৭.
লীলাবতী রাতে খায়নি। লীলাবতী ক্রুদ্ধ মারজারিকার মতো ফুঁসতে থাকে। হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। লীলাবতী রাগ করে। লীলাবতী কাঁদে। তার সন্দেহ হচ্ছিল। তার জীবন নষ্ট করে দেবে বাবা শীতলচন্দ্র। মা খেত না। মা নীরবে কাজ করে যেত। লীলাবতীকে বলত, তার বাবা বলে পাহাড়িয়া বিবাহ করে পতিত হয়েছে, কুনকি। মা ছিল নাকি কুনকি। যে হস্তিনী ভুলিয়ে ভালিয়ে বন্য হস্তিকে গড়ে বন্দী করে ফেলে তার স্বাধীনতা হরণ করে। কুনকি হাতি তার বাবাকে ভুলিয়ে গড়ে বন্দী করেছে। মা মরলে ব্রাহ্মণের আবার উত্থান হবে। না খেয়ে খেয়ে মা রোগে পড়েছিল। সেই রোগেই মা মরে যায়। লীলাবতীকে বিয়ে দিতে পারলে প্রায় বুড়ো বাবা আবার বিয়ে করবে। কিন্তু লীলাবতী হাজঙের ঘরে যাবে। গিয়ে এই ব্রাহ্মণকে আরো পতিত করবেই করবে।
লীলাবতীকে ঘরে বন্ধ করে, তালা দিয়ে পরদিন সকালেই কংস নদী পার হয়ে শীতলচন্দ্র চলল পূর্ব ধলা। ত্রিলোচন বামুনের ঘর কে না চেনে ? বামুনের ঘরে দুই বউ। বামুন খুব সম্পন্ন গেরস্ত। জমি সব নিষ্কর।হাজং চাষারা চষে দেয়। গরু বাছুর সব আছে। ঘি দুধ দইয়ের খামতি নেই। বাড়ির পিছনে পুষ্করিনী আছে। পুষ্করিনীতে রুই কাতলা মৃগেল আছে। বামুন তার সঙ্গে কথা বলল, আমতলায় বসে। লীলাবতীকে সে বিবাহ করতে চায়। বামুন পরিষ্কার করেই বলল। তাহলে শীতলচন্দ্রকে আর পতিত থাকতে হবে না। লীলাবতীকে তার পছন্দ হয়েছে। লীলাময়ী কইন্যা। শীতলচন্দ্র আন্দাজ করেছিল এই। সে বলল, হবে।
কবে হবে ? জিজ্ঞেস করল বামুন ত্রিলোচন।
কবে দিন আছে কহেন।
বামুন বলল, আজ কিংবা কাল বা পরশু।
আজ কী করে হবে ?
না, আজ হবে না, আজ ব্যবস্থা করা যাবে না, কাল জৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি, হবে না, সংক্রান্তিতে কোনো শুভ কাজ অনুচিত, তাইলে পরশু হবে, আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে।
শীতলচন্দ্র আকাশে তাকায়। নির্মেঘ। গরমে পুড়ছে সব। গাঙের জলও ফুটছে যেন। বামুনের তর সইছে না। এত তাড়াতাড়ি ! বামুন ত্রিলোচন যেন তার মনের কথা শুনতে পায়, বলল, শুভস্য শীঘ্রম। তোমার কইন্যা যদি হাজঙের সঙ্গে পলায় তবে কি তোমার নরকবাস আটকাবে ?
শীতলচন্দ্র বলে, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
পূর্ব ধলা বাজার থেকে যা যা সওদা করার করে নিয়ে ঘরে ফেরো, কইন্যারে সাবধানে রাখো, আমি নিজে সকাল সকাল উপস্থিত হবো বিবাহের ব্রাহ্মণ সমেত।
এরপর আর কী হতে পারে ? লীলাবতীর বিবাহ হয়ে যায়। তার জন্য ত্রিলোচন বামুনের সঙ্গে আরো দুই বামুন ছিল। সেই দুইজনের একজন ভিটে শুদ্ধ করে শীতলচন্দ্রকে উন্নীত করল ব্রাহ্মণত্বে। আর একজন বিবাহ পড়ল। গাঁয়ের সব লেঠেলরা বাড়ি ঘিরে থাকল। তারা বামুনের ঘরে বামুনের মেয়েকে পাঠাতে চায়। এর জন্য খরচ করেছিল শীতলচন্দ্র। তাকে অবশ্য কথা দিতে হয়, বামুন হয়ে সে আবার তার নিজের গাঁয়ে ফিরে যাবে না। কৈবর্ত, চাষাদের গ্রামে একজন বামুন চাই, সে সেই বামুন হয়ে যেন থেকে যায়। ত্রিলোচনের ডাকে লীলাবতী হয়ে যায় লীলাময়ী। সে অনেক কেঁদেছে, কান্না বিফলে গেছে। সে অনেকবার ভগবানকে ডেকেছে, ভগবান ডাক শোনেনি। পাহাড়কে ডেকেছে, সিমসাং আর কংস নদীকে ডেকেছে, জঙ্গলকে ডেকেছে, হাতিদেবতাকে ডেকেছে। কারো কাছে ডাক পৌছয়নি। শেষ অবধি ভেবেছিল কিছু একটা হবে। হাতির দল এসে তছনছ করে দিয়ে তাকে নিয়ে যাবে মায়ের জন্মভূমিতে, গারো পাহাড়ের দেশে। কিন্তু হয়নি। কিন্তু সে জানতে পারেনি, প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, তারা সকলে সন্ধ্যায় বসছিল একত্রে । হস্তীযূথ যাত্রা করবে এমন কথা ভাবছিল। সেই আষাঢ়ের প্রথম দিবসে তারা গর্জন করছিল যূথবদ্ধ হয়ে। তারা ভাবছিল বিরিসিরি, বহেরাতলী থেকে সুসঙ্গ দুর্গাপুরের দিকে যাবে যূথবদ্ধ হয়ে। পায়ে পায়ে, মানুষের পায়ে মানুষ হাঁটবে রাজার বাড়ির দিকে। মনা সর্দার, অথৈচন্দ্র থাকবে মিছিলের পুরোভাগে। আষাঢ় মাস এসে গেল, এখন জমিতে নামবে চাষা হাজঙ। হাতিখেদা করবে না।
বিষুদ বারে গুরু বার
খরক শনি মঙল,
কায়ু না মানে কায়ু না মানে
যালা যিংকৈ সম্বল।
( আজকে এটা কালকে ঐটা
হরেকরকম বাধা,
এই বাধার তোড়ে হয় না মোদের
কাজের কাজ সাধা।)
হাতিখেদা হবে না। চাষ হবে। জমির চাষা জমিন চায়। বনের হাতি বন। চাষের শনি মঙ্গল নেই। শুধু অম্বুবাচীর তিন দিন বাদ।
চম্পানগরে তখন লীলাময়ীর হাতে হাত ধরেছে বুড়ো ত্রিলোচন। পরদিন ভোরে লেঠেল পাহারায় বউ নিয়ে সে বাড়ি পৌছল। আর তখন খবর নেওয়া আর খবর দেওয়ার জন্য পূর্ব ধলায় বসেছিল বাণেশ্বর খবরিয়া। খবর সে এনেছে অনেক। সব খবর প্রকাশ্যে আনার নয়। সব খবরই গোপন। সর্ব সমক্ষে ফাঁস করা যাবে না। পূরব ধলায় খবরিয়া অপেক্ষা করছিল খবর পাবে। কী খবর ? না, ব্রাহ্মণ ত্রিলোচন পুনর্বিবাহ করেছে এক ষোড়শ বর্ষীয়া কন্যাকে। বধূ বরণ করল ত্রিলোচনের বড় বউ, মেজ বউ। খবরিয়া তখন তার দুয়ারে হাজির। কাছারি ঘরে ডাকল ত্রিলোচন, বলল, ইবার তুমার দায়, কী করৎ খবর করবা, বলবা পতিত ব্রাহ্মণকে উদ্ধারের নিমিত্ত এই কারয সিদ্ধ করৎ পূর্ব ধলার ব্রাহ্মণ তিলোচন চক্কোত্তি।
বাণেশ্বর জিজ্ঞেস করে, কইন্যার গেরাম ?
সব বলল ত্রিলোচন। বুড়োর এত আহ্লাদ হয়েছিল লীলাময়ীকে ঘরে এনে যে সে কিছুই পেটে রাখতে পারে না। শূদ্র হাজং পুরুষের হাত থেকে যে উদ্ধার করেছে লীলাময়ীকে, উদ্ধার করে যে তার নরকবাস ঠেকিয়েছে সেই কথা পুনঃ পুনঃ বলতে লাগল। বাণেশ্বর খবর সংগ্রহে অতি পটু। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নেয়। বুড়ো বলে, সে কীভাবে রক্ষা করেছে কইন্যাকে। হাজং বেটা তারে বনের ভিতর পেড়ে ফেলেছিল প্রায়। হাজং বেটার হাত থেকে রক্ষা না করলে এ মেয়ে ভেসে যেত। বাণেশ্বর খবরিয়া ভাবে এমন খবরের চেয়ে ভালো খবর হয় না। সে গুছিয়ে এই খবর গাঁয়ে গাঁয়ে বলে অনেক উপার্জন করতে পারবে। সব শুনে নিয়ে, কল্পনা করে নিয়ে বাণেশ্বর বলল, তার কাছে এক কঠিন খবর আছে। কী খবর ? না হাজং চাষারা কইসে চাষাবাদ করবে। এইডা আবার কী খবর ? চাষা কি মাছ ধরা করৎ ? নিষ্কর জমিন ভোগ করে তো চাষের জন্য। শুনতে শুনতে মাথা নেড়ে খবরিয়া বলে, জুতের খবর তুমি জান না ঠাকুর। চাষায় চাষ করবে যেমন ঠিক, তেমনি হাজং চাষা হাতি ধরবে, তাও ঠিক। হাতি ধরৎ তবে চাষাবাদ। তারা কইতেসে হাতি ধরা করবে না। কেন করবে না ? না চাষাবাদে ক্ষতি হয়। সব মিছিল করে রাজার বাড়ি যাবে কইসে। সে এক মহা কান্ড হবে।, রাজার মন খারাপ তাই দেখা হয়নি। রাজার মন খারাপ ? সুসঙ্গ রাজার মন কেন খারাপ ? রাজার কি মন আছে যে খারাপ হবে ? খবরিয়া বলে, রাজার মন কেন খারাপ হয়েছিল তা সে খুঁজে বের করবে। তবে আন্দাজ করেছে রাজার মন খারাপ কেন না রাজার ভালো ঘুম হয় না। কেন ঘুম হয় না ? খবরিয়া বলে, মুর্শিদাবাদ থেকে, মৈমনসিং থেকে শুধু হাতি চায়, কিন্তু হাতির দাম সময় মতো দেয় না আবার দেয়। দিল্লির মুগল সম্রাট হাতি চায়, সে হাতির দামও দেয় না। হাতি নিয়ে মুর্শিদাবাদ যেতে হবে। হাতির খোরাকি দিতেই রাজকোষ ফাঁকা হয়ে যায়। হাজংবেটারা বলে হাতি ধরবে না। রাজার তাই ঘুম আসে না। ঘুম আসে না তাই মন খারাপ হয়ে থাকে। তখন বামুন বলে, তুমি কংস নদী পারৎ বিরিসিরি, বহেরাতলী যাও, গিয়াৎ খবর ছড়াও, লীলাময়ী পসন্দ করিসে বামুন তিলোচনকে, পসন্দ করৎ বিবাহ করিসে, খুব ধুম হইসে বিবাহৎ , হাজং বেটা শুনুক সব, কহি দাও গিয়ৎ, শালার বিটা মেয়েডারে প্রায় পেড়ে ফেলসিল মাটির পরৎ, আমি তারে শুদ্ধ করি নিইসি।
খবরিয়া বুঝে নেয় যা বোঝার। সে কতটা বলবে, কতটা বলবে না তা সে নিজে জানে। বানাতে হবে অনেক। যে যত বানাতে পারবে সে ততো বড় খবরিয়া। যে খবরে যুবতী নারীকে যুক্ত করা যায় সেই খবরের দাম হয় বেশি। এই খবরে তা আছে। সুতরাং খবরের দাম হবে। বামুনের বাড়ি উপাদেয় খাদ্য ভক্ষণ করে চলল খবরিয়া। লীলাময়ী হলো লীলাবতী। তার দুই সতীন আর বুড়ো বর। সে বুঝতে পারল তার সব্বোনাশ করে দিয়েছে বুড়ো বামুন আর তার বাপ। কিন্তু গারো রক্ত সহজে শীতল হয় না। সে বামুনকে বুঝে নেবে। বামুন বরের দিকে তাকালেই তার গা ঘিনঘিন করছে। দুই সতীন, বড় বউ আর মেজ বউ তাকে নিয়ে স্নান করালো পুকুরে। তাঁতি ঘর থেকে আনা নতুন কাপড় দিল। তার দু পায়ে আলতা পরিয়ে দিল দুই সতীন। সিঁদুর, শাঁখা, নোয়া নিয়ে লীলাময়ী বামুনের ছোট বউ হয়ে গেছে। লীলাবতী বলল, বুড়ার কি কিছু আছে ?
কচি মেয়ের মুখে এহেন কথা শুনে বড় মেজ, দুই বৌয়ের অবাক ভাব যায় না। ছোট বউ যেন গনগনে আগুন। এই বয়সে এমনই হয়। তাদের কুড়ি পেরিয়েছে। বুড়ি না হয়েও বুড়ি। বড়র তো তিরিশ হতে যায়। বড় একেবারের বুড়ি গিন্নি। মেজর তেজ বেশি, সে বলল, ও মা, তুই দেখিসনি, বাসর হয় নাই, বাসর ভর্তি লোক ছিল ?
আমি ও লকের মুখই দেখি নাই।
মেজ খিলখিল করে হাসে, কেনে, শুভ দিষ্টি হয় নাই ?
চখ বুঁজে ছিলাম।
দুই বউ লীলাময়ীর গায়ে হাত রাখে। কী বলবে ? কিছুই বলার নেই। সতীন এল, হিংসে যে হবে, তাও হয় না। বরং কষ্ট হলো কচি মেয়েটার কথা ভেবে। কী হবে পুষ্প শয্যায় ? কন্টক শয্যা হবে তা। জীবন নষ্ট হলো। তাদের স্বামীর প্রতি ঘৃণা হলো তার।
এত অবধি বলে থামলেন অতীন সরকার। তিনি থামলে বিপুল বলে, আপনি বাণেশ্বর খবরিয়ার কথা শুনলেন কোথা থেকে ?
শুনিসি চন্দ্রকুমার খবরিয়ার কাছে।
বিপুল চন্দ্রকুমারের দিকে ঘুরে তাকায়। চন্দ্রকুমার বলে, খবরের সোর্স বলা যায় না স্যার, সকাল হয়ে গেসে অনেক সময়, বড় দাদার কাছে যাবেন না ?
অতীন বলল, হ্যাঁ, বড়দার কাছে চলুন, তিনি এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন।
সকলে উঠে এল। একই ঘেরার ভিতরে দুটি আলাদা বাড়ি। একতলা লম্বা প্যাগোডা গড়নের লম্বা কুটিরের মতো। বাইরে ভয়ানক শীত। রোদ না উঠে বেলা আটটা পার হয়ে গেছে। অতীনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগান পেরিয়ে নীতিন সরকারের বাড়ি। বাগানে ফল ও ফুলের গাছে। সবের পাতা শিশির সিক্ত। নুড়ি পাথরের পথ দিয়ে এগোল তারা। বাগানের ঘাস শিশিরে ভেজা। কুয়াশা কাটেনি এখনো। অতীন বললেন, কুয়াশা কাটতে সময় লাগবে, এমন হতে পারে দুপুরের দিকে, শেষ বেলায় একটুখানি রোদ দেখা গেল, তারপরই সূর্য ডুবে গেল। নীতিন সরকারের বয়স আশির কাছে। বাইরের ঘরে বিছানায় চাদর জড়িয়ে, মাথায় কান ঢাকা উলের টুপি পরে বসে আছেন তিনি। বিপুলের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বিপুল যে আসবে তা তিনি জানেন। চন্দ্রকুমার, খবরিয়া খবর দিয়েছে। খবরিয়া–হা হা হা। খবরিয়া নামটি তাঁর খুব পছন্দ। নতুন শব্দই বলা যায়। তবে গাঁয়ের দিকে এসব চালু শব্দ…। হারিয়ে যাওয়া শব্দ ফিরে আসছে বিপুল দেখছিল দেওয়াল জুড়ে বই। ছোট একটি খাট আর সোফা সেট বাদ দিয়ে সব কিছুতেই বই। শো-কেসে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সম্মাননা। দেওয়ালে মানপত্র। নীতিন ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর ছাত্ররা বাংলাদেশ কেন, বিদেশেও ছড়িয়ে আছে। নীতিন বললেন, আপনি স্বাগত, কতদূর থেকে এসেছেন, কিন্তু কেন এসেছেন ?
কেন ? বিপুল কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। সে এসেছে তো সুধীন্দ্র সোমের খোঁজে। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? সুধীন্দ্র সত্যিই কি চলে এসেছেন এত দূরে ? সম্ভব ? তাহলে সুধীন্দ্র গেলেন কোথায় ? স্মৃতিহারা মানুষ কোথায় যেতে পারে তা কে বলতে পারে ? হয়তো কলকাতা শহরেই তিনি আছেন। সে জানে না। তাঁর পুত্রই খোঁজ করল না, পুত্র তো এই দেশে উড়ে আসতে পারত। বিপুল টের পায় সুধীন্দ্র একটি সূত্র, আসলে সে কৌতুহলে এসেছে এই দেশে, সুধীন্দ্র যে কমলা সায়রের কথা লিখেছেন, মৈমনসিংহ গীতিকার সেই কমলা সায়র দেখতে তার আসা, সুসঙ্গ দুর্গাপুর, সোমেশ্বরী নদী, গারো পাহাড়, রাজার বাড়ি দেখতে তার আসা। সে তবু বলল সুধীন্দ্রর কথা। বিবরণ দিল সুধীন্দ্রর। লম্বায় ছ-ফুট, গৌর বর্ণ, সত্তর পেরিয়ে বয়স, আসলে তাঁরা সোমেশ্বরী নদীর কূলের মানুষ ছিলেন। গ্রামের নাম বিরিসিরি বা বহেরাতলী হতে পারে। শুনতে শুনতে নীতিন বললেন, আসলে নদীটা তো সিমসাং, আপনি বলছেন সোমেশ্বরী, এই ভুল নামে চলছে, মানচিত্রেও তা রয়েছে, আর এই দ্যাখেন, কমাস আগে, আমার কাছে কেউ একজন এসেছিল, তিনি তো ধলা নন, আর অত উচ্চও নন। কিন্তু তিনি এসেছিলেন।তিনিও কইলেন যাবেন সোমেশ্বরী গাঙের পারে। কিন্তু আমি বললাম নদীর নাম সিমসাং, বলুন সিমসাং নদীর পারে যাবেন, নদীটার জল আর নাই প্রায়। তাঁরে আমি বললাম গীতিকা যেমন সত্য, টঙ্ক আন্দোলন, হাতিখেদা বিদ্রোহ সত্য, গীতিকা রচনায় সত্য, কবি মানসে সত্য, কিন্তু বিদ্রোহ বিপ্লব যে সব ঘটেছিল তাই সত্য। যা ঘটেছিল তা যদি গীতিকায় আসে সে কেমন হয় ? তিনি বললেন, কমলা সায়রে রানি কমলার মৃত্যু সত্য। কী জানি কোনটা সত্য, সেই সত্যের সঙ্গে আর কোন সত্য জড়িত ? বিপুল যাবে সুসঙ্গ দুর্গাপুর, সঙ্গে যাবে চন্দ্রকুমার। তার ইচ্ছে বিপুলকে নিয়ে একটা খবর করে। খবর বানায়। বিপুলের সঙ্গে সে ইন্ডিয়া থেকেই আসছে। নীতিন বললেন, তুমি ওঁরে নিয়ে যাও ১৯৪৫-এর মাঠে। ১৯৪৫-এর মাঠ ! নেত্রকোনায় ১৯৪৫ এ সারা ভারত কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং হয়েছিল গোপাল হালদার এসেছিলেন। তিনি তখন কৃষক সভার নেতা। এসেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আরো সব বড় বড় নেতারা এসেছিলেন। দশদিক থেকে হাজং পাহাড়িয়ারা এসেছিল ঢোল বাজাতে বাজাতে। কমরেড মণি সিংহ ছিলেন সেই সম্মেলনের প্রধান সংগঠক, তিনি তো ছিলেন সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজবাড়ির মানুষ। সব ছেড়ে দিয়ে হাজংদের নিয়ে টঙ্ক বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেন। এসব না থাকে যদি মৈমনসিংহ নিয়ে কী লেখা হবে আর নতুন করে ? মৈমনসিংহ শুধু গীতিকার দেশ নয় মশায়, তার মাটি কত মানুষের মিছিলে মিছিলে কেঁপেছে। কেঁপেছে গারো পাহাড়। ভূমিকম্পের মতো কেঁপেছে গারোপাহাড়ি দেশ।
কী সুন্দর বলছিলেন নীতিন সরকার। বলছিলেন আর হাহা হাসিতে ঘরে তরঙ্গ তুলছিলেন। এত প্রাণ তাঁর ভিতরে। ভাই যেমন বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি কোথাও, ইন্ডিয়াতেও নয়, তিনি অনেক দেশ গেছেন। তাঁর কন্যা থাকে প্রাগ শহরে। ঐ দেশেই বিয়ে করেছে ভিনদেশী পুরুষ এক। হাসলেন তিনি, বললেন, ভিনদেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতোন, লাজ রক্ত হইল্যা কইন্যা পরথম যৈবন…। আমার মৈমনসিংহর কবির কথা। হা হা হা। তিনি বলছিলেন, খবরিয়া, তুমি এই এনারে সব দেখাবা, গোপন করবা না কিছু,তুমার কাজই হলো গোপন খবর ফাঁস করে দেওয়া। পারবা তো চাঁদু ?
ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, পারব বলে এই লোকেরে নিয়া আসছি এখেনে, ইনি একা আসতিছিলেন, একা এসে কী খুঁজে পেতেন, ঠগের হাতে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতেন।
হুঁ, ঠগের সংখ্যা দিনদিন বাড়তেসে, আপনার দেশে ?
বিপুল বলল, আপনার দেশ আর আমার দেশে তফাৎ নেই, টঙ্ক আন্দোলন কি তেভাগা আন্দোলন ?
তেভাগা আর টঙ্কতে তফাৎ আছে। বললেন নীতিন। বুঝিয়ে দিলেন তফাতটা কী ? তেভাগা ধানের ভাগ নিয়ে আন্দোলন, ফসল তিন ভাগ করে, দুই ভাগ চাষা আর এক ভাগ জমির মালিক পাবে। ফসল যেমন হবে, তেমনি তার ভাগ হবে। এখন তো চ্যাঁর ভাগের তিন ভাগ পায় চাষা আর এক ভাগ পায় মালিক। কিন্তু টঙ্ক প্রথা হলো ফসল নয়, টাকা দিতে হবে। জমি দিলাম চাষ করতে, তুমি এই টাকাটা বছরে আমাকে দেবে। যদি ফসল না হয়, তাহলেও নিস্তার নেই। টঙ্কা দিতেই হবে। খরা বন্যায় নিস্তার নেই। কমরেড মণি সিং রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে হাজংদের নিয়ে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলেন। তার কত ইতিহাস।
এতক্ষণে অতীন কথা বললেন, হাতিখেদা না করতে চাওয়ায় রাজা প্রতিহিংসায় নামলেন।
হুঁ, তা সত্য, হাজংরা মিছিল করে গিয়ে বলল হাতিখেদা করব নাই। চন্দ্রকুমার বলল, এই নিয়ে একটা লেখা আমার পত্রিকা, মৈমনশাহী কথকতায় স্যার লিখসিলেন।
নীতিন বললেন, আমার ছাত্র একটা বই লিখেছে টঙ্ক প্রথা নিয়ে, দেখি পাই কি না।
হ্যাঁ, রক্তে ভেজা গারো পাহাড়, শিশির রাজন, ওই রক্তে ভিজল যখন গারো পাহাড়, তখন সে পিছায়, পিছায়ে যেতে থাকে। অতীন বললেন, দাদা পিছিয়ে যায় নাই ?
নীতিন বললেন, সেই যে ১৯৪৫, আমি তখন বছর দশ হবো, স্পষ্ট মনে আছে, পাহাড় নিয়ে হাজং আর গারোরা এসেছিল মিটিং শুনতে, টঙ্কর বিরুদ্ধে রব উঠল, আহা গারো পাহাড়, কবে পিছাই গেলরে অতীন ?
কবে পিছাই গেল, গারো পাহাড় অপর হই গেল ? অতীন বিড়বিড় করলেন।
হাঁ, ঠিক যেন দেখা যেত মিটিঙের মাঠ থেকে, আমার তখন দশ বছর, দেখতিসি পাহাড় থেকে নেমে আসতিসে গারো আর হাজঙের মিছিল, কবে সেই পাহাড় সরে গেল রে অতীন ?
অতীন বিড়বিড় করতে থাকেন, হাতি, আসলে ওটি একটা হাতি, হাতি পাহাড় ঐ গারো পাহাড়, হাতি ক্রমশ সরে যাচ্ছে দাদা।
নীতিন বললেন, হ্যাঁ, বনও সরে যাচ্ছে, আকাশও, মেঘ বৃষ্টি সব…।
বিপুল দেখতে পাচ্ছিল স্পষ্ট। বন পাহাড় আর বন পাহাড়ের মানুষ……বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছ।।চোখের সামনে থেকে। তার মনে পড়ল পূর্ব ধলার আয়না বিবির কথা। আসলটা ঠিক ধরা যাবেই যতই কিসসা বানাও বাবু।
(চলবে)