হিন্দোল ভট্টাচার্য

বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ১

আমি নিজেকে সবসময় উপলক্ষ্য ভাবি। এই যে কবিতা লিখি, আদৌ আমি কি লিখি? না কি আমি কেবলমাত্র লেখার আধার হয়ে থাকি? ঈশ্বরের কথা জানি না। প্রকৃতির কথা কিছুটা জানি। দর্শন হোক বা বিজ্ঞান, সঙ্গীত হোক বা কবিতা- কোনওকিছুই আমরা নতুন করে তৈরি করছি না, ইংরিজিতে ইনভেন্ট যাকে বলে, যা করছি, তা হল  ডিসকভারি, মানে খুঁজে পাচ্ছি। খুঁজে পাচ্ছি, তার কারণ, আমাদের মধ্যে কেউ না কেউ কোনও না কোনও ভাবে খুঁজে চলেছে। প্রশ্নটা হল, কী খুঁজে চলেছে এবং কাকে খুঁজে চলেছে। আমাদের সমস্ত অসীমেরও ধারণার অতীত এই মহাবিশ্বে নিজস্ব সীমার মধ্যেও সীমাবদ্ধ আমরা খুঁজে চলেছি এই ধারণার অতীত মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কারণ।
অথবা হয়ত কিছুই খুঁজছি না। কিন্তু আপনা থেকে ঘটে চলা খুঁজে পাওয়ার মধ্যেও খুঁজে পাওয়ার কিছু কারণ থাকে। আর তা হল, নিজেকে উপযুক্ত আধার হিসেবে প্রস্তুত রাখা। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন- আমি কান পেতে রই। মাঝে মাঝে প্রকৃতির সেই বার্তা আমার ভাষায় কথা খুঁজে পায়। মাঝে মাঝে, আমি সেই কথাগুলিকে ধারণ করার জন্য উপযুক্ত আধার হয়ে উঠি। এই যে মাঝে মাঝে চকিত আলোর ঝলকানির মতো ঝলমল করে ওঠে চিত্ত, এই-ই হলো প্রকৃতি থেকে খুঁজে পাওয়া এক বৃহত্তর সত্যের হদিস। যে সত্য আমার চেতনাকেই ক্রমশ চৈতন্যের প্রবাহিত ধারার সাথে সংযুক্ত করে। প্রত্যেকের এই প্রত্যেকের মতো অপেক্ষা করে থাকা, প্রত্যেকের এই প্রত্যেকের মতো করে প্রকৃতির লেখনী হয়ে ওঠা—অপেক্ষা এবং বোধির মধ্যবর্তী যে অজ্ঞাত বিস্ময়ের পরিসর, জীবনানন্দের ভাষায় যা বিপন্ন বিস্ময়, বুদ্ধের ভাষায় তা-ই বোধি। আমি অনেক ভেবেছি জীবনানন্দ কথিত এই বিপন্ন বিস্ময় শব্দটিকে নিয়ে। বিপন্ন কেন? তবে কি বিস্ময়টাই বিপন্ন, না কি বিস্ময়ের ফলে যে বিপন্নতা, যার জন্য প্রকৃতই পাশে রাজমহিষী আর পুত্রকে ফেলে, রাজ-ঐশ্বর্য ফেলে, তিনি একাই হেঁটে যান জরা দুঃখ, মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে, সব তুচ্ছ মনে হয় তাঁর, পণ্ড মনে হয় সকল চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়। এই শূন্যতা অবসাদ নয়, অস্থিরতা, এমন এক অস্থিরতা যা মনকে ক্রমশ বৃহতের সূক্ষ্মতার কাছে নিয়ে যায়। আর তা প্রাপ্তির-ই আরেক নাম  জেন প্রাপ্তি।

জেন শব্দটির অর্থ ধ্যান। ধ্যান তো নানাভাবেই হতে পারে। একজন কবি বা লেখকের লিখনপ্রক্রিয়াও তো একপ্রকার ধ্যান। তাত্বিক ধারণার খোলসগুলি যদি বাদ দেওয়া যায়, তবে বলাই যায়, এই ধ্যান বা জেন হল জীবনের নানান ছোট ছোট অভিজ্ঞতা, দৃশ্য , ঘটনা, বা অনুভূতিমালার মধ্যে দিয়ে জগতের বৃহত্তর সত্যের বোধকে খুঁজে পাওয়া। সাধারণ, টুকরো টুকরো ঘটনা বা অনন্যসাধারণ অনুভূতিমালার উন্মেষ, সে যত ছোট মুহূর্তেরই হোক না কেন, অপ্রত্যাশিত বোধের কাছে নিয়ে যেতে পারে। অপ্রত্যাশিতের খোঁজ-ই তো আমরা করে যাই, আর বোধ, অপ্রত্যাশিতের মতোই আমাদের কাছে হাজির হয়। তাই সে কখন কী রূপে হাজির হবে, তার কোনও পদ্ধতি নেই। আর তাই তাকে খুঁজে পেতে কখনও মানুষ বাউল হয়, কখনও বা এই নগরের মধ্যেও ঘুরে বেড়ান কবি, আবার কখনও একা হেঁটে যান পর্যটক।  সেই অন্ধের কথা মনে পড়ে, যিনি, দুর্যোগপূর্ণ রাস্তায়, হেঁটে হেঁটে প্রতিকূল পাহাড়ের রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, এই তো আমার চোখ আছে, কত কিছু দেখলাম। এই বদ্রীনাথজিকেও দেখতে পাচ্ছি। আর সেই কথাটা মনে নেই? পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়, পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়। তিনি মন দিয়ে শোনার পরে বললেন, আমি না দেখতে পেলে কী হবে, তিনি তো আমায় দেখছেন। এই যে মুহূর্ত, এই মুহূর্ত-ই তো পাহাড়ের শিক্ষা। এই মুহূর্ত-ই হিমালয়ের শিক্ষা। তিনি একজন অন্ধ হতে পারেন, কিন্তু তিনি অনেকের চেয়ে বেশি চক্ষুষ্মান। কারণ তাঁর অন্তরের চক্ষু উজ্জ্বল হয়ে আছে। আরও গভীর ভাবে ভাবলে, আমরা যেমন দৃশ্যকে দেখছি, দৃশ্যও কি আমাদের দেখছেনা? দৃশ্যও কি আমাদের দিকে তাকিয়ে নেই? দৃশ্য যে দ্রষ্টার দিকে তাকিয়ে আছে, তা কি বাইরের চোখে ধরা পড়ে? অন্তরের চোখে ফুটে ওঠে। জেন-এর মূল বক্তব্য কিন্তু তাই। জগতের সঙ্গে জগতকে যে অনুভব করছে তার এক ধরনের পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। আর সে সম্পর্কের দিকটি খুব সহজ। তুমি জগতের এক অংশ। বলা যেতে পারে, এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তুমি ছাড়া জগতের অস্তিত্ব নেই। আবার তুমি জগতের এক সামান্য বিন্দুর মতো অংশই কেবল। তাই তুমি কিছুতেই জগতের সমগ্র বুঝতে পারা দূরের কথা, অনুভব করতেও পারবে না। কেবলমাত্র তুমি দেখে যেতে পারে। শব্দেও ধরতে পারবে না তাকে। এই কথাটি বলেই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে আদাবাবার কথা।  আদাবাবার সম্পর্কে বলার আগে একটা কথা বলি। এই যে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সাধুদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, তাদের কারো মধ্যে আমি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখিনি। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি তারাই করে, যারা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। পাহাড়ী সত্যিকারের  সাধুদের মধ্যে বরং দেখেছি ধর্ম সম্পর্কে এক প্রবল উদাসীনতা। ঈশ্বর যেন তাদের বন্ধু। তপোবনে এক সাধুর গুহায় ছিলাম । গোমুখ থেকেও পাঁচ কিলোমিটার উপরে (১৪ কী ১৫ হাজার ফিট হবে) চারিদিকে সাদা তুষারক্ষেত্রের মাঝখানে একচিলতে সবুজ ময়দান, যার মধ্যে মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় ছোট ছোট নদী। ঠান্ডায় জমে যাওয়া ঝরনা থেকে নেমে আসা জলের প্রবাহ, যা নেমে যাচ্ছে রহস্যময় সব পথে গোমুখ থেকে বয়ে যাওয়া গঙ্গায় অথবা একটু নীচে আকাশতালের দিকে। সামনেই বিশাল শিবলিঙ্গ। যে না দেখেছে সে বুঝতে পারবে না তিনি কী সুন্দর! কোনও শব্দেই আমি তাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। তো, মনে হয় তপোবনের সবুজ জমিটি উঁচু হয়ে মিশে গেছে শিবলিঙ্গে। তো এ হেন স্বর্গাদপী গরিয়সী জায়গায় থাকেন কিছু কিছু অদ্ভুত মানুষ। আগে থাকতেন বাঙালি বাবা বাঙালি মা। যাঁরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করে দিয়ে চলে এসেছিলেন এই জায়গায়, অত্যন্ত কঠিন রাস্তা দিয়ে এসে। আর ফিরে যাননি। তাঁদের সাহায্য করতেন পাহাড়ি মানুষজন। তো , আমরা পৌঁছবার পরে প্রবল শীতে আশ্রয় নিয়েছিলাম যে গুহায়, সেখানে থাকতেন এক সাধু। ইনি আদাবাবা। আদা খেয়ে বেঁচে থাকেন। মৌনীবাবা। স্লেট আছে একটা। কিছু চক। আমাদের দেখে মৃদু হাসিতে ভরে গেল মুখ। লিখে লিখে জিজ্ঞেস করলেন  কোথা  থেকে  আসছি, ইত্যাদি। আমরা রান্না বসালাম। তাঁকে খাবার অফার করলাম। তিনি, আশ্চর্যের ব্যাপার, খেলেন। মানে, বোঝা গেল আবাহন নেই, বিসর্জন নেই। তিনি তাকিয়ে থাকেন শিবলিঙ্গের দিকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম- এই যে তাকিয়ে থাকেন, কী দেখেন? তিনি লিখে জবাব দিয়েছিলেন, রোজ বদলে যাওয়া হিমালয়কে। জিজ্ঞেস করেছিলাম- কই নতুন? তিনি হেসে লিখেছিলেন- আমি তো প্রতি মুহূর্তে নতুন হচ্ছি, তাই আমার দেখাটাও রোজ নতুন হচ্ছে। আমাকে যারা দেখছে, তারাও নতুন   দেখছে। কিছু কি পুরোনো হয়? এই হলো গিয়ে জেন মোমেন্ট। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গিয়েছিল একটি নদী তো আসলে একটি নদী নয় অসংখ্য নদী। আমরাও কী সেরকম নই?

আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, পাহাড়, বিশেষ করে হিমালয় পর্বত অনেকটা বিশাল বড় কোনও দর্শনের মতো, যার প্রতিটি কোণে রয়েছে সূক্ষ্মতার বিভিন্ন পরত। আসলে বৃহত তো সে-ই, যার অন্দরমহলে সূক্ষ্মতার আনাগোণা এবং সূক্ষ্ম-ও সে-ই, যার আকৃতি যাই হোক না কেন, আসলে সে বৃহতের এক অংশ। এই সূক্ষ্মতাকে নিয়ে থাকা বৃহতের রূপের ভিতরে যে অরূপের উপস্থিতি, ্তা-ই আমার কাছে  জেন। কারণ এই  জেন দর্শন কখনও বলে না, বিশেষ কিছুকে অনুভব করার জন্য বিশেষ কিছু হয়েই অনুভব করতে হবে। এক মুচি, সে যদি নিখুঁতভাবে , সততার সঙ্গে একটি জুতো সেলাই করতে পারে, তবে সে  জেন। যে, যে কাজটি নিখুঁত ভাবে করতে পারে, সে, সে-ই কাজের মাধ্যমেই অর্জন করতে পারে সেই সূক্ষ্ম এবং বৃহতের চরম অনুভূতিমালার জায়গাটি। কারণ এই অনুভূতিমালার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেই অপ্রত্যাশিতের স্পর্শ। এমন এক অপ্রত্যাশিত-র খোঁজ আমি ব্যক্তিগত ভাবে পেয়েছিলাম একবার। গোমুখে যাওয়ার আগের রাতে ছিলাম ভুজবাসায় লালবাবার আশ্রমে। তো, বেশ শীত। লালবাবার আশ্রমে  প্রার্থনাগীতের পরে ডিনার শেষ করে আমরা খড়ের বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তো, রাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ আর কীসের যেন ছমছম শব্দ। আমি সাধারণ ভাবে খুব একটা ভয় পাই না, আর হিমালয়ের এই অন্দমহলে গেলে আমি গভীর ভাবে   আস্তিক হয়ে পড়ি। তখন মনে হয়, দেবভূমিতে এসেছি যখন , নিশ্চয় দেবতার দেখা পাব। তো দেখলাম বাকিরা সকলেই ঘুমোচ্ছে। আমি উঠে পড়লাম। একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। প্রসঙ্গত, লালবাবার আশ্রমে ঘরটা ছিল মাটির নীচে। উঠে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু যা দেখলাম তাতে মনে হল এই দৃশ্য দেবতার অধিক কিছু দেবতা। দেখলাম চারিদিক চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে মাতৃ, সুদর্শন ভাগিরথী শৃঙ্গ। বরফ পড়েছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। কাছেই গঙ্গা গোমুখ থেকে নেমে বালিকার মতো নাচতে নাচতে চলেছে নীচের দিকে। সবে জন্ম নিলেন তিনি। আর সামনে পাশে দূরে সর্বত্র বরফে মোড়া শৃঙ্গের উপর চাঁদ তাঁর সর্বস্য ঢেলে যেন সঙ্গম করছেন। এমন দৃশ্যের কাছে এসে, আমি কাউকে বিশ্বাস করাতে পারব না, নিজের কথা ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আত্মবিলুপ্তির কথা আমরা বলি বটে। লেখার সময় বা সাধনার সময় আত্মবিলুপ্তি ঘটাতে হয়। কিন্তু আত্মবিলুপ্তি তো এমন সচেতন ভাবে ঘটানো যায় না। ঘটে যায়। এই ঘটে যাওয়ার মুহূর্তটিই আসলে কবিতা। তার পর তো তা লিখিত হয়। সেই দৃশ্যের কাছে এসে আমার সম্পূর্ণ ভাবে আত্মবিলুপ্তি ঘটে গিয়েছিল। আমি শুধু দেখছিলাম। তখন আমি কিছুই  ভাবছিলাম না। কারণ দৃশ্য তখন নিজের মোহে আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। কতক্ষণ  এভাবে তাকিয়েছিলাম জানি না। চটকা ভেঙেছিল এক প্রবল বিস্ফোরণের শব্দে।  গোমুখ যাঁরা গেছেন এবং লালবাবার আশ্রমে যাঁরা থেকেছেন, তাঁরা জানেন, লালবাবার আশ্রমের ঠিক উল্টোদিকে গঙ্গার অপর পাড়ে পর পর রয়েছে আকাশচুম্বী সব্  শৃঙ্গ। তাদের অনেকের-ই নাম জানি না। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন আছেন, যাকে দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো। গঙ্গার উপরেই যেন তিনি ঝুঁকে থাকেন। আর এই প্রবল বিস্ফোরণটি আসলে হচ্ছিল ধস। যাকে বলে আভালাঁশ। সে কী বিস্ফোরণের শব্দ! বজ্রবিদ্যুতভর্তি খাতা। চাঁদের আলোর ঝড় তখনও অব্যাহত। আর তার সঙ্গে মিশে গেল বরফধসের তীব্র দৃশ্য। সুন্দর এবং ভয়ংকর সুন্দর মিশে গেল একে অপরের সাথে। যেন মহাদেব তার শান্ত সুন্দর ধ্যানমগ্ন রূপ থেকে ঝাঁপ দিলেন রুদ্ররূপে। বুঝিয়ে দিলেন সমস্ত অনুভূতিমালাই আসলে একই সাথে ক্ষণস্থায়ী এবং চিরন্তন। আমাদের চিরন্তনকে পেতে হবে ক্ষণস্থায়ীত্বের মধ্যেই। এই বোঝাটা কিন্তু তখন হয়নি। কিন্তু পরে যতবার  ভেবেছি দৃশ্য নিয়ে, ততবার, মনে হয়েছে আমি নিজেও তো ছিলাম সেই দৃশ্যের-ই একটা অংশ। আর সেই দৃশ্য তো অনেকরকম। আমি নিজেও তো আসলে বহু-ই। কখনও শান্ত, কখনও শিব, কখনও বুদ্ধ এবং কখনও রুদ্র। আমার যে রূপ দেখে, যে আমার ‘আমি’ কে ভেবে আমি মনে করি, এই আমার পরিচয়, এই আমার ‘আমি’ তা একপ্রকার, ওই কিছু সময়ের আত্মবিলুপ্তি। আমার অরূপটিই আসলে সত্য, রূপটি নয়। আর সেই অরূপ আছে কোথায়? ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম তাহার পায়ে। সমস্ত ভাবনা , জগতের সমস্ত সৃষ্টি কেমন মুহূর্তের মধ্যে মিলেমিশে যায়! মনে হয় তখন  কোনও কিছুই আলাদা নয়, সব কিছুই পূর্ণ। আবার পরমুহূর্তেই বুঝতে পারি, খণ্ডগুলিও  সত্য । পূর্ণ-ই একমাত্র সত্য, এও একপ্রকার মায়া, একপ্রকার ভ্রান্তি। আমার আমিও সত্য, আবার আমার অসংখ্য আমিও সত্য। জেন ভাবনায় যে নিজের জ্ঞানকে প্রথমে শূন্য করার কথা বলা আছে, সেখানে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন করে জগতের বিশালত্বকে অনুভব করার কথা বলা হয়েছে জীবনের ছোট ছোট অভিজ্ঞতাগুলির প্রেক্ষিতেই। কোনও ছোট অভিজ্ঞতাই আসলে পূর্ণ নয় এবং তথাকথিত খণ্ড-ও নয়। সেগুলি নিজেদের প্রেক্ষিত অনুসারে পূর্ণ, আবার অন্য প্রেক্ষিত অনুসারে খণ্ড। জেন-ভাবনায় এভাবেই আমাদের দর্শনকে বলা হয়েছে বা ভাবা হয়েছে আপেক্ষিকতা দিয়েই। যেমন  একটা গল্পের কথা এখানে তুলে ধরাই যায়, যেখানে একজন জেন সন্ন্যাসী তাঁর শিষ্যকে শিক্ষা দেওয়ার আগে একটা চায়ের কাপে চা ঢালতেই লাগলেন। চা উপচে পড়তে লাগল। ছাত্র জিজ্ঞেস করলেন কেন এত চা ঢালছেন? পড়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে তো। শিক্ষক উত্তর দিলেন- এই কাপের মতোই মনকেও  আগে, নিজেকেও পূর্বে যা জেনেছ, তা থেকে মুক্ত করতে হবে। না নিজেকে শূন্য করলে আবার পূর্ণ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে কীভাবে। এই কথাটি যেন বা একদম প্রকৃতি থেকেই নেওয়া। হিমালয়ে বারবার ভাঙা গড়ার খেলা চলে। সমুদ্রের ধারে গেলেও এক। পাড় ভাঙছে, ঢেউ ভাঙছে। আবার ঢেউ আসছে। নতুন করে সৈকত গড়ে উঠছে। প্রকৃতির সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ জানে এই সত্যের কথা। কিন্তু মানুষ এই সত্যকে জানলেও, হয়ত এই সত্যকে বিশ্বাস করতে চায় না, বা বিশ্বাস করতে ভয় পায়।

(ক্রমশ)

Facebook Comments

Related posts

One Thought to “বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ১”

  1. অমিতাভ

    স্বতন্ত্র ভাবনা।

Leave a Comment