নেকড়ে মায়ের খোঁজ
বিশ শতকের বিশ দশক। ব্রিটিশ ভারতের বিভক্ত তবু একদেশী বাংলা। জেলা মেদিনীপুর। গ্রামের নাম গোদামুরি। কাছেই এক খৃষ্টিয় অনাথ আশ্রম। তার অধ্যক্ষ রেভারেন্ড যোসেফ অমৃতলাল সিং। রেভারেন্ডের কাছে গ্রামের মানুষ প্রায়ই এসে একটা গল্প বলে। ভূতের গল্প। দুটো সাদা ভূত নাকি মাঝে মাঝে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় এক পাল নেকড়ের সাথে। তারা মানুষভূত না পশুভূত বলা মুশকিল। কেউ কেউ রীতিমতো ভয়ার্ত। কিন্তু কেউই স্পষ্ট বর্ণনা করতে পারেনা সেই ভূতেদের। অশিক্ষিত ভয় নির্জ্ঞানকে কানাঘুষোয় ফুলিয়ে বিশালাকৃতি করে তোলে। একদিন রেভারেন্ড সেই ভূতেদের দেখতে পেলেন।
দুই মানবশিশু। দুটি মেয়ে। মেয়ে? না পশুমানব?
হ্যাঁ, মানব কীরকম ‘পশু’ হে! ‘পশু’ নামটাকে জলায়, জংলায়, নরকে ফেলে দিয়ে যায়! কই পশুরা তো এই পরিত্যাগ দেখায়না! একটা বছর সাতেকের মেয়ে, আর একটা মেরেকেটে এক বছর। মানুষের বাচ্চা। বাপ-মা ফেলে দিয়ে গেছে। হয়তো বিভিন্ন সময়ে পরিত্যক্তা। হয়তো ভিন্ন মা-বাবার। ভাগাড়ে না ফেলে ভাগ্যিস জঙ্গলে ফেলেছিলো। মমতাময় ঘনবনজের করুণাময়ী এক নারী, নেকড়ে সে, কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। নিজের বাচ্চার সাথে ওদেরও পালন করে। গায়ের রঙ মেলেনা তো, তাই লোকে দেখে ভূত ভেবেছে। অনেক দশক কেটে গেছে এরপর। এখন বড় মেয়েটার স্বর বলে –
“ভিজে ভিজে, সবুজ সবুজ। ওদের সাথে মিশি আর সম্পন্ন হই। বাচ্চা একটা! চটচটে তখন, মা আমায় চেটে পরিষ্কার করে দিতো। সবচেয়ে ভালো হলুদের পাশে বাদামী। সবচেয়ে ভালো নীল, তারপর বাদামী। সবচেয়ে ভালো হলুদ। শেষ হবার পর কোথায় যাবে সূর্যটা? মাকে জিজ্ঞেস করি। মায়ের ত্বকের, চামড়ার ভেতর দিয়ে জিজ্ঞেস করি। কী লাল আমার মা। সূর্যটা জমির গর্তের মধ্যে চলে যায়। আমাদের মা যে, তাই সূর্যটা গর্তের মধ্যে চলে যায়, প্রত্যেক রাতে। আমরা ওকে মিলিয়ে যেতে দেখি, তারপর আমরাও মিলিয়ে যাই। নীলের মত নীল, অতঃপর খয়েরি, তারপর সবুজ, কালোঃ আপনাদের ধর্মের বইতে যেমন লেখা ছিলো, না!”
রেভারেন্ড সিং দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় এক নিবন্ধে সব লেখেন, এই অধ্যায়ের মাঝপথে। ১৯২০ সালের ৯ই অক্টোবর লোকজন নিয়ে এসে জঙ্গলে নেকড়ের গর্ত থেকে উদ্ধার করা হয় দুই পশুমানব বালিকাকে। অমৃতিলাল সিং তাদের নাম দেন – অমলা, কমলা। রেভারেন্ড প্রায় এক দশক ধরে এদের উদ্ধার ও সভ্য করার তথ্যপুষ্ট কাহিনি লিখে যেতে থাকেন। আজ অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন পশুমানবের উদ্ধার, পুনর্বাসন ও আচরণ বিষয়ে এর চেয়ে জীবন্ত, জ্বলন্ত দলিল আর নেই।
সেই নারী নেকড়ে সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অধ্যক্ষ লিখেছিলেন- ‘সে মা-নেকড়ের মতো হিংস্র প্রাণী আমি আর দেখিনি কখনো, তেমনি দেখিনি সন্তানের প্রতি সেই মহিমাময় স্নেহ। এক পশুর মমতা যে এতটা ক্ষমতা রাখে, মানুষের স্নেহের চেয়ে এত উচ্চ হতে পারে, সে ধারণা আমার ছিলো না।’ নেকড়ে মায়ের কন্দর থেকে মেয়েদুটোকে ছাড়িয়ে আনা যাচ্ছিলো না। মা তাদের আগলে বসেছিলো। আততায়ীকে আক্রমণে ছিন্নভিন্ন করতে উদ্যত। তেমনি আক্রমণাত্মক অমলা-কমলার ‘ভাইবোনেরা’। মাকে হত্যা করে তবেই অমলা, কমলাকে উদ্ধার করা সম্ভব হলো।
পশুমানবশিশু। Feral children। তাদের অনাথ আশ্রমে রাখা হয়। সারা গায়ে নেকড়ের মতো লোম। কামিয়ে দেওয়া হয়। জামা পরাবার চেষ্টা হয়। কিছুদিন পর অন্য মানবশিশুদের সাথে রাখার চেষ্টা। একদিন তারা পালিয়ে যেতে চায়। কমলা, অমলা। কবি লেখেন –
“কমলা তার বোনের সাথে বাগানের পাঁচিল টপকে ছুটতে থাকে, চার পায়েহাতে, মেদিনীপুরের আর ঘেরা শালের মাঝে এক জটিল ভুবনে। পশুমানব দশা, শরীর সচেতনতাকে ঘিরে এক শুদ্ধ উদ্বেগ। দুই সন্ত্রস্ত শিশু দেখছে জেলাটিন আস্তরে মোড়া স্ফীত মফস্বল ভয়াবহরূপী। দুই জন্তু দেখতে পায় অনচ্ছ, ঘন দুধের মতো এক ঝিল্লি প্রাণে ও প্রত্যাহারে চঞ্চল। যেমন তুমি দেখবে তোমার অন্তর্জগতকে।
রাঁধুনী আমাদের অনেক রকম মাংশ খাওয়ালো। পাশের মেয়েটার পেটে পেট ঠেকালাম। গোলাপী মতন, মাংশের খোঁজে আমরা চঞ্চু খুলি। ভিজে ছিলো, একে অন্যের মুখ থেকে আমরা চেটে নিয়েছিলাম অভিধান।
…
…
এটা কী পশুমানব প্রশ্ন? না তো, এটা একটা চাকতি, যা আলো সংবাহিত করছে মেয়েটার চোখের এক কোণ থেকে অন্য কোণে। যেন পশুর পোষক স্তর। যেন রাতের পশু। জান্তব চোখ, জ্বলজ্বলে, যে ঘরে তাকে সে রেখেছে, তার মেয়েটা, হোমের গভীরে।”
কবি ভানু কপিল। প্রায় আমারই সমবয়সী। ইংল্যান্ডে বড় হয়েছেন। আজ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন। সাহিত্যের অধ্যাপিকা। তাঁর এই সম্পূর্ণ অসমান্তরাল কবিতার নাম ‘The wolf girls of Midnapore’। পরে একটা বৃহত্তর বইয়ের অন্তর্ভুক্ত – Humanimal, A Project for Future Children। মৃতা নেকড়ে মায়ের প্রচ্ছায়ার অভাব, মানবসভ্যতার অসভ্য চাপান ঊতোর দুই পশুমানবের ছা’য়ের কী অবস্থা করে, কপিল তার মর্মস্পর্শ করেন কবিতায়। এ কাহিনি যেমন অ-সাধারণ, তেমনি অনন্য ভানু কপিলের এই কবিতা। ভানু লেখেন –
‘স্নান কঠিন, তারপর প্রাতরাশ। কীভাবে উপভোগ করতে হয় হয় ওই মোলায়েম স্রোত, কিন্তু আমরা দুর্বল, ক্ষীণ, সমস্যাই সমস্যা। বোনটা কিশমিশ চোষে, আমি চামচ বাড়াই ওকে, কিন্তু আমি কি মা? নিজের কাদাই সামলাতে পারিনা। যে নারী যোদ্ধা, তাকে মৃত্যুশয্যাতেও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হয়, আমার মা বলতো। অথচ এরা যেদিন এসেছিলো, চকিতে হাড় সোজা ক’রে মা আমার উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই, তার গোটাটায় ফাটল ধরলো, হারিয়ে গেলো মা, এরা আমাদের কাপড় মুড়িয়ে নিয়ে এলো।
…
…
প্যাঁচা একটা ড্র্যাগন।
দুধ হলো পাতলা রক্ত।
তালুর নিচে রূপোলি – মানে পান করার মূল্য।
আমি বড় হচ্ছি তো হচ্ছি।
…
…
নেকড়ে।
কে নেকড়ে?
নেকড়ে হলো এক বাদামী মেয়ে যার হাঁটুতে ঘষটে চলার কাটাদাগ ভর্তি। অনুসরণের দাগ। প্যাঁচা তার বন্ধু। স্বপ্ন এলে সে দেখে সে আধা-পুরুষ, জল ভাগ করে নেবার সাথী; “সিঁড়িতে জল ছুঁড়ে দেয় লোকটা
তবে সে সিঁড়ি ভাঙে
ঘর থেকে বেরয়”,
এই তার কল্পনা।
আমার নিজের দুধের কথা ভাবি, কিন্তু মা-বিনা সে দুধ আসবেনা। এমনকি ওই যে রূপোলি অস্সি-মা জঙ্গলে রেখেছিলো, মাছ, তাকে মারার জন্যে। সমুদ্র নিশ্চয় কাছে। নতুবা একটা পমফ্রেট বালতি ক’রে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছয় কীভাবে?
হয়তো শুক্রবার আজ।
হয়তো সে শিশু।
…
…
যখন বৃষ্টি পড়ে, অশ্বত্থ দোলে। বৃষ্টি বন্ধ হয় আর হাওয়াও, কিন্তু দেখো গাছটা শক্ত হয়ে গেলো, যেন ঝোলা প্যাঁচারা ঝিমুতে গেল তার মগে, কিন্তু এখন বিকেল, প্যাঁচারা এখনি? না, না। অতিথিরা আসে, পরিদর্শক। ছোট ছোট কমলালেবু বাড়িয়ে দেয়। ওর নাভির ওপর যেই রাখে কমলা, নাভিকুন্ড থেকে রক্ত বেরয় বয়ে। তারপর থেমে যায়। গত মে-মাসে ওঝার বয়স হলো বিয়াল্লিশ, সে ধরতে পারেনা সব।
…
…
দাঁড়াতে গেলেই মেয়ে মুতে ফেলতো তো, তাই ওর কোমর, পাছায় একটা সাদা কাপড় বেঁধে দিয়েছিলো। তার চিনিমার্কা চায়ের ওপর টান, বাটিটার ওপর ব্যগ্র হয়ে ঝুঁকতো ব’লে, ওরা ইংরেজিতে কথা কয়, কায়দা ক’রে উচ্চারণ করে।’
ভানু কপিল কমলার প্রেক্ষিত থেকে লেখেন তাঁর তথ্যকবিতা। কমলার কল্পিত মনের ভেতর সেই কাব্যভাষার রসায়নাগার। ভাষাটাকে ভঙ্গুর, কাঁচা রাখেন ভানু। কমলা কী বলছে সব বুঝতে সচেষ্ট হতে হয়। সম্পূর্ণ কি বোঝাও যায়? সবটা কি বোঝা যায় কবিতার? সব বুঝে ফেলা কবিতা কি আদৌ ভালো? – এই প্রশ্নগুলো ওঠাও বিচিত্র না।
কমলা কেন প্যাঁচা খোঁজে? কেন প্যাঁচারা তার ড্র্যাগন? কেন অশ্বত্থের বৃষ্টিকাঁপ থামলেই সে মগডালের দিকে চায়, প্যাঁচার আগমনের কথা ভাবে? সে কি নেকড়ে-মাকে দেখতো গাছ বেয়ে উঠে গিয়ে প্যাঁচা মেরে নামিয়ে আনতে? সেই প্যাঁচার মাংশেই কি হতো তাদের নৈশভোজ? ভানুর কবিতার ইশারার দিকে এগোই। ওঝা নিয়ে আসা হয়েছিলো বুঝি? নেকড়ে-মেয়েদের মানুষ করতে? রেভারেন্ডের দিনিলিপিতে ছিলো ওঝাদের কথা? ভানুর ভাষায় –‘The exorcist’।
বছর পাঁচেক অনাথ আশ্রমে কাটানোর পর কমলা কিছু মানুষের মত। বুদ্ধির ব্যবহার শিখেছে, হাঁটার সময়ে অতটা ন্যুব্জ নয়, সংখ্যা, নাম, রঙ – এসব চিনেছে। নিজের থালা থেকে খেতে শিখেছে। অন্য মেয়েদের থালায় হাত দেয় না। ক’জন মেয়ের নাম ধরেও ডাকতে পারে। একটু বাংলা বলতে পারে, দুটো, একটা ছোট বাক্য। আর অমলা? তার কথা পরে।
নেকড়ে মায়ের আদরে আগলে, নেকড়ে ভাইবোনেদের সাথে যে আদিবাসে বড় হচ্ছিলো অমলা-কমলা, সেই ‘পশুমানব’ জীবন ও জগতের স্বাভাবিক সৌন্দর্য যা প্রকৃতি ও দৈব প্রদত্ত, যা সহজ ও সুন্দর, তার ওপরেই চড়াও হয় মানব সভ্যতা। দুই সৎ ও মহৎ আদর্শের সমুদ্রমন্থন এখানে – প্রকৃতি ও পশু যাদের রক্ষা করেছে তারাই আবার মানবাত্মার কাছে, সভ্যতার কাছে বিপন্ন। তাদেরই পুনরুদ্ধার করার চেষ্টায় রেভারেন্ড সিং মেয়েদুটিকে ‘উদ্ধার’ করেন।
তারপর যা হয় তা সভ্যতার একরকম অত্যাচারই, যার জন্য রেভারেন্ডকে দোষারোপ করা যায়না আরেক মানব হিসেবে, বরং এক অর্থে তিনি ধন্যবাদার্হই হয়তো। কিন্তু আখেরে সভ্যতার সদুদ্দেশ্য এখানে বেশান্তরে অত্যাচারীর ভূমিকা নিয়েছে। মানবতার খোলস ছেড়ে চলে যাওয়া মানবকে আমরা মানতে পারিনা। মনে করি সে বিপথে বেপথু। বিদেহী, পাশবিক। অমলা-কমলার শরীর, শরীরভঙ্গি, অস্থিকাঠামো, চলনপদ্ধতি, তাদের খাবার, পানীয়, বাসস্থান, পরিচর্যা, রুচি, আনন্দ, দুঃখ – তাদের সমগ্র চেতন ও অস্তিত্বের মধ্যে চূড়ান্ত পরিবর্তন আনার চেষ্টায় অতি সদয় রেভারেন্ড সিং-এর সমস্ত সুপ্রয়াস শেষ পর্যন্ত সেই বর্বরতারই নামান্তর হয়ে উঠেছিলো যার নাম ‘সভ্যতা’।
ভানু কপিল সেটা ধরতে পেরেছেন তাঁর কবিতায়, উষ্ণতম সমবেদনায়, এক কম্প্র মানবিকতায়। অসংখ্য পত্র পত্রিকায়, সংকলনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে, কবিতাপাঠের আসরে কপিলের – Humanimal, A Project for Future Children পঠিত, আলোচিত হয়েছে।
নারীবাদের বৃহত্তম জংশন শরীরসচেতনতা। কিন্তু খুব দুঃখিত হয়ে দেখি বাংলা তথা ভারতীয় বা বাংলাদেশী কবিতায় সেই হুঁশ যৌনমুক্তির উচ্ছ্বসিত প্রকাশেই সীমাবদ্ধ। ‘শরীর’-এর কোনো বৃহত্তর রূপ, রূপকতা এখনো নেই। ‘flaunting female sexuality’আজো এতটা বিপজ্জনক ও বিদ্রোহী, তাকে ঘিরে এখনো এত রক্ষণশীলতা, প্রতিবন্ধকতা যে সেই সাহসে সাহসী হবার লোভ এখনো নারীবাদী কবিতার এক প্রধান ভূষণ হয়ে আছে। আছে পাশাপাশি, তার সামাজিক সংজ্ঞা, বাকমুক্তি ও তৃপ্তিপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন। কিন্তু এখানেই সব থেমে গেছে।
শুধু পশ্চিমই নয়, পৃথিবীর অন্যত্রও অনেক ভাষাদেশের কাব্যসাহিত্যে মেয়েদের লেখালিখির মধ্যে ‘শরীর’ আজ এক বিরাট সংজ্ঞা। ‘শরীর’ এক দেশ, জাতি, সম্প্রদায়, ভূগোল, ধারণা, সভ্যতা; ‘শরীর’ ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, তত্ত্ব। ইংরেজীতে বলা হয় –a body of work।‘শরীর’ সেই ‘বডি’ হয়ে উঠেছে। ভানু কপিল সেই আলোকেই ‘শরীর’কে দেখেন এক নিজস্বতায়। ওঁর আগ্রহের বিষয় সেই সব ‘উদ্বাস্তু শরীর’ – দেশ, জাতি, পশুপ্রাণী, অপোষ্য পশুমানব, লঘুসম্প্রদায়, জাতিচ্যুত, একঘরে, অভিবাসী – যাদের শতক শতক ধরে ঔপনিবেশিক শক্তি হিংস্র আক্রমণে শুধুমাত্র প্রান্তিক্যেই নয়, রেখেছে সন্ত্রাসে। অমলা-কমলা এই উপদ্রুত প্রজাতিরই অন্তর্গত। তাদের সন্ত্রাসী উপনিবেশ অবশ্য অন্য। তার নাম সভ্যতা।
ভানু কপিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক অত্যন্ত আলোচিত কবি, লেখিকা, অধ্যাপিকা। কলোরাডো রাজ্যের বিখ্যাত সাহিত্য বিশ্ববিদ্যালয় ‘নারোপা’য় পড়ান। আমার একদা সহ-সম্পাদিকা, কবি ও প্রাবন্ধিক স্যারা ডাউলিং, যিনি পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত জ্যাকেট২ জালিকায় বাংলা পরিবিষয়ী কবিতার সাহিত্যসংগ্রহ প্রকাশ করতে সাহায্য করেছিলেন, তিনিও ভানু কপিলের এই বইটা নিয়ে ভেবেছেন অনেক, লিখেছেনও। স্যারার মতে ‘এক ঝরঝরে লিপির মাধ্যমে কপিল সেই নির্ঘাত ও ত্রাসকে পুনর্জীবিত করেছেন যা ওই অপোষ্য শিশুদ্বয়ের ওপর সভ্যতার সন্ত্রাস’।
অনাথ আশ্রমে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার পর আশ্রমকর্মিদের কঠিন পরিশ্রমে অমলা, কমলার অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হয়। তাদের প্রথমে অন্য শিশুদের সাথে রাখা হয়, যার পরিণতি ভয়ংকর হ’তে যাচ্ছিলো। অমলা কমলার ব্যবহার শ্বাপদ, হিংস্র। তারা কাঁচা মাংশ প্লেট থেকে খেতে চায়, কথা বলতে পারেনা, দুপায়ে দাঁড়াতে পারেনা, হামাগুড়ি দিয়ে চলে, ভয় ছাড়া তাদের মুখে চোখে অন্যঅনুভূতির প্রকাশ নেই। তাদের আলাদা ঘরে রাখা হয়। রাতে অমলা কমলা ‘ডাক’ দিত। রেভারেন্ডের ভাষায় সেই ডাক কী বন্য, করুণ। যেন কান্নার সুর, যেন মানবতাভেদী এক আর্তনাদ। তারা ডাক দিত তাদের মাকে, তাদের ভাইবোনদের। অমলা এক বছরের মধ্যে বৃক্কের সংক্রামণে মারা যায়। কমলা মৃত বোনের শরীরের ওপর শোকপ্রকাশ করেছিলো বন্যপ্রাণীর মতো। আস্তে আস্তে তার মধ্যে পরিবর্তন আসে। তার মনন, অনুভূতি, শরীরভঙ্গি কিছুটা মানুষের রূপ নিতে থাকে। প্রায় ষোলো বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে মারা যায় নেকড়ে-মায়ের বুকের পুঁটলি পশুমানবী, ‘মানবেতর’ কমলা।
= = =
ভানু কপিলের মূল কবিতার বঙ্গানুবাদঃ আর্যনীল মুখোপাধ্যায়
কমলা ও নেকড়ে-মায়ের ছবি রেভারেন্ড অমৃতলাল সিং-এর তোলাঃ সূত্র আন্তর্জাল
ভানু কপিলের চিত্রসূত্রঃ ব্যক্তিগত