বিশ্বজিৎ রায়

কবিতাযাপনঃ জেরক্সওয়ালা

সবাই যে চাকরি পাবে তা তো নয় । তবে সবাইকেই খেতে হবে । কে কীভাবে জোটাবেন তাঁর খাবার তাঁকেই ঠিক করতে হবে তা । তিনি ঠিক করেছিলেন জেরক্স করবেন । জেরক্স করে যা হয় তাতেই চলে যাবে বিধবা মা আর ছেলের । মুর্গি  কাটা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে । শেওড়াফুলিতে তখন অনেক মুর্গিওয়ালা । একজনের পর আরেকজন গজিয়ে উঠছেন । খুলছে এস টি ডি আর আই এস ডি বুথ । ফোনে কথা বলার নেশায় আস্তে আস্তে মজে যাচ্ছে পাড়া । পাড়ার মোড়ে মোড়ে বসে পড়ছে্ন মুর্গিওয়ালা ।

একটা আয়তকার খাঁচা । খাঁচার ভেতরে মুর্গি । তারা দানা খায় আর ঝিমোয় ।  সেই খাঁচার ওপরটা টিনের পাত দিয়ে ঢাকা । রোদ পড়লে ঝিকিয়ে ওঠে । ঝিকিয়ে ওঠা টিনের পাতের ওপর বঁটি । কাস্টমার এলে তলার মুর্গি কাটার জন্য ওপরে তোলা হয় । এমন একটা দোকান তাঁর পক্ষে চালানো অসম্ভব । মুর্গি সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে উঠতে পারেননি তিনি । যেমন পেরেছিলেন বাবুসোনাদা । মুর্গি কাটার সময়  বাবুসোনাদা অনেক অনেক কথা বলতেন । বাবা অফিস গেছে কি না ! মা আজ কী রান্না করল ! পড়াশোনা কেমন চলছে ? বড়ো হয়ে সায়েন্স পড়াই ভালো । চাকরির বাজার খুব খারাপ । এসব বলতে বলতে মুর্গি কাটা হয়ে যেত । ছাল ছাড়ানোর পরেও কাঁপতে থাকত সেই কিছুক্ষণ আগেও দানা খাওয়া মুর্গি ।

তাঁর দোকানটা ছিল একটা ওষুধের দোকানের পেছনে । এমনিতে চোখে পড়ত না । চোখে পড়ার মতো জায়গায় দোকানঘর পাওয়ার জন্য যে পুঁজি লাগে তা ছিল না তাঁর । মায়ের কিছু গয়না সম্বল করে দোকান ঘরের সেলামি দিয়েছিলেন ।   চোখে-না-পড়া পেছন দিকের দোকানঘর হলেও সেলামি বাবদ যা দিতে হয়েছিল তা তাঁর পক্ষে যথেষ্টই । জেরক্স মেশিনটা সেকেলে । কালি ভরার পদ্ধতি প্রাচীন । চালু করার পর রেডি হতে অনেকটা সময় নেয় । তাছাড়া শেওড়াফুলিতে একটু ভালো মেশিনওয়ালা জেরক্সের দোকান ছিল কয়েকটা, একটা ছিল খুবই ভালো   মেশিনওয়ালা । সেগুলোতেই ভিড় । ইলেকট্রিক বিল, রেশন কার্ড, বাড়ির দলিল, খাজনার রসিদ জেরক্স করিয়ে নিয়ে যায় লোকে । সেই সব জেরক্সওয়ালারা বলিয়ে কইয়ে । উদ্যোগের অভাব নেই । একজন তো জেরক্স দিয়ে শুরু করল তারপর ক্রমে রমরম করে বড়ো হয়ে উঠল । একই অঙ্গে খুলে ফেলল কত কিছু । ‘এখানে ছবি ল্যামিনেট করা হয় । ইলেকট্রিক বিল ও টেলিফোনের বিল জমা লওয়া হয়।’ শেষে এস টি ডি আই এস ডি-ও খুলে গেল । এমনকী বাড়ির ল্যান্ড-লাইন থেকে তার লাইনে ফোন করলে বাড়ির ফোনে আই এস ডি-র লাইন দিয়ে দিতে পারত । বাড়িতে বসে আমার বাবা ইংল্যন্ডে দাদার সঙ্গে কথা বলত ।

তা সবার যে এমন উদ্যোগ-উদ্যম থাকবে তা নয় । তাঁরও ছিল না । তাঁর দোকানে ভিড় লেগেই থাকত না । তিনিও একটু আধটু যা হত তাই করে চুপ করে বসে থাকতেন । দোকানঘরটা পেছনের, তাই আলো পড়ত না । কেমন নিভে  থাকত । কেবল দুপুর যখন বিকেলের দিকে ঢলে পড়ত তখন এক চিলতে রোদ্দুর এসে পড়ত তাঁর দোকানে । তিনি রোদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকতেন ।

ভিড় ছিল না বলেই আমি তাঁর কাছে যেতাম । আসলে আমি যা জেরক্স করতাম তা খুব বেশি লোকজনকে দেখাতে চাইতাম না । ভিড়ের দোকানে তাই আমার যেতে খুব লজ্জা করত । দেখলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হবে তা নয় । তবে আমার সেই ব্যক্তিগত যত কম জন দেখেন তত ভালো । ভিড়ের দোকানে গেলে আমার মনে হত সবাই আড়চোখে দেখছে আমাকে । দলিল নয়, ইলেকট্রিক বিল বা রেশন কার্ড নয়, পড়ার বইয়ের পাতা নয় । এ সব আবার কেউ জেরক্স করে না কি ! কবিতা ! তাও আধুনিক কবিতা ! আমি অবশ্য করতাম । আমার খুব প্রিয় কবিতা । বইটা হয়তো আমার নয় । ফিরিয়ে দিতে হবে । ফিরিয়ে দেওয়ার আগে জেরক্স করে রাখতাম । আর সেই প্রিয় কবিতার সবচেয়ে প্রিয় পঙক্তিগুলো লিখে রাখতাম একটা ডায়রিতে । সে ডায়রি আমি কাউকে দেখাতাম না । কবিতা জেরক্স করার জন্য আমি খুঁজে নিয়েছিলাম তাঁকে, তাঁর ওই পিছিয়ে পড়া আলো না-ঢোকা   দোকানঘরকে ।

ক্রমশ বুঝতে পারলাম তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন । কবে আসব আমি, কবে নিয়ে আসব আমার একটা-দুটো প্রিয় কবিতার বই । বইয়ের পাতাটা পরম মমতায় তিনি রাখতেন তার মেশিনে । আলতো করে ঢাকা দিতেন । কবিতার ওপর চাপ পড়ে যাতে বইয়ের বাঁধাই আলগা না হয়ে যায় সেদিকে ছিল তাঁর গভীর   নজর । বুঝতে পারতাম জেরক্স করার পর ঠিক মতো হল কি না তা দেখার ছল করে তিনি পড়েই ফেলতেন আমার প্রিয় কবিতা । তাতে অবশ্য একটুও লজ্জা পেতাম না আমি । বরং তিনিই লাজুক স্বরে বলতেন, ‘ সারাদিন কত কিছু তো জেরক্স করি কিন্তু তোমার এটা জেরক্স করে খুব আনন্দ হয় । তুমি কবিতা লেখো ?’ আমি বলতাম, ‘না।’ তবে আমি যে কবিতা পড়ি এটুকু তাঁকে জানাতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হত না । তাঁর দোকানে খুব বেশি কাগজ থাকত না । খুব বেশি জেরক্স হত না বলে খুব বেশি সাদা-কাগজ রাখতেন না তিনি । তাছাড়া খাজনার রসিদ জেরক্স করার সময় পুরো কাগজ ব্যবহার না করে যেটুকু লাগত সেটুকুই স্কেল দিয়ে কেটে আলাদা করে নিতেন  । কবিতার বেলায় অবশ্য তাঁর সংগ্রহের সবচেয়ে পরিষ্কার কাগজ ব্যবহার করতেন তিনি ।

এখন তিনি কোথায় থাকেন জানি না । দোকানটা উঠে গেছে, দোকানঘরের মালিকানা গেছে বদলে । কবিতা জেরক্স করে জমিয়ে রাখার দিন-রাত এখন  অতীত ।

আমি জানি তাঁর খবর জানে রোদ্দুর, তাঁর খবর জানেন সূর্য । সূর্যই তো টহল দেন চরাচর । সূর্যের আলো পড়েই ঝিকিয়ে উঠত বাবুসোনাদার বঁটি । আর বাবুসোনাদা  কথা বলতে শুরু করতেন – অজস্র কথা । সে-কথায় ঢাকা পড়ে যেত মুর্গির রক্তের দাগ । সূর্যই তো ঘুরে যেতেন বিকেলবেলায় তাঁর একলা জেরক্সের দোকানে । এখনও তাঁর খবর রাখেন সূর্য । জানেন কীভাবে দিন কাটে তাঁর, জানেন কীভাবে তিনি জোটান তাঁর খাবার ।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment