শৌভিক দে সরকার

মার্টিন এস্পাদা’র কবিতা

মার্টিন এস্পাদাঃ 

১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মার্টিন এস্পাদা। ১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দা ইমিগ্রান্ট আইসবয়’স বোলেরো’ প্রকাশিত হয়। ‘সিটি অফ কাফিং অ্যান্ড ডেড রেডিয়েটরস’, ‘ইমাজিন দা এঞ্জেলস অফ ব্রেড’, ‘আলাবাঞ্জা’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন  ‘এল কোরোঃ এ কোরাস অফ ল্যাটিনো অ্যান্ড চিখানা পোয়েট্রি’ এবং ‘পোয়েট্রি অফ ব্রেডস’ নামে দুটি উল্লেখযোগ্য সংকলন। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিশেষ করে পুয়ের্তো রিকোর বিভিন্ন অনুষঙ্গ উঠে আসে এস্পাদা’র কবিতায়। দীর্ঘদিন আমেরিকায় বসবাসকারী সংখ্যালঘু শ্রমিকদের অভিবাসনের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি এবং আইনি পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন। আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষদের যাপনের অন্তরঙ্গ ও মর্মান্তিক কিছু ছবি বারবার উঠে আসে এস্পাদার কবিতায়।  ‘রবার্ট ক্রেলি এ্যাওয়ার্ড’, ‘প্যাটারসন পোয়েট্রি প্রাইজ’ ‘পুশকার্ট প্রাইজ’ পেয়েছেন তিনি  ‘পুলিৎজার প্রাইজ’ এবং ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কল অ্যাওয়ার্ড’- এর জন্য মনোনীত হয়েছিলেন এস্পাদা। ২০০৯ সালে ‘দা পিপল স্পিক’ নামে একটি তথ্যচিত্রে অভিনয় করেছেন এস্পাদা যেটি হাওয়ার্ড জিনের ‘এ পিপল’স হিস্ট্রি অফ দা ইউনাইটেড স্টেটস’- এর ওপর নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে তিনি ম্যাসাচুসেটস- আমহারস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

 

 

যে মানুষগুলি লাল রঙের গাছ হয়ে গিয়েছে

আমি যখন লাল মেপল গাছগুলিকে দেখি
আমার ঐ মুচিটির কথা মনে পড়ে যায়
ঐ মাছওয়ালাটির কথাও মনে পড়ে
পাতার মত টকটকে লাল,
ম্যাসচুসেটস সরকার যাদের
ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলেছিল।

আমি যখন লাল মেপল গাছগুলিকে দেখি
আমার লাল ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলের কথা মনে পড়ে
ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলের মতো দুজন কবি
কব্জিতে দড়ি বাঁধা
নেভির গানবোট ছাড়াই যারা
সান খুয়ান উপসাগরের কথা ভেবেছিল।

আমি যখন ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলগুলিকে দেখি
ঠাকুমার কথা মনে পড়ে যায় আমার
ক্যাটালানে লাল রঙকে যা বলা হয়
সেটাই ঠাকুমার নাম ছিল,
স্পেনের যুদ্ধ
হাজার হাজার নামহীন শ্রমিক
ভাঙা রাইফেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

যখন আমি আমার ঠাকুমাকে দেখি
ক্যাটালানে যার নামের অর্থ লাল রঙ,
আমার য়ুনিয়নের সংগঠকদের কথা মনে পড়ে
যারা নামহীন কবরে পড়ে থেকে শুধু
লাল গাছগুলির
খাবার জুগিয়ে যাচ্ছে।

যখন আমি একটি পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে
কয়েকশ বছরের পুরনো লাল গাছগুলিকে দেখি
আমার মনে হয়, লাল পাতাগুলি আসলে
জেলে মরে যাওয়া সন্ত্রাসবাদীদের হাত আর
লাল ফুলগুলি, দড়ি দিয়ে বাঁধা কবিদের চোখ-মুখ
ওদের কথা মনে রাখার জন্যেই ফুলগুলি ফুটে আছে।

আমি দেখি লাল রঙের গাছ হয়ে যাওয়া মানুষগুলি
ভাঙা রাইফেলের মতো
তাদের ডালপালা আকাশে তুলে ধরেছে।

 

আমের খোসার নীচে লুকনো মাথার খুলি

এল সালভাদর ১৯৯২

মহিলাটি আতঙ্কের ঘোরের মধ্যে
বিড়বিড় করে বলছিলঃ
আর্মির লোকেরা এখানেই সবাইকে খুন করেছিল!
কিন্তু কোথাও কোনও চাষির লাশ ছিল না
কোনও সাদা ক্রস এমনকি বাড়িগুলিও উবে গিয়েছিল।
ক্যামেরাগুলি অনবরত খচখচ করে ছবি তুলছিল
নোটবুকগুলি ভরে যাচ্ছিল লাইনের পর লাইন শব্দে
অনেকে ফিসফিস করে বলছিল এই গণহত্যার বিষয়টি
আসলে একটি কুসংস্কার
নতুন চুক্তি আর ব্যালট বাক্সের দেশে ঐসব হয় না।

সবাই মাটিতে পড়ে থাকা আম জড়ো করছিল
যাওয়ার আগে একজন মার্কিন সাংবাদিক
দু’হাত ভর্তি আম নিয়ে মাটি থেকে বেরিয়ে থাকা
একটি উঁচু জিনিসে হোঁচট খেল।
সে নিজেকে সামলে নিল
তাকিয়ে দেখল তার স্নিকারের নীচে
আমের মাংসের মত হলুদ হয়ে যাওয়া
একটি মানুষের খুলির কপাল।

সাংবাদিকটি ভাবল, প্রতিদিন
এরকম কত খুলি আমের সঙ্গে
বাজারে চালান হয়ে যাচ্ছে
হলুদ মাংস, কাঁচা সবুজ চামড়া নিয়ে
কাঠের বাক্সের ভেতর প্রতিদিন কত মানুষের
মাথার খুলি আমেরিকার বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে!
‘আসলে এটা থেকেই বোঝা যায়’,
সাংবাদিকটি আমাকে বলেছিল
‘এল সালভাদরে যে লাশগুলি পাওয়া যায়
কেন সেগুলির মাথা কাটা থাকে!’

 

জিমির অন্ধ ব্লু’জ গুলি

কয়েকটি বিষয়
ডাক্তাররা ধরতেই পারেন নি।
ওর ভাই বলল,
হেরোইন আর ডায়াবেটিস

তোষকের ওপর ন্যাংটো হয়ে বসে
বোকার মত মুখ করে
ও চোখ খোলা কুকুরের জোকসগুলি বলছিল
মুখটা ফুলে গিয়েছিল ওর
বারবার, আত্মহত্যার চেষ্টার ভূগোল
ঘুমে ঢুলছিল ও
আর ওর হাসিটি দেখে মনে হচ্ছিল
কোন জ্যাজ গায়কের শবযাত্রায়
মুখ ভ্যাঙ্গাতে থাকা কোন ক্ল্যারিওনেট

আর কিছু বলবেন না,
ওর শিরা খুঁজে পাওয়া যায় না
তাই ও ঘাড়ের মধ্যেই
সূচটি গেঁথে দেয়,
ওর ভাই বলল।

নোংরা সুচটি
ওর মজ্জার ভেতরে ঘা করে দিয়েছিল,
চামড়ার ওপরেও ঘা হয়ে গিয়েছিল
ওর গা থেকে শবযাত্রার রিহার্সালের
গন্ধ বেরোচ্ছিল।
চোখে ভালো করে দেখতে পারছিল না ও
রেডিও খুঁজতে গিয়ে
ভাইয়ের ফ্ল্যাটের মেঝেতে পড়ে থাকা
ওষুধের বোতলগুলির ওপর
হোঁচট খাচ্ছিল।

দাদা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে
আমরা গাড়ি নিয়ে
বের হব ক্রস কান্ট্রি করতে
পুরো দেশটা ঘুরতে হবে,
ওর ভাই কথাগুলি বলল,
ওর জেল খাটা ভাই,
সপ্তাহে একশ ডলার কামানো ভাই,
কেয়ারটেকার ভাই, এসব বলল।

একজন নেশাখোর
ঐসব জায়গাতেই যায়
যেখানে গোপন বিষয়গুলিকে
নিলামে চড়ানো হয়
আর ছায়ারা একে অন্যকে
অন্ধকার বিক্রি করে।

এখানে ঐ অন্ধকারের পায়ের তলায়
রাতের কালো পাঁকের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে
ওর ভাই কিছুতেই
বুঝে উঠতে পারছিল না
কোথায় ওকে খুঁজবে।

 

ধারের দোকানের ল্যাটিন রাত

একটি সালসা ব্যান্ডের ভুতুড়ে ছায়া
‘লিবার্টি লোন’,ধারের দোকানের
জানালার কাচের ওপর চকচক করছেঃ

সোনালী ট্রাম্পেট,
রূপোলী ট্রমবোন,
কঙ্গো, ম্যারাকাস, ট্যাম্বুরিন,
সবার শরীর থেকে দামের ট্যাগ ঝুলছে
ঠিক যেভাবে শহরের মর্গে মৃতদেহের
পায়ের আঙুল থেকে নম্বরের টিকিট ঝোলে।

 

সমারসেট, মেরিল্যান্ডের একজন চাষির ডানহাত

বুড়ো আঙুল আর
তর্জনীর মাঝখানে আঁকা
রোজারি ট্যাটুর
অর্থ হল
এক এক মুঠো
শস্য আর ধুলো আসলে
এক একটি প্রার্থনা,
আর যীশুর হাতদুটিও
খুব শক্তিশালী ছিল।

 

প্যারোল বোর্ডের শুনানি

তিন ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্যারোল বোর্ডকে শুধু
একটি কথাই বলে যাচ্ছিল আসামীটি,আমি এটা করিনি!
তার বাদামী রঙের হাতদুটো থরথর করে কাঁপছিল
প্লাস্টিকের জলের গ্লাস থেকে জল চলকে
টেবিলের ওপর পড়তেই ,শক্ত হয়ে গেল আসামীটির শরীর
চলকে পড়া জল, টেবিলের একদম কোনায়
আসামীটির কোলের কাছে, তার নীল স্যুটের সামনে এসে থামল।
প্যারোল বোর্ডের মেম্বারদের সাত জোড়া চোখ
টেবিলের ওপর জলের গতিবিধি মন দিয়ে দেখছিল
তাদের স্তব্ধতা অনেকটা জলের স্তব্ধতার মতো হয়ে গিয়েছিল
আধ মাইল নীচে যতক্ষন না একজন জিজ্ঞেস করে উঠল
তোমার কি এটা মোছার জন্য কিছু লাগবে?
যেন সে আসলে বলতে চাইল, তোমাকে জেলেই মরতে হবে।
আর আসামিটি মাথা উঠিয়ে, শ্বাস টেনে বলল, হ্যাঁ।
যেন আসলে বলতে চাইল, আমি এটা করিনি!

 

কারমেন মিরান্দার মৃত্যু

টিভির পর্দায় মরতে গিয়ে
জিমি ডুরান্টের শো-এ
ট্যুরিস্টদের জন্য আরও একবার সাম্বা নাচতে গিয়ে
মাথার ওপর কলার মুকুট নিয়ে
হাঁটু ভেঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ল কারমেন।
মাথার ওপর কলার পিরামিড ভেঙ্গে যেতে দেখে
দর্শকরা খিক খিক করে হেসে উঠল,
কিন্তু মোটা নাকওয়ালা, ফেদোরা টুপি পড়া কমেডিয়ান
বিপদের আঁচ পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন,মিউজিক থামাও!
আর কারমেনকে টেনে তুললেন।
‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’
বুকের ওপর আঙুল নাড়তে নাড়তে বলল সে।
ক্যামেরার মুখটি খুলে গেল
ওর গলার আওয়াজে মুচকি হাসার জন্য কিন্তু
বড় হাঁ থেকে শুধু ঘাবড়ে যাওয়া ‘ওহ’ শব্দটি বেরিয়ে এল।

অনেক রাতে, প্রাসাদের ঘরে কাজের লোকেরা এসে দেখল
দম বন্ধ করেই ঘুমোচ্ছে কারমেন,
ওর হাত থেকে আয়নাটি ছাড়াতে পারল না ওরা!
আর যে চুলগুলিকে টিভির পর্দায় খোলা অবস্থায় দেখেনি কেউ
সেগুলি কলার মুকুটের নীচে ছড়িয়ে আছে
কলার রঙের মতো ফ্যাকাসে হলুদ রঙের চুল।

 

একটি বৈপ্লবিক স্প্যানিশ শিক্ষা

যখনই কেউ আমার নাম
ভুল উচ্চারন করে,
আমার ইচ্ছে হয় একটি খেলনা পিস্তল কিনি
চোখে কালো সানগ্লাস পরি
টুপিটাকে একটু তেরছা করি
দাড়িটাকে আরও ছুঁচলো করে আঁচড়াই
আর উইসকন্সিন থেকে আসা
রিপাব্লিকান টুরিস্টদের একটি বাস
হাইজ্যাক করি,
তারপর তাদের স্প্যানিশে
আমেরিকা-বিরোধী
স্লোগান দিতে বাধ্য করি,
যতক্ষণ না পর্যন্ত এসডাব্লিউএটি-র
দোভাষী সেনারা এসে
মাথার ওপর হেলিকপ্টার নিয়ে চক্কর কাটছে
আর আমার সঙ্গে
রফা করতে চাইছে।

 

একটি গিটারের ভূমিকায় আমার বাবা

কার্ডিওলজিস্ট বাবাকে একটি
একটি নতুন ওষুধ দিয়ে
কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেন।
কিন্তু বাবা বললঃ এটা আমি পারব না।
মালিক আমাকে ছেড়ে দেবে না!
জুয়ার ঘুঁটির মতো ওষুধগুলি
বাবার হাতেই থেকে গেল,
আসলে ঐ জুয়ারির প্রতি মাসের শুরুতেই
মাইনের টাকা লাগে।

একদিন রাতে অনেক দূরে পুয়ের্তো রিকোয়
ঐ জুয়ারির মা মারা গেল,
বাবা বিছানায় ওপর কাত হয়ে পড়ে গেল
বুকের ভেতর হাতুড়ির মতো ধাক্কা মারছিল হৃৎপিণ্ড
ঠিক যেভাবে কেউ বন্ধ দরজার ওপর ঘুষি মারে।
কয়েক মিনিট পর
টেলিফোন উগরে দিল
মৃত্যু সংবাদ।

মাঝেমধ্যে আমি স্বপ্ন দেখি
আমার বাবা একটি গিটার হয়ে গিয়েছে,
বুকের মাঝখানে একটি গর্ত
আর ঐ গর্তের ভেতর, আমার আঙুলের মধ্যে
গানের সুরগুলি বেজে যাচ্ছে।

 

আমার নিজস্ব পোশাক

শহরের স্কুলের মাস্টারমশাই
বললেনঃ
আপনি যেদিন আবার আসবেন
আপনাদের নিজস্ব পোশাকটাই
পরে আসবেন।

কিন্তু আমি তো একজন উকিল!
আমি অবাক হয়ে বললাম
আর আমার নিজস্ব পোশাক হল
পিন স্ট্রাইপ দেওয়া স্যুট।
মাস্টারমশাই বললেনঃ
আমি আপনাদের পুয়ের্তো রিকানদের
পোশাকের কথা বলছি।
মানে গুয়াবেরা? শার্ট?
কিন্তু এখন তো ফেব্রুয়ারি মাস,
আমি বললাম।

বাচ্চারা আপনাদের
পোশাক দেখতে চায়,
মাস্টারমশাই বললেন।
তাই পরদিন
আমি এম্ব্রডেয়ারি করা গুয়েবারা
আর একটি টার্টল নেকের ওপর
হাফ শার্ট পরে শহরের স্কুলটিতে গেলাম
আর বাচ্চাদের বললাম,
দ্যাখো, এটাই সাংস্কৃতিক অভিযোজন।

 

হাঙর

একশ ষোল ডিগ্রি পূর্ব
আর একটি লম্বা লাল রঙের গাড়ি
হুড তুলে দাঁড়িয়ে আছে
ভেতর থেকে তারস্বরে ভেসে আসছে সালসা
বিশাল একটি হাঙরের মত
মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটি
যার পেটের ভেতর গিলে ফেলা
শেষ জেলেটির রেডিওটি
তখনও বাজিয়ে যাচ্ছে
জেলেটির প্রিয় স্টেশনের গান

 

Facebook Comments

Related posts

One Thought to “মার্টিন এস্পাদা’র কবিতা”

  1. দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম

    আপনার অনুবাদ অনেক প্রাঞ্জল। কবিতাগুলো পড়ে আনন্দ পাওয়া গেলো।

Leave a Comment