অমিতাভ মৈত্র

এক ধূসর অন্তহীন হাওয়া

যখন জানলেন মুখ থেকে বেরিয়ে আসা রক্তস্রোতের কারণ তাঁর যক্ষ্মারোগ, তখন প্রথম যে অনুভূতি হল কাফকার তা বিস্ময়ের। এই বিস্ময় তাঁকে যেন আস্তে আস্তে ফিরিয়ে নিয়ে গেল তাঁর শৈশবে আর অসুখই হয়ে উঠল যেন তাঁর মা। বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে লিখলেন, ‘In any case my attitude towards the tuberculosis today resembles that of a child clinging to the pleats of his mother’s skirts. If the disease came from my mother, the image fits even better.’ তাঁর মনে হলো যে নিঃসঙ্গতার ঘেরাটোপে ডুবে থাকা মা যেভাবে নিঃশব্দে তাঁর স্নেহ ভালোবাসা ও যত্নে বড় করে তুলেছেন তাঁকে, সেভাবেই এই রোগটিরও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন কাফকার মধ্যে। কাফকার মায়ের কিন্তু যক্ষ্মা ছিল না। তবু কাফকা – যিনি তাঁর নিজের অস্তিত্বকেই সারাজীবন ধরে করে তুলেছিলেন এক আধ্যাত্মিক জটিল প্রশ্ন ও উত্তরহীনতা, তাঁর বিচ্ছিন্নতা ও অসুখের এক বিস্তৃত মেটাফর- তাঁর মায়ের অস্তিত্বের সাথে হঠাৎ-পেয়ে-যাওয়া এই অসুখটিকে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তাঁর ছিন্নমূল আত্মার এক শিকড়-প্রাপ্তির, এক উদ্ধারের উপায় হিসেবে।

আমাদের রক্তপাতে, আমাদের মৃত্যুর মুহূর্তে আমরা মায়ের উপস্থিতি অনুভব করি। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রক্ত মুছিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মা। একসময় বসন্ত রোগে যখন উজাড় হয়ে যেতাম আমরা- সেই রোগকে মাতৃমূর্তির সাথে মিলিয়ে নিয়েছিলাম আমরা এবং নাম রেখেছিলাম ‘মায়ের দয়া’। সত্যি, কতরকম ভাবেই না এই মা সারাজীবনের আলোছায়ায় জড়িয়ে রাখেন আমাদের!

২.

মৃত্যুর দু’সপ্তাহ আগে আলব্যের কামু তাঁর সাতাত্তর বছর বয়েসের মাকে লিখেছিলেন, ‘Dear Mama, hope that you will always stay as young and beautiful and that your heart will remain the best in the world…’ দু’সপ্তাহ পরে ( ৪ জানুয়ারি ১৯৬০) ফ্রান্সের পাঁচ নম্বর জাতীয় সড়কে এক মোটর দুর্ঘটনায় যখন মারা যান কামু, তখন তাঁর কাদামাখা ব্রিফকেসে ছিল ‘The First Man’ উপন্যাসটির অসমাপ্ত পান্ডুলিপি, খসড়া কিছু নোট্‌স আর মন্তব্য সমেত। উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর মাকেঃ ‘তোমাকে, যে কখনো এই বই পড়তে পারবে না।‘ তাঁর নোটবুকে মাঝে মাঝেই এসেছে তাঁর মা কাথরিন এলে সিন্তেসের কথা- (পক্ষাঘাতের জন্য যিনি কথা বলতে পারতেন না এবং যিনি ছিলেন নিরক্ষর।) ‘I coved my mother with despair. I have always coved her with despair.’ কখনো লিখেছেন, ‘When my mother’s eyes were not resting on me I have never been able to look at her without tears.’

 

৩.

‘দ্য আউটসাইডার’ উপন্যাস শুরু হয় নায়ক ম্যরসোর মায়ের মৃত্যুসংবাদ দিয়ে। “Mother died today. Or may be yesterday, I do not know. I had a telegram from the home: ‘Mother expired. Funeral tomorrow. Deep sympathy’. That does not mean anything. It may have been yesterday.” ম্যরসোর কাছে এই সংবাদ কোনো শোকের বার্তা হয়ে আসে না। সে থেকে যায় আবেগবর্জিত, অভাব বোধহীন। মাকে সে রেখেছে দূরের এক হোমে, যেখানে সে দেখা করতে কমই গেছে। সারা সপ্তাহের অফিসের পর ছুটির দিনে মায়ের কাছে যাওয়ার কোনো তাগিদ ছিল না তার, মৃত্যুসংবাদ পেয়ে হোমে যাওয়ার পথে দীর্ঘ বাসযাত্রার সময় সে চিন্তাহীন ঘুমিয়ে কাটায়। মায়ের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে সে মৃত মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখার বিষয়েও অনাগ্রহ প্রকাশ করে। কফিনের সামনে বসে দুধ মেশানো কফি খায়, সিগারেট ধরায়। হোমের অন্য বয়স্ক আবাসিকেরা যখন মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কফিনের চারপাশে এসে বসে, ম্যরসো তাদের সাথেই সেখানে সারারাত জাগে। পরদিন দেখা হয় বৃদ্ধ পেরেজের সঙ্গে- শেষজীবনে ম্যরসোর মায়ের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল যাঁর। ম্যরসোর মনে পড়ে আগে মা সারাদিন চুপচাপ বসে থাকত আর ম্যরসোকে লক্ষ্য করতো। কিন্তু অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে এই হোমে আসার পর মাঝেমাঝেই কাঁদতো তার মা। মাকে দূরের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর জন্য ম্যরসোর প্রতিবেশীরা অখুশি। সেও বেশ কমই আসতো মায়ের কাছে। বাসে চারঘন্টা যাতায়াতের ক্লান্তি ছাড়াও রবিবারগুলো নিজের মত কাটানো সম্ভব হতো না তাহলে। পরদিন সকালে অন্ত্যেষ্টি যাত্রায় ম্যরসোর অংশগ্রহণ ছিল যান্ত্রিক। বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকেরা তীব্র রোদ ও দূরত্ব অগ্রাহ্য করে সঙ্গে যায়। ছোটোখাটো অশক্ত চেহারার সেই বৃদ্ধ পেরেজ  দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে চলার প্রাণপণ চেষ্টা করে। ম্যরসোকে স্পর্শ করে বৃদ্ধ মানুষটির জীবনবোধ। দ্রুত, শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এবং সূর্যতাপে সমাধিপর্ব শেষ হবার পর বাসে বাড়ি ফেরার সময় বারো ঘন্টা ঘুমের আশায় ম্যরসো আনন্দিত হয়।

পরদিন সে সমুদ্রস্নানে যায় যেখানে তার পুরনো বান্ধবী মারীর সঙ্গে দেখা হয়। স্নানের সময় তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, একটা হাসির সিনেমা দেখতে যায়, নিজের ফ্ল্যাটে মারীর সাথে রাত্রিবাস করে। পরের ঘটনাক্রমের বিস্তারে উল্লেখ আর করলাম না যেহেতু এই লেখাটির সঙ্গে তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। একজন আরব কে হত্যা করে ম্যরসো। তার হৃদয়হীনতার প্রমাণ হিসেবে আদালতে বারবার প্রশ্ন ওঠে মায়ের মৃতদেহ দেখতে না চাওয়া, মৃতদেহের সামনে স্বাভাবিকভাবে কফি, ধুমপান এবং ঘুমিয়ে পড়া বিষয়ে। মায়ের মৃত্যুতে কোনো শোক ছিল না তার এবং এমন মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নরঘাতক এবং সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক- এই যুক্তিতে সে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়।

ম্যরসোর অপরাধ বিষয়ে কামু একবার বলেছিলেন, ‘In our society any man who does not cry at his mother’s funeral is liable to be condemned to death’.

ম্যরসোকে এখানে বিদায় জানিয়ে আমরা এবার ঢুকতে যাচ্ছি স্যামুয়েল বেকেট এর লেখা উপন্যাস ‘মোলোয়’ (Molly) এর মাকে খোঁজার আখ্যানে।

‘দ্য আউটসাইডার’ এর মতো ‘মোলোয়’ শুরু হচ্ছে মায়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। মোলোয় একজন লেখক এবং তার স্মৃতি যথেষ্ট দুর্বল। মায়ের ঘরে সে থাকে, যদিও সে জানেনা তার মা বেঁচে আছে কিনা এবং কীভাবে সে মায়ের ঘরে এসেছে। বিস্তারে যাওয়ার আগে উপন্যাসটির প্রথম কয়েক লাইন পড়া যাক- ‘I am in my mother’s room. It’s I who live there now! I don’t know how I got there. Perhaps in an ambulance, certainly a vehicle of some kind. I was helped. I’d never have got there alone. There’s this man who carries every week. Perhaps I got here thanks to him. He says not. He gives me money and takes away the pages. So many pages, so much money. Yes, I work now, a little like I used to, except that I don’t know how to work anymore.

That doesn’t matter apparently.’

কোথাও কোনো জটিলতা নেই, সবকিছুই অত্যন্ত সহজ- আর এর মধ্য দিয়েই বিভ্রমকে দ্যুতিমান করে তোলেন বেকেট। দু’এক পৃষ্ঠা পড়ার পরেই পাঠক একটি গোলকধাঁধার জগতে প্রবেশ করেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় যেন আছড়ে পড়ে দুর্বার এক শব্দস্রোত, যার স্থির কোনো অভিমুখ নেই। কোনো কিছুই স্পষ্ট হয় না। বাস্তব আর কল্পনার মাঝে কোনো ভেদরেখা নেই। উপন্যাসটি উত্তম পুরুষে লেখা। মোলোয় যা বলছে আমরা শুধু সেটাই জানতে পারি। কিন্তু যেহেতু তার স্মৃতি প্রায় নেই যখন সে অতীত সম্পর্কে কিছু বলে, বোঝা যায় না তার কতোটা সত্যি আর কতটা কল্পনা। সে মায়ের ঘরে থাকে এবং লেখে। সে টাকার জন্য লেখে না, কিন্তু কেন তাকে লিখতে হয় সে জানে না। সপ্তাহে একদিন কেউ এসে তার লেখা নিয়ে যায় এবং সেই মতো টাকা দেয়। কীভাবে সে এই ঘরে এসেছে সে জানে না। হয়তো অ্যাম্বুলেন্সে, আবার অন্য কোনো ভাবেও হতে পারে। তার মা মৃত কিনা সে জানে না। তার ধারণা তার মাকে হয়তো সমাধিস্থ করা হয়েছে। তার একটা ছেলের দরকার। হয়ত তার কোনো ছেলে আছে তারই মতো বয়সের। নাও থাকতে পারে। তার একটা পা খোঁড়া। সে ঠিক করে সাইকেল চেপে মাকে খুঁজতে বেরোবে এবং সত্যিই বেরিয়ে পড়ে। তার মা এবং সে সমান বয়সের এবং মা তাকে ‘ছেলে’ বলে ভাবে না, ‘ড্যান’ বলে ডাকে যা তার বাবার নাম। সেও মাকে মা না বলে ‘ম্যাগ’ বলে ডাকে।

‘My mother never refused to see me, that is she never refused to receive me… I shall try and speak calmly. We were so old, she and I, she had me so young. That we were like a couple of old cronies, sexless, unrelated, with the same memories, the same rancours, the same expectations. She never called me son, fortunately, I couldn’t have borne it, but Dan, I don’t know why, my name is not Dan. Dan was my father’s name perhaps, yes perhaps she took me for my father. Dan, you remember the day I saved the swallow.  …I called her Mag, when I had to call her something. And I called her Mag because for me, without my knowing why, the better I abolished the syllable Ma, and as it were spat on it, better than any doubtless unacknowledged need, the need to have a Ma, that is a mother, and to proclaim it, audibly.’

পুলিশ যখন তাকে থানায় নিয়ে আসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজের নামটুকুই সে বলতে পারে। মায়ের নাম তার মনে নেই। চিন্তাভাবনা করে সে জানায় মায়ের নামও মোলোয়। ছাড়া পাওয়ার পর মাকে খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে যায় সে। মাকে সে আর খুঁজে পায় না।

কামুর উপন্যাসে ম্যরসোর মায়ের অস্তিত্ব নিয়ে কনো প্রশ্ন ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে নায়ক- একজন Absurd hero – কীভাবে এবং কতদূর নিস্পৃহ তার মায়ের ব্যাপারে। ম্যরসো মিথ্যে কথা বলে না এবং তার স্বভাবে কোনো ভাণ নেই। আমরা, যারা নানারকম মিথ্যে আচরণ করি এবং মিথ্যে অনুভূতির ওপর সত্য-প্রতিম আলো ফেলে বাঁচি, তাদের কাছে ম্যরসো একজন মূর্তিমান অস্বাভাবিকতা। এবং এভাবেই সে একজন absurd hero হয়ে ওঠে। কিন্তু বেকেটের মোলোয় উপন্যাসে কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব নয় এই মা বাস্তবের না স্বপ্নের। সম্ভব অসম্ভবের দোলাচলে গোটা উপন্যাস জুড়ে নিজেই মীমাংসাহীনভাবে বন্দি হয়ে থাকে। উপন্যাসটি যেন এক মূর্তিমান প্রহেলিকা, এক নিরূপায় ধাঁধা- অজস্র কোণ থেকে যার ব্যাখ্যা করা যায় এবং কোনো ব্যাখ্যাই পাঠককে এক পা’ও এগোতে দেয় না। ‘As to her address, I was in the dark, but knew how to get there, even in the dark’ – মায়ের ঠিকানা এভাবেই পুলিশকে জানিয়েছিল মোলোয়। উপন্যাসটিও যেন নিজের বিষয়ে একই কথা বলছে- যাকে অস্তিত্বের ক্রম বিলীনতা আলো দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শূন্যতার দিকে। ‘I was on my way to my mother, whose charity kept me dying’ এই উপন্যাস কি আসলে মৃত্যুর দিকে এক অভিযাত্রার ইঙ্গিত? নাকি মৃত্যুর অনন্ত গভীরে ডুবে যাওয়া এক চূড়ান্ত শূন্যতার ভাষ্য যেখানে শূন্যতা পর্যন্ত ভয়ে মূক হয়ে যায়? একটি জাগ্রত মনের প্রতি পল-অনুপলের চিন্তাস্রোত যেভাবে যায়। উপন্যাসটিতে সেই স্রোত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ধরে রাখা যেন। অস্তিত্ব থেকে বিলীনতার মধ্যে উপন্যাসটি নিজেই- জিভের নীচে সরবিট্রেটের মতো- নিজের মধ্যে গলে যায় শেষপর্যন্ত। কিন্তু যা গলে যায় না তা মায়ের করুণার মধ্যে মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাওয়া- ‘Whose charity kept me dying’।

৪.

একটু কোমলভাবে, একটু স্বগতোক্তির ধরণে হেমকান্তিও তাঁর মায়ের সম্পর্কে বলতে পারতেন ‘whose charity kept me dying’। সম্ভবত ১৯৭০ সালে শারদীয় দেশ এ বিমল কর ‘ভুবনেশ্বরী’ – একটি উপন্যাস- লিখেছিলেন যার কেন্দ্রীয় বিষয় মৃত একটি মানুষকে নিয়ে সেই পরিবারে বংশানুক্রমে চলতে থাকা একটি মিথ। বিহারের কোনো এক জায়গায় পরিবারের ডালপালা ছড়িয়ে বড় হতে থাকা সদস্যরা তাদের দেবীর মতো গুণসম্পন্না প্রপিতামহীর নামে (ভুবনেশ্বরী) একটি পারিবারিক স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করতে নানা জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়েছে। ভুবনেশ্বরীকে তারা কেউ দেখেনি কিন্তু সারাক্ষণ তাদের কথায় ভাবনায় ভুবন-মা’র অলৌকিক এবং রূপকথার মতো পল্লবিত অজস্র গল্প। মানুষ থেকে দেবী হয়ে ওঠা এই ভুবন-মা’র মহিমা নিয়েই তারা মগ্ন।  এই ভুবনেশ্বরী -মা’র ছেলে সোমকান্তি – ছিয়াত্তর বছরের এক প্রবল ব্যক্তিত্ব- দীর্ঘদিন এই পারিবারিক ঘেরাটোপের বাইরে একা দেরাদুনে থাকেন। তাঁকে সন্ধান করে আনা হয়েছে এই ভুবনেশ্বরী স্মৃতিসৌধ স্থাপনের অনুষ্ঠানে। দেবীর আদলে ভুবনেশ্বরীর প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, ফুলে আলপনায় সাজানো হয়েছে বেদি। বিচ্ছিন্ন,আত্মস্থ একা সোমকান্তি দূর থেকে দেখছেন সব। সন্ধ্যাবেলায় পরিবারের সবাই তাঁকে ঘিরে বসে। সোমকান্তির কাছে তাঁর মায়ের মহিমা নিইয়ে আরো কথা শুনতে চায় যা সমৃদ্ধ করবে তাঁদের। তাঁর দেখা  একের পর এক ঘটনার সবিস্তারে উল্লেখ করে তিনি তাঁর মায়ের স্বার্থপর, নীচ, মিথ্যেবাদী নিষ্ঠুর রূপ নগ্ন করে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করতে সবাই উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মকভাবে তাঁকে বাধা দিতে শুরু করে। সোমকান্তি বোঝাতে পারলেন না “কোথাও না কোথাও এই মিথ্যের শেষ হওয়া উচিত। এমন অসত্য সত্য হয়ে বেঁচে থাকা অন্যায়”। শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে কিছু গড়ে তুলতে চাইলে একসময় ঠিক তা ভেঙে পড়ে। সোমকান্তিকে, সংক্ষিপ্তভাবে, পরিত্যাগ করল সবাই এবং তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো তাদের স্বপ্ন দিয়ে গড়া ভুবনেশ্বরীই সত্যি। তিনিই থাকবেন। তাঁকে সরানো যাবে না- সোমকান্তির দেখা রক্তমাংসের মানুষটিই আসলে মিথ্যে। পরদিন সকালে সেই সৌধ থেকে পরিত্যক্ত একা সোমকান্তি চলে যাবার সময় সবিস্ময়ে দেখলেন সকালের রোদে তাঁর ছায়া মাটিতে পড়ছে না। দেখলেন সৌধের চূড়ায় দীর্ঘ ছায়ার আড়ালে তাঁর ছায়া চিরকালের মতো হারিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যে দিয়ে বানানো মায়ের ছায়া, ঢেকে দিচ্ছে তাঁর সত্যের মুখ।

মা যেন সবকিছু ভালোত্ব দিয়ে মনে মনে তৈরি করে নেওয়া এক আদর্শ নির্বিকল্প প্রতিমা, দেবতার প্রতিরূপ হয়ে আমাদের মধ্যে লালিত হয় যে এবং প্রশ্নহীন বিশ্বাসে যাকে মেনে নিতে হয়। এই মাকে দেখার মধ্যে যন্ত্রণা আছে। ভারী পাথরের মতো এই মাকে বহন করাও যন্ত্রণার। আমরা বরং আরেকবার ফিরে যাই The Outsider এ- দেখি আঙুলের ফাঁকে জ্বলে যাওয়া সিগারেট নিয়ে সুদূর আর আত্মমগ্ন অন্য এক ম্যরসো’কে।

৫.

মায়ের মৃত্যু বিন্দুমাত্র শোকগ্রস্ত করেনি তাকে, মৃত্যুর দিনটি নিয়েও সে নিশ্চিত নয়, অনিচ্ছুক অনাগ্রহে সে মায়ের শবযাত্রায় থাকে এবং ফিরে এসে বান্ধবীর সাথে সমুদ্রস্নান, সিনেমা ওঁ রাত্রিবাসে সে স্বচ্ছন্দ থাকে। কিন্তু এমন না হয়ে যদি সে হয়ে উঠত নির্জন এক মানুষ, আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে যার মনে পড়ছে অশক্ত মা’কে কোলে তুলে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসার সেই সব স্মৃতি, যখন তার কোটের বুকের কাছের বোতামে লেগে থাকতো তার মায়ের মাথার ধূসর চুল। মা নেই আর। তবু সে কোটের বোতামে আজ খুঁজছে একটি দুটি ধূসর চুল- চিমনির ধোঁয়ায় সেই চুল যেন একে একে ছেড়ে যাচ্ছে তার বোতাম। ডি. এইচ. লরেন্সের লেখা এই কবিতাটি এবার পড়া যাক?

Sorrow

Why does the thin grey stand
Floating up from the forgotten
Cigarette between my fingers,
Why does it trouble me?
Ah, you will understand;
When I carried my mother downstairs,
A few times only, at the beginning
Of her soft-foot malady,
I should find, for a reprimand
To my gaiety, a few long grey hairs
On the breast of my coat; and one by one
I let them float up the dark chimney.
এমন সংবেদনশীল সূক্ষ্ম প্রায়-অশ্রুত সুরের রণনের মতো, স্থির জলে মৃদুতম কোনো ঢেউয়ের মতো কবিতা ম্যরসোর ধারণার দিগন্তেও থাকবে না। বাতাসের মতো অলক্ষ্য আর মৃদু এক শোক আর হাহাকার কবিতাটি জুড়ে। ডি. এইচ. লরেন্স- একজন ঋষিপ্রতিম মানুষ- খুব ভেতর থেকে আমি এটা বিশ্বাস করি। মাতৃহীন এমন কেউ থাকতে পারে না যাঁকে স্পর্শ করবে না এই কবিতা।

সত্যিই ম্যরসো যদি এমন হতে পারতো! এমন সুমিত শোক যদি কখনো থাকতো তার!

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment