সঙ্ঘমিত্রা হালদার

সুখ নেই, দুঃখও নেই

নিজের আত্মজীবনীমূলক বই ‘অক্ষয় মালবেরি’তে জীবনের প্রথম স্মৃতির অনুভূতি নিয়ে বলতে গিয়ে লিখেছেন– ‘পরিত্যক্ত থাকার কষ্ট এবং অসহায় ক্রোধ—এই দ্বৈতই বোধ হয় আমার সারা জীবনের সারসংকলন।’ তিনি মণীন্দ্র গুপ্ত। এই পরিত্যক্ত থাকার কষ্ট, অসহায় ক্রোধের অভিমুখ নিজে হাতে তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। পরিণত করেছিলেন মিত্রশক্তিতে। পজিটিভ এনার্জিতে। তাঁর ‘হয়ে ওঠা’য়, তাঁর কবিতা আর গদ্যের মন ও ইন্দ্রিয়ের সর্বাত্মক ব্যবহারে। নিজের মধ্যে এক ‘আমি’ হয়ে ঢুকে, বহু ‘আমি’ হয়ে প্রবেশ করে তিনি নিজেকে দূর থেকে দেখার আশ্চর্য কৌশলটি রপ্ত করেছিলেন। যেকোনও দেখায়—দেখার প্রয়োজনীয় দূরত্বটি অবিচল রাখতে পেরেছেন তিনি। জীবনের নানা গলি- চোরাপথ- পথ হারানো-পথ করে নেওয়ায় তিনি উপনীত হয়েছিলেন এক সরল ও কঠিন বিশ্বাসে— আসলে সুখও নেই, দুঃখও নেই। তাই তাঁর কাছে—

 
                       কবি শুধু আত্মপ্রদর্শক নয়, সে দুরারোগ্য নার্সিসিস্টও—মনোরোগী। সেই          
                   অমানবিক, বিকলাঙ্গ নার্সিসাস সারাদিন জলের আয়নার সামনে ঝুঁকে থেকে
                   সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যায়, আরও বেশি খেদ আর ক্ষোভ সঙ্গে নিয়ে। জল ছায়ায়
                   ভাসিয়ে তার বিকৃত মুখকে কোমল করে এনেছিল কিন্তু সে দেখেনি।   
                   বাতাসের শব্দ, ঘাসপোকার গুঞ্জন; ঝাঁঝির মধ্যে ছোট্ট ফ্লুরেসেন্ট মাছের 
                   বিস্ময়শব্দ সে শোনেনি। একটু যদি সে নিজেকে ভুলতে পারত!  
                                                                    (চাঁদের ওপিঠে)

মণীন্দ্র গুপ্ত’র আত্মজীবনীমূলক বই—‘অক্ষয় মালবেরি’ এবং কবিতা ভাবনা বিষয়ক বই—‘চাঁদের ওপিঠে’ কারণে-অকারণে একাধিকবার পড়েছি। পড়তে গিয়ে একসময় মনে হয়েছে একটা বই-এর শব্দ-পংক্তি-অক্ষর অপর বই-এর শব্দ-পংক্তি-অক্ষরকে কী এক অলীক টানে আকর্ষণ করে চলেছে। এ যদি এক পা হাঁটে, তো সে চেষ্টা করেছে বাকিটা হেঁটে ফেলতে। এই দুটি বই-এর একটা উভমুখী যাত্রা আমি টের পাই ভেতরে ভেতরে। একটিতে তাঁর হয়ে ওঠা, অন্যটিতে তাঁর কবিতার হয়ে ওঠা। তাঁর গদ্যের হয়ে ওঠা। একদিকে তাঁর ‘পরিত্যক্ত হওয়ার কষ্ট এবং অসহায় ক্রোধ’ ছিল বলেই অন্যদিকে সর্বক্ষণ ক্ষোভ–কষ্ট-বিরক্তির আত্মপ্রতিকৃতি তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করেছেন। প্রয়োজনে সেই আত্মপ্রতিকৃতি ভেঙেছেন। রেশমকীটের মতো। ছোটবেলায় বই-এ পড়া দুটো বাক্য তাঁর রক্তের গভীরে শিকড় গেঁথেছে। প্রথম বাক্য—গাছপালা কীটপতঙ্গ-পশুপাখি সবার মধ্যে নিজেকে দেখা। দ্বিতীয় বাক্য—নিজের মধ্যেও অনুরূপভাবে সবার উপস্থিতি টের পাওয়া। আর তাই এই নীল গ্রহটাকে এত অনুভূতিময় করে দেখেছেন তিনি—

যতটুকু না হলে নয় ততটুকু, যতটুকু না হলে নয় ততটুকু—এইভাবে খুদে খুদে হাতে একটু একটু নিয়ে, একটু একটু দিয়ে, পৃথিবীকে বিরক্ত না করে এতদিন কাটল। ছবি আঁকার সময় মিনিয়েচারের থেকে একটু বড় আঁকি। লিখবার সময় ছোট ছোট বই লিখি—একটি একটি শব্দ ভেবে সময় কাটাই। বেশ লাগে। পৃথিবীর আলোবাতাসের সঙ্গে শব্দগুলি কেমন দোয়েলের মতো, চড়ুইয়ের মতো, কাচপোকার মতো মেশে, দেখি। বেশ লাগে। … আমি কি পাহাড়ের বাঁকে অজন্তা এলোরা বানাতে পারতাম? অসম্ভব। আমি উদয়গিরির চেয়েও অনেক ছোট একটি গুহা বানিয়ে ছেড়ে দিতাম। সেখানে বসে মেঘে-বর্ষায় বৃষ্টির রেখা, শীতে অস্তমান সূর্যের রেখা দেখতাম।(অক্ষয় মালবেরি)

এই যতটুকু না হলে নয়, ঠিক ততটুকু নিয়েই তিনি তাঁর কবিতা ও গদ্যের ভুবনটিকে আক্রান্ত করতে চেয়েছেন। শব্দকে মেশাতে চেয়েছেন কাচপোকার মতো, দোয়েলের মতো, চড়ুইয়ের মতো, পৃথিবীর আলোবাতাসের সঙ্গে। আপাত গদ্যের চলনে তিনি রোপন করতেন কবিতার প্রাণ। সঞ্চার করতেন কবিতাক্রান্ত ঢেউ। তাঁর কথায় কবিতা ‘প্রচন্ডভাবে জীবিত’। জীবিত বলেই সে অন্যকে সংক্রামিত করতে পারে। যে কবিতা অন্যকে সংক্রামিত করতে পারে না সে কবিতা মৃত। কবিতার জীবনধর্ম অন্যের মধ্যে কিছু একটা সঞ্চারিত করে। কী সঞ্চারিত করতে পারে একটি কবিতা? হয়ত বিরহের মৃদু উচ্চারণ, আনন্দের স্মৃতিবাহিত অনুভূতি, হয়ত কষ্টও। তারপরই মনে পড়ে তাঁর সেই চেতাবনি—দুঃখও নেই, সুখও নেই। তাহলে কী আছে? উত্তর মেলে তাঁর লেখাতেই—সম্বিৎ। কিংবা অভিজ্ঞতাবাহিত স্মৃতি, স্মৃতিবাহিত অনুভূতি। অর্থাৎ একটা কবিতা পড়ে একটা চেতনায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া। কিংবা, স্মৃতিবাহিত কোনও অনুভূতিতে নিজেকে হঠাৎ আবিষ্কার করা। তাই কবিতাটি পড়ার আগের মুহূর্ত থেকে কবিতা পড়ার পর-মুহূর্ত এত পৃথক হয়ে যায়। অন্তত যেতে পারে! কবিতার এই জীবনীশক্তি তাঁর কাছে বিশুষ্ক পদ্মবীজের মতো। যা হাজার বছর পর অনুকূল পাঠকের মানসভূমির আলো-জল-বাতাস পেয়ে বিকশিত হয়। সপ্রাণতা ফিরে পায়। তার পুনরুজ্জীবন ঘটে। এই পুনরুজ্জীবনের কথা বলতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত ইয়েটস ও ম্যাক্স প্লাউম্যানের হাতে উইলিয়াম ব্লেকের এবং এলিয়েটের হাতে জন ডান-এর পুনরুজ্জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেইসঙ্গে আক্ষেপও করেছেন বিদেশ থেকে এই উদাহরণ ধার করতে হল, বাংলা সাহিত্য থেকে এরকম উদাহরণ দেওয়া গেল না বলে।

কাগজস্থ হওয়াকে কবিতার জন্ম বলার ঘোর বিরোধী তিনি। লেখার আগে তার অবয়ব যখন মানসলোকে আস্তে আস্তে পেকে উঠছে, অবয়ব পাচ্ছে—সেই রসায়ন প্রক্রিয়া তাঁর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনও তাৎক্ষণিকতাকে তিনি বর্জন করতে চেয়েছেন। তাই তাঁর কবিতায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্থান নেই। খুব দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন—অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংলগ্ন থেকে কবিতা লেখা যায় না। আরও স্পষ্ট করে বললে কবিতা প্রাথমিকভাবে অভিজ্ঞতা থেকেই আসে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে দূরত্বও অর্জন করা চাই। এইমুহূর্তে যা অভিজ্ঞতা, পরমুহূর্তেই তা স্মৃতি। বা অভিজ্ঞতাজাত অনুভূতির স্মৃতি। আর একটা মুহূর্ত-সময় পেরিয়ে অভিজ্ঞতা যখন স্মৃতির ঘরে টোকা দেয়, সে আপনা থেকেই তার রঙ-রূপ কিছুটা পালটে নেয়। সে আর তত লৌকিক, তত প্রত্যক্ষ থাকে না। স্মৃতির এই রঙ-ছোপ, বর্ণচোরা স্মৃতিই তাঁর কবিতার জন্মবীজ। তাঁর কবিতায় ইন্দ্রিয়ের একক উপস্থিতি নয়, সকল ইন্দ্রিয় সমস্বরে কাজ করে। জগৎ ও জীবনের, ব্যক্তি ও বস্তুপৃথিবীর সঙ্গে ইগোর সংঘর্ষে অভিজ্ঞতাকে নব নব রূপে পল্লবিত হতে দেখেন। সেইসঙ্গে সকল ইন্দ্রিয়কে খাটিয়ে খাটিয়ে সমগ্র ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারকে ধারালো তরবারির অগ্রভাগ করে তোলেন। করে তোলেন সূক্ষ্ম- সংবেদনশীল। পৃথিবীর ভিতর রপ্ত করেন আরেক পৃথিবী। তাঁর কবিতার পৃথিবী। যা প্রত্যক্ষ। তবু তার ভেতরেই থাকে অপ্রত্যক্ষের খোঁজ। আলোর উৎস এক, তবু তার ব্যবহার পৃথক।

তবে কি তিনি কবিতার কাছে ‘সোনার পাথরবাটি’র মতো কিছু অযৌক্তিক দাবি করেছিলেন? যদিও সবাই প্রায় জানেন, এবং আমার থেকে অনেক বেশি সুনিশ্চিতরূপে জানেন, তাও একবার মনে করিয়ে দিই- কবিতার যুক্তি, তার নিজস্ব যুক্তি। তাকে বুঝতে চাওয়া নয়, উপভোগে যেতে হয়। যাইহোক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মণীন্দ্র গুপ্ত’র কবিতা বা কবিতাক্রান্ত গদ্যের ভুবন কি এই জল-মাটি-আলো-হাওয়ায় রসস্থ নয়? তাঁর কবিতা ও গদ্যের ভুবনটি কি স্বতন্ত্র কোনও ভুবনে, সমস্ত সংস্রব এড়িয়ে হিমালয়ের মতো শিখর-প্রত্যাশী? একেবারেই না। এই জল-হাওয়াতেই পুষ্ট তাঁর লেখা। বরং অনেকবেশি বাস্তবসম্মত কবিতার কাছে তাঁর দাবিদাওয়া। তিনি তাঁর কবিতার পোশাকে কিংবা নগ্নতায় চোরাস্রোতের মতো বইয়ে দিতে চেয়েছেন রহস্যময়তা। বারবার কবিতার স্বধর্ম হিশেবে চিহ্নিত করেছেন সেই রহস্যময়তাকে। যে কবিতা একবার পাঠে পুরোটা পড়া হয়ে যায়, তার কোনও অবশিষ্টের ভার বা সম্বিৎ-এর কিছুটা আয়োজন থেমে থাকে না, আরেকবার পড়ার আকুতি জাগায় না– সেই কবিতাকে তিনি কিছুতেই ‘জীবন্ত কবিতা’ বলে মেনে নিতে পারেন নি। এখানে আমি উৎপলকুমার বসু’র সঙ্গে তাঁর মানস-সাযুয্য টের পাই। হে পাঠক, একটু ভেবে দেখুন তো, বিদ্যাপতি বা চন্ডিদাসের পদগুলো যদি এক একবার পাঠে একেকরকম অভিজ্ঞান-আর্তি-বেদনা-পুলক না নিয়ে আসত, একেকবারের স্পর্শে যদি তারা একেকরকম শিহরন-সম্বিৎ না এনে দিতে পারত– তাঁদের মৃত্যুর কয়েকশ’ বছর পরও এভাবে ফিরে ফিরে যেতাম সেইসব কবিতার কাছে? আকাশকুসুম নয়, কবিতার কাছে আসলে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত দাবিই করেছেন তিনি, সচেতনে, সুচেতনে। আজকের দিনের কবিতা কেমন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন, তাঁর স্বকীয় কৌশলেই—
‘কবিতা যার একদিক অনির্দেশ্য অনির্বচনীয়কে স্পর্শ করে আছে, সে কেমন হবে, কেমন হওয়া তার উচিত, এমন কোনও ফরমান জারি করা করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তবু প্রারম্ভিকভাবে এটুকু বলা যায়, কম্পিউটার, গাইগার কাউন্টার, পরমাণবিক বোমা, মঙ্গল চাঁদ শুকতারায় যাবার হাউই ও জাহাজ যে সূক্ষ্ম, নিপুণ, সংবেদনশীল, নির্ভুল, প্রলয়বীর্য, অনন্তভেদী, অমোঘলক্ষ্য ধ্যানের ফল, আমাদের কবিতাকেও যেতে হবে সেই পথে। এ কথার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আমি কবিতার মধ্যে কিছু সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতির লোহালক্কড় বা নাড়িভুঁড়ি বা কিছু বৈজ্ঞানিক সমীকরণ ভরে দিয়ে তাকে এক মহাপন্ডিত রোবট বানাতে চাইছি। আমি চাইছি তার আত্মা হোক অনন্তসম্ভব, আর সেই অনুযায়ী তার দেহ হোক নিখুঁতগঠন।’ (চাঁদের ওপিঠে)

তিনি জানতেন, সব লেখা কখনওই কবিতা হবে না। তাই দিস্তা দিস্তা লিখে শব্দের দূষণ নয়, বরং লোকচক্ষুর আড়ালে সেইসব না-হয়ে-ওঠা লেখাদের নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলেন। সত্যি, অন্তত এটুকু মোহমুক্তও যদি আমরা হতে পারতাম নিজেদের কাছে, লেখার কাছে এটুকু দায়বদ্ধও যদি হতে পারতাম! যদি হতে পারতাম, সেই বাংলা কবিতার চেহারা কেমন হত? উত্তর তিনিই দিচ্ছেন- বর্তমান বাংলা কবিতার লাইব্রেরি সেক্ষেত্রে একটিমাত্র আলমারিতে গিয়ে ঠেকত!

কবিতার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ মোহমুক্ত ও বাস্তবধর্মী। কবিতা তাঁর কাছে কেবল সুন্দরের সংগ্রহ নয়। বা তিলতিল করে জমানো তিলোত্তমাও নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন কবিতায় তিলোত্তমার ঠোঁটের তিলটি যেমন দরকারি, পায়ুর ছিদ্রটিও ততটাই দরকারি। এই বাস্তবসম্মত দৃষ্টি তাঁর জীবনকে দেখার ধরনও বটে। একসময় খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান নিয়ে চিন্তা করতেন। অ্যাকাডেমিক পড়াশুনায় ততটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারবেন না বুঝে ভাবতেন ৩৬৫ টা যদি কলা গাছ পোঁতা যায়, তাহলে রোজ এককাঁদি কলা পাওয়া যাবে। যার কিছুটা খাবেন, কিছুটা বিক্রি করে জীবনের বাকি প্রয়োজন মিটে যাবে। আসলে জীবনের দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন চিন্তা করেছেন, তেমনি কী জীবন কী কবিতা—সবকিছুর প্রতি সমগ্রের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছেন। তাই গোটা কবিতার কেবল একটা বা দুটো লাইন তুলে নিয়ে সুখী বা দুঃখী হওয়ার ঘোর বিরোধী তিনি। ‘রসাত্মক বাক্যই কবিতা’—ভারতীয় কাব্যতত্ত্বের এই কথাটিকে তাই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন নিখুঁত মুন্সিয়ানায়—একটি কবিতার সব বাক্য কখনওই দ্যোতনা আনে না। তাহলে কি যে বাক্যগুলো দ্যোতনা আনে না, সেগুলো অকবিতা? তাঁর মতে রসাত্মক বাক্য একটা ফাঁদ। যে ফাঁদে বাণভট্ট ধরা দিয়েছিলেন। তাই কেবল রসাত্মক বাক্য নয়, গোটা কবিতাটা কীভাবে রসাত্মক হয়ে উঠতে পারে—সেইদিকে ছিল তাঁর ঈগল দৃষ্টি।

নার্সিসিস্ট কবিদের প্রতি যে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন, তার আবহেও ছিল এই বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ যদি সততই নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে, নিজেকে একটু ভুলতে না পারে, তার উপরে ক্রিয়াশীল পৃথিবীর অভিকর্ষের প্রতি সে সাড়া দেবে কীভাবে? অর্থাৎ আমাকে যদি তোমার দিকে যেতে হয়, আমি’কে তো খানিকটা ভুলতেই হবে আমাকে! নাহলে তোমার আকর্ষণ- তোমার ক্রিয়া আমি টের পাব কীভাবে? তাঁর মতে নিজেকে কিছুতেই ভুলতে না-পারা অতি স্বাভাবিক শক্তশাঁস মানুষেরা কবি হতে গিয়ে স্রেফ ন্যাকামি শিল্পের চর্চা করেন। তাই যাঁরা একসময় নামী পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন সেইসব রথীকান্ত ঘটকচৌধুরী বা বটকৃষ্ণ দে’র নাম আজ আর কেউ জানেন না!

মণীন্দ্র গুপ্ত’র তরুণ কবিদের প্রতি নির্দেশ—বিখ্যাতির জন্য ছুটোছুটি না করে বইটিকে ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে কালের গর্ভে নিক্ষেপ করুন। কিন্তু কেন জানিনা এই কালের গর্ভের প্রতি আমার তেমন আস্থা নেই। আমার সবচেয়ে অবাক লাগে জীবনের সুখ-দুঃখ নামক মৌল অনুভূতিকে স্বীকার না করা’কে। দীর্ঘদিন আমায় ভাবাত—আমার উপস্থিতি আছে, অথচ আমার ইগোর কোনও উপস্থিতি নেই, এও কি সম্ভব? মণীন্দ্র গুপ্ত’র এই বিশ্বাসকে তারপর একদিন হঠাৎই আবিষ্কার করি, তাঁর অক্ষয় মালবেরি দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে। কোনও এক বারবেলার অচেনা রাস্তার বাঁকে তখন পথ হারিয়ে পথের জন্য ঘুরছি। তাঁর লেখাই আমাকে সেই গোলকধাঁধায় পথ দেখায়। ‘পরিত্যক্ত থাকার কষ্ট এবং অসহায় ক্রোধ’—এর থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিলেন বলেই তাকে সমূলে অতিক্রম করে গেছেন তিনি। গড়ে নিয়েছেন সুখ-দুঃখ বিরহিত নিজের ভুবন। যেভাবে ছোটবেলায় আদর-স্নেহ ওম পরিত্যক্ত হয়ে শীতের রোদে মেলে দেওয়া লেপের মধ্যে তাঁবু বানিয়ে শিখেছিলেন নিজেকে ওম দিতে। আসলে শরীর যা পেয়েছিলেন, তাই ছিল, কিন্তু ‘অস্তিত্বের বিদেহ আভা’ তিনিই তৈরি করেছিলেন। বই পড়ে। ছবি দেখে। প্রকৃতির আকর্ষণে সাড়া দেওয়ার জাদুটি শিখে। তাই তো সমস্ত কোলাহলকে কেবল দূর থেকে দেখেছেন। চেয়েছেন সমস্ত দল ভেঙে যাক। চেয়েছেন একা বিচ্ছিন্ন মানুষ কেবল বেঁচে থাক। যে নিজের হালকা ওজনটি কেবল নিজেই বইবে।

এখানে কি তবে এক বিচক্ষণ দ্রষ্টার মধ্যে একজন শিশুও উঁকি দিয়ে গেল না? সম্ভবত। তিনি টং ঘরের রাজা। তিনি প্রথম মণীন্দ্র গুপ্ত। তাঁর বিচক্ষণতার গহীনে এক শিশু ছিল। যে শিশুকে, যে শিশুর খেলাটিকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথের আঁকায় । খুঁজে পেয়েছিলেন বলে এত ভালোবাসতেন তাঁর আঁকা। আর নিজের এই শিশুটিকে তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁর কৌতুকে। লেখায়। ছবিতে। তাই তাঁর সুখ নেই, দুঃখও নেই। সব শোক একদিন নমনীয় হয়ে আসে। চেয়ে থাকে শিশুর মতো—

  
                     বৃষ্টি শেষে আকাশ কী নীল, যেন স্নেহ। মধ্যে
                     পাখি উড়ছে। খোঁচা হয়ে আছে কাঁটা
                     তারও মুখে আলো।
                     এই দিনঃ যেন কুটুমবাড়িতে ছেলে চলেছে
                     গ্রামের পথে একা—চতুর্দিকে আহ্লাদের
                     মাঠ ও বাতাস—মাঠে জলপিপি, হঠাৎ-শাপলা।

                     তেরাত্তির না পেরুতে শোক নমনীয় হয়ে এল;
                     দুঃখ তার কান্না হারিয়ে, ভুলে শিশুদের মতো
                     চেয়ে আছে।
                     
                     এই শূন্য পবনের মধ্যে
                     কোনো পাপ কঠিন না—কোনো দুঃখ
                     ব্যক্তিগত নয়।
                    
                        (নিসর্গেঃ মুক্তি—লাল স্কুলবাড়ি)
Facebook Comments

Related posts

One Thought to “সুখ নেই, দুঃখও নেই”

  1. দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম

    একজীবন কবিতায় মগ্ন এবং নির্মোহ থাকার যে অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো, তাই মণীন্দ্র গুপ্তকে বাংলা কবিতায় দিনদিন স্মরণীয় করে রাখবে। একজন প্রকৃত কবি চলে গেলেন।

Leave a Comment