অর্ক চট্টোপাধ্যায়

বাক্যকাব্য

কাছের মানুষের মৃত্যুতে জীবন ক্রমশ দূরতিক্রম্য হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না সম্পূর্ণভাবে অনতিক্রম্য হয়ে পড়ছে। চোখের সামনে অনেকগুলো পর্দা তৈরী হয় দূরত্বের। কতোকিছুতে আর ফিরে যাওয়া যায় না। যাবে না। অনেকদিন পর ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে উঠেছে সঞ্জয় । চলে যাবার আগে শেষবার। সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোয় ছোটবেলার বদলে যাওয়া শহরতলি। আজকাল আর এবাড়িতে থাকা হয় কই? কর্মসূত্রে রাজ্যছাড়া। রাজ্য? রাজ্য তো রাজার হয়! সঞ্জয় তো নিতান্ত প্রজা!

প্রায় দশ বছর আগে লেখা একটা গল্পের লাইন মনে পড়ে যায় ওর: ‘এতোটা ওপরে থাকলে কেমন রাজা রাজা ভাব হয়।‘ ঐ ভাবই বটে! আজ এক দশকের বেশি হল সে গল্প লিখছে। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে নিজের লেখা একেকটা বাক্য কেমন যেন হন্ট করতে শুরু করেছে সঞ্জয়কে। এক একটা বাক্য থাকে, মৃত্যুর মতো একা। ভর করে নিলে রাজা-গজা সব একাকার।

যারা মনে করেন লেখক নিজের লেখার দুনিয়ায় রাজা, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, সে কত অসহায়? লেখা মানেই লেখক থেকে লেখা হয়ে যাওয়া। অক্ষরে অক্ষরে মৃত্যুবৎ দূরত্ব এবং সান্ধ্যভাষার প্রহেলিকা। এই যে বুকের ভেতর উচাটন, এটাকে বার করে আনার জন্য লেখা, কিন্তু এ কি আর ওতো সহজে প্রকাশ পায়? বেশিরভাগটাই অস্ফুট রয়ে যায়। বাক্যেরা কেবলই শববাহক। কলমগুলো শ্মশ্মানপথে চলে যায়।

ঘনীভূত হতে থাকা অন্ধকারে পুনরাবৃত্তিহীন অতীতের কথা মনে পড়লে সঞ্জয়ের চোখ দূরে চায়। পূর্বদিক, নাকি ওটা পশ্চিম? রাস্তা, মাঠ, হলদিবাটি ছাড়িয়ে আমগাছে ঘেরা ঐতো সঞ্জয়ের পুরোনো পাড়া! পোড়া, মরা গাছ ছাড়িয়ে চক্কোত্তিদের বাড়ি, তারপর কারখানা, আর তারপরেই আমগাছে ঢাকা ওই তিনতলা বাড়ি, যার দোতলায় ওর ছোট থেকে বড়বেলার সিংহভাগ কেটেছে।

উচ্চতা দেখতে সাহায্য করে বটে, তবে দূরত্বও বাড়িয়ে দেয়। ছাদ থেকে দূরবর্তী জন্মবাড়িকে অপরের নাটকের কুশীলব মনে হয়। যেন অন্য কেউ বড়ো হয়েছিল ওখানে, অন্য কারুর দিনরাত-জীবন কেটেছিল, অন্য কেউ মারা গিয়েছিল ওখানে। অন্ধকার সঞ্জয়ের চোখ দিয়ে ঢুকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় মাথার ভেতর লিখে দিয়ে যায় ছায়াময় এক বাক্য:

‘ধ্বংসের আশ্রয়, অলীক অতীত, বেজান সময়, সকলকিছুই মনের পার।’

তর্জমাসুলভ বাক্যটি সঞ্জয়ের সূক্ষশরীর বহন করে আমগাছে ঘেরা জন্মবাটিতে নিয়ে গিয়ে ফেলে। শ্মশ্মানের আগুনের উজ্জ্বলতায় জ্বলে ওঠে জন্মবাটির উঠোন। সহসার সে আগুন-আলোর আবেশে অনতিক্রম্যের মতো করাল শব্দকেও কেমন নমনীয় দেখায়।

সময় তাকে উঠোনের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়। নাকে ভেসে আসে বসন্ত মালতীর গন্ধ। না, বসন্ত মালতী ফুল নয়। সঞ্জয়ের ছোটবেলায় ঐ নামের একটা ক্রীম ছিল। বসন্ত মালতী ক্রীম। ক্রীমের মিষ্টি গন্ধে মম করছে জন্মবাটির উঠোন। তারপর কেন জানি না, সঞ্জয় দূরদর্শনে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন বাজাতে দেখলেই তাকে ‘বসন্ত মালতী’ বলে উঠতো। ঠিক কি সম্পর্ক ছিল ক্রীমের সঙ্গে পিয়ানোর? তা আজ আর নতুন করে বোঝা সম্ভব নয়। এমনিতেও যে ক্রীম আর পিয়ানো গুলিয়ে ফেলতো, তাদের জুড়ে দিত একই একটা শব্দ দিয়ে, সেই ছোট ছেলেটার সঙ্গে সঞ্জয়ের কোন মিল নেই। সে উচ্চতাহত অন্যমানুষ। নিজেকে অন্য ভাবে। এভাবেই তো গল্পের জন্ম হয়।

সঞ্জয় উঠোন থেকে ঘরে ঢুকতে ভয় পায়। অতীতকে ভয় পায় সে। মৃতের রেখে যাওয়া প্রতিটা খুঁটিনাটি জিনিস মৃত্যু হয়ে যায়, পড়ে থাকতে থাকতে। তাদের মধ্যে এসে জড়ো হয় মৃত্যুর প্রাণ। সেসব মৃত্যুর আশ্রয়ের হাতছানি ভর করে সঞ্জয়কে। যতক্ষণ না বাক্যগুলো গলে যাচ্ছে। যতক্ষণ না বাক্যগুলো জায়গা করে দিচ্ছে সময়কে, সময়ের এপাশে ওপাশে গিয়ে বসছে। বাক্যের স্বধর্মে অপর আর অপর থাকে না। আবেশে অবশ হওয়ার পিছুটান থেকে যায়। সঞ্জয় তাই বাক্যদের সরিয়ে ছুটে যেতে চায় বাইরের মাঠের দিকে। মাঠ মানেই বিকেল, খেলা। মাঠের কি আর রাত হয়? রাত তো হয় বাড়ির? এখন যেমন রাত নেমেছে তার ছোটবেলায়।

নিজের পুরোনো লেখা সহজে মনে করা যায় না। বাক্যেরা স্মৃতির কাছে ধরা দিতে চায় না। সেই যে লেখাটা, মৃত্যুর আগে যেখানে অসুস্থতা ছিল, সেই লেখার একটা বাক্য প্রাণপণ চেষ্টার পরেও মনে এলো না সঞ্জয়ের। অথচ মাথার মধ্যে আবছায়া হয়ে ঘুরতে লাগলো। ‘সুতোয় বাঁধা শরীর’ কথাটা ছিল সে বাক্যে। শুধু এইটুকুই মনে এলো। বাকিটা ছিনিমিনি খেলতে লাগলো। তারপর আরেকটা। ‘লোকটা যা কিছু পারেনি, পারবে না কোনদিন, সেইসব না পারার ভেতর মাথা গুঁজে বসে থাকে।’ তাও একেবারে হুবহু মনে এলো না বাক্যটা। উদ্ধৃতিতে গোলোযোগ হল, তবে মর্মার্থে নয়। মৃত্যু রুখতে না পারা মানুষের জীবন, তাও সে আপ্রাণ রুখতে চায় তাকে। আর না পারলে নিজেকে ব্যর্থ মনে করে।

কার মৃত্যু? তা আর কোনোদিন জানা যাবে না। সঞ্জয় উঠোনের ঠিক মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালো। তারপর একে একে পুরোনো ঘরগুলোর দিকে তাকালো। তার দৃষ্টির সুবাদে একেকটা ঘর একেকটা বাক্য হয়ে গলে গেলো। আলটপকা হতাশার মতো খসে পড়লো একেকটা বাক্য আর ঘরগুলো একেক করে উবে যেতে লাগলো। শেষে বাড়িটা। উঠোনটা। সবই বাক্য হয়ে উবে গেলো। সঞ্জয় ফিরে এলো ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে। মুঠোভর্তি বাক্য তার হাতে। প্রতিটা ঘরের জন্য একটা। তারপর উঠোনের জন্য এক আর গোটা বাড়ির জন্য আরেক।

১. সঞ্জয় বলে কেউ কোনোদিন এই বাড়িতে থাকতো না।

২. গোটা একটা বংশতালিকা শেষ হয়ে যায় এবাড়িতে।

৩. একটা প্রজন্ম। তিন তিনটে ছেলে আর তাদের স্ত্রী। কারুর কোনো বাচ্চা হলো না।

৪. বাড়িটা হয়তো সেদিনই গলতে শুরু করে। তারপর এতবছর ধরে একটু একটু লেখার সঙ্গে ক্রমশ গলেপচে যায়।

৫. ফ্ল্যাটবাড়ির এই ছাদটায় আর আসে না কিশোর। তার বন্ধু সঞ্জয় থাকতো তিনতলায়। সে নেই, আজ নয় নয় করে তিন বছর হয়ে গেল। আজ ওর জন্মদিনে পুরোনো আড্ডার ঠেকে এসে নিজেকে বড়ো একলা লাগে কিশোরের। সঞ্জয় একবার ওর এক গল্পে লিখেছিলো:

‘একলা মানুষের দৃষ্টি দৃশ্যপ্রান্তে বাসা বাঁধে। উই হয়ে যায়।’

সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। অনেকগুলো বছর আগেকার কথা।

 

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment