অনুরাধা বিশ্বাস

একটি পাহাড়ের মুখোমুখি

*
দুই হাত জড়ো করে, পাহাড়, এই বসলাম। এখন ভয়ের সুগন্ধ নেই মালতীলতায়,
তবু আমার প্রাণ এই রাখলাম একজোড়া চেরিফলের মতো। বিরাট পাথরের আকার
তোমার হৃদয় হতে দুটি জলের ধারা, একটু ভিজে পাতার সুবাস পাওয়া যেতে পারে –
স্থানীয়রা এমনই বলেছে। বলেছে একটি পাখির হৃৎস্পন্দনের মতো ছোট সামান্য
উচ্ছ্বাস, মরমী গাছের শ্লেষ্মার মতো ব্যথা , এইসব কথা বলতে বলতে মেঘ নেমে আসবে
জলপ্রপাত হয়ে। ত্রিভুজের মতো বাড়ির চিমনি হতে এগিয়ে আসবে ঘন্টার শব্দ।
আর আমি এ সমস্ত হতে দেব আমার শ্লেষ্মা, শ্লেষ, অস্ট্রিচের গলার মতো সরু বেদনা
এই দুটি চেরিফলে রেখে। কিন্তু এখন ভয় নেই, তিক্ততা নেই হাসিতে, লালায়।
লম্বা ঘাসের মাঝে বসে শুনি কাছের চ্যাপেলে এক বিয়ের পার্টি, তাদের
পোশাকের আলো, হাসির চকমকি। নিজেকে দুইহাতে জড়িয়ে ঘাসের মাঝে আমি
শুয়ে পড়েছি। ওঠার তাড়া নেই। বুঝি, গড়িয়ে যায় একখানা পিতলের গ্লাস মেঝেময়।
এই পীড়াপীড়ি আর দুটি বাদাম, একটা ঘাড়ভাঙা জলের বোতল – খুব বড় খোসার মত এক
অস্থায়ী বাড়ির কল্পনা জাগে, তার জানালায় কার দেহের বয়াম জুড়ে একটি জোনাকি পোকা
উড়ছে টের পাই। চোখ বুজে, পাহাড়, এইখানে বসেছিলাম তোমাকে কত কী বলব বলে!
এইবার
সামান্য হৃদ্‌স্পন্দের সুখ, সংগ্রহের হালকা চাদর ও লালফল নিয়ে ফিরে যাব।

*
শ্যাওলাজড়ানো ক’খানি টিলা ঢুকে পড়েছে ভাড়াবাড়িতে। তাদের
ল্যাংটো সবুজ হাসির ওপর উড়োজাহাজ যায়। তাদের পিঠের ওপরে
বিস্তীর্ণ ডানার মত যে আকাশ – অর্থাভাবে কাতর হলে
আমাদের ঠাকুর সেখানে বেলুনে চড়ে বসেন । লাল হলুদ কমলা বেলুন
বিকট জেলিমাছের মতো আকাশ শাসন করলে গুটি গুটি শৈশব ফেরে,
আনন্দ ফেরে আমাদের। দুটি টাকার বিনিময়ে ভাজা মালপোর কিটকিটে
মিষ্টিতে জিভ ভারি হয়। অন্নকণা চাটতে চাটতে
আমরা তাকে দেখি,তার অশ্রু-বিরাগ ও যন্ত্রণা দুরন্ত ঝর্ণার বেগে নেমে
আসে পাহাড়ি হাইড্রেনে। এখানে দারুণ গরম, চুলের গভীরে নতুন শিরা
জন্মাবার মত ঘাম গড়িয়ে নামে। জামার সাথে পাঁজর আটকে যায়, পাঁজরের
সাথে পুরনো ক্যাশমেমো, ঠাকুরের লকেট। ছাপা, স্বচ্ছ ও জংলা হয়ে পড়েছি।
গিঁট বাঁধা পর্দায় আমাদের হাওয়া স্বচ্ছ হয়ে পড়েছে। পাতা পচা সুড়ঙ্গ হয়ে পড়েছে
একটি বিশ্বাসযোগ্য সুবাস।
চারটি কাঠের ঘোড়া ও দুটি ঝিনুকের পাখি গোছাতে গোছাতে
আঙুল বেঁকে গেল। আনন্দকে জানাই, আহত হলে
নখের ভিতর বুনোফুল জন্মায় আর অপমানের ক্ষত হতে এক দুটি মৃদু পাহাড়
*
বড় বেশি তিক্ত হয়ে উঠেছে লালা, ওগো ঢালুজমির সিমেন্ট বাঁধানো দেবতা,
একখানা উপায় দেখাও। মিষ্টি ফলের শ্বাস ভরে দাও আমাদের দুঃখের গানে।
কচুবন ও চন্দ্র-সম্মোহনের রাতে, আমরা ক্লান্ত
বানরের মত আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছি। আমাদের অন্তর্জ্বালা ভীতু কুপির মতো
জ্বলছে, বিনীত শোক হাই তুলছে মুখ চেপে। এ সময়ে ঘন্টা বাজে চ্যাপেলে,
দুটি দিশি কুকুরকে প্রকৃতির দিকে টেনে নিয়ে যায় বড় বড় মানুষ।
একটি মিষ্টি জলের নদী, যার হাওয়ায় বুকের ভিজে শ্যাওলাভাব, তাকে
হাঁটুজলে পেরিয়ে আসছেন যুবক পিতামাতা। নীরোগ ও কাচা কাপড়ের মতো
উজ্জ্বল। এই অসামান্য মিথ্যে অঞ্জলিতে দুটি তেলাকুচো ফলের সঙ্গে, অন্তরের
পাখিটির ঠোঁটে ধরে রেখেছি। মানালি শহরের রূপোর আকাশ ভেঙে পড়ছে –
গায়ে এঁটে যাচ্ছে তবকের মতো। সেখানে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল;
পুজোর ছুটিতে, পিতামাতার কোলে কাঁখে, একখানি পুটুলি আর হাতপাখার মতো।

*
দুটি সন্ধের হাঁটা আমরা একবারে হেঁটে ফেলেছি। বৃষ্টির একটু আগে, যখন
সামান্য পিছিয়ে, পোয়াতি কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছি, তুমি এই দোতলা
বাসের মতো পাহাড়টিকে দেখালে। অমন খর্ব দেহ নিয়ে কী ঘৃণা তার
নিজেরই পাহাড় পরিচয়ে – উপরন্তু রুগীর প্রস্রাবের মতন এক খাঁড়ি তাকে
বেঁধে রেখেছে সমুদ্রের সাথে। যাত্রীবোঝাই দুটি মিনিবাস পাখির মত এক
অপূর্ব গতিতে আমাদের অতিক্রম করলে স্পষ্ট হল নীলফুলের ঝোপ।
এখন ভাঁটা, ফলে রহস্য ফুরিয়ে নিরেট হয়ে পড়া বোট, একটি তোয়ালে
ও জলের বোতল আর দোতলা পাহাড় কী কথা বলবে বলে
দুটি কাঁকড়ার দিকে চেয়ে রয়েছে। ওদের ক্ষুদ্র প্রাণ, ছোট দাঁড়া কেমন
অপূর্ব লেগেছিল আমাদের। ভালো লেগেছিল সমুদ্রের প্রমাণ, হাওয়ার
লোনা আঠা। দেখেছিলাম দেবদূতের মতো ফুটফুটে একটি
আলোকস্তম্ভ উঁচু গাছেদের সঙ্গে দোল খায়। খাঁড়ি বয়ে একটি চটি, চিপসের সোনালি
প্যাকেট সমুদ্রে পৌঁছেছিল।

এসমস্ত সত্যি দেখেছিলুম কিনা বলা যায় না।
নীল ফুল আর আলোকদন্ড, আমাদের ক্লান্তি থেকে ছুটে বেরিয়েছিল
সম্ভবত মিনিবাস আর বাদুড়ের মতো প্রচন্ড যাত্রীরা ।

বেঁটে খাটো পাহাড়টিকে আবারও দেখেছি। বৃষ্টির একটু আগে, যখন
সামান্য পিছিয়ে, পোয়াতি কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছি।
এ অঞ্চলের সূর্যের মতো তার আত্মকরুণা নোনাধরা, অস্পষ্ট। তবু সত্যি তাও।
সত্যি তার পাহাড় জীবন আর মাংসল ও অমর একটি সুতো সমুদ্রের।
সত্যি এই বুনোফুলের বাহার, লাল কাঁকড়া, পোষা কুকুরের গোঙানি।

*
যা মিথ্যে নয় আর যা সত্যিও নয় এমন একটি নদী ভেঙে গিয়েছে।
পাথরে, পাহাড়ে এক ফলের সবুজ শ্লেষ্মা। কুঁজো হয়ে সন্ধের দিকে
চেয়ে ছিলাম – গুঁড়ো সাবানের সৌন্দর্য পাড়ার ছাদে ফ্যাকাশে
ফুলের মতো ফুটেছে। লোম ওঠা কালো ঘর – তার হলুদ কেন্দ্রে এক কুঁজো
ও ব্যর্থ উটপাখি বসে থাকে- ধূপ জ্বলে। তাকে দেখি; পাখার আওয়াজের ভিতর
তার অমসৃণ স্বরের কল্পনা ঘোরে। এসময়ে একটি মিনিবাস আমার সমস্ত
মনোবল ছোঁ মেরে বলে যায় – এমনই তো হওয়ার কথা। ছোটদিদার স্বপ্নে
এই পাখি ছিল। ঝাউগাছের লোমশ টাউনে মোটা পাহাড় থুবড়ে পড়েছিল
এক ভাঙা নদীর মুখে। কত কত বিড়াল, কাগজের প্লেটে তাদের অর্ঘ্য, ধূপ, জল।
কালপুরুষের বেল্ট থেকে একটি তারা বুঝি নিভে গিয়েছিল।
ছোটমাসি তখনও টাঙ্গাইল পড়েন – চুল কম।
একঘর লোকের মাঝে মায়ের মুখ মনে করে কেঁদে উঠেছিলেন।

*
জড় ভবিষ্যতবাণীর মত একখানা মেরুণ আলমারি আমরা তুলে এনেছি
ঘরে। এই আলমারি আসবে এ কথা চাতকের গল্পে লেখা ছিল। নক্ষত্রেরা
সরে সরে যেতে যেতে একথা জানিয়েছিল তোমাকেও, যখন ভীমের পায়ের
মতো এক মেঘ এসে পড়েছে বাসস্টপে। পিতামহ লিখেছিলেন –
আমাদের নখে দুটি ফুল গজাবে বলে কারোও একটি আঙুল বাদ যাবে;
আমাদের গলায় দারুণ সুদৃশ্য তেলতেলে এক পাতা জন্মাবে বলে
নাক খসে যাবে দু’চারখানি মর্মর মূর্তির। পালিশ উবে হওয়া, খসখসে কল্কার
এই মহৎ জীবটিকে তারাই রেখে গিয়েছে নদীর কিনারে। থলেবন্দি
মাছের কাঁটারা বড় লোভী, বড় দুঃখী ওই কুয়াশা পরিহিত মানুষের বস্তা।
কীটের প্রজনন দেখবে বলে বাতাসে মাটি গুলে দিয়েছে ক’টি তরুণ বৃক্ষশাখা।
আমাদের বুকে খুসখুসে বালি ঘুরেছে, একটি গোপন বেদনা আলুর মত ফুটে
উঠেছে কপালে। সমস্ত অতিক্রম করে দাঁত উঁচু টেবিলের অঙ্গভঙ্গিতে
আমরা এই দৈবী আলমারি বয়ে আনতে পেরেছি। গ্রাম্য চ্যাপেলে যেন ফের
দেখা হল আমাদের। আলমারির ভিতর বসে পড়ল গানগাইয়েরা, কামিজ
আর বালাপোষের ভাঁজে অন্তরজ্বালা ও উদরবিভ্রাট ভুলে হেলান দিলেন
গৃহদেবতা। তার দেহে সাদা চন্দনের শ্যাওলা, তার হাসিতে বছর ত্রিশের অনিদ্রা।
আলমারির আগমনে আমাদের অনিদ্রা ঘুচেছে। চোখের পাতায় জেগে
উঠেছে মহাপদ্ম, দুর্দান্ত পালিশের ঘ্রাণ, পুষ্পলতিকার দৃঢ় বাদামি কল্কা।
পিতামহ দেখেছিলেন, আমাদের চোখে দুটি স্ফটিক জন্মাবে বলে, নদীতীরে
কুঁজো হয়ে হিসি করতে বসেছে পাথরের মূর্তিরা। চন্দ্রের শরীর দীর্ঘ হলে তাদের
হাঁটু কাঁপে, দাঁতে ব্যথা হয়। জোয়ারে ভেসে আসা লাল কাঁকড়ারা তীব্র করমর্দনে
তাদের কুশল অনুমান করে।

*
আনন্দ, সেই কবে লিখেছিলে – তোমার ভিতর ঐ যে যুবা ধীবর আর ঐ তার
কাঙ্ক্ষিত মাছ, অধীরযৌবনা – ওদের কাউকেই তুমি বাঁচাতে পারবে না।

তা না পারো, দ্যাখো, চুরি করা এই একটি স্বপ্ন বাঁচিয়ে বিষণ্ণ
ঝড়ের রাতে আমরা ময়দার গুলির মতো নরম হয়ে ঘুমোতে পেরেছি।

পশুর মাথার মতো দীর্ঘ গাছের দেহগুলি – হাওয়ার ভিতর কী দুর্বল প্রতিরোধ
তাদের; সমুদ্র দুর্দান্ত সাপের মত ফণা তুলেছে, কুমিরের মত উঠে
এসেছে ঘরে। বার্লির পাত্রের ভিতরে ডুবে আমরা ঘুমোতে পেরেছি
পেকে ওঠা ফলের রাতে।

ফলের শরীর ভেঙে একটি বীজ কীটের আকার নিল।
জানালা ভেঙে ঢুকে পড়ল বিদগ্ধ শত্রুর তীর, বৃষ্টি।

আনন্দ, একটি ট্রলারের কথা লিখেছিলে –
লিখেছিলে বর্ষার খেয়া ঝড়ে ঝাপটে একটি অস্পষ্ট সাদা রেখার মত ক্ষুদ্র হয়ে চলেছে।
আমাদের দৃষ্টি মগ্ন হয়েছে ঐখানে।

*
এক বিষণ্ণ জ্যোৎস্নার সর পড়েছে তোমার চোখে – এই বলে আমি মিথ্যে
হেসে উঠি, আর উজ্জ্বল হয় চিনেপাড়া। সাদা মেলনের জেলি, যথেষ্ট
পাক দিলে তার ধোঁয়ায় একটি জেট বিমানের লেজ দেখা যায়, লম্বা
সারসের ঢেউ, ক্রীম রঙের কটনের শাড়ি মেলে দেওয়া হয় আকাশের ওপরে।
জেলির কিটকিটে মিষ্টি গন্ধে আমাদের অসম্মত হৃদয় বোঁ বোঁ করে। ফুলের
অনুগ্র শোভা সেখানে পৌঁছয় না। বাতাসের সামিসেন বাজে না চাপাত্রে, গেলাসে।

*
আমার দুর্দান্ত ঈর্ষা ফুটে আছে ক্ষণজীবন ফুলে। মানুষের
আকার হেঁটে গেল একটি বার্চ হতে অন্য ম্যাপেলে। বুড়ো শিশুর
মত লালাসিক্ত তন্দ্রায় আমরা দেখি মানুষের আকার, তার টেবিল,
গেলাস হেঁটে যায়। একটি লতা, তাকে হাওয়ায় কাঁপতে দেখে মনে
হয় এক বৃহৎশরীরের অদৃশ্য জীব শ্বাস নিচ্ছে। তার শীতযন্ত্রণাকে
উপেক্ষা করতে পেরে – অবজ্ঞার রূপ ঝরে পড়ল দুটি ওকফলের গায়ে।
চাকরি চলে যাওয়ার পরে, আনন্দ, তুমি জানিয়েছিলে,
প্রকৃত নিষ্ঠুর হতে পেরেছ। প্রিয় পাখিটির ক্ষুধা তৃষ্ণা অতিক্রম
করে দেখেছ নিজেরই সাদা হাসি গোল হয়ে বসেছে বরফের স্তূপে।
নিজের সৌন্দর্যের সামনে আমিও কদর্য ভঙ্গিতে বসে থাকি, সেই তখন
থেকে যখন পীড়া হতে পাতা জন্মাল, করুণার খোসা খুলে বেরিয়ে পড়ল লালাজীর্ণ পোকা।
দুই প্রিয়জনের মৃত্যু হল সেবছর ; একটি চামড়া ফাটা হাতব্যাগ আর
একটি পাঁচতলা বাড়ি আমাকে পরিত্যাগ করবার পরে ছাতা খুলে
হেঁটে গেল পরাক্রমী ঋষিতাপসের মতন। জলে তাদের পা ভিজল না।

*
দুটি শেষ না হওয়া কথায় আমার স্বস্তি।এই যে পাখির লাল গলার মতো ক্ষোভ ও দুঃখ
না বলেই ফিরিয়ে এনেছি, কাপড়ের ব্যাগে তার জ্যোতি দেখি – যেন এক দুর্দান্ত মাছ
আমারই না-বলাটিকে ধারণ করে উজ্জ্বল হয়েছে। একটি স্রোত তার দেহের স্মৃতিতে
খলবল করে। একখানা খেলনা পাহাড়, বুকের ভিতরে বেঁধে দিয়েছ।
মনে হয় অল্পঘুমে ডুবে যেতে পারি। জেগেই আছি। ভেবেছি বালতিভরা একখানা
ঢেউ এর কথা – অনেক বছর আগে প্লাস্টিকে মোড়া একমুঠো ঝিনুক, হোটেলের সাদা চাদর
ও ঘোলাটে টেবিল ল্যাম্প উড়ে বেড়ায় ঘরে। শুকোতে দেওয়া হাওয়াভরাট জামা, এখন
তার বড় শ্রোতা হবার ইচ্ছে – অথচ দুটি অসম্পূর্ণ বাক্যের করুণায় আমি দাঁড়িয়েছি
সন্ধের বাঁকানো ঠোঁটের কাছে, একটি পাহাড়ের মুখোমুখি।

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment