হিন্দোল ভট্টাচার্য

বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ৩

অভিজ্ঞতাগুলি ক্রমে…

শুকনো পাতার স্তূপ্ বললেই মনে পড়ে যায় গ্রীসিয়ান আর্নের কথা। একটি অসামান্য জায়গা ছিল- হার্ড মেলোডিজ আর সুইট, বাট দোজ আনহার্ড আর সুইটার। আমার এক মাস্টারমশাই ছিলেন, পিএম বলে ডাকতাম। পুরো নাম পার্থ মুখোপাধ্যায়। একবার পড়ানো হয়ে গেছে। বসে আছি তাঁর সল্ট লেকের বাড়ির ছাদে। পাশে ঘুরঘুর করছে তাঁর দুই সন্ন্যাসী কুকুর। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন- জানো, এই লাইনটা, বোল্ড লাভারস ক্যান্সট নেভার নেভার দাউ কিস- এই ব্যাপারটাকে ঠিক কিছু দিয়েই ধরা যায় না। আমরা বৃথাই এসব পড়ি। পড়াই। কিন্তু যা বাজে অন্তরে তা মনে হয় আরও বেশি সুন্দর, একে ধরা যায় না কিছুতেই। এ লাইন কীটস লেখেননি, লাইনটা নিজেই কীটসকে দিয়ে লিখিয়েছে। অনেকেই বলবেন এ সব ভাববাদের কথা। কিন্তু সত্যিই জড়বাদ আর ভাববাদের মধ্যে এই যে দ্বন্দ্ব, তার কোনও কারণ খুঁজে পাই না। কারণ দুটি ভিন্ন প্রেক্ষিতের। দুটির উদ্দেশ্যও আলাদা। যেমন, বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেই আপনি হয়তো কম্পিউটার বা মোবাইলে বসে এই লেখাটি পড়ছেন। আবার এই বিপুল মহাজগতের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞান নিজেই উদাসীন হয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। সে জানে, তাকে এগিয়ে যেতে হবে এমন এক উদ্দেশ্য-র দিকে, যার কোনও সীমারেখা নেই। জড়বাদের জগতে রয়েছে ডেফিনিট এক উদ্দেশ্য। ভাববাদের জগতে রয়েছে ইনডেফিনিট এক উদ্দেশ্য। সুতরাং, একটা দিয়ে আরেকটাকে কোনমতেই ব্যাখ্যা করা যাবে না। জানাও যাবে না। এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল আরেকটি জেন গল্পের কথা। অনেক দূরে এক পাহাড়ের কোলে ছিল এক জেন সন্ন্যাসীর বাড়ি। তাঁর কাছে পৌঁছনো মানে জীবন বাজি রেখে প্রায় মহাপ্রস্থানের পথে যাওয়া। তাই বেশির ভাগ লোক যেতই না। কিন্তু একজন তরুণ সেই পথে যাবে বলে পাড়ি দিল। দিনের পর দিন যায়, বছরের পর বছর যায়। সে রাস্তা ফুরোয় আর না। সে শুধু দেখে পাহাড়টি কাছে আসছে তার। রাস্তাটি এঁকেবেঁকে চলেছে। সে শুধু অনুভব করে তাকে যেতে হবে সেখানে, যেখানে রয়েছেন সেই প্রাজ্ঞ জেন। এই ভাবে পথে যেতে যেতে আলাপ হয় তার অনেকের সঙ্গে। আলাপ হয় সারা জীবন ধরে চাষ করে চলা চাষির সঙ্গে, দুঃখী মোটবাহকদের সঙ্গে, রূপকথার মতো দেখতে চাষিকন্যার সঙ্গে, ফুলে ফুলে ভরা গাছের সঙ্গে। একের পর এক গ্রাম পার হয় সে। একের পর এক নদী পার হয়। বয়স বাড়ে। বয়স ক্রমশ তাকে শ্লথ করে দেয়। তবু সে হেঁটে যায়। আর অনুভব করে, পাহাড় আগের থেকে কিছুটা হলেও কাছে এসেছে তার। শেষ পর্যন্ত সে বুড়ো হয়ে যায়। আর সে এগোতে পারে না। চারিদিকে দেখে তার ফেলে আসা পথের চিহ্নই যেন বা হয়ে উঠেছে এলোমেলো পাহাড়। সে ঠিক করে আর হয়ত সে যেতে পারবে না। কোথাও না কোথাও তো থেমে যেতেই হয়। দূরের দিকে তাকিয়ে দেখে সেই পাহাড়। যে পাহাড় পেরিয়ে হয়ত সেই সন্ন্যাসীর বাড়ি। এই জীবন ধরে চলতে চলতে ততদিনে তার অনেক শিষ্য হয়ে গেছে। সেই সব শিষ্যকেও সে বলে সেই পাহাড়ের কথা। সেই সন্ন্যাসীর কথা। বলে, যেতে হবে, সেই পাহাড়ে। তার জীবন শেষ হয়ে যায়। গল্পটি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হয় না। তার পরদিন এক বৃদ্ধ জেন সন্ন্যাসী হাজির হন সেখানে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কার জন্য কোথা থেকে এসেছেন? তিনি বলেন, ওই পাহাড় থেকে। তিনি শুনেছিলেন এক সন্ন্যাসীর কথা, যিনি প্রকৃতই জেনপ্রাপ্ত। পাড়ি দিয়েছিলেন দেখা করবেন বলে। আসতে লেগে গেল একজীবন। তাঁকে শিষ্যরা প্রশ্ন করে- তাহলে আপনিই কী সেই সন্ন্যাসী, যিনি থাকেন পাহাড়ের ওপারে? তিনি বলেন- হ্যাঁ। তখন তাঁরা তাঁকে প্রণাম করে বলে- আপনার কাছে দীক্ষা নেবেন বলে আমাদের গুরুদেব সারাজীবন ধরে হেঁটে এসেছেন। কিন্তু প্রাণত্যাগ করলেন। আর আপনি বলছেন, আপনি সারাজীবন হেঁটে এসেছেন তাঁর জন্য? শুনে চুপ করে থাকলেন সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। বললেন- এতেই বোঝা যায়, আমরা কেউ জেন পাইনি। শুধু একে অপরের দিকে হেঁটে এসেছি মাত্র। কারণ এইটুকুই আমরা করে যেতে পারি। আর কিছু নয়। এই বলে তিনিও অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আবার কোনও পথে হেঁটে গেলেন হয়ত। এই গল্পটি পড়ে আমার মনে হত এ যেন বন্ধন আর মুক্তির চিরকালীন পারস্পরিক খেলা। সেই চতুরঙ্গ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- গান গাওয়া হল মুক্তিকে বন্ধনের মধ্যে নিয়ে আসা এবং যে গান শোনে, সে বন্ধন থেকে মুক্তির দিকে যায়। তবে কি বন্ধন এবং মুক্তি পরস্পরের জন্য অপেক্ষা করে থাকে? দৃশ্য এবং দ্রষ্টার মতো? কবিতা এবং পাঠকের মতো? এমনকী নিহত ও হত্যাকারীর মতো? রিলকে তাঁর হেমন্ত নামক কবিতায় যেমন লিখেছিলেন- এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত। ‘যেন প্রতিশ্রুত’ – এই ভাবনাটি আমাকে বারবার ভাবায়। যেন আমরা সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুত হয়ে আছি, কিন্তু আমরা নিজেরাও তা অনুধাবন করতে পারছি না বলেই এত সমস্যা। সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ কিন্তু আমাদের কাজে নেই। আমাদের কাজ যে সমাজের মধ্যে নিজের আইডেন্টিটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে তার মধ্যে আছে। কারণ ‘কাজ’ এবং সেই ‘কাজ’ যে করছে, এই দুজনের অবস্থান ও সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক আলাদা। কবিতার সঙ্গে আর কবির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক আলাদা তার কারণ কবিতাকে কোনও সামাজিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও ডিফাইন করতে পারে না, যেখানে কবিকে পারে। যে সন্ন্যাসী হেঁটে চলেছেন সেই উদ্দেশ্যের দিকে, সেই উদ্দেশ্য-ও তো সেই সন্ন্যাসীর দিকে হেঁটে আসছেন। অথচ দুজনেই একে অপরকে জানেন না। জানতে চান। একে অপরকে উদ্দেশ্য মনে করেন। সেটি তখন-ই সম্ভব, যদি, যিনি বা যাঁরা হেঁটে আসছেন তাঁদের আর অন্য কোনও উদ্দেশ্য না থাকে।

এমন একজনের কথা বলি। তাঁর সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছিল পাহাড়ে। সেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে গোমুখ থেকে নন্দনবন ধরে চতুরঙ্গী গ্লেসিয়ার ধরে অলকানন্দার উৎস শতোপন্থ তাল ধরে বদ্রীনাথ যাওয়ার। তা, আমার সঙ্গে খুব সুন্দর আলাপ ছিল লালবাবা আশ্রমের গোপালবাবার। তিন চার বার যাওয়ার ফলে সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। তিনিও আমাদের বাড়ি আসতেন, শীতকালে। সেদিন ভোরে গোমুখ থেকে রওনা দেব আমি। যেহেতু সেবার একাই গিয়েছিলাম সেই দুর্গম রাস্তায় প্রবল আত্মবিশ্বাসে, তাই সঙ্গে আর কেউ না থাকায় কিছু সমস্যা ছিলই, আর তার বেশির ভাগটাই হল খাওয়ার সমস্যা। গাইড হিসেবে পেলাম নাগ সিং কে। এই নাগ সিং হলেন গোপালবাবার আশ্রমের এক দক্ষ গাইড। তো বেরোনর সময় নাগ সিংকে পইপই করে বলে দিলেন গোপালবাবা, এ হচ্ছে ‘দুবলা আদমি’, সবসময় এর সঙ্গে সঙ্গে যেতে হবে। আমি প্রবল আপত্তি করলাম এই কথায়। কাজ দিল না। যাই হোক, জার্নি শুরু করলাম। নন্দনবন পর্যন্ত চড়াই ভালোই, কিন্তু দারুণ রাস্তা। কিন্তু তার পর শুরু হল গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের উপর দিয়ে যাওয়া। কিছুদূর এগিয়ে গিয়েই চতুরঙ্গী গ্লেসিয়ার। এই চতুরঙ্গী গ্লেসিয়ারের রাস্তাটি অনেকটা মেরুদণ্ডী পথের মতো। দুদিকেই নেমে গেছে খাদ। উঠে যাওয়া। তো, আমি তো একটু গিয়েই অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে থামি। ক্যামেরা বের করি। কিন্তু নাগ সিং তা করতে দেবে না। পিঠে রীতিমতো খোঁচা দেবে। এভাবে আমাকে সারা রাস্তা প্রায় গোরু চড়ানোর মতো করে নিয়ে গেল। আমি তো প্রচণ্ড রেগে গেলাম। এ কী রে ভাই! পাহাড়ে এসেও যদি এরকম হিটলারি শাসনের মধ্যে চলতে হয়, তাহলে আর কীসের মুক্তি? সে যাই হোক, নাগ সিং বলল, আরে এ রাস্তায় পাথর পড়ে। আর আপনি দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন! ‘আজীব পাবলিক’! শূনে আরও রেগে গেলাম। এত বরফ যে সে রাস্তায় আইস এক্স নিতেই হয়। মাটিতে জোরে জোরে ঠুকে এগোতে এগোতে হল বিপদ। এক জায়গায় কী ছিল জানি না। আমি দেখলাম পা পিছলে গেছে, আর আমি পড়ছি। কত নীচুতে পড়ছি আমি জানিনা। বরফের গায়ে আইস এক্স ঠুকতে ঠুকতে পড়ছি। বুঝতে পারছি অবস্থা সঙ্গিন। কিন্তু সৌভাগ্য আমার, একটি হ্যাঙ্গিং চেয়ারের মতো জায়গায় এসে পা মাটি পেল আর এক্সটাও বরফে আটকে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম উপর থেকে ধপাস করে এসে পড়ল নাগ সিং। বরফ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল- যাক। আমার তো তখন সারা গায়ে ব্যথা। বললাম- আপনি? নাগ সিং বলল- হ্যাঁ, আপনাকে পড়তে দেখে লাফালাম। জিজ্ঞেস করলাম- কত ফুট হবে? বলল- প্রায়্ ৪০ ফুট। নীচের দিকে তাকালাম। হ্যাঙ্গিং চেয়ারের সামনে অনন্ত খাদ। প্রায় ৫০০ /১০০০ ফুট নীচে গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার। বললাম- আপনি লাফালেন? মরে যেতে তো পারতেন? বললেন- আরে আপনার দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। এটাই তো আমার কাজ। আর মরে যাওয়া? পাহাড় মে তো এয়সা হোতাই হ্যায়।

কিন্তু এই গল্পটি আমি কেন বললাম! সে কী কেবল দায়িত্ববোধের জন্য? যিনি নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য নিজের প্রাণকেও বিসর্জন দিতে পিছপা হন না? তেমন মানুষ তো অনেকেই আছেন। অনেক সময় এই কাজগুলি ইন্দ্রিয়নির্ভর হয় যাকে বলে ইন্সটিংটিভ। আমার মনে হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কথা। মনে হয়েছিল একধরনের উদাসীনতার সঙ্গে তিনি কাজগুলি করছেন, যে উদাসীনতা তাঁকে কাজের সামাজিক ভূমিকার চেয়েও কাজের দার্শনিক ভূমিকার কাছে নিয়ে এসেছে, তাকেই বোঝার চেষ্টা করেছিলাম অনেকদিন। এখনও করি। কাজের সামাজিক ভূমিকা নিয়ে আমার তেমন কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু কাজের দার্শনিক ভূমিকা আমাকে বিস্মিত করে। এমন অনেক সাধারণ মানুষ এমন সব ভাবনার মধ্যে নিয়ে যান, যা আমার কাছে চিরকালীন এক বিস্ময়ের জায়গা।

সাধারণের মধ্যে অসাধারণ, ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহৎ ও বৃহতের মধ্যে ক্ষুদ্র,- এই বিষয়টিকে খুঁজে যাওয়াই সম্ভবত শিল্পের কাজ বলে মনে হয়। শুধু শিল্প কেন, জীবনের কাজ। আর এই কাজের মধ্যে কাজ করা সম্পর্কে একধরনের নিশ্চেষ্টতাও কাজ করে বলে মনে হয়। ব্যাপারটি অনেকটা হিমালয়ে হাঁটার মতোই। একবার সুন্দরডুঙ্গা যাচ্ছি। অফিস থেকে ছুটি নিয়েই। কিন্তু যাচ্ছি যে, যাওয়ার মধ্যে আমাদের কারুর কোনও এমন তাড়া বা উদ্যম নেই, যে আমাদের যেতেই হবে। ঠিক করেই রেখেছিলাম, এগিয়ে যাব। তাড়াহীন। গেলে ভাল। নাহলে যেখান থেকে আর যেতে পারব না, সেখানেই কিছুদিন থেকে ফিরে আসব। কিছু তো প্রমাণ করার উদ্দেশ্য নেই। রাস্তাটির ভয়াবহতা সম্পর্কেও খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলাম না। পরে গেছি পাতি একটা কেডস। তো, তিনজন মিলে যাচ্ছি। একটা জায়গায় এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ হল এক যুবকের। তিনি আসছেন সেই সুদূর সুইডেন থেকে। তিনি আমাদের সঙ্গ নিতে চাইলেন। তখন অগত্যা বলেই দিলাম, দেখুন আপনি আমাদের সঙ্গ নেবেন, আমরা এতে আপ্লুত। কিন্তু আমাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই, যেতে না পারলে দুঃখ নেই, ফলে যেখান থেকে পারব না মনে হবে, জাস্ট ফিরে আসব। সেই ব্যক্তিটি বললেন- আমিও তো তাই। শেষ তিন মাস ধরে হিমালয়ে ঘুরছি। ফলে আমাকে যে যেতেই হবে, তার মানে নেই। ব্যাস, বন্ধুত্ব হতে দেরি হল না। চলতেই থাকলাম। রাস্তায় আমাদের দেখে ফিরে আসা লোকজন বলতে লাগলেন- পারবেন না, এই জুতো পরে পারবেন না। বললাম- পারব না যখন , যাব না। তো, এমন হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে কখন চলেও গেলাম। কোনও কষ্ট কিন্তু হল না। জুতোর কথা ভুলেও গেলাম। অথচ এমন স্ক্রি জোনে যেতে হলে বিশেষ জুতো তো লাগেই। কিন্তু হিমালয় বোধ হয় তখন আমাদের ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাই, অসুবিধা হয়নি। হিমালয়ে নানা সময়ে ঘুরতে ঘুরতে এমন অনেক সাধু সন্ন্যাসী ভবঘুরে বিদেশির সাক্ষাৎ পাই, তাদের সত্যিই কোথাও যাওয়ার নেই। উদ্দেশ্য নেই। গেলে ভালো, না গেলেও ভালো। একটু ‘তাই কি’ গোছের। এই মনে পড়ে গেল আরেকটি জেন গল্প। একটি গ্রামে গুহায় এক জেন সন্ন্যাসী বাস করেন। কারু সাতে পাঁচে থাকেন না। গ্রামের লোকজন যান, কথা বলেন। তো, গ্রামের এক যুবক ও যুবতী পরস্পরকে খুব ভালোবাসে। ক্রমে মেয়েটি গর্ভবতী হয়। ছেলেটি চাকরি খোঁজার নামে শহরে চলে যায়। কিন্তু আর পাত্তা নেই। ক্রমে যখন লোকে জানতে পারে, মেয়েটি গর্ভবতী, তখন গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। মেয়েটি তখন নিজেকে বাঁচাতে বলে, তার সন্তানের পিতা ওই জেন সন্ন্যাসী। গ্রামের লোক খুব ক্ষিপ্ত হয়ে পাহাড়ে যায়। জেন সন্ন্যাসীকে বলে, আপনি এই কাণ্ড করেছেন, আপনাকে এই সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি শুধু বলেন- তাই কি? ক্রমে মেয়েটির সন্তান হয়। সন্তান সন্ন্যাসীর কাছে বড় হতে থাকে। খুব স্নেহ আদরেই বড় হতে থাকে। সন্ন্যাসী ছেলেটিকে খুব ভালোবেসেফেলেন। যখন ছেলেটি প্রায় বড় হয়ে গেছে, তখন সেই ছেলেটি ফিরে আসে। তার মনে কষ্ট হয়, অনুতাপ হয়। গ্রামের সবাইকে ডেকে নিজের কাণ্ডের কথা খোলসা করে বলে। মেয়েটি ও ছেলেটিকে নিয়ে গোটা গ্রাম হাজির হয় পাহাড়ে সেই সন্ন্যাসীর কাছে। ছেলেটিকে ফেরত দিতে দিতে সন্ন্যাসী শুধু বলেন- তাই কি?

আমি জানি না বাস্তব জীবনে সত্যি এমন উদাসীন হওয়া যায় কিনা! আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, যখন হিমালয়ে যাই, তখন সম্পূর্ণ এক অন্য মানুষের ইঙ্গিত টের পাই নিজের ভিতরে। কিন্তু যখন থাকি এই আধুনিক, নাগরিক, যান্ত্রিক সভ্যতায়, তখন মন থেকে কখন এ সব ভাবনা হারিয়ে যায়। আমাদের জীবন থেকে মনে হয় উদাসীনতা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আর তাই এত সব জটিলতা। অবশ্য ব্যাপারটাকে এত সহজ সরল হিসেবে না দেখলেও চলবে। সেদিন ভাবছিলাম, নিজেদের আমরা কত বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখি! অথচ এত বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখি বলেই সমস্যা হয়। খ্যাতি হচ্ছে আমাদের শরীরের মতো। জীর্ণ হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঝরেও যায়। কিন্তু মৃত্যুর জন্য জীবন যেমন অপেক্ষা করে থাকে সারাজীবন, আর সেই অপেক্ষার মধ্যে যেমন মৃত্যুকে প্রতি মুহূর্তে হারিয়ে দেওয়ার একটি আকাঙ্খাও কাজ করে, তেমন চলতে থাকে জীবন নিয়ে আমাদের নানান লীলা। কেউ সাজ নিয়ে, কেউ বাড়ি নিয়ে, কেউ সংসার নিয়ে, কেউ টাকা নিয়ে আবার কেউ খ্যাতি নিয়ে। কেউ বা ক্ষমতা নিয়ে। খ্যাতি তো ক্ষমতাই দেয়, আবার ক্ষমতার প্রসাদ না থাকলে খ্যাতি পাওয়াও যায় না। কিন্তু এই যে চেষ্টা, মৃত্যুকে হারানোর চেষ্টা, নিজেকে অন্যতম প্রধান হিসেবে প্রতিষ্টিত করার চেষ্টা, নিজের সমাধির উপরে নিজের স্ট্যাচু গড়ে তোলার চেষ্টা, এর মধ্যে আর যাই হোক নির্জন নিশ্চেষ্ট উদাসীন আসক্তি নেই। এই উদাসীন আসক্তি কাকে বলে টের পেয়েছিলাম একবার।

তাঁর সঙ্গে যে সেবার সে সময়ে দেখা হবে, ভাবতেই পারিনি। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। ১৬০০০ ফুটের উপর তখন মেঘভাঙা বৃষ্টি। বরফ পড়ল ব’লে! কাঁপতে কাঁপতে হাজির হলাম হেমকুণ্ড সাহিবের ক্যাম্পে। উদ্দেশ্য ছিল ব্রহ্মকমল দেখা। পেয়ে গেলাম প্রকৃতই ব্রহ্মাকে। বাইরে তখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমার সমস্ত শরীরে আর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। উচ্চতাজনিত কষ্ট বুঝতে পারছি। ভেসে আসছে আমার প্রিয় এক লেখক অরূপরতন বসুর সাবধানবাণী- ‘ যাবে, যাও। জানবে, বেশি উঁচুতে উঠলে মাথা ফাঁকা হয়ে যায়’। সঙ্গে তার সেই বিখ্যাত হাসি।

Facebook Comments

Related posts

4 Thoughts to “বিপন্ন বিস্ময়গুলি – পর্ব ৩”

  1. Ruma Tapadar

    আমরা নিজেদের যখনি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি প্রকৃতপক্ষে তখনি তো আমরা উদাসীন হয়ে যায় নিজেদের প্রতি।গুরুত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্রেন একটিভ হয়ে ওঠে মন অপেক্ষাকৃত কম থেকে আরো কম ভিতরকারএকা মানুষটি আরো একা হতে থাকে। আপনি যখন হিমালয়ে যান তখন নিজের মধ্যে যে মানুষ টিকে পান,সেটিই আপনি।নগর জীবনের ব্যস্ত মানুষ টিও আপনি, হারিয়ে যান না কোথাও আপনার উদাসীনতা দিয়ে শহুরেজটিলতা খুলতে খুলতে যান বলেইউদাসীনতা টের পান না।আমার মনে হয় এহল উদাসীনতার প্রতি উদাসীনতা। এও তো এক জেন প্রাপ্তি। নাম,যশ খ্যতির প্রতি আসক্তি হলে যেমন উদাসীনতা থাকেনা তেমনি উদাসীনতার প্রতি আসক্তি হলে আসক্তি হয়,সেখানে উদাসীনতা কোথায়,?যেমন উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হেঁটে যাওয়াও তো এক উদ্দেশ্য…

    1. Sanghamitra Halder

      অনেক ধন্যবাদ

  2. শৌভ

    খুব ভালো লেখা! অত্যন্ত গভীর উপলব্ধির লেখা। আজকাল, এই বস্তুকেন্দ্রিক জগতে, যখন আমাদের উপলব্ধির ধার ক্রমশই কমে আসছে, ক্রমশই ভোঁতা হয়ে আসছে আমাদের অনুভূতিগুলো; যখন, আমাদের প্রত্যক্ষ, স্থূল ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্বের চাপে আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে অন্যতর অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা; যখন যুক্তিবাদের অযৌক্তিক অহংকারে আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, আমাদের এই জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোরও একটা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তখন এইধরণের লেখাগুলো একরকম প্রত্যয় যোগায়।

    পুনশ্চঃ এর আগের পর্বগুলো, ইতোপূর্বে, আমার পড়া হয়নি। এই পর্বটি পড়ে ভালো লাগল বলে, সেগুলোও খুঁজে নিয়ে পড়লাম।

    1. Sanghamitra Halder

      অনেক ধন্যবাদ শৌভ

Leave a Comment