সাম্যব্রত জোয়ারদার

#ডেটলাইন

চৈত্রে রচিত রোদ্দুর ফেটে বেরিয়ে পড়েছে শিমুলের তুলো। বীজ, ফল বিস্ফোরিত হয়েছে। শাল্মলীসারি এই তমালের নীচে খাঁ-খাঁ টানা মাঠ। পর্ণমোচনের ধ্বনি যেন তুলাচাষির দীর্ঘশ্বাসের মতো পাথর আঁচড়ায়। ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থা আর ঋণনীতি অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে। মহাজন-দালাল-ফড়ে ব্ল্যাকম্যাজিক চর্চা করে। আরও একটি আত্মহত্যার জন্ম হয়।

স্ক্রোল-আপ করতে থাকি। নিউজ ফিড, ইমোজি, স্পনসরড পোস্ট, শপ নাও, ফানি ভিডিও, ঢেঁকুর তোলার ট্যাগড, অ্যাপ্লিকেশনের মাতৃভাণ্ডার। চিকিৎসা শুরুর আগেই মৃত্যু ঘটে যায়। হাসপাতালের ঘরে পোকা ওড়ে ভিজিটিং আওয়ারে। হাতে মাত্র পড়ে থাকে মিনিট খানেক যোগাযোগ। রোগীদের পথ্য নেই, ওষুধেরও ডেট এক্সপায়ার্ড।

আমি লিখি না। ট্রোলসভ্যতা আমাকে লুডো খেলতে শেখায়। টিভি যা বলে, প্রাইমটাইম যা শেখায় আমি মাথা নাড়ি। ‘জ্বি, জ্বি, জ্বি আ‍জ্ঞা’ করতে থাকি। আমি লিখি না। থম মেরে বসে থাকি কয়েক দশক। আমাকে কেন্দ্র করে ইমারত গড়ে উঠতে থাকে। সিন্ডিকেট ধ্বজা, গণ কনভেনশন, মিড-ডে মিল দুর্নীতি ও মাসাজ পার্লার। দন্তকান্তি শোভা করে। ড্রোন চক্কর কাটে, নজরদারি করে। সিসিটিভি ক্রমাগত শ্যাডো করতে থাকে। ক্যান্টনমেন্টের প্লাম্বার সানসেটে দাঁড়িয়ে কোমরে দড়ি বাঁধছিল। জানের বিমামূল্য ছিল কিনা জানতে পারে না কেউ। পা হড়কে নীচে নামতে থাকে। কীটনাশকের মৃত্যু নিয়ে আমি অন্তত এপিটাফ লিখি না।

চাষের খরচের গ্রাফ। হিমঘর সন্ত্রাস। বেইলকার্ভ পদ্ধতির ডাউন সাইজিং কৃষক বোঝে না। পাওয়া যায় না ফসলের দাম। সেচপাম্পে ডিজেলের ভর্তুকি বাজেট বরাদ্দে কাটা যায়। গরিব মানুষের বলিরেখা, খড়িওঠা ফাটা মুখ। তাকে আমি ফটোশপে জিএফএক্স বানাই। বিলবোর্ডে ফেরি করি। ট্রোল থেকে র-ফলা ছেঁটে ফেলি। পড়ে থাকে টোল। সংখ্যা। শতাংশের সংখ্যা। মৃতের সংখ্যা। ভোটের সংখ্যা। পরমাণু চুক্তির সংখ্যা। শ্রীহরিকোটা ক্ষেপণাস্ত্র ফাটায়। ছাই পড়ে থাকে বিদর্ভের গ্রামের থালায়। বাতাসে তুলোফুল ওড়ার কাব্যময়তা থেকে দূরে বন্ধ কারখানাগুলোর গেট স্তব্ধ, থমথমে। এবছর কার যেন শতবাষির্কীর পোস্টারপালিত।

জুন মাসে ৩৪ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করে সরকার। তারপরেও আত্মহননের ব্লাইন্ড লেনে ঢুকে পড়েন দেড় হাজারেরও বেশি কৃষক। জুন থেকে নভেম্বরের শেষ। সরকারি পরিসংখ্যান শতাংশের হিসেব দেখাচ্ছে, বলছে গত বছরের তুলনায় আত্মহত্যা কমেছে ৪.২ শতাংশ। সরকার ফলাও করে সফলতা প্রোপাগান্ডা করছে। কিন্তু ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণছাড়ের ঘোষণার পরেও কেন আত্মহত্যার অন্ধকার? করদাতাদের সাড়ে উনিশ হাজার কোটি টাকা তো ৪১টি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে ঢুকে গেল। কিন্তু তারপর? ভেরিফিকেশনের অনলাইন সিস্টেম হ্যাং হয়ে যায়। ডেটা বেস বোগাস, ভুয়ো অ্যাকাউন্টে ভরে থাকে। পেট ভর্তি বিটি মল্লিকা, বিটি বিপাশা খেয়ে, আঁচিয়ে, কুলকুচি করে আরামের হাইব্রিড সেলফি পোস্টায় দেড় হাজার কৃষক। মৃত্যুর চেয়ে অধিক আরামের আর কিছু নেই।

সিয়াচেনে মরলেই তাই শহিদ। আর কৃষকের আত্মহত্যা শুধুমাত্র অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার। শুধুই ডিপ্রেসন। তাঁর কান্না সাইকোর কান্না। তাঁর চেতনা হননের। ডোপামিন রাসায়নিক আমাকে লেখায় না। কয়েক দশক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। চৈত্রের রোদ্দুরে শিমুলের ফল ফাটে। তুলোর রোঁয়ার আত্মপ্রকাশ হয়। নির্বাচন এসে পড়ে। সহ্য করি। পরিত্যক্ত কেল্লার ভিতর নির্বাসন শিখি। দুর্ভেদ্য পরিখা বানাই। পুরোনো লেখার মধ্যে যেরকম পরাজিত সৈনিকের পোশাক পেরেকে টাঙানো থাকে।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment