রাজদীপ রায়

চর্যাপদ: প্রথম পা ফেলা বাংলা কবিতা

চর্যাপদ বাংলাভাষার সেই অভিজ্ঞান, যা গোপনে একটি নিজস্ব পরিসর গড়ে তুলে সৃষ্টি করেছিলো বাংলা কবিতার ভুবন নিজেরই অজান্তে। অজান্তে এই কারণে যে, যে বৌদ্ধ-তন্ত্র কায়াবাদী সাধকেরা এই পদগুলির নির্মাতা, তারা কিন্তু সচেতনভাবে কবিতা লিখতে চাননি, তারা চেয়েছিলেন তাদের প্রান্তিক ধর্মকে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের ঘেরাটোপ থেকে বাঁচিয়ে সুরক্ষিত করতে। কিন্তু এই কাজ তো সহজ নয়। তাহলে উপায়? উপায় গড়ে দিলো এমন এক নব্যআবিষ্কৃত ভাষা যার সঙ্গে সমাজে মূলস্রোতে বসবাসকারী মানুষদের তেমন সংস্পর্শ তৈরি হয়নি। লোকে বলতো প্রাকৃতজনের ভাষা। উচ্চবর্ণের মানুষের যে ভাষার প্রতি ছিলো ভীষণ উপেক্ষা। পাল-সেনযুগের রাজাদের ক্রূরচক্ষু এড়িয়ে এইসমস্ত সিদ্ধাচার্যদের ওই গোপন ভাষাকেই করতে হয়েছিল ঈষৎ দুর্বোধ্য, যাকে পরবর্তী সময়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্রমুখেরা মেনে নেবেন আলো-আঁধারির ভাষা বলে, কেননা  এই ভাষার খানিক বোঝা যায়, খানিক যায় না। সেই সন্ধ্যাভাষার হাত ধরেই বাংলাভাষার প্রথম আত্মপ্রকাশ।

সমাজজীবনের  বিভিন্ন পর্যায়কে ছুঁয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও ভূগোল উঠে এল চর্যার পদগুলিতে। অনেক সময় পেরিয়ে চর্যার যে বিশেষত্বটি গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবে আধুনিক পাঠকদের কাছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে এই প্রয়াস কোনও সচেতন কাব্যপ্রয়াস না হয়েও শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলো বাংলা কবিতার আদিতম দৃষ্টান্ত, এবং বাংলা কবিতার যে আদিরূপ ধারণ করেছিলো কীর্তন, তাই সম্প্রসারিত হলো চর্যাগানে। আমরা একটু পিছিয়ে গেলাম। অথচ এই পদগুলি কী নির্জনে কী নিরাপত্তাহীনতায় রচিত হয়েছিল, রচিত হয়েছিল প্রকাশের বিপরীতে নিজেকে সংগুপ্ত রাখবার অভিপ্রায় নিয়ে। প্রকাশই যদি কবিত্ব হয়, তাহলে বলতে হয় চর্যার এই প্রকাশ ঘটেছিলো কোনও দরিদ্র কুটিরে কিংবা কোনও নিভৃত নদীর তীরে। যেখানে সমাজের এলিটদের নজর পড়েনা, কিংবা পড়লেও তারা এসব পাগলের প্রলাপ ভেবে সংক্ষেপে উড়িয়ে দেন। আর যত উপেক্ষা বাড়ে, ততই যেন নির্জনতার গহনে সৃষ্টি হয়ে চলে এই চর্যাগান আত্মপ্রকাশের পরোয়া না করে। ভবিষ্যতের বাংলা কবিতার মধ্যে যে কূটত্ব যে রহস্যর পরত অবশ্যম্ভাবী অংশ হয়ে উঠবে, তার আভাস চর্যার পুথিতেই পাওয়া যায়।

বাংলা কবিতার ইতিহাস লক্ষ্ করলে দেখা যায় চর্যাপদের খুব জোরালো অভিঘাত বাংলা কবিতায় পড়েছে এমন নয়, কেননা চর্যাপদ সামনেই আসছে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে, যখন ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রবেশ ঘটেছে, ফলে মধুসূদন যেমন তাকান না চর্যাপদের দিকে, তেমনি রবীন্দ্রনাথকেও খুব একটা আগ্রহ বোধ করতে দেখা যায় না। মনে রাখতে হবে উনিশ শতকেও কিন্তু কীর্তনই বাংলা গান ও কবিতার আদিতম দৃষ্টান্ত। এবং মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ের মধ্যেই কীর্তনের প্রভাব ছিল। মধুসূদন না হলে তার মিস রাধাকে নিয়ে ব্রজাঙ্গনা কাব্য লিখতেন না। আর রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক কবিমানসে কীর্তন তথা রাধাকৃষ্ণের বিরহবিজড়িত প্রেমের যে গভীর প্রভাব ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মধ্যেই চর্যাপদের আবিষ্কারে যে হঠাৎ করেই তার ওপর এই দুই মহান কবির আস্থা জন্মে যাবে, এমনটা নাও হতে পারে। সে কারণে চর্যাপদের প্রভাব বাংলা কবিতায় পড়তে লেগে গেলো অনেক সময়। অবশ্য প্রভাব বললে অতিশয়োক্তি হবে, ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রগাঢ় প্রভাব যখন স্তিমিত হয়ে এলো, যখন কেউ কেউ ফিরে তাকাতে শুরু করলেন লোকায়ত ঐতিহ্যর পুনরুদ্ধারে। বাউল, সহজিয়া দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে আবার যেন চর্যাপদের নামটা উঠে এলো এই দর্শনকে আধার করে কবিতা লেখার সাপেক্ষেই। বিচ্ছিন্নভাবে বাংলা কবিতায় চর্যার অনুষঙ্গ উঠে এলেও তা অধিকাংশক্ষেত্রেই অলংকার হিসেবে থেকে গেছে। কবিতা সিংহ,গীতা চট্টোপাধ্যায়, পরবর্তী সময়ে গৌতম চৌধুরী, জহর সেনমজুমদার, গৌতম ঘোষদস্তিদার প্রমুখের লেখার অনুষঙ্গে চর্যাপদ এসেছে। আবার যদি চর্যাপদের নির্ধারিত কয়েনেজগুলো মাথায় না রেখে যদি এর দার্শনিক মূল্যের কথা ভাব যায়, তাহলে দেহ, দেহাতীতের এই প্রগাঢ় দার্শনিক টেক্সট্‌ যে শূন্য-র কথা বলে, তার বরং প্রভাব আমরা চল্লিশ পরবর্তী কবিতায় কিছু কিছু দেখতে শুরু করি। তাকে চর্যার প্রভাব না বলে অবশ্য লোকায়ত সংস্কৃতির প্রভাব বলেই গ্রহণ করা হয়, কেননা তার সমসময়ের মতোই আজও চর্যাপদ একটি প্রান্তিক টেক্সট্‌ হিসেবেই থেকে গেছে, যাকে ঈষৎ উন্নাসিকতায় প্রায়শই বাউল দর্শনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। চর্যার যে মূল সুর, তা বৌদ্ধধর্মের আদিরূপ নয়, বরং একটি পরিবর্তিত তন্ত্ররূপ, সেই সুরটি যিনি ধরতে পেরেছেন, সেই  সুর কখনো তাঁর লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে প্রকৃতই যদি চর্যাপদকে কেউ আত্মস্থ করে কবিতা লিখে থাকেন এ বঙ্গে, তিনি দেবদাস আচার্য। তাঁর ‘আচার্যের ভদ্রাসন’ গ্রন্থটির সামগ্রিক আবহ গড়ে উঠেছে চর্যাপদের পরিমণ্ডলকে আশ্রয় করেই। নগর থেকে দূরে বাড়ি নির্মাণ করে থাকতে গিয়ে কবির মনে যে একাকীত্বের উন্মেষ ঘটেছে, তার সঙ্গে আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতাকে মিশিয়ে দেবদাস বাংলা কবিতার প্রথম নিদর্শনকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গে আল মাহমুদের কবিতার জগতে চর্যার প্রভাব চোখ এড়ায় না। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু, ফরহাদ মজহার প্রমুখের লেখায় লোকায়ত দর্শনের বৃহৎ পরিসরে চর্যাপদ ইশারা দেয় বৈকি। সুমন গুণ ‘চর্যাপদ: আশ্চর্য নৈঋত’ এই শিরোনামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন, যেখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখেরা  চর্যাপদের পদগুলি প্রাচীন বাংলা থেকে আধুনিক বাংলায় রূপান্তরিত করেন।

চর্যাপদকে আজকের যুগে পড়বো কেন- এই প্রশ্ন যদি মনে জাগে,তাহলে তার উত্তর এই হবে বাংলা ভাষার গঠনের ইতিহাস ও পরম্পরার প্রকৃত সূত্রটি জানতে হলে এই আত্মপ্রচার সর্বস্ব যুগে চর্যাপদের প্রকৃত পাঠ আবশ্যক। ‘বৌদ্ধ গান ও দোহা’-র মুখবন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন: “এই সকল উচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্যভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাহারা সাধনভজন করেন,তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই। আমরা সাহিত্যের কথা কহিতে আসিয়াছি,সাহিত্যের কথাই কহিব।“ সাহিত্যের যে কথার দিকে তিনি আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন,তার মধ্যে কি এই দিকদর্শন নিহিত ছিল না যে,নিজেকে না প্রচার করে উত্তীর্ণ কবিতা লেখার মূল সূত্রটি সাগরপারের কোনও ধরাধামে শুধুমাত্র নয়,আমাদের দেশেও তার শেকড় নিহিত আছে।

 

অপণে রুচি রুচি ভব নির্বাণা।
মিছেঁ লোঅ বন্ধাবএ অপণা॥ ধ্রু
অম্ভে ন জানহূঁ অচিন্ত জোই।
জাম মরণ ভব কইসণ হোই॥ ধ্রু
জইসো জাম মরণ বি তইসো।
জীবন্তে মঅলেঁ ণাহি বিশেসো॥ ধ্রু
জা এথু জাম মরণে বি সঙ্কা।
সো করউ রস রসাণেরে কংখা॥ ধ্রু
জে সচরাচর তিঅস ভমন্তি।
তে অজরামর কিম্পি ন হোন্তি॥ ধ্রু
জামে কাম কি কামে জাম।
সরহ ভণতি অচিন্ত সো ধাম॥ ধ্রু

পুথিস্পৃষ্ঠা ৩৩/ সরহপাদ
রাগ গুঞ্জরী

১,২ : ভব ও নির্বাণ নিজেই রচনা করে, লোকে মিথ্যাই আপনাকে বন্ধন দেয়।
৩,৪ : আমরা অচিন্ত্যযোগী, জানি না, জন্ম মরণের রূপ, ভব-বন্ধন কী প্রকারের হয়।
৫,৬ : জন্ম যেমন,মরণও তেমন, জীবিতে ও মৃতে বিশেষ পার্থক্য নেই।
৭,৮ : এখানে জন্ম মরণে যার আশঙ্কা আছে, সেই রসায়নের আকাঙ্ক্ষা করুক।
৯,১০ : যারা পৃথিবী থেকে স্বর্গে বিচরণ করে তারা কোনওমতেই অজরামর হয় না।
১১,১২ : জন্ম থেকে কর্ম, কি কর্ম থেকে জন্ম, সরহ বলে, সে কথা এই ধর্মে অচিন্ত্য, অর্থাত্‍ এই ধর্মচিন্তার
বহির্ভূত।

 

হাঁউ নিরাসী খমণ ভতারি।
মোহোর বিগোআ কহণ ন জাই॥ ধ্রু
ফেটলিউ গো মাএ অন্তউড়ি চাহি।
জা এথু বাহাম সো এথু নাহি॥ ধ্রু
পহিল বিআণ মোর বাসনয়ূড়া।
নাড়ি বিআরন্তে সেব বায়ূড়া। ধ্রু
জা ণ জৌবণ মোর ভইলেসি পূরা।
মূল ম খলি বাপ সংঘারা॥ ধ্রু
ভনথি কুক্কুরিপা এ ভব থিরা।
জো এথু বুঝএ সো এথু বীরা॥ ধ্রু

পুথিস্পৃষ্ঠা ৩০/ কুক্কুরীপাদ।
রাগ পটমঞ্জরী

১,২ : আমি নিরাশী আমার ভর্তা ক্ষপণক, আমার অনুভব বর্ণনা করা যায় না।
৩,৪ : মা গো, আঁতুড় দেখে আমি প্রসব করলাম,যাকে এখানে বিয়োই তা এখানে নেই।
৫,৬ : প্রথম প্রসব আমার, বাসনার পুটুলি। নাড়ি টিপতে সেও হলো হাওয়া।
৭,৮ : যখন আমার নবযৌবন পূর্ণ হল, আমার দ্বারা মূল স্থাপিত হল,বপনক্ষেত্র নষ্ট হল।
৯,১০ : কুক্কুরীপা বলেন, এ সংসার স্থির। যে এই কথাটি বোঝে,সেই আসলে বীর।

 

নগরবাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ্ন সো ব্রাম্হনাড়িআ॥ ধ্রু
আলো ডোম্বী তোএ সম করিব ম সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাগ॥ ধ্রু
এক সো পদমা চৌষটঠী পাখুরী॥
তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী॥ ধ্রু
হা লো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে॥
আইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ। ধ্রু
তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর না চঙ্গেড়া।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়এড়া॥ ধ্রু
তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী।
তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী॥ ধ্রু
সরবর ভাঞ্জীঅ ডোম্বী খাঅ মোলাণ।
মারমি ডোম্বী লেমি পরাণ॥ ধ্রু

পুথিপৃষ্ঠা ১৬ / কাহ্নপাদ
রাগ দেশাখ

১,২ : নগরের বাইরে ডোম্বী তোর কুঁড়েঘর,ছুয়ে ছুয়ে যাস সেই ব্রাম্হণবালককে।
৩,৪ : ওলো ডোমনী, আমি তোর সঙ্গে সাঙ্গা করবো। আমি ঘৃণাহীন এক নগ্ন,কাপালিক যোগী।
৫,৬ : এক সে পদ্ম, ৬৪ পাপড়ি,তাতে চড়ে নাচে ডোমনী ও বহুরূপী (কাহ্ন)।
৭,৮ : তোকে সদভাবে জিজ্ঞেস করি, তুই আসিস কার নায়ে?
৯,১০ : তুই না তাঁত আর চাঙারি বিক্রি করিস,তোর জন্যে আমি নটের ঝাঁপি ট্যাগ করলাম।
১১,১২ : তুই ডোম্বী আমি কাপালিক, তোর জন্যে আমি হাড়ের মালা নিলাম।
১৩,১৪ : সরোবর ভেঙে ডোম্বী মৃণাল খায়, ডোম্বী, তোর আমি প্রাণ নিই।

 

ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দু আন্তে চিখিল মাঝেঁ ন থাহী॥ ধ্রু
ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই।
পারগামিলোঅ নিভর তরই॥  ধ্রু
ফাড্ডিঅ মোহতরু পাটি জোড়িঅ।
আদঅ দিঢ় টাঙ্গী নিবাণে কোহিঅ॥ ধ্রু
সাঙ্কমত চড়িলে দাহিণ বাম মা হোহী।
ণিয়ড্ডী বোহি দূর ম জাহী॥ ধ্রু
জই তুমহেলোঅ হে হোইব পরগামী।
পুচ্ছতু চাটিল অনুত্তরস্বামী॥ ধ্রু

পুথিপৃষ্ঠা ৯ / চাটিলপাদ
রাগ গুর্জরী

১,২ : গহণ ভবনদী গম্ভীর বেগে বয়, দুই পাড়ে কাদা মাঝে থৈ নেই।
৩,৪ : ধর্মের জন্যে চাটিল সাঁকো গড়ে, পারগামী লোক নিশ্চিন্তে পার হয়ে যায়।
৫,৬ : মোহতরু ফাড়া হলো,পাটি জোড়া হলো,অদ্বয় টাঙ্গী নির্বাণে দৃঢ় ভাবে হানা হলো।
৭,৮ : সাঁকোতে চড়লে দান-বাম হয়ো না, বধি নিকটেই,দূরে যেও না।
৯,১০ : ওহে,তোমরা যদি পারগামী হবে,তবে শ্রেষ্ঠ সাই চাটিল কে জিজ্ঞেস করো।

 

কাহারে ঘিণি মেলি অচ্ছহু কীস ।
বেঢ়িল হাক পড়অ চৌদীস॥ ধ্রু
অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়অ ভুসুকু অহেরী॥ ধ্রু
তিণ ন চ্চুপই হরিণা পিবই ন পাণী।
হরিণা হরিণীর নিলঅ ণ জাণী॥ ধ্রু
হরিণী বোলঅ হরিণা সুণ হরিআ তো।
এ বণ চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো॥ ধ্রু
তরসঁন্তে হরিণার খুর ন দীসঅ।
ভুসুকু ভণই মূঢ়া হিঅহি ণ পইসঈ॥ ধ্রু

পুথিপৃষ্ঠা ১১/ ভুসুকুপাদ
রাগ পটমঞ্জরী

১,২ : কাকে নিয়ে কাকে ছেড়ে কী যে ভাবছি, চারিদিক বেষ্টন করে হাঁক পড়েছে।
৩,৪ : হরিণ তার নিজের মাংসে নিজেরই শত্রু, ভূদুকু ক্ষণিকের জন্যও শিকার ছাড়ে না।
৫,৬ : হরিণ ঘাস স্পর্শ করে না,জল পান করে না। হরিণ হরিণীর আবাস জানে না।
৭,৮ : হরিণ হরিণীকে বলে, শোন জুয়ারী তুই,এ বণ ছেড়ে পলাতক হ।
৯,১০ : ভয়ে পালানো হরিণের ক্ষুর দেখা যায় না। ভুসুকু বলে এই চর্যার অর্থ নির্বোধের হৃদয়ে প্রবেশ করে না।

 

কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল॥ ধ্রু
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥ ধ্রু
সঅল স[মা] হিঅ কাহি করিঅই।
সুখদুখেতেঁ নিচিত মরিআই॥ ধ্রু
এড়িএউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুন্নপাখ ভিড়ি লাহু রে পাস॥ ধ্রু
ভণই লুই আমহে ঝাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পিণ্ডি বইঠা॥ ধ্রু

পুথিপৃষ্ঠা ৩ / লুইপাদ
রাগ: পটমঞ্জরী

১,২ : কায় অর্থাৎ শরীর,তার পাঁচটি ডাল। চঞ্চল চিত্তে বা মনে কাল প্রবিষ্ট হয়েছে।
৩,৪ : দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ কর। লুই বলে,গুরুকে জিজ্ঞেস করে জান।
৫,৬ : সমাধি সমস্ত নিয়ে কী হবে? সুখ এবং দুঃখে মরতেই হবে নিশ্চিতভাবে।
৭,৮ : অতএব বাসনার বন্ধন ও পঞ্চেন্দ্রিয়ের আসক্তি ট্যাগ কর। শূন্যতার পক্ষের দিকে যাও।
৯,১০ : লুই বলে, আমরা ধ্যানে শূন্যতার এই রূপ দেখেছি। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এই দুই পিঁড়িতে বসেছি।

 

সংযোজন :
চর্যাপদগুলি প্রকৃতপক্ষে গান। সেই কারণে অনিবার্যভাবে এসেছে রাগ এবং প্রতিটি পদে ধ্রুবপদের উল্লেখ। আলোচ্য পদগুলির বাচ্যার্থ ও মূল টেক্সট্‌ অধ্যাপক নির্মল দাশের ‘চর্যাগীতি পরিক্রমা’ অনুসারে করা হয়েছে। গূঢ় অর্থের ব্যাখ্যা এই কারণে দেওয়া হল না, কেননা চর্যাপদকে আমরা প্রথম বাংলা কবিতা হিসেবেই পড়তে চেয়েছি। যদিও তার নিহিত অর্থ কখনোই উপেক্ষণীয় নয়। লক্ষণীয়, চর্যার পদগুলি পড়লেই পাঠক যেন এক কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে গিয়ে উপস্থিত হন, কিংবা হয়ত ভোর না সন্ধে, বুঝতে পারেন না। এই বোঝা-না বোঝা, স্পষ্টতা-অস্পষ্টতা, অর্থ-অর্থহীনতার পরপারে দাঁড়িয়ে এই গীতিকবিতার সংকলন আমাদের প্ররোচিত করে, আহ্বান জানায়। সত্যিই আধুনিক বাংলায় এর অনুবাদ হয় না। করতে গেলে চর্যার অনুবাদ না থেকে সেগুলি চর্যার আশ্রয়ে লালিত কবিতা হয়ে ওঠে মাত্র। আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা পেরিয়ে আসা রণক্লান্ত বাঙালি কবি-পাঠক যখনই বুঝবেন, তাঁর কাব্যচিন্তনের নিগূঢ় ভাষ্যের সঙ্গে এই দলছুট অথচ শেকড়ে প্রোথিত সাহিত্যকর্মের একটি আত্মিক সম্পর্ক আছে, সেখানেই এর অস্তিত্ব, সেখানেই এর প্রসিদ্ধি।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment