শতাব্দী দাশ

পিরিয়ড কথা-স্বাভাবিকতা বনাম রাজনৈতিক উদযাপন

আমি তেমন পরিবারেই বড় হয়েছি যেখানে মা প্রথম ঋতুদিনের আগে পর্যন্ত মেয়েকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না৷ আমার প্রথম রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল ক্লাস সেভেনের গ্রীষ্মাবকাশে। মা বললেন, ‘এবার থেকে প্রতি মাসে এরকম হবে তিন-চার দিন। হলে আমায় বলবে। পেট ব্যথা হতে পারে। হাত পা যন্ত্রণাও। ঘাবড়ানোর কিছু নেই।’  যাবতীয় পারিবারিক যৌন-শিক্ষার এখানেই শুরু এবং শেষ। ‘মাসিক’ ছাড়া যৌনতার সঙ্গে সুদূর সম্পর্কযুক্ত আর কোনো বিষয়ে মা কোনোদিন আলোচনা করেছেন বলে মনে পড়েনা৷ আর সেই আলোচনাও এত অসম্পূর্ণ যে এরপর রাস্তাঘাটে হঠাৎ শুরু হলে কী করতে হবে, জামা নোংরা হলে কী করব, কতক্ষণ অন্তর প্যাড বদলাব ইত্যাদি কোনোকিছুরই হদিশ পাওয়া গেল না। বোঝা গেল না, ভ্যাকেশনের বদলে যদি স্কুলেই প্রথমবার রক্ত-দর্শন ঘটত, তাহলে কোনো প্রাক্-প্রস্তুতি ছাড়া আমি কী করতাম!

সে ছিল নব্বই দশকের শেষ দিক৷ স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহারের হার এমনকি শহরাঞ্চলেও ব্যাপক ছিল না৷ আমাদের গার্লস স্কুলে তখন ‘হুইস্পার’ আসত বিজ্ঞাপনী প্রচারে৷ ট্যাগলাইন ছিল- ‘ধোনা,সুখানা, বনানা…অব গয়া ও জমানা!’  ‘হুইস্পার’ নামেই ছিল লজ্জা আর গোপনীয়তার উত্তরাধিকার। রেণুকা সাহানে পর্দায় ভারি লজ্জা-টজ্জা পেয়ে যা বলতেন, তা বাংলা ডাবিং-এ এরকম শোনাত,‘একটা কথা বলার আছে, কিন্তু কী করে যে বলি!’ ‘কী করে যে বলি’ ভাবতে ভাবতে আমাদের মায়েরা বা শিক্ষিকারা কোনোদিনই কিছু বলে উঠতে পারলেন না৷ এদিকে দশ ক্লাসের বায়োলজিতে যা বলা আছে, তা সাত ক্লাসের বালিকারা  পুরোপুরি হজমও করতে পারেনি স্বতঃপ্রণোদিত চেষ্টায়। শুধু বুঝেছিল, এর সঙ্গে প্রজনন ক্ষমতার সরাসরি যোগ আছে, এ ভারি স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু কী এক আশ্চর্য কারণে, এমনটা যে হয়, তা জনসমক্ষে বলতে নেই।

তবুও আমরা নিঃসন্দেহে ছিলাম সৌভাগ্যবান। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থানে ‘প্যাড’ জুটত।  ভারতে ত্রিশ কোটি মেয়েকে যে কাপড়ের ন্যাকড়া দিয়ে কাজ চালাতে হয়, যা কিনা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন নয়, তা জানতে তখনও ঢের বাকি ৷ আমাদের স্কুলে অন্তত ছিল চেঞ্জ করার আড়াল,মানে উপযুক্ত ছাত্রী শৌচালয়৷ অনেক পরে জানতে পারব, ভারতে ২৩% মেয়ে ঋতুস্রাব শুরু হলেই স্কুলছুট হয়। বাকিরা গড়ে তিন থেকে পাঁচ দিন স্কুল কামাই করে ‘সেইসব দিনে’। পশ্চিমবঙ্গে একটি-দুটি মাত্র সরকারি স্কুলে সম্ভবত স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেণ্ডিং মেশিন আছে। সেগুলি বসেছে প্রধান শিক্ষকের উদ্যোগে৷ এমনিতে সরকারী স্কুল তো দূরস্থান, মহার্ঘ্য বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেণ্ডিং মেশিন ডুমুরের ফুল,আজও ।

ঋতুস্রাব কি স্বাভাবিক একটি জৈব ঘটনা নয়? তাহলে তাকে গোপনীয় বা  কলুষিত ভাবব কেন? আবার ঋতুস্রাব যদি স্বাভাবিক জৈব ঘটনাই, তবে তার উপর অতিরিক্ত গুরুত্বই বা আরোপ করা হবে কেন? কেন তাকে ঘিরে অধুনা  আন্দোলন, স্লোগান এবং সর্বোপরি উদযাপন? তর্কগুলো পরিচিত,বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রতিবারে যখন এমন কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে যার সঙ্গে নারীর ঋতুস্রাব কোনো ভাবে জড়িত-সে ‘পিরিয়ড লিভ’ হোক বা শবরীমালা, স্যানিটারি-প্যাডের উপর জিএসটি হোক বা রূপী কৌরের ইন্সটাগ্রাম ছবি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া-তখনই এইসব  তর্ক শুরু হয় নতুন উদ্যমে। ঋতুস্রাবের মতো একটি ‘গোপন’ বিষয় নিয়ে এই যে খানিক বৌদ্ধিক তর্ক হচ্ছে, সেটাও মন্দ নয়৷

এমনিতে এগারো থেকে চোদ্দর মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া স্তনের বিকাশ, যৌনকেশ ও বাহুমূলে কেশের আগমন ইত্যাদির  মতোই বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েবেলার একটি স্বাভাবিক ঘটনা৷ ঋতুস্রাব বলতে সহজ কথায় বোঝায় নারীসুলভ হরমোনগুলির তৎপরতায় ডিম্বাশয় থেকে নির্গত একটি পরিণত ডিম্বাণুর  জরায়ুতে এসে পড়া এবং পুরুষের শুক্রাণুর সাথে মিলিত হতে না পেরে জরায়ুপর্দা বা এন্ডোমেট্রিয়ন ফেটে রক্তক্ষরণ সহ বেরিয়ে আসা, যা কমবেশি ২৮-২৯ দিন অন্তর চক্রাকারে চলে। এর মধ্যে রক্তক্ষরণে কাটে ৩-৭ দিন। ইংরেজি ‘মেন্সট্রুয়েশন’ কথাটি ‘মুন’ থেকে এসেছে মনে হয়।  লাতিনে ‘মেনসিস’ মানে মাস, যে কথাটি আবারও গ্রিক ‘মেনে'(চাঁদ) শব্দ থেকেই এসেছে৷ অর্থাৎ এই জৈবিক প্রক্রিয়া যে নিয়ম মেনে প্রতি মাসে ঘটে এবং প্রতি মাসে চাঁদের বাড়া-কমার মতোই যে অমোঘ ও স্বাভাবিক এই ঋতুস্রাব -তা সুদূর অতীতেও মানুষের চোখ এড়ায়নি৷ তা সত্ত্বেও, একবিংশ শতকেও প্রথম ঋতুস্রাবের আগে ভারতের  শতকরা ৪১ ভাগ কিশোরী তার সম্পর্কে থাকে অন্ধকারে। এদিকে, তাদের মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগই কিন্তু জানে এ’সময়ে কী কী সামাজিক ট্যাবু মেনে চলতে হয়। শতকরা ৫৮ ভাগ মনে করে এ হল দূষিত রক্ত; শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ভাল। ফলত, তারা এ-ও বিশ্বাস করে যে পিরিয়ডের সময় তাদের নিজেদের শরীর অপবিত্র থাকে। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে আজও  রজঃস্রাবকালে মেয়েরা পারিবারিক টয়লেট ব্যবহার করে না, শরীর ও ব্যবহৃত কাপড় ধোওয়ার জন্য পরিষ্কার জলও ব্যবহার করতে পারেনা, রক্ত আটকাতে প্যাডের বদলে কাপড় ব্যবহার করলেও সেই কাপড় ধুয়ে খোলা জায়গায় মেলতে পারে না। ‘ওয়াটার এইড’ ও ‘ইউনিসেফ’-এর যৌথ সমীক্ষা এই সব তথ্য তুলে এনেছে৷ এ সময়ে আমিষ খাওয়া, রান্না করা,রান্নাঘরে যাওয়া, পুরুষদের স্পর্শ করা, স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে একই বিছানায় শোওয়া, এমনকি একই ঘরে থাকা, ধর্মীয় উপাসনালয় তথা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ -অনেককিছুই বন্ধ হয়ে যায় তাদের।

অথচ একটি ছেলের শরীরেও বয়ঃসন্ধিকালে নানা বদল ঘটে- কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, দাঁড়ি গোঁফ ওঠা, বীর্যপাত। শেষটি নিয়ে আছে কিছু ভ্রান্ত  ধারণা ও অজ্ঞতা। কিন্তু যে অস্পৃশ্যতা, শুচিবায়ুতা, লোক-লজ্জা ও বিধিনিষেধ মেয়েদের ঋতুস্রাবের জন্য বরাদ্দ,তার সঙ্গে কিছুই তুলনীয় নয়। ঋতুস্রাব নিয়ে ট্যাবু যেহেতু সরাসরি প্রভাব ফ্যালে শিক্ষার অধিকারে, স্বাস্থ্যের অধিকারে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকারে, সুতরাং তাদের প্রত্যক্ষভাবে  মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বলাই যায়।

নারীদেহের এই  সহজ ও সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়া যে কীভাবে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে  ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতীকী গুরুত্ব পেয়েছে, তা নৃতত্ত্ববিদদের অবাক করতে পারে। অসাধারণত্ব আরোপিত হয়েছে মূলত দুটি মাত্রায়। এক,ঋতুস্রাব অশুচি। দুই, ঋতুস্রাব পবিত্র, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন।  যেমন ভারতবর্ষের মধ্যেই, ছত্তিশগড়ে জনসাধারণের বিশ্বাস হল, রক্তভেজা ন্যাকড়া, বিশেষত প্রথম ঋতুস্রাবের পর,পুড়িয়ে ফেলা ভালো, নাহলে তা কালো-যাদুতে ব্যবহার করা হতে পারে৷ আবার মণিপুরে মেয়ে রজঃস্বলা হলে প্রথম রক্তাক্ত কাপড়ের খণ্ডটি সংরক্ষণ করা হয় ও সেই মেয়েটিরই বিয়ের সময় তুলে দেওয়া হয় তার হাতে; তা নাকি তাকে ও তার পরিবারকে বাঁচাবে অশুভ শক্তির প্রকোপ থেকে।   পিতৃতন্ত্র যুগে যুগে নারীকে দেবী-শয়তানীর বাইনারিতে মেপেছে। ঋতুস্রাবের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও তার ব্যতিক্রম নয় । নারীর প্রজননক্ষমতা সম্ভবত যে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময় ও ভীতির সৃষ্টি করেছিল অ-নারীকূলে, তারই প্রতিফলন এই বাইনারিতে।

নাপাক রক্ত না ঐশি ধারা?

মনু সংহিতা ৪:৪১ শ্লোকে আছে, ‘যেদিন প্রথম রজঃদর্শন হবে সেদিন থেকে তিন রাত্রি পর্যন্ত রমণী সবকিছু পরিত্যাগ করে ঘরের মধ্যে সর্বদা আবদ্ধ থাকবে, যাতে অন্য কেউ তাকে না দেখতে পায়। স্নান করবে না, অলংকার পরবে না। এক বস্ত্র পরিধান করবে। দীনভাবে মুখ নিচু করে বসে থাকবে। কারো সাথে কোন কথা বলবে না। নিজের হাত, পা ও চোখ থাকবে স্থির। দিনের শেষে মাটির হাঁড়িতে তৈরি করা ভাত সে খাবে এবং ভূমিতে সাধারণভাবে শয্যা করে নিদ্রা যাবে।’ মনু সংহিতায় আরও আছে: ‘রজঃস্বলা নারীতে যে পুরুষ সঙ্গত হয়, তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু ও চক্ষু ক্ষয় পায়।’  হিন্দু সংস্কৃতিতে শুধু রান্নাঘর এবং পুজো-আচ্চাই নিষিদ্ধ হয় না ঋতুমতীদের জন্য, , এমনকি উচ্চগ্রামে কথা বলা, ফুল বা অলংকার দিয়ে সাজসজ্জা ও যৌনতাও নিষিদ্ধ৷ আজও কুমারী পূজার জন্য যে বালিকাটিকে নির্বাচন করা হয়, তাকে প্রাক-ঋতুমতী হতে হয়। কিছুদিন আগে নেপালে এক সনাতনী অমানবিক প্রথা বে-আইনি ঘোষিত হল। সে প্রথার নাম ‘‘ছৌপদী’, যার মাধ্যমে ঋতুমতী কিশোরীকে ঘরের বাইরে, ছোট্ট কুঁড়েঘর বা গোয়াল ঘরে থাকতে বাধ্য করা হত। ইসলাম ধর্মে ঋতুমতী নারীকে উৎসবে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোরান স্পর্শ করা ও নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এ সময়ে রোজা রাখারও বিধান নেই।( সুরা বাকারা, আয়াত ২২২-তে নাকি বলা আছে-

 ‘আর যদি তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে (ঋতু) সম্পর্কে, , বলে দাও, তা অশুচি।  তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাকো। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা আবার পবিত্র হয়… যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন।’ ইহুদি ধর্মেও একই সুর।   ঋতুমতী নারীকে স্পর্শ করলে স্নান করে শুদ্ধ হতে হবে। শারীরিক মিলনের তো প্রশ্নই ওঠেনা।

যদি প্রবীণাদের প্রশ্ন করেন, তাঁরা বলবেন, যৌবনে  তাঁদের ঋতুকালের শারীরিক ঝক্কি পুইয়েও ঘরের কাজ করতে হয়েছে, কাউকে হয়ত সেই  সঙ্গে ক্ষেতের কাজও করতে হয়েছে৷ এরপরে যে আবশ্যিক স্বামীসঙ্গ করার ধকল নিতে হত না, এ একরকম ভালোই৷ এমনকি ছত্তিশগড়ের  মহিলাদের মধ্যে বর্তমান দশকের সমীক্ষাও দেখাচ্ছে যে তারাও ঋতুস্রাবের সময় আলাদা থাকতেই পছন্দ করেন, তাতে শরীর বিশ্রাম পায়। কিন্তু তাঁরা বলছেন, আলাদা থাকার জায়গাটি স্বাস্থ্যকর হলে ভালো হত। অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে হয়ত মহিলাদের বিশ্রামের সুযোগ করে দেওয়াই লক্ষ্য ছিল; মুখ্য লক্ষ্য না হলেও একটি গৌণ লক্ষ্য৷ কিন্তু কালক্রমে তা অস্পৃশ্যতার পর্যায়ে পৌঁছেছে।

খ্রিস্টান ধর্মমতে,  যিশু নাকি নিজে ঋতুমতী নারীর চিকিৎসার জন্য তাকে স্পর্শ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সুতরাং লেভিটিকাসের নানা বিধিনিষেধ সত্ত্বেও রজঃস্রাবরত মহিলাদের ‘শুচিতা’ নিয়ে  বিশেষ কোনো বিতর্ক নেই। তবে মহিলাদের যাজক না হতে পারার একটা প্রচ্ছন্ন কারণ হিসেবে রজঃস্রাবের প্রসঙ্গ বারবার এসে পড়েছে৷

ভিক্টোরিয়ান আমলে মেয়েদের রজঃস্রাবকে চিকিৎসাশাস্ত্রের আওতায় আনা হয়। এর ভালো মন্দ দুই দিকই ছিল মনে হয়৷ একদিকে প্রয়োজনে মেয়েরা শুশ্রূষা পেতে থাকেন অল্পবিস্তর, অন্য দিকে একটি স্বাভাবিক(যদিও কষ্টদায়ক)  জৈব প্রক্রিয়াকে ‘অসুখ’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়, ব্যথা-যন্ত্রণা-নির্জীবতা- হতাশা যে অসুখের উপসর্গ। হাল আমলে ‘অসুখ’ কথাটি বাদ গিয়ে এসেছে ‘সিনড্রোম’ কথাটি, যেমন পিএমএস বা প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম৷ কিন্তু সেই সঙ্গে এসেছে অবিবেচক অনেক পিএমএস জোক আর ‘ডেড বেবি’ জোকও।

ধর্ম ও ঋতুস্রাব সংক্রান্ত আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়বে কেরলের আয়াপ্পা মন্দিরে  নারীদের প্রবেশাধিকার ঘিরে বিতর্ক৷ দীর্ঘ সাতাশ বছর পরে ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টের আদেশে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের জন্য সেই মন্দিরের প্রবেশদ্বার খুলেছিল। অথচ কার্যক্ষেত্রে মহিলারা ঢুকতে পারেননি অনেক চেষ্টাতেও ।২৮ সেপ্টেম্বর দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের  ঐতিহাসিক রায়ের পর একে একে আসতে থাকে মারধোর-খুন-ধর্ষণের হুমকি। এনডিএর সমাবেশে একের পর এক নেতা প্রকাশ্যে বলেন,শবরীমালা মন্দিরে যেসব মহিলা যাবেন তাদের কেটে দু’টুকরো করে ফেলা হোক,তাদের পুরুষেরা ও বাঘেরা ছিঁড়ে খাক, তাদের ঔদ্ধত্যেই কেরলে নাকি বন্যা হয়েছে৷ আয়াপ্পার মন্দিরে  ঢোকার আগে নিজেকে ‘শুদ্ধ’ করার জন্য যে একচল্লিশ দিন ব্যপী ব্রত পালন করতে হয়, তা ঋতুমতী নারীদের পক্ষে করা অসম্ভব, কারণ প্রতি আটাশ ঊনত্রিশ দিন অন্তর তার শরীর ‘অপবিত্র’ হয়-এই ছিল আয়াপ্পার ভক্তদের যুক্তিবিন্যাস।

এর আগে মুম্বইয়ের বিখ্যাত হাজি আলি দরগার গর্ভগৃহে মেয়েদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন ভারতীয় মুসলিম নারী আন্দোলনের সংগঠন (বি এম এম এ) প্রতিষ্ঠাতা ও  সদস্য নুরজাহান নিয়াজ। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে কিন্তু মেয়েরা হাজি আলি দরগায় প্রবেশ করছেন। সম্প্রতি বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের আদেশে মেয়েরা আমেদনগরের শনিসিংনাপুর মন্দিরে প্রবেশের অধিকারও পেলেন। কিন্তু শবরীমালার ভক্তদের অন্ধত্ব ও অযৌক্তিক জেদের সামনে থমকে গেল সুপ্রীম কোর্ট-এর রায়ও।

ধর্ম ও পিতৃতন্ত্রের যৌথ মস্তিষ্ক প্রক্ষালন এতই সুচারু যে শবরীমালার মন্দির কর্তৃপক্ষের সমর্থনে হাজার হাজার মহিলাও গলা ফাটান। নীলাক্কাল বেসক্যাম্পে হাতে আয়াপ্পার ছবি নিয়ে মহিলারাই তল্লাশি চালান বাস, অটো, ট্যাক্সিতে। মহিলা দেখলেই তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়,  ফিরে যেতে বলা হয়। সাংবাদিক কবিতা জাক্কাল আর নারী অধিকার কর্মী রেহানা ফতিমা সহ অনেক মহিলা ভক্তকে আটকে দেওয়া হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে তো বটেই, এমনকি কেরলের নাস্তিক সিপিএম-কে প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে বৈঠক করতে হয় ভোটের বালাই মাথায় রেখে। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছিলেন, শবরীমালায় ঢোকার পথে মহিলা ভক্তদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আশ্বাস ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।

আয়াপ্পার ভক্তরা অবশ্য  দাবি করেন,মন্দিরে প্রবেশের মুহূর্তে রজঃস্বলা না হলেও, প্রজননক্ষম যে কোনো নারীর উপস্থিতিতেই দেবতা আয়াপ্পা বিচলিত বোধ করতে পারেন৷ তিনি নাকি গহীন অরণ্যে যোগসাধনরত তাপস । দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সী নারীর নৈকট্যে তাঁর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। হিন্দু ধর্মে দেবতারা ‘পার্ফেক্ট’ নন, কিন্তু তাঁরা নাকি মানুষের চেয়ে উন্নততর।  ভক্তের মতে দেবতারই যদি নিজের রিপুর উপরে এত কম নিয়ন্ত্রণ থাকে, তবে সাধারণ পুরুষ যাবতীয় স্খলন একরকম ‘স্বাভাবিকত্বের’ তকমা পায়। এবং তাদের যাবতীয় স্খলনের জন্য দায়ী করতে হয় নারীর স্বাধীন বিচরণকে, তার উপস্থিতিকে, তার অস্তিত্বকে।

অথচ শবরীমালা নাকি অন্যতম ‘ইনক্লুসিভ’ দেবস্থান! শবরীমালা মন্দিরের কাছেই আছে বাবরস্বামী-র মসজিদ।  তাঁদের দুজনের সখ্য কল্পনা করে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকল পুরুষকে শবরীমালায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বহু বছর ধরে। শিব ও বিষ্ণুর মোহিনী-রূপের সঙ্গমে যে আয়াপ্পার জন্ম, তাঁর ভক্তরা লিঙ্গ-সাম্য নিয়ে পিতৃতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠে ভাবলেও ভাবতে পারতেন৷কিন্তু  আমাদের ইনক্লুশনের ধারণাতেও আসলে কখনও লিঙ্গসাম্যের কোনো স্থান ছিল না।

আবার এই দেশেই অসমের কামাখ্যা মন্দিরে ভরা বর্ষায় দেবী স্বয়ং নাকি ঋতুমতী হন । লোকমতে এখানে  শিবের তাণ্ডবকালে সতীর যোনি পতিত হয়েছিল। তাই তা একান্নপীঠের অন্যতম। যুক্তিবাদীরা বলেন, বর্ষার জলে লাল মাটি ধুয়ে এই  অতিলৌকিক রজঃস্রাব স্ৃষ্টি করে। কিন্তু বর্ষাকালে কামাখ্যায় যে অম্বুবাচী মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তা আদতে একটি ফার্টিলিটি রিচুয়াল৷ লক্ষ মানুষ আসলে শ্রদ্ধাবনত হন দেবীর তথা নারীরূপী প্রকৃতির উর্বরতার আদিম রহস্যের সামনে। তন্ত্রসাধকরাই মূলত ঋতুস্রাবের এই ধর্মীয় উদযাপনে অংশ নেন৷  আবার কিছুটা সহজিয়া বৌদ্ধ দর্শন, কিছুটা তান্ত্রিক তত্ত্ব মিশে যে সহজিয়া বাউল দর্শন, সেখানেও রজঃস্বলা নারীর সঙ্গে মিলনই নাকি মুক্তির পথ।

‘দ্য ব্লিডিং সেরেমনি’ বইতে জেসিকা সিমনস দেখান, কীভাবে মাটির কাছাকাছি বাস করা কৃষিপ্রধান জাতি  এবং প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতো জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপজাতি নারীর রজঃস্রাবকে উর্বরতার চিহ্ন মেনে সম্মানের চোখে দেখেছে। আমেরিকান উপজাতিগুলির কথাই ধরা যাক। চেরোকি ইন্ডিয়ানদের কাছে রজঃস্রাবের রক্ত শত্রুনিধনকারী। এখনও ‘রেড টেণ্ট’-এর আয়োজন থাকে এইসব উপজাতির গ্রামে, রজঃস্বলা মহিলারা যেখানে যত্নে থাকেন পরস্পরের সান্নিধ্যে। আবার প্রাচীন রোমে মনে করা হতো,  রজঃস্রাবরত নারী তার শরীর উন্মুক্ত করলে শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আর বজ্রপাত ভয়ে পিছু হঠে৷ তিনি যদি নগ্নদেহে শস্যক্ষেতে হেঁটে বেড়ান, তবে পাকা ফসল থেকে পোকা ঝরে যায়। আফ্রিকার সংস্কৃতিতেও রজঃস্রাবের রক্ত একটি শক্তিশালী জাদু তরল,যা অশুচিকে পবিত্র করতে পারে,রোগ সারাতে পারে, আবার ধংস করতে পারে শত্রুকে।

ভারতবর্ষের ধর্মগুলির মধ্যে শিখ ধর্ম ঋতুস্রাবের বিষয়ে শুরু থেকেই ছিল ছক-ভাঙা। স্বয়ং গুরু নানক নারীদের ঋতুস্রাবের সময় অপবিত্র মানার ঐতিহ্যকে তিরস্কার করেছিলেন।  শিখ ধর্মমতে, ঋতুমতী নারী অতি পবিত্র এবং এই মাসিক চক্র ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে ঘটা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। আবার কাশ্মীরের বিশেষ আইন অনুযায়ী, একজন ঋতুমতী নারীকে অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচনা করা নিন্দনীয়। বরং ঋতুমতী নারীর সেবা করলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাওয়া যায় বলে কাশ্মীরি জনশ্রুতি।

উদযাপনের রাজনীতিঃ কী ও কেন?

অবশ্য বর্তমানে নারীবাদী আন্দোলনগুলিতে ঋতুস্রাবকে উদযাপন করার যে ধারা, নারীকে অলৌকিক দৈব ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তার লক্ষ্য নয়৷ সে’ আন্দোলন ও উদযাপনের কারণ ও অভিমুখ  আলাদা৷ গ্লোরিয়া স্টেইনেম বহুপূর্বেই বলেছিলেন, ক্ষমতাবানের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বৈশিষ্ট্য-চিহ্নই ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে, আর ক্ষমতাহীনের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত সবকিছুকেই অশুভ,মন্দ, দুর্বল দেগে দেওয়া হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তাই মেয়েরা ঋতুমতী হয় বলেই ঋতুচক্র নিয়ে এত লুকোছাপা, এত নিন্দেমন্দ। তার বদলে ছেলেরা রক্ত ঝরালে তা-ই হয়ে উঠত শৌর্যের প্রতীক৷ ‘If Men Could Menstruate’’ প্রবন্ধে তাঁর সকৌতুক কল্পনাঃ

‘So what would happen if suddenly, magically, men could menstruate and women could not?

Clearly, menstruation would become an enviable, worthy, masculine event.

Men would brag about how long and how much.

 

…. Young boys would talk about it as the envied beginning of manhood. Gifts, religious ceremonies, family dinners, and stag parties would mark the day….Sanitary supplies would be federally funded and free.’

কৌতুকের আড়ালে যে ক্ষমতাতন্ত্র ও রাজনীতির ইঙ্গিত তিনি দিচ্ছেন, তা না থাকলে ঋতুরক্ত উদযাপনেরও প্রয়োজন হত না৷

দলিতকে বার বার ‘দলিত’ বলে আক্রমণ করলে তার জাতিসত্ত্বাই তার প্রতিবাদী অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ধর্ষিতাকে বার বার ‘ধর্ষিতা’ বলে অপমান করলে সেও নিজের ধর্ষিতা পরিচয়কেই লড়াই-এর হাতিয়ার করে তুলতে পারে সুজেট জর্ডনের মতো- এ আর আশ্চর্য কী? সুতরাং যুগের পর যুগ ধরে স্বাভাবিক জৈব প্রক্রিয়ার কারণে বৈরিতা, অপমান,অস্পৃশ্যতা সহ্য করতে হলে সেই স্বাভাবিক বিষয়টিকে ঘিরেই লিখতে হতে পারে  আন্দোলনের স্লোগান, তাকে ঘিরে ঘটতেই পারে উদযাপন।

নারীবাদী লেখিকাদের কলমেও তাই ঋতুরক্ত ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠে। জেনেট উইন্টারসন  ‘Written on the Body ‘’ তে লিখছেনঃ

‘When she bleeds the smells I know change colour. There is iron in her soul on those days. She smells like a gun’.

লুসিলি ক্লিফটন লেখেন -‘Poem in Praise of Menstruation:

‘If there is a river
more beautiful than this
bright as the blood
red edge of the moon if
there is a river
more faithful than this
returning each month
to the same delta if there

is a river
braver than this
coming and coming in a surge
of passion of pain if there is

a river
more ancient than this
daughter of eve
mother of cain and of abel if there is in

the universe such a river if
there is some where water
more powerful than this wild
water

pray that it flows also
through animals
beautiful and faithful and ancient
and female and brave.’

তিন বছর আগে  শবরীমালা বিতর্ক থেকেই #হ্যাপিটুব্লিড ক্যাম্পেন শুরু হয়েছিল৷ কারণ, আলগোছে বলা হয়েছিল-মহিলা ভক্তরা রজঃস্বলা কিনা, তা মেশিন বসিয়ে যাচাই করে নেওয়া গেলে, তাদের মন্দিরে ঢোকার কথা পুনর্বিবেচনা করাই যায়। ২০১৫ সালে নিকিতা আজাদ ফেসবুকে হ্যাপিটুব্লিড হ্যাশট্যাগ দিয়ে যে ভার্চুয়াল আন্দোলন শুরু করেন,প্রবাসী ভারতীয় কবি রূপী কৌর তা অনুসরণ করে ইনস্টাগ্রাম-এ ঋতুস্রাব সংক্রান্ত একটি ছবি দিয়েছিলেন। ছবিটি সরিয়ে দেন ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদের ঝড় উঠলে অবশ্য ক্ষমা চেয়ে ছবিটি ফের প্রকাশ করে ইনস্টাগ্রাম। ‘লাইক’ পড়ে কয়েক হাজার। সেই বছরই জামিয়া মিলিয়া, যাদবপুর সহ আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে স্লোগান লিখতে ব্যবহার করা হয় স্যানিটারি প্যাড। সদ্য বিশ্বব্যাপী  সচেতনতামূলক ‘মিনোস্ট্রুয়াল ডে’ পালন শুরু হয়েছে।

আমার বান্ধবী ‘হ্যাপি টু ব্লিড’ ক্যাম্পেনের কথা শুনলে রেগে  যায়। পলিসিস্টিক ওভারির কারণে প্রতিমাসে তার রক্তক্ষরণ চলে এক সপ্তাহ থেকে দশদিন ব্যাপী৷ শরীর ভেঙে পড়ে, মেজাজ থাকে তিরিক্ষে। রক্ত ঝরিয়ে কোনও সুখের অনুভূতি তার  হয়না। খুবই স্বাভাবিক৷ কিন্তু সমাজ-বাস্তবতার আরেক দিক হল, গুজরাতি লেখিকা কাজল ওঝা বৈদ্য ও তার ছেলেকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছিল, কারণ বিবিসি-র ‘লেটস টক পিরিয়ড’ অনুষ্ঠানে কাজল শুধু অকপট জানিয়েছিলেন যে, ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের বিভিন্ন ধর্মীয়স্থলে যাওয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা তাঁর মতে অযৌক্তিক। ২০১৮ সালের দুর্গাপুজোতেও ঋতুস্রাবকে ধর্মের উঠোনে এনে ফেলে বিপদে পড়েছিলেন শিল্পী অনিকেত মিত্র৷ একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন, তার ওপর একটি রক্তলেপা পদ্মফুল, তাকে ঘিরে চালচিত্র- এমনই একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন তিনি। বিবিধ হুমকির পর কলকাতা পুলিশের পেজেও রিপোর্ট করা হয় তাঁর ছবি । ছবি তুলে নিয়েও হেনস্থা এড়াতে পারেননি অনিকেত। অথচ নবপত্রিকার উপস্থিতিই বলে দেয়, কৃষিপ্রধান বাংলায় দুর্গাপুজো ছিল উর্বরতার প্রতি আবাহন।  বলা বাহুল্য, কলকাতার পুজো উদ্যোক্তারা অনেকেই তাঁদের আবশ্যিক ফার্স্ট এইড সেন্টারে তুলো বা ব্যাণ্ডেইডের সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখেন না৷

ধীরে হলেও দিন বদলাচ্ছে। ভারতে নিঃশব্দে কম খরচে স্যানিটারি প্যাড তৈরি করার কাজ করছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানিয়ে তাক লাগিয়েছিলেন অরুণাচলম মুরুগন্থমের মতো কেউ কেউ৷   আন্দোলনের ফলে উঠে গেছে স্যানিটারি ন্যাপকিনে জিএসটি। ঋতুমতী মহিলার স্বাধীন গতিবিধি যে একটি সাংবিধানিক অধিকার, তা অন্তত খাতায় কলমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন উচ্চ আদালত সহ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে। স্বাভাবিক জৈব প্রক্রিয়াকে ঘিরে যে গোপনীয়তা, ছুৎমার্গ, বিধিনিষেধ, চোখ রাঙানি – তাকে চ্যালেঞ্জ করতে এখনও ঘটছে ‘ব্রেক দ্য সাইলেন্স’ মুভমেন্ট বা  ‘টাচ দ্য পিকল’ মুভমেন্ট। আবার এসব কর্পোরেট-প্রাণিত হ্যাশট্যাগ মুভমেন্টের, এমনকি কর্পোরেট-সান্নিধ্যহীন, স্যানিটারি-প্যাডে-স্লোগান-লেখা, সাহসী,শহুরে মিছিলের নিশ্চয় সীমাবদ্ধতাও আছে। যুগ যুগ ধরে যে নারীবিদ্বেষ ও রজঃস্রাব-বিদ্বেষের হেজিমনি, তা সমূলে উপড়ে ফেলতে এসব আন্দোলন যথেষ্ট নয়৷ তাই শবরীমালায় মহিলাদের ঢুকতে বাধা দিয়েছেন মহিলারাই৷  অরুণাচলের জীবন-অনুসারী ‘প্যাডম্যান’ ছবির প্রচারে যত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহৃত হয়েছিল, তা কয়েক হাজার মেয়ের একমাসের রজঃস্রাবে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ছিল হয়ত।

শহর কলকাতায় আজও স্যানিটারি প্যাড বিক্রি হয় কালো মোড়কে। আশ্চর্য ‘ডিনায়াল’-এ ভোগা বিজ্ঞাপনে নীল ঋতুরক্ত ঝরে স্যানিটারি প্যাডে। যে মহিলা আথলেট পিরিয়ড চলাকালীন স্যানিটারি প্যাড না পরেই প্রতীকী দৌড় দৌড়েছিলেন, তাঁর শারীরিক ভাবে কষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়৷ কিন্তু গিমিক বলে উড়িয়ে না দিয়ে আমরা এটিকে দেখতে পারি ঋতুরক্তকে দৃশ্যমান করার এক রাজনৈতিক আজেন্ডা হিসেবে। ঋতুরক্ত এবং তার কারণে ঘটা শারীরিক অসুবিধেকে  আমরা যদি মানুষের(পড়ুন পুরুষের) পঞ্চেন্দ্রিয়র আড়ালে রাখতেই তৎপর হই, তাকে যদি না আসতে দিই চোখ-কান-স্পর্শের আওতায়, তাহলে বিমূর্ত ভাবনার ভিত্তিতে কোনো লড়াই যথেষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করবে না হয়ত৷ ঋতুস্রাব স্বাভাবিক,কিন্তু সমাজের ঋতুরক্তকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে শেখা এখনও বাকি৷ তা না করা গেলে কিসের ভিত্তিতে ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে প্রচার হবে, কিসের ভিত্তিতে হবে পিরিয়ড লিভের আন্দোলন? কে যেন বলেছিলেন, ‘you are leaking’ টিটকিরি শুনলে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেন বলা যায়- ‘your misogyny is leaking.’ এই রোখই  সময়ের দাবি আপাতত।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment