নীলাঞ্জন দরিপা

ব্যক্তিগত কান্নার নিকটে

১.
এমন হাতের টান; মনে হয় লিপিটি অস্থির
যেন কিছু কাঠুরিয়া সার বেঁধে সারি সারি গাছে
কুঠার বসিয়ে দিচ্ছে, অবিশ্বাস্য হরফের ভিড়ে
পাঠে ব্যর্থ কোন এক পুরুষের দৃষ্টি জমে আছে

২.
এখানে বিকেল, গায়ে হলুদ আলোয় ম্রিয়মাণ;
গান নিয়ে ঘুরে ফেরে, সমুদ্রের পাড় বরাবর,
ক্রেতা-বিক্রেতা, ঢেউ, মদ, ছুটি, লৌকিক চা-পান
মানুষের ছাপ নেই, বহুদিন বালির ওপর

৩.
সে কিসের স্মৃতি, যার সাথে তুমি তুলনামূলক
দুঃখ-মুহূর্তে তাকে রোমন্থন করে কোনদিন
ভেবেছি উপায় হবে, অতঃপর মন্ত্রমুগ্ধবৎ
আনন্দের ক্ষণগুলি হয়ে গেছে দুঃখের অধীন।

৪.
তবুও বিশ্রাম পেলে মগজ পুনর্পাঠে ডোবে
উতল ছটফটানি-দৃশ্যকে থামিয়ে দেয় যতি
এবং শীতল শব্দ, সংক্ষিপ্ত; নীরব বান্ধবের
স্পন্দন-উৎস মুখে বিঁধে দিচ্ছে বরফ টুকরোটি।

৫.
অথচ হিমের রাতে মোম জ্বেলে গানের আসর;
সে সমস্ত আয়োজনও মিশে আছে অক্ষরের স্রোতে
তবু সে চোখে এমন ইচ্ছে হল ফাল্গুনের পর
অনুচ্ছেদ শেষে দুই শ্বদন্ত-কিনারা জেগে ওঠে

৬.
সেও জানে, অশ্রু থেকে ওষ্ঠ, তবে সমর্পণ, স্তন,
সমুদ্র-গর্ভের থেকে উঠে আসা তপস্বীর যোগ
কুলের চাঞ্চল্যে যদি নড়ে, তবে কিসের বন্ধন
শিখে নিক ঊরু-স্কন্ধে, ভালো মন্দ জাদুর প্রয়োগ

৭.
নিজের মতন খুঁজে পেয়ে যাবে দু তিন স্তবক
সেখানে এনো না ঘুম, নিয়ে এসো ঝঞ্ঝাট প্রহর
কীভাবে নিস্তার মেলে, তাপের বিভেদে পোড়ে চোখ
শরীরের তৃপ্তিগুলি দানা খুঁটে খেয়ে নিল জ্বর

৮.
সেরূপ কবিতা কৈ, যার বুকে গোপন সততা
আমার নিকটে এলে ফেলে দেবে প্রকাশের লাজ
অসৎ পদ্ধতিগুলি ব্যর্থ স্বরে শোনাবে দু’কথা
পাঠের অযোগ্য চোখে পড়ে যাব হরফের নাচ

৯.
প্রেমের ভেতরে ঢুকে ছিঁড়ে দেব ম্যাজিকের ফিতে
একই সে খেলায় আর কতবার চমক লাগাবে
আমি স্থির। সে আমার ভেতরে অলস ভঙ্গীতে
বয়স সিঁড়ির গায়ে কী লিখে রেখেছে কোন ধাপে।

১০.
গোল ট্র্যাক গেঁথে আছে মানুষের মাথার ভেতর
ফিতে নেই, দৌড় নেই, কবে কোনকালে খড়ি দাগ
শীতের দুপুর জুড়ে, প্রাইমারি, লালের ওপর
সাদা কাজে বুনেছিল প্রজাপতি, অকাল পরাগ।

১১.
বহুদিন আমি কোন ব্যক্তিগত কান্নার নিকটে
পৌঁছোতে চেয়েও যেন পারছি না বলে মনে হয়
এমন ব্যর্থতা যদি থাকে অক্ষরের প্রেক্ষাপটে
তবে আলো নষ্ট হয়ে ঝরে যাবে লেখার সময়

১২.
তুমিও স্মৃতির মধ্যে ঢুকে যাবে তীব্রতা ছাড়াই
এত নিরুপদ্রব, নিরুদ্‌বিগ্ন; সুখ-শান্তি-সুখ
দ্বন্দ্বপথ শেষে চাই অশান্তিমুখর সুখ-ঠাঁই
সে সামর্থ্যটুকু নেই, বন্ধ করি স্মৃতি-গুহামুখ।

১৩.
যা চেয়েছি, তা নেহাৎ সামান্যই, বসন্ত সময়,
যেমন সকলে ভাবে। সেভাবেই চেয়েছি অন্তরে
আন্দোলন, তীব্রতর পীড়া, অতঃপর নিরাময়।
সেসব পাইনি কিছু, খাম খুলে, চিঠির ভেতরে।

১৪.
এই যে না পাওয়া, তার জন্য তুমি দায়ী নও আর
যথেষ্ট বিদ্রূপ ছিল, ছিল টান, ছিল উন্মাদনা
সমগ্র কাগজ জুড়ে চাপ চাপ মুহুর্ত-পাহাড়
নির্লিপ্ত শীতল ঠোঁটে আমি এই গল্প শোনাব না।

১৫.
মানুষের নাম ফোটে মানুষের বাগানবাড়িতে
অনিচ্ছের ফুল, তাকে যত মারো, সব বৃথা যায়
নিকটে আঁধার পেয়ে যদি পারে রূপ খুলে দিতে
তবে তা জেনেও কেন ছায়া ফেলো, ফুলের পাড়ায়

১৬.
আলোর সম্মুখে যদি বাধা হও, নিশ্চিত আঁধার
যদি বা ফোটেই, তাতে কলঙ্কের ভয় কেন আজ
আমি তো দেখেছি নষ্ট, শুনেছি তারিফ শব্দ, আর
বিধাতার কক্ষ থেকে অপ্সরার নাচের আওয়াজ

১৭.
আমিও করেছি নৃত্য, ছিটকে গেছে ঘুঙুরের ফুল
আমিও ডেকেছি নাম, পাহাড়ে এখনো ঘুরে আসে
তোমার চিঠির বর্ণে যত বাঁক নিয়েছে আঙুল
সে সমস্ত বাঁকে নদী প্লাবন এনেছে অনায়াসে

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment