হিন্দোল ভট্টাচার্য

বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ২

অপ্রত্যাশিতের এই স্পর্শ পাওয়ার জন্য জগতের কাছে সবসময় হাত পেতে বসে থাকতে যে হয়, সেটিই আসল সত্য। মানে, অপেক্ষাই আসলে প্রধান। মিলন নয়। ধরা যাক দুজন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে, তারা একে অপরের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত তাদের অপেক্ষা আর ফুরোচ্ছে না। এই না ফুরোনো অপেক্ষাই হল প্রেম। মিলন তো ক্ষণিকের। অপেক্ষাই চিরকালীন। এ প্রসঙ্গে একটি দৃশ্য ও একটি গল্প মনে পড়ছে। আমি বসে আছি দেউরিয়া তালে। সারা রাত ধরে অপেক্ষা করেছি দেউরিয়া তালের ধারে একটি তাঁবুতে। সূর্য উঠবে। পাহাড়ে সূর্যোদয়ের উলটো ছায়া পড়বে দেউরিয়া তালের জলে। দেখব। অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল সূর্যোদয় ঘটছে আমার জীবনে। তা, তিনি উঠলেন। অপূর্ব দৃশ্যটি দেখলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য। আর তা আলোয় হারিয়েও গেল। দেখলাম, কিন্তু মনে হল সারারাত ধরে দেখলাম দৃশ্যটিকে। মনে পড়ল এমন একটি গল্প। এক  জেন শিক্ষকের কাছে আরেক সন্ন্যাসী জেন প্রাপ্তির জন্য সাধনা করছেন। বিশেষ এক অনুভূতি  লাভের পর জেন সন্ন্যাসী বললেন- তুমি জেন প্রাপ্ত হলে। ছাত্রটির মুখ আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক বললেন- তুমি তা হারিয়েও ফেললে। ছাত্রের মুখ অন্ধকার হল না, বরং উদাসীন হল। আবার সন্ন্যাসী বললেন- তুমি আবার জেনপ্রাপ্ত হলে। ছাত্র বলল- কেন? শিক্ষক বললেন- আগের অপেক্ষায় ছিল আকাঙ্খা। এবারের অপেক্ষায় উদাসীনতা। মানুষ যখন বারবার হিমালয়ে যায়, তখন হয়ত এই শিক্ষাটি অনুভব করে সে। তাই না? তবে কী অপ্রত্যাশিত মানুষকে আরও উদাসীন করে দেয়? অপ্রত্যাশিতের কাজ-ই এই , তা মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে তার নিজের বাইরের অংশটি থেকে আলাদা করে ভিতরের অংশে নিয়ে যায়। ভিতরের ঘরে হয়তো তখন থাকে তার শৈশব। বা তার চিরকালীন অভিজ্ঞতাগুলি। কিন্তু উদাসীনতার সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে উদ্ভাসিত হওয়ার কী সম্পর্ক। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিখ্য্যাত মানুষ এডমন্ড হিলারীর কথা। হিলারী এভারেস্ট জয় করার পরে তাকে আবিষ্কার করেছিলেন ধীরে  ধীরে। তাঁর এক বিখ্যাত উক্তি- এভারেস্ট জয় করে এসে বুঝতে পারলাম, শীর্ষে আরোহণ করাটাই সবকিছু নয়। কারণ শীর্ষে আরোহণে চ্যালেঞ্জ থাকে, প্রেম থাকে না”। এই অসামান্য উক্তিটি তো একজন কবির-ই। একজন কবিই বলতে পারেন এভাবে কথা। সারা জীবন ধরে হিলারী নেপালের খুম্বু গ্রামের মানুষদের সাথেই কাটিয়ে গেছেন। লুকলায় করে দিয়েছেন এয়ারস্ট্রিপ, সম্পূর্ণ নিজের খরচে। গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল। খুম্বু গ্রামের মানুষজন হিলারীকে ভগবানের মতো করে ভালোবাসেন। এমনকী প্লেনে করে নামতে গিয়ে এখানেই প্রাণ হারান তাঁর স্ত্রী ও সন্তান। তাতেও হিমালয়কে ছেড়ে যাননি হিলারী। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি কাটিয়েছেন হিমালয়ের অন্দরে কন্দরে। তিনি যে রেনল্ড মেশনারের মতো খুব বেশি শৃঙ্গ জয়ের খেলায় নেমেছিলেন, তা নয়। বরং হয়ত দূর থেকেই হিমালয়ের সৌন্দর্যকে দেখতেন। মাথায় পা রাখার চেষ্টা আর বেশি করতেন না। জয় করার মনোভাব তাঁর মন থেকে একেবারেই চলে গিয়েছিল। যেন এক দীর্ঘতম অপেক্ষা। জয়েসের Araby গল্পের সেই বয়ের ‘ লাইফ ইজ এ ভিভিড ওয়েটিং’—এর মতো। মিলন হল তো হয়ে গেল। তার চেয়ে অপেক্ষাতেই আছে প্রজ্ঞা। মিলনে আছে বিচ্ছেদ। কারণ মিলন যত দীর্ঘসময়ের জন্য হোক না কেন, তা আদতে ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু অপেক্ষার কোনও গন্তব্য নেই, টাইমটেবিল নেই, তাড়াও নেই।

যখনই কোথাও পৌঁছতে পারি না, মনে হয়, সেই জায়গার জন্য আমার অপেক্ষা চলছে। একবার চোপতা ভ্যালিতে থেকেও আমি তুঙ্গনাথে পৌঁছতে পারলাম না। থেকেই গেলাম চোপতা ভ্যালিতে। শরীর একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সকলে উঠে গেল। আমি পড়ে রইলাম সেই পাহাড়ী ঢালে জঙ্গলের এক ধারে তাঁবুর মধ্যে। এদিক ওদিক ঘুরছি। নেমে গেলেম পাহাড়ী ঢাল বেয়ে জঙ্গলের মধ্যে। পাহাড়ে গেলে আমার মৃত্যুভয় কমে যায়। কোন জঙ্গলে কোথায় ভাল্লুক আছে, সে সব ভাবলে আর পাহাড়ে যাওয়া কেন? তো, সবাই চলে গেছে। আর আমি কী করব, আমিও ঘুরি, এই ভেবে চোপতা ভ্যালির রাওয়াতের দোকান থেকে যে ঢাল নীচের দিকে নেমে গেছে সেই ঢাল বরাবর নামতে নামতে পৌঁছে গেলাম এক আশ্চর্য জঙ্গলে। এমন এক জঙ্গল, মনে হল,আদি শঙ্করাচার্যের সময় থেকেই হয়তো ইনি এমন ভাবেই আছেন। আকাশস্পর্শী সব গাছ, আর তাদের গুঁড়ি ঘিরে গজিয়ে উঠেছে অসম্ভব সুন্দর কিছু গুল্মজাতীয় গাছ। আর ভিতরে কী সুন্দর এক সোঁদা আদিম গন্ধ। ছড়িয়ে আছে সবুজ, শুকনো, আধা শুকনো সব পাতা। কত উঁচুতে বা কোথায় যে বসে থেকে কত সহস্র পাখিরা যে কিচিরমিচির করে চলেছে বলার নয়। ঠিক কোথা থেকে করছে বোঝা যাচ্ছেনা। কিন্তু এক অপরূপ সঙ্গীত। একটু অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলি, এমন অপরূপ সঙ্গীত আমি শুনেছিলাম এক সম্পূর্ণ অকাব্যিক এক জায়গায়, আর তা হলো ব্যারাকপুর স্টেশন। ব্যারাকপুর স্টেশনে কেউ যদি গোধূলির সময়ে যান, তাহলে শুনতে পাবেন এই পাখিসঙ্গীত। গোটা স্টেশনটি ঢাকা দেওয়ায় এক উঁচু সিলিং আছে। আর সেই সিলিং অব্দি বিভিন্ন জায়গায় হয়তো এলাকার সব পাখির ঘর। গোধূলি হলেই তারা সবাই ফিরে আসে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলে। এমন অসম্ভব সুন্দর সঙ্গীত যে কোনও ব্যস্ত স্টেশনে থাকতে পারে, তা ব্যারাকপুরে না গেলে কেউ বুঝবেনই না। অন্তত এই পাখিসঙ্গীত শোনার জন্যই মানুষের উচিত যে যেখানেই থাকুন, একবার না একবার গোধূলিতে ব্যারাকপুর স্টেশনে নেমে একাকী চুপ করে শোনা। যাই হোক, হিমালয়ে আসি। সেই যে সঙ্গীত আমি শুনতে শুরু করলাম, মনে হল এমন অপার্থিব জগতের কাছে আসাটাও জীবনের এক পাওয়া। না হয় নাই বা গেলাম উঁচু কোনও জায়গায়। কাছেই ছিল একটি পাথর। পাথরটার থেকে একটু দূরে একটা ঝরনা, নদীর নাম জানি না, নেমে আসছে। কোথায় নামছে জানি না। কার সাথে মিশছে তাও জানি না। কিন্তু ঝরনাটি ভারী সুন্দর! যেন আদিম এক গন্ধ আছে ঝরনাটির ভিতরে। আর তার দিকে চেয়ে থাকলে ঘোর লেগে যায়। জঙ্গলের গাছগুলি এত উঁচু, যে সূর্যের আলো বিভিন্ন গাছের ঝাঁকড়া পাতাগুলির ভিতর দিয়ে নেমে আসছে ঈশ্বরের ফোকাসের মতো। যেন আকাশে আছে এক নরম লাইটহাউস, আর তার আলো এভাবেই পড়ে মানুষের উপর। আর যদি কেউ ঘুরতে ঘুরতে ঝরনাটির কাছে যান, দেখবেন তার একটু বাঁদিকেই খুলে গেছে সমস্ত দৃশ্য। দেখা যাচ্ছে বদ্রীনাথ শৃঙ্গ, চৌখাম্বা, নন্দা দেবী, হাতি শৃঙ্গ। দূরে ত্রিশূল। এমন অমোঘ জায়গা যে ভার্জিন হয়ে রয়েছে, বা একাকী হয়ে রয়েছে, দেখলেও ভালো লাগে। আমি সেবার হয়তো তুঙ্গনাথের কাছে যেতে পারিনি, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে আমি আবার নতুন করে প্রেমে পড়েছিলাম। এই প্রসঙ্গে আরেকটি জেন গল্প মনে পড়ল। দুই সন্ন্যাসী। একজন খুব উদ্যোগী, পরিশ্রমী এবং আশাবাদী যে তিনি একদিন খুঁজে পাবেন তাঁর ইপ্সিত বোধি। আর আরেকজন একদম-ই উদ্যোগী নন, সাধনা করেন, কিন্তু আশা করেন না যে একদিন তিনি খুঁজে পাবেন সেই ইপ্সিত বোধি। একবার সেই উদ্যোগী সন্ন্যাসী নিস্পৃহ সন্ন্যাসীর কাছে এসে বললেন- আশা পূর্ণ হয়েছে আমার। ভগবান দেখা দিয়েছেন। আমি লাভ করেছি সেই বোধি। নিস্পৃহ সন্ন্যাসী বললেন- বাহ! এ তো দারুণ খবর। তাহলে এখন তুমি কী করবে? উদ্যোগী সন্ন্যাসীটির মুখে যে আলো জ্বলেছিল তা সবটুকু নিভে গেল। তিনি স্থির হয়ে গেলেন। জেন গল্পটি শেষ হচ্ছে এভাবে, ভগবানের দেখা না চাওয়া বা বোধি না পাওয়া সন্ন্যাসীটি আবার ডুবে গেলেন সাধনায়। শুধু বললেন- ‘ভাগ্যিস আমি ভগবানকে পাইনি’। কী করতাম আমি, যদি আমি সত্যি একদিন বুঝে যেতাম লিখতে পেরেছি আমার ইপ্সিত কবিতা। কী করতাম আমি যদি বুঝে যেতাম, যে দৃশ্যের খোঁজে ঘুরছি নানা জায়গা, এই-ই সে। যদি জানতে পারতাম এ জীবন লইয়া কী করিতে হয়! ভাগ্যিস আমরা জানতে পারি না। ভাগ্যিস পাহাড়ের মাথায় চড়া-ই নয় পাহাড়ের অংশ হয়ে ওঠা। ভাগ্যিস আমরা বুঝতে পারি না, অপ্রত্যাশিত কখন আমাদের কাছে আসে, কীভাবে আসে, কেন আসে আর কেনই বা আসে না। আর তাই তো আমরা চিরকাল ছুটে যেতে পারি। ‘আমি বারবার হিমালয়ে যাই, কারণ হিমালয় ওখানে ছাড়া আর কোথাও নেই’, বলেছিলেন ম্যালোরি। রেনল্ড মেশনারের লেখাতেও সেই এক কথা শুনতে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সান্দাকফুতে আলাপ হওয়া দুজন ড্যানিশ অভিযাত্রীর সঙ্গে। আমার চেয়েও খারাপ ইংরিজিতে তাঁরা কথা বলতে বলতে সান্দাকফুর নির্জন সন্ধ্যায় বলেছিলেন, সারাবছর টাকা জমিয়ে সব টাকা খরচ করতেই তাঁরা এখানে চলে আসেন। পেশা গ্যারেজে মেকানিক। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে ভবিষ্যতে কী করবে? উত্তরে বললেন- ভবিষ্যত তো একধরনের অনিশ্চিত ব্যাপার। নিশ্চিত হচ্ছে বর্তমান আর অতীত। এই যে সুন্দর , তা সত্য বলেই, তার কোনও ভবিষ্যত নেই’। আমার আর কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। রাস্তা কি এভাবেই মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে?

আমার দৃঢ় বিশ্বাস হিমালয়ের প্রাণ আছে। তিনি সবকিছু শুনতে পান, কথাও বলেন। আমার কিছু অর্বাচীন কবিতাও আমি হিমালয়কে শুনিয়েছি আগে। যদিও আমি সেই সকল কবিদের পর্যায়ে পড়ি না, যাঁরা প্রচার করেন কবিতা লেখার জন্য তাঁরা হিমালয়ে যান, বা এই বলেন, তাঁরা আধুনিক নন, নাস্তিক নন, তাঁরা ধরে ফেলেছেন আধ্যাত্মিকতার গোপন অভিসন্ধিগুলি। কিন্তু আমি অনেক শব্দসন্ধানী কবিদের চেয়ে বড় কবি দেখেছি এই হিমালয়েই। যাঁরা অনেক বেশি মৌন। হয়ত দুটি একটি কথা বলেন, কিন্তু সেই কথার মধ্যেই ঝরে পড়ে তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি অন্তদৃষ্টির নাম-ই কবিতা? অবশ্যই আপনার মতো আমিও ‘না’ বলব। কিন্তু বলার কথা না থাকলে আর বলা কেন? তো, হিমালয় কীভাবে আস্তিক করে তোলে, তার দুটি ঘটনা বলব। একবার রূপকুণ্ড থেকে হোমকুণ্ড যাচ্ছি। রাস্তা তো বলতে গেলে কিছুই নেই। আস্তে আস্তে যাচ্ছি। কারণ আমি সত্যি খুব একটা জোরে হাঁটতে পারি না পাহাড়ে। আস্তে এবং লয়ে হাঁটলে দেখেছি দমে অসুবিধা হয় না। হিমালয় হাতে ধরে শেখায় লয়ে হাঁটো, তাড়া রেখো না কিছুর। যদি পৌঁছনোর হয়, যাবে, যদি না পৌঁছনোর হয়, যাবে না। এই যাওয়ার পথে আছে জিউনার গলি কল বলে এমন এক জায়গা, যেখানে এক পা দিয়ে পার হয়ে যেতে হয়। প্রায় তিন হাজার ফুট নীচে খাদ। যাওয়ার সময় পই পই করে গাইড বলে দিলেন, নীচের দিকে তাকাবেন না। আর মানুষের স্বভাবজাত কৌতূহলে তাকালাম সেই নীচেই। এক পা পিছনে। এক পা ওই ছোট্ট খাঁজে। নীচে খাদ। আমি বিহবল। সামনে গাইড ও আমার সঙ্গীরা আশংকায়। সে সময় আমার যে কী হল! আমি ঠিক ভয় পাচ্ছিলাম না। নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর ঠিক মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার হাত ধরে আছে। মুহূর্তের মধ্যে জেগে ওঠা ভয় মুহূর্তের মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছিল। আধ্যাত্মিকতার এ এক অদ্ভুত স্তর বলা যেতে পারে! যে সময় আমি ঈশ্বরের কথাও ভাবছি না। আর ডাকছিও না আমার হাত ধর এসো আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা কর। আমার তখন শুধু মনে হচ্ছে আমার শরীরটা শুধু আমার মধ্যে নেই। আরও বড় কিছুর অংশ, আর সেই বাকি অংশটি এত বড় যে আমার পক্ষে তাকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। পেরিয়ে গেলাম সেই জিউনার গলি কল। তো, ঈশ্বর কি এসেছিলেন আমাকে হাত ধরে পার করে দেবেন বলে? ঈশ্বর কি আমার চেয়ে আলাদা কিছু? এই যে হিমালয়ের হাঁটছি, আমিও কি হিমালয়ের অংশ নয়? যদি অংশ-ই হই, তাহলে আর কী করে সেই অংশকে জয় করব আমি? কীভাবে বলব আমিই পা রাখলাম এভারেস্টের মাথায়? আমিই পেরিয়ে গেলাম অফুরন্ত মহাসাগর? আমিই সে, আমিই অধিকার করলাম প্রেম? এর মানে হল, পাহাড়কে, প্রেমকে, কবিতাকে, সাগরকে, জীবনকে জয় করা যায় না। আমি কতটা অংশ এ সবকিছুর, তাকে অনুভব করা যায় মাত্র। আমরা মানসিক ভাবে এবং বাস্তবিক ভাবে এত নশ্বর, যে সেই আমাদের অংশ, অথচ আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় বলে, তাকে আমরা সবসময় বুঝতে পারি না। বুঝে ওঠাটাই কঠিন। কারণ বুঝে উঠলে আমরা আর কিছুই অধিকার করতে চাইতাম না। বা অধিকারের গর্বে বলে উঠতাম না, আমিই এর মালিক।  সবকিছুর মালিক- এই অনুভূতিটা তো কবিজনোচিত নয় এবং দার্শনিক জনোচিত-ও নয়। এমনকী মানব-জনোচিত-ও নয়। কিন্তু আমরা তা করি। আমাদের অস্তিত্বের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে এই অধিকারবোধ। প্রকৃতির প্রতি, প্রেমের প্রতি, নিয়তির প্রতি, সময়ের প্রতি আমাদের এই দুর্দম অহংকার এবং অধিকার আমাদের নিজেদের কাছ থেকেই আলাদা করে রাখে। যে কারণে, আমরা আধ্যাত্মিকতা বলতে অন্য কিছুকে বুঝি, ঈশ্বর বলতে বুঝি এক অতিপ্রাকৃত শক্তিকে, আর কত কিছু বুঝি। কিন্তু কখনও ভাবি না মহাপ্রকৃতিই সব কিছু লিখছেন। মহাপ্রকৃতিই আমাদের অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বের এক বৃহৎ অংশ। আর সেই নিজের সঙ্গে নিজের বৃহতের সংযোগসাধন-ই আধ্যাত্মিকতা, কবিতাও বলা যায়। হিমালয় হয়ত সেই সংযোগ সাধনটুকু করে যান।

কবিতায় এপিফ্যানি বলে একটি বিষয় আছে। এমন এক মুহূর্ত, যা বৃহত্তর বেশ কিছু অনুভূতিমালার কাছে নিয়ে গেল। জীবনের নানা  সময়েই ছোট ছোট এমন নানা অভিজ্ঞতার জন্ম হয় আর তা থেকে কবিতার বিভিন্ন মুহূর্ত-ও তৈরি হয়। আমাদের জেন  দর্শনে এই সব মুহূর্তগুলিকেই জেন মুহূর্ত বলা হয়। রামকৃষ্ণদেবের সেই বালক অবস্থায়, কালো মেঘের নীচে সাদা এক ঝাঁক বকের উড়ে যাওয়া দেখে যেমন সমাধিস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি, সেই রকম মুহূর্ত। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই মুহূর্তগুলিই কি মহাপ্রকৃতির ইশারা? কবিতার আঁতুড়ঘর? জানা নেই। আমি যে দ্বিতীয় আধ্যাত্মিকতার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম তার মধ্যে হয়ত এই এপিফ্যানির জন্মের ইশারা আছে। বদ্রীনাথ যাওয়ার পথে পড়ে যোশীমঠ নামক এক শহর। খুব সুন্দর শহর বলা যাবেনা। কিন্তু পাহাড়ী শহর। যোশীমঠের উপরেই আউলি। যোশীমঠের নীচ দিয়ে বয়ে গেছে বিষ্ণুগঙ্গা। শহরেই বেশ কিছুটা উপরে আছে শংকরাচার্যের গুহা। বেশ সুন্দর মন্দির করে জায়গাটি সুরক্ষিত। সেই গুহার বাইরে লেখা আছে, ভিতরে গেলে পাঁচমিনিট ধ্যান করবেন। আমার ওসব ধ্যান ইত্যাদি করার খুব একটা চর্চা নেই। গুহার ভিতরে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মনে হল গুহার ভিতরে কোনও সময় নেই আলাদা করে। অদ্ভুত একটা গন্ধ। বসেই গেলাম আমি ও আমার মামা ( তিনি রীতিমতো মাউন্টেনিয়ার) ধ্যানে। পাঁচ মিনিটের জন্য। আর, সত্যি কথা বলতে, যে আমার পাঁচ মিনিট দূরের কথা , এক মিনিটও ধ্যানে বসার অভিজ্ঞতা নেই, সে নিজেকে হারিয়েই ফেলেছিল। কারণ অন্য লোকের ডাকে যখন আমাদের দুজনের সম্বিত ফিরেছিল, তখন প্রায় এক ঘণ্টা কাবার হয়ে গেছে। রাত তখন আটটা। প্রায় আধঘন্টা নামতে হবে আমাদের। কী পেয়েছিলাম জানি না। কিন্তু মন অদ্ভুত শান্ত হয়েগিয়েছিল। নিজের সাথে নিজের যোগাযোগে যে নিজের মধ্যে এমন অপরূপ শান্তি আসে, তা আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আর চেষ্টা করেও এই শহরে এসে ধ্যান করতে পারিনি আমি। শংকরাচার্যের প্রতি আমার গভীর ঈর্ষা হয় এবং প্রবল শ্রদ্ধা জাগে। এত বড় মাপের একজন কবি, তিনি দ্বৈত না অদ্বৈত এ নিয়ে আমার কৌতূহল কম, হিমালয়ের অন্দরমহলে ঘুরে ঘুরে তিনি গাড়োয়ালের সুন্দরতম জায়গাগুলিতে মন্দির স্থাপন করে গেছেন। আর হিমালয়ের সঙ্গে তাঁর অন্তরের সম্পর্কটি তো তাঁর কাব্যের মধ্যেই স্পষ্ট। আমার তো মনে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক আধ্যাত্মিকতা নয়, আদি শংকরাচার্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক আধ্যাত্মিকতার সেরা নিদর্শন তাঁর কবিতাগুলি।

মনে পড়ছে আরেকটি জেন গল্প। এক জেন সন্ন্যাসী আসলে পর্যটক। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এসেছেন এক শহরে। পাহাড়ী শহর। সেখানে এক গুহায় ধ্যান করেন এক জ্ঞানী জেন সন্ন্যাসী। তো, তিনি গেলেন তাঁর কাছে। কথায় কথায় বৃদ্ধ জানতে পারলেন, সেই সন্ন্যাসী গত দু তিন বছর ধরে কেবল ঘুরছেন। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন- এখনো কি তোমার গন্তব্য খুঁজে পাওনি হে যুবক? ঈশ্বর আসেননি? জেন আসেননি? একটু স্থিত হও। বুদ্ধ আসবেন।

যুবক সন্ন্যাসী বললেন- আমি জানি তিনি আসবেন। আপনার কাছেও, আমার কাছেও। ধ্যান করলেও, ধ্যান না করলেও। আমি তো শুধু দেখতে চাইছি, কতরকম ভাবে তিনি আছেন। তিনি আসবেন, আসুন। আমিও কি তাঁর কাছে যাব না?

হয়ত এ কারণেই আমরা কবিতার কাছে যাই। হয়ত এ কারণেই যাই হিমালয়ে, বারবার।

জেন গল্পটির শেষে ছিল, জেনপ্রাপ্ত সেই বৃদ্ধ জ্ঞানী মহাপুরুষ, সেই যুবার সাথে বেরিয়ে পড়লেন। পড়ে রইল তাঁর সাধের গুহা। সেখানে কিছু গ্রন্থ এবং শুকনো পাতার স্তূপ।

(ক্রমশ)

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment