বিশ্বজিৎ রায়

কবিতাযাপনঃ ‘এবার আপনারা যে যার মতো বন্দুক তুলতে পারেন…’

শান্তিনিকেতন আর বোলপুর লাগোয়া তবে দুয়ের মধ্যে ধাতুগত পার্থক্য আছে । শান্তিনিকেতন অভিজাত, আন্তর্জাতিক । বোলপুর নয় । ট্রেন বোলপুর স্টেশনে থামে, তারপর বোলপুরকে পেছনে ফেলে শান্তিনিকেতনের দিকে চলে যাওয়া । তবু বোলপুরে শান্তিনিকেতনের হাওয়া পাক খায় – বিষাদের, সংস্কৃতির, কবিতার । শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সাবেকি সংযোগ থাকলে যতটা আলো পাওয়া যায় বোলপুর থেকে উঠে আসা বিষাদ ততটা আলো সবসময় পায় না । বোলপুরকে খুঁজতে হয় তার আত্মপরিচয় – শান্তিনিকেতনকে ছুঁয়ে থাকে, তবে জানে বোলপুর শান্তিনিকেতন নয় । স্টেশনে অবশ্য লেখা থাকে বোলপুর(শান্তিনিকেতন),সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠায় শান্তিনিকেতন   শান্তিনিকেতনই ।

ছেলেটি বোলপুরের – বিষাদের, সংস্কৃতির, কবিতার । তার পেছনে আরও কোনও গ্রাম, আধাশহর । শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল, তবে জানত সে  শান্তিনিকেতনের কেউ নয় । বোলপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তার পড়াশোনা, বাংলা মিডিয়াম, মধ্যবিত্ত বাড়ি । ইলেভেন টুয়েলভ পর্যন্ত সায়েন্স । সাইকেলে করে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া । রে অ্যান্ড মার্টিন খুলে ইংরেজি করতে বসা । ঘুঘু পাখি ডাকলে মন না-ইংরেজ হয়ে যেত । লেটার রাইটিং পরীক্ষায় কমন পড়ত না কোনোদিন । ক্রিকেটের প্রতি টান ছিল, ছিল ঘুড়ি  ওড়ানো । যে যে কাজে হিরো তার দিকে তাকিয়ে তার ঝিলমিল লেগে যেত । যেমন তোপাইদা । সাধারণ একটা ছেলে । ‘তোপাইদা ঘুড়ি ওড়াত না । তোপাইদা ঘুড়ি লুটত … ঘুড়ি কেটে গেলে তোপাইদার কাছে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়ালেই কেটে যাওয়া ঘুড়ি ফিরে পাওয়া যেত।’(গতজন্মের মেমারি কার্ড) এই তোপাইদাকে, সাধারণ তোপাইদাকে তার তুফান  বলে মনে হত । যে কোনো সাধারণ ছেলেই  বিশেষ ক্ষেত্রে তুফান হয়ে যেতে পারে এ বিশ্বাস তার মনে দানা বাঁধছিল । জয়েন্টের ফর্ম ভরেছিল, তবে জয়েন্ট যে পাবে না সে-কথা জানত । তবে জয়েন্টের নাম করে বর্ধমানে যাওয়া যাবে । বর্ধমানে একটা দোকান আছে । সে দোকানে পুরনো পুজো-সংখ্যা পাঁচ-দশ টাকায় পাওয়া  যায় । সাহিত্যের ঘোর লেগেছিল তার মনে । বাছ-বিচার না করে সাহিত্য যা পেত পড়ত । রবীন্দ্রনাথের থেকে সমকালীন কাগজের পুজো সংখ্যার লেখা তাকে অনেক বেশি টানত । তার দেখা হিন্দি সিনেমা, যৌন অভিজ্ঞতা, ক্রিকেটের মাঠ, ইস্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড সব কিছু অকপটে লিখতে চাইত – পদ্যে, গদ্যে ।

তার ছিল দুটো জগৎ । একটা প্রত্যক্ষের একটা আভাসের । প্রত্যক্ষের জগতের পাশে এই রহস্যময় আভাসের জগৎটা চুপ করে বসে । সে সেখানে ঠিক ঢুকে পড়ত – সে মানে তার পদ্য, গদ্য । ভূগোল ক্লাসে ম্যাপ পয়েন্টিং বড়ো তঞ্চক । জায়গাটা ঠিক হতে হতেও হয় না । নম্বর কাটা যায় । সারা শরীরে যে বিষাদ তাকে কোথায় ধরব ? কোনখানে তার অস্তিত্ব ? পাঁচটা ইন্দ্রিয় দিয়ে ধরা যায় না । তখন মন জেগে ওঠে । মনই তো পারে প্রত্যক্ষের পাশে থাকা আভাসের রহস্যে ডুবে যেতে । আর মন জেগে উঠলেই শুরু হত ইন্দ্রিয় বিপর্যাস । এতোল-বেতোল । ‘আঁচলের  মধ্যে ছায়াপথ ঘুমিয়ে পড়েছে।’ ‘নিবে যাওয়া বিছানার চাদরে/ টুকরো আগুনের ফুলকি খোঁজে সময়’ ‘আওয়াজের গন্ধ নিয়ে কারা তবু একটা ঝুলন বানিয়েছে’ – এভাবেই এক ইন্দ্রিয়ে অন্য ইন্দ্রিয় ভর করে। শুধু লেখায় নয়, তার শরীরেও এমন কাণ্ড ঘটে যায় । প্রত্যক্ষের মধ্যে লাগে এসে আভাসের রহস্য । চেনা বিশেষ্যের  সামনে এসে লাগে অচেনা বিশেষণ, গড়ে ওঠে অন্য রকম সম্বন্ধপদ । ‘সাদাকালো ভাতঘুম’, ‘তাজা স্পর্শের রাফখাতা’ ‘স্বতঃস্ফূর্ত আলো’ । মধ্যবিত্ত জীবনে কত আর বস্তু থাকে কত আর চমক ? যা আছে তাদের এই বিষাদ ও রহস্যের আভাসে মনোময় করে তোলাই ছিল তার বাসনা ।

বাইরের সময়টা অবশ্য বস্তুময় । বিশেষ করে যারা সফল, যারা জয়েন্ট পেয়ে বা না-পেয়ে কর্পোরেট তারা অনেক বস্তুর কাছাকাছি হাসিমুখে থাকে । তাদের বায়োডাটা কোম্পানি থেকে কোম্পানির গায়ে ঝোলে । আর যারা সাধারণ ? তারা কী করে তোপাইদার মতো ঘুড়ি লুট করবে ? সে ভেবেছিল শব্দই হবে তার ঘুড়ি লুট করার হাতিয়ার ।‘মাথার ভিতর লাইন করে শব্দরা/ একদিন গাছের পাতায় পাতায় হেডলাইন হবে বলে !’ বিস্ময়বোধক চিহ্ন দিয়েছে সে কবিতায়, পূর্ণ ছেদ দেয়নি । স্বপ্ন দেখেছে শব্দই হবে তার ‘বায়োডাটা’ । সেই বায়োডাটা নিয়ে সে উড়বে ।  দেখবে পৌষ মেলার মাঠ, দেখবে কালিকা সিনেমাতলা । গানের লিরিক লিখবে, লিখবে গদ্য-পদ্য, তার শব্দে সচকিত হয়ে উঠবে বোলপুর থেকে কলকাতা । ‘সে দিন ইন্টারভিউ নেওয়া হবে / তারাদের, ধুলোদের…’

বস্তুর প্রত্যক্ষ অতিক্রম করে রহস্যের আভাসে যেতে অনুঘটক লাগত তার । শব্দকে ‘বায়োডাটা’ করতে গিয়ে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে নেমেছিল । লিখেছিল ‘একা একা রাস্তা পেরোয় মুখনীচু হাওয়া/ এত সহজ ! এতই সহজ, ছেড়ে চলে যাওয়া ?’ শব্দ তো ঘুড়ি নয় । তাকে দেখা যায় না । কখন যে কীভাবে মাথায় এসে নামে । শব্দের অযুত বায়োডাটা লিখতে গিয়ে নিজের জীবনকে বাজি ধরে ফেলে যারা তাদের আমি আর যুধিষ্ঠির নামে ডাকতে পারি না ।  জীবন তো মহাভারত নয়! যুধিষ্ঠির জুয়ায় হেরে গেলে তাকে লাইফ-সাপোর্ট দেন বেদব্যাস, লিরিক কবিদের জীবনে কোথায় সে ফিরে আসা !

Facebook Comments

Related posts

2 Thoughts to “কবিতাযাপনঃ ‘এবার আপনারা যে যার মতো বন্দুক তুলতে পারেন…’”

  1. I like the valuable information you provide in your articles.

    I’ll bookmark your blog and check again here regularly.
    I’m quite sure I will learn many new stuff right here! Best
    of luck for the next! http://www.redrice-co.com/page/jump.php?url=http://sos.victoryaltar.org/tiki-index.php%3Fpage=UserPagebessienicholsfmdkw

Leave a Comment