১।
অপেক্ষার মত অশান্ত একটা ঢেউ দেখতে
খালি পায়ে অজস্র মানুষ চলে যাচ্ছে সচরাচর পেরিয়ে –
ভূখন্ড সাদা, লবনের শুভ্রতা দুঃখের হাসির মত
একটা মুখমন্ডল খেয়ে ফেলেছে –
সৌন্দর্য দেখে ঈশানী, মনে পড়ে
আমার ইতিহাস ভূগোল সবই সমান পিচ্ছিল –
হয়ত রক্তে
বাসি ভগ্নপ্রায় এই খন্ডদৃশ্য তোলা আছে
দীর্ঘদিন পর দেখবার জন্য
সময় ও মানুষের গলে যাওয়ার মধ্যে আছে
একটা লুপ্ত নদী –
অন্যথায় যাকে বলা যায়
শূন্যতা –
বা একটা দেওয়াল
বা এমনকিছু যা
কোনওকিছুর থেকেই আলাদা নয় –
আজ সন্ধেবেলা এক প্রৌঢ়া আমার কাছে আসায় আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেলাম
তাঁর একাকিত্বে সমানতালে একটা রেডিও বাজছিল
সারা ঘর সে কয়েক মুহূর্তে ভরে যায়
আমি তাঁর মধ্যে থেকে শুনতে পাই
মানুষের ছেড়ে যাওয়ার পর দুঃখিত উপোসী ভূখন্ডে
শুষ্ক ঘাসেদের জন্মচিৎকার
একটা ঢেউ উঠছে – শুনতে পাই তা-ও
২।
মানুষের অসামান্য কাছে গেলে কী হয়?
আমার মনের মধ্যে খালি একটা অহ্ন জ্বলজ্বল করে।
ঝুঁকে দেখো, কষ্টের ফুল – মানুষের ভাত-খাওয়া কত ভ্রমরপ্রত্যাশী,
সুন্দর
দেখে যদি বলি, অকস্মাৎ মন ভারী হয়ে ওঠার নাম ভগবান
গাঁ গঞ্জের লোকজন কি আমায় ক্ষমা করবে?
বাতার প্রাচীর ছিল, সরু কঞ্চি দিয়ে আড়াল আগলে রাখা
ওপরে অ্যাজবেস্টস – সম্পর্কের বুনিয়াদও এক রকম স্খলিতই
হয়ত কাগজ-সাঁটা আঠা দিয়ে দেওয়াল খাড়া করা। লেখা –
বিপ্লব, প্রকৃত সুসন্তানের মতো শতায়ু হও হে!
এই অনন্ত শূন্যতার মধ্যে উচ্ছেদ শব্দটি একটি স্থানীয় সংবাদ হয়ে
ধুকপুক করবে রেল ইয়ার্ড বরাবর কাঁচা রাস্তায়…
যাকে বলি ভগবান, তাঁর অনবরত আত্মা
বাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। পৃথিবী
ইলেকট্রিক পোলের চূড়ায়
বারংবার একটি পায়রাকে স্বীকার করে বার্তা দেয়ঃ
তুমি মনোনীত। মনোনীত
আলোবাতাস খেলা করছে একজন ভাঙা মানুষের ভূমিকায়
মানুষের কাছে যেতে চেয়ে
মানুষের কাছে যেতে না পেরে
৩।
এইবার একটা ক্ষীণ মানুষ হাওয়ার ভূমিকায় নামলেন
ধুলিকণাগুলোকে কে যেন ডাকছে – অমল অমল
এখানে গ্রাম ছিল – তার আগে বটগাছ। তারও আগে
শুধুই বটের ছায়া দীর্ঘ শতাব্দী জুড়ে প্রাণ-জুড়ানো প্রশ্ন করে রাখে –
ক্লান্তি তুমি কতদূর হইতে আসিয়াছ?
কথিত আছে এই বুড়ো পাহাড় অসীম কারও দুঃখের ভারমাত্র – এক বিশাল জনজাতি সাবাড় হয়ে
গিয়েছে, এখন শুধু কিছু মাটির খেলনা যার প্রতিটা মৌলে খুকুর তীব্র আবেগ – কী ছিল না,
সারাজীবন একটা জীবনে কী ছিল না – ছটফট করে
আমাদের সৃষ্টিকর্তা ছিলেন বেশ ছোটখাটো লোক। তাঁর দুচোখে এখন শোনা যায় শুধুই শৈত্য প্রবাহ
– এখন চরাচরে অনুপস্থিতির থেকে গম্ভীর আর কিছু নেই। থাকতে পারে না। শোনা যায় বেদনা এত
ঠান্ডা না হলে তাকে আরও সুন্দরভাবে পাওয়া সম্ভব। এই মনুষ্যজন্মেই।
যখন
নাম-ভূমিকায় খেলে যাচ্ছে আলো ও বাতাস
উড়তে উড়তে একটা ভাঙা পাখি ক্ষয়ে যাচ্ছে দৃশ্যে
আর একটুকরো পাথর হয়ত – বা তার থেকেও নির্জীব কোনও বস্তু
আমার ভূমিকায় অভিনয় করে যায়।
৪।
খুব প্রসন্ন অসহায়তা নিয়ে একজন বেঁচে আছে।
মানুষের মতো নদীর কংকাল বালির মধ্যে পড়ে থাকে –
বেঁচে থাকার মাংস – তার মনে হয় –
কে খায়? চতুর্দিকে
থলিবন্দী শূন্যতা, খাজনাবোঝাই
মসৃণ পিচের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ট্রাক
ছবিতে তাকে দেখলে মনে হয়
একাকীত্বের বাঁ গালে একটি সূর্য-দাগের তিল
থাকলে মানুষ হয় খুব গভীর হয়ে থাকে –
জল ও একটু নিস্তব্ধতা পেলেই দিন কাবার করে নেয় –
তারপর একটা ভগ্নস্বাস্থ্যের বুড়ি এসে–
কলকাত্তাকে কাঁহা সে – শুধালে বলে
মরুক্রন্দসী কিন্তু বড় সরেস জিনিস।
অসীম বেদনা ও রূপো ঝরা আনন্দে
খাঁটি দুধের অশ্রু দোহন করা যায় সম্পর্ক থেকে।
দলে দলে লোক উটের প্রদেশে আসেই কেবল
আদিগন্ত
ও
চরাচর
শব্দদুটিকে এ জীবনে ব্যবহার করবে বলে।
৫।
একটা পুকুরের ধ্বংসস্তুপ বলতে লোকে কী বোঝে?
নিশ্চয়ই বহু নীচে জমে থাকা বিসর্জন দেখতে পায়।
নিজের বয়স ভাঙা হাওয়ার মতো
মন্থর হয়ে যাক তারপর সবকিছু – এই-ই চাওয়া
একটা দৃশ্যে যখন বিন্দুর মতো গেঁথে যাচ্ছে কেন্দ্র,
তখন আর কিছু বাকী থাকে না
অঙ্কুরের মতো শুধু চোখ দুটো
একটানা বিস্ময়হীন বুদ্বুদ্ তোলে শূন্যতায়
ফুটে থাকে, আজ সকাল
শীত স্বভাবের কাছে হঠাৎ নত হয়ে এল, ছায়ার উত্তাপ
ঘেঁটে কেউ তুলে আনছে স্মৃতি
ডাক পাড়ছে – আরেকটু বড় রশশি দিন
পানা আমাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে
মনে পড়ছে খালি মনে পড়ছে এককালে আমরা সমবয়সী ছিলাম
কথা হল তোতোন ঠাকুর যদি সত্যি ফিরে আসে
হাতে এক ডালা অস্ত্র শস্ত্র – ভালোবাসার…
…যারা চলে যায় – তারা কি সত্যি হওয়া থেকে বিরত হল গো?
যারা আছো সকল
তারা কোথাও না কোথাও তো নেই –
৬।
একই লোক নিজের সন্তান
তার সন্তান, পৌত্র, এমনকী তারও পৌত্র হতে হতে
তুলসীগাছ। উঠোনের মাঝে যখন
কুলদেবতার মতো বয়স দাঁড়িয়ে আছে।
সহজ কথায়, ছিল বলেই মানুষ টিকে যায়
ভেঙে ফেলার আগে তাকে শেষবার দেখতে এসে
ঠিক বুঝতে পারি না কী দেখব।
এই তো ইহজীবনে মাঝে মাঝেই
পদ্মার গাঙ ধরে হাঁফ ওঠে টান ওঠে
সুখ থেকে শিহরণ থেকে আস্ত সূর্য থেকে
স্খলিত হয় অস্ত যাওয়া সূর্য
পুরো ভূখন্ড জুড়ে চাকার দাগ তবু
তাঁকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়
আগে একজন লোকের ভূনিকায় দিলীপবাবু অভিনয় করতেন
মঞ্চে তারপর আনন্দবাবু আসেন
আজ যিনি এখানে তিনি একই সঙ্গে দিলীপ আনন্দ
অরুণ অনিল – সোজা কথায়
আজ যিনি অভিনয় করেন তিনি
ধুলো দক্ষিণের জানালা, বড় সড়ক –
বিদ্যুৎ সংযোগ – ও অন্ধকার
অর্থাৎ বছর বছরের ইতিহাস
তাকে ঘিরে চাকার দাগ বাড়তে পারে যত ইচ্ছে
তার ওপরে বিমানের নীল ভাঙা পথ যতটা সম্ভব
৭।
আমার একটি ব্যক্তিগত পিশাচ ছিল
শুধু অশরীরী বলেই তার তৃপ্তির সীমা ছিল না,
তল ছিল না অতীতের –
দু পলক অবাক ছিটিয়েই তাকে বশ করা যেত
কেননা তৃষ্ণা একটি প্রতিসরণমাত্র, আকাঙ্খার
গমনাগমনের পথে আমার মধ্যে প্রায়ই
উটের ছাপ ফুটে ওঠে। আমার মধ্যে
প্রবল অহ্ন পুড়ে যায়, তোমার আচমনের শীতল
এ করপুটে আঁটে না, আঁটে না
মহাকাল আসলে প্রতিমুহূর্তই
তার সংকেতের ভারে দৃষ্টি তোমার টানাটানা সীমাহীন মণিহীন সাদা প্রেত হয়ে গেলে পরে
শুনতে পাওয়া যায় খুব মন দিয়ে এখন শিশির পড়ছে সর্বত্র। তখন
তোমার আচমনের মতোই শীতল তোমার বিস্ময়
আমার থেকে শান্ত আমার ছায়া
খুব অন্ধকারে গাছের শিকড়
এখন এখান থেকে
বহুদূর চলে যায়
বহুদূর
দৃশ্য দুটি চোখ খেয়ে গেছে
৮।
এক।
ভাবো আমার ঠিক পাশে বসে তোমার পিত্তসবুজ মন
কেউ ভেঙে দিল। বজ্রপাতের ভয় তখন। আমার ভিতরে সমস্ত
বৈদ্যুতিক সংযোগ আমি খুলে রাখছি – হঠাৎ
তোমার কান্নার সোঁদা ঝাপট
এইভাবে একটি গল্পের চরিত্র ডাক দেয় – রাজু, রাজু
পঞ্চম পরিচ্ছেদে এসে সমবেদনার কাছে দাঁড়িয়ে
ভিরমি খায় ভ্যাবাচ্যাকা খায়
দুই।
গ্যালারিভর্তি করতালি ফড়িং হয়ে উড়লে
বৃদ্ধ দম্পতি খেয়াল করছেন –
এই যাঃ ছাতা ভুলে এসেছি তো
এবার কী হবে সেটা কিন্তু শহরের বেশিরভাগ
সীমাই জানতে পারে না আজীবন। হতে পারত প্রথম চুম্বন
কিন্তু কী দরকার দুঃখে ভাগ নিয়ে –
এই সমস্ত চিন্তায় মানুষের প্রতি নিপাট ভালবাসা
একটা বস্তির গলির মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে
তিন।
সীগাল সহ অন্যান্য ছোটখাটো সামদ্রিক পাখি
চাইলে কিন্তু বাংলা কবিতা লিখতে পারে।
আমাদের বাধাহীন কবিতার মানচিত্রে গুটি গুটি মানুষ ঘুরছে পিঁপড়ের মত
এ কল্পনা করলে একটা স্বতোৎসারিত দুঃখ পাওয়া যায়
বস্তির বাম দিকে লোনা খন্দ, ছিপদুপুর
উড়ানসম্ভব আকাশ তার ওপর, বিমানমুক্ত, সদাই
ধারে দামী ফুলের ঝোপঝাড়
যে পাখিদের বৃক্ক ছোট তাদের শরীর টিকবে কী করে
সমুদ্রের জল খেলে – বড় লবনের ভার
কেঁদে তাই তৃষ্ণার বিষ মিটিয়ে দিতে
আকাশে তারা জড়ো হচ্ছেন –
নীচে
চাল নেই গুমোট,
বাপ নিখোঁজ উৎকন্ঠা,
বোন রেপড চীৎকার,
বেড়াল মারা গেছে এমন অশুভ ডাক যুক্ত হওয়া অশ্রুর একটি
ঘরোয়া সাগর
২০১৭ সাল। সময় ঠিক ঘড়িবিদ্ধ বৈকাল
স্থান মাটি থেকে আধমাইল ওপরে
কবিসম্মেলনে আপনি আমন্ত্রিত
Sundor