট্রের কোন কারণ নেই, বিবাহের কোন কারণ নেই, নিয়মের কোন কারণ নেই, – আমরা তৈরি করেছি, অভ্যস্ত হয়েছি, নাহলে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এই যে ধর্ম নামক অদ্ভুত বিষয়। এ কী প্রাকৃতিক, বল তো! কে কৃষ্ণ, কে রাম, কেই বা আল্লা, – কেউ তো আসলে নেই। এই মহাশূন্যতা আছে। এই মহাশূন্যতাও আসলে নেই। স্থির আছে, থাকবে অনন্তকাল, এমন কিছুই নেই। সব পরিবর্তনশীল, মরণশীল, কারুর লাইফস্প্যান বড়, কারুর অতিক্ষুদ্র। একটি ঘাসফুল একদিনের জন্য ফোটে। আর নক্ষত্র কয়েকশো কোটি কোটি বছরের জন্য। তারপর সে মরে যায়, সুপারনোভা হয়, ব্ল্যাক হোল হয়ে যায়। ধর্ম বলতে কিছু ছন্দ, কিছু ধ্রুবক, কিছু সমীকরণ যা মহাজাগতিক। এই সব হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান– এসব আমাদের অসহায়তা আর আধিপত্যবাদ। তাই মানুষকে ধর্মের চোখে দেখা প্রাকৃতিক নয়। ওই চোখটাকে সরালেই মানুষ তার স্বাভাবিকতায় ঈশ্বরের মত সুন্দর রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
আসলে মানুষ যে ভীষণ প্রাকৃতিক। তা যে কেন আমরা ভুলে থাকি! আর কিছু কৃত্রিম ধর্ম নিয়ে বসে থাকি, যেগুলির আদৌ অস্তিত্বই নেই। 
ঘরের কথা বললে? আমি তো চিরকাল এমন একটা ঘর চেয়েছি, যার সামনে দিয়ে বয়ে গেছে শিপ্রা নদীর মত কুলুকুলু স্রোত। আমি এমন একটা নদীর সামনে যদি থাকতে পারতাম! বা ধরো, আমার বড় প্রিয় নদী অলকানন্দা। তার নীল স্রোতের পাশে যদি আমার একটা গুহা থাকত! তপোবনে থাকতেন বাঙালি এক বৃদ্ধ দম্পতি। বাঙালি বাবা আর বাঙালি মা। সংসারের সব দায় দায়িত্ব মিটিয়ে চলে এসেছিলেন শিবলিঙ্গের সামনে। এখানেই ছিলেন, এখানেই মারা গেছেন। দুজনেই। 
একটি সম্পর্ক, একটি ভালবাসার সম্পর্ক আসলে দুটি মানুষকে সহজ, মহৎ, উদার করে তোলে। আর তখন মানুষ নিজেদের খুঁজে পায়। নিজেকে খুঁজে পায় বলেই মানুষ তখন ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরে। এই আঁকড়ে ধরা অধিকার করা না। কিন্তু অধিকার করা হয়ে যায়, যত সমস্ত বিষয়ের মত সম্পর্কটিও একটি অভ্যসে পরিণত হয়।
কবিতায় হয়ত কোন কবি আর নতুন কিছু লিখছেন না। বারবার নিজেকেই রিপিট করে যাচ্ছেন। নতুন ফর্ম দূরের কথা, নতুন ভাবনাও নেই তাঁর। কিন্তু তিনি মৃত্যুভয়ে ভীত বলেই আঁকড়ে ধরেছেন শেষ সম্বল- নিজের আইডেন্টিটি। তখন আর তিনি প্রেমে পড়েন না। ভালবাসার ঝড়ে আকুলিবিকুলি করেন না। হাবুডুবু খান না স্রোতে। তিনি অভ্যাসের মত লিখে চলেন। নিজেকে বানিয়ে চলেন বারবার। এক বৃত্তের মধ্যে ক্রমাগত, ক্রমাগত এবং ক্রমাগত। 
এও কি মৃত্যু নয়? মৃত্যু, কারণ এ হল অভ্যেসে লেখা। সম্পর্ক, কবিতা, ভালোবাসার মৃত্যুও হয়, যখন তা অভ্যেসে বাঁচতে শেখায়। নিজেদেরকেই নতুন করে খুঁজে পাওয়ার মত সহজ মহৎ উদার আর অনন্ত করে তোলে না। তখন সাঁতরানো যায় না নিজস্ব প্রবহমান নদীতে।  তখন নদীতেও চড়া পড়ে। জল ঘোলা হয়ে যায়। মূল নদীর থেকে আলাদা এক হ্রদের নদীর মত।  আসলে কী জানো তো, কবিতা হোক, বা ভালোবাসা, মরণশীলতার ভয়ে মানুষ অস্থির হয়ে যায়। আর সে যখন বুঝতেই পারে, তার কিছুই নাও থাকতে পারে, যখন বুঝতে পারে, সে কেবল অসীম এক স্রোতের কোন এক বিন্দু মাত্র, তখন সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। জলে পাথর ছোঁড়ে। শান্ত পায়রাদের মধ্যে ঢিল ছোঁড়ে। কিছু না কিছু ঘটনা ঘটিয়ে যায়। কবিতা যে এক চরম অসামাজিকতার সাধনা, তা সে বিস্মৃত হয়।  তখন তারা আধিপত্য করতে চায়। অধিকার করতে চায়। অধিকৃত হতে নয়।  ভালবাসার মৃত্যু ঘটে তখন।  বেঁচে থাকে শরীর আর ইন্দ্রিয়। ভূতের মত। আত্মার মত নয়।  

সমর্পণ সম্পর্কে কথা বলতে বসলেই মনে হয় বিচ্ছেদের কথা। প্রতিটি বিচ্ছেদ আসলে এক অনন্তকালীন সংযুক্তি। তা না হলেই তো পরিবর্তন আসে। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্ত আমরা এই মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যাই। সে ভাবে ভাবলে, আমরা সকলেই এক একটা নদীর মত। প্রবহমান। পরিবর্তনশীল। নশ্বর ভাবে অবিনশ্বর। কেন নশ্বর আর কেনই বা অবিনশ্বর? জানো, আমাদের যে ভালবাসা তা তো ক্রমেই নশ্বর থেকে অবিনশ্বরতার দিকে যাচ্ছে। যেন বা মহাকাশ। সে জানে যে সে একটা সময় আবার বিন্দু হয়ে যাবে। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছোটবেলায় ভাবতাম, এইই কি আমি? না কি আমি এক অন্য কেউ, যাকে দেখা যাচ্ছে না। এই ভাবে আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আমরা পেয়ে যাই সেই ইপ্সিত চোখ, যার চোখে আমরা খুঁজে পাই, আমাদের। তখন মনে হয় না, এই কি আমি! বরং তখন মনে হয়, ওই চোখের মধ্যে যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মধ্যে আমি, আর সেই আমিই আমার দিকে তাকিয়ে আছি অনন্তকাল। আর এভাবে, একে অপরের চোখের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পেতে পেতে আমরা অতিক্রম করছি কয়েকশো কয়েকহাজার কিলোমিটার, আলোকবর্ষ, ইতিহাস, মহাকাশ এমনকী মৃত্যুকেও। কিন্তু আদৌ কি পাচ্ছি আমরা নিজেদের? সব কিছুই তো চূড়ান্ত ভাবে এক বিচ্ছেদের দিকে, এক মিলনের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এই যে বিরহের মত নদী, অসংখ্য নদী, একটি নদীর ভিতর, তারা সকলে ঝাঁপ দিচ্ছে এক বা অসংখ্য মোহানায়। এই যাত্রাপথের সাথে তার বা তাদের হচ্ছে চিরকালের বিচ্ছেদ এবং মোহানায় হচ্ছে চিরকালীন মিলন। এ তো জানা কথা। এই যে মহাশূন্য, সেও এখন বাড়ছে, পরে শূন্যের চেয়েও, সময়ের চেয়েও আগে কোন এক সময়ে আত্মবিসর্জন দেবে বলে। কোথায় যাবে সে? কোথায় যাবে? কোথায় এসেছে? কেন?  আমরা কিছুই জানি না। বরং বলা ভাল, আমরাও ওই মহাশূন্যের অংশ হয়ে এই নিত্যলীলায় ডুবে আছি। আমরা খন্ড, আবার আমরাই পূর্ণ। আমরা জন্ম, আবার আমরাই মৃত্যু, আমরা মিলন, আবার আমরাই বিচ্ছেদ। তুমি কাকে দু:খ বলবে এর পর? কাকে ভয় করবে? কাকে ভাববে পাপ? ভাববে মিথ্যে? lie is a commitment of truth- বলেছিলেন এক ফরাসী দার্শনিক। আর আমাদের ভারতবর্ষ বলছে- মিথ্যা নেই। আছে অসত্য। যা মিথ্যা নয়, সত্যের অংশ। 
এই দেখ, আবার চলে এল রেফারেন্স। কথা বলতে বলতে কতকিছু চলে আসে যে! তুমি তাদের এড়িয়ে থাকতে পারবে না, কারণ সে তোমার হয়ে গেছে। আসলে এই ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক, যেমন ভাবে আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। মৃত্যুর দিকে তাকাতে ভয় পাই, কারণ তার চোখের ভিতর নিজেকে দেখতে পাই না। বার্গম্যানের ছবির মত সে প্রতিমুহূর্তে দাবা খেলে আমাদের সঙ্গে। আমরা হারিয়ে ফেলতে ভয় পাই। শুরু মানেই বুঝি শেষ আছে কোথাও। আমরা পূর্ণ হলেও আসলে কাঠামোটা আমাদের খন্ড। মিলনের শুরুতে, মিলনের মধ্যে, অস্পষ্ট বা তীব্র চুম্বনের মধ্যেও আমাদের মন কোথাও একটা আশঙ্কায় দুলে ওঠে। আমরা হাত ছুঁয়ে থাকি পরস্পরের, যেন যেকোন মুহূর্ত শেষ এক মুহূর্ত, যেকোন মুহূর্ত মোহানা, আমরা না চাই ধবংস করতে একে অপরকে, না চাই ঈশ্বর করতে একে অপরকে, আমরা শুধু যাত্রাপথ হয়ে থাকি, যে পথ চিরকাল দুটি মুহূর্তকে অসংখ্য মুহূর্তের হাত ধরে পৌঁছে দিতে চায়। সেটাই তার কাজ, সেটাই তার জীবনের উদ্দেশ্য, বিধেয় এবং বিধি। 
ভালবাসা যেমন, কবিতা লেখাও তেমন। এই যাত্রাপথ, যা ঈশ্বর হতে চায় না, যা চায় মিলন আর বিচ্ছেদের শুভদৃষ্টি ঘটিয়ে নিজে বিস্মৃত হতে। যা চায় মৃত্যু এবং জীবনের সঙ্গম ঘটিয়ে নিজে একটা উন্মাদ প্রহর হয়ে থাকতে। প্রতিটি প্রেম, সে যে ফর্মেই থাকুক, তা নিজেই বিবাহ। প্রতিটি কবিতা আসলে বইয়ের প্রথম কবিতা। 
লেখো। এই মায়াকে লেখো। এই জার্নিকে লেখো। এই মুহূর্তকে অনন্তকালীন বিবাহ কর, সেই চোখগুলো আমাদের নিজেদের, আমরা চল, আবিষ্কার করি একে অপরকে। লিখি আমাদের। আমাদের দেশের বাড়িতে, একটা পুকুর আছে। আর সেই পুকুরে যাওয়ার জন্য একটা ছোট্ট রাস্তা আছে। রাস্তাটা বাড়ি আর পুকুরের মধ্যে বিয়ের মত সুন্দর, বহু বছর পড়ে আছে। দুপাশে গাছ। পাতা ঝরে পড়ে হেমন্তে। বর্ষায় ওঠে সঙ্গমকালীন সোঁদা গন্ধ। রাস্তাটা কেন আছে? তার নাম কি? তার শৈশব, কৈশোর, বার্ধক্য নেই?  মৃত্যুও কি নেই? না কি সব আছে? রাস্তাতেই? গোমুখে যেবার গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম গঙ্গার বালিকাবেলা। মনে পড়েছিল গঙ্গাসাগরকে। মনে হয়েছিল মোহানা মিথ্যে, উৎস সত্য। বা উৎস মিথ্যে, মোহানা সত্য। কিন্তু দুটিই সত্য। আর দুটিই রয়েছে দুটিতেই। মোহানাই উৎস আর উৎসই মোহানা।মাঝের যাত্রাপথ তবে?
চল তাকে বলি ভালবাসা। বলি কবিতা। বলি জীবন। মৃত্যু। সুন্দর। বলা যাবে তো?

এক জেন গল্পের কথা বলতেই হয় এখানে। এক জেন শিল্পী খুব নিখুঁত কাজে বিশ্বাসী। এক রাজা অনেক টাকা দিয়ে তাঁকে বলেছেন একটি সর্বশ্রেষ্ঠ ফুলদানি তৈরি করে দিতে। তিনি একটির পর একটি তৈরি করেন, তার পর পাথর দিয়ে ভেঙে দেন। আবার তৈরি করেন আরেকটি নিখুঁত ফুলদানি। বহুদিন পরে রাজা আসেন। জিজ্ঞেস করেন- একটা ফুলদানি তৈরিতে এত সময়? একটাও কি ভালো হচ্ছে না? লোকে তো বলছে প্রতিটিই ছিল অপরূপ। শিল্পী কিছু বলেন না। কাজ করতে থাকেন। বছর যায়, যুগ যায়। শিল্পী বুড়ো হয়ে পড়েন। রাজার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে। ডাকেন সেই শিল্পীকে। বলেন- আমি বোধহয় দেখে যেতে পারব না সেই ফুলদানি। তখন শিল্পী বলেন- রাজা, আমি নিজেই যে নিখুঁত নই, আমার শিল্প কী ভাবে নিখুঁত হবে? তাই আমি চেষ্টা করে যাব আমৃত্যু। শিল্পীর মৃত্যুর আগে তিনি শিষ্যদের বলেন- আমার শেষ রচিত ফুলদানিটি কাউকে দিও না। কারণ আমি এখনও শিখে উঠতে পারিনি অনেককিছু। ত্রুটি আছে। অনেক।

এই হল সমর্পণ। এই হল শিল্প। পৃথিবীর সমস্ত শিল্পের ইতিহাস আসলে ব্যর্থতার ইতিহাস। আর লোকে ভাবে সাফল্যের কথা! হাস্যকর নয়?

 

Facebook Comments

Related posts

One Thought to “বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ৫”

  1. nabakumarpodder

    ভাল লাগা জানাই

Leave a Comment